গল্পঃ পুরুষ
হাবিবা সরকার হিলা
বসার ঘরে অল্পবয়স্কা একটা মেয়ে অঝোর হয়ে কাঁদছে। মেয়েটা কান্না লুকানোর কোনো চেষ্টা করছে না। আঁচলে চোখ মোছার সঙ্গে সঙ্গেই দু-চোখ আবার জলে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আমি সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে মেয়েটাকে দেখছিলাম। পরনের শাড়ি খানিকটা অগোছালো৷ নীল ব্লাউজ ফর্সা দুইহাত খামচে জড়িয়ে আছে। নগ্ন কাঁধ, পিঠের একাংশ হতে যেন হলুদাভ আভা বের হচ্ছে। মেয়েটা সত্যি সুন্দর।যদিও চোখের কাজল লেপ্টে গেছে, এলোকেশী চুল তবু ওর সৌন্দর্যে ছায়া ফেলতে পারছে না।
মুখোমুখি সোফায় বসলাম। অচেনা একটা মেয়ে এত কান্নাকাটি করলে কিভাবে সান্ত্বনা দিতে হয় আমার জানা নেই। ওকে সহজ হতে সময় দিচ্ছিলাম। চোখে জলের ধারা খানিক কমলে বললাম,
-আমি শিখা, আপনি আমাকেই খুঁজছিলেন। দুঃখিত, গোসলে ছিলাম তাই আসতে দেরি হল।
-নাফিস এখানে এসেছে? আমি ওকে পাগলের মত খুঁজছি৷ কোথাও খুঁজে পাই নি। ওর নাম্বারটাও বন্ধ।
মেয়েটা হড়বড় করে বলল। বড় বড় চোখে কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। গোলগাল পুতুলের মত চেহারা।নাফিসের বউ বুঝি! খুব মিষ্টি বউ পেয়েছে তো।
উঠে দাঁড়ালাম৷
-তুমি বসো। আমি এখুনি আসছি।
উঠে গিয়ে নাফিসকে কল করলাম।ওর নাম্বারে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না অবশ্য তিন বছর আগের সিম চেঞ্জ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কতদিন পর ওর নাম্বারে ডায়াল করলাম। ওর নাম্বার মুখস্থ ছিল।মস্তিস্ক এতকার পরেও বেঈমানি করে নাই দেখছি।
-নাও, পানি খাও৷ আর এত কান্নাকাটি করো না শরীর খারাপ করবে। বামপাশে বাথরুম আছে চোখমুখে জল দিয়ে এসো।
-নাফিসের কোনো খোঁজ পেলেন?
-তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। তোমার সাথে আমার কথা আছে।
মেয়েটা অনিচ্ছাকৃত বাথরুমে গেল। আমিও চা বানাতে রান্নাঘরে গেলাম। সকাল থেকে এক কাপ চা খাওয়ার সুযোগ হচ্ছে না। পট ভর্তি চা নিয়ে এসে দেখি মেয়ে একই ভঙ্গীতে বসে আছে। মুখ স্বাভাবিক৷
-তুমি চায়ে ক’চামচ চিনি খাও?
-এক চামচ। নাফিস বলেছিল আপনি চা,কফি কিছুই খান না।
-আগে খেতে পারতাম না৷ জিহ্বা পুঁড়ে যেত।এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
ও হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিল।
-আমার আবার খুব চায়ের নেশা।
-ভালো তো৷ নাফিসও খুব চা খেত অবশ্য গাঢ় লিকারের রঙ চা।
-আপনার সব মনে আছে দেখছি।
-তা কিছুটা আছে।তারপর তোমাদের সংসার জীবন কেমন চলছে?
-ভালো না৷খুব ঝগড়া হয়।
-তোমার বয়স কম তো৷ একটু বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।পড়াশোনা রানিং?
-জ্বী৷ ইকোনোমিক্স অর্নাস সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।
-বাহ! এতটুকু মেয়ে কি সুন্দর সংসার, পড়াশোনা একসাথে সামলাচ্ছ।
-পারছি না। ছয় মাস হয় নি আমাদের বিয়ে হয়েছে ঝগড়া লেগেই আছে। আপনার হাজবেন্ড কোথায়?
-ও ময়মনসিংহ গেছে৷ নাফিস এরমাঝেই তোমাকে আমার কথা বলে দিয়েছে।কাজটা খুব অন্যায় করছে।
-ও বলতে চায় নি। রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম ভাঙতে দেখি লুকিয়ে লুকিয়ে আপনার প্রফাইল দেখছে।জিজ্ঞেস করলাম, বলল কলেজ ফ্রেন্ড।তারপর বললাম, ফ্রেন্ডলিস্টে নাই কেন?অনেকক্ষণ ভণিতা করার পর সত্যিটা বলল আপনি ওর গার্লফ্রেন্ড ছিলেন।
মেয়েটা মুখ নীচু করল। চোখ আবার ছলছল করছে।
ওর পাশে গিয়ে বসে মাথায় হাত রাখলাম।
-এই, তুমি কাঁদছ কেন? বোকা মেয়ে! সে তো অনেক বছর আগের কথা।
-আপনাকে ও এখনও ভালোবাসে। তাই আপনার প্রফাইলে ঘাটাঘাটি করে।কালরাতে ঝগড়ার সময় বলল…
-কি বলল?
– বলল, ও আপনার কাছে চলে যাবে।একমাত্র আপনিই ওকে ভালো বুঝতেন,শান্তি দিতেন।
-আর তুমি এজন্যে সকাল না হতেই আমার কাছে ছুটে এসেছ? আমার বর ঝগড়া লাগলে বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও, তোমার মুখ দেখলে ঘেন্না লাগে অথচ একরাত পাশে না থাকলে রাতে ঘুম হয় না ওর।
-খুব ভালোবাসে আপনাকে।
-তোমার নামটা জানা হল না।
-নাঈমা হাসান। সবাই রুচি ডাকে।আপনার এখানে ও আসে নাই না?
-না ভাই, আমার বিয়ের পর ওর সাথে আর যোগাযোগ হয় নি।
-বিশ্বাস হচ্ছে না। এতবছর পরও ও আপনার ছবি দেখে আর সব খবরাখবর রাখে৷ আর আপনি বলছেন…
হাসলাম।বিয়ের পর আমিই বরং কয়েকবার ওকে ফোন করেছিলাম, রিসিভ করে নি। আমার প্রতি রাগ,ক্ষোভ দুটোই ছিল। আর অহংকারীও বটে চায় নি আর কখনও মুখদর্শন করতে।
রুচি নিরুত্তাপ।
-আপনাদের ব্রেক আপ হয়েছিল কেন?
-ব্রেক আপ হয় নাই হুট করে আমার বিয়ে হয়ে যায়। সেইম এজ রিলেশনে যা হয় আর কি! ছেলেটা বেকার এদিকে মেয়ের বিয়ের বয়স পাড় হয়ে যাচ্ছে।
-ছবি দেখে আমি ভেবেছিলাম আপনি আরো বেশি ফর্সা।
-না ভাই, তোমার মত রূপবতী নই আমি। চোখমুখের গড়ন অর্ডিনারি। এত ঘনকালো চুলও নেই। এই দেখো স্ট্রেইট করতে এসেছি তারপরও ঘোড়ার লেজ।
-আপনার হাসি সুন্দর।
-তাই? এখন বলো তুমি কি খাবে? আমিও নাস্তা করি নাই। ঝটপট কিছু একটা বলে ফেলো।আড্ডা মারতে হবে তো।
-আমি কিছুই খাব না।
-তা বললে কি হয়! তুমি না খেয়ে থাকলে ও বাড়ি ফিরবে! তুমি বসো। ম্যাগাজিন আছে, পড়বে কিছু?
রুচি ঘাড় নাড়ল।
রুচির কাছ থেকে রান্নাঘরে এলাম নিজের মুখটা আড়াল করতে। আরো কিছুক্ষণ থাকলে কেঁদে ফেলতাম। কয়েকবছর আগে স্বপ্নগুলো দুজনের ছিল আমার আর
নাফিসের। একটা ছোট্ট ঘর, একফালি বারান্দা,দুটো বেতের টেবিল চাওয়া-পাওয়াগুলো খুব বেশি কিছু ছিল না। নাফিস বলত,
-এই তোর চুলগুলো স্ট্রেইট করবি না৷ কোঁকড়া চুলে আঙুল আটকে যায়। মনে হয় তুই নিজেই আঁকড়ে ধরে রেখেছিস।
আমার বরের কোঁকড়া চুল পছন্দ নয়।
রুচি বলে দিল আমি ততটা সুন্দর নয়। সত্যিই তো। নাফিস লতাবরণ কন্যা ডাকত বিয়ের পর জানলাম আমি
শ্যামলা। ও বলত পৃথিবীতে বিখ্যাত চার জোড়া চোখের বাইরেও আরেকজনের চোখ সবচেয়ে সুন্দর সেই মানুষটা তুই।
আমার বর বউয়ের চেহারায় বিশেষত্ব কিছু খুঁজে পায় না।স্ত্রী মানে নিরীহ,ভদ্রগোছের প্রাণী তাকে আলাদা করে কিছু ভাবাটা অন্যায়। না চাইতে গয়না পাচ্ছি, আলমারিতে বিস্তর শাড়ি,দূরে গেলে রোজ একবার করে ফোনে কথা হয় এই কি যথেষ্ট নয়! অতঃপর সুখী থাকো।
মিথ্যা বলেছিলাম, বিয়ের পর নাফিস ফোন করেছিল একবার নয় বহুবার। কত রাত ওর ফোনের ভয়ে নাম্বার বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম। অথচ খুব ইচ্ছা ছিল একটাবার ওর কথা শুনি। তিনটা বছর যে মানুষটা আমার হাসি কান্নার সঙ্গী ছিল, তার জীবনের চরম দুঃসময়ে আমি পাশে ছিলাম না।অন্তত বন্ধু হিসেবে বলতে পারতাম,
-আমায় আর ডেকো না,তুমি ভালো থেক।
ঐযে বললাম একটা সংসার বাঁচাতে গিয়ে মেয়েরা কত স্বপ্ন বিসর্জন দেয়। একটা রাতের সম্পর্ককে স্থায়ী করতে গিয়ে নিজের স্বরুপটাকে খোলস আবৃত করতে হয়।
আপনি একজনৃ মানুষ এপরিচয় নিয়ে কখনই সংসার করতে পারবেন না, মোটের উপর আপনি একজন নারী এই হল আপনার সংসার।
রুটি ভাজলাম। ফ্রীজে রান্না করা মাংস ছিল গরম করলাম, ডিম পোচ করে রুচিকে ডাকলাম।ও খেল একদম কম। এক টুকরো রুটি মুখে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল,
-আপা,আমি সারারাত ঘুমাতে পারি নাই।ও জানে ওর সাথে কথা না বলে আমি একদম থাকতে পারি না। ঝগড়া লাগে,তর্ক হয়। ও আমাকে বাবা-মা তুলে গালিগালাজ করে তবু ওর বুকে মাথা না রাখলে আমার রাতে ঘুম হয় না।
ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।মেয়েজাতটা এমন কেন! এত দুঃখ সয় তবু তাকেই চাই।
-তুমি বাড়ি যাও। দেখবে ও বাড়ি ফিরে এসেছে।এতক্ষণে এসেছেও হয়ত।
-যদি না আসে?
হাসলাম,
-পুরুষেরা নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় এগল্প খুবই কম বরং তারা পান থেকে চুল খসলে পাশের জনকে ঘাড় ধাক্কায় বের করে দিতে আনন্দ পায়।
রুচি আরো খানিকক্ষণ বসে থেকে চলে গেল।
-আপা, ফিরলে আপনাকে ফোন করে জানাব।
-জানাতে হবে না।ও এতক্ষণে এসে পরেছে বোধহয়,তোমাকেই বরং খুঁজছে।
রুচি চলে গেলে ড্রয়ার ঘাটাঘাটি করে পুরানো ডায়েরির ভাজ হতে নাফিসের একটা ছবি বের করলাম।নষ্ট হয়ে গেছে, খালি মুখটা সামান্য বোঝা যায়৷ এই মানুষটা যে প্রেয়সীর জন্যে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জীবনানন্দ দাসের কবিতা আবৃত্তি করত তার মুখে স্ত্রীর জন্যে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ বেরিয়ে আসে।
ভালোবাসা আর নেই বুকের ভেতর অবশিষ্ট কিছু মায়া ছিল তাও কি মন্ত্রবলে আজ গায়েব হয়ে গেছে। নাফিকের ছবিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললাম।
-কি জানি ভাই, স্বামীরা পুরুষ হয়,প্রেমিক নয়।
গল্পঃ পুরুষ
হাবিবা সরকার হিলা