এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা পর্ব-০২

0
1952

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব দুই |

[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]
——————————–
–“তুই পালিয়ে যা নওরি।”

রাফিয়ার মুখে এরকম একটি বাক্য শুনে নওরি বিমূর্ত, স্তব্ধ। এমতাবস্থায় কীরকম পতিক্রিয়া করা উচিত তা নওরির মস্তিষ্ক বুঝে উঠতে ব্যর্থ। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রয় রাফিয়ার পানে। রাফিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে চুড়িগুলো দেখছে, হাতড়াচ্ছে।

পালিয়ে যাবে? পালিয়ে যাবে কোথায়? কোন নীড়ে সে নিজের আশ্রয় করে নিবে? যুগ এখন কালো হৃদয়ের মানুষে ভর্তি। স্বার্থপরতায় দুনিয়া অন্ধ। যেখানে নিজের পরিবারই তাঁকে ময়লার মতো করে ডাস্টবিনে ছুঁড়েছে সেখানে বাহিরের দুনিয়া থেকে কিছু প্রত্যাশা করা নেহাৎ -ই বো!কামী বৈ কিছু নয়। মাথা ভনভন করছে নওরির। খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে সব। রাফিয়া তাঁর হাত দুলাতে দুলাতে ধপ করে নওরির পাশে বসলো। কক্ষটিতে গাঢ় নিরবতা বিরাজ করছে। গুমোট হয়ে আছে পরিবেশ। নওরির চোখের পানি থমকে গেছে রাফিয়ার সেই একটি অবিশ্বাস্য বাক্য শুনে। রাফিয়া মিথ্যা চেষ্টা করছে হাতের বালার শব্দ শোনার জন্যে। কিন্তু সেগুলোতে ঝুনঝুনি নেই, এটা মানতে বেজায় নারাজ সে। রাফিয়া আবার বলে ওঠে,

–“তুই এখানে থাকলে আমি সব হারাবো। এই বিয়ে ভেঙ্গে গেলে মা আবার কোনো আধ বুড়ো ধরে আনবে তোর জন্যে। তাই বলছি তুই পালিয়ে যা। তুই পালালে আমি আমার ভালোবাসাকে পাবো। আমার সব হবে। চাইলে-ই আমার এতদিনে তিলতিলে বুনে রাখা স্বপ্ন ভাঙবে না। বোনের জন্যে এইটুকু করবি না?”

নওরি হাসলো। তাচ্ছিল্যে ভরা সেই হাসি। আজ নিজের সবচেয়ে প্রিয় আপাকেও স্বার্থপর হতে দেখলো সে। এটাই সেই রাফিয়া আপা যে কি না নিজের খাবারের ভাগ অবধি দিতো নওরিকে। আজ সেই রাফিয়া আপাই বলছে পালাতে, পালিয়ে কোথায় যাবে সেই চিন্তা করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তাঁর মধ্যে নেই। বাহিরের জগতে তার ছোট বোনটা কী করবে, কোথায় আশ্রয় নিবে সেটা ভাবারও সময় নেই তাঁর। মানুষ বড়োই অদ্ভুত। কিছু না করেও তাঁর জন্যে কৃতজ্ঞতা ফলাতে হবে। কী সুন্দর নৈতিকতা।

নিজের প্রতি বড্ড তুচ্ছতা অনুভব করলো নওরি। উপলব্ধি করলো মা ছাড়া এই দুনিয়ায় আপন কেউ নেই। কেউ মায়ের মতো তাকে আগলে রাখবে না। তোমার মা নেই তো দুনিয়ার কেউ-ই তোমার পাশে নেই। সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিবে সপ্তপর্ণে। রাফিয়া পালিয়ে যাওয়ার কথা বলে রুম থেকে চলে গেলো। শুধু একই জায়গায় স্থির হয়ে বসে রইলো নওরি। শক্ত হতে হবে তাকে। ভীষণ শক্ত।

নওরি যখন ভাবনায় বিভোর তখন হুট করে কোথা থেকে ফ্রিশা নওরির কোলে গিয়ে বসলো। কোলে নওরির হাত দু’টোর উপরই ফ্রিশা আলগোছে বসলো। হাতে চাপ লাগতেই নওরি ক্ষীণ আর্তনাদ করে উঠলো। ফ্রিশা চোখ বড়ো বড়ো করে নওরির দিকে তাকালো। নওরি গলায় দম আটকে আস্তে-ধীরে হাত জোড়া ফ্রিশার নিচে থেকে নিয়ে আসলো। বড্ড ব্যথা করছে হাত জোড়া। টনটনে ব্যথা। নওরি ভাঙ্গা গলায় বললো,
–“কোল থেকে নাম ফ্রিশা। হাতে মলম লাগাতে হবে।”

নওরির কষ্টটা হয়তো কিছুটা অনুভব করলো। ফ্রিশা এক লাফে নিচে নেমে ল্যাজ নাড়িয়ে হেঁটে বেড়ালো। এরপর চুপ করে বসে নওরিকে দেখতে লাগলো। পিটপিট করে। সেই রাতে নওরির আর খাওয়া হলো না। সেই দুপুরের পর থেকে কিছু পেটে পরেনি তার৷ কেউ ডাক পর্যন্তও দেয়নি। সবাই নিজের জন্যে ব্যস্ত সবার স্থান থেকে।

সারা রাত বারন্দায় বসে আকাশ-পাতাল ভাবলো নওরি। চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই তাঁর। এক পর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চাপা, শব্দহীন দীর্ঘশ্বাস। নওরি অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তাঁর পোষা বিড়ালটার দিকে। বর্তমানে ফ্রিশা নওরির গা ঘেঁষে বসে আছে৷ ফ্রিশা হয়তো বুঝতে পেরেছে নওরির মনের ক্ষ’ ত, অসহীয় ব্যথা। পুণরায় ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো নওরি।

আযান দিচ্ছে। ফজরের ধ্বনিতে চারপাশ মুখোরিত। নওরি বুঝে উঠতে পারেনি যে তাঁর ভাবনায় সারা রাত কেটে গেছে। মন বললো, এখন আল্লাহ্’র দরবারে বসতে হবে। একমাত্র তিনি ব্যতীত নওরির দুঃখের কথা শোনার মতো কেউ নেই। নওরি দেরী করলো না। ফ্রিশার উদ্দেশ্যে বললাম,
–“ফ্রিশা, ওঠ। নামাজ পড়তে হবে তো।”

ফ্রিশা পিটপিট করে নওরির দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখে তার একরাশ ঘুম। যেন নওরির কথা বুঝতে পারেনি সে। নওরি ফ্রিশাকে কোলে উঠিয়ে বিছানায় দিকে গিয়ে সেখানে বসিয়ে দিলো। এতক্ষণ বেলকনিতে বসে আকাশ বিলাস করতে করতে সবকিছু ভাবছিলো নওরি। নওরির মন খারাপের সঙ্গী এই বারান্দাই। আকাশ দেখতে ভালো লাগে।

যদি পালিয়ে যায় তাহলে এই বারান্দা ছাড়া কীভাবে থাকবে সে? নাহ, নওরি সেসব ভাবতে চাইছে না। পালানোর কথা তো মোটেই না। ফ্রিশা নওরির দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে রইলো।
–“মিঁয়াও!”
–“নামাজ পড়ব, এদিক সেদিক যাবি না কিন্তু।”

নওরি ফ্রিশাকে শাসিয়ে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হলো। ওযু করতে গিয়ে হাতে পানি লাগতেই টনটনে ব্যথাটা আবারও টের পেলো নওরি। ব্যথায় চোখ-মুখ খিঁচে রইলো। কোনরকমে ওযু সেরে বেরিয়ে আসলো। জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে এতক্ষণ কঠিন হয়ে থাকা চোখ দুটো মুহূর্তে-ই কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। ফ্রিশা নামাজরত অবস্থায় নওরির কোলে অবস্থান করছে। নওরি চোখের জল ফেলে তাঁর জমানো সকল বেদনা আল্লাহ্’র দরবারে বলতে থাকে। মোনাজত শেষ করে ঝাপসা চোখে ফ্রিশার দিকে তাকালো। ফ্রিশা তাঁর দিকে তাকিয়ে বারংবার “মিঁয়াও মিঁয়াও” করছে৷ কতটা উত্তেজিত লাগছে তাকে।

হঠাৎ নওরির দু’ ফোঁটা জল গড়িয়ে ফ্রিশার গায়ে পরলো। ফ্রিশা আঁতকে উঠে লাফ দিয়ে অন্যদিকে চলে আসলো। চোখ জোড়া তার বড়ো বড়ো। নওরি চোখে জল নিয়েই ফিক করে হেসে দিলো। আসলেই পাগল এই ফ্রিশাটা। নওরির হাসির দিকে বো’ কার মতো তাকিয়ে আছে ফ্রিশা। ক্ষণে ক্ষণে লেজ নাড়াচ্ছে সে। নওরি জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

জায়নামাজ ভাঁজ করে ড্রয়ারে রাখতেই বারান্দায় কিছু ভাঙ্গার শব্দ হলো। নওরি ভয়ে চমকে ওঠে। নওরি ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকালো। ফ্রিশার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে নিলো। নাহ, ফ্রিশা তো তার সাথে-ই আছে। তাহলে বিকট শব্দ আসলো কীভাবে? নওরি মুহূর্তের জন্যে ঘাবড়ে গেলেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলো। শক্ত হয়ে ফ্রিশার উদ্দেশ্যে বললো,
–“বারান্দায় কী হচ্ছে? চল তো দেখি গিয়ে।”

নওরি ধীর পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো। ফ্রিশা নওরির পিছু নিলো। বারান্দায় গিয়ে দেখলো ছোট ইটের ঢিল। নওরি বেশ চমকালো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো তাদের ঠিক পাশের ছাদে দাঁড়িয়ে আছে মাহি আপু। ছাদটা নওরির বারান্দার সাথে লাগোয়া। অনায়াসেই বারান্দা থেকে ছাদে আসা-যাওয়া করা যায়।

নওরির বারান্দার এক পাশে গ্রিল দেয়া আর অপরপাশ উম্মুক্ত। এই পাশে নওরির বাবা গ্রিল লাগাবেন, লাগাবেন বলে আর তাঁর লাগানোর সুযোগ হয়ে উঠে না। আর এই উম্মুক্ত দিক দিয়েই মাহি আপুদের বাড়িতে আসা-যাওয়ার পথ।

অবশ্য এদিক দিয়ে বড়ো টিন দিয়ে দেয়া হয়েছে। যাতে কেউ আসা-যাওয়া করতে না পারে। মাহি সেটাই সরিয়েছে। মাহিদের দো’তলা কাজ চলছে৷ মাহি আপু স্মিত হেসে বলে,
–“আমি ভেবেছিলাম মাঝ রাতেই আসবো কিন্তু কখন চোখ লেগে গিয়েছিলো বুঝতে পারিনি।”

নওরি বিস্মিত হয়ে শুধায়,
–“রাতে আসার কী প্রয়োজন আপা? আর তুমি টিনটা সরিয়ে ফেললা কেন?”
মাহির মুখ-ভঙ্গি এবার পাল্টে গেলো। মুখশ্রী গুরুতর করে বললো,
–“শুনলাম তোর নাকি বিয়ে হয়ে যাবে এক আধ বুড়োর সাথে?”

নওরি যেন আসমান থেকে পরলো। নওরি যতদূর জানে, বিয়ের ঘটনা পরিবারের মানুষ ছাড়া কেউ জানে না। তাহলে মাহি জানলো কী করে? সে নিজেও তো বলেনি। নওরি মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে ওঠে,
–“কিন্তু আপু, তুমি…”
–“তোর বোন ছোটটার থেকে শুনেছি। শুধু আমি কেন? সে তো পুরো মহল্লা বিয়ের কথা বলে বেরিয়েছে। একেবারে ঢাক-ঢোল পি!টিয়ে যাকে বলে!”

নওরি এবার কী ধরণের প্রতিক্রিয়া করবে বুঝে উঠতে পারলো না। এর মানে তো মাহি সত্যিটা জানে না। জানানো কী দরকার? মাহি কিছুক্ষণ থম মেরে নওরির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য সুরে বললো,
–“তোর মা বুঝলাম সৎ। কিন্তু তোর বাবা? তার-ও কী বিবেক-বুদ্ধি লোপ পেলো? কী করে পারছে তোর মতো সুন্দরী মেয়েকে ওরকম একটা বুড়োর জীবনে ঝুলিয়ে তোর জীবন তছনছ করে দিতে?”
–“এখন উপায় কী আপু? আমি নিজেও কোনো বিয়ে করতে চাই না। তবে বিয়েটা…”
নওরি কিছু বলার আগেই মাহি তাকে থামিয়ে দিলো। নিজ উদ্যোগে বলতে লাগলো,
–“সেই উপায় জানাতেই তো আসছি এই ভোর বেলায়।”

নওরির চোখ-মুখ চিকচিক করে উঠলো। ভীষণ আগ্রহ প্রকাশ করলো সমাধান জানার জন্যে। সে নিজেও জানতে চায় মাহির পরিকল্পনা কী? মাহি নওরির চোখ-মুখ দেখেই বুঝেছে মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কতটা পু!ড়ছে। বড্ড মায়া হলো নওরির প্রতি। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–“পালিয়ে যা নওরি।”

নওরির আশার আলো যেন ধপ করে নিভে গেলো। রাফিয়া আপার মতো মাহিও তাকে একই সমাধান দিলো? পালিয়ে যাবে কোথায় সে? নওরি মুখ ঘুচে বলে,
–“আমার কোনো বুড়োর সাথে বিয়ে ঠিক হয়নি। বিয়ে ঠিক হয়েছে রাফিয়া আপার প্রেমিকের সঙ্গে। প্রিতম ভাইকে চিনো?”

মাহি যেন বড়ো সড়ো শক খেলো এই বাক্য শুনে। শেষ পর্যন্ত রাফিয়ার প্রেমিক? বড়ো বোনের প্রেমিক? মাহি চোখ কপালে তুলে বলে,
–“বলিস কী? প্রিতম ওই মোড়ের আকবর আঙ্কেলের ছেলে না?”

নওরি ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। এদিকে মাহির মাথায় হাত। সব হিসেব মেলাতে মেলাতে বলে,
–“এখন তুই কী করবি নওরি? তোর তো সবদিকেই বিপদ। এই বিয়ে করলেও তুই সব হারাবি আবার না করলেও আবার তোর ওই মা যে কারো ঘাড়ে তোকে চাপিয়ে দিবে। সবাই কেন করে তোকে নিয়ে মাতামাতি?”

মাহির শেষোক্ত প্রশ্নের উত্তর নওরির কাছে নেই। নওরির বুক চিরে বেরিয়ে এলো চাপা দীর্ঘশ্বাস। মাহি কপালে দুই আঙুল চালিয়ে বলে,
–“তোর পালানোটাই ঠিক হবে নওরি।”
–“পালিয়ে যাবো কোথায়? সেটা ভাবলে না? সবাই বলছো পালাতে।”

মাহি বেশ চমকালো। ডান ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে বলে,
–“আমি ছাড়া আবার কে বললো?”

নওরি হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। জড়ানো কন্ঠে বললো,
–“রাফিয়া আপা। সেই বোন যে আমার সব থেকে আপন ছিলো। সে এখন ভাবছে আমি এখানে থাকলে তাঁর ভালোবাসাকে সে হারাবে৷ আজ ভালোবাসার বাজার থেকে সে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো আমায়। খুব কষ্ট লাগছে মাহি আপু। আমার আপনজনও আজ নিজেকে স্বার্থপরদের খাতায় নাম লিখিয়েছে।”

মাহি বেজার মুখে নওরির দিকে তাকালো। মাহির নওরির থেকেও কয়েক বছরের বড়ো। তাও এই ছোট মেয়েটার বাস্তব অভিজ্ঞতা, কষ্টের মাত্রা বেশি। একদম একা সে। যেখানে আপন’রা-ই তাকে এভাবে ট্রিট করছে বাকি পৃথিবী তাকে কী মূল্য দিবে? মাহি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

–“তুই ভাব নওরি তুই কী করবি। আমিও ভাবছি। যদি পালানো তোর কাছে সুবিধা লাগে তাহলে আমায় বলবি আমি ফুল সাপোর্ট দিবো তোকে। অন্যান্য সিদ্ধান্তেও। এখন তাহলে যাই, আম্মা যেকোনো সময় ছাদে চলে আসবে।”
–“আচ্ছা মাহি আপু। তুমি যাও।”

মাহি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বড়ো টিনটা সাবধানে পাশ থেকে নিয়ে নওরির বারান্দা ঢেকে দিলো। ঠিক আগের মতো। বোঝার জো নেই যে এখান থেকে টিন সরানো হয়েছিলো।

————————
মাহি হচ্ছে নওরিদের প্রতিবেশি। এখানে বাড়ি করে থাকছে দুই তিন বছর৷ রাফিয়ার চাইতে মাহির সাথে নওরির সখ্যতা বেশি। মাহিদের বাসায় ভালো-মন্দ রান্না হলে মাহি সেই ভাগ নওরিকেও দেয়। এমন কী নওরির প্রত্যেক জম্মদিনে উপহারও দেয়। নওরি নিজেও মনে রাখতে পারে না তার জম্মদিন, সেখানে মাহি ঠিক মনে রাখে প্রতি বছর। রাফিয়ার মতোই মাহির জন্যে নওরির হৃদয়ে জায়গা ছিলো অনেকখানি। এখন সে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, তাঁর এই আপা একদমই স্বার্থপর নয়। কখনো হতেও পারে না।

এখন বেলা দশটা। সমাধানের চিন্তা করতে করতে নওরি ব্যথায় জর্জরিত। একপ্রকার ছটফট করছে একমুঠো সুখের প্রত্যাশায়। এসব ঝা!মেলা একদমই নিতে পারছে না সে। কেন প্রিতমের মা নওরিকেই পছন্দ করলো? আর প্রিতম? সে যদি রাফিয়াকে ভালোবেসে থাকে তাহলে সে কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না? কোনো উত্তর নেই নওরির মস্তিষ্কে। মস্তিষ্ক খালি হয়ে যেন খাঁ খাঁ করছে। নওরি বাসন সব ধুঁয়ে লিভিংরুমে চলে গেলো।

সৎ মা সুরভীকে নিয়ে স্কুলে গেছে৷ আসতে আসতে বাজবে এগারোটা। এজন্যই লিভিংরুমে আসার সাহস পেয়েছে সে। সিলিং ফ্যানটা ছেড়ে সোফায় গিয়ে ধপ করে বসে পরলো। পরপর বেরিয়ে আসছে ক্লান্তির নিঃশ্বাস। ফ্রিশা হয়তো এতক্ষণ নওরির ঘরে ছিলো। মিনিটখানেকের মধ্যে সেও ছোট ছোট পায়ে লিভিংরুমে চলে আসলো৷ আপাতত ফ্রিশা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখছে৷ যেন খাবার দেখলেই হামলা চালাবে। নওরি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ফ্রিশার উপস্থিতি টের পেলো। তবে কোনো পতিক্রিয়া করলো না সে। সিলিং ফ্যানের ঠান্ডা বাতাস নওরির ক্লান্তিমাখা মুখমন্ডল জুড়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ কী মনে হতেই নওরি চোখ মেলে তাকালো। দ্রুত নিজের বসার স্থান ঠিক করে সিলিং ফ্যান বন্ধ করে বেরিয়ে পরলো। ফ্রিশা তখনো লিভিংরুমে নির্বিকার হয়ে হেঁটে চলেছে। নওরি রাফিয়ার রুমে গিয়ে উঁকি দিলো। রাফিয়া ঘুমে কাত। তাঁর পাশেই ফোন আছে। নিশ্চয়ই সারা রাত প্রিতম ভাইয়ের সাথে কথা বলেছে? অথবা বলেনি। নওরি নিশ্চিত হতে পারছে না। যদি প্রিতমের সাথে কথা হয়ে থাকে তাহলে প্রিতম কিছু বলেছে? হঠাৎ হৃদয় ভীষণ ব্যাকুল এবং উত্তেজিত হয়ে পরলো। মস্তিষ্কে চর্কির মতো ঘুরতে লাগলো একগাদা প্রশ্ন। কিন্তু রাফিয়া তো ঘুমে। কী করবে সে?

কলিংবেলের শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে নওরির। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে দশটা বাজছে। এত দ্রুত সৎ এসেছে নাকি? নওরি বুকে থুঁ থুঁ দেয়ার ভঙ্গি করে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। কোনো রকমে মাথায় ওড়না পেচিয়ে দরজা খুলতেই দেখে সৎ মা দাঁড়িয়ে আছে। নওরির দিকে কঠিন চাহনি নিক্ষেপ করে ভেতরে প্রবেশ করলো। নওরি দরজা লাগিয়ে আলতো স্বরে বললো,
–“এত তাড়াতাড়ি আসলেন যে?”
–“জ্যাম ছিলো না।” সৎ মায়ের কাঠ কাঠ কন্ঠস্বর।

নওরি আর কোনো প্রশ্ন করলো না। সৎ মা লিভিং রুমে চলে গেলেন। যেতে যেতে বললেন,
–“আমার জন্যে ঠান্ডা পানি মিশিয়ে এক গ্লাস ট্যাঙ সরবত আনিস তো!”

নওরি বিনা-বাক্যে দ্রুত পায়ে কিচেনে চলে গেলো। ট্যাঙ বানানো ধরতেই সৎ মায়ের চিৎকার শুনতে পেলো সে। সৎ মা রীতিমতো চেঁচিয়ে নওরিকে ডাকছে। নওরি আঁতকে দ্রুত লিভিংরুমে ছুটে গেলো। সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেই সৎ মা উচ্চস্বরে বাণী ছুঁড়লো,
–“তোর এই বান্দর বিড়ালটা এখানে কী করছে? তুই লিভিংরুমে এসেছিলি?”
নওরি আমতা আমতা করে বলল,
–“কেন আসবো মা?”
–“না আসলে এই বিড়ালকে সরা। আমি যেন একে আমার ত্রিসীমানায় না দেখি।”

ফ্রিশা কেমন গম্ভীর নজরে তাকিয়ে আছে সৎ মায়ের দিকে। তাঁর চাহনি দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে একদম পছন্দ করে না সৎ মাকে। তাও সৎ মা কে জ্বালাতে দুই ধাপ আগাতেই নওরি ওকে কোলে নিয়ে নিলো। ফ্রিশা ক্ষীণ স্বরে “মিঁয়্যাও” করে উঠলো। নওরি কিছু না বলে দ্রুত ফ্রিশাকে নিয়ে চলে এলো।

এগারোটা নাগাদ নওরি রেডি হয়ে সৎ মায়ের আসলো। ফ্রিশাও তাঁর পাশে আছে। সৎ মা তখন চায়ের কাপে সুখের চুমুক বসাচ্ছিলেন। নওরিকে দেখে তার ভ্রু-দ্বয় কুচকে গেলো। কপালে দুই একটি সূক্ষ্ম ভাঁজ পরলো। বিরক্তির ভাঁজ।
–“কী ম্যাডাম? এতো সাজগোজ করে কই যাচ্ছো?”
–“ফ্রিশার খা..খাবার শেষ হয়ে গেছে তা..তাই ক্যাট ফুড কিনতে যাচ্ছি।”

সৎ মা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। কন্ঠে তুচ্ছতা ফুটিয়ে শুধায়,
–“পাইছে এক বেশাদ! নিজে খেতে পারে না আবার এর জন্যে খাবার কিনতে যাচ্ছে। যত্তোসব আজেবাজে কাজ।”

নওরি চুপ করে গেলো। সৎ মায়ের কন্ঠস্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে বহু কষ্টে তার ক্রো!ধ দমিয়ে রেখেছে। কারণটা নওরি পুরোপুরি ধরতে না পারলেও কিছু আন্দাজ করেছে। হয়তো প্রিতমের মা কিছু বলে গেছে। নয়তো এরকম আচরণ অন্তত সৎ মায়ের স্বভাবপূর্ণ নয়। নওরি মিনিটখানেক চুপ থেকে বললো,
–“যাই?”
–“যা তো! যেখানে খুশি যা। তাও কানের সামনে ঘ্যানঘ্যান করবি না। চা খাচ্ছি, মুড নষ্ট হওয়ার আগেই আমার চোখের সামনে থেকে সর।”

ফ্রিশার ইচ্ছে হলো নিজের ভারি ল্যাজ দিয়ে সৎ মায়ের চায়ের কাপে বারি দিতে। তারপর গরম চা গিয়ে পরবে সৎ মায়ের শরীরে। দারুণ হতো।
নওরি ফ্রিশাকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পরলো। খামাখা দাঁড়িয়ে থেকে কাজ নেই।

সত্যি বলতে নওরির হাতে এক আনাও নেই। সে মিথ্যে বলে বাসা থেকে বেরিয়েছে। মূলত মাহির সাথে দেখা করার জন্যেই বেরিয়েছে। মাহিদের বাসায় এসে দরজায় কড়া নাড়তেই কিছুক্ষণের মাঝে মাহির মা এসে দরজা খুলে দিলেন। নওরি তাকে দেখতেই সালাম দিলো। মাহির মা মৃদু স্বরে সালামের উত্তর নিয়ে বলে,

–“হঠাৎ এই সময়ে এলে?”
–“মাহি আপু আছে?”
মাহির মা থমথমে গলায় বললো,
–“আছে তবে ঘুমোচ্ছে। কী দরকার? ”
এরকম অপ্রত্যাশিত উত্তরে নওরির মনঃক্ষুণ্ন হলো। নওরি আমতা আমতা করে শুধালো,
–“কিছু না। এমনি। দুঃখিত আন্টি, বিরক্ত করলাম।”
বলেই নওরি ফিরে আসতে চাইলে মাহির মা পিছু ডাক দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“শুনলাম তোমার নাকি আধ বুড়োর সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে? ঘটনা কী সত্যি?”

মাহির মায়ের কন্ঠে স্পষ্ট কৌতুহল। কিছু খুঁচিয়েই প্রশ্নটি করেছে সে। নওরির কাছে অন্তত এটি স্বাভাবিক প্রশ্ন লাগলো না। মাহির মায়ের কথার সুর-ই বলে দিচ্ছে তার তাচ্ছিল্যতা। নওরি শক্ত হয়ে পিছে ফিরে আলতো হেসে বলে,
–“না, আন্টি। বিয়ে ভেঙ্গে গেছে।”

নওরি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। মাহির মা নওরির যাওয়ার পানে তাকিয়ে মিনমিন করে বলে,
–“মেয়ের মুখ চলে ভালো। এর আবার কিসের কষ্ট?”

নওরি গন্তব্যহীন হয়ে হাঁটছে। আশেপাশের মানুষজন তাকে যেভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে তাতে নওরি বেশ স্থির। এসবের আড়ালের কাহিনী সে জানে। সুরভী যে ঢোল পিটিয়েছে। মাহি ঠিকই বলেছিলো। তবে লোকজনের এমন চাহনি বড্ড অস্বস্তিকর লাগছে নওরির।

খোলা আকাশের নিচে হাঁটলেও চারপাশে বি!কৃত মানুষদের বি!কৃত নজর তাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে। যেন কোনো ঘনবসতিতে চলে এসেছে সে। শান্তিমতো নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। রীতিমতো দম আটকে আসছে যেন। ফ্রিশা তো ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মানুষদের চলাচল দেখছে। মানুষ’রা কী তাকে দেখছে? হয়তো।

এসব সহ্য করতে করতেই নওরি হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলো সে প্রিতমদের বাড়ি যাবে। আজ একটা কিছু হবেই। ভাবনা অনুযায়ী নওরি প্রিতমদের গলিতে প্রবেশ করলো। এইতো কয়েক বাড়ি পরেই আকবর ভিলা। বেশ নামী-দামী মানুষ তাঁরা। আকবর ভিলার সামনে পৌঁছাতে-ই…..

——————————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনীয়। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে