গল্পঃ “heart touch love 3”
পর্ব:- ০৬
২৮শে জুন ২০১৫,
সকাল নয়টা, পিয়াল, রুমি সিএনজিতে চেপে তামান্নার বাসায় যাচ্ছে। নীল পাঞ্জাবীতে রুমিকে আজ অন্যরকম লাগছে। মিষ্টি একটা সুগন্ধিও ব্যবহার করেছে মনে হচ্ছে।
পিয়াল- তোরে তো কখনই পাঞ্জাবী পরতে দেখি নি। আজকে হঠাৎ পাঞ্জাবী?
রুমি – এই পাঞ্জাবীটা তামান্না দিয়েছিলো। পাঞ্জাবী পরা পছন্দ করি না বলে ফেলে রেখেছিলাম। কিন্তু আজকে পরলাম শুধুমাত্র তামান্নার জন্য। (লাজুক হাসি দিয়ে)
– মিষ্টি একটা সুগন্ধ পাচ্ছি! এটাও নিশ্চই তারই দেয়া!
– হুম্ম। জানি না তামান্না আমাকে এই অবস্থায় দেখলে কি বলবে।
– তাহলে রুমি ভাইয়া আজকে তামান্নার মনের মতো করেই সেজেছে। চিন্তা করিস না তামান্না সব মেনে নিয়ে তোকে আবারো কাছে টেনে নিবে।
– সেইটাই যেনো হয়। ওই দেখ একটা ফুলের দোকান! কিছু ফুল কিনে নিয়ে যাই। (ফুটপাতের একটা ফুলের দোকানের দিকে ইঙ্গিত করে)
– হ্যা! খারাপ হয় না। মামা সিএনজিটা থামান তো! (সিএনজি চালকের উদ্দেশ্যে)
সিএনজি থেকে পিয়াল ও রুমি নামে, দোকানে গিয়ে বেশ কয়েকটা লাল গোলাপ কেনে। আবারো সিএনজিতে উঠে পরে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই সিএনজি এসে তামান্নার বাসার সামনে থাকে। পাঁচ তালার ফ্লাটটি সাদা রং করা,ছাদে লাগানো কিছু গাছপালার শাখা মাথা নিচু করে রেলিংএর বাহিরে ঝুলে পরেছে। দুই তালায়ই থাকে তামান্না আর ওর বাবা-মা। রুমি বেশ কয়েকবার তামান্নার বাসায় এসেছে। রুমি পাঞ্জাবিটা টেনে-টুনে ঠিক করে নিলো, মোবাইলটা বের করে চুলটাও দেখে নিয়ে পা বাড়ালো তামান্নার বাসার দিকে।
তামান্নার বাসার সামনে এসে দরজায় টোকা দিলো। তামান্নার মা এসে দরজা খুললো।
তামান্নার মা – !!!
পিয়াল -আসসালামু আলাইকুম আন্টি!!
তামান্নার মা – ওয়ালাইকুম আসসালাম! কে তোমরা বাবা?
পিয়াল- আন্টি আমরা তামান্নার বন্ধু, কলেজের পরীক্ষার ব্যাপারে ওর সাথে একটু কথা ছিলো।
– ও আচ্ছা, আসো ভিতরে আসো।
– জ্বি আন্টি, ধন্যবাদ।
– তোমাদের সাথে আমার কিছু কথা ছিলো বাবা।
– জ্বি বলুন আন্টি!
– তামান্নার কি হয়েছে বলতে পারো? একটু অন্যরকম হয়ে গেছে।
– আন্টি চিন্তা কইরেন না এখন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা এসে গেছি না?
– ও ওর রুমে আছে। গত কালকে বিকাল থেকে রুম থেকে বের হচ্ছে না। রাতে একবার বের হয়েছিলো কিছু খায় নি। অনেক বার বললাম খেয়ে শুয়ে পরতে, কিন্তু বললো খিদে নেই। হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো “মা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, কোনো ভূল করলে মাফ করে দিয়ো।” এরপর আবার রুমে চলে গেলো। আমি অনেকবার জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে কিছুই বললো না আমাকে।অনেক ডাকাডাকি করলাম সকাল থেকে কিন্তু কোনো সাড়া শব্দই পাওয়া যাচ্ছে না।
– ঘুমাচ্ছে মনে হয়! আংকেল কোথায় আন্টি?
– সেও ঢাকার বাহিরে গেছে বেশ কয়েকদিন হলো। তাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছি। বললো আসতেছি।
– আচ্ছা তামান্নার রুম কোনটা?
– ওই যে ওইটা, একটু দেখো তো! (একটা রুমের দিকে ইংগিত করে)
– জ্বি আন্টি।
পিয়াল রুমের দরজায় সশব্দে ধাক্কা দিলো আর বললো –
পিয়াল – তামান্না, আমি পিয়াল। দরজাটা খোলো তো একটু।
কিন্তু অপর পাশ থেকে কোনো আওয়াজই পাওয়া যাচ্ছে না। পিয়াল হাল না ছেড়ে বেশ কয়েকবার চেঁচিয়ে তামান্নাকে ডাকলো। লাভ হলো না, ফল একই দাঁড়ালো। এইবার রুমি এসেও দরজায় ধাক্কাধাক্কি লাগালো আর ডাকাডাকি শুরু করলো। এতো ডাকাডাকির পরেও দরজার ওপাশ থেকে একটা পিন-পতনেরও আওয়াজ আসছে না। এবার কিছুটা ভয় ঢুকলো পিয়ালের ভিতর। পিয়াল রুমির মুখের দিকে তাকালো, রুমির মুখটাও যেনো ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। পিয়াল দেরী না করে খুব জোরে ধাক্কা দিতে থাকলো দরজায়। পিয়ালের দেখাদেখি রুমিও দাঁড়িয়ে থাকলো না। ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে দরজার ছিটকানি ভেঙ্গে দরজাটা খুলে যায়। দরজাটা খুলে যেতেই একটু ভ্যাপসা গরম বাতাস পিয়ালের শরীরে ছুঁয়ে যায়,তার সাথে রক্তের ঘ্রান। পিয়াল ভিতরে ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। রুমি দরজার বাহিরে নিস্তব্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তামান্নার আম্মু ছুটে এসে বিছানার উপরে তামান্নার দেহের উপরে ঝুকে পরে, “তামান্না মাগো কি হয়েছে তোর,কথা বল” বেশ কয়েকবার চিৎকার দিয়ে বলে।কিন্তু তামান্নার নিথর দেহ ঠায় ওখানেই পরে থাকে, একচুল পরিমাণ নড়াচড়া নেই। গোলাপি রংএর চাদরটা লাল রক্তের সাথে মিশে গিয়েছে। কোনটা গোলাপি, কোনটা লাল তা বুঝে ওঠা কঠিন। বিছানার চাদরটাও এলোমেলো, হয়তো অন্তিমসময়ে কষ্টটা একটু বেশিই হয়েছিলো। একটা রক্তমাখা ধারালো চাকু নিচে পরে আছে। তামান্নার শরীরের কিছু অংশ রক্তে ভিজে আবার শুকিয়েও গিয়েছে। তামান্নার মা চিৎকার করে কাঁদছেন, কিন্তু পিয়াল যেনো এক ঘোরের মধ্যে পরে গিয়েছে। সব কিছুই দেখছে, সব কিছুই শুনছে কিন্তু কোনো কিছুই সত্যি মনে হচ্ছে না। বিছানার এক কর্নারে হাল্কা রক্ত মাখানো একটা ডায়েরী পরে আছে। সাদা রঙের ডায়রীটা লাল রক্ত চুষে নিয়ে লাল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কিছু অংশভাগ এখনো সাদাই রয়েছে। যা থেকে প্রমাণিত হয় ডায়রিটা সাদাই ছিলো। হঠাৎ একটা শব্দে পিয়াল নিজেকে তামান্নার রুমে আবিস্কার করে, শব্দটা পিছন থেকে আসে। আগত শব্দের উৎস খুজতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে তাকায় পিয়াল।রুমি, রুমি নিচে বসে পরেছে।যদিও বসে পরাটা স্বাভাবিক ভাবে ছিলো না। তামান্নার এমন অবস্থা দেখে রুমিও হয়তো নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। তামান্নার দরজার পাশে একটা চেয়ার রাখা ছিলো। হয়তো নিজের ভারসাম্য ধরে রাখার জন্য চেয়ারটাকে আকরে ধরতে চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু চেয়ারটা ফসকে গিয়ে পিয়ালকে নিচে ফেলে দেয়। রুমির চোখ দুটো বড় হয়ে গেছে। মানু্ষ যখন অতিরিক্ত কষ্টে কাঁদতে না পারে এমনটাই হয়তো হয়। পিয়ালের ইচ্ছে করছে রুমিকে টেনে তুলতে, কিন্তু এই মুহূর্তে পিয়ালের কোনো অঙ্গই যেন কাজ করছে না।
বিকাল পাঁচটা,
তামান্নার বাবা বাসায় এসেছেন, এসেই একমাত্র আদরের মেয়ের মরা মুখটা দেখতে হলো তার। বাসায় কান্নাকাটির রোল পরে গিয়েছে। অনেক আত্নিয়-স্বজন এসেছে। তামান্নাকে গোসল করিয়ে লাশবাহী খাটে তোলার সময় হয়ে এসেছে। রুমি একটা চেয়ারে বসে তামান্নার মৃত দেহের দিকে তাকিয়ে আছে। বুকে জড়িয়ে রেখেছে তামান্নার সেই রক্তমাখা ডায়রীটা।পিয়াল রুমির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। রুমের চারদিক আগরবাতির ঘ্রানে ভরে গিয়েছে।তামান্নাকে গোসল করিয়ে খাটে তোলা হলো। খাটটা কয়েকজন মুরব্বী কাঁধে তুলে নিলো।
রাত ৭টা, তামান্নার জানাজা শেষে দাফনকার্য শেষ হলো।পিয়াল আর রুমি বাসায় ফিরছে। রুমিকে, পিয়াল বেশ কয়েকবার কয়েকটা প্রশ্ন করেছে। কিন্তু রুমি কোনো কথাই বলছে না। বুকের মধ্যে ডায়রীটা চেপে ধরেই আছে সেই কয়েক-ঘন্টা ধরে। রুমিকে টেনে যেখানেই নিয়ে যাওয়া হয় সেখানেই যায়, দাড় করিয়ে রাখলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। একটা সিএনজি করে রুমির বাসায় চলে আসে পিয়াল,রুমি। পিয়াল রুমিকে, রুমির রুমে এনে বসায়।
রুমির মা – কি হয়েছে রুমির? রুমি কি হয়েছে তোর?
রুমি- (নিশ্চুপ ভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে)
পিয়াল- আন্টি কিছু হয় নি। মন খারাপ, আপনি যান রুমি একটু বিশ্রাম নিক।
রুমির হাত থেকে ডায়রীটা নিয়ে পাশের একটা টেবিলে রাখে। এরপর রুমিকে শুয়িয়ে দেয় পিয়াল। আজকে রুমির কাছে থাকাটা খুবই দরকার পিয়ালের। কিন্তু ওর বাসায় ওর মা একা। পিয়ালের বাবা সৌদিআরব থাকেন। তাই বাসায় পিয়াল আর ওর মা-ই থাকেন। পিয়াল রুমিকে শুয়িয়ে দিয়ে রুমের আলো বন্ধ করে দেয়। রুমির বাসা থেকে বের হয়ে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে একটা রিক্সা নেয়। পিয়ালের কিচ্ছুই ভালো লাগছে না। পিয়াল শুধু রুমির চিন্তা করছে, একসাথে দুইটা ধাক্কা রুমি কি সহ্য করতে পারবে?
দেখতে দেখতে পিয়াল ওর বাসার সামনে এসে যায়। ভাড়া মিটিয়ে বাসায় এসে শুয়ে পরে। পিয়ালে মা রাতের খাবার খাওয়ার কথা বললেও না খেয়ে শুয়ে পরে। কেমন যেনো! পেট ভরা লাগছে পিয়ালের। একটা মিষ্টি সুগন্ধির ঘ্রান নাকে আসছে, যে সুগন্ধিটা রুমিকে তামান্না দিয়েছিলো….
চলবেই