#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২৭ |
——————-
স্টেজে এখন নাচ, গান চলছে। ইরা’দ কোনো বরিং স্পিচ নয় বরং তাঁর শিক্ষা জীবনের কিছু ঘটনা শেয়ার করেছিলো। জীবনের সখ, আহ্লাদ, কিছু বিপদ সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছে। মূলকথা, তাঁর স্পিচ ছিলো একদম উত্তেজনাময়, যেমনটা প্রতিটি স্টুডেন্ট পছন্দ করে। মাঝে মধ্যে কিছু ঘটনা শুনে হাসতেও বাধ্য হয়েছে ছাত্র-ছাত্রী’রা।
নওরি, সারিফা, তৃণা এবং রাইসা সকলেই ভার্সিটির পেছন দিকে চলে এসেছে। সড়গোল খুব একটা ভালো লাগছে না নওরির। ভার্সিটির এপাশটা কিছুটা নিরব। নিরব শান্তিও অনুভব করলো নওরি। সবুজ ঘাসের উপর চারজন গোল হয়ে বসেছে। এর মাঝে নওরির ফোনে মেসেজ এলো। নওরি ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ইরা’দের মেসেজ। নওরি একপলক এ তিন জনকে পরোখ করে নিলো। তিনজনই কথা বলতে ব্যস্ত। নওরি এবার মেসেজ এ ঢুকলো। ইরা’দ লিখেছে,
–“কোথায় তুমি?”
নওরি আশেপাশে চোখ বুলালো। সরল মনে রিপ্লাই করলো,
–“ভার্সিটির পেছন দিকটায়। কেন?”
আর কোনো রিপ্লাই আসে না৷ তৃণা ডাকলে নওরি আবার ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে। মিনিট দশেক পর একটি ছেলে আসলো। নওরির সিনিয়র সে। ছেলেটি তাদের মাঝে এসে বলে,
–“নওরি আপু কে?”
নওরি চমকে ছেলেটির দিকে তাকালো। সারিফার দিকে চাওয়া – চাওয়ি করে বলে,
–“জি আমি!”
ছেলেটি এবার চোখ নামিয়ে বলে,
–“আপনাকে ইরা’দ ভাইয়া ডেকেছে। আমার সাথে আসুন!”
তৃণা এবং রাইসা যেন আকাশ থেকে পরলো। ফ্যালফ্যাল করে একবার নওরির দিকে তো একবার ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছে। বিস্ময়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে দু’জন। নওরি সারিফার দিকে তাকালো। সারিফা ইশারায় যেতে বললো। নওরি অস্বস্তি, জড়তার সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
–“আচ্ছা চলুন!”
নওরি একপলক সবার দিকে তাকিয়ে ছেলেটির সাথে চলে গেলো। ছেলেটা ভার্সিটির ভেতরে নিয়ে গেলো। এতে নওরির ভয়ে বুক কেঁপে উঠেছে। ছেলেটি কোনো ক্রমে কী মিথ্যা বলেছে? নওরির আসাটা তাহলে ভুল হয়েছে? এখন কী করবে সে? ফিরে যাবে? ফিরে যাওয়া উচিত হবে? এরকম নানান দ্বিধা- দ্বন্দ্বে ভুগে এগোতে লাগলো। ছেলেটি দো’তলার একটি রুমের সামনে নিয়ে গিয়ে বলে,
–“ভাইয়া ভেতরে আছে। আপনি যান, আমি আসছি!”
বলেই ছেলেটি চলে গেলো। নওরি বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ ক্লাসরুমের দরজা খুলে ইরা’দ বের হলো। নওরিকে দেখে চমৎকার হাসি দিলো। দরজার সাথে হেলান দিয়ে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো নওরির পানে। নওরি হতভম্ব দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইরা’দের পানে। সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুললো না। নওরিকে এভাবে নিঃশ্বাস ফেলতে দেখে ইরা’দ বললো,
–“ভয় পেয়েছিলে? সুন্দরীকে নিয়ে আবার কারা নীল নকশা আঁকলো?”
ইরা’দের রসিক কন্ঠস্বর শুনে নওরি বললো,
–“আমি মোটেও সুন্দরী নই!”
–“তাই? সুন্দরী না হলে এভাবে ছেলেদের নজর কেড়ে নিতে পারতে না। একজনের তো পুরো মনটাই কেড়ে নিলে। সাবাশ!”
নওরি পিটপিট করে তাকালো। মন কেড়েছে আবার কার? ইরা’দ হেসে বলে,
–“বুঝতে পারোনি? বোঝার কথাও নয়। আজই প্রায় ছয় জন তোমায় প্রপোজ করতে এগিয়ে গেছিলো কিন্তু আমার লোকেদের জন্যে তোমার কাছেই পৌঁছাতে পারেনি। কী সুন্দর ঘটনা তাই না?”
–“প্রপোজ করলেই বা কী? আমি এক্সেপ্ট করতাম?”
ইরা’দ একমনে নওরির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
–“তা করতে না। কিন্তু তোমার উপর একজনের ভ!য়া!নক নজর পরেছে। তাঁর পক্ষে দেখা সম্ভব না তাঁর প্রিয় ফুলকে কেউ ছুঁতে গিয়েছে।”
–“সেটা কে শুনি?”
–“সেদিন বুঝোনি?”
–“বুঝলে কী জিজ্ঞেস করতাম?”
–“তাহলে তোমার বোঝার বয়স হয়নি। নিতান্তই তুমি পিচ্চি মানুষ!”
–“আপনি কী এসব বলার জন্যে ডেকেছেন?”
–“না তো। তোমায় প্রাণ জুড়ে দেখার জন্যে ডেকেছি। পেইনফুল স্পিচ দিতে গিয়ে তো দেখতে-ই পারলাম না। এখন চোখ জুড়িয়ে নেই!”
নওরি এতক্ষণে ইরা’দের চাহনির গভীরত্ব অনুভব করলো। মুহূর্তে-ই সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেলো। উথাল-পাথাল ঢেঊ খেলে গেলো অন্তঃস্থলে। এ কেমন অনুভূতি? কিছুটা অ!সহ্যকর আবার কিছুটা সুখময়! এই অনুভূতির কী নাম দিবে সে?
–“ছবি তুলবে?”
নওরি আরও চমকে যায় ইরা’দের এরূপ প্রশ্নে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
–“মানে?”
–“ছবি তুলবো তোমার সাথে। দুজন পাশাপাশি দাঁড়াবো, ছবি উঠবে! ভবিষ্যতে স্মৃতিচারণ করতে অসুবিধা হবে না। আমি চাই না তোমার এই স্নিগ্ধ, হৃদয়কাড়া রূপটি আমার স্মৃতিতে কোনোদিন ঝাপসা হয়ে ঝড়ে যাক! এই স্মৃতিটুকু জীবনের প্রতিটি ধাপে আমি মুখস্থ রাখতে চাই। বুঝলে নৌরি ফুল?”
নওরি অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, “না!”
ইরা’দ শুনলো না নওরির নিষেধাজ্ঞা। জোর করে ছবি তুললো। ছবি তোলা শেষে সেগুলো দেখতে দেখতে বলে,
–“আমি এখন চলে যাবো। অনুষ্ঠানও শেষের পথে। তোমার বোরকা আমি আনিয়েছি, সেটা পরে আমার সাথে বাসার দিকে রওনা হবে।”
নওরি অস্ফুট স্বরে আওড়ায়,
–“বোরকা কেন?”
–“তোমার ঝ!লসা!নো রূপ বাহিরের মানুষের জন্যে নয়। আমি অপেক্ষা করছি, ভেতরে যাও!”
বাঁকা মানুষটার সাথে তর্কে যাওয়া সময় নষ্ট ব্যতীত কিছুই নয়। এজন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে নওরি ক্লাসরুমের ভেতরে চলে গেলো। ইরা’দ সেখানেই অপেক্ষা করলো।
সারিফার মুখে ইরা’দের কথা শুনে তৃণা এবং রাইসা মোটামুটি নয় বরং অনেকটা শকে আছে। ভেতরে ভেতরে এত কারবার ঘটলো আর ওরা সামান্য টের অবধি পেলো না? অনেকক্ষণ নির্বাক থেকে হঠাৎ তৃণা উচ্ছ্বাসের সাথে বলে ওঠে,
–“তাহলে এবার পুলিশের গু!লি খেতে হবে না তাইতো? ডিরেক্ট বাসায় গিয়েই প্রপোজ। আহা!”
এমন সময়ই বোরকা পরিহিত নওরি আসলো ওদের মাঝে। তাঁর আসতে ইচ্ছে করছিলো না কিন্তু সারিফাকে নিয়ে যাবার জন্যে আসাটা প্রয়োজন ছিলো। নওরি তৃণা এবং রাইসার দিকে তাকিয়ে বেশ ভালো করে বুঝে গেলো ওরা সব জেনে গেছে। নওরি তপ্তশ্বাস ফেলে বলে,
–“দুঃখিত। সারিফা, বাসায় যেতে হবে। চলো!”
–“বাসায় যাবার এত তাড়া কেন? এছাড়া বোরকা-ই বা পেলি কোথায়?”
তৃণার প্রশ্নে নওরি কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলে,
–“আসলে, ইরা’দ আমাদের এখুনি যেতে বলেছে। উনি অপেক্ষা করছেন!”
–“ভাইয়া বলেছে? আচ্ছা। কিন্তু বোরকা?”
নওরি লজ্জায়, জড়তায় মাথা নিচু করে ফেললো। আমতা আমতা করে বললো,
–“তোমার ভাইয়া বাসা থেকে আনিয়েছে!”
তৃণা এবং রাইসা যা বুঝার বুঝে নিলো। সারিফাও কিছুটা বুঝতে পারলো। নওরির এরূপ উক্তিতে তৃণার স্বল্প আলোকিত আশার আলো ধপ করে নিভে গেলো।এদিকে নওরি অস্বস্তিতে রীতিমতো থরথর করে কাঁপছে। এমন পরিস্থিতিতেও জীবনে পরতে হবে কে জানতো? নওরি ওদের এড়িয়ে চলে তাড়া দিয়ে বলে,
–“তুমি আসো, আমি এগোচ্ছি!”
নওরি এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলো। তৃণা ভ্রু কুচকে নওরির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সারিফার উদ্দেশ্যে বলে,
–“ইরা’দ ভাই নিজে আনিয়েছে? অবিশ্বাস্য।”
–“অবিশ্বাসের কিছু নেই আপু। ভাইয়া আপুর ব্যাপারে খুবই পজেসিভ। চলো একসাথেই গেট পর্যন্ত যাই!”
তৃণা ব্যথিত মন নিয়ে বললো,
–“চলো!”
তিন জন হাঁটছে। এমন পর্যায়ে রাইসা তাঁর মুখ তৃণার মুখের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
–“প্রেম করার আগেই ছ্যাঁকা খেয়েছিস। সমবেদনা বান্ধুবী! এখন সমবেদনার জন্যে ট্রিট দিস!”
তৃণা গরম চোখে রাইসার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“আমি ম!রলেও ট্রিট চাইবি?”
–“কেন চাইবো না? চল্লিশা তো পাচ্ছি-ই!”
–“তাহলে সেই অপেক্ষা না করে এখনই গরম কড়াইয়ে ভেঁজে আমায় খা। অ!সভ্য!”
রাইসা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো তৃণার এরূপ বক্তব্যে। গেট থেকেই চারজন বিদায় নিলো। সারিফা নওরির পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
–“আচ্ছা আপু, তোমার এবং ভাইয়ার মধ্যে কিছু চলছে?”
নওরি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, “না!”
–“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
নওরি উত্তরে আর কিছুই বললো না। সারিফাও প্রশ্ন করলো না। ইরা’দ গাড়ি নিয়ে ভার্সিটি থেকে দূরে দাঁড়িয়েছে। এপাশটা ভীষণ নিরিবিলি। খুব একটা মানুষজন নেই। হঠাৎ নওরির ফোনে কল এলো। নওরি কল রিসিভ করতেই ইরা’দ বললো,
–“আমি নামবো না গাড়ি থেকে। গাড়ির সামনে এসে পেছনের ডোর খুলে সোজা বসে পরবে। ঠিকাছে?”
—————–
এভাবে-ই কেটে যায় পুরো একটি বছর। ইরা’দের প্রতি নওরির ভালো লাগা, অদ্ভুত অনুভূতি ক্রমশ বেড়েছে, একটুও কমেনি। তবে ইরা’দ আজকাল ভীষণ ব্যস্ত। এর কারণ সামনে ইলেকশন। ইলেকশনের জন্যে ইরা’দ সেই সকালে বের হয় এবং রাত করে ফিরে।
নওরি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের পানে চেয়ে আছে। নির্বাক তাঁর ভঙ্গিমা। আজ এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। রাফিয়া কল করেছে। রাফিয়া তাঁর নাম্বার কই পেলো সেই ভেবেই নওরির ঘুম আসছে না। নওরি রাফিয়ার কোনো কথা না শুনেই কল কেটে দিয়েছে। দেড় বছর পর কেন রাফিয়া তাকে কল দিলো? কী তাঁর উদ্দেশ্য? সবটাই নওরিকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
হঠাৎ কী মনে হতেই নওরি বাগানের দিকে তাকালো। বাগানের এক পাশে তাকিয়ে নওরি থমকে গেলো। রাত বাজে প্রায় বারোটা। এই সময়ে ইরা’দ বাগানে বসে কী করছে? বাগানের ঝাপসা আলোয় বুঝলো ইরা’দের কপাল র!ক্তাক্ত। আর হাতে সাদা কিছু পেঁচানোর চেষ্টা করছে। এরকম দৃশ্য দেখে নওরি অনেকটা আঁতকে উঠলো। ভেতরটা দুমড়ে মু!চড়ে গেলো তাঁর। এ কী বিধ্বস্ত অবস্থা ইরা’দের?
ইরা’দ আধো চোখে তাকিয়ে হাতে ব্যান্ডেজ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বাসাতেও যেতে পারছে না সে। কারণ, তাঁর মা মৌসুমি। তাঁর চোখে পরলে এই মাঝ রাতেই মৌসুমি তাঁর ক্লাস নিবে। যা এই মুহূর্তে ইরা’দ চাইছে না। বড্ড ক্লান্ত সে।
আজ আসার সময় ইরা’দ একাই বাইক নিয়ে আসছিলো। হঠাৎ কোথা থেকে দুটো বাইক এসে তাঁর বাইককে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। ইরা’দ বাইক নিয়ে ফুটপাতের ওপর পরে যায়। পায়ে কোমড়ে চরম ব্যথা পেয়েছে। পায়ে দুই জায়গায় ছি!লে গেছে। হাত তো কেটে রীতিমতো র!ক্ত বেরিয়েছে। কপালেও চট। ভাগ্যিস বাইকে ব্যান্ডেজ নিয়ে ঘুরে সে। নয়তো এখন কোনো ফার্মেসী খোলা থাকার আশা নেই। পায়ের শব্দ পেতেই ইরা’দ চোখ তুলে তাকালো।
———————-
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২৮ |
——————
চারপাশে পিনপতন নীরবতা। মাঝরাত। বাগানের কর্ণারে বেঞ্চির উপর বসে ইরা’দ যখন গাল-মন্দ করতে ব্যস্ত তখনই স্বচ্ছ পায়ের শব্দ শ্রবণ হলো। ইরা’দ থমকালো। মাথা তুলে তাকালো পায়ের শব্দের মালিকের দিকে। মানুষটিকে দেখে ইরা’দ এক মুহূর্তের জন্যে থমকালো। নওরি ভণিতা ছাড়াই শুধায়,
–“কী হয়েছে আপনার?”
ইরা’দ গভীর চোখে তাকালো নওরির উৎকন্ঠা, বিধ্বস্ত, উত্তেজনাময় চোখে। টলমলে চোখ জোড়া দেখে ইরা’দ হতবাক হতে বাধ্য হলো। কিছু সময় বাদেই নিজেকে সামলে বলে ওঠে,
–“ব্যান্ডেজ করে দিবে?”
নওরি যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। সপ্তপর্ণে ইরা’দের পাশে বসলো। ইরা’দের হাত থেকে ব্যান্ডেজ নিয়ে ব্যান্ডেজ করায় মনোযোগী হয়। কম্পিত কন্ঠে নওরি শুধায়,
–“কীভাবে হলো এসব?”
–“সামনে ইলেকশন। তাই কিছু ঈর্ষান্বিত ছা!গল আক্রমণ করেছিলো। পেছন থেকে হা!ম!লা! শা!লা কাপুরুষের দল!”
–“কেন করেন এসব রাজনীতি? রাজনীতি করেন দেখেই তো মানুষদের শত্রু হয়েছেন!”
–“তুমিও প্লিজ মায়ের মতো কথা বলিও না। আগেও বলেছি রাজনীতি আমার রক্তে মিশে গেছে। এটা ছাড়লে আমি জীবন্ত থাকব না!”
–“অলুক্ষণে কথা বলবেন না প্লিজ! একটু সাবধানে থাকলে কী হয়?” নওরির তীব্র অনুনয়।
ইরা’দ থমকে তাকায় নওরির পানে। কোনো কথা বললো না। শুধু শুকনো ঢোঁক গিললো। নওরি ইরা’দের হাত ব্যান্ডেজ করে ইরা’দের সাথে ব্যান্ডেজ করতে গেলেই দুজনের মুখ কাছাকাছি চলে আসে। একে অপরের নিঃশ্বাস ঘনিষ্ঠ হয়ে মিলেছে। নওরি অবাক চোখে তাকালো ইরা’দ দিকে। ইরা’দের দৃষ্টি তখনো নওরির চোখে। ওই চোখে ইরা’দ কিছু খুঁজতে ব্যস্ত। নওরি নিঃশ্বাস আটকে কোনোরকমে কপাল ব্যান্ডেজ করে সরে এলো। ইরা’দ হঠাৎ হাসলো। নৈঃশব্দ মাখা হাসি। হাসি বজায় রেখেই বললো,
–“আমি যখন ইলেকশনে জিতবো, তখন আমার পদ আরও উপরে যাবে। তখন নিজস্ব গাড়ি থাকবে, গার্ড থাকবে। তখন আর খোলামেলা ঘুরাঘুরি করবো না। ঠিকাছে? নাও, এবার একটু হাসো তো নৌরি ফুল। ফুলেদের হাসতে হয়, ফুলেদের বিষণ্ণ মুখমন্ডলে মানায় না।”
———————-
ইরা’দ ইলেকশনে বিপুল ভোটের মাধ্যমে জিতে গেলো। এবার ইরা’দ হয়েছে আরও স্বচ্ছল। নওরিকে দেয়া কথা মতোই ইরা’দের গ্যারেজে তাঁর বাইকের সাথে গাড়ি দাঁড়িয়েছে৷ প্রাইভেট কার। চার- পাঁচজন গার্ড সবসময়-ই ইরা’দের আশেপাশে বিচরণ করে। এখন তাঁর বাইকের দিন শেষ হয়েছে। প্রিয় বাইক ছেড়ে এখন তাকে প্রাইভেট কারে চলাচল করতে হয়। সব মিলিয়ে ইরা’দের সময়টা কাটছে ভালো।
নওরি পরীক্ষা শেষে পায়ে হেঁটে বাসার দিকে যাচ্ছে। আজ রিকশা পায়নি নওরি। ইরা’দও আসেনি। হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত। রাফিয়া তাকে বেশ কয়েকবার কল করেছে কিন্তু নওরি রিসিভ করেনি। খুব ভয় পেয়েছে সে। রাফিয়ার কথা ভাবতে ভাবতেই ফুটপাত ধরে হাঁটছে নওরি। আচ্ছা রাফিয়া কী বলতে চাইছে তা কী শুনবে নওরি? রাফিয়া নিশ্চয়ই ক্ষমা চাইবে? এছাড়া রাফিয়ার থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে সে। তাহলে চিন্তা কিসের? মাহিকেও কিছু বলতে পারছে না সে। মাহি গ্রামে গিয়েছে। ওখানে ভীষণ নেটওয়ার্ক ইস্যু। কে জানে কবে ফিরে? ভেতরে ভেতরে আর পারছে না সইতে।
হঠাৎ তাঁর ফোনের রিংটোন কানে এলো। নওরি বাস্তবে ফিরে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখলো রাফিয়া কল করেছে। মুহূর্তে-ই নওরির চলমান পা জোড়া থমকে গেলো। গলা শুকিয়ে এসেছে নওরির ভয়ে। আতঙ্কিত চোখে চেয়েই রইলো ফোনের স্ক্রিনে। পরমুহূর্ত তাঁর বিবেক বলে ওঠে, এ তুই কী করছিস নওরি? এত পরিশ্রম ঢেলে, মনোবল সহকারে তুই এতদূর এসেছিস কী সামান্য কারণে ভয় পাবার জন্যে?
তাইতো! নওরি নিজেকে সামলাতে প্রায় দেড় বছর সময় নিয়েছে। পড়াশোনা করছে, টিউশনি করছে! এখন নওরি হাসতে শিখেছে, চলতে শিখেছে। সে তো আগের নওরি নেই। তাহলে তাঁর আবার কিসের ভয়? সে তো পারবেই রাফিয়া উলটো পালটা কিছু বললে সঠিক জবাব দিতে। নওরি নিজের সমস্ত মনোবল একসাথে জড়ো করার চেষ্টা করলো। অতঃপর লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে কল রিসিভ করলো। থমথমে সুরে বললো,
–“হ্যালো!”
–“নওরি, বোন আমার। কেমন আছিস তুই?”
নওরি তাচ্ছিল্যের হাসি দিও। কন্ঠে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলে,
–“খুব ভালো আছি। তুমি?”
–“ভালো। কোথায় আছিস তুই? জানিস কত মনে পরেছে তোকে। এভাবে না বলে কোথায় হারিয়ে গেলি?”
–“তাই? তা মনে পরলে দেড় বছর পরে এসে খবর নিলে কেন? এতই যদি মোহাব্বত তাহলে যেদিন পালিয়েছি তার কিছু দিনের মাঝেই খবর নিতে!”
–“আমি লজ্জিত আমার কর্মে নওরি। আমি এখন বুঝতে পারছি বাইরের মানুষের জন্যে আমার নিজের ঘরের মেয়েকে কতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছি, মানসিক অ!ত্যা!চার করেছি! আমার জন্যেই তুই বাড়ি ছেড়েছিস। আমার ভুলের ক্ষমা হয় না আমি জানি কিন্তু ক্ষমা না চেয়ে আমি থাকতে পারছি না রে!”
রাফিয়ার ভাঙা গলা। নওরি নরম হলো। যতই হোক, বোন তো। বোনকে কী করে অবহেলা করবে সে? তাঁর বোন স্বার্থপর হতে পারে কিন্তু নওরি তো পারে না। নওরি নরম গলায় বলে,
–“আমার নাম্বার কোথায় পেলে?”
–“একদিন ছাদে তোর সাথে মাহি আপুর কথা বলতে দেখেছিলাম। তিনি “নওরি” উচ্চারণ করেছিলো। পরবর্তীতে মাহিকে অনেক রিকুয়েষ্ট করি তোর নাম্বারটা দেয়ার জন্যে। কিন্তু মাহি দেয়নি। পরে সুরভীকে দিয়ে নাম্বার আনিয়েছি।”
নওরি আঁতকে উঠলো। ভয়ার্ত কন্ঠে শুধায়,
–“বাসার কেউ জানে?”
–“না জানে না। জানাইনি। তুই ফিরে আয় বোন!”
নওরি রাফিয়ার সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,
–“বাবা কেমন আছে?”
–“ভালো। তুই চলে যাওয়ার পর বাবা তর-তাজা নেই। ইদানীং তোর কথা খুব জিজ্ঞেস করে। আফসোস করে।”
নওরি চুপ করে পদতলের নিকট দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। বাবার মুখশ্রী চোখের সামনে ভেসে উঠেছে মুহূর্তে-ই। নওরির নিরবতায় রাফিয়া বললো,
–“হ্যালো? হ্যালো?”
নওরি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে তাকাতেই কয়েকি ভোল্টের শক খেলো। অতি দ্রুত আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো সে। ওদিকে রাফিয়া “হ্যালো, হ্যালো” করেই চলেছে। নওরি খট করে কল কেটে দিলো। ফোন একেবারে বন্ধ করে সেটা ব্যাগে পুরলো। দেয়ালের পেছন থেকে মাথা বের করে উঁকি দিলো নওরি। দৃষ্টি তাঁর আতঙ্কিত দেখাচ্ছে। তাঁর থেকে-ই কিছুটা দূরত্বে প্রিতম হেসে হেসে কথা বলছে। নওরির আত্মা শুকিয়ে গেলো যেন। থরথর করে কাঁপছে সে। শেষ পর্যন্ত এভাবে প্রিতমের খপ্পরে পরবে কে জানে? নওরির নিজেকে নিজে মা!র দিতে ইচ্ছা করলো। কী হতো আরেকটু সময় অপেক্ষা করতে? কেন বেশি বুঝে হেঁটে আসতে গেলো সে? হেঁটে না আসলে অন্তত প্রিতমকে পেত না। নওরি সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো। নাহ কোনো রিকশা বা সিএনজি নেই। রিকশা ওয়ালাদের উপর আজই কেন ঠা!ডা পরতে হলো?
ভয়ে, আতঙ্কে নওরির মাথা কাজ করছে না। কী করবে সে? প্রিতমের আশেপাশে মোটামুটি মানুষজন চলাফেরা করছে কিন্তু প্রিতমের সেদিকে খেয়াল নেই। সে একমনে কথা বলেই চলেছে। নওরির হঠাৎ মনে পরলো, সে তো বোরকা, হিজাবে আবৃত। প্রিতম তাকে কী করে চিনবে? অবশ্যই চিনবে না সে! নওরি কিছুটা স্বস্তিবোধ করলো। কোনো রকমে এড়িয়ে যাওয়া যাবে তাহলে। নওরি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো সটান মেরে দাঁড়ালো। ভয় পেলে চলবে না। স্বাভাবিক ভাবে প্রিতমের পাশ কেটে যাবে বলেই ঠিক করেছে সে। মাথা নিচু করে হাঁটা দিবে সে।
“ভয় নেই, কিছু হবে না!” এই মনোবল নিয়ে আল্লাহ্’র নাম নিয়ে নওরি এগোতে লাগলো। মনে মনে অসংখ্যবার আল্লাহ্ কে ডাকলো। প্রিতমকে অতিক্রম করতে যেতেই আতঙ্কে নওরির পা চলছিলো না। ভীষণ কাঁপছিলো সে। কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। প্রিতম সেভাবে তাকে খেয়াল করেনি। নওরি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই পেছন থেকে প্রিতমের ডাক শুনতে পেলো।
–“এইযে মিস শুনছো?”
নওরির ভয়ে আত্মা কেঁপে ওঠে। নওরি থামলো না সেই ডাকে। না শোনার ভান করে অনেকটা দূর চলে গেলো। প্রিতম হাতে একটি কাগজ নিয়ে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকবার ডেকেছে নওরিকে কিন্তু নওরি শুনলো না? মেয়েটির যাওয়ার পানে তাকিয়ে প্রিতম ভাবলো,
–“অদ্ভুত মেয়ে তো!”
প্রিতম কী ভেবে কাগজটা আস্তে করে খুলে দেখলো। প্রয়োজনীয় হলে নওরির পিছে গিয়ে ফিরিয়ে দিবে আর প্রয়োজনীয় না হলে ফেলে দিবে। প্রিতম কাগজটি খুলতেই দেখলো একটি ট্রেইলারের কাগজ। ওটাতে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে “নওরি”!
প্রিতম প্রথমে বিষ্ময়ের সাথে চেয়ে রইলো কাগজটির দিকে। বিষ্ময়ে তাঁর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। প্রিতম আবার সামনে তাকিয়ে খুঁজলো মেয়েটিকে। নাহ্, নেই কোথাও নওরি। এর মানে কী এটাই নওরি? নওরি দেখেই তাঁর ডাককে এভাবে অবজ্ঞা করলো? প্রিতম হাসলো। বিজয়ের হাসি। হাসি বজায় রেখেই শূণ্য রাস্তায় নজর দিয়ে বলে,
–” অবশেষে তোমাকে পেয়েছি পাখি। এবার তুমি আমার হবেই। লুকোচুরি খুব হয়েছে, খুব জ্বালিয়েছো, এবার পালা তোমার ধরা দেবার। সুইটহার্ট!”
——————–
নওরি হন্তদন্ত হয়ে তাঁর রুমে প্রবেশ করলো। প্রচন্ড হাঁপাচ্ছে সে। রিকশা পেয়ে তখনই চলে এসেছে সে। ভীষণ ভয় লাগছে তাঁর। প্রিতম এখন এই শহরে। তবে এই ভেবেও স্বস্তি মিললো যে প্রিতম তাকে দেখেনি। তাও একটা ভয় তাকে তাড়া করেই চলেছে। কীভাবে কী করবে সে? নওরি দ্রুত ফোন অন করে ফেললো। মাহিকে দেয়া ভীষণ জরুরি। ফোন অন করতেই দেখলো রাফিয়ার কল। রাফিয়ার পরে ইরা’দের কল। এই মুহূর্তে নওরি ইরা’দকেও খেয়াল করলো না। বদ্ধ উ!ম্মাদের মতোন ডায়াল লিস্টে মাহির নাম্বার খুঁজতে লাগলো সে। সবকিছু সহজ, অথচ ভয়ের চটে সব গাঢ় শক্ত লাগছে নওরির কাছে। মাহির নাম্বার পেতেই দ্রুত কল করে ফোন কানে দিলো সে। বারবার নেটওয়ার্কের বাইরে বলছে৷ নওরি হতাশ হলো। ভীষণ হতাশ।
কোনভাবে বোরকা খুলে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো সে। ফ্রিশা ঘরের এক কোণায় তখন ঘুমোতে ব্যস্ত। খুদা পেয়েছে নওরির। খালি পেটে মাথা কাজ করছে না তাঁর। বিধ্বস্ত অবস্থায় নওরি তরকারি গরম করলো চুলায়। গরম করতে গিয়ে আনমনে হয়ে যায় সে। গরম হলে দু’হাতে তরকারির পাতিল নিয়ে অন্যদিকে ফিরতেই হাতে আগুনের ছ্যাঁকা লাগলো। নওরি আর্তনাদ করে পাশের বেসিনেই শব্দ করে পাতিলটা রাখে। এর ঘটে যায় বিরাট কান্ড৷ হাতে ছ্যাঁকা খাওয়ার সময় নওরির ওড়নাতেও আগুন লেগে মেঝেতে পরে যায়।
নওরি ফোন ধরছিলো না দেখে ইরা’দ নিজেই ওদের বাসাতে আসে। দরজা ভেঁজানো। এর মানে নূরজাহান কোথাও গিয়েছে? হঠাৎ ভেতর থেকে শব্দ পেয়ে ইরা’দ প্রথমে রান্নাঘরের দিকে তাকালো। নওরি ওড়নায় আগুন জ্বলছে। আঁতকে উঠলো ইরা’দ। দ্রুত ছুটলো নওরির দিকে।
———————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
গঠনমূলক মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকলাম। রিচেক দেয়া হয়নি, ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।