#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ১০ |
——————-
আজ ভালোমতোন সিটকিনি দিয়ে ঘুমিয়েছে নওরি। গত রাতের ঘটনা মস্তিষ্কে এতটাই গভীর দাগ কেটেছে যা নওরি কল্পনা করতে পারে না। কী কেলেঙ্কারি এক কান্ড৷
ভোর ছয়টা। নামাজ সেরে নওরি রান্নাঘরে ঢুকেছে৷ এতদিনে নওরি যতটুকু বুঝেছে নূরজাহান ঠিক সাতটায় রান্নাঘরে ঢুকে। ঘুম চোখে নিয়ে সর্বপ্রথম এক পাতিল গরম পানি দিবে। এটা অবশ্য সৈকত সাহেবের জন্যেই। তিনি রোজ অফিসে যাবার পূর্বে গোসল সেরে যান। উষ্ণ পানির রমরমা গোসল!
নওরি প্রথমে নাস্তার জন্যে জিনিসপত্র খুঁজতে লাগলো। নাস্তা অর্ধেক হতেই ঘড়ির দিকে তাকালো সে। সাতটা বাজতে কিছুক্ষণ। নওরি তৎক্ষণাৎ ব্যস্ত হাতে এক চুলো খালি করে বড়ো পাতিলে পানি ভরে চুলোয় চড়িয়ে দিলো।
নওরির রুটি বেলার মুহূর্তে-ই নূরজাহান ঘুমের ঘোরে রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন। নওরিকে রুটি বেলতে দেখে ঘুম উড়ে গেলো নূরজাহানের। গোল গোল চোখে পুরো রান্নাঘরে চোখ বুলিয়ে নিলো। সবই ঠিকঠাক।
চুলোর একপাশে থাকা আলু ভাঁজির কড়াই থেকে ধোঁয়া উড়ছে। চুলোতেও গরম পানি চড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মেয়েটা এতকিছু কখন করলো? নূরজাহান ব্যস্ত সুরে শুধায়,
–“এ কী! এসব কী করছো তুমি?”
নওরি রুটি বেলা থামিয়ে হাতের উল্টোপিঠে ঘর্মাক্ত কপাল মুছতে মুছতে মৃদু গলায় শুধায়,
–“ভালো লাগছিলো না। তাই করে ফেললাম। রুটি বেলা প্রায় শেষ। নাস্তার সময়ের আগে ভেঁজে দিবো, গরম গরম খেতে ভালো লাগবে।”
নূরজাহান নওরির কথা শুনলেন না। তড়িৎ নওরির হাতের বেলুনীটা কেড়ে নিয়ে বলেন,
–“আমি করে নিবো। এতক্ষণ যা করার করেছো আর নয়। ভালো না লাগিলে বাহির থেকে ঘুরে আসবে। তাও রান্নাঘরে গরমে সিদ্ধ হবার প্রয়োজন নেই, বুঝেছো?”
আলতো হাসলো নওরি। ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে পরলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একমনে তাকিয়ে রইলো বাড়ির বাগানটার দিকে। ফ্রিশা বর্তমানে নওরির পায়ের উপর হাত-পা মেলে ঘুমোচ্ছে।
–“গতকাল বাগানটায় যাওয়া হয়নি। আজ বড্ড লোভ লেগেছে বাগানে যাওয়ার, মালিদের সাথে একটু আলাপ করার!”
মনের অফুরন্ত ভাবনা নিয়ে আরও মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয় বাগানটার দিকে। কী মনে করে ফ্রিশাকে কোল পা থেকে আলতো করে সরিয়ে রুমের ভেতর চলে গেলো। ওড়না গায়ে ভালো করে জড়াতেই ফ্রিশা তাঁর পিছু নিলো। নওরির হাব ভাবে ফ্রিশা বেশ বুঝে নিয়েছে খোলামেলা পরিবেশে নিজেকে আবারও হারাতে চলেছে।
বাগানে আসতেই ফ্রিশা এদিক সেদিক ছুটাছুটি শুরু করে দিলো। নওরি একপলক ফ্রিশার দিকে তাকিয়ে এদিক ওদিক আনমনে ঘুরতে লাগলো। এই বাগান দেখে নওরির মনে পরে গেলো প্রিতমের সাথের কালো মুহূর্তটি। বিষাদে গা শিরশির করে উঠলো নওরির। কতটা ভয়ানক ছিলো সেই দিনটি। সব থেকে বড়ো দোষ ছিলো প্রিতমের চাহনিতে। চাহনিতে স্বচ্ছতার রেশ ছিলো না। অদ্ভুত, গা গুলিয়ে আসা চাহনি ছিলো।
হঠাৎ নওরি অতীত ভুলে এক হলদে ফুলের সন্ধান পেলো। এই ফুলের নাম জানে না সে। তবে সবুজের সমারোহে হলুদ ফুল গুলো অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। নওরি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় ফুলগুলোর দিকে।
হঠাৎ কী মনে হতেই একটি ফুল ছিঁড়ে হাতে নিয়ে নিলো সে। এমন সময় কর্কশ কন্ঠে নওরি চমকে উঠলো।রোশপূর্ণ, ভারী পুরুষালি কন্ঠ। নওরি পিছে ফিরতেই দেখলো হাতে গাছে পানি দেয়া বালতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মধ্যবয়সী লোক। লোকটি এগিয়ে এলো নওরির দিকে।
–“কে তুমি মেয়ে? ফুল ছিঁড়েছো কেন?”
নওরি আমতা আমতা করে শুধায়,
–“আমি নওরি। নূরজাহান আন্টির দূসম্পর্কের আত্নীয়।”
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ রইলো। হয়তো মন-গহ্বরে নামটি নিয়ে তীব্র রেশারেশি চলছে তাঁর। নওরি নূরজাহানের স্বামীর নাম মনে করার চেষ্টা করলো। হয়তো চাচা তাকেই চিনবে। মাথায় কিছুটা জোর খাটাতেই নামটি মনে এলো নওরির। সময় বিলম্ব না করে লোকটির উদ্দেশ্যে বললো,
–“সৈকত আঙ্কেলের ওয়াইফ নূরজাহান আন্টি।”
———————-
সকাল দশটা। মাহির সাথে কথা বলতে মন বড্ড আনচান করছে তাঁর। হাতে কিছু খুচরো টাকা নিয়ে নওরি নূরজাহানের কাছে গেলো। নিদ্র স্কুলে এবং সারিফা কলেজে। বর্তমানে কিছু কাপড় কাঁচতে ব্যস্ত সে। কাজের বুয়া আজ আসেনি এখনো। তাই সৈকত সাহেবের কাপড় গুলো নিজেই ধুঁতে বসেছেন। নওরি ইতস্তত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বলে,
–“আন্টি?”
মাথা উঁচু করে তাকালেন নূরজাহান। নওরিকে দেখে জোরপূর্বক হেসে বলে,
–“হ্যাঁ বলো।”
–“মোবাইলে রিচার্জ করে কোন দোকানে? একটু বলে দিবেন?”
হাসি উড়ে গেলো নূরজাহান। চোখ-মুখে একরাশ বিস্ময় ফুটিয়ে বলে,
–“কেন? হঠাৎ?”
–“মোবাইলে টাকা নেই আন্টি। জরুরি কলেরও একটু তাড়া আছে।”
–“তাহলে আমারটা দিয়ে কল করে নাও।”
পরমুহূর্তে নূরজাহানের কী মনে হতেই আফসোসের সুরে বললো,
–“আমারও তো ফোনে ব্যালেন্স নেই। গতকালই ভাবীর সাথে কথা বলতে গিয়ে ফুরিয়েছে।”
–“তাহলে আপনি-ই দোকানটি চিনিয়ে দিন আন্টি। আমি যেতে পারবো।”
নূরজাহান কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
–“বামপাশের গলি দিয়ে কিছুদূর হাঁটলেই রিচার্জ এবং বিকাশের জন্যে একটি দোকান পাবে। সাবধানে যাবে।”
নওরি মাথা নাড়িয়ে একপলক রুমের দিকে তাকালো। ফ্রিশাকে রুমে বন্ধ করে এসেছে সে। নওরি কোনোক্রমেই চায় না ফ্রিশা রাস্তাঘাটে তাঁর সাথে আসুক। এমনিতেই অচেনা জায়গা। হারিয়ে ফেলার ভয় বেশি।
খান ভিলার ডানপাশে কিছুটা দূরত্বে একটি টঙ আছে। মোটামুটি রকমের, খুব বেশি বড়ও না। ওটা যেন ইরা’দের জন্যে এক আস্ত ভালোবাসা স্বরূপ! সেখানে বসে বর্তমানে নিখিলের সাথে চা পান করছে।
নিখিল তার বেস্টফ্রেন্ড। হিন্দু ধর্মালম্বীর হলেও তাদের মধ্যে ধর্মের ভেদাভেদ কখনোই ছিলো না। ধর্ম নিয়ে শেষ কবে কথা বলেছিলো সেটাও তাদের মনে নেই।
কয়েকজন বন্ধু মিলে টঙের ছাউনিতে করা কাঠের বেঞ্চগুলোতে বসে নানান আলাপ – আলোচনায় ব্যস্ত। বেশিরভাগ কথাই হয় রাজনীতি নিয়ে। এখন ইরা’দ মোটামুটি ফ্রী। শুধু বুধবারে প্রসাশন অফিসে গিয়ে তাঁর হাজিরা খাতায় সাইন করে আসতে হয়।
এছাড়া আশেপাশে কোনো সম্মেলন অথবা জনসভা বসলে সেদিকেও যেতে হয়। তবে এই সপ্তাহ কোনোরকম সম্মেলন বা কোনো কাজের তাড়া নেই। তাই হয়তো নিশ্চিন্তে টঙে বসে আড্ডা দিতে পারছে।
হঠাৎ নিজ বাড়ির গেটের দিকে নজর যেতেই ইরা’দ থমকালো। ভ্রু কুচকে বোঝার চেষ্টা করলো আদৌ সঠিক দেখছে কী না! কিন্তু তা নয়। সঠিক-ই দেখছে। ওটা নওরি! নওরি এদিক ওদিক সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে বামপাশের দিকে হাঁটা দিলো।
ভেতরটা খুঁতখুঁত করে উঠলো ইরা’দের। ভোরেও নওরিকে দেখেছিলো সে। বাগানে। ইরা’দ যে বারান্দায় ছিলো সেটা নওরি খেয়াল করেনি। তবে নওরি বাড়ির বাহিরে কেন, কোথায় যাচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ নিখিলদের চমকে দিয়ে ইরা’দ উঠে দাঁড়ালো। নিখিল মাথা উঁচু করে ইরা’দের দিকে তাকালো। ইরা’দের থমথমে চাহনির আগা-মাথা কিছুই বুঝলো না সে। গোল গোল চাহনি নিক্ষেপ করে নিখিল বললো,
–“কী হলো?”
–“তোরা চা খা। আমি একটু আসছি!” রাশভারী কন্ঠস্বর।
নিখিল ইরা’দের উক্তির বিপরীতে প্রশ্ন করার পূর্বেই ইরা’দ হন্তদন্ত পায়ে চলে গেলো। নিখিল ঘাড় বাঁকিয়ে ইরা’দের হঠাৎ চলে যাওয়া দেখছে। অন্যমনস্ক হয়ে ইরা’দের একজন সহকারীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“আবার কী হলো এর? কই যাচ্ছে? অদ্ভুত তো!”
———–
–“নৌরি ফুল, দাঁড়ান!!”
ভরাট, শীতল পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে নওরির চলমান পা জোড়া দমে গেলো নিমিষেই। কানের পাশ দিয়ে যেন শিহরণ বয়ে গেলো তাঁর। চমকে পিছে ফিরে তাকালো নওরি। ইরা’দকে দেখে নিঃশ্বাস আটকে গেলো যেন। ইরা’দ এগিয়ে আসলো নওরির দিকে। দুই হাত দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। নওরি ভীত নজরে ইরা’দের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা’দ সেই চোখে তাকাতেই নওরি সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি নত করে ফেললো।
–“কোথায় যাচ্ছেন?”
–“পা..পাশেই!”
–“হঠাৎ?”
–“রিচার্জ করব!”
–“তো আপনার যাওয়ার কী দরকার? আমায় দিন।”
“আপনি” সম্বোধনটা নওরির বুকে তীরের মতো বিঁধছে। এতটা সম্মান পেয়ে তাঁর দাঁড়িয়ে থাকতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। এ জীবনে এতটা সম্মান দিয়ে কেউ কখনো কথা বলেনি তাঁর সাথে। লোকটা এমন কেন? কী চায় সে? কেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপ দেখায়? নওরির জানা নেই, সত্যি কিছু জানা নেই তাঁর। ইরা’দ নামক ব্যক্তিটি এক গোলকধাঁধা, এক চক্র। যেই চক্রকে ঘিরে হাজারো রহস্য।
–“চুপ আছেন যে? সংকোচ হচ্ছে?”
ইরা’দের হঠাৎ বলা বাক্যে নওরির ধ্যান ফেরে৷ আমতা আমতা করে বলে,
–“জ্বী, না। আসলে নাম্বার জানি না আমি!”
ইরা’দ হতভম্বের মতোন তাকিয়ে রইলো নওরির পানে। এ যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। কোনো মেয়ে নিজের নাম্বার জানে না? নিজের পার্সোনাল নাম্বার? এ তো আজ-কালকার জামানায় একদম অসম্ভব। ইরা’দ নিজের বিস্ময় দমিয়ে বলে,
–“কী সিম?”
–“রবি।”
–“তাহলে আপনার ফোনটি দিন। আমি রিচার্জ করে আসছি। আপনি বাসায় যান!”
–“না, না! আমি যেতে পারবো।”
ইরা’দ এদিক ওদিক তাকালো। মূলত এসব আবাসিক এলাকা গুলো ভীষণ নিরব থাকে। আশেপাশে মানুষও দেখা যায় না খুব একটা। তবে রিচার্জের দোকানটি আবাসিকের মধ্যে পরেনি। লোকালয়ে পরেছে। বেশ কিছুটা দূরেও বটে!
ইরা’দ হঠাৎ নওরির হাতের ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলে,
–“ওখানটায় বখাটে ছেলেদের আড্ডা আছে। আপনি একা সেখানে একদমই নিরাপদ নন। বাসায় যান! আমি রিচার্জ করে আসছি!”
ইরা’দ যেতে নিলে নওরি আটকে বলে,
–“টাকাটা নিচ্ছেন না..?”
ইরা’দ আলতো হেসে বলে,
–“টাকার সংকট পরেনি আমার। ওটা রেখে দিন!”
ইরা’দ চলে যেতে নিলে নওরি হঠাৎ বলে ওঠে,
–“আমি আপনার কাছে ঋণি হতে চাই না।”
ইরা’দ দমে গেলো। ফিচেল হাসি দিয়ে পিছে ফিরে বেশ সরল কন্ঠে বলে ওঠে,
–“কিছু কিছু ঋণ দেখতে এবং ভাবতে সুন্দর। সৌন্দর্য নষ্ট করতে নেই। বাসায় যান।”
————————
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।