গাঁইয়া_বউ।পর্ব_৪
#তিতিশ্মা_মুসাররাত_কুহু।
~আজ যদি আমার আম্মু আমাদের সাথে থাকতো কতই না ভালো লাগতো তাইনা নানা ভাই?আমরা আরো বেশি বেশি মজা করতে পারতাম তাইনা?
অনুর কথা শুনে অনুর নানা ভাই আর অনুর নানীমা চুপ হয়ে গেলেন,
আর অতল এক ভাবনার সাগরে হারিয়ে গেলেন!
দেখতে দেখতে কত গুলো বছর কেটে গেলো।আজ থেকে ছয় বছর আগে অনুর জন্ম হয়।
যেদিন অনুর জন্ম হবে সেদিন অনুর মা অর্না বার বার হসপিটালে বসেও বাইরের দিকে তাকাচ্ছিলো,
শুধু মাত্র একটা বার অপূর্ব আসে কিনা সেই অপেক্ষায়।
অথচ অপূর্ব আসেনা।
অপূর্বের না আছে ওর বউর প্রতি মায়া,না আছে ওর বাচ্চার প্রতি মায়া।
অর্নার ডেলিভারি পেইন উঠার সাথে সাথে ওকে হসপিটালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।
আর সেদিনই জন্ম হয় অনুর।
অতিরিক্ত চিন্তার ফলে অর্না অসুস্থ হয়ে পড়লেও কিছু ক্ষণ পর ও সুস্থ হয়ে উঠে।
কোলে তুলে নেয় ওর কলিজার টুকরা অনুকে।
অনুর মুখ দেখে সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যায় অর্না।
সবাই অনুকে পেয়ে খুশি।
অর্না ধীরে ধীরে অনুকে লালন পালন করতে থাকে।সাথে ওর মা বাবাও।
অনু বড় হতে থাকে।
আর অর্না এদিকে চালিয়ে যায় ওর পড়াশোনা।
ওর মা বাবার অনুরোধে ও এক্সাম দিতে থাকে।এস.এস.সি পাশ করে সবে মাত্র অর্না কলেজে ভর্তি হয়েছিলো।আর তখনি বিয়ে করে চলে যায় অপূর্বের সাথে শহরে।
কিন্তু যখন অপূর্ব ওর গর্ভের বাচ্চাটার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে।
ঠিক তখনই ও গ্রামে ফিরে এসে ওর মা বাবার কথায় নিজেও পড়াশোনা চালিয়ে যায় আর বাচ্চাদেরও পড়াতে থাকে।
পেটের মধ্যে বড় করে তুলে নিজের কলিজার টুকরা সন্তান কে।
অনুর জন্মের পর থেকে অর্নার পরিবার আর অনু খুব ভালো আছে।
অনুর দাদা দাদীও এসে অনুর খোঁজ খবর নেন।
অর্না এখন অনার্স ফাইনাল এক্সাম দিচ্ছে।
ইন্টার পাশ গ্রামে করলেও।
অনার্স টা ঢাকায় করতে হয় ওর।
এক্সামের সময় ঢাকায় গিয়ে এক্সাম দিয়ে আসে অর্না।
অর্না আজ নিজে পায়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্রামে একটা কোচিং সেন্টার খুলে নিয়েছে।
যেখানে গ্রামের ছেলে মেয়েরা পড়তে আসে ওর কাছে।
ওর মা বাবার সাপোর্টের ফলে ও এত দূর আসতে পেরেছে।
আবার নিজের উপর আস্থাও ছিলো যে আমি পারবো।আমাকে পারতেই হবে।
অন্তত মেয়েটার ভবিষ্যৎ এর জন্য হলেও আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
অনুর ডাকে অনুর নানা নানুর ধ্যান ভাঙে।
~ও নানীমা,আম্মু কবে আসবে?আম্মুর পরীক্ষা কি এখনো শেষ হয়নি?
~এইতো নানু ভাই আর একটাই আছে।এরপর তোমার আম্মু তোমার কাছে ফিরে আসবে।
অর্নার মা বাবা অর্নাকে আর বিয়ের জন্য জোর করেনি।কেননা তাদের পছন্দে বিয়ে করেই আজ তাদের মেয়ের এই অবস্থা।
যদি কখনো মেয়ে নিজ ইচ্ছেয় বিয়ে করে তবে করবে।
নয়তো তারা আর কিছু বলবেন না।
দুদিন পর সকালে অনু ঘুমিয়ে আছে।
আর হঠাৎ করেই অনুর চিৎকার।
চিৎকার শোনেই অনুর নানা নানু দৌড়ে রুমে যান,গিয়ে দেখেন অনু অর্নাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
খুশিতে চিল্লাচ্ছে দুরন্ত অনু।
~আম্মু এসেছে আম্মু এসেছে।
~কিরে তুই কখন এলি?
~এইতো চুপি চুপি চলে এলাম সারপ্রাইজ দিতে।
~ভালো করেছিস।এক্সাম কেমন হলো?
~হয়েছে আব্বু আলহামদুলিল্লাহ্।
~শেষ এক্সাম?
~হ্যাঁ শেষ।
~আর কোথাও যাবেনা তুমি আমাদের ছেড়ে আম্মু।
~উঁহু একটুও যাবোনা।
~জানো আমরা এ কয়দিন কত মজা করেছি।তুমি থাকলে আরো কতই না মজা হতো।
~এইতো আম্মু আমি এসে গেছি,এখন থেকে আমরা সবাই মিলে এক সাথে মজা করবো।ঠিকাছে?
~আচ্ছা ঠিকাছে।
যা এবার মা মেয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।
আমি খাবার দিচ্ছি।
সবাই ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে বসে।
~তারপর?এখন কি করবি ভেবেছিস?
~এইতো বাবা,কয়েকটা অফিসে সিভি জমা দিয়ে রেখেছি।দেখি কি হয়।বলেছে হলে ফোন করবে।
আর রেজাল্ট দিলে আবার ভর্তি হবো,পড়ালেখাটা শেষ করবো।
আর যে পর্যন্ত জব না হয়,এই কোচিং সেন্টারতো আছেই।
~জব টব না করলে হয়নারে মা?এখানেই তো আমরা ভালো আছি সবাই মিলে।
~না মা,আমি আমার মেয়েকে শহরে নিয়ে যাবো।আর সাথে তোমরাও যাবে।
আমার মেয়ের কপালে আমি গাঁইয়া নামক দাগ টা লাগতে দেবোনা।যেই জন্য আমার জীবন টা ধ্বংস হয়ে গেছে।
আমি আমার মেয়ের জীবন টা ধ্বংস হতে দেবোনা।
আর মিঃ অপূর্ব কে বুঝিয়ে দেবো।গাঁইয়ারাও মানুষ।গাঁইয়ারাও সেই সব পারে,যা শহুরেরা পারে।
~আচ্ছা এবার,বাদ দাও তো অর্নার মা।মেয়েটাকে খেতে দাও।
খাওয়া দাওয়া শেষে অর্না বলে আজকের রান্নাটা আমি করবো।
অনুর নানা নানু অনুকে নিয়ে স্কুলে চলে যান।
আর অর্না এদিকে রান্না করে।
অনুকে নিয়ে অনুর নানা নানু বাসায় ফিরলে সবাই গোসল করে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে।
বিকেলে সবাই মিলে ঘুরতে বের হয়।
সবাই অনেক আনন্দ করে।
মজা করে,
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসে সবাই।
খাওয়াদাওয়া শেষে গল্প করে সবাই ঘুমিয়ে পরে।
পরের দিন সকালে হঠাৎ অর্নার মোবাইলে ফোন আসে।
অর্না ফোন হাতে নিতেই দেখে অয়ন ভাইয়ার কল।
~হ্যালো অয়ন ভাইয়া।
~হ্যাঁ কেমন আছো?
~এইতো ভালো আছি।এত সকালে কি মনে করে?
~তুমি এক্সাম দিয়ে বাসায় চলে গেলে অথচ আমাকে একটু বলেও গেলে না।
~সরি অয়ন ভাইয়া,আসলে মেয়েটার জন্য মনটা খুব খারাপ লাগছিলো।তাই কাউকেই তেমন জানানো হয়নি।
~ঠিকাছে শোনো তুমি না জব খুজছিলে?আমি আজ থেকে আমার বাবার অফিস দেখা শোনা করবো।বাবা আমার উপর দায়িত্ব দিয়েছেন।তুমি যদি চাও এখানে জয়েন করতে পারো।তোমার সিভিটা আমাকে পাঠিয়ে দিও।
~আচ্ছা অয়ন ভাইয়া অসংখ্য ধন্যবাদ।
~এত ভাইয়া ভাইয়া করতে হবেনাতো।
এ আর এমন কি ই বা করছি আমি তোমার জন্য।
তুমিতো আমার পুরো জীবন টাই বদলে দিয়েছো।
~আরে না,কি যে বলেন না।
~আচ্ছা তুমি তাহলে তোমার সিভি টা পাঠিয়ে দিও কেমন?
~আচ্ছা ঠিকাছে।
~রাখি তবে আল্লাহ্ হাফেজ!
~আল্লাহ্ হাফেজ!
অয়ন হচ্ছে অর্নার সিনিয়র।
অর্না অনার্সে পড়ে আর অয়ন মাস্টার্সে পড়তো।
হঠাৎ একদিন অর্না দেখে কলেজ মাঠের এক কোনায় একটা ছেলে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।
তখনি সবাইকে ডেকে তাড়াহুড়ো করে তাকে হসপিটালে নিয়ে যায় অর্না।
পরে ডাক্তার বলেন,অতিরিক্ত মদ্যপানে এই অবস্থা হয়েছে তার।উনাকে বাঁচাতে হলে এই নেশার জগত থেকে তাকে বের করে নিয়ে আসতে হবে।
পরে সবার কাছ থেকে অর্না শুনতে পায় ছেলেটার নাম অয়ন।
ছেলেটা খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলো।কিন্তু একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে অনেকটা গোল্লায় যেতে থাকে এই অয়ন।
ধনীর ছেলে এই অয়ন।খুব ভালবাসতো লাকী নামের একটা মেয়েকে।কিন্তু পরে জানতে পারে লাকী একাধিক রিলেশনে জড়িত।যেটা অয়ন মানতে পারেনি।
একদিন শোনে লাকী এক ছেলের সাথে কোথায় যেন ধরা পড়েছে।আর সেখানেই ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়।এর পর থেকে অয়ন পুরোপুরি নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।
অর্না শপথ করে যেভাবেই হোক অয়নকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনবে।
অর্না অয়নকে ওর জীবনের কাহিনী বলে,
আর বলে,
~দেখুন এরপরও আমি ভেঙে পড়িনি।আবার উঠে দাঁড়িয়েছি।আর আপনি কিনা এভাবে ভেঙে যাবেন?
আমার থেকে কি আপনার কষ্ট বেশি?
একটা বার ভাবুন।
এভাবে ধীরে ধীরে অর্না অয়নকে বোঝাতে থাকে,আর অয়ন বুঝতে সক্ষম হয়।
ফিরে আসে নতুন জীবনে।ত্যাগ করে নেশার জগত।
মাস্টার্স পাশ করে।
এখন আবার বাবার অফিসও দেখাশোনা করবে।
ফিরে পায় নতুন একটা জীবন।
ওই ঘটনার পর থেকে অর্না আর অয়নের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়।
অয়ন অর্নার মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নেয়।
পড়াশোনা কেমন চলছে,বাবা মা মেয়ে কেমন আছে খোঁজ নেয়।
অর্না অয়নকে সিভি পাঠিয়ে দেয়।
তারপর অয়ন একদিন অর্নাকে ফোন দিয়ে বলে তোমার জব কনফার্ম।
তুমি এবার জয়েন করতে পারো।
অর্না অর্নার বাবা মাকে সু খবর টা জানায়।
আর সবাই মিলে শহরের পথে রওনা দেয়,
নতুন জীবনের সন্ধানে।
অনুর জীবন গড়তে।
আর ওই দিকে অয়ন অপেক্ষায় আছে অর্নাকে স্বাগতম জানাতে।
চলবে…