গল্পঃ “heart touch love 3″
পর্ব:- ০৪
কয়েকদিন পরের ঘটনা-
২০ই জুন ২০১৫ বিকালে-
পিয়াল রুমে বসে জেরিনের সাথে ফোনে কথা বলছে –
জেরিন -গতকালকে যে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেছিলা অইটার খাবারটা দারুন ছিলো। এক কথায় অস্থির।
পিয়াল- হুম্ম।
– ইস! প্রতিদিনই যদি যেতে পারতাম। আচ্ছা কালকে আবার দেখা করবা?
– গতকালকেই তো দেখা করলাম, আবার কালকে কেনো?
– এমন করে বলো কেনো? আমাকে কি একটুও সময় দিবা না বলো? (ঢং এর সহিত)
– দিবো না কখনো বলছি। কিন্তু কালকে না কয়েকদিন পরে দেখা করি।
– না না কালকেই করবা। একটু মার্কেটিং করবো। আমার একটা ড্রেস পছন্দ হইছে।
– আচ্ছা দেখি।পরে জানাচ্ছি।
-আচ্ছা বাবু। আই লাভ ইউ।
-হুম! আই লাভ ইউ টু!
-আচ্ছা এখন রাখি। পরে কথা বলবো।
-আচ্ছা বাবু বায়।
-হুম বায়।
ফোন কেটে দিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে বিছায় শুয়ে পরে পিয়াল।কিছুক্ষন পরেই রুমির ফোন থেকে কল আসে পিয়ালের নাম্বারে। পিয়াল ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফোনটা ধরবে কিনা সেই চিন্তা করছে। সেইদিনের কাহিনীর পরে রুমির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো পিয়াল। আজকে হয়তো সরি বলার জন্য কল দিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই কলটা রিসিভ করার আগেই কেটে যায়। পিয়াল আবারো ফোনে গান ছেড়ে হেডফোন কানে দেয়। কিছুক্ষন পরে আবারো রূমি ফোন দেয়। এইবার পিয়াল সাথে সাথেই রিসিভ করে –
পিয়াল- হ্যালো!
রুমি- হ্যালো পিয়াল!!
-হ্যা বল।
-তুই একটু তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় আয়।
-কেনো?
– প্লিজ আয়, তাড়াতাড়ি। (কান্না কন্ঠে)
-কি হইছে দোস্ত? কি হইছে বল?
– আমার বোন টিয়া সুইসাইড করছে।
” আমি এখনই আসতেছি ” বলে ফোনটা কেটে দিয়ে দ্রুত বের হয়ে পরে পিয়াল। রেডি হওয়ার সময় নেই তাই একটা থ্রি-কোয়ায়ার প্যান্ট আর টি-শার্ট পরেই বের হয়ে পরে পিয়াল।বাসা থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে খুব দ্রুত রওনা হয় রুমির বাসার উদ্দেশ্যে। টিয়া, রুমির একমাত্র আদুরে ছোট বোন।এবার দশম শ্রেনীর ছাত্রী সে।ছাত্রী হিসেবে অনেক ভালো। রুমির সাথে সারাক্ষণ ঝগড়াঝাঁটিতে মেটে থাকতো।দেখতেও পরীর মতই সুন্দর। পিয়াল ওদের বাসায় গেলে টিয়াকে পেত্নি বলে পচাইতো,টিয়াও অনেক রাগ করতো। বেশি পচালে কান্না করে দিতো। পিয়ালের কোনো ছোট বোন না থাকায় ওরেই ছোট বোন বলতো। ওদের বাসায় যখনই যেতো তখনই কয়েকটা চকলেট কিনে নিয়ে যেতো। চকলেট কেনার সময় রুমি জিজ্ঞাসা করতো “কার জন্য কিনিস এইগুলা?”। তখন পিয়াল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলতো- ” আমার ছোট বোনটার জন্য”। টিয়াকে যদি কখনো কেউ জিজ্ঞাসা করতো ওরা কয় ভাই-বোন তখন টিয়ার উত্তর থাকতো -“ওরা তিন ভাই বোন, দুই ভাই আর এক বোন”।কিন্তু টিয়ার মতো মেয়ে আজকে এমন একটা কাজ করবে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না পিয়াল।সব কিছুই যেনো স্বপ্নের মতো লাগছে আজকে।এটা যদি সত্যিই স্বপ্ন হতো তাহলেই হয়তো ভালো লাগতো পিয়ালের।কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ফোনটা থ্রি-কোয়াটার প্যান্টের পকেট থেকে বের করে সিএনজিতে বসেই বন্ধু রাসেদকে ফোন দেয় পিয়াল –
পিয়াল- হ্যালো রাসেদ।
রাসেদ – হ্যা বল। (ঘুম জড়ানো কন্ঠে)
– তুই এখনই রুমির বাসায় আয়।
– কেনো?
– ওর বোন সুইসাইড করেছে।
-কি? আচ্ছা আমি আসতেছি।
– রিয়া, আলিসা, আরাফ ওদেরও কল দিয়ে আসতে বল।
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। তুই বের হইছোস?
– হ্যা আমি বের হইছি তোরা একটু তাড়াতাড়ি আয়।
-আচ্ছা আমরা আসতেছি, তুই যা। রাখলাম।
ফোন কেটে দেয় রাসেদ।
পিয়াল সিএনজি চালকের উদ্দেশ্যে-
পিয়াল- মামা একটু তাড়াতাড়ি জান প্লিজ।
সিএনজি চালক – হ যাইতাছি।
২০ মিনিটের মধ্যেই সিএনজি রুমির বাসার সামনে এসে থামে। পিয়াল সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে। রুমির বাসার দিকে পা বাড়ায়। রুমিদের ফ্লাটটা সাত তালা। ওরা ৩য় ফ্লোরে থাকে। পিয়াল দৌড়ে ওদের বাসায় চলে যায়। বাসার সামনে অনেক মানুষের ভিড়। পিয়াল ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢোকে। ঢোকার সাথে সাথেই রুমির বোন টিয়ার মৃত দেহ নিচে শোয়ানো দেখে পিয়াল।সাদা কাপড়ে ঢেকে রেখেছে। টিয়ার লাশের পাশে বসে কান্না করছে তার মা,কিছু আত্নিয়-স্বজন আর ওর কয়েকটা বান্ধবী। রুমির আব্বু সোফায় বসে আছেন। তিনি এক দৃষ্টিতে মরা মেয়ের লাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে তার পাশ থেকে ধরে আছেন কয়েকজন মুরুব্বী। রুমি এক কর্নারে দাঁড়িয়ে কান্না করছে। পিয়াল রুমির কাছে গেলো। পিয়ালকে দেখা মাত্রই রুমি, পিয়ালকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো। পিয়ালও রুমিকে জড়িয়ে ধরলো।
পিয়াল- কাঁদিস না দোস্ত। (কাঁদতে কাঁদতে)
রুমি – আমার বোনটা কেনো এমন করলো, বল? আমরা কি ওরে কম ভালোবাসতাম।
– যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন কেঁদে আর কি হবে বল?
– আমার কি হবে? আমার একটা মাত্র বোন। কতো দুষ্টামি করতো আমার সাথে। কতো স্বপ্ন দেখছিলাম বোনটাকে নিয়ে।
– কিভাবে হলো? কেনো করলো টিয়া এইসব?
রুমি, পিয়ালের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো টিয়ার রুমে। রুমটা আগের মতই গুছানো ও পরিপাটি। শুধু ফ্যানের সাথে একটা বাধা ওড়না ঝুলছে। হয়তো এই ওড়নার স্পর্শেই এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে রুমির বোন টিয়া। রুমি, পিয়ালকে টিয়ার রুমে এনে হাতে একটা ভাঁজ করা কাগজ ধরিয়ে দেয়। পিয়াল রুমির মুখের দিকে তাকায়, কাঁদতে কাঁদতে চোখ জোড়া লাল হয়ে গিয়েছে রুমির। পিয়াল কাগজের ভাঁজটা খোলে। কাগজটার ভিতরে কাঁপা কাঁপা হাতে কিছু লেখা আছে। হাতের লেখাটা টিয়ার তা বুঝতে কষ্ট হলো না পিয়ালের। কাগজটা পড়তে পড়তে পিয়ালের চোখ দুটো বড় হয়ে গেলো। যা লেখা ছিলো কাগজটায়-
“এই পৃথিবীর মধ্যে আমি খুবই ছোট একটা মানুষ। কিন্তু আমারো একটা মন আছে, আছে কিছু স্বপ্ন। আমাকে ঘিরে হয়তো তোমাদের অনেক স্বপ্ন ছিলো এবং আছে। হয়তো ভবিষ্যতে আর থাকবে না। কিন্তু আমারো কাউকে নিয়ে স্বপ্ন ছিলো। তোমরা যেমন আমাকে ভালোবাসতে আমিও ঠিক তেমনি একজনকে খুবই ভালোবাসতাম। কিন্তু সেই স্বপ্ন গুলো যখন ভেঙ্গে যায় তখন সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। হয়তো আমার স্বপ্ন আমাকে চায় না। কিন্তু আমি আমার স্বপ্ন ছাড়া কিভাবে বাচঁবো। প্রতিদিন কষ্ট পাওয়ার থেকে একদিনেই সব কষ্ট শেষ দেয়াটাই ভালো। আর আমি সেই পথটাকেই বেছে নিলাম। ভালো থাকুক,বেঁচে থাকুক সবার স্বপ্ন গুলো।”
কাগজের লেখাগুলো পড়ে চোখ থেকে পানি পরে যায় পিয়ালের।
রুমি- এই ওড়নার সাথে ঝুলে আমার বোনটা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। (ঝুলন্ত ওড়নার দিকে আঙ্গুল তুলে)।ঘরটা অনেক শান্ত হয়ে গেছে। কেউ আর আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে না। কেউ আর মোবাইলে গেইম খেলার জন্য বিরক্ত করবে না। জানিস তো বাসায় রাগ করে যখন ভাত খেতাম না, তখন আমার বোনটা আমাকে জোর করে ভাত খাইয়ে দিতো। এখন আর কেউ খাওয়াবে না। শত বকাবকির পরেও কেউ আর আমার কাছে এসে টাকা চাইবে না। গতকালকে টিয়ার মনটা অনেক খারাপ ছিলো আমি দেখেছি। আমি ভেবেছিলাম হয়তো আম্মু বকা দিয়েছেন। টিয়াকে জিজ্ঞাসা করাতেও আমাকে কিছু বলে নি। ও যদি একবার মুখ ফুটে বলতো ও কাউকে ভালোবাসে তাহলে তার পুরো পরিবার তুলে এনে টিয়ার সামনে রাখতাম। কিন্তু এখন বলে কি লাভ, আমার বোনটা তো আর ফিরে আসবে না।
পিয়াল মাথা নিচু করে হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছে, আর রুমি কি বলছে তা শুনছে। হঠাতই রাশেদের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো। পিয়াল হেটে সামনের রুমে গেলো। দেখলো রাসেদ এবং আরাফ দাঁড়িয়ে আছে। রিয়া আর আলিসা রুমির আম্মুকে ধরে বসে আছে। পিয়াল রাসেদ এবং আরাফাতক্র ইশারায় ডাক দিলো। রাসেরদ এবং আরাফ পিয়ালের পিছু পিছু টিয়ার রুমের দিকে গেলো। সেখানে রুমিকে দাঁড়ানো দেখে রুমির কাঁধে হাত রেখে আরাফ বললো-
আরাফ – ছেলেটা কে?
রুমি – টিয়া এই বিষয়ে আমাদেরকে কিছুই বলে নি।
আরাফ – আমি খোঁজ-খবর নিয়ে দেখতেছি।আজকে ওই ছেলে বেঁচে থাকবে না হয় আমি।
রাসেদ – আরাফ! ওই ছেলেকে মারলে আমাদের বোন কি ফিরে আসবে?
আরাফ মাথা নিচু করে টিয়ার খাটের উপরে বসে পরলো। আর কিছুক্ষন পরেই টিয়াকে জানাজা পড়িয়ে কবর দেয়া হবে। টিয়াকে গোছল করিয়ে লাশবাহী খাটে তোলা হলো। পিয়াল,রুমি, আরাফ এবং একজন মুরুব্বী খাটটা কাধে নিলো। সবাই কবরস্থানের দিকে পা বাড়ালো।
রাত ৯টায় টিয়াকে জানাজা পড়িয়ে কবর দেয়া হলো। রুমির মন খারাপ দেখে পিয়াল বললো –
পিয়াল – আজকে আমি তোর সাথে থাকি রুমি।
রাসেদ- হ্যা সেইটাই ভালো হবে। তুই ওদের বাসায় চলে যা।
রুমি – না থাক। আমার কিছু ভাল্লাগছে না। আমাকে একটু একা থাকতে দে তোরা।
রুমির এমন উত্তরে পিয়াল, রাসেদ আর কিছুই বললো না। রুমিকে বাসায় দিয়ে গেলো পিয়াল,রাসেদ। আরাফ, আলিসা এবং রিয়াকে এগিয়ে দিতে গিয়েছে। রুমির বাসা থেকে বেড়িয়ে রাসেদ এবং পিয়াল একটা চায়ের দোকানে বসলো।
রাসেদ – সিগারেট খাবি?
পিয়াল- না।
– অন্য কিছু খাবি? সারা বিকাল তো কিছু খাওয়া হলো না।
– নাহ ভালো লাগছে না। রুমিদের কিছু খাবার কিনে দিয়ে এলে ভালো হতো না?
– পাশের বাসায় ওদের জন্য রান্না করা হয়েছে।
– তুই খবর নিয়েছিস?
– হ্যা আমি সব কিছুর খবর নিয়েই ওখান থেকে নেমেছি।
– যাক ভালো করেছিস।
-তা কি করবি এখন?
-কিছুই ভালো লাগছে না। বাসায় যাবো।
-হ্যা সেইটাই কর তাইলে। আমিও যাই। গিয়ে গোসল করতে হবে। তুইও করে নিস।
-আচ্ছা চল তাইলে আমি আমার বাইকে তোরে তোর বাসায় নামিয়ে দিচ্ছি।
-চল।
রাসেদর ওর বাইকে করে পিয়ালকে, পিয়ালের বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। পিয়াল আস্তে আস্তে হেটে ওর বাসায় গেলো। সোজা রুমে গিয়ে ঢুকলো। বিছানার উপরে সশব্দে বসে পরলো। মোবাইলটা বের করে টিয়ার সাথে কয়েকটি তোলা ছবি দেখতে থাকলো। নিষ্পাপ হাসি দেখে চোখে পানি এসে গেলো পিয়ালের। ছবি দেখে মনেই হচ্ছে না কিছুক্ষন আগে এই মেয়েটাকেই কবর দিয়ে এসেছে। ফোনটা রেখে বাথরুমে গেলো পিয়াল। গোসল করে বের হলো। খুব খিদে পেয়েছে কিন্তু খাওয়ার ইচ্ছেটাই যেনো মরে গিয়েছে। রুমের লাইটটা বন্ধ করে শুয়ে পরে বিছানায়। ঘুম আসছে না পিয়ালের।
সকাল ৭টা, সারারাত জাগিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে পিয়াল। খুব মাথা ব্যাথা করছে আর একটু ঘুম-ঘুম পাচ্ছে।চোখ বুঝলো একটু ঘুমানোর জন্য। হঠাতই জেরিনের কল আসলো,ফোনটা কর্কশ স্বরে বেজে উঠলো। পিয়ালের মাথা সর্বোচ্চ পর্যায়ে গরম হয়ে গেলো। ফোনটাকে বিছানা থেকে দেয়ালের গায়ে ছুড়ে মারলো পিয়াল।ফোনটার চেঁচামেচি বন্ধ হয়ে গেলো। এখন একটু শান্তি লাগছে পিয়ালের। আবারো চোখ বন্ধ করলো পিয়াল……
চলবেই