গল্পঃ অনাগত

0
1466

গল্পঃ অনাগত

হাবিবা সরকার হিলা

প্রতি মাসে দু”চারবার মায়েরা আসেন মেয়েদের পেট খালাস করতে। ভদ্রলোকেরা যাকে বলেন অ্যাবরশন বা গর্ভপাত। গ্রাম্য মহিলারা অতশত বুঝেন না। পেটের আপদটারে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে পারলে তারা বেঁচে যান।

তারা সরাসরি ডাক্তার বা নার্সদের সাথে কথা বলতে সাহস পান না। হাসপাতালের বারান্দায় বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে থাকেন। মেয়ে এবং মেয়ের আত্মীয়াদের আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা থাকে। আয়া মতন কাউকে দেখলে ফিসফিস করে ডাকে,

আপা, এট্টু শুনে যান। প্রাইভেট কথা আছে।

এইসব ক্লায়েন্ট ধরার ব্যাপারে সবচেয়ে অভিজ্ঞ নাজমা আপা। ২২ বছর ধরে এই হাসপাতালে স নার্সের দায়িত্বে আছি আট বছর। কেন জানি না নাজমা আপা আমাকে বেশ পছন্দ করেন। এই ধরনের রোগী এলে তিনি ডাকেন,

-আপা, আপনের একটু হেল্প দরকার।

বাবা-মা দুইজনের মতামত ছাড়া গর্ভপাত করাটা রীতিমত বেআইনী।যথাযথ কারণ থাকাটাও আবশ্যক। কিন্তু হায়! যাদের শরীর থেকে এক খণ্ড মাংসপিণ্ড বের করতে হয় তাদের কারোরই বয়স ১৪-১৫ এর বেশি নয়।এমন ও আছে বারো বছরের কন্যাকে মা নিয়ে এসেছেন গর্ভপাত করাতে। বড় বড় চোখ,তেলতেলে চেহারা,বুক আর কোমর পূর্ণাঙ্গ নারীর গঠন পায় নি অথচ দেখো তলপেট ভারী হয়ে শক্ত হয়ে আছে।জিজ্ঞেস করি,

-মেয়ের স্বামী কই?

-অল্প বয়সে মাইয়া বিয়া দিছিলাম। হারামজাদা ভাত-কাপড় দেয় না,পেট বাজাইয়া ভাগছে।দুই পেট চালানোর ক্ষমতা নাই, আপনে খালাস করেন।

-শেষ কবে মাসিক হইছ?

মেয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে।মা বলে,

-ওই তিন চাইর মাস হইব। আপনের পেট ধইরা কি মনে হয় বেশি দেরি হয়া গেছে?

মায়ের মুখ উৎসুক,মেয়ের মুখ ভাবলেশহীন।

প্রথমদিকে মেয়ের মায়েদের সাথে তর্ক জুড়ে দিতাম।
-এত অল্প বয়সে মেয়ের বিয়া দিছেন কেন?
-গায়ে গতরে বড় হইয়া গেছে কি করুম!
-জামাই নয়ত দেখে না, মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন কই?
মেয়ের মা নিরুত্তর।
নাজমা আপা ফিসফিস করে বলে,
-আপা, আপনি উনাদের এখন এই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন,পরে সবটা বুঝায়া বলব।
-আপনি অন্য কাউকে বলেন, আমার দ্বারা এই পাপকাজ হবে না।

কয়েক সপ্তাহ পর আবার একই কেইস হাজির।মেয়ের অভিভাবকের সাথে তর্ক জুড়তেন কলিগ শাহনাজ আপা ডেকে নিয়ে সবটা বুঝিয়ে দিলেন।

-গ্রামে বিশেষত চরাঞ্চলে সেক্স এডুকেশনের বালাই নাই। সন্তান বড় হয়। অার্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও বাবা-মা সন্তানদের জন্যে আলাদা ঘর তোলার প্রয়োজনবোধ করেন না। বয়স্ক ছেলে-মেয়ে এক বিছানায় নিয়ে স্বামী-স্ত্রী ঘুমাতে লজ্জাবোধ করেন না অথচ মেয়ে মাসিক হলে মায়েরা লুকিয়ে রাখে সমাজটা এমন।

-এরসাথে গর্ভপাতের সম্পর্ক কি?

-বলছি,শোনো,

-গ্রামে বিশেষত চরাঞ্চলের মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল একটু আগেভাগেই শুরু হয়ে যায়। ঋতু হবার পর মায়েরা মনে করেন অনেক তো পড়াশোনা হল এবার স্কুল ছাড়িয়ে দেই,ঘরের কাজকর্ম শিখে বিয়ের আগাম প্রস্তুতি নিক। ফ্রক ছেড়ে কামিজ ধরে অথচ নিজের শরীরটাকে রাখঢাক রাখতে শিখে নাড়। এবয়সে স্বভাবতই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আর্কষণ জন্মায় কিন্তু এদের গায়ে আধুনিক হাওয়া লাগে নাই সহজেই চোরাস্রোতে গা ভাসায়৷ অধিকাংশই সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্টের স্বীকার হয় চাচাত-ফুপাতো ভাইদের দ্বারা, পাড়ার ভায়েরাও বাদ যায় না। কিছুক্ষেত্রে নিজেদেরও সায় থাকে। শারীরিক সুখ আর মানসিক অজ্ঞতায় কিছু বুঝে উঠার আগেই কৌমার্য হারায়। গ্রামের বাড়ি গৃহস্থের বাড়ির বউদের একা হাতে সংসার সামলাতে হয়, ধান পাটের মৌসুমে দম ফেলার জো থাকে না।

-কালামের পোলা নানা ছুতোয় বাড়ি আসে, মোখলেসের মেয়ের গায়ে হলুদে আমেনার গাল টিপে দিছে সাগর। এই অপরাধগুলো বাপ-মা ধর্তব্যের মধ্যে ফেলেন না।

-অল্প বয়সী পোলাপান এট্টু তো রঙ্গতামাশা করবই। হাত নেড়ে মুরব্বিরা উড়িয়ে দেন।
মেয়ের শরীরে একমাত্র পোয়াতি হবার লক্ষণ দেখা গেলে বাবা-মায়ের হুশ হয়।

চড়-থাপ্পড়ের চোটে মেয়ে উ করলেই মা মুখ চেপে ধরে।
-চুপ।পাছে লোক জানাজানি হলে কলঙ্ক রটে যাবে না,বিয়ে দেওয়া যাবে না।অতঃপর গর্ভপাত।

কেমন নিথর হয়ে শুনছিলাম।অনেকক্ষণ পর প্রশ্ন করলাম,

-আপা,মেয়েটা যদি ভিক্টিম হয় তাহলে বিচার হয় না?

শাহনাজ আপা চোখ থেকে চশমা খুলে গ্লাস মুছলেন।

-গ্রামের মানুষ থানা-পুলিশ করতে ভয় পায়।গ্রাম্য সালিশ হচ্ছে শেয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেওয়া। মাতব্বরেরা দু’চার ঘা বেতের বাড়ি দিয়ে ছেলে পক্ষের থেকে নগদ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে বা দু’পক্ষের সম্মতিতে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেওয়া হয় শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটার অবস্থা হয় পাপোসের মত।একজন ধর্ষকের কাছে তার স্ত্রী কতটা নিরাপদ বলতে পারো?

সদুত্তর নেই। বিধ্বস্ত হয়ে আপার রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। এরপর থেকে বাচ্চা মেয়ে গুলির শরীর থেকে মাংসপিণ্ড বের করার সময় মনে হত পাপ নয় স্রেফ উপকার করছি।

-মেয়ের শরীরের যত্ন নিয়েন।ঠিকমত দুধ,ডিম খাওয়াবেন।

প্রশ্ন করতাম না৷ কামনা থাকত একটাই মেয়েগুলি যত দ্রুত সম্ভব ক্ষতচিহ্ন মন থেকে মুছে ফেলে নতুন করে বাঁচতে পারে।

এবারের মেয়েটি বিবাহিতা।নাকফুল,হাতে এক গাছা চুড়ি
স্বামীর চিহ্ন বহন করছে। বয়স কত হবে! ১৭ বা ১৮। নেকাব খুলতে তারা ফুলের ছোট্ট একটা মুখ বেরিয়ে এল। বড় বড় চোখের পাঁপড়িতে ঢাকা বিষণ্ণ দু’খানা চোখ। নাজমা আপা আমার কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলল,

-আপা,ঘটনাটা কি বুঝলাম না।মেয়েটার সাথে ওর মা আসে নাই শ্বাশুড়ি আসছে।

শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম,

-বউকে গর্ভপাত করাতে নিয়ে এসেছেন,আপনার ছেলে কোথায়?

-ও মধ্যপ্রাচ্যে থাকে।

-আপনার ছেলে জানে অ্যাবরশন করাচ্ছেন? প্রথম বাচ্চা অ্যাবরশন করা মায়ের স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর।

-জ্বী জানে৷ আমাদের কিছু পারিবারিক সমস্যা আছে।
আপনারা পারবেন তো?

আর কোনো প্রশ্ন না করে মেয়েটাকে অটিতে ঢুকালাম।কিছুতেই মনে সায় দিচ্ছিল না।স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্কে যে ভ্রুণের জন্ম হয় তাকে হত্যা করা মহাপাপ।মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম,

-তোমার নাম কি?

-মুক্তা।

-তোমার সাথে তোমার বাবা-মা কেউ আসে নাই কেন?

-তআমি ক্লিনিকে আসছি কেউ জানে না।

-কেন?

-তারা জানেন না আমি কনসিভ করেছি।

খানিকক্ষণ নীরবতা।মুক্তা বলল,

-আমার স্বামী বাংলাদেশে এসে গেছেন দেড় বছর আগে। আমার বাবা বেঁচে নেই, বিধবা মা ভাইদের সংসারে থাকে।চুপচাপ অ্যাবরশন করা ছাড়া আমার আর উপায় নাই।

-বাচ্চাটা কার?

মেয়েটার মুখ শক্ত। চোখ থেকে ফোটা ফোটা জল গড়াচ্ছে।

– চাচা শ্বশুরের।আম্মা বলেছেন, তার ছেলেকে কিছু না জানাই। নয়ত….

-নয়ত?

-আমার আর স্বামী-সংসার করা হবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে