চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে পর্ব ৫৫
লেখা আশিকা জামান
গলগল করে বমি করে অনন্যার দিশোহারা অবস্থা। অঙ্কনের সাহায্যে নিজেকে পরিষ্কার করে নিয়ে সরু চোখে তাকায় সে। কেমন যেন অসুস্থ অসুস্থ লাগছিলো তবে মাতলামো কমলো বলে মনে হচ্ছেনা।
ওয়াশরুমেই অঙ্কনের গলা জড়িয়ে ধরতে যায় আবার।
অঙ্কন সরে দাঁড়ায়। গলাটা নরম করে বললো,
” লক্ষীটি তুমি রুমে যাও। আমার শার্টে বমি লেগে গেছে পরিষ্কার করে আসতেছি।”
অনন্যা লালচে চোখে তাকায়। বিড়বিড় করে বলে,
” তুমি বমি করেছো! কেন করেছো? কেন করলে এমন!” হুট করে কান্না শুরু করে দেয়।
অঙ্কন হতবিহ্বল তাতে কী অনন্যার হাত তখন তার কলার অব্দি ঘুরছে। মুহুর্তেই এত জোর কোথা থেকে আসলো অঙ্কন বুঝতে পারছেনা। শার্টের কলার খাঁমচে ধরে ঝুঁকাতে লাগলো।
” আর ইউ প্রেগন্যান্ট! কেন করলে এটা! ”
” হোয়াট?” অঙ্কন লাফিয়ে উঠলো।
” বলো কার বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরছো। কেন করলে আমার সাথে।” নির্বিকার অনন্যা ওয়াশরুমের মেঝেতে বসে পড়লো।
অতি দুঃখেও অঙ্কনের হাসি পাচ্ছে। দু’হাত দিয়ে অনন্যাকে মেঝে থেকে তুলতে তুলতে বলল।
” ছেলেরা কখনো প্রেগন্যান্ট হয়না সোনা। ভুলভাল বলো কেন। যাও একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো ভালো লাগবে। এসো এসো।”
অনন্যা উঠছেই না। অঙ্কন নিজের শার্ট খুলে ফেলল। এরপর অনন্যাকে কোলে তুলে নেয়।
অনন্যা বিড়বিড় করছে অঙ্কন মাথা ঝুঁকিয়ে আনে।
আমি তুমি,তুমি আমি
দিনভর পাগলামি
দুপুরের আলসেমি
খানিকটা বাদরামি
এভাবেই কেটে যায়।
বিছানার গালিচায়
চাদরে ঢেকে মুখ
খুজে পাই যত সুখ।
তুমি আমি রাতভর
চুমি চুমি মাঝরাতে
ফাজলামি আধেকটা
মাতলামি শিহরিত
শাসনে এভাবেই
কত রাত ছুয়ে ঠোঁট
ছুয়ে হাত কেটে যায়
তুমি জানো আমি জানি
ভালোবাসি কত খানি।
অঙ্কন বিস্মিত মাতলামো করেও কেউ এমন সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতে পারে কীনা ওর জানা নেই। তার একটু পরেই সে অঙ্কনের বুকে ঢলে পড়ে।
” কাল তো চলেই যাবে পাগলি। আজ রাতে এমন মাতলামো না করলে তোমার চলছিলই না। যাই হোক মনে থাকবে। ”
অঙ্কন শব্দ করে অনন্যার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।
★★★★
সকালবেলা পত্রিকার পাতা হাতে নিয়ে বিনোদনের পাতা উল্টাতেই আহনাফ সাহবের মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড় হলো।
চেঁচামেচিঁতে আয়েশাও এসে হাজির।
” তোমার মেয়ে মানসম্মান ডুবানোর আর বাকি রাখেনি। দেখ!”
সে কাগজটা আয়েশার দিকে ছুঁড়ে মারে। হাতে নিতেই চক্ষু চড়কগাছ। মেয়ে আহ্লাদী চোখে অঙ্কনের গলা জড়িয়ে ধরে কোলে উঠেছে। বড়বড় করে লেখা ‘শ্যুটিং এর পাশাপাশি সমানতালে চলছে মধুচন্দ্রিমা।’
উনি আরও কয়েকবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। নাহ্ এবার আর মেনে নেওয়া যাচ্ছেনা। এরপর আত্নীয় স্বজনদের মধ্যে কয়েকজন যখন ফোন করে বললেন,
” বিয়ের আগেই মেয়েকে কী করে তারা হানিমুনে পাঠালেন!” এই প্রশ্নের কোন উত্তর তারা দিতে পারলেন না। নিজেদের মধ্যে চেঁচামেচিঁ করে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দুইজন দুইমুখ হয়ে বসে থাকলেন।
★★★★★
খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গে অনন্যার। অঙ্কন দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। খুব মায়াময় লাগছে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাল রাতের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় চেলসিয়ার বলা কথাটা,
” এই হ্যাভ নো ড্রেস সেন্স! এইরকম ক্ষ্যাত হয়ে কেউ পার্টিতে আসে। আফটার অল অঙ্কন চৌধুরী এতবড় একজন স্টার! তার প্রেস্টিজের কথাও চিন্তা করাটা উচিৎ এজ এ উড বি ওয়াইফ।” কথাটা বলেই চেলসিয়া হঠাৎ হেসে উঠলো।
অনন্যা বিব্রত চোখে তাকায়।
” ওহ্ সরি! হাসি পাচ্ছে। আসলে মিডিয়া পাড়ায় এইসব বিয়ে টিয়ে খুব একটা ম্যাটার করেনা। জাস্ট সাময়িক ইস্যু। সিরিয়াস্লি না নেওয়াটাই বেটার! আর অঙ্কনের বেলায় তো বুঝাই যাচ্ছে কয়েকদিন ফূর্তি টুর্তি করে….. ”
অনন্যা তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। চেলসিয়া থেমে যায় আবার বলে,
“নাহ্ আসলে অপ্রিয় হলেও সত্যি গোপনে কে কয়টা বিয়ে সেরে বসে আছে কে জানে! আর অঙ্কন তো….”
” শাট আপ! আপনার কাছ থেকে আর কিছু শোনার ধৈর্য্য আমার নাই। প্লিজ সরুন।”
” হ্যাঁ শিউর যাচ্ছি। আমি আপনাকে ভালোটাই বুঝাতে এসেছিলাম। পরে যখন পস্তাবেন কেঁদেও কূল পাবেন না।”
অনন্যার গলা শুকিয়ে আসছে। বড্ড তেষ্টা পাচ্ছে। চেলসিয়া ওয়েটারকে দেখিয়ে বলল,
” আপনার তেষ্টা পাচ্ছে জুসটা নিয়ে নিন স্পেশালি আপনার জন্য।”
অনন্যা সাত পাঁচ ভাবতে পারেনি। দিশোহারা লাগছিলো জুসের গ্লাসটা তুলে নেয় এরপর আরো কতগুলো নিয়েছে মনে পড়ছেনা। এরপরই পাগলামোগুলো মনে পড়ে যায়। এবার খুব কান্না পাচ্ছে।
এদিকে ফোন বেজে অঙ্কনের ঘুম ভাঙ্গার উপক্রম হয়। আড়মোড়া ভেঙ্গে তাকায়। ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলে,
” প্লিজ পিক আপ দ্যা ফোন!”
নিনিত ফোন করেছে। রেডি হতে হবে। চলে যেতে হবে নিজের গন্তব্যে।
” কী হলো! ফোনটা তুললে না। ইম্পোর্টেন্ট কল হতে পারে।” মধুর ঘুম বিদায় দিয়ে অনন্যার কোমড় জড়িয়ে ধরে।
” নিনিত ফোন করেছে। রেডি হতে হবে।”
” তো!” অঙ্কন ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
” তো! এখন ছাড়ো।” অনন্যার চোখেমুখে দ্বিধা আর সংশয়।
অঙ্কনের চারপাশটা বিষাদগ্রস্ত মেঘে ছেয়ে যায়। তবে বুঝতে না দিয়ে রহস্যময় হেসে বলল,
” তো! এখন তুমি তোমার এই প্রেগন্যান্ট হাজব্যান্ডকে ছেড়ে চলে যাবা। ”
অনন্যার হাসি পেল। খুব করে হাসি পেল।
” হাসছো কেন! যতরকমভাবে সন্দেহ করা যায় তার সমস্ত মাত্রাজ্ঞান তুমি কাল ছাড়িয়ে গেছো। এবার দাঁত বের করে হাসছো।”
” আচ্ছা, অনেক হয়েছে এবার ছাড়ো।”।
” তোমার প্রেগন্যান্ট হাজব্যান্ড যাওয়ার আগে অবশ্যই একটা সুইট কিস ডিজার্ভ করে। নাউ ইউর টার্ন। লেট্স স্টার্ট সুন্দরী। ”
অনন্যা মৃদু হেসে অঙ্কনের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দেয়।
মুহুর্তেই অঙ্কন আৎকে উঠে বলল,
” আমি বাচ্চা নই। বাচ্চার বাবা। এরকম বাবু কিস দিলে কি করে হবে। কিসসিটা একটু এডাল্ট করা যায়না।”
” তুমি কিছুই পাবেনা। যাও সরো।”
অনন্যা মুহুর্তেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠে অঙ্কনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তাতে সে দমে গেলনা বরংচ উঠে এসে অনন্যাকে জাপটে ধরে চুমু খেল । একটুপর সে সরে আসতে চাইলেও অনন্যা দু’হাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে। সরতে দেয়না। মিনিট খানিক পরেই অনন্যার ডুকরে কেঁদে উঠলো।
” খুব মিস করব লক্ষীসোনা। এভাবে কাঁদেনা। আমি তাকাতে পারছিনা৷ প্লিজ চোখ মুছো।”
প্রতিউত্তরে অনন্যা কেবল অঙ্কনকে জড়িয়ে ধরে থাকল৷ আর কোন স্বর গলা থেকে বের হলোনা।
★★★★
সকাল সাতটায় বাস৷ ওরা সকাল সকাল বাস স্ট্যান্ড পৌছে গেল।
বাস স্ট্যান্ড গিয়ে আরেকটা ধাক্কা। এতো বিশাল বরফের পাহাড়!!!! যেন একদম আকাশের সাথে লেগে আছে। এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে
আট ঘন্টার জার্নির কষ্টটা কারো মনেই থাকল না।
কাঠমুন্ডুতে এসে হোটেল মাউন্টেন পিস এ উঠলো। সন্ধ্যার দিকে কাঁচাবাজারে ঢুকে এটা সেটা কিনে নিলো।
বাদ গেলনা নেপালের ফুটবল সাইজের আপেল আর কমলা।
নেপালের ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো মো-মো। ভেজ মো-মো, চিকেন মো-মো, মাটন মো-মো। ওরা প্রথমে এক প্লেট নিয়ে টেস্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু হোটেলের লোকজন যেভাবে ঘাপুস ঘুপুস করে মজা করে খাচ্ছে তাই দুই প্লেট করে নিলো। অবশ্য বুদ্ধিটা তানভীরের ছিল। একটু পরেই সবার মুখ ইয়াককককক। যেন মুখটাই নষ্ট হয়ে গেলো। সবাই তীক্ষ্ণ চোখে তানভীরের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছু বলতেও পারছিলোনা। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে এতো লবন আর বেমজাদার খাবার তানভীর গপগপ করে গিলছিলো।
” কী মজা! তোদের মুখই খারাপ। কুত্তার পেটে কী আর ঘি হজম হয়।”
সাইমুন বেশ রেগে গেল কথাটায়।
একটুতেই একটা মারামারি লাগার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেল। শেষ মেয়েরা ধরে বেধে সামাল দেয়।
কাঠমুন্ডুতেও সিটি ট্যুর করার জন্য বাস আছে। কিন্তু প্রায় সব স্পটই মন্দির। তাই সিটি ট্যুর বাদ দিয়ে পরদিন ওরা ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেল নাগরকোট। ভাড়া ১৮০০ রুপি। ওখান থেকেই হিমালয় দেখা যায়। সরু রাস্তা দিয়ে পাহাড় বেয়ে বেয়ে উপড়ে উঠতে হয়। মনে ভয়ও হয়। গাড়ি একটু এদিক সেদিক হয়ে গেলে আর খুঁজেও পাওয়া যাবে না। ওখানে মেঘের উপর থাকে পাহাড়। মানে পাহাড়ের নিচের অংশ হলো মেঘের নিচে আর উপরের অংশ হলো মেঘের উপরে। আর হিমালয় তো আছেই।
নাগরকোট টাওয়ার নামে একটা জায়গা আছে ওখানে সবাই চলে গেল। উপরে একটা ছোট টাওয়ারের মতো আছে। ওটাতে দাড়িয়ে হিমালয় ভাল দেখা যায়।
এখান থেকে হিমালয়ের তিনটা চূড়া দেখা যায়। ভাবতেই অন্যরকম লাগছিলো সবার। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বগুলোর একটা নিজ চোখে দেখার আনন্দই আলাদা। দৃশ্যটা একদম ছবির মতো। ঠান্ডা ওখানেও খুব একটা নেই। তবে এভারেস্ট দেখতে যেতে হবে আরো ৩শ কি.মি. দূর।
অবশেষে ফেরার পালা।
পরদিন বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্ট রওয়ানা হয়ে যায়। নাড়ির টানে অস্থির হয়ে উঠেছিলো সবাই। এছাড়া কারো মন মানসিকতারও ঠিক নেই। কেমন যেন একটা গুমোট ছেঁড়া ছেঁড়া ভাব। পূর্বের সেই উচ্ছ্বাস আর আনন্দ অবশিষ্ট নেই। কেবল রয়েছে বিষাদের ছায়া।
বিমান ফ্লাই করার কথা ছিলো নেপাল টাইম ৩টা ১০ এ। নেপালের সাথে বাংলাদেশের সময় পার্থক্য ১৫ মিনিট। কিন্তু বিমান আসতেই দেরি করলো দেড় ঘন্টা। ছাড়তে লাগলো আরো আধা ঘন্টা। প্রায় পৌনে পাচঁটার দিকে রওয়ানা করে সন্ধ্যার মধ্যেই দেশে পৌছে গেল।
চলবে….