#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_৪
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“আমার এত দিনের সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। এত দূর এসেও হেরে গেলাম আমি। কুয়াশাকে নিজের হাতের মুঠোয় আনার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। এখন এই সম্পর্কে থেকে কি করব আমি!”
বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসে কথাগুলো বলছে তুরাব। তুরাবের এক বন্ধু মেহেদী কিছু একটা ভেবে বলল,
“শোন তুরাব, কুয়াশা সব জেনে গিয়েছে তো কী হয়েছে? আইনগতভাবে সে এখনো তোর স্ত্রী। তাই ওকে তোর কাছে ফিরতেই হবে।”
মেহেদীর কথার প্রতিত্তোরে মিরাজ হেসে বলে,
“কুয়াশা আইনের ছাত্রী। গতবছর এলএলবি সম্পন্ন করেছে। হয়তো সামনে আইনজীবী হবে। সেই মেয়েকে আইন শেখানোর দরকার হবে না নিশ্চয়ই।”
তুরাব সবার কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বলে,
“ওই মেয়ের সাথে সংসার করার নাটক আর করার প্রয়োজন নেই আমার। সুতরাং ওকে ডিভোর্স দিয়ে আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব। কুয়াশার প্রতি তো আমার সত্যিকারের কোনো অনুভূতিই নেই। এই সম্পর্ক রেখে কোনো লাভ আছে? আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে পারব না আমি।”
“তাহলে তুই ওকে কল দিয়ে ডিভোর্সের কথা বল।”
সিয়ামের কথায় মিরাজ অবাক হয়ে বলে,
“এমন বউ আমি পেলে কখনো ডিভোর্স দেওয়ার কথা বলা তো দূরে থাক, মুখেও আনতাম না। তুরাব ভাই তুই খুব বোকা। নয়তো এমন বউকে কেউ ছাড়তে চায় নাকি? আরো একবার ভেবে দেখ। এতদিন তো ভালোবাসার নাটক করলি। এইবার নাহয় সত্যি সত্যি ভালোবেসে কাছে আয় দু’জন। সব মিটমাট করে নে ভাই।”
“এই তুই চুপ কর তো। ওর মতো অনেক মেয়ে পেয়ে যাব আমি। মেয়ে নিয়ে ভাবছি না আমি। ওর থেকে আপাতত মুক্তি লাগবে আমার।”
“যা করবি ভেবে করিস।”
মেহেদী তুরাবকে কথাটা বলার পর তুরাব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আচ্ছা আমি এখন আসি। তোরা আড্ডা দে।”
সিয়াম তুরাবকে আটকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“বাসায় যাচ্ছি। কুয়াশার সাথে কথা বলতে হবে আমার।”
এটুকু বলে চলে যায় তুরাব। বাকি বন্ধুরা আবার আড্ডায় মেতে ওঠে। বাসায় গিয়ে তুরাব কোনোরকমে ফ্রেস হয়ে কুয়াশাকে কল দেয়। কুয়াশা কল রিসিভ করতেই তুরাব বলে,
“তোমার সাথে প্রেমালাপ করার জন্য কল দিইনি। তুমি যখন সবকিছু জেনেই গিয়েছ তখন আমাদের আর এই সম্পর্কে থাকার কোনো মানে হয় না। আমি ডিভোর্স চাই। এতে তুমিও মুক্ত হবে আর আমিও।”
“কিন্তু আমি তো মুক্ত হতে চাই না তুরাব।”
“মানে?”
“মানে আমি আপনাকে ডিভোর্স দিব না।”
“কিন্তু কেন? এই সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে লাভ কী? তুমি তো আমার সাথে সংসার করবে না। আর আমারো তোমার সাথে সংসার করার কোনো ইচ্ছা নেই। এমনিতেও আমার ইচ্ছা তো পূরণ হয়ে গিয়েছে। তিন্নিকে কিছুটা হলেও কষ্ট দিতে পেরেছি। আর কিছু লাগবে না আমার।”
“আমার লাগবে যে!”
তুরাব এবার কিছুটা রেগে প্রশ্ন করে,
“এই মেয়ে কী চাও তুমি?”
“আপনার জীবনে থাকতে চাই। ভাব্বেন না যে ফিরে যেতে চাইছি আমি। আপনার মতো জঘন্য মানুষের সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি আপনার কাছে থাকব না। তবে আমাদের সম্পর্ক থাকবে।”
“তুমি ডিভোর্স দিয়ে দাও আমাকে। আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করতে পারব না আমি।”
“আমার জীবন নষ্ট করার সময় এই কথা মনে ছিল না? আপনার জীবনটাই জীবন। আর আমার জীবন ফেলনা হ্যা?”
“এক বছরও হয়নি আমাদের বিয়ে হয়েছে। এই বিয়ে ভেঙে গেলে কী এমন হবে? সবচেয়ে বড়ো কথা হলো আমরা কেউই একসাথে থাকতে চাই না। তাহলে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উত্তম নয় কী?”
“আমি এই বিয়ে ভেঙে ফেলতে চাই না। এই সম্পর্ক আমি যতদিন চাইব ততদিন পর্যন্ত থাকবে। আমার কথা বুঝতে পেরেছেন আপনি?”
“দেখ তুমি আমাকে সহজে ডিভোর্স না দিলে আমি কিন্তু কোর্ট পর্যন্ত চলে যাব।”
“আপনি আমাকে কোর্টের ভয় দেখাচ্ছেন? হাস্যকর না? আচ্ছা শুনুন, আপনি চাইলে কোর্টে যেতেই পারেন। ডিভোর্সের আবেদনও করতে পারেন। আমি ডিভোর্স দিয়ে দিব সেটাও কথা দিচ্ছি। তবে এসবের জন্য আপনাকে গরাদের পেছনে দীর্ঘ সময় কাটাতে হবে। এতে আপনি রাজি তো?”
কুয়াশার কথা কিছু বুঝতে না পেরে তুরাব প্রশ্ন করে,
“মানে?”
“আপনি কোর্টে গেলে আমিও তো যেতে পারি। আইন সম্পর্কে আপনার থেকে কিছুটা হলেও ভালো জানি আমি। আপনি যে আমাকে ঠকিয়েছেন তার জন্য প্রতারণার কেস করতে পারি। পরকীয়ার জন্য এবং আমার উপর মানসিক নির্যাতনের জন্যও কেস করতে পারি। এসবের ফলে আপনাকে যেতে হবে গরাদের পেছনে। তারপর আমার আপনাকে ডিভোর্স দিতে আর কোনো আপত্তি থাকবে না। এখন আপনিই ভেবে দেখুন, ডিভোর্স নেওয়ার জন্য গরাদের পেছনে যাবেন? নাকি এই সম্পর্ক নষ্ট না করে স্বাধীনভাবে বাইরে ঘুরে বেড়াবেন?”
কুয়াশার কথায় তুরাবের রাগে সম্পূর্ণ শরীর কাঁপছে। কখনো কোনো মেয়ে তাকে এত কথা শোনায়নি। আর এই মেয়ে তো তাকে সোজা গরাদের পেছনে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। তুরাব রাগে চিৎকার করে ওঠে।
“তোমাকে আমি দেখে নিব কুয়াশা। তোমার জীবন ন র ক করে তুলব আমি।”
“এসবের কী কিছু বাকি রেখেছেন? এতদিন আপনি আমার জীবন নিয়ে খেলেছেন। এখন আমার সময় আপনার জীবন তছনছ করার। আগে ঘুড়ি ছিলাম আমি। লাটাই ছিল আপনার হাতে। এখন থেকে ঘুড়ি আপনি। সেই ঘুড়ির লাটাই এখন কার হাতে বলুন তো? আমার হাতে! ভবিষ্যতে আপনার সাথে ঠিক কি কি হবে সেটা এখনো কল্পনা করতে পারছেন না আপনি। তবে প্রস্তুত হোন। মানসিক অশান্তিতে পা গ ল হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিন এখন থেকেই।”
কথাগুলো বলে কুয়াশা মুচকি হাসে। তার চোখেমুখে আলাদা এক ধরনের উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে। যে মেয়েটার জীবনে দুই দিন আগে ভয়াবহ একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে সেই মেয়ে এখন স্বাভাবিক। কি চলছে তার তুখোড় বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মস্তিষ্কে তা কেবল সেই জানে। মলি ঘরে ঢুকে কুয়াশাকে হাসতে দেখে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“এমন করে হাসছিস কেন?”
“ওও কিছু না। মা কোথায় রে?”
“টিভিতে নাটক দেখছে আন্টি।”
“আমার সাথে আয়।”
কুয়াশা মলিকে নিয়ে মায়ের পাশে বসে বলে,
“মা আমি বার কাউন্সিলর সনদ নেওয়ার জন্য ঢাকায় যেতে চাই।”
“তুমি কী এখন থেকেই প্র্যাকটিস শুরু করতে চাও?”
“হ্যা মা। কিছুদিন আগেই তো আমার এলএলবি সম্পন্ন হলো। এখন প্র্যাকটিস না করলে সমস্যা হবে৷ তাছাড়া বাসায় বসে থাকার চেয়ে কাজে মনোযোগ দেওয়া ভালো।”
“ঠিক আছে। কবে যেতে চাচ্ছ?”
“আমি যার আয়ত্তে থেকে কাজ করব তার সাথে কথা বলে নিয়েছি আমি। আগামীকালই আমি রওনা দিতে চাই। আমার থাকার কোনো অসুবিধা হবে না। সবকিছু ঠিকঠাক করে নিয়েছি আমি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যেখানে ছিলাম সেখানেই উঠব আবার।”
“একা একা সব সামলাতে পারবে তো?”
“মা আমি তোমার মেয়ে। আমি না পারলে আর কে পারবে?”
“তুমি আমার অনেক আদরের মেয়ে। তোমার কিছু হলে আমার সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। চিন্তা হয় আমার তোমাকে নিয়ে।”
মলি এতক্ষণ নিরব দর্শকের মতো মা-মেয়ের কথা শুনছিল। অবশেষে নিজের মুখ খুলল সে।
“আন্টি আমি আর ছয় মাসের মধ্যেই হয়তো ঢাকায় চলে যাব। এই ছয় মাস কলি একা থাকুক। এরপর আমরা দু’জন একসাথে থাকলে আর চিন্তা করতে হবে না। ঢাকায় আমাদের বেশ কয়েকজন পুরোনো বন্ধুবান্ধবও আছে।”
“আচ্ছা কুয়াশা শোনো, আমি তোমার বাবার সাথে তোমার বিষয়ে কথা বলেছি। তেমার বাবা, ভাই, ফুপি সবার মতামত হলো তুমি ওই ছেলেকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন করে সবটা শুরু কর।”
“এসব নিয়ে এখন কথা বলতে চাচ্ছি না আমি। ভবিষ্যতে এই বিষয়ে ভেবে দেখব। আপাতত ডিভোর্স নিয়ে কিছু ভাবতে চাই না আমি।”
চলবে??