কঙ্কাল

0
963
জন্মের ২/৩ বছরের সময়ই নাকি আমার দাদা দাদী বুঝতে পারেন তাদের প্রথম সন্তানটি জন্মগত পাগল । তার চলা ফেরা, হাটা চলা, কথাবার্তা নাকি অন্য সুস্থ ছেলেদের সাথে মিলতোনা।সব সময় এক অস্থিরতা তার মধ্যে দেখা যেতো। পুকুরে নামলে সারাদিন তাকে পুকুর থেকে তোলা যেতোনা , খাওয়ার সময় গাছের মগডালে পা ঝুলিয়ে একা একা বিড় বিড় করতো । বাড়িতে মেহমান এলে লাঠি নিয়ে তার পিছু পিছু দৌড়ে বাড়ির ত্রিসিমানা পার করে দিতো । দাদা দাদী তাদের সাধ্যমতো কবিরাজ দিয়ে ঝাড়ফুক করিয়ে ডজন ডজন তাবিজের মাদুলী গলায় ঝুলিয়ে দিতেন । তাদের ছেলে সেই মাদুলি ছিড়ে তাবিজ বের করে দূরে ছুড়ে ফেলে বলতেন – ওই যাহ্ । এমনি করে ছেলে বড় হলো , এখন বছরের গরমের ৬ মাস পাগল আর শীতের ৬ মাস ভালো থাকেন । দাদা দাদীর বয়স হয়েছে, ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে শান্তিতে মরতে চান । অন্যদের নিয়ে সমস্যা নেই , যতো সমস্যা বড় ছেলেকে নিয়ে ।
এক মাঘের হাড় কাপানো কনকনে শীতে ১০ গ্রাম পেরিয়ে সব গোপন রেখে কন্যা দেখতে যান । গরীব ঘরের সুন্দরী কন্যার বাবা এতো বড় ঘরে মেয়ে বিয়ে দেয়ার আনন্দে কোন খোঁজ খবর না নিয়ে মেয়ে বিয়ে দেন । সেই সুন্দরী কন্যাটি আর কেউ নন , পরবর্তীতে তিনি আমার মা হন। আমার দুখিনি মা ! বাবার বিয়ের ৪ বছর পরের এক গরমে আমার জন্ম , বাবা তখন অপ্রকিতস্থ পাগল । বাড়ির পেছনের আম গাছে তাকে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয় । মা আমাকে বুকের দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে বাবাকে গোসল করান , লোকমা তুলে খাওয়ান । রাতে শিকল খুলে ঘরে এনে মশারী টানিয়ে ঘুম পাড়ান । মা একই সাথে যেনো দুটি শিশুর যত্ন করেন । আমার জন্মের পর কেউ কেউ নাকি বাবাকে টিপ্পনী কাটতো – রইস্যা পাগলা জাতে মাতাল, তালে ঠিক । পাগল হইলেও ঠিকই বউ চিনে আবার পোলাও জন্ম দেয়, হি হি হি । এসব মা গায়ে মাখতেননা , মা আমাকে আর বাবাকে শিশুর মতো যত্ন করতেন । দাদার বিশাল সম্পত্তির মালিক বাবাও । কেউ কেউ চাইতেন পাগলের সংসার না করে মা আমাকে নিয়ে বাপের বাড়ি ফেরত যাক । মা আমার বাবাকে অন্ধের মতো ভালোবাসতেন , পাগল স্বামীকে একদন্ড চোখের আড়াল করতেননা । একটু যখন বড় হলাম বাবার পাগলামীও পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেলো , এখন শীতেও পাগল হন, গরমেও হন । যখন তখন যেখানে সেখানে পেশাব পায়খানা করে কচলে হাত নোংরা করেন , মা এতোটুকু বিরক্ত না হয়ে বাবাকে সাফ করেন । আমি নাক কুচকে মায়ের কাজ দেখি , মাঝে মাঝে বালতি ভরে মাকে পানি তুলে দেই । ভেবে পইনা- মায়ের ঘেন্না করেনা এসব সাফ করতে ? এসব সাফ করে খেতে বসলে মায়ের হাতে গন্ধ লাগেনা ? অবাক হতাম এর কোনটাই মায়ের নেই ! মাঝে মাঝে শিকল খুলে বাবা কোথায় যেনো গায়েব হয়ে যেতো । আমি আর মা মিলে এপাড়া ওপাড়ার ঝোপ ঝাড়ে বাবাকে খুজে পেতাম , ঝোপে বসে বাবা একা একা কার সাথে যেনো কথা বলেন । আমাদের দেখে অচেনা মানুষের মতো কপালে হাত ঠুকে সালাম দিতেন । জোড় করে আমরা বাবাকে বাড়ি এনে বিছানায় শুইয়ে পায়ে শিকল বেধে দিতাম । এতো বছরে মা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন । একবার মায়ের খুব জ্বর হলো , উথাল পাথাল জ্বর । জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকেন – বাজানরে তোর বাপের শিকল খুইল্যা দে, হের পায়ে ঘা হইয়া গেছে, ও বাজান হেরে আর কষ্ট দেস ক্যান ? পাগল মানুষটারে হুদাহুদি কষ্ট দেস ক্যান ? মা সুর করে বিলাপ করেন । আমি কিছু না বুঝে মায়ের আদেশ পালন করি । শিকল মুক্ত হয়ে বাবা কোথায় যেনো হারিয়ে যান।
প্রবল জ্বরের ঘোরে মা বাবার গোঙানোর শব্দ না পেয়ে আমার কাছে জানতে চান – তোর বাবার শব্দ পাইনা ক্যান , হেয় এমুন চুপ মাইরা গেলো ক্যান ? দুরু দুরু বুকে মায়ের ছেড়া কাঁথার বিছানার পাশে দাড়িয়ে বলি – মা তুমি না কইছিলা বাজানের শিকল খুইল্যা দিতে ? – হ কইছিলাম , তয় হের রাও শব্দ নাই ক্যা ? – শিকল খুইল্যা আমি ইস্কুলে গেছি, আইয়া দেহি বাজানে নাই ! – ও বাবারে ! এইডা তুই কি কইলিরে এ এ । মা গায়ের কাঁথা ছুড়ে বাড়ির বাইরে দৌড় দিলেন , মায়ের পেছন পেছন আমিও দৌড়াই । নিঃস্বাস বন্ধ করে দৌড়েও আমি মায়ের অনেক পেছনে পরে থাকি । মা দিক বিদিক ছুটে বাবাকে খুঁজেন । কয়েক গ্রাম , আত্মীয় বাড়ি খুঁজেও বাবার খোঁজ পাইনা । বাবার খোঁজ না পেয়ে মা রোগে শোকে পাথর হন । ৩/৪ বছর পর তাহের চাচা খবর দেন বাবাকে জিনার্দী রেল ষ্টেশনে বসে আপন মনে বিড় বিড় করতে দেখেছেন । তাহের চাচা অনেক চেষ্টা করেও বাবাকে তাকে চেনাতে পারেননি । বাড়ি ফেরানোর চেষ্টা করেও পাগল মানুষটাকে আনতে পারেননি । খবর শুনে মা আর আমি জীনার্দী ষ্টেশনে ছুটে যাই , অনেক খুঁজেও বাবার খোঁজ পাইনি । দু একজনের কাছে শুনেছি একটা পাগল মাঝে মাঝে ষ্টেশনে বসে একা একা বিড় বিড় করে, দোকানে চেয়ে চিন্তে শুকনো পাউরুটি, সিগারেট নিয়ে উধাও হয়ে যায় । কারো প্রয়োজন পরেনা তাই তার অবস্থান কারো জানা নেই । ২/৩ দিন অপেক্ষা করে আমরা ফিরে আসি । মা আজকাল কারো সাথে তেমন কথা বলেননা, নিরবে নিভৃতে সংসারের কাজ করেন । সামনে আমার এইচ, এস, সি, ফরম ফিলাপের টাকা জোগানোর চিন্তা মায়ের মাথায় ঘুরপাক করে । মা ভালো কাঁথা সেলাই জানেন , সেই সুবাদে কেউ কেউ কাঁথা সেলাই করতে দেয় । মা ফুলতোলা কাথা বানায়, সুই সূতায় কাজ করেন আর গুনগুন করে গান করেন – সোনা বন্ধুরে আমারে পাগল বানাইলা। আমি ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছি , পড়ার টাকা জোগাড় মায়ের একার পক্ষে সম্ভব না । কজন বন্ধুুর সাহায্যে ২/৩ টা টিউশানি জোগাড় করেছি । ওদের পড়িয়ে আমার পড়ার টাকা হয়ে বেশ কিছু টাকা বেচে যায় । মা গ্রামে একা থাকেন , সব সময় ভয়ে থাকি – কখন কি হয়ে যায় । চাচাদের সাথে পরামর্শ করে জমি জমা এক বছরের জন্য ভাড়া ( পত্তন) দিয়ে মাকে নিয়ে ঢাকা থাকার মোটামুটি টাকা হয়ে যায় হিসাব করে পরের মাসে মাকে নিয়ে এলাম। এক ধনীর চিলেকোঠায় আমরা মা ছেলের নতুন সংসার শুরু হয় । একটা চৌকিতে আমাদরে মা ছেলের চলে যায় । পুরানো দুটো চেয়ার ১ টা টেবিল কিনে নিলাম পড়ার সুবিধার জন্য । হাড়ি পাতিল, বালতি কড়াই সহ সংসারের মোটামুটি জিনিস নিয়ে মা তার স্বামীর ঘরে তালা দিয়ে আমার কাছে এসেছেন।। মায়ের চোখে সব সময় দেখি তার নিজের সংসারের হাহাকার । মুখ ফুটে বলেননা, মায়ের চোখের ভাষা আমার বুঝতে অসুবিধা হয়না । মেডিক্যালের ১ম বর্ষের এনাটমি ক্লাশে এক সময় একটা কঙ্কাল কেনা জরুরী হয়ে যায় । বড় ভাইয়াদের কাছে শুনি আমাদের পরেশ ডোম কঙ্কাল জোগাড় করে দেয় । পরেশ ডোমের শরনাপন্ন হলে তিনি জানালেন ২/৩ মাস অপেক্ষা করতে হবে । তিনমাস পর পরেশ ডোম বড় পলিথিনে মুড়িয়ে পাওনা টাকা বুঝে একটা কঙ্কাল আমাকে দিলো । বাসায় ফিরে কঙ্কালটা চৌকির তলায় রেখে রোজকার কাজ করি । ৩/৪ দিন পর ঘরে ফিরে দেখি মা নাকে আচল গুঁজে ওয়াক ওয়াক বমি করছেন । আমাকে দেখে যেনো মায়ের প্রাণ এলো । বলেন – দেখতো বাবা কিয়ের জানি গন্ধ ! পেট মোচড়াইয়া বমি আইতাছে ! কঙ্কালটা রোদে দিতে হবে ভুলেই গেছিলাম , মায়ের কথায় মনে হলো – আরে মা , তোমারে কইতে মনে নাই ! চৌকির তলে একটা কঙ্কাল রাখছি । – ওমাগো ! এইডা কি কস্ ? চৌকির তলে কঙ্কাল ক্যারে ? – ডাক্তারী পড়তে কঙ্কাল লাগে মা , ও মা কাইলকা তুমি এইডারে ছাদে শুকাইতে দিও কেমন? – আইচ্ছা । – ভুইল্যা যাইবানা তো ? – নারে বাজান ! ভুলমু ক্যারে ? পরদিন ক্লাশ থেকে ফিরে দেখি মা কঙ্কালটা রোদে দিয়ে গালে হাত রেখে ভাবনার জগতে । পেছন থেকে জাপটে ধরলে মা হকচকিয়ে যান, বলেন – তোর বাপের শইলডা এমুন লম্বা আছিলো , হের কঙ্কালডাও এতো লম্বা হইবো । আইচ্ছা বাজান তোর বাপের আর খবর লইবিনা ? মায়ের কথায় আৎকে উঠি ! এইটা আসলেই আমার বাবার বেওয়ারিশ লাশের কঙ্কাল নয় তো ? ছুটে যাই রমেশ ডোমের কাছে , জানতে চাই – কাকা সত্যি করে বলেন এই কঙ্কাল কোথা থেকে জোগাড় করেছেন ? – এইডা তো কওন যাইবোনা বাবা । – কাকা আপনার পায়ে ধরি , কেউ জানবেনা, কাউকে বলবোনা । আমাকে একটু দয়া করেন কাকা ! মাতাল রমেশ ডোমের মধ্যে মায়ার চিহ্ন দেখি , একটু এগিয়ে এবার সত্যিই তার পায়ে ধরি । রমেশ ডোম একটু একটু করে বলতে থাকে – বাবারে মানুষ যহন মইরা যায় তহন আমাগো কাছে হের পরিচয় অয় লাশ নামে । আমরা আশায় থাহি হেগো আত্মীয় স্বজন কহন আইয়া তাগো লাশ নিবো । কোন কোন লাশের কপাল খারাফ অইলে হেগো স্বজন আহেনা , হেরা অয় বেওয়ারিশ । রশিদ পাগলা আছিলো তেমন একজন বেওয়ারিস । হেয় বহু বছর হাসপাতের বারিন্দায় বইয়া বিড়বিড় কইরা নিজে নিজে কতা কইতো । কেউ খাওন দিলে খাইতো , না দিলে না খাইয়া বারিন্দায় গুমাইতো । – কাকা উনার নাম যে রশিদ তা জানতেন কেমনে ? – হেয় বিড়বিড় কইরা কইতো – হে হে রশিদ পাগলা , বিড়ি খাইবিনা ? তহন বুজতাম হের নাম রশিদ । – তারপরে কি হইলো কাকা ? – রশিদ পাগলার একদিন বেদম জ্বর অইলো , ডাক্তার ছাড়েগো কইয়া হেরে মেডিকেলো বর্তী করাই । ৩/৪ দিনের জ্বরে রশিদ পাগলায় মইরা যায় । হের লাশ ১ মাস লাশগরে থাইকা পোকে দরে । হেই লাশের কঙ্কালডা তোমার কাছে বেচছি বাবা । আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আমাদের চিলেকোঠার সংসারে ছুটে আসি , মা তখনও কপালে বাম হাত রেখে ডানহাতে কঙ্কালে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করছেন । মাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরি , ফিসফিস করে বলি – মা, মাগো বাবার খোঁজ পাইছি। মা নিষ্প্রান চোখে আমাকে দেখেন , আরো জোড়ে মাকে বুকে চেপে ধরি – মা তুমি কিছু হোননা ? – আমিও পাইছি , এই হাড্ডির মইদ্দে তর বাপের গেরান পাইছি ।
বাবার কঙ্কালটা মা প্রাণ ভরে আদর করুক , বুকে জড়িয়ে কেঁদে হালকা হোক । চিৎকার করে কেঁদে বুকের জমানো কষ্ট হালকা করুক। আমিও নিরিবিলি কোন জায়গা খুজে বুক উজার করে ক্ষানিক কেঁদে নেই ! এই ইট শুরকীর শহরে এমন কোন নিরিবিলি জায়গার খোঁজে আমি পথে নেমেছি , জানিনা খুঁজে পাবো কিনা………………………. !!!!!!!!! ( আমার ছেলে ডাক্তারী ভর্তি হওয়ার পর তার এনাটমি ক্লাশের জন্য একটা কঙ্কাল কিনতে হয় ।লম্বা এই কঙ্কালটা দেখার পর আমার মনে হতো এই মানুষটার নিশ্চয়ই সংসার ছিলো , সন্তান ছিলো এবং এটা একটা বেওয়ারিশ লাশের কঙ্কাল । সেই থেকে এই গল্পটা আমার মাথায় ঘুরপাক করে । অনেক বছর পর আজ এই কঙ্কালটা নিয়ে লিখলাম।। ) শেষ………………………… # মাহবুবা আক্তার নাজমা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে