গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-৩৯ এবং শেষ পর্ব

0
489

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৯.

আজ আষাঢ় মাসের আঠারো তারিখ। তনয়ার জন্মদিন। এই প্রথমবার তার নিজের জন্মদিন একেবারেই মনে ছিল না। সকালে মা বাবা ফোন করে উইশ করায় মনে পড়েছে৷ তারপর ফেসবুকে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের শুভেচ্ছা পাওয়া গেছে। কিন্তু সবাইকে ধন্যবাদ জানানোর সময়টা পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা বড় দুষ্টু হয়েছে। মাকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দিতে চায় না। অবশ্য বাবা বাসায় থাকলে ভিন্ন কথা। তখন বাবাই তার সব। ক্ষুধা ছাড়া তখন মা চেনে না।

মেয়ে এখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তনয়া জিজ্ঞেস করল, “কিরে, কী দেখিস?”

মেয়ে হাসল। মাড়ি বের করা মিষ্টি হাসি। ওর হাজারটা নাম রাখা হয়েছে। কোনোটাই ফাইনাল নয়। ওরা গুল্টু, মিষ্টু, দুষ্টু এসব বলে চালিয়ে দিচ্ছে।

তনয়া জিজ্ঞেস করল, “আমাকে হ্যাপি বাড্ডে বলবি না?”

আবারও হাসি।

“তোর বাবাকে আজকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখব। আমার জন্মদিন ভুলে গেছে।”

মেয়ের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। তনয়া ভাবল, ও কি সত্যিই বুঝতে পারল সে কি বলছে? মেয়ে তো বাবা পাগল পুরো! দেখতেও বাবার মাতো। বেশি হাসলে নাক কুঁচকে যায় যখন, তখন বোঝা যায় বাবার হাসিটা কার্বন দিয়ে কপি করে এর ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন বোধহয় বাবার বিপদ বুঝে চুপ করে গেছে।

তনয়া আবারও বলল, “বাবাকে বলবি না কিন্তু কিছু। আজকে ওর খবর করে ছাড়ব!”

মেয়ে চোখ কটমট করে তাকাল। তনয়া ভারি অবাক হলো। এ তো দেখি সব বোঝে!

সে মোবাইলের টুং শব্দ পেয়ে চোখ সরাল। ওর এক কাজিন ফ্যামিলি গ্রুপে মেসেজ পাঠিয়েছে, “রূপা আপু, তুমি আমাকে স্বরূপ ভাইয়ার মতো একটা বর খুঁজে দেবে। না হলে আড়ি!”

তনয়ার ভুরু ওপরে উঠে গেল। বাবা! ওনার স্বরূপ ভাইয়া এমন কোন মহান কাজটি করলেন?

অন্য একজন লিখেছে, “হ্যাঁ লেখাটা কত রোমান্টিক! আমি দুবার পড়লাম।”

লেখা? তনয়ার কপালে ভাজ পড়ল। কোন লেখার কথা বলছে এরা? সে কৌতুহল নিয়ে ফেসবুকে ঢুকে দেখল স্বরূপের একাউন্ট থেকে লম্বা একটা লেখা পোস্ট হয়েছে। তনয়া পড়ল। একবার, দুবার, তিনবার… প্রতিবারই কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল তার। মেয়ে প্রথমে অবাক হয়ে ভাবছিল মায়ের আবার কী হলো? কাঁদে কেন? একটু পরে সে নিজেও কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু পুনরায় অবাক হয়ে কান্না থামিয়ে দিল। কারন মা তার কান্না থামানোর কোনো চেষ্টাই করছে না৷ হয়েছেটা কী?

*

স্বরূপ লিখেছে-

আমি সম্প্রতি বাবা হয়েছি। সবাই জানে আমার একটা বাচ্চা। কিন্তু আসলে আমার বাচ্চা হয়েছে দুটো। একটা ছোট্ট, মাত্র চার মাস বয়সী। আরেকজন আজ ছাব্বিশে পা দিল।

প্রতিদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরে দেখি দুই বাচ্চা ঝগড়া করে একে অপরের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। আমি গেলে দু’জন একত্রে নালিশ জানায়। একজন ট্যাঁ ট্যাঁ করে বলতে থাকে মা তাকে কত বিরক্ত করেছে। জোর করে গোসল করিয়েছে, ঘুমাতে চায়নি তবুও ঘুম পাড়িয়েছে, চোখ গরম দেখিছে। আর বড় বাচ্চা কাঁদো কাঁদো হয়ে জানায় ছোটোটা তাকে কত জ্বালিয়েছে। খেতে দেয়নি, খাবার সময় পটি করে বসে থেকেছে, দুপুরে একফোঁটা ঘুমায়নি, সন্ধ্যায় অযথা কেঁদে কান ঝালাপালা করে দিয়েছে, ইত্যাদি।

তখন আমি দু’জনকে একত্রে সামলাই। ছোটজন আমার কোলে এলেই খুশি। বড়জনকে কোলে নেয়া সম্ভব না, তাই তার জন্য রোজ একটা করে ক্যাডবেরি নিতে হয়। তাতে ছোটোজনের লোভ এখনো লাগেনি, আর ক’দিন পর লাগবে। তখন খরচ বাড়বে। দুটো চকলেট কিনতে হবে।

ছোটোজন আমার কোলে আসার আধঘন্টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। আমার কোল খুব আরামের কি না! তখন বড়জন খাবার বেড়ে দেয়, আমরা আরামে খাওয়াদাওয়া করি।

এরপর বড়জন তেল আর চিরুনি নিয়ে এসে হাজির হয়। তার চুলে তেল দিয়ে বেনী করে দিতে হবে। সে সারাদিনে সময় পায়নি। সত্যিই তো। দুষ্টু পাখিটা মাকে নিজের কাজ করতে দেয় না। কতদিন তো গোসলও করতে পারে না বড়জন। আমার মায়া হয়। আমি সুন্দর করে চুল বেঁধে নেই। সে খুশি হয়ে আমাকে পারিশ্রমিক হিসেবে একটা চুমু দিয়ে যায়।

দুষ্টু পাখি খুব রাত জাগে। একটু পরপর সে হিসু করে তার ডায়পার ভেজায়, তারপর এক পেট ক্ষুধা নিয়ে বিকট চিৎকার দেয়। আমরা যখন নতুন বাবা মা হয়েছি, তখন ভয় পেয়ে যেতাম। এখন সামান্য পুরাতন হয়েছি বলে ওর চিৎকারে অভ্যাস হয়ে গেছে।

ওর মা তখন ওকে খাওয়ায়, হেঁটে হেঁটে ঘুম পাড়ায়, আবার এক দেড় ঘন্টা পর তার চিৎকার!

মাঝেমধ্যে আমি উঠি। মায়ের থেকে ওকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে ঘুম পাড়াই। ওর মা চোখ গরম করে তাকায়, বলে সকালে অফিস আছে, ঘুমাও। আমার ঘুমাতে ইচ্ছে করে না। সকাল থেকে তো তারও মায়ের ডিউটি আছে। অবশ্য মায়ের ডিউটি চব্বিশ ঘন্টাই থাকে।

আমি ভেবেছিলাম ডীল করে নেব৷ রাতে একবার ওর মা জাগলে একবার আমি জাগব। কিন্তু সেটা পুরোপুরি সম্ভব নয়। দুষ্টু পাখির খাবার তো আমার কাছে নেই। মাকে তাই উঠতেই হবে।

আমি আমার মাকে ফোন করলে জিজ্ঞেস করি, আমি কি এত দুষ্টু ছিলাম? মা হেসে বলেন, তোর মেয়ে তোর থেকে লক্ষ গুণ ভালো। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, তাহলে পেলেছ কেমন করে? মা উত্তর দেয়, রক্ত পানি করে।

কথাটা সত্য! দুষ্টু পাখির বাবা হয়ে এটা বুঝতে পেরেছি। আমার মনে হয় একটা বাচ্চা পালার চেয়ে অফিসে সারাদিন কাজ করা ঢের আরামের। তাই দুষ্টু পাখির মায়ের সাথে আজকাল আর রাগ করতে পারি না।

আমি অবাক হয়ে দেখি, সারাদিন আর কিছু পারুক না পারুক, দুষ্টু পাখির মা ঠিকই রান্নাবান্না সব করে। আমি বাসায় ফিরলে গরম ভাত, তরকারি সবই পাই। যে চুল বাঁধার সময় পায় না সে এসব কখন করে? আমি জিজ্ঞেস করি। সে বিরক্ত হয়ে বলে, এতকিছু তোমাকে বলার সময় নেই।

ভোরবেলায় দুষ্টু পাখি ঘুমায়। আমি গোসল করতে করতে তার মা রুটি বানিয়ে ফেলে। সে গরম রুটি একটা একটা করে ভেজে টেবিলে দিয়ে যায়৷ আমি খেতে থাকি। প্রতিবার সে এলে আমি একটা বড় টুকরো তার মুখে গুঁজে দেই।

রুটি খাওয়া শেষে সে দু’কাপ চা নিয়ে আসে। চা খেতে আমাদের সময় লাগে বারো মিনিট। এই বারো মিনিট আমরা সব ভুলে নিজেদের মতো থাকি। সেদিন দুষ্টু পাখির মা বলছিল, দেখেছ, আমাদের একান্ত সময় কমে গিয়ে মাত্র বারো মিনিটে এসে দাঁড়িয়েছে?

আমি ভাবলাম, তাই তো! বাকি পুরোটা সময় আমরা বাবা মা হয়ে যাই। শুধু দিনের এই বারো মিনিট আমাদের নিজস্ব সময়৷

এত কথা বলার কারন একটাই, বারো মিনিটকে আরেকটু দীর্ঘায়িত করতে চাই৷ এই ধরুন, পনেরো কিংবা বিশ মিনিট। দুষ্টু পাখির মায়ের আজ শুভ জন্মদিন। উপহার হিসেবে তাকে একটা রুটি মেকার কিনে দিলে কেমন হয়? দ্রুত রুটি বানানো হয়ে যাবে। তাহলে একসাথে সকালের নাস্তা খাওয়া যাবে। বলুন তো, কোন ব্র্যান্ডের রুটি মেকার সবচেয়ে ভালো হবে?

ও হ্যাঁ, দুষ্টু পাখির মাকে শুভেচ্ছা জানতে ভুলবেন না।

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে