#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
[২য় পরিচ্ছেদ]
৩৭.
তুষারের এহেম প্রস্তাবে বাড়িতে যেন একপ্রকার তান্ডব চললো। রাত থেকেই নূরজাহান রাগ করে নিজের ঘরে বদ্ধ অবস্থায় পরে আছে। তুষার মাকে ডেকেও খুব বেশি ফায়দা হয়নি। ওদিকে আরেক নতুন ঝড় শুরু হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে কেউ একজন ইরা’দের বিয়ের কথা ছড়িয়ে দিলো। সাথে ছড়ালো ইরা’দের কাবিননামায় সাইন করা মুহূর্তের ছবি। বাড়িতে সবাই তুষারকে নিয়ে মেতে আছে বিধায় কেউ সেই খবর জানতে পারেনি। তবে সেই খবর কোনো না কোনো ভাবে মৌসুমির কান অবধি পৌঁছালো। এই খবর শুনে বিপি হাই করে বিছানায় পরে আছে সে। সিদ্দীক সাহেব মুচকি হাসতে হাসতে মৌসুমির মাথায় আইস ব্যাগটা দিলো। কোনোদিন বিয়ে করতে না চাওয়া ইরা’দ কী না বাপ-মাকে গোল খাইয়ে বিয়ে করে ফেললো। আর তাঁরা কী না এর টু-শব্দও পেলো না। ছেলে তাঁর বড়ো হয়েছে। এতই বড়ো যে লুকিয়ে বিয়ে করেছে সে। এ নিয়ে সিদ্দীক সাহেবের কোনো আক্ষেপ নেই, রাগও নেই। ছেলের প্রতি আলাদা বিশ্বাস আছে তাঁর। এজন্যে বউমা কে, কীরকম হবে সেসব নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় সে।
তবে তাঁর স্ত্রীর অবস্থা দেখে সে হাসছে। যেই মা ছেলেকে বিয়ে দেয়ার জন্যে উঠে-পরে লেগেছিলো সেই মা কী না ছেলের বিয়ের কথা শুনে প্রেশার হাই করে ফেলেছে। এ তো হাস্যকর ব্যাপার। ধাক্কা খাওয়ার কথা সিদ্দীক সাহেবের আর তাঁর পরিবর্তে ধাক্কা খেয়েছে মৌসুমি নিজে। সিদ্দীক সাহেব তো পারছে না খুশিতে পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করতে। মৌসুমি চোখ বুজে বিড়বিড় করে বারবার বলছে,
–“কী হয়ে গেলো এসব! কাকে বিয়ে করলো আমার ছেলে। কেন জানালো না আমাকে? কবে বিয়ে করলো? এই দিন দেখার ছিলো?”
সিদ্দীক সাহেবের পেট ফেটে হাসি আসার উপক্রম। এমন মুহূর্তেও সে হাসতে পারে তাঁর জানা ছিলো না। মৌসুমির অসুস্থতার খবর চাইলেও নূরজাহানকে দিতে পারছে না। সে তো আরেক চিন্তায় কাতর। না জানি কী অবস্থা তিনতলার!
——————
আফিফা নওরির পাশে বসে অনবরত কান্না করেই চলেছে। নওরি আফিফাকে থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। আফিফা নাক, মুখ লাল করে ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
–“কেন হচ্ছে আমার সাথে এসব? তুষার কী সত্যি-ই আমায় ডিজার্ব করে না? কেন দিলে তুমি আমায় তুষারের ক!সম? আমি চাইলেও বলতে পারছি না তোমার বিয়ের কথা। কেন এত অমানবিক হচ্ছো তোমরা আমার সাথে? বলো!”
নওরি জোর করে আফিফাকে নিজ বক্ষে আগলে নিয়ে বলে,
–“এভাবে পাগলামি করিও না আপু। শান্ত হও। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুষার ভাইয়া নিজের ভুল বুঝতে পারবে। নূরজাহান আন্টি ঠিকই রাজি করিয়ে নিবে দেখিও।”
–“তুষারের মনে তো তোমার বসবাস নওরি!”
–“তুষার ভাইয়া মনে হয় না কখনো কাউকে ভালোবেসেছে। আমার প্রতি তাঁর অনুভূতিটা ভাইয়ার সামান্য মোহ। সে হয়তো বুঝতে পারছে না। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ঠিকই বুঝে যাবে। তুমি দয়া করে কেঁদো না আফিফা আপু। পজিটিভ ভাবো। এভাবে হাল ছাড়তে নেই!”
আফিফার চোখ বারবার মুছে দিলেও আফিফার কান্না থামছে না। এই মুহূর্তে নওরি নিজেকে ভীষণ অসহায় অনুভব করছে। মনে মনে ভাবছে,
–“আপনি কোথায় নিদ্র সাহেব? এই পরিস্থিতিতে আপনার সঙ্গ যে আমার ভীষণ দরকার। প্লিজ চলে আসুন, তাড়াতাড়ি চলে আসুন। একা একা আমি আর কত সামলাবো? হিমশিম খাচ্ছি যে!
——-
খুব ভোরে নওরি নূরজাহানের রুমের সামনে গেলো। কম্পিত হাতে দরজায় হাত রাখতেই দেখলো দরজা খোলা। সারা রাত বন্ধ থাকলেও এখন খোলা দেখে ভীষণ চমকালো। নওরি আশেপাশে তাকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে গিয়ে দেখলো সৈকত সাহেব বিছানায় ঘুমোচ্ছেন আর নূরজাহান জায়নামাজে নামাজরত অবস্থায়। মোনাজাতে আছেন তিনি। নওরি বুকে সাহস জুগিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো নূরজাহানের দিকে। নূরজাহানের পাশে সন্তপর্ণে বসলো। নওরির উপস্থিতি বুঝতে পেরে নূরজাহান মোনাজাত শেষ করে ঘাড় বাঁকিয়ে নওরির দিকে তাকালো সে। নওরির চোখ জোড়া হঠাৎ ছলছল করে উঠলো। ধীর গলায় শুধায়,
–“আমায় বিশ্বাস করো তো আন্টি!”
নূরজাহান কিছুক্ষণ অপলক নয়নে চেয়ে রয় নওরির পানে। অতঃপর স্মিত হেসে নওরির মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলে,
–“করি। খুব করি!”
নওরি হঠাৎ নূরজাহানের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো। ভাঙা গলায় বললো,
–“বিশ্বাস করো আন্টি। তুষার ভাইয়ার সাথে আমার সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই। তুমি তো দেখো-ই, তোমার চোখের সামনেই তো এতদিন ধরে আছি!”
নূরজাহান নওরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আনমনে বলে উঠলো,
–“খেয়াল করতাম তুষারকে ফোনে দেখলে তুই এড়িয়ে চলতি কিন্তু তখনো বুঝিনি যে এরকম কিছু হয়ে যাবে!”
–“এখন কী হবে আন্টি? আমি মোটেও তুষার ভাইয়াকে বিয়ে করবো না আন্টি। আফিফা আপু অনেক আপসেট!”
–“তুই এই দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাক, তুষারকে আমি সামলে নিবো। আফিফা ঘুমিয়েছে?”
–“হুম। সারারাত কেঁদেছে!”
নূরজাহান পুণরায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
–“আমার-ই ভুল হয়েছে, আমি-ই মেয়েটাকে আগে-ভাগে স্বপ্ন দেখিয়েছি। তুষারকে যদি আগেই বলে রাখতাম, তাহলে এরকম ঘটনা ঘটতো না।”
নওরি নীরব রইলো। সংকোচে পরলো বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে। কী করে জানাবে নূরজাহানকে? বিব্রতবোধ করলো ভীষণ। নূরজাহান সত্যিটা জানলে কী হবে? তাকে পর করে দিবে? তাকে খারাপ ভাববে? নওরি তো অনেক সাহস জুগিয়ে নূরজাহানকে সব সত্যি জানাতে এসেছে। তাহলে এখন কেন সব সাহস, মনোবল হারিয়ে ফেলছে? সারা রাত আফিফাকে কাঁতড়াতে দেখেছে সে। ভালোবাসার ব্যথা যে খুব যন্ত্রণাদায়ক। তাঁর চুপ থাকার কারণেই তো মেয়েটা এত কষ্ট পাচ্ছে। নওরি কী করে পাষাণ হবে? নওরি কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। চোখ বুজে আল্লাহ্কে ডাকলো। আল্লাহ্কে স্মরণ করে ভয়ে ভয়ে বলে,
–“একটা সত্যি কথা বলবো আন্টি?”
–“হ্যাঁ, বল!”
নওরি মিনিটখানেক চুপ থেকে বলে,
–“আমি এবং ইরা’দ সাহেব একে অপরকে ভালোবাসি আন্টি!”
নূরজাহানের বিস্ময় যেন আকাশচুম্বী। নওরি শোয়া থেকে উঠে বসলো। নূরজাহানের মুখোমুখি। নূরজাহানের পতিক্রিয়া দেখে নওরি চোখ নামিয়ে ফেললো। মেঝেতে হাতের নখ দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে বলে,
–“সেদিন স্টেশন থেকে আসার সময় ইরা’দ সাহেবের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।”
—————
ইরা’দ বাড়িতে ফিরলো পরেরদিন-ই। ফিরে এসে দেখলো তাদের ফ্ল্যাটে পিনপতন নীরবতা। কোনো কাক-পক্ষীরও শব্দ নেই। ইরা’দ কাঁধের ব্যাগের হাতল ধরে মিনমিন করে বললো,
–“কাহিনী কী? সবাই কী মূর্ছা গেলো নাকি? এত নীরব কেন? চুরি-ডাকাতি হবে তো!”
ভাবতে ভাবতেই ইরা’দ মৌসুমির রুমে গিয়ে উঁকি দিলো। উঁকি দিয়ে দেখতে পেলো মৌসুমি মাথায় আইস ব্যাগ দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আর তাঁর পাশেই আধশোয়া হয়ে ঝিমুচ্ছে সিদ্দীক সাহেব। ইরা’দ কী মনে করে হাসলো। উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
–“মা, আইসব্যাগের বরফ সব তো গলে পানি হয়ে গেছে। আরেকটা আইসব্যাগ এনে দিবো?”
মৌসুমি চট করে তাকালেন। হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসলেন। ছেলের কথাগুলো কান দিয়ে নিঁখুত ভাবেই প্রবেশ করেছে। রাগে ফেটে পরে মাথার আইসব্যাগ ছেলের দিকে ছুঁড়ে মারলো। ইরা’দ হাসত্র হাসতে সরে পরলো। মৌসুমি রাগে গিজগিজ করতে করতে বলে,
–“অ!সভ্য!”
নূরজাহান রুম থেকে বেরিয়ে সকলের জন্যে নাস্তা বানিয়েছে। নওরি তাকে সাহায্য করেছে। মুখ তাঁর ভার। তুষার বেশ কয়েকবার রান্নাঘরে এসেছিলো। তুষারকে লক্ষ্য করলে নূরজাহান তাঁর হাতের খুন্তি তুষারের দিকে তাক করে বলেছে,
–“আর যদি তোকে রান্নাঘরে দেখি তাহলে এই বড়ো অবস্থায় সবার সামনে তোর পিঠে খুন্তি বসাবো। তাই সময় থাকতে এখান থেকে ভাগ!”
তুষারের আর কী করার। মায়ের রাগের কাছে হার মেনে সে চলে গেলো। নওরি মিটিমিটি হাসলে নূরজাহান তাকেও খুন্তি দেখিয়ে বলে,
–“একদম হাসবি না। এত বড়ো কান্ড ঘটিয়েছিস অথচ আমায় জানানোর প্রয়োজন মনে করিসনি! আসুক একবার ইরা’দ। দুটোর একসাথে হাত-পা ভেঙে দিবো!”
নওরি ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো। নূরজাহানের অভিমান সে বুঝতে পেরেছে। ভালোই লাগছে তাঁর শাসন শুনতে। নওরি এই ভেবে স্বস্তি পাচ্ছে যে মা সমান নূরজাহান তাকে ভুল বুঝেনি।
নাস্তার সময় সকলেই একসাথে বসেছে। আফিফাকে জোর করে নিদ্র তুষারের পাশে বসিয়েছে। সেদিকে অবশ্য তুষারের ধ্যান নেই। সে বারবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। মা যে ভয়!ঙ্কর রূপ ধারণ করে আছে। তাকে মানাবে কী করে? নূরজাহান বারংবার আফিফাকে দেখছে। এক রাতের ব্যবধানে মুখটা কেমন শুকিয়ে ফেলেছে। নাস্তার টেবিলে নিদ্র বাদে সকলেই নীরব। এর মাঝে সুযোগ বুঝে তুষার পুণরায় এক কথা বলে ওঠে,
–“প্লিজ মা রাজি হও। নওরিকে তো তুমিও ভালোবাসো। ঘরের মেয়ে ঘরে বউ হয়ে থাকলে ক্ষতি কী?”
–“মে!রে একদম হাড্ডি, থুঁতনি ভেঙে ফেলবো শা**। তোর সাহস তো কম না আমার বিবাহিত বউকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিশ! অনেকদিন মা!ইর খাসনি তাই না? মা!ইরের স্বাদ পেতে চাস?”
®লাবিবা ওয়াহিদ
———————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।