চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে পর্ব ৫৪

0
1361

চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে পর্ব ৫৪

আশিকা জামান

অঙ্কন রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। নিনিত দু’হাতে অনন্যাকে ধরে রেখেছে। তবে সামলাতে পারছেনা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে কয়েকটা কথা শুনাতে তবে এই মুহুর্তে শুনিয়েও লাভ নেই। রেড ভেলভেটের গাউনটা দু’হাতে টান টান করে ধরে হঠাৎ বাচ্চাদের মতো দুলছে অনন্যা। অঙ্কনের দিকে চোখ পড়ায় লাল টকটকে ঠোঁট কিঞ্চিৎ তীর্যকভাবে বাঁকিয়ে উড়ন্ত চুমু দেয়ার মুখভঙ্গি করল।
নিনিত চোখ বড়বড় করে অঙ্কনের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।
” এইবার নিজের বউকে নিজে সামলিয়ে আমাকে উদ্ধার করো ভাই!”
কতক্ষন বিড়বিড় করে গেলো কিন্তু যার উদ্দেশ্য বলা সে চাপা রাগে তখনও ফুলে আছে।

একটু আগেই চেলসিয়া আর রাইমার সুক্ষ্ম খোঁচাটা সে ভুলেনি।
” তোমার উড বি ওয়াইফ গলায় এইটা কী গরুর দড়ি ঝুলিয়ে এসেছে। হাউ রিডিউকিউলাস চেলস দেখ! ”
চেলসিয়া রাইমার কথা ধরে বলল,
” তুই অবাক হচ্ছিস কেন রাই! এইরকম গ্ল্যামার ওয়াল্ডের সাথে পরিচয় আছে নাকি! হয়তো আজই প্রথম এইধরনের ককটেল পার্টিতে।” চেলসিয়া শয়তানি হাসিতে মাতোয়ারা।

অনন্যার রেড ভেলভেট গাউনের একপাশে উড়না আর অপরপাশে বুকের উপর কয়েক গাছি চুল ছড়িয়ে আছে। আরেকটু আগেই তাকে হাসির খোঁরাক হতে হয়েছিল। আফটার অল এই পার্টির মেইন আকর্ষন অনন্যা। আর যাই হোক অঙ্কনের উড বি ওয়াইফকে আরেকটু খোলামেলা পোশাকে দেখার বাসনায় সবাই বসেছিলেন। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি।

মধুর সকালের পর থেকেই গোটা দিনটাই তার কাছে হেল মনে হচ্ছে। এই শনিটা লাগিয়েছে চেলসিয়া স্বয়ং। এটা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয়না। হোটেলের লবীতে চেলসিয়াকে দেখে কেমন কু গাইছিলো সেটাই হয়তো সত্যি হতে চলেছে। তার চমকানোর মাত্রা দ্বিগুন করে দিয়েছে ডিরেক্টর স্বয়ং।
” অঙ্কন, কাজের প্রেসারে একটা রিফ্রেসমেন্টের তো প্রয়োজন আছা নাকি! তুমি আমাকে মুখ ফুটে বলতেই পারতে! এভাবে উড়াল দিয়ে পোখরা না এসে, জানাতেও পারতে। আমাদের চিন্তা হয়। চিন্তিত হয়ে ফুল টিম নিয়ে চলে এসেছি শুধুমাত্র তোমার জন্য। বুঝতে পারছো তোমাকে কতোটা ভরসা করি। তোমার উড বি ওয়াইফ এখানে এটা জানার পর নিশ্চয়ই আটকাতাম না। আফটার এতোটাও আনরোমান্টিক নই আমি। ”
অঙ্কন আমতা-আমতা করে। কিছু বলতেও পারেনা। মানজুর আহসানের এত ভালুমানুষি পেটে হজম হতে চাইছিলোনা।
” রাতে পার্টি এরেঞ্জ করা হয়েছে তোমার আর তোমার উড বি ওয়াইফের অনারে! কেমন গুছিয়ে চলে এসো। লেট’স এনজয়।”
বিব্রত অঙ্কনের পিঠে চাপড় মেরে সে বলেছিলো।

নিনিত আশেপাশে তাকায়। সবাই নাচে গানে পার্টিতে মেতে উঠেছে। তবে তার চোখ ভীড়ের মাঝে খুঁজে চলেছে জ্বলন্ত একজোড়া চোখকে। সাইমুন একটার পর একটা স্যাম্পেইনের গ্লাস তুলে নিচ্ছে আর তার দিকে তীর্যকভাবে তাকিয়ে আছে। সে চোখ নামিয়ে নেয়। এরমাঝে হাতের বাধঁন আলগা হয়ে অনন্যা দৌড়ে অঙ্কনের কাছে ছুটে যায়।

অঙ্কন চোখ তুলে তাকায়। পুরোদস্তুর মাতাল অবস্থা।
” সবাই ডান্স করছে। আমিও কাপল ডান্স করব।” চোখে যেন শতজন্মের অনুনয়।

” নো। নো ওয়ে। হাত পা ভেঙ্গে সারাজীবন কোলে নিয়ে ঘুরার শখ নেই। চলো এখান থেকে।” অঙ্কন শক্ত হাতে অনন্যার বাহু চেপে ধরে।

” যাবনা! উফ্ কী সুন্দর পরিবেশ বেশ লাগছে যাবনা।” জড়ানো গলায় বলল।

” চলো বলছি! ” অঙ্কনের কন্ঠে রুক্ষতা।

” আচ্ছা ঠিকাছে। আগে চুমু খাব পরে যাব। ” অনন্যা মৃদু হাসছিলো।

” রুমে! এখানে না! তারপর দেখব তুমি কত চুমু খেতে পারো।”

অঙ্কনের শার্টের কলার টেনে ঠোঁট বাঁকিয়ে অনন্যা চুমু খেতে যায়। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সে মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়।
“বিহেভ ইউর সেল্ফ অনন্য!” অঙ্কন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে।
হঠাৎ অনন্যা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো। অঙ্কন বিস্ময়ে হতবাক। আশেপাশে মোটামুটি সকলের দৃষ্টি সেদিকে।
” জাস্ট চুমুইতো খেতে চেয়েছি। তুমি আমাকে বকছো কেন!”

চেলসিয়া এক কোণে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে সিনেমা দেখছে। বিড়বিড় করে বলে,
” এইবার লও ঠ্যালা।” ভেতরে ভেতরে এক পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে।

” অঙ্কন, দিয়ে দাও না। বেচারি বাচ্চা মেয়ে!” রাইমা ফোঁড়ন কাটে।

অঙ্কনের রাগে শরীর জ্বলে যায়। চেলসিয়া বলে উঠে,
” আহা! বকছো কেন! এমন জীনিস দেখে লোভ সামলাতে পারেনি।বকোনা। কয় পেগ খেয়েছে আল্লাহ জানে। ছেড়ে দাও। লেট’স এনজয়। এখন নিশ্চয় এমন আনকালচারাল মেয়ের জন্য গোটা পার্টিটাই নষ্ট করবেনা।”

অঙ্কন রাগে উত্তেজিত হয়ে বলল,
” আমি কী করতে পারি আর না পারি ইউ ক্যান’ট ইমাজিন।”।
অঙ্কন হঠাৎ পাজাকোলা করে অনন্যাকে নিয়ে গটগট করে বের হয়ে গেল।

চেলসিয়া সহ সকলেই বিস্মিত। কেবল মানজুর আহসান চেলসিয়ার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
” চেলস, আগুন নিয়ে খেলোনা ফল ভালো হবেনা।”
” আমি কী করব না করবনা তা তুমি আমাকে ঠিক করে দিতে পারোনা।” তার এইমুহূর্তে পার্টিতে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। গ্লাসটা রেখে হাই হিলে শব্দ তুলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।

অনন্যা সমান তালে হাত-পা ছুড়ছিলো। সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
” আমি রুমে যাব না! কেন নিয়ে আসলে! যাব না”
” প্লিজ শান্ত হও। কথা শোন। না হলে কিন্তু ভালো হবেনা। ” অঙ্কনের দিশোহারা অবস্থা।
” তুমি কি ভালো করলে। সবাই এনজয় করছে আর আমি!” কথাটা বলেই অনন্যা আবার কাঁন্না শুরু করলো।
” কান্না থামাও নাহলে সুইমিং পুলে ফেলে দিবো!”
কথাটা শোনামাত্র অনন্যা ঘাড় ঘুরায় সুইমিং পুলের নীলচে জলরাশির দিকে চোখ আটকে যায়। উচ্ছ্বাসিত গলায় বলে,
” আমি সুইমিং পুলে নামব। প্লিজ নামাও।” অস্থির হাত পা ছুড়াছুড়ি চলছিলো।

বিরক্ত হয়ে নিজের মাথার চুল নিজেরি ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। কেন যে সুইমিং পুলের কথা বলতে গেলো। দ্রুত হাটার গতি বাড়ায় রুমে ঢুকে যেন কিছুটা স্বস্তির দেখা মিলল। অন্তত হাটে হাড়ি ভাঙ্গার থেকে তো রেহাই পেল।

অনন্যা ফের অঙ্কনের গলা জড়িয়ে ধরলো।
” আমি আরও খাব। সবাই খাচ্ছেতো!”
” হ্যাঁ সবাই খাচ্ছে তোমার মতো মাতলামি তো কেউ করছেনা। সব মানসম্মান ডুবিয়ে এবার বলে আরও খাব। পেটে হজম হয়না খেতে কে বলেছে! আমি না করেছিলাম না। কেন খেয়েছো! আন্সার মি!” রুদ্ধশ্বাসে অঙ্কন গেয়ে উঠলো।

অনন্যা অঙ্কনকে ছেড়ে দিয়ে আবার কান্না শুরু করল।
” আমি খেতে চেয়েছি নাকি! বকছো কেন! ওরাইতো দিল। জুস খেলাম খাওয়ার পর আরও খেলাম। আরও খাব। প্লিজ দাও। এনে দাও।”

চেলসিয়া কিছু একটা করেছে এটা নিশ্চিত। উফ্ এবার না অসহ্য লাগছে।
” দিল আর তুমি খেয়ে নিলে। খুব ভালো করেছো৷ নাও এবার ইচ্ছেমতো পাগলামো করো আমি কিছুই বলবনা।”.

” তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসোনা! একটা কিস্সিও দাওনি। আনরোমান্টিক। তোমাকে কে হিরো বানিয়েছে! পঁচা ছেলে।”
অঙ্কন কিছু বললনা। চুপচাপ শুনে গেল।
” পঁচা ছেলে আমি বমি করব। বমি পাচ্ছে!”
অনন্যার গা গুলিয়ে উঠে। অঙ্কনের উপরেই বমি করে দেয়।

অঙ্কন ভীত সন্ত্রস্ত চোখে তাকায়। দু’হাতে আঁকড়ে ধরে অনন্যাকে। দ্রুত পা ফেলে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।

★★★★

ডক্টর মৌমিতা দেব চলে যাওয়ার পর থেকে আহনাফ বিমর্ষ মুখে বসে আছেন।
আয়েশা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে বিডি বাটার মাখতে মাখতে আড়চোখে তাকান।
” আহু সেই তখন থেকে দেখছি৷ কী হয়েছে তোমার? ”
আহনাফ কিছু বললেন না৷ আয়েশা আবার বলল,
” ভালো কথা! সেই সুন্দরী প্রফেসর কী বলে গেলেন আমিতো শুনতেই পারলাম না। কিচেনে ছিলাম! হ্যাঁ গো হুট করে আমাদের বাড়িতে আসলেন। মতলব ভালো ঠেঁকছেনা। ”
আহনাফ সাহেব রেগে গেলেন।
” তোমার হাত- পা এত ফর্সা কী করে হলো! আগের থেকে দ্বিগুন ফর্সা।”
” সত্যি! এত ফর্সা হয়ে গেছে। ” নিজের হাত পায়ে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিজেই মুগ্ধ হয়ে ফের বলল,
” আল্লাহ, এই লোশনটা বড় ভাই ইউ.এস. এ থেকে পাঠিয়েছে। আল্লাহ সত্যিই কাজ করেছে। আই লাভ ইট!”
আহনাফ রেগে গিয়েও মুখ বাঁকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন।
আয়েশা হঠাৎ তীর্যকভাবে তাকালেন।
” তুমি কিছু লুকাতে চাইছো। ওই ম্যাডাম তোমার কাছে কেন আসলো আমি কিন্তু বুঝতেছিনা।”
” তুমি যেন বোকা তেমনি তোমার বুদ্ধিগুলোও বোকা বোকা। উনি আমার কাছে নয় তোমার মেয়ের কাছে এসেছিলেন। মেয়ের কোন খুঁজ রাখো।”
” এতদিন জানতাম মেয়ে তোমার! আজ আমার হয়ে গেল। মেয়ে গেছে ট্যুরে! খুঁজ কি রাখবো।”

” হ্যাঁ সেটাই। তোমার মেয়ের ইউ এস এ যাওয়ার সব কনফার্ম কিন্তু আমরা জানিনা। সে এখন বড় হয়ে গেছে। এই খবরটা মৌমিতা ম্যামের কাছ থেকে জানতে হলো। তোমার মেয়ের এমন আচরণে সে নিজেও হতবিহ্বল। কোন খুঁজ পাচ্ছেনা তাই বাড়ি চলে এসেছে বুঝতে পারছো।”
আয়েশা নিজেও অবাক চোখে চেয়ে থাকল। মেয়ে এমন কাজ সচারাচর করে না। হঠাৎ কি হলো। এবার এই ট্যুরে যাওয়া নিয়েও সন্দেহ হচ্ছে।
চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে