গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-৩৮

0
510

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৮.

ঝড়বৃষ্টি কমল না, বরং ক্রমেই বাড়তে লাগল। বাবা ফোন করে জানালেন, তিনি ফিরতে পারবেন না। স্বরূপ যেন রাতটা থেকে যায়।

রাত বাড়তেই তনয়ার ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে রান্নাঘরে ঢুকল। এখানে আসার পর থেকে মনমেজাজ আর শরীর খারাপ থাকায় রান্নাঘরের দিকে আসার ইচ্ছেও হয়নি। মা-ই মুখে তুলে খাইয়েছে৷ খাবার কিছু আছে কি না কে জানে!

তনয়া দেখল দুপুরের রান্না অল্পই আছে। স্বরূপ এসেছে বলে হয়তো মুরগি ভিজিয়ে রেখেছিলেন মা। রান্নার সময় হয়নি। তনয়া ভাবল এটাই রেঁধে ফেলা যাক। তার আগে কিছু খেতে হবে। সে দুপুরের বেঁচে যাওয়া ভাত আর তরকারি বেড়ে নিয়ে খেতে বসল।

স্বরূপ গোসল করতে গিয়েছিল। এই গরমেও সে সারাদিন গোসল করার সুযোগ পায়নি। সে গোসল সেরে বের হয়ে দেখল তনয়া ঘরে নেই। তাকে পাওয়া গেল রান্নাঘরে। টুলে বসে ভাত খাচ্ছে। কী আরাম করে কাঁচামরিচে কামড় দিচ্ছে! স্বরূপের ভারি ভালো লাগল।

তাকে দেখে তনয়া কিছুটা লজ্জা পেল। বলল, “স্যরি, তোমাকে রেখে খাচ্ছি। খুব খিদে পেয়েছিল। তোমার জন্য রান্না করব এখন।”

স্বরূপ হেসে বলল, “দরকার নেই মিসেস সিন্ডারেলা, আপনি আরাম করে খেতে থাকুন। আমি রান্না করছি।”

তনয়া উঠতে গেল, “সেকি! না না, তোমার কিচ্ছু করতে হবে না, যাও তো!”

স্বরূপ তাকে জোর করে বসিয়ে দিল। বলল, “ইটস ওকে তনয়া! তুমি জানো আমি রাঁধতে পারি।”

“তাই বলে এই বাসায়?”

“আমার বাসায় গিয়ে তুমি রাঁধতে পারলে তোমার বাসায় আমি পারব না কেন?”

“আজব আজব সব যুক্তি!”

“আমি মানুষটাই আজব।”

স্বরূপ রাঁধতে লেগে গেল। তনয়ার খাওয়া শেষ হলে সেও হাত লাগাল। স্বরূপ কাটাকুটি করে ফেলেছে। তনয়া রান্না বসিয়ে দিল। অনেকদিন পর দুজন একসাথে রান্না করল।

রান্না শেষে স্বরূপ নিজের জন্য খাবার বেড়ে নিল। তনয়ার জন্য নিল না। তনয়ার আবারও খিদে পেয়েছিল। কিন্তু কিছু বলল না। ভাবল, স্বরূপ না জানি কী বলবে! একটু আগেই তো সে খেল।

স্বরূপ প্লেট নিয়ে খাবার টেবিলে চলে গেল। তনয়াও গেল পিছু পিছু। তনয়াকে সে নিজের সামনে বসাল। তারপর ভাত মাখিয়ে ওর মুখের সামনে ধরে বলল, “হা করো।”

তনয়া বলল, “আমি তো মাত্রই খেলাম, তুমি খাও।”

“উহু, আমার সাথে খেতে হবে। নয়তো আমি খাব না।”

তনয়া আর না করল না৷ এত ধৈর্যও নেই। একে খিদে পেয়েছে, তার ওপর কতদিন পর স্বরূপের হাতের রান্না তার হাতেই খাবে! সে খেয়ে নিল। মুখে খাবার নিয়ে চোখে পানি চলে এলো তার।

স্বরূপ বলল, “এই না, একটুও কাঁদবে না। বলেছি না আর কোনো কান্নাকাটি নয়!”

তনয়া চোখ মুছল। একটু আগে তাকে থামাতে স্বরূপের ভালোই কসরত করতে হয়েছে। বহু কিছু করেও যখন তনয়ার কান্না থামছিল না, তখন সে তনয়ার লিপস্টিক মেখে মাথায় ওড়না জড়িয়ে খানিক নেচে দেখিয়েছে৷ অতঃপর তনয়ার কান্না থেমে হাসির দেখা মিলেছে।

খাওয়াদাওয়া শেষে ঘুমুতে গেল তারা। ঝড় বহু আগে থামলেও বৃষ্টির বিরাম নেই। স্বরূপ জানালার পাল্লা সামান্য খুলে হাত বাড়িয়ে দিল বাইরে। বৃষ্টিভেজা হাতে তনয়ার গাল ছুঁয়ে দিল। তনয়া সামান্য কেঁপে উঠল।

স্বরূপ বলল, “সুইটহার্ট, এটা আমাদের প্রথম রাত যেটা আমরা একসাথে কাটাব, আর সাথে থাকবে ছোট্ট সোনামণি।”

“উহু, আগেও এমন রাত এসেছে।”

“কিন্তু তখন আমরা তার উপস্থিতির ব্যাপারে জানতাম না তাই না?”

স্বরূপ কাছে এসে তনয়ার পেটে হাত বুলিয়ে বলতে শুরু করল, “তুই কি বাবার ওপর অনেক রাগ করেছিস?”

তনয়া উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”

“তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি।”

“ওর বয়স কত জানো? মাত্র বারো সপ্তাহ। তাই ওর হয়ে আমি সব বলব।”

“ও কি নড়াচড়া করে না?”

“উহু। এখনই না।”

“কাঁদে না?”

“ধুর!”

“হাসেও না?”

“তুমি একটা পাগল।”

“প্রথম বাচ্চা আমার। সব কি জানি?”

“তো আমার কি আগে আরও বাচ্চা হয়েছে?”

“না, দুজনেরই প্রথম। এজন্যই তো আনাড়ি। বিশ্বাস করো, আমাদের দশ নম্বর বাচ্চা হওয়ার সময় আমি মোটেও এই প্রশ্নগুলো করব না।”

তনয়া চোখ বড় বড় করে তাকাল। “দশ নম্বর!”

“হ্যাঁ, আমার তো ইচ্ছে আছে টোটাল দশটার।”

“বাকি নয়টার জন্য আরেকটা বিয়ে করে নিও। গুড নাইট।” বলে তনয়া বিছানায় একপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

স্বরূপ বাতি নিভিয়ে শুতে এলে তনয়া বলল, “শোনো! তোমাকে আমার দায়িত্ব দিয়ে গেছে মা বাবা। কোনোভাবেই দায়িত্বের সুযোগ নেওয়া যাবে না। ওই কর্ণারে গিয়ে শুয়ে থাকো।”

স্বরূপ কাঁধ ঝাঁকাল, “As Your wish!”

তনয়া শুয়ে প্রতিদিনকার মতো দোয়া পড়ে সারা গায়ে ফু দিল। তারপর হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে শুরু করল।

ঘরে একটা মৃদু সবুজ আলো জ্বলছে। তাতেই স্বরূপ এসব কার্যকলা দেখতে পাচ্ছে। তার বেশ আগ্রহও হচ্ছে। এভাবে কি ঘুমিয়ে যাবে নাকি? তনয়ার নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকল। স্বরূপের একসময় মনে হলো মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তার চোখে তো ঘুম নেই। কতরাত শান্তিতে ঘুমাতে পারে না!

সে এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় তনয়ার পাশ ফিরে অবাক হয়ে দেখল তনয়া তাকিয়ে আছে।

“একি! ঘুমাওনি?”

“ঘুম আসতে দেরি হয়।” উত্তর দিল তনয়া৷

স্বরূপ হতাশ গলায় বলল, “এককালের সিন্ডারেলার এখন এত কসরত করেও ঘুম হয় না?”

“না। একটা রাক্ষস সব ঘুম খেয়ে ফেলেছে।”

“স্যরি।”

“স্যরি শব্দটা পঁচিয়ে ফেলেছ।”

স্বরূপ নিচু গলায় বলল, “ঘুম আনার একটা লাস্ট ট্রিকস অ্যাপ্লাই করতে পারো।”

“কোনটা?”

স্বরূপ কাছে গিয়ে তনয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এবার চেষ্টা করে দেখো ঘুম আসে কি না।”

তনয়া সরে গেল না। চুপ করে পড়ে রইল। তার আবার কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদা যাবে না।

একসময় ঘুম এলো দু’জনের চোখেই। কখন সেটা নিজেরাও বুঝতে পারল না।

*

পরদিন স্বরূপ তনয়ার খালা, যে কিনা রূপার মা তাকে দেখতে তাদের বাড়িতে গেল। হাসপাতাল থেকে সকালেই রিলিজ করে দেয়া হয়েছে তাকে। সেখানে গিয়ে রূপার সাথে দেখা হয়ে গেল। অনেকদিন তার সাথে দেখা নেই।

স্বরূপকে দেখে রূপা কোনো কথা বলল না। কঠিন দৃষ্টিপাত করে ভেতরে চলে গেল। রূপার স্বামী ফসয়াল স্বরূপের সাথে বসে গল্প জুড়ে দিল। ফয়সাল মানুষ ভালো আর ভীষণ আলাপী। আসর জমিয়ে ফেলতে সময় লাগে না। আর কথা শুনতেও ভালো লাগে। তবুও স্বরূপের মনোযোগ সরে যেতে থাকল। রূপার হয়েছে কী? সে কি তনয়া আর তার ঘটনায় রেগে আছে?

বের হবার একটু আগে রূপাকে পাওয়া গেল। সে তার বাচ্চাকে সুজি খাওয়াচ্ছিল। স্বরূপ গিয়ে পাশে বসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল।

রূপা বিরক্ত গলায় বলল, “দেখছিস না খাওয়াচ্ছি।”

“খাওয়াস। আমি চলে যাচ্ছি। খাবার তো এখানেই থাকবে।”

“ঠান্ডা হয়ে যাবে। ছাড় ওকে।”

“তুই রেগে আছিস কেন?”

রূপা এই কথায় দারুণ রেগে গিয়ে বলল, “তোর জন্য লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেছে। খালা খালুর কাছে তোর নামে ভালো কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিলাম৷ আর তুই কী করেছিস? এরকম হবে জানলে জীবনেও তোর বিয়ের ঘটকালি করতে যেতাম না। তনয়ার সমানে আমি লজ্জায় যাইনি। আমি ওকে কী বলেছিলাম জানিস? বলেছিলাম তোর মতো ছেলে ও হাজার খুঁজলেও পাবে না। আর তুই শেষ পর্যন্ত এই করে ছাড়লি! ছি! আমি তনয়াকে দেখতে যেতেও পারিনি ভয়ে।”

“স্যরি।”

“ফালতু কোথাকার! তুই বলেছিলি না, তনয়াকে কোনোরকম জুলুম করবি না?”

“ইচ্ছে করে করিনি।”

“কেন করলি?”

“হয়ে গেছে। তুই জানিস মাথা গরম হয়ে গেলে আমি উল্টোপাল্টা বিহেভ করে ফেলি।”

রূপা আরেকটু চড়ে গিয়ে বলল, “আচ্ছা? বুঝলাম। কিন্তু তুই কাল মিলির সাথে ছবি পোস্ট করেছিস কেন? তোর কি মনে হয় তুই এখনো ভার্সিটিতে পড়িস যে বন্ধুবান্ধবের সাথে যখন তখন ছবি দিয়ে দিবি? শ্বশুরবাড়ির লোকের সাথে অ্যাড আছে না তোর? জানিস কতগুলো কাজিন আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে ঘটনা কী? কেউ কেউ ভেবে বসে আছে তনয়ার সাথে ছাড়াছাড়ির পর মিলির সাথে তোর রিলেশন! যা তা অবস্থা! মায়ের মাথা ফাটায় ব্যাপারটা থেকে সবার মনোযোগ সরে গেছে। তুই কি আজীবন মাথামোটা থাকবি?”

স্বরূপ ক্লান্ত গলায় বলল, “এতকিছু কি আমি বুঝে করেছি?”

“আহারে! বাচ্চার বাবা হয়ে যাচ্ছো, আর কিছু বোঝো না।”

“সত্যিই বুঝিনি।”

“তনয়ার রাগ ভাঙিয়েছিস?”

“মনে তো হয় ভেঙেছে।”

“ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবি না?”

“হ্যাঁ। ভয়েই কিছু জিজ্ঞেস করিনি। যদি না করে দেয়? এখন গিয়ে বলব।”

“যা তাহলে।”

স্বরূপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই আমার জন্য লজ্জা পেয়েছিস সেজন্য স্যরি। আর আমার জন্য তনয়াকে খুঁজে দিয়েছিস বলে থ্যাংস। তুই চিন্তা করিস না। তনয়া একদিন নিজে এসে তোকে বলবে তুইও ওর জন্য সবচেয়ে ভালোটাই করেছিস। আই প্রমিজ!”

*

“ফিরে চলো না তনয়া। প্লিজ! বাসাটা খাঁ খাঁ করে।”

“আমার ভালো লাগে না কিছু৷ ওখানে গেলে একা হয়ে যাব।”

“তুমি চলো, আমি মিতাকে নিয়ে আসব। ভালো লাগবে তখন।”

“আমার সব ভালোলাগা মরে গেছে।”

“তনয়া! আমি ভেবেছিলাম আমাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে।”

“হয়েছে। কিন্তু আমার যে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। আমি কেমন যেন হয়ে গেছি। কিছুই ভালো লাগে না।”

“বাসায় চলো, ভালো লাগবে।”

“আমার খুব কান্না পায়। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারি। ওখানে গেলে কাকে পাব?”

“আমি আছি তো!”

“তুমি তো মা নও।”

স্বরূপ হতাশ হয়ে পড়ল। এক ঘন্টা ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে সে ব্যর্থ। কিছুতেই কেন যেতে চাইছে না ও? ইনসিকিউরিটি? ভয়? অভিমান? কোনটা?

স্বরূপ মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল বাইরে। মনের ভারটা আবার ফেরত এসেছে। তনয়া এমন করল কেন?

তনয়ার মন একদিকে খুব চাইছিল স্বরূপের সাথে চলে যেতে। আবার আরেক দিকে কেমন জড়িয়ে ধরা ভয় তাকে বলছিল, যেতে হবে না। এই তো ভালো! এই ছেলে আবার অমন করলে বাচ্চাটা বাঁচবে তো? সে স্বরূপকে বিশ্বাস করে। কিন্তু রেগে গেলে ওর যে আরেকটা রূপ বের হয় তাকে বিশ্বাস হয় না।

তনয়া জানালা ধরে বাইরে তাকাল। নিচে স্বরূপকে দেখা গেল বের হয়ে গাড়ির দিকে যেতে। গাড়িতে চড়ে বসল সে। কিন্তু গাড়িটা চলে গেল না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তনয়ার মনে হলো স্বরূপ ড্রাইভ করতে পারছে না। তার হাত কাঁপছে। সে কাঁদছে। গতকালও কাঁদছিল স্বরূপ। ওই মানুষটা প্রবল আবেগী, ভালোমানুষ, ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু….

স্বরূপ চোখ মুছে সোজা হয়ে বসে স্টিয়ারিং ধরল শক্ত হাতে। এত ইমোশনাল সে কবে থেকে? কখন থেকে চেষ্টা করেও কেন নিজেকে সামলাতে পারছে না?

বড় করে নিঃশ্বাস নিল সে। গাড়িতে স্টার্ট দিল। তখনই মেসেজের টুং শব্দটা কানে গেল তার। স্টার্ট বন্ধ করে মেসেজবক্স খুলল। তনয়ার মেসেজ,

“চলে যাচ্ছো যে বড়! আমি কি ব্যাগ গোছাতে পারি? গুছিয়ে না দিলে যাব কী করে?”

স্বরূপ গাড়ি থেকে বের হয়ে ওপরের দিকে তাকাল। তনয়া হাসিমুখে কাঁদছে। তারও চোখে জল। তবে ভেতরে অসম্ভব প্রশান্তি।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে