#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_৬
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“সম্পর্কে থাকাকালীন কখনো এভাবে পাশাপাশি হাঁটার সুযোগ হয়নি। অথচ আজ!”
রায়াদের কথায় কুয়াশা কিছু বলে না। চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটছে সে। রায়াদ আবারো বলে,
“আমাদের সম্পর্কটা অন্যরকম ছিল। আমরা এমন এক সম্পর্কে ছিলাম যেখানে একে-অপরের হাত কখনো ধরতে পারিনি। তোমাকে ছোঁয়া যে বারণ ছিল আমার। কথা ছিল বিয়ের পর সম্পূর্ণ নিজের করে তোমাকে পাব। তার আগে কোনো স্পর্শ নয়। আমি তোমার কথা রেখেছি। তাতে লাভ কী হলো? তুমি কী আমার হলে কুহু?”
কুয়াশা এবার রায়াদের চোখে চোখ রাখে। মেয়েটার দু’চোখ যেন তার ভেতরে জমে থাকা অনেক না বলা কথা বলে দিচ্ছে তার চাহুনির মাধ্যমে।
“নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছি সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। সর্বপ্রথম নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে ভালোবাসি কথাটা বলা থেকে শুরু করে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া, সবকিছু আমিই করেছি। যেগুলো মূলত আপনার করার কথা ছিল। এরপরেও আপনার অভিযোগ একটাই। আমি আমাদের প্রায় দুই বছরের সম্পর্কের জন্য কিছুই করিনি। আমার জন্যই সম্পর্ক ভেঙেছে। সত্যি কী তাই?”
“কুহু বিশ্বাস কর সেই সময় আমি রাগের মা থা য় তোমাকে বিয়ে করে নিতে বলেছিলাম। মন থেকে একটা কথাও বলিনি আমি। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।”
“এসব শুনতে চাই না আমি। বিবাহিত মেয়েকে এসব বলতে লজ্জা করে না আপনার?”
“আমি জানি তুমি ওই তুরাবের সাথে সুখে নেই। ফিরে এসো আমার কাছে। আমি আজও তোমাকে প্রথম দিনের মতো করেই চাই।”
“মনে আছে আপনার? একদিন আপনি আমাকে বলেছিলেন যে কখনো যদি আমি নিজ ইচ্ছায় কারোর সংস্পর্শে যাই তখন আপনি আমাকে আর গ্রহণ করবেন না। আমি তুরাবের কাছে নিজ ইচ্ছাতেই গিয়েছি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা যা হয় আমাদের মধ্যে সব হয়েছে। এরপরও গ্রহণ করবেন আমাকে?”
“তুমি নিজ ইচ্ছায় ওর কাছে গিয়েছ?”
“হ্যা নিজ ইচ্ছাতেই গিয়েছি ওর কাছে। হাজার হলেও সে আমার স্বামী তো!”
“তুমি এটা কী করে করতে পারলে?”
“আপনি যেমন আমার সাথে সম্পর্কে থাকাকালীন সময়ে অন্য মেয়ের সাথে গভীরতার সাগরে ডুব দিয়েছিলেন ঠিক সেইভাবে।”
“আমি কারোর সাথে কখনো থাকিনি। কোনো মেয়েকে স্পর্শ করিনি।”
“তা ঠিক। তবে কথা তো বেশ গভীরভাবেই বলেছেন। অনলাইনে সব হয়ে গেলে অফলাইনে আসার কী দরকার?”
“তুমি আজও একইরকম আছ। একটুও বদলাওনি নিজেকে।”
“কার জন্য বদলাব? বেইমান, বিশ্বাসঘাতকের জন্য?”
“আমারই ভুল হয়েছে তোমার কাছে এতদিন পর আবার ফিরে আসা।”
“এসেছেন কেন?”
“ভালোবাসি যে তাই।”
“ভালোবাসা! কোনটা ভালোবাসা? দিনের পর দিন মিথ্যা বলে ঠকানো আপনার কাছে ভালোবাসা? নাকি রাতের পর রাত আমাকে কাঁদিয়ে নিজে হেসেছেন সেটা ভালোবাসা?”
রায়াদ কোনোকিছু না বলে রেগে বড়ো বড়ো পা ফেলে সেই স্থান থেকে চলে যায়। কুয়াশা তাকে আটকায় না। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে। এই ছেলেটা প্রতিবার এভাবে হুট করে এসে আবার হুট করেই চলে যায়। দুই বছরের সম্পর্কে এমন প্রায় প্রতিবারই হয়েছে। পুরোনো কাজ বিধায় এখন অভ্যস্ত কুয়াশা। তার জীবনে দু’জন পুরুষ এসেছে। দু’জনই তাকে মিথ্যা বলেছে, ভালোবাসার নামে মিথ্যা অভিনয় করেছে, চোখে চোখ রেখে মিথ্যা বলেও জোর গলায় বলেছে সে মিথ্যা বলেনি। ঠকবাজ, বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, এই শব্দগুলো রায়াদ আর তুরাবের সাথে ভালোভাবেই যায়। কুয়াশার এখন মনে হয়,
“ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা, এই শব্দগুলো কুয়াশা নামক মেয়ের জীবনে বড্ড বেমানান!”
ধীর পায়ে রমনার চত্বর থেকে বেরিয়ে আসে কুয়াশা। ব্যস্তময় শহরে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অন্যের দিকে তাকানোর সময় কারোর নেই। নতুবা সবাই দেখতে পেত একটা মেয়ের চোখের কোণে লুকিয়ে থাকা পানি কিভাবে বারংবার উপচে পড়তে চাইছে। আর মেয়েটা অনেক কষ্টে সেই পানি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
“না কুয়াশা না! তুই কাঁদবি না। তোর চোখে পানি একদম মানায় না। কাঁদলে তোকে সবাই দুর্বল ভাববে। সবাই তখন তোর কষ্ট দেখে মজা পাবে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে তোর কষ্ট বহুগুণ বাড়িয়ে তুলবে। মানুষ তো এমনই। একজন কাঁদে তো অপরজন হাসে! এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম।”
নিজেকে নিজেই বোঝাচ্ছে কুয়াশা। নিজের জন্য সে একাই যথেষ্ট। তার ভাষ্যমতে,
“পৃথিবীতে নিজের সেরা বন্ধু হিসেবে কেবল নিজেকেই পাওয়া যায়। কারণ জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু অন্য কোনো সত্তা হতে পারে না। নিজের পরিস্থিতি নিজেকেই বুঝে নিতে হয়। এবং সেই অনুযায়ী মোকাবিলা করতে হয়। আমি কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি এটা কিছু মানুষ অনুভব করতে পারলেও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারবে না কখনোই। সম্পূর্ণ বোঝা একমাত্র নিজ সত্তার দ্বারাই সম্ভব। অন্য কারোর দ্বারা নয়। তাই নিজের প্রকৃত বন্ধু নিজেকেই হতে হবে।”
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কুয়াশার এক রুমমেট আদ্রিতা এসে জিজ্ঞেস করল,
“কুয়াশা তোর প্র্যাকটিস শুরু কবে থেকে?”
“আগামীকাল থেকে।”
“ওও আচ্ছা। এই শোন ঘুরতে যাবি?”
“না রে। ভালো লাগছে না আমার।”
“আরে চল না একটু আশেপাশে থেকে ঘুরে আসি।”
“একটু আগেই বাইরে থেকে এলাম। এখন আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।”
আদ্রিতা কুয়াশাকে টেনে তুলে বলল,
“কোনো কথা শুনব না। বেশি কিছু করতে হবে না। তোকে আমিই তৈরি করে দিচ্ছি।”
অতঃপর আদ্রিতা যত্নসহকারে কুয়াশাকে তৈরি করে দিয়ে বিছানার উপর অনেকগুলো জামা রেখে বলল,
“কোনটা পড়বি বল?”
“আমার যেতেই ইচ্ছা করছে না। আর তুই জামা নিয়ে আসছিস।”
“আরে তাড়াতাড়ি বল।”
“বোরকা পড়ব আমি।”
“আচ্ছা তাহলে আমিও বোরকা পড়ি।”
দু’জন ঝটপট তৈরি হয়ে বের হয়ে গেল বাসার কাছের একটা রুফটপ রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। আদ্রিতা ফোন হাতে নিয়ে কুয়াশাকে বলল,
“ছবি তুলব। একটু সুন্দর করে হাসি দে বোন। এমন গম্ভীর হয়ে বসে আছিস কেন?”
“আমার ভালো লাগছে না।”
“তোর ভালো লাগার জন্য এত চেষ্টা করছি। আর তুই এখনো বলছিস ভালো লাগছে না! কী করলে তোর মন একটু ভালো হবে বল আমাকে। আমি সেটাই করব।”
আদ্রিতার এমন কথায় কুয়াশা চকিত দৃষ্টিতে তাকায় আদ্রিতার দিকে। এই মেয়েটার সাথে কুয়াশার খুব বেশি দিনের পরিচয় নয়৷ হবে বছরখানেক ওর সাথে পরিচয়ের। তার মধ্যেই মেয়েটা এত ভাবছে ওর জন্য! কুয়াশা ঢাকা থেকে চলে যাওয়ার সময় আদ্রিতার ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। প্রতিদিন ফোন করে কুয়াশার খবর নিত। মাঝখানে যোগাযোগ বন্ধ থাকলেও আদ্রিতা নিজেই একদিন কুয়াশাকে কল দিয়ে কথা বলে। তারপর থেকে আবারো নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয় তাদের মধ্যে।
এসব মনে করে কুয়াশার মুখে আপনাআপনি হাসি ফুটে ওঠে। এই সুযোগে আদ্রিতা কুয়াশার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নেয়। তারপর বলে,
“হাসলে তোকে ভারি মিষ্টি লাগে। আগে কত হাসিখুশি ছিলি তুই। এখন কী হয়েছে তোর?”
“তুই তো জানিস আমার অবস্থা!”
“হুম জানি। কিন্তু তুই তো ভেঙে পড়ার মতো মেয়ে না কুয়াশা। তোকে শক্ত হতে হবে। যারা তোকে কষ্ট দিয়ে ভালো আছে তাদের জন্য তুই কেন কষ্ট পাবি? বরং নিজেকে এমনভাবে তৈরি কর যেন একদিন তারা সবাই তোকে দেখে আফসোস করে। তোকে হারানোর জন্য আফসোস করে। নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব কিন্তু নিজেরই। অন্যের হাতে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দিলে ভালো থাকাটাই হারিয়ে যায় কুয়াশা।”
“ঠিকই বলেছিস তুই। আমার নিজেকে ভালোবাসতে হবে। আমি যদি নিজেকেই ভালোবাসতে না পারি তাহলে অন্যরা আমাকে কিভাবে ভালোবাসবে!”
কথাটা বলে কুয়াশা নিজে থেকেই হেসে আদ্রিতার সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে যায়। হাসি না আসলেও হাসতে হবে। বেশি বেশি হাসতে হবে। যেন কান্নারা হাসির কাছে হেরে গিয়ে পালিয়ে যায় বহুদূরে!
চলবে??