ছায়া পর্ব-০৩

0
727

#ছায়া_৩য়_পর্ব
#Misk_Al_Maruf

সিয়াম বুঝতে পারে না দুই ভাইয়ের এই বিষের বোতল নিয়ে কিসের এতো ভয়? তবে কি লায়লা বেগমকে বিষ দিয়ে মারার সাথে ওদের কোনো যোগসূত্র রয়েছে? হিমেলের সন্দেহ টাই কি তবে ঠিক?
এসব ভাবনার মাঝে আচমকাই জামাল দ্রুত কামালের কাছে এসে বলে,
“কিরে তোরে না কইছিলাম বিষের বোতল টা জায়গা মতো লুকাইয়া রাখতে? তা না কইরা তুই এই লোকের হাতে বিষের বোতল দিছোস ক্যান? আর উনি কেডা? ওনারেতো চিনলাম না।”
বড় ভাইয়ের এমন হঠাৎ প্রশ্নে কামাল কিছুটা চমকে ওঠে। পরক্ষণেই ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বলে,
“না ভাইজান আসলে উনি হইলো হিমেলের ছোট কালের বন্ধু, আমাগো বাসায় আইছিলো পরিচিত হইতে। বিষের বোতল টা তাকের উপর দেইখা একটু নিতে চাইলো। হিমেলগো বাসায় নাকি ইন্দুর ভরা তাই বিষ দিয়া উনি ইন্দুর মারার জন্যই বোতল টা চাইছে।”
ছোট ভাইয়ের এমন কথা শুনে জামাল বেশ উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
“তাই বইলা তুই আমারে না জিগাইয়া যারে তারে বিষের বোতল দিয়া দিবি?”
বড় ভাইয়ের এই প্রশ্নে কামাল কিছু একটা বলতে যেয়েও আর বললো না বরং চুপ করে স্থির হয়ে ঠায় স্বস্থানেই দাঁড়িয়ে রইলো। সামান্য বিষের বোতল নিয়ে জামালের এমন উৎকন্ঠা দেখে সিয়াম আর চুপ থাকতে পারলো না উল্টো আগুনে ঘি ঢেলে জামালকে জিজ্ঞেস করে,
“আচ্ছা ভাই, এই সামান্য বিষের বোতলের জন্য আপনি ওনার সাথে এমন ব্যবহার করছেন কেন? এই বিষের বোতলের মধ্যে কি আলাদিনের জিন বাস করে নাকি এই বিষ দিয়ে কাউকে খুন করেছেন?”
সিয়ামের এমন কথা শুনে মুহূর্তেই বাজ পরার মতো চমকে উঠলো জামাল। সিয়াম বেশ নিখুঁতভাবে জামালের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করছে। একজন চোর ধরা পরে যাওয়ার পর তার মুখখানা ঠিক যেমন দেখতে হয় জামালের মুখখানাও ঠিক তেমনি দেখতে মনে হচ্ছে ওর কাছে। পরমুহূর্তেই থতমত খেয়ে সে বলে ওঠে,
“মানে কি কইতে চান আপনে? এই বিষ আমি একটা কামের জন্য আনছি। কাউরে মাইরা আমার লাভ কি?”
“লাভ লস তো পরের বিষয়, এমনওতো হতে পারে যে হিমেলের মা’কে বিষ দিয়ে মারার জন্যই আপনি এই বিষ কিনে নিয়ে এসেছিলেন। তাই নাহ?”
এই কথা শোনার পর মুহূর্তেই দুই ভাইয়ের মুখ-মন্ডলে এক রক্তিম আভা ছেঁয়ে যায় এবং কপালের চিক চিক করা ঘামের আস্তরণ গুলো আস্তে আস্তে বৃহৎ অণুতে পরিণত হয়ে টপ টপ করে বেয়ে পরে। সিয়াম বুঝতে পারে সে ভুল জায়গাতে পা ফেলেনি বরং জায়গা মতোই ঢিলটা মেরেছে।
জামাল এবার বেশ উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
“ঐ মিয়া আপনে এইসব কি কন? আমরা ক্যান আমাগো চাচিরে বিষ দিয়া মারতে যামু? আমাগো জায়গাজমি নিয়া ঝগড়া হইলো হিমেলের লগে তাইলে চাচিরে মাইরা আমাগো লাভ কী? চাচিতো আরো হিমেলরে কইছিলো আমাগো দাবি করা জায়গা জমি আমগো কাছে দিয়া যেন মিলমিশ হইয়া যায়। তাইলে তারে মাইরা আমাগো কোনো কাম আছে? আর আপনে এইসব কথা জিগাইতাছেন কির লাইগ্যা? আপনে কি পুলিশের লোক নাকি?”
সিয়াম এবার মুখের কোণে কিছুটা হাসির রেখা টেনে বললো,
“হুম ঠিকই ধরেছেন। আমি একজন পুলিশের লোক। এখন জানতে চাইবেন এটার প্রমাণ কি? প্রমাণটা দুই দিন পরেই না হয় দেই। আজ তবে আসি, আপনাদের বাসায় কিন্তু আবারো আসবো, প্রস্তুতি নিয়ে থাকবেন, কেমন? আর হ্যাঁ বিষের বোতল টা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। এটা দিয়ে অনেক কিছু জানা বাকি আছে।”
এই বলেই চেয়ার থেকে উঠে সিয়াম হাঁটা ধরলো। এদিকে জামাল ও কামাল দুই ভাই অদ্ভুত নয়নে সিয়ামের চলার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মনে হচ্ছে অনেক বড় একটি বোঝা তাদের ঘাড়ের উপর থেকে সরে গেল কিন্তু সেটার ভারের রেশ এখনও কিছুটা রয়ে গেছে।

সন্ধ্যার এ-ই সময়টাতে বহুবছর পর গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটছে সিয়াম। দক্ষিণা বাতাসটা বারবার তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে সীমিত সময়ের জন্য। তার মন খুব করে চাচ্ছে জীবনের বাকিটা সময় শহরের সেই ব্যস্ত কোলাহলকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গ্রামেই থেকে যেতে। কিন্তু তা চাইলেও কখনোই সম্ভব নয় কেননা সে তো আর ভবঘুরে ছেলেদের মতো বিন্দাস নয় যে যা ইচ্ছা হবে তাই করবে। আজ সে দায়িত্বশীল নামক এক শিকলে আবদ্ধ, তার আছে একজন ভালোবাসার মানুষ যে প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ঐ কপালখানিতে চুমু এঁকে দেয়। মেয়েটির নামটাও যেমন মিষ্টি দেখতেও ততটাই মায়াবী। প্রতিদিনই যেন সে নতুন করে তার অর্ধাঙ্গিনীর প্রেমে পরে।
এসব ভাবতে ভাবতে অজান্তেই সিয়ামের মুখে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কখন যে সে হিমেলের বাড়িতে চলে এসেছে সেদিকে যেন তার খেয়ালই নেই।

হিমেল আর সিয়াম বসে আছে পাশাপাশি, কারো মুখেই কোনো কথা নেই। হঠাৎই সিয়াম বলে উঠলো,
“আচ্ছা সামান্য একটুখানি জায়গাজমির জন্য সম্পর্ক খারাপ করার কোনো মানে হয়? তোর চাচাতো ভাইরা যেই জমিটুকু দাবি করছে সেটুকু দিয়ে দিলেইতো পারিস, শুধু শুধু ঝামেলা বাড়ানোর কি দরকার বলতো?”
হিমেল কিছুটা ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বললো,
“দোস্ত, আমি আর আম্মা ওদের জমিটা একেবারে দিয়ে দিতেই চাইছিলাম কিন্তু সাথীর জামাই আমাকে বললো ওর বাপে আদিম কালে কিনছিলো মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়া আর সেসময় কোনো দলিলও ছিল না ভালোমতো। আর এখন সেই জমির দাম পাঁচ লাখ টাকা! তাই আমি ওনার কথামতো নতুনভাবে আবার দলিল করি। বিশ্বাস কর আমি দলিলটা জীবনেও করতাম না যদি না উনি আমারে ভুলভাল বুঝাইয়া মগজ ধোলাই না করতো। তুই যদি বলিস তাইলে আমি কালকেই সবুজ ভাইরে বুঝাইয়া ওদেরকে জায়গা জমি বুঝাইয়া দিমু।”
সিয়াম কিছুটা সন্দেহচক্ষু নিয়ে বললো,
“ওনাকে আবার বুঝাতে হবে কেন?”
“না মানে দলিল করার সময় ওনার নামেও অর্ধেক জমির ভাগ দিছিলাম”
এই বলেই হিমেল মাথা নিচু করে ফেললো। সিয়ামের বুঝতে বাকি থাকে না সে তার বন্ধুকে যতটাই চালাক মনে করেছিল হিমেল ততটাই বোকা একটি ছেলে। তবুও সে হিমেলকে এব্যাপারে আর কিছু না বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। পরক্ষণেই সিয়াম বলে ওঠে,
“আচ্ছা সুমির সাথে দেখা করতে তুই থানায় গিয়েছিলি?”
“হুম বিকালে গেছিলাম কিন্তু সুমি আমার সাথে একটা কথাও কয় নায়। ঐদিন ওরে কয়েকটা কঠিন কথা কইছিলাম এই কারণে ও আমার উপর থিকা বিশ্বাস হারাইয়া ফালাইছে। আমার দিকে একবার তাকাইলোও না।”
এই বলেই হিমেল কিছুটা ইমোশনাল হয়ে যায়।
“এটা স্বাভাবিক। ঐদিন সুমির সাথে তোর এভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি।”
“এখন কিছু করার নাই। শুনলাম কালকেই নাকি ওরে আদালতে উঠাইবো এর আগে তুই কিছু একটা কর ভাই।”
সিয়াম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“চেষ্টাতো করেই যাচ্ছি কিন্তু এখনও পর্যন্ত সামান্য কোনো ক্লুও খুঁজে বের করতে পারিনি। আমার মনে হয় না জামাল ও কামাল এসবের সাথে জড়িত কারণ ওদের সাথে আন্টির কোনো শত্রুতা নেই, যা ঝামেলা তা তো তোর সাথেই। আর আন্টিকে বিষ দেওয়ারও কোনো উদ্দেশ্য নেই ওদের।”
“তাইলে তুই কইতে চাস সুমিই কি আম্মারে বিষ দিছে?”
“বুঝতে পারতেছি না কিছু। আর এইখানে অন্য কেউ বিষ দেওয়ার প্রমাণ স্বরূপ কোনো কিছুই আমার কাছে নাই। ফরেনসিক রিপোর্টগুলাও পুলিশের হাতে। এখন আমি চাইলেও অন্য কোথাও থেকে এসে এই থানায় পুলিশদের কাছে গিয়ে তদারকি করতে পারবো না। এটা একদিকে যেমন নিয়ম বহির্ভূত অপরদিকে তারাও আমাকে কোনো সুযোগ দিবে না।”
সিয়ামের কথাগুলো শুনে মুহূর্তেই হিমেলের চোখদ্বয় রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। সে এতক্ষণে বুঝে গিয়েছে তার বন্ধু সিয়াম সুদূর ঢাকা থেকে এসেছিল শুধুমাত্র তাকে ব্যর্থ সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই। সে কখনোই তার স্ত্রীকে মায়ের মিথ্যা খুনের অভিযোগ থেকে রেহাই দিতে পারবে না। সে শুধু নামেই একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা কাজের বেলায় কিছুই নয়। সুমিকে বাঁচানোর শেষ সম্বলটুকুও বোধহয় আজ তবে ফিকে হয়ে গেল।

রাত দুইটার কিছুটা বেশি,
সিয়াম এখনো নিজের দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। পারবেই বা কেমন করে? সে তার বন্ধুর মনে যেই আশাটা জুগিয়ে দীর্ঘ দশবছর পর এই গ্রামে এসেছিলো সেটার কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো সে হিমেলের কাছে আরো কিছুটা ছোট হয়ে গেল। সিয়ামের কাছ থেকে হিমেল সেই সময়ে কথাগুলো শুনে কিছু না বলেই হুট করে চলে যাওয়ার কারণটাও সিয়ামের অজানা নয়।
অনেক চেষ্টা করেও যখন নিজের দুচোখের পাতা এক করতে পারছিল না সিয়াম তখন সে রুম থেকে বাহিরের বেলকনিতে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। বহুদিন সে গ্রামের সেই আকাশগঙ্গার তারকারাজির দেখা পায়নি। আজ সে মনের মতো প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে চায়।
রুম থেকে বের হয়ে যখনি সে বেলকনির দিকে এগোবে তখন হঠাৎই সে ডান পাশের রুমটিতে মিট মিট আলোর প্রকোপ এবং হালকা নাড়াচাড়ার শব্দ শুনতে পায়। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে কেউ বোধহয় স্টিলের ট্রাঙ্ক খোলার চেষ্টা করছে। হিমেলের কাছ থেকে সিয়াম শুনেছিলো এটা ওর মায়ের রুম এবং এই রুমেই তিনি বিষক্রিয়ায় খুন হয়েছিলেন। কিন্তু এতো রাতে কেইবা ওনার রুমে ট্রাঙ্ক নিয়ে গুতাগুতি করবে?
অজস্র কৌতূহল এবং সন্দেহকে পুঁজি করে ধীরপায়ে সিয়াম হিমেলের মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। দরজার কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ সিয়ামের পায়ের সাথে কিছু একটি বারি খেয়ে সামান্য শব্দ হতেই আলোর উৎসে থাকা অবয়বটি মুহূর্তেই নিশ্চুপ হয়ে যায় এবং সাথে থাকা লাইট টাও নিভিয়ে দেয়। লাইট নিভিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে পুরো ঘরে এক নিকষ কালো অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়। সিয়াম কিছুটা ভয় পেয়ে আচমকাই বলে ওঠে,
“কে ওখানে?”
কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসে না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবারো সিয়াম জিজ্ঞেস করে,
“কে এখানে? এতো রাতে এই রুমে কি কর…”
কথা শেষ করার আগেই অন্ধকারে মিলিয়ে থাকা লোকটি দৌড়ে এসে সিয়ামের মাথা বরাবর ভারি কিছু একটা দিয়ে প্রকাণ্ড বেগে আঘাত করে। সাথে সাথেই মেঝেতে লুটিয়ে পরে সিয়াম। কিন্তু অজ্ঞান হবার আগে চিৎকার দিতে ভুলে না সে। কারণ এই চিৎকারের মধ্যেইতো আসল খুনির পরিচয় নিহিত…
.
[To be continued]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে