#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১.
“এরকম অদ্ভুত স্বভাবের নাকউঁচু ছেলেটার সাথে তুমি আমাকে জেনেশুনে বিয়ে দিতে চাও? তুমি চাইছ কী? সে তোমার বন্ধু হলে আমিও তোমার বোন।” কথাটা বেশ অভিমানী সুরেই বলল তনয়া।
রূপা গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিল৷ দোলতার বারান্দা থেকে পূব আকাশের চাঁদটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কোমল আলোর ছোঁয়া মেখে আছে আকাশজুড়ে। রূপা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুই জানিস, আমি স্বরূপের জন্য তোর থেকে ভালো আর কাউকে ভাবতেই পারছি না। ও যতই নাকউঁচু ভাব দেখাক না কেন ওর মতো ভালো ছেলে তুই পুরো জীবন খুঁজলেও পাবি না।”
তনয়া এবার নড়েচড়ে বসল। “আহা! তাই নাকি? তোমার এই ভালো ছেলে প্রথমদিন এসেই আমাকে কী জিজ্ঞেস করেছে জানো?”
“কী?”
কথাটা ভেবেই যেন তনয়ার গা জ্বলে গেল। বলল, “জিজ্ঞেস করেছে আমি কোন ব্র্যান্ডের পারফিউম ইউজ করি।”
“তো তাতে সমস্যাটা কোথায়?”
তনয়া দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “পারফিউমের নাম বলার পর জিজ্ঞেস করেছে, এটা কে কিনে দিয়েছে? বয়ফ্রেন্ড? এত দামি জিনিস কেনাও বয়ফ্রেন্ডকে দিয়ে? সে তো এতদিনে ফকির হয়ে গেছে বোধহয়।”
রূপা হো হো করে হেসে ফেলল। হাসির এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই যেন হোঁচট খেয়ে চুপ হয়ে গেল। মুখ অন্ধকার হয়ে গেল তার।
তনয়া জিজ্ঞেস করল, “কী হলো তোমার?”
রূপা বলল, “কিছু না। একটা কথা মনে পড়ে গেল। বাদ দে। তুই রাজি হয়ে যা প্লিজ!”
“যাতে তোমার জীবনের প্রথম ঘটকালি সাকসেসফুল হয়? না বাবা আমি তা কিছুতেই হতে দেব না।”
“তুই জানিস না স্বরূপকে কত কষ্ট করে রাজি করিয়েছি আমরা।”
“কষ্ট কেন? সে কি বিয়ে করতে চায় না?”
“না। সে মেয়েদের মোটেও পছন্দ করে না।”
তনয়ার আবারও গা জ্বলে গেল। “মানে কী? একটা ছেলে, যে মেয়েদের দেখতে পারে না তার সাথে তুমি জোর জবরদস্তি করে কেন আমার বিয়ে দিতে চাও? তোমার সমস্যাটা কোথায়?”
রূপা এতক্ষণে তনয়ার মুখোমুখি বসল। বলল, “আচ্ছা তোকে একটা ঘটনা বলি।”
“কোন ঘটনা?”
“স্বরূপের জীবনের ঘটনা।”
তনয়া হাত নেড়ে বলল, “আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড।”
রূপা হেসে বলল, “তোর ইন্টারেস্টের খবর জানতে চাইনি। বলছি, শোন।”
রূপা মনে মনে ঘটনাটা গুছিয়ে নিল। তনয়ার দিকে একবার তাকাল। কী মিষ্টি মুখ মেয়েটার! দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। তনয়ার সবটাই মাধূর্যে মোড়া। ওর চাহনি থেকে শুরু করে কাজ করার ঢঙ, হাসি থেকে শুরু করে মনমানসিকতা সবটাই এত সুন্দর যে রূপার রীতিমতো ঈর্ষা হয়। যদিও রূপা দেখতে তনয়ার চেয়ে সুন্দর, তবুও সে জানে, বাকিসব দিক দিয়ে তনয়া তার থেকে অনেক এগিয়ে। তার এই ছোটো খালার মেয়েটাকে সে ভীষণ পছন্দ করে। তবে ছোটো বলে পছন্দটা স্নেহের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পায়।
সে বলতে শুরু করল, “তুই তো জানিসই, স্বরূপ আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু। যদিও সবাই বলে ইউনিভার্সিটিতে সত্যিকারের বন্ধু হয় না, তবুও আমরা কয়েকজন সত্যিই প্রাণের বন্ধু হয়ে রয়ে গেছি। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল ছেলে ছিল স্বরূপ। ওর মতো খোলা মন আর চমৎকার মানসিকতার ছেলে আজকের যুগে পাওয়া মুশকিল। ও ছিল আমাদের দলের অঘোষিত দলনেতা। তবে সেরকম আচরণ তার ছিল না। সবার বিপদে সে সবার আগে পাশে গিয়ে দাঁড়াত। যে কোনো ক্ষেত্রে, হোক দুষ্টমি, কিংবা সিরিয়াস বিষয়, সবার সামনে থাকত সে। আমরা ওর ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে গা হাত পা ছেড়ে বসে থাকতাম। সে দায়িত্ব নিত, সেই সাথে আমাদেরও কান ধরে উঠিয়ে ছাড়ত। ও কখনো কারো মন খারাপ হতে দিত না। হলেও সেটা বেশিক্ষণ টিকতে দিত না। আর ও এখন নিজেই চিরস্থায়ী মন খারাপের জগতে ঢুকে গেছে। আমরা হাজার চেষ্টা করেও তাকে সেখান থেকে বের করতে পারিনি।”
তনয়াকে আগ্রহী হতে দেখা গেল। “কী করে এমন বদলে গেল?”
“একটা এক্সিডেন্টের পর। এটাকে দুর্ঘটনা বলব নাকি দুর্ভাগ্য জানি না। তবে ওটাই সবকিছু বদলে দিয়েছিল। তোর ভাষায়, ওই নাকউঁচু ছেলেটা যখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠল, তখন প্রেমে পড়ল। সাধারণ প্রেম না, একেবারে সাইক্লোনোর মতো তীব্র প্রেম! পাগলের মতো ভালোবাসত সে মেয়েটাকে। মেয়েটার নাম ছিল লোপা। এক বছরের জুনিয়র ছিল। ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট। ওরা বলা চলে দু’জন দু’জনার প্রেমে পড়েছিল। তুমুল প্রেম চলেছিল পুরো চারটা বছর।
স্বরূপের ঢাকায় কিছুই ছিল না। বাড়ি ছিল গ্রামে। সেই ছেলে লোপার জন্য, ওর সুখ সুবিধার জন্য কষ্ট করে চার বছর কাটিয়ে একটু একটু করে টাকা জমিয়েছিল সংসারের জন্য। পার্ট টাইম চাকরি করত অনলাইনে। সেখান থেকে পাওয়া সব টাকা জমিয়ে রাখত। মাস্টার্সের পাশাপাশি অফলাইনেও একটা চাকরিতে ঢুকল। মাস্টার্স শেষ করার পরপরই ঢাকায় ছোটোখাটো একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলল সে। সেটা সাজাল অল্প অল্প জিনিস দিয়ে। কিন্তু লোপার কাছে গোপন রাখল সবটা৷ চেয়েছিল হঠাৎ জানিয়ে চমকে দেবে।
আমরা স্বরূপের সাথে ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে আড্ডা দিতাম, ওকে গোছাতে সাহায্য করতাম। আর ও নতুন জীবনের কথা বলত। কত স্বপ্নই না দেখেছিল ছেলেটা! ওর গলায় ভবিষ্যতের কথা শুনলে সত্যিই পৃথিবীটা রঙিন মনে হতো। তারপর…” বলতে বলতে গলাটা কেঁপে গেল রূপার।
তনয়ার কেমন কষ্ট হচ্ছিল শুনে। শেষটা নিশ্চয়ই সুখের হয়নি। হলে আজকের পরিস্থিতি অবশ্যই হতো না। সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছিল তারপর?”
“স্বরূপ মাস্টার্স শেষে ভালো একটা চাকরিতে ঢুকল। যেহেতু তার টুকটাক বেশ ভালোই অভিজ্ঞতা ছিল, দারুণ একটা চাকরিও পেয়ে গেল। চাকরির প্রথম মাসের বেতন পাওয়ার দিন আমাদের সবাইকে নিয়ে সে প্ল্যান করল লোপাকে সারপ্রাইজ দেবার আর তাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করার।
লোপার তখন অনার্স শেষ, মাস্টার্স চলছে। সে আর হলে থাকে না, একটা বাসা ভাড়া নিয়ে একা থাকে। ঠিক হলো হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হব। হলামও৷ স্বরূপের কাছে লোপার বাসার চাবি ছিল। চুপিচুপি ঢুকে গেলাম আমরা। কিন্তু ঢুকে যা দৃশ্য দেখলাম তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।”
“কেন?” বলতে গিয়ে তনয়া খেয়াল করল তারও গলা কাঁপছে। মেয়েটা কি মরে পড়েছিল?
রূপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “লোপাকে আমরা একটা লোকের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় পেলাম। কী ভয়ানক বিষয় ভাবতে পারিস?”
তনয়া চুপ হয়ে গেল। সে সত্যিই ভাবতে পারছে না৷
রূপা বলল, “লোকটা ছিল লোপার ডিপার্টমেন্টের লেকচারার৷ ইভেন, আমরা পরে জানতে পেরেছিলাম লোপা গোপনে টাকার বিনিময়ে অনেক মানুষকেই সার্ভিস দিত।
এরপর থেকেই আমাদের বন্ধুটা কেমন যেন হয়ে গেল। সবই ঠিকঠাক, আবার কিছুই যেন ঠিক নেই। এখন ওই অবস্থা থেকে অনেকটা বেরিয়ে এলেও সে আমাদের, মানে তার কিছু মেয়ে বন্ধু, আর ফ্যামিলি বাদে আর কোনো মেয়েকেই পছন্দ করে না। সহ্যই করতে পারে না। কিন্তু সব মেয়েরা তো আর লোপার মতো নয় তাই না? আমি ওকে একদিন বলেছিলাম, তোকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়েকে এনে দেখিয়ে দেব মেয়েরাও কী চমৎকার হতে পারে! ও হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল।
তনয়া বিশ্বাস কর, আমি তোর খারাপ চাই না৷ আমি শুধু দুটো সুন্দর মনের মানুষকে মেলাতে চাই। ও যাই বলুক, ওর ভেতরের মনটা পুরোপুরি মরে যায়নি৷ ও এখনো ভালোবাসতে জানে। শুধু ক্ষতটা একটু বেশিই গভীর হয়ে গেছে।”
তনয়া স্বরূপের মুখটা কল্পনা করল। ছেলেটা দারুণ দেখতে! ওর এক দেখায় পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। কী মায়াকাড়া চোখদুটো! দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। তবে গা জ্বালানো কথাবার্তা শুনেই ও ছেলেটাকে বিয়ে করার ইচ্ছে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করছে। মানুষের কষ্ট কখনোই সহ্য করতে পারে না তনয়া। তার হঠাৎ খুব ইচ্ছে হলো, মানুষটার গভীর ক্ষততে হাত বুলিয়ে কিছুটা সান্ত্বনা দিয়ে আসতে। বিকেলের অসহ্য লাগা মুখটার জন্য এখন এত মায়া লাগছে কেন?
সে রূপার দিকে তাকিয়ে দেখল রূপা গভীর চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তনয়া তাকাতেই সে বলল, “তুই ভেবে বলিস। প্রয়োজনে আবার দেখা করতে পারিস ওর সাথে। তোকে সবই বললাম। আর জোর করব না। বাকিটা তোর ইচ্ছের ওপর ছেড়ে দিলাম।”
রূপা উঠে চলে গেল। ওর দু’বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করেছে।
তনয়া রেলিংয়ে হেলান দিয়ে গোল চাঁদটার দিকে তাকাল। কী করা উচিত তার?
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু