#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_চৌদ্দ
‘তুমি কি বাইরে গিয়া বইলা দিবা আমার কথা?’ শমসের একটু দ্বিধা নিয়েই প্রশ্নটা করল।
সুফিয়াও দ্বিধায় আছে। তবে এই ছেলেটাকে তার শুরু থেকেই ধান্দাবাজ মনে হচ্ছে না। কেন জানি মনে হচ্ছে একে কেউ ফাসিয়েছে। কে ফাসাল? এটা আগে জানতে হবে। শমসেরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সুফিয়া তাকে অন্য কথা জিজ্ঞেস করল।
‘আপনের কুনো শত্রু আছিল যে আপনের নামে মিথ্যা কথা কইতে পারে?’
‘আমি তো সেইরকম কুনো শত্রুর কথা জানি না। তয় ছিল হয়ত! আমার শত্রু না হইলেও আমার মনিবের যে ম্যালা লোকেই শত্রু আছিল এইটা আমি ভালা কইরাই জানি!’
‘আপনে এইখানে একা একা থাকেন… আপনেরে জিনিসপাতি কে আইনা দেয়? মন্দিরের মইধ্যে তো ম্যালা জিনিসপাতি আছে!’
‘দেয় একজন। তার নাম তুমার কাছে কওন যাইব না। তার নিষেধ আছে।’
‘ওহ আইচ্ছা। অখন আপনে কন আমি আপনের কী কামে লাগতে পারি!’ সুফিয়া পাকা চুক্তিবাজের মতো বলল।
‘তুমি এট্টু আগে পুলিশের কথা কইতাছিলা। তুমি কি সত্যি সত্যি পুলিশের কাছে যাইতে পারবা?’
সুফিয়া সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় কাত করে জানায় যে সে তা পারবে। শুনে শমসের বলে, ‘আইচ্ছা তাইলে পুলিশের কাছে একটা খবর দিতে হইব। কইবা যে, জঙ্গলের যেই সাইডে ঝর্ণা আছে… মানে জঙ্গলের পূর্ব পাশে… সেই খানে দামি আগর গাছ আছে। এই গাছ ম্যালা দামি। এই জঙ্গলে একটা বড় জায়গা জুইড়া এই আগর কাঠের গাছ আছে। তুমি কি জানো এই আগর গাছের দাম কেমুন? তুমার কইলাম জানার কথা না!’
‘দাম কেমুন?’
‘প্রতি কেজি কাঠ বিক্রি হয় প্রায় তিন চার লাখ টাকায়!’
শুনে সুফিয়ার চোয়াল ঝুলে পড়ার অবস্থা হলো। এত দাম? সে বলল, ‘আপনে এই গাছের কথা ক্যামনে জানলেন? আর কী হইছে সেই গাছের?’
‘এই গাছগুলান এই এলাকার সম্পদ, দ্যাশের সম্পদ। কিন্তু সেই সম্পদ বিদেশে পাচার হইতাছে। আমাগো দেশের বর্ডার দিয়া রাইতের বেলা অন্যদেশে চইলা যাইতাছে।’
সুফিয়ার মনে পড়ল, কথা প্রসঙ্গে সে জামান শিকদারের কাছে ঝড়ে বক মারার মতো এই গাছ কেটে ফেলার কথাই বলেছিল। সেই কথাই এভাবে ফলে গেল! সে বলল, ‘আপনে জানেন গাছ কেডায় কাটে?’
‘আমি জানি না। আমারে একজন কইছে। কিন্তু সে পুলিশের কাছে যাইব না। তার অসুবিধা আছে। কীয়ের অসুবিধা সেইটা আমারে জিগাইও না। কইতে পারুম না। গাছ রাইতের বেলা কাটতে আসে। আমি লোকজনের আওয়াজ পাইছি। কিন্তু বাইর হই নাই। আমি বাইর হইলে আমার বিপদ হইব। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করব না। আমারে ধইরা নিয়া যাইব! তুমি তো জঙ্গলে মাঝে মইধ্যে আসো, ঘুরাফিরা করো। পুলিশের কাছে গিয়া কইবা, তুমি গাছ কাটতে দ্যাখছ।’
‘তারপর পুলিশ যদি আমারে সেই জায়গা দেখাইয়া দিবার কয়?’
‘দেখাইয়া দিবা! চলো আমি তুমারে দেখাইয়া দেই। একবার দ্যাখলেই চিনতে পারবা।’
এরপর শমসের সুফিয়াকে নিয়ে গেল সেই আগরগাছে ঘেরা জায়গাটার কাছে। এত দামি গাছ এখানে এভাবে সারি সারি লাগানো আছে দেখলে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। মনে হয় কেউ বুঝি পরিকল্পনা করে গাছগুলো লাগিয়েছে। আশেপাশে অন্য গাছপালাও আছে। সুফিয়া এই দামি গাছের কথা জীবনে প্রথমবার শুনল। লম্বা গাছটা তেমন একটা মোটা না। ইউক্যালিপটাস গাছ দেখেছে সুফিয়া। দেখতে অনেকটা সেই গাছের মতো। গাছের পাতাগুলো তেজপাতার মতো। অবাক হয়ে গাছগুলো দেখতে দেখতে সুফিয়া জিজ্ঞেস করল,
‘কী কামে লাগে এই গাছ? আর গাছে এত ছিদ্র করছে ক্যান? পেরেক মাইরা থুইছে অনেক গাছে! এগুলান কীসের লাইগা?’
‘আগর গাছ ম্যালা কামে লাগে। আগর তেল দিয়া সাজগোজের জিনিসপাতি বানান যায়। আতর হয় এই তেল দিয়া। আগরবাতি দ্যাখছ না? সেইটাও এই গাছের কাঠ দিয়া হয়। ছিদ্র করছে কারণ এই ছিদ্র করা হইলে গাছে ক্ষত হয়। সেই জায়গাডা কালো হইয়া গেলে তখন সেই কাঠ কাইটা নিয়া যায়। ঐ কালো কাঠ দিয়াই আগর তেল হয়। নানারকম পদ্ধতি আছে তেল করোনের।’
সুফিয়া অবাক হয়ে শুনল। ছেলেটার জ্ঞানের পরিধি দেখেও অবাক হলো। নিখাদ বিস্ময়েই বলে উঠল, ‘আপনে তো ম্যালা কিছু জানেন! এত কিছু জানেন আর গাছ কেডা কাইটা নিতাছে এইটা জানেন না?’
শমসের একটু কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘এক্কেরে কিছু জানি না কইলে ভুল হইব। তয় পুরাপুরি নিশ্চিত না।’
‘তাইলে আগে এইটা বাইর করেন এই গাছ কারা কাটতাছে। কারণ আমি যদি পুলিশরে খবর দেই তাইলে পুলিশ আইসা সবার আগে আপনারে ধরব। আর আপনে যদি কইবার পারেন যে গাছ কারা কাটতাছে তাইলে পুলিশ আপনেরে ধরলেও আপনে বাঁচতে পারেন!’
শমসের মনে মনে স্বীকার করল, এই তের চৌদ্দ বছরের মেয়েটি প্রখর বুদ্ধিমতী। তবে সে যা বলছে পুরোটা বুঝে বলছে না। শমসের গাছ কারা কাটছে এটা বলে দিলেও পুলিশ তাকে ছাড়বে না। কারণ পুলিশ তাকে ছাড়লেও চেয়ারম্যান সাহেব তাকে ছাড়বে না। এখানে মহা ঘাঁপলা আছে। এত কথা একে বুঝিয়ে বলা সম্ভব না। তাই শমসের সংক্ষেপেই বলল, ‘আমি পলাইতে পারুম, তুমি আমার চিন্তা বাদ দাও। তুমি খালি আমারে এইটা কইয়া যাও পুলিশরে খবর দিবা কুনদিন? আইজ দিবার পারবা?’
‘হ পারুম! কিন্তু গাছ কে কাটতাছে সেইডা তো আপনে জানেন না!’
শমসের চিন্তায় পড়ল। গাছ কে কাটছে এই খবর একজন জানে। কিন্তু সে এখন কিছুতেই মুখ খুলবে না। তার সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নেওয়া দরকার।
‘আচ্ছা তুমি তাইলে পুলিশরে খালি এইটা কইয়ো, তুমি জঙ্গলের এক জায়গায় কাটা গাছের খণ্ড দ্যাখছ। ব্যস! বাকি কাম পুলিশের!’
সুফিয়া আর কিছু বলল না। এটাই ঠিক আছে। তার এত বেশি কথা পুলিশ শুনবে কেন? সে শুধু গিয়ে বলে আসবে যে, সে জঙ্গলে কাটা গাছ দেখেছে। কেউ এই জঙ্গলের গাছ কাটছে।
তবে তার এই ছেলেটার জন্য এখন চিন্তা হচ্ছে। সে যদি ধরা পড়ে যায়? ছেলেটা কি সত্যিই খুন করেনি নাকি তাকে মিথ্যা কথা বলছে? চোখমুখ দেখেই কি সবসময় মানুষ চেনা যায়?
ওদিকে পুলিশস্টেশনে বসে জামান শিকদার পুরনো ফাইলপত্রগুলো ঘাটাঘাটি করছিল। এলাকার যত চোর ছ্যাঁচড় আছে, তাদের নামে যতরকম কেস আছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে দেখছিল সে। আগের ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলার আগে একবার ফাইলগুলোতে নজর বুলানো দরকার।
দেখতে দেখতেই একটা ফাইল দেখে একটু থমকাল জামান শিকদার। আপাতদৃষ্টিতে সেরকম কোনো বিশেষ ফাইল না। তবু রেকর্ডে যেটুকু তথ্য দেওয়া আছে সেটা যেন অসমাপ্ত। ফাইলে একজন গ্রাম্য ব্যক্তির ছবি। তাকে চোরাচালানের অপরাধে ধরা হয়েছিল। সামান্য কিছু জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছিল তার কাছ থেকে। এখন যেসব গ্রামবাসী এটা সেটা জিনিস বর্ডারের ওপারে পার করে দেয়, সেরকমই কিছু মামুলী জিনিস। কিন্তু যে জিনিসটা দেখে ফাইলে চোখ আটকে যায়, তা হলো লোকটা জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে হার্ট এ্যাটাকে মারা যায়। ফাইলটা সেখানেই ক্লোজ করা। আরেকটা রহস্যময় ব্যাপার হচ্ছে ফাইলের শেষে লাল কালিতে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকা আছে। ব্যস এতটুকুই! ঐ প্রশ্নবোধক চিহ্নটা দেখে কী যেন মনে হয়। এই চিহ্নটা কেন আঁকা হয়েছে সেখানে?
ফাইলের তারিখ দেখল জামান শিকদার। আগের ওসি সাহেবের মেয়াদেই ফাইলটা ওপেন করা হয়েছিল। ছোটখাট চোর ছ্যাঁচড়দের ধরার পরে যে এরকম ফাইল রাখা হয় সেটাও জামান শিকদারের কাছে নতুন। এই লোকটার কাছে তো এমন কিছু আহামরি জিনিসও ছিল না! তাহলে এই ফাইল তৈরির পেছনে কারণ কী!
অন্যান্য কাগজপত্র ঘেঁটে রহস্যজনক কিছুই তেমন পাওয়া গেল না। জামান শিকদার একটু দোনোমোনো করতে করতে ওসি আব্দুস সোবহান সাহেবকে ফোনটা দিয়েই ফেলল।
‘হ্যালো সোবহান ভাই, আমি কদমপুর থানার ওসি জামান শিকদার বলছি। ভালো আছেন?’
‘ওহ… জি আলহামদুলিল্লাহ ভাই ভালোই আছি এখন বলতে পারেন। তা আমাকে কেন স্মরণ করলেন জামান সাহেব?’
জামান শিকদার প্রশ্ন করতে একটু ইতস্তত করছিল। কাউকে এমন প্রশ্ন করা যথেষ্ট বিব্রতকর। তবু চোখ কান বন্ধ করে প্রশ্নটা করতেই হলো। ‘সোবহান সাহেব, আমার প্রশ্নটা শুনে দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। খুব বিপদে পড়েই আপনাকে এই আপত্তিকর প্রশ্নটা করছি।’
‘কী ব্যাপার বলুন তো? এত দ্বিধা রাখবেন না মনে। যা জানতে চাইছেন খোলামনেই জিজ্ঞেস করুন। আমি আসলে মনে মনে আপনার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম এতদিন। ফোনটা আসছিল না দেখেই অবাক হচ্ছিলাম!’
জামান শিকদার মনে মনে অবাক হলো। ফোনের অপেক্ষাতে ছিলেন? তার মানে তিনি জানতেনই যে জামান শিকদার এই বিপদে পড়বেই!
‘ভাই আপনাকে এখান থেকে বদলী করা হয়েছিল কেন?’
‘আসল কারণটা তো আমার জানার কথা নয় ভাই! যেটুকু ওপরওয়ালা জানিয়েছে সেটুকুই জানতে পেরেছি। হেড অফিস থেকে এসপি স্যার জানিয়েছিলেন যে, আমার প্রগ্রেস ফ্রুটফুল না। আমার চাকরিকালীন সময়ে নাকি ঐ অঞ্চলে চুরি ডাকাতি খুন চোরাচালান এসব বেড়ে গেছে। অথচ আমার রেকর্ড মোটেও তা বলেনি। চুরি ডাকাতির ঘটনা তো ঘটেইনি। চেয়ারম্যান সাহেবের ভাইয়ের খুন হয়েছিল, কিন্তু সেটাতে আমি হাত দেওয়ার আগেই তো আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো!’
জামান শিকদার নড়েচড়ে বসল। বলল, ‘আপনি নাকি কিছু একটা জানতে পেরে হেড অফিসে যোগাযোগ করেছিলেন! কী সেটা বলা যাবে?’
‘নিশ্চয়ই বলব ভাই। দেখেন আপনি কিছু করতে পারেন কী না। কোথা থেকে যে বাঁধা আসছে তা জানার আগেই তো সরিয়ে দিলো। আপনি কাজ শুরু করলে একটু সাবধানে গোপনে কাজ করবেন, যেন কেউ কিছু জানতে না পারে। আরেকটা কথা, চেয়ারম্যান সাহেবকে খবরদার এই ব্যাপারে কিছু বলবেন না!’
জামান শিকদারের মাথায় বাজ পড়ল। প্রথমেই এই সাবধানবাণী! অথচ সে কী না সবার আগে উনার সঙ্গেই পরামর্শ করতে যেত!
‘আমি একটা অদ্ভুত কথা জানতে পেরেছিলাম ভাই। জানি না সত্যতা কতটুকু। একদিন কদমপুর থানায় একটা ছিঁচকে পাচারকারী ধরা পড়ে। এটা সেটা ওপাড়ে চালান করে। তাকে ধরে দুই একটা উত্তম মধ্যম দিয়ে কথা বের করার জন্য আমার এক কনস্টেবলকে লাগাই। সে অল্প কিছুসময় পরে এসেই বলে, লোকটা নাকি অসুস্থ বোধ করছে। আমি তাড়াতাড়ি সেখানে যাই। দেখি সে ছটফট করছে। বারবার নিজের এক বাহু দেখিয়ে বলছিল, ‘বিষ দিছে! বাঁচুম না!’
আমি বারবার জিজ্ঞেস করি, সে আর কিছুই বলতে পারে না। শুধু হাত দিয়ে নিজের লুঙ্গির নিচে কী যেন দেখাচ্ছিল। পরপরই মুখে ফেনা উঠে লোকটা মারা যায়।
আমরা তার লুঙ্গির নিচটা পরীক্ষা করে সেখানে একটা পকেট মতো জায়গা দেখতে পাই। পকেটটা সেলাই করা ছিল। সেই পকেটের মধ্যে থেকে বের করা হয় এক খণ্ড কাঠের টুকরা। কালো হয়ে যাওয়া কাঠের টুকরা। নাকের কাছে নিয়ে পরখ করতেই চমকে উঠি। আগর কাঠ! তার মানে লোকটা আগর কাঠের স্যাম্পল দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। টুকটাক চোরাচালানের জিনিসপাতি সব আসলে চোখকে ফাঁকি দেওয়া। আসল জিনিস ওটাই ছিল!’
জামান শিকদার রুদ্ধশ্বাসে শুনতে থাকে। আব্দুস সোবহান বলে যেতে থাকে, ‘আমি ব্যাপারটা জানিয়ে হেড অফিসে ফোন করি। সেখান থেকে আমাকে জানানো হয় অল্পসময়ের মধ্যেই তারা ফোর্স নিয়ে এসে দেখে যাবে। কিন্তু বেশ অনেকটা সময় পার হওয়ার পরেও যখন কেউ আসে না, তখন আমি সদরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। পথেই বদলির ফোন পাই।’
জামান শিকদার সব কথা শুনে স্থবির হয়ে বসে থাকে কিছুটা সময়। আব্দুস সোবহান বলে, ‘আপনি খোঁজ নেন, সেখানে আগর গাছ আছে কী না। আপাতত এটাই আপনার প্রধান কাজ। একটা দিয়ে কাজ শুরু করেন। আমার কেন জানি মনে হয়, এটা ধরে টান দিলেই চেয়ারম্যান সাহেবের ভাইয়ের খুনিকেও পেয়ে যাবেন!’
ফোন রেখে জামান শিকদার গভীর ভাবনায় ডুবে যায়। ভাবনার মাঝে ছেদ পড়ে পিওনের হাঁকে।
‘স্যার একটা মাইয়া আপনার লগে দেখা করতে চায়। নাম কইতাছে সুফিয়া। ভেতরে নিয়া আসুম?’
জামান শিকদার অবাক হয়। সেদিনের সেই মেয়েটা! আজ কী হয়েছে তার? পিওনকে বলল, ‘নিয়ে এসো!’ (ক্রমশ)
#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_পনের
চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ আজ একটু খোশমেজাজে আছে।
ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে নানা কারণে তার মনমেজাজ ভালো থাকে না। সব মন খারাপের কারণ সবার কাছে বলাও যায় না। ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য তিনি যে একটু বিশেষভাবে শোক করবেন, সেটাও করবার উপায় নাই। মানুষের নজর এত খারাপ! ওপরে ওপরে কেউ কিছু না বললেও লোকে আড়ালে কী বলে বেড়ায়, সেটা ভালোই জানা আছে তার। কিছু কিছু কথা তো তার সাগরেদ মোস্তাকই তাকে বলেছে। অবশ্য সে বেশি কথা বলে। তার সব কথাকে আব্দুল লতিফ তেমন গুরুত্ব দেয় না। ছেলেটা এমনিতে কাজের আছে। দরকারে জান দিয়ে দিতে পারে। শুধু এই অহেতুক প্যাঁচালটা একটু হজম করে নিতে হয়, এই যা!
‘হুজুর, মাইনষে কইতাছে আপনে নাকি ভাইয়েরে হিংসা করতেন। তার ব্যবসা বাণিজ্যের দিকে আপনের নজর পড়ছিল! বেবাক কিছু দখল করোনের পাঁয়তারা করতাছিলেন!’
‘কুন হালায় এই কথা কইছে ব্যাডারে আমার সামনে নিয়া আয়! আমার ভাইয়ের কিয়ের হাতিঘোড়া ব্যবসা আছিল যে আমি হেইডার পিছে লাগুম!’
‘মাইনষে আরো কয়, আপনে নাকি নিজে লোক লাগাইয়া ভাইরে মারছেন! আমি না হুজুর… মাইনষে কয়।’
‘হারামজাদা তুই যাইবি আমারা এনে থেইকা? আমার তো মন কইতাছে এইগুলান কথা তুইই কইয়া বেড়াস!’
‘মায়ের কিরা হুজুর! আমু কমু কুন সাহসে? মাইনষে কইয়া বেড়ায়!’
আজ আব্দুল লতিফের মেজাজ ভালো আছে কারণ তিনি তার ছোটপুত্রের কাজকর্মের দিকে মনোযোগ দেখে খুব খুশি হয়েছেন। আপাতত রুবেলকে তিনি তার ছোটভাইয়ের ব্যবসাটাই দেখতে বলেছেন। লোকে যা বলে বলুক, ভাইয়ের যেহেতু কোনো ওয়ারিশ নাই তার ফেলে রেখে যাওয়া ব্যবসাবাণিজ্য তো তাদেরকেই দেখতে হবে! সেগুলো তো আর নিলামে চড়িয়ে দিতে পারেন না!
রুবেলকে দায়িত্ব দিয়ে আব্দুল লতিফের বেশ একটু চিন্তাই ছিল। এসব কাজ বুঝে উঠতেও তো সময় লাগে! কিন্তু রুবেল দেখা যাচ্ছে খুব দ্রুতই সবকিছু শিখে ফেলেছে। ঢাকা থেকে পাইকারি দরে কাপড় কিনে আনা থেকে শুরু করে দোকানে মালামাল বুঝে দেওয়া, ভালো সেলসম্যান রাখা… সবকিছুই সে একা হাতে সামলাচ্ছে। আগে শমসের ছেলেটা এসব দিক দেখত। কিন্তু সে তো তার অন্নদাতাকে খুন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় যে পালিয়ে আছে হারামজাদা! এখন পর্যন্ত তার টিকিটারও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ তো কম করলেন না! কিন্তু ব্যাটা কেমন জানি ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে!
শমসের ছেলেটাকে তার এমনিতে খারাপ মনে হয়নি কখনো। কথা কম বলত। কিন্তু সেটা তো কোনো দোষের কিছু না। এভাবে খুন করে পালিয়ে যাওয়ার মতো ধূর্ত ধান্দাবাজ মনে হয়নি তাকে। আর আব্দুল রফিকের সঙ্গে তার কীসের এত গ্যাঞ্জাম চলছিল সেটাও এখন আর জানার উপায় নাই। কদমপুর থানায় ওসিগুলাও আসে সব একেবারে ম্যান্দামারা। কেউ যে কেস হাতে নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে সমাধান করবে এত বড় এলেম কারো নাই। যা করার তাকেই অর্থাৎ এই আব্দুল লতিফ শর্মাকেই করতে হবে!
চারপাশের হাল হকিকত জানার জন্য আব্দুল লতিফ বাবুলকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। চেয়ারম্যানের দশ দিকে খোঁজখবর রাখতে হয়। কিন্তু দশ দিকে তার নিজের যাওয়ার উপায় নাই। তাই খুব বিশ্বস্ত একজন লোক দরকার। তার শ্যালক মুজিবর বেশ কিছুদিন আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে। কাজকাম কিছু করে না। মোসাহেবি করে আখের গোছাতে চায়। নজর পড়ে আছে শুধু নিজের ফায়দার দিকে। সিয়ানা ভাব দেখায়, কিন্তু কাজ দিয়ে ভরসা পাওয়া যায় না। আব্দুল লতিফ মুজিবরকেও দলে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু সব কাজে তাকে লাগায় না। তার একান্ত বিশ্বস্ত ডান হাত হিসেবে বাবুল একেবারে ঠিকঠাক। মুখ দেখে মনের মতিগতি কারো বোঝার উপায় নাই। কিন্তু সে ঠিকই সময়মত আসল কাজ হাসিল করে ফেলে।
বাবুলকে খোঁজ করতেই সে সামনে এসে দাঁড়াল। আব্দুল লতিফ এক নজর তাকে দেখে নিয়ে বেজার মুখে বলল, ‘আইজকাল দ্যাখতাছি তর খুব ত্যাল বাড়ছে! না ডাকলে দ্যাখাই পাওন যায় না!’
বাবুলের মুখে জবান নাই। একটা শলার কাঠি দিয়ে সে তার দাঁত খোঁচাচ্ছে। অন্য কেউ এরকম ভাব নিয়ে সামনে দাঁড়ালে আব্দুল লতিফ চড় মেরে তার দাঁত তুলে ফেলত। কিন্তু বাবুলের কথা আলাদা। সে বিশেষ ভাবে থাকে। দরকার ছাড়া মুখের বাক্য খরচ করে না।
‘কী হইছে কথা কছ না ক্যা?’
‘না জিগাইলে কী কমু? জিগান কিছু!’
‘অত ভাব নিছ না সবসময় বুঝলি? অত ভাব নিছ না! জঙ্গলে গেছিলি? নাকি হেই যে ভয় পাইয়া ফিরা আইলি আর উঁকি দ্যাছ নাই?’
‘গেছিলাম।’
‘মোস্তাকরে লছ নাই তো?’
‘না!’
‘হুম। কী দ্যাখলি?’
‘টুকরা ফালাইয়া থুইয়া আইছে।’
‘কছ কী? ধরা খাইব তো! তুই কিছু করছ নাই? সরাস নাই?’
‘নাহ টাইম পাই নাই।’
‘ক্যা টাইম পাইবি না ক্যা?’
‘জোরে চাপছিল কী করুম?’
‘কী চাপছিল?’
‘দুই নাম্বার!’
‘ধুর শালা! হারামজাদা খবিস। জঙ্গলে বইয়া যাইতে পারছ নাই? এইডার লাইগা চইলা আইছস!’
বাবুল এই কথার উত্তর দিলো না। মন দিয়ে আবার শলা চিবাতে লাগল। যেন তার যতটুকু বলার ছিল, বলা হয়ে গেছে। এখন চেয়ারম্যান বকাবকি গালাগালি যা খুশি করুক, তার জানার দরকার নাই!
ওদিকে সুফিয়া পুলিশ স্টেশনে যেতে যেতে বারবার এদিকে সেদিকে তাকাচ্ছিল। কেউ যদি তাকে পুলিশস্টেশনের দিকে যেতে দেখে তাহলে বিপদের ওপরে বিপদ। প্রশ্নবাণে ছারখার করে মারবে। তার চাইতেও বড় কথা, খবর তার মায়ের কাছে নিমেষেই সাপ্লাই হয়ে যাবে। তাছাড়া জঙ্গলের ছেলেটা তাকে একটু গোপনে কাজ করতে বলেছে। বেশি জানাজানি হয়ে গেলে আসল লোকেরা সাবধান হয়ে যাবে।
ছেলেটার নাম জানা হয়নি। অবশ্য জানতে চাইলেও বলত বলে মনে হয় না। ছেলেটাকে দেখেশুনে ভালো ঘরের ছেলে বলেই মনে হয়। বয়স কম হলেও ছেলেদের চোখের দৃষ্টির স্বচ্ছতা মাপার জ্ঞান সুফিয়ার ভালোই আছে। এই ছেলেটার চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ। সেখানে কোনো অস্বচ্ছতার দেখা পায়নি সে।
পুলিশ স্টেশনের মূল ফটকেই সুফিয়াকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো। কনস্টেবল গোছের একটা লোক তো কিছুতেই তাকে ঢুকতে দিবে না। একেবারে সিনা তাক করে তাকে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘এ্যাই মাইয়া, তুমি হন হন কইরা কই ঢুকতাছ? এইটা কি তোমার কাছে হাটবাজার মনে হইতাছে নাকি? বাজার করতে আসছ? এইটা হইতাছে পুলিশ ষ্টেশন। এইখানে লোকে আসে হয় গ্রেফতার হইতে নয় কাউরে গ্রেফতার করাইতে। তুমি কী করাইতে আসছ?’
‘ওসি সাব আছেন? উনার লগে দেখা করতে আইছি। আমার নাম সুফিয়া।’
‘আরেব্বাবা! সোজা একেবারে ওসি সাহেবের লগে দেখা করার আর্জি নিয়া আসছ? কী উদ্দেশ্য? খুইলা বলো। আগে সবকিছু এইখানে বলবা তারপর ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে পারবা কী না ভাইবা দেখা হইব।’
‘ক্যান? আপনারে কমু ক্যান? ওসি সাব আমারে চেনেন। আমার নাম কইলেই হইব। আপনে গিয়া কন নোয়াহাটি গ্রামের সুফিয়া দেখা করবার চায়। খামাখা আপনে নিজেরও সময় নষ্ট করতাছেন, আমারও!’
কনস্টেবলের চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড় হলো। সুফিয়ার প্রস্তাবে তো সে রাজি হলোই না, উপরন্তু জিজ্ঞাসাবাদের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিলো। সুফিয়া বহু কষ্টে বিরক্তি চাপতে চাপতে চিন্তা করতে লাগল, ‘খালি একবার ওসি সাবের কাছে যাইয়া লই, তুমার হালুয়া আমি টাইট করুম! খাড়াও! ব্যাটা পুলিশে চাকরি করতাছ দেইখা আমারে হাইকোর্ট দেখাইতাছ!’
অল্পসময়েই পুলিশস্টেশনে বেশ একটা চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হলো। কেউ কেউ কনস্টেবলের পক্ষ নিলো, কেউ সুফিয়ার পক্ষ। তবে এই পক্ষপাতিত্ব গোপনে গোপনে চলল। ওপরে সবাই তাদের সরস বাকবিতণ্ডায় তেল পানি দিয়ে যেতে লাগল।
ওসি জামান শিকদারের পিওন এই দৃশ্য দেখে তার কাছে গিয়ে খবর দিতেই ঘটনার মোড় ঘুরে গেল। পিওন একটু পরে এসে সুফিয়াকে বলল, ‘স্যার আপনারে ভেতরে বুলাইছে।’
কনস্টেবলের এতে খুব অপমানবোধ হলো। সে ঘাড় শক্ত করে পিওনের দিকে একটা কড়া দৃষ্টি ফেলে বলল, ‘স্যারে বুলায় মানে? স্যার জানল ক্যামনে এই মেয়ের কথা? স্যারের রুমে কি সিসি ক্যামেরা লাগাইছে নাকি?’
পিওনের মুখেও জবাব এসে গেল, ‘আপনেরা এত জোরে চিল্লাচিল্লি করতাছেন আর স্যারের কানে কিছু যাইব না?’
‘খুব কথা শিখছ তুমি তাই না? স্যারের কানে গিয়া তুমিই যে খবরটা লাগাই দিছ সেইটা কি আমি বুঝবার পারি নাই? কনস্টেবল আমি নাকি তুমি?’
‘আপনে। এইবারে মাইয়াটারে যাইবার দ্যান। স্যার অপেক্ষা করতাছে!’
কনস্টেবলের কটমট দৃষ্টিকে বেমালুম পাত্তা না দিয়ে সুফিয়া গটগট করে পিওনের পিছে পিছে রওয়ানা দিলো। যাওয়ার আগে এমন একটা ভাব করল যেন ছোটখাট একটা যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে!
জামান শিকদার সুফিয়াকে উষ্ণ অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘আরে সুফিয়া! তুমি দেখি রাস্তা খুঁজে ঠিকই পুলিশ স্টেশনে চলে এসেছ! কোনো কাজে এসেছ? কাজে না এলে আমি আজ বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না। আগেই বলে দিলাম। একটা জরুরী কাজে আটকে গেছি।’
সুফিয়াকে ওসি সাহেবের ঘরে পৌঁছে দিয়ে পিওন সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। সুফিয়া বারদুয়েক তার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করছে দেখে জামান শিকদার পিওনকে বলল, ‘বারেক, তুমি একটু বাইরে যাও।’ পিওন চলে যেতেই সুফিয়া বলল, ‘স্যার আমিও জরুরি কামেই আইছি। আপনে কইছিলেন কুনো সমস্যা হইলেই জানি আপনারে জানাই!’
‘কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?’ কথা বলতে বলতেও জামান শিকদার ফাইলপত্র থেকে মুখ সরাচ্ছিল না। এখন একটা মুহূর্তও এক ঘণ্টার চাইতে দামি মনে হচ্ছে তার কাছে। যেন রহস্য খোলার ছোট্ট একটা চাবি তার হাতে চলে এসেছে। এখন এই ছোট্ট চাবিটাকে সম্ভাব্য সব তালাতে এখনই তাকে লাগিয়ে লাগিয়ে দেখতে হবে। দেরি হয়ে গেলেই চাবির ডেট এক্সপায়ার্ড হয়ে যাবে!
‘স্যার, আমি গতকালও জঙ্গলে গেছিলাম। সেইখানে আমি একটা জিনিস দ্যাখছি!’
‘কী জিনিস? আর আমার নিষেধ করার পরেও তুমি আবার সেই জঙ্গলে একা একা ঢুকেছিলে? তুমি তো মেয়ে বিপদে না পড়ে ছাড়বেই না দেখছি!’
‘স্যার আমার বিপদের কথা পরে চিন্তা কইরেন। আগে কী দ্যাখছি সেইটা কইয়া নেই। আমি জঙ্গলের একটা জায়গায় ম্যালা কাঠের খণ্ড পইড়া থাকতে দ্যাখছি!’
জামান শিকদার রীতিমত চমকে উঠল। আরেকটু হলে তার হাত থেকে ফাইল পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। মুখ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো, ‘কী… কী দেখেছ? কাঠের খণ্ড? মানে গাছ কেটেছে? কী গাছ?’
‘ঠিক কইবার পারি না স্যার। তয় সেই গাছে ম্যালা পেরেক ঠুইকা রাখা আছে। দেইখা মনে হয়, কেউ বুঝি ইচ্ছা কইরা পেরেকগুলানরে গাছের সঙ্গে ঠুইকা রাখছে!’
‘আগর কাঠ!’ নিজের অজান্তেই জামান শিকদারের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। একটু আগেই সে মোবাইলে ‘আগর কাঠ’ লিখে সার্চ দিয়েছিল। আগর কাঠকে ব্যবহারের উপযোগী বানানোর জন্য যে কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া গাছের ওপরে চালানো হয় সেটাই বিস্তারিত পড়ছিল এতক্ষণ। গাছ যখন ইনফেক্টেড হয়ে কালোরঙের হয়, তখনই সেই গাছ দামী হয়ে ওঠে। আর এর দাম রীতিমত আকাশছোঁয়া। তাহলে কি সুফিয়াও সেই গাছের কথাই বলতে এসেছে যার ব্যাপারে আব্দুস সোবহান সাহেব বলছিলেন? কদমপুরের জঙ্গলে কি সত্যিই তাহলে আগর গাছ আছে? এত দামি গাছ! সেই গাছ চুরি হয়ে যাচ্ছে পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই?
জামান শিকদার আর অযথা কথা বলে সমস্য নষ্ট করতে গেল না। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমাকে সেই জায়গাটাতে নিয়ে যেতে পারবা? মনে আছে তোমার জায়গাটা কোথায়?’
‘হ পারুম।’
‘গুড! চলো তাহলে। এক্ষুণি যেতে হবে!’
সুফিয়াকে নিয়ে বের হয়ে আসতে আসতে জামান শিকদার তার দুজন কনস্টেবলকেও গাড়ি নিয়ে বের হতে বলল। গন্তব্য কদমপুরের পশ্চিমের জঙ্গল। প্রতিটা চোখে জ্বলজ্বল করে থাকা জিজ্ঞাসাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে জামান শিকদার বলল, ‘আপনারা সবাই আমার গাড়িকে ফলো করতে করতে আসুন। রাস্তায় কারো সঙ্গে কোনোরকম কথাবার্তা বলবেন না!’
সুফিয়াকে একটু আগে যে কনস্টেবল জিজ্ঞাসাবাদ করছিল সে মিনমিন করতে করতে বলল, ‘স্যার, সবাই চইলা গ্যালে তো পুলিশ স্টেশনে কেউ থাকব না। রেজা আপনার লগে যাক, আমি না হয় এইখানেই থাকি!’
‘শরফুদ্দিন সাহেব, আপনি কি সবকিছু একটু বেশিই বোঝেন? আমি যা করতে বলছি আপনি তাই করবেন। অযথা প্রশ্ন করে আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন কেন?’
কনস্টেবল শরফুদ্দিনের মনে হলো, কেউ বুঝি তাকে চিরতার শরবত খাইয়ে দিয়েছে। সুফিয়া মেয়েটাও তার দিকে কেমন বিদ্রূপের চোখে তাকিয়ে মজা দেখছে। একটা সামান্য গ্রামের মেয়ের সামনে স্যার তাকে এভাবে না বললেই পারত! শরফুদ্দিন মনে মনে বলল… ‘এই হিসাব আলাদা তোলা থাকল স্যার! হিসাব হইব পইপই কইরা!’
ঠিক হয়েছিল ওসি জামান শিকদারের গাড়িতে সুফিয়া উঠবে, আর আরেকটি গাড়িতে উঠবে তার দুই কনস্টেবল শরফুদ্দিন আর রেজা। কয়েকজন সাধারণ পুলিশকেও তাদের গাড়িতে ওঠানো হবে। এত জন ফোর্স না নিয়ে গেলেও হয়ত হয়, কিন্তু শুরুতেই সতর্ক হয়ে গেলে ভালো হয়। কারণ বলা যায় না, যারা গাছ কাটছে তারা হয়ত এত নিষ্কণ্টক করে রাখেনি জায়গাটাকে!
কনস্টেবল রেজা ওসি স্যারের নির্দেশনা পাওয়ামাত্রই গাড়িতে গিয়ে উঠেছে। কিন্তু শরফুদ্দিন তখনো ইতস্তত করছে, যেন কিছু একটার জন্য সে অপেক্ষা করছে। মাঝে মাঝে নিজের মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে। গ্রামদেশে নেটওয়ার্ক ভালো আসে না। একটু পর পর সে তার ফোনটাকে নিয়ে কিছু দূরে চলে গিয়ে নেটওয়ার্ক চেক করছে।
জামান শিকদার সুফিয়াকে গাড়িতে উঠতে বলে শরফুদ্দিনের হাবভাব দেখতে লাগল। তিনি যে দূর থেকে তাকে লক্ষ করছেন, এই ব্যাপারে শরফুদ্দিনের কোনো খেয়াল নেই। তাকে দেখে কেমন একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে।
মিনিট দুয়েক এই হাবভাব দেখার পরে জামান শিকদার সুফিয়াকে গাড়ি থেকে নেমে সামনে ড্রাইভারের পাশে বসতে বলল। তারপর শরফুদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এই যে শরফুদ্দিন, তুমি এসে এই গাড়িতে বসো। পেছনের সিটে বসো। আমি আর তুমি পেছনে বসি, সুফিয়া সামনে বসুক।’
শরফুদ্দিনকে দেখে মনে হচ্ছে, সে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ওসি স্যার তাকে তার গাড়িতে উঠতে বলছেন! কিন্তু কেন? ওসি স্যারের গাড়িতে উঠলে সে তার কাজ অর্থাৎ মেসেজ চালাচালিটা করবে কীভাবে?
জামান শিকদার তাড়া লাগায়, ‘কী হলো কথা শুনতে পাওনি? ঝটপট আমার গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে বসো!’
‘ইয়ে মানে স্যার… আপনার পাশে! সেইটা কি ভালো দেখায়?’
‘কেন? ভালো দেখায় না কেন? তুমি কি আমার পাশে আগে কখনো বসোনি নাকি? মনে হচ্ছে আজকেই নতুন বসছ!’
এরপরে কথা চলে না। শরফুদ্দিন তবুও গাইগুঁই করছে দেখে জামান শিকদার এবারে গম্ভীর গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার শরফুদ্দীন, তুমি দেখছি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছ! ঘটনা কী একটু খুলে বলবা?’
‘স্যার, আমার একটা কথা। কোথাকার কে না কে… একটা আকাইম্মা গ্রামের মাইয়া আইসা আপনারে বলল আর আপনে তার কথা শুইনা একেবারে ফোর্স নিয়া জঙ্গলে যাইতাছেন! এইটা কি একটা কথা হইল স্যার? আমরা পুলিশরা কি এইখানে বইসা বইসা ঘুমাইতাছি? এইরকম কিছু যদি হইত, তাইলে কি আমরা এদ্দিনে খবর পাইতাম না?’
জামান শিকদার তীক্ষ্ণচোখে শরফুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আমরা তো এতদিন ধরে ঘুমের মধ্যেই আছি! তবে তুমি মনে হচ্ছে এতদিন ধরে জেগে জেগে ঘুমাচ্ছিলা! আশেপাশে মশামাছি এসে আমাদের ঘুমে ডিসটার্ব করে কী না সেই পাহারায় ছিলা!’
‘বু… বুঝলাম না স্যার!’
‘কিছু বোঝার দরকার নাই। গাড়িতে ওঠো। খবরদার আর একটা কথাও যাতে খরচ না করতে হয়!’ (ক্রমশ)
#ফাহ্মিদা_বারী