#একটুখানি ভালোবাসা
#পর্ব_২৪_শেষাংশ
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
” আমি দুঃখিত মি. স্পর্শ। আমরা আপনার স্ত্রী’কে বাঁচাতে পারলাম না। তবে আপনার সন্তান সুস্থ রয়েছে। আসলে আপনার স্ত্রীর রক্ত অনেকটাই বেরিয়ে গেছে। তারউপর পেটে গুরুতরভাবে আঘাত পেয়েছে। আল্লাহর দয়ায় বাচ্চা সুস্থ আছে।
ডক্টরের কথা শুনে স্পর্শ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। মস্তিষ্ক কাজ করছে না স্পর্শের। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল স্পর্শ। স্পর্শের পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেল। সে আর বলতেই পারলো না যে সে তার মায়াবতীকে কতটা ভালোবাসে। স্পর্শের জন্য মনে অভিমান রেখেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো মাধবীলতা। চোখের পানি হাজারো আটকানোর চেষ্টা করে আজ ব্যর্থ স্পর্শ। এদিকে মাধবীলতার মা বাবা এবং বোন কান্না করতে করতে পুরো হাসপাতাল মাথায় তুলে ফেলেছে।
ডক্টর স্পর্শের কাঁধে হাত রেখে বলে,
” নিজেকে সামলে নিন ভাই। কী করবেন বলুন, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। একদিন আপনাকে আমাকে সবাইকেই আপন ঠিকানা ছেড়ে চলে যেতে হবে। আপনার মেয়েকে দেখুন। একদম আপনার স্ত্রীর মতো দেখতে হয়েছে।
ডক্টর চলে যেতেই স্পর্শ উঠে দাঁড়ায়। এক পা দু পা করে এগোতে থাকে। স্পর্শের মনে হচ্ছে কেউ তার কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। নিঃশ্বাস নিতেও যে বড়ো কষ্ট হচ্ছে তার। নার্স এসে বাবুকে কোলে তুলে দেয় স্পর্শের। স্পর্শ একপলক দৃষ্টিতে দেখছে তার মেয়েকে। নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায় স্পর্শের। ঠিক যেন মাধবীলতা ঘুমোচ্ছে তার কোলে। স্পর্শের মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দে একটি শব্দ বের হয় “মায়াবতী”।
আলতো করে কপালে একটা চুমু দিল স্পর্শ। এবার চোখ পড়লো মাধবীলতার মৃতদেহের উপর। সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। নার্স মুখের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দিল। স্পর্শ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রয়েছে মাধবীলতার মুখপানে। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির প্রলেপ লেপ্টে রয়েছে এখনো। স্পর্শের মনে হচ্ছে তার মায়াবতী হয়তো ঘুমিয়ে আছে। এই বুঝি উঠে বলবে ” এইযে আমার ঘুম পাচ্ছে তোমার বুকটা পেতে দাও আমি ঘুমাবো। তোমার বুকে মাথা না রাখলে আমার ঘুম আসে না।
স্পর্শের চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা পানি মাধবীলতার ঠোঁটে পড়ে। স্পর্শের শ্বাস প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। শ্বাস নিতে এতটাই কষ্ট হচ্ছে যে, মনে হচ্ছে এই বুঝি মৃত্যু তাকেও আপন করে নিলো। স্পর্শ বুঝতে পারছে তার সাথে কী হতে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শ মাধবীলতার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” আমাকে ক্ষমা করে দাও মায়াবতী।
স্পর্শ মাধবীলতার কপালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দেয়। এমন সময় আবীর লক্ষ্য করল স্পর্শের কোল ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। বাবুটাও আস্তে আস্তে মাটিতে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। আবীর স্পর্শকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” ভাইয়া এটা কী করছেন? বাবু তো পড়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আবীরের কথায় কোনো কাজ হলো। মাটিতে পড়ার আগেই আবীর বাবুকে ধরে ফেলে। স্পর্শ এখনো একইরকম অবস্থায় রয়েছে। মনে হচ্ছে মাধবীলতার কপালে এক গভীর ভালোবাসার পরশ একে দিচ্ছে স্পর্শ। আবীর বারবার স্পর্শকে ডাকছে। কিন্তু স্পর্শের কোনো সাড়াশব্দ নেই। আবীর স্পর্শের কাঁধে হাত রেখে একটু টান দিতেই স্পর্শের দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেখানে উপস্থিত সকলের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। নার্স এসে পরীক্ষা করে বলে,
” উনিও আর,,,,,,!
হাসপাতালের সকলেই যেন হতভম্ব। সবাই নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। কতটা ভালোবাসলে স্ত্রীর মৃত্যুর শোকে একটা ছেলেও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে পারে! যে ছেলেটার পেটে বারবার ছুরির কোপ দেওয়া সত্বেও বেঁচে থাকতো। সেই ছেলেটাই স্ত্রীর মৃত্যুতে নিজেও সবকিছুর মায়া ত্যাগ করল।
আবীরের মাথা শূন্য হয়ে গেছে। পৃথিবীটাই অন্ধকার হয়ে আসছে তার।
এমন সময় স্পর্শের বাচ্চা কেঁদে ওঠে। হয়তো খিদে পেয়েছে। এই নিষ্পাপ মেয়েটারই কী হবে? তার ভবিষ্যৎ কী? মা বাবা কীভাবে কাটবে তার বাকি জীবনটা?
নার্স বলে,
” বাবুর খিদে পেয়েছে হয়তো। কিন্তু ওকে কে খাওয়াবে? ওর মা তো আর নেই।
তখন পিছন থেকে এক ব্যক্তি বলে ওঠে,
” বাবুটাকে আমার কাছে দিন। আজ আমারও স্ত্রীর বাবু হয়েছে। আমি ওকে খাইয়ে আনছি।
আবীর স্পর্শের বাবুকে লোকটার কোলে দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলে,
” বড়ো কৃতজ্ঞ থাকব ভাই। বাঁচালেন আমাদের।
লোকটি বাবুকে নিয়ে গেল।
মাধবীলতা এবং স্পর্শের লাশ মায়াপুরী নিয়ে যেতে একদিন সময় লেগে গেল।
আবীর আগেই বড় মামাকে ফোন করে বলে দিয়েছে সব ঘটনা। এবং এটাও বলেছে যে সবার আড়ালে দু’টো কবর খুঁড়ে রাখতে যেন কেউ জানতে না পারে। বড় মামা স্পর্শের মৃত্যুর খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন তার পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। সে কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে স্পর্শ মারা গেছে। যে ছেলেটা মানুষকে বাঁচতে শেখায়, যার কাছে মানুষ জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করার অনুপ্রাণিত হয়। সেই ছেলেটা এত সহজে মরে গেল। বড় মামা মাধবীলতা এবং স্পর্শের মৃত্যুর ঘটনাটি বাড়ির সকলের আড়ালে রেখেছে। কারণ নানা- নানু যদি জানতে পারে তাহলে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়বে নিজেকে সামলাতে পারবে না তারা। বড় মামা নিজেকে যে কীভাবে দমিয়ে রেখেছে সেটা তিনিই জানেন। তার বারবার মনে হয়েছিল যে চিৎকার করে বুক ফাটিয়ে কান্না করতে কিন্তু নিজের মা-বাবার কারণে কাঁদতে পারেনি।
স্পর্শ আর মাধবীলতার লাশ দু’টো যখন বাড়ির উঠোনে রাখা হয় তখন বাড়ির সকলে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে বাইরে আসে। দু’টো লাশ দেখে নানু আঁতকে ওঠে। তড়িঘড়ি করে বড় ছেলের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
” খোকা এসব কী? লাশ কেনো আমাদের বাড়ির উঠোনে রাখা হয়েছে?
নানু তার বড় ছেলের চোখে পানি দেখে অবাক হলেন।
” খোকা তুই কাঁদছিস কেনো? কী হয়েছে তোর?
বড় মামা নানুর হাতদুটো শক্ত করে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
” মা আমাদের গুড্ডু সোনা যে আর নেই।
বড় মামার কথা শুনে বাড়ির প্রতিটি ব্যক্তির পিলে চমকে ওঠে। কেউ-ই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
নানু ভাই রেগে গিয়ে নিজের হাতে থাকা লাঠি দিয়ে নিজের বড় ছেলেকে মারতে শুরু করল।
” তুই আর মানুষ পাসনি! আমার গুড্ডু সোনাকে নিয়ে তোর মজা করতে হচ্ছে। আজ তো তোকে আমি মেরেই ফেলবো।
এমন সময় বাসাতে স্পর্শ আর মাধবীলতার লাশের উপর থেকে কিছুটা কাপড় সরে যায়। মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। স্পর্শের লাশ দেখে নানু স্তব্ধ হয়ে গেল। লাঠিতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে তিনি স্পর্শের পাশে গেলেন। ধপ করে বসে পড়েন। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে স্পর্শের মাথাটা কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। আহাজারি বকতে থাকল নানু। মামি, মিথিলা আর বাকি সবাই ছুটে এলেন। কান্নার রোল পড়ে যায় জমিদার বাড়িতে। এই বাড়িতেই বারবার এমন কান্নার উৎসব পালন করা হয়। প্রথম উৎসব পালন হয় স্পর্শের মা বাবা এবং বোনের লাশ রেখে। তারপর হয়েছে স্পর্শের অসুস্থতার সময়। আর এখন শেষবারের মতো হচ্ছে স্বয়ং স্পর্শের লাশ সামনে রেখে।
অবশেষে স্পর্শ আর মাধবীলতাকে পাশাপাশি দু’টো কবরে শায়িত রাখা হলো। কথা ছিল সারাজীবন একসঙ্গে থাকার। সেটাই হলো। হাজারো ঝড়ঝাপটা এলেও কখনো আলাদা হবে না। স্পর্শ রেখেছে তার মায়াবতীকে দেওয়া কথা। মাটি দেওয়া শেষ করে একে একে সবাই যে যার গন্তব্যে চলে যায়। আবীর স্পর্শের কবরের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মনে পড়ে হাজারো স্মৃতি। কী মিষ্টি ছিল আবীর আর স্পর্শের সম্পর্ক। সুখে দুখে প্রতিটি মুহূর্তে ছায়ার মতো ছিল একে অপরের পাশে। স্পর্শের মনে পড়ে সেদিনের কথা। যখন আবীর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতো। আবীর ছিল একটা রাস্তার ছেলে। এটা ওটা চুরি করে দিন কাটাতো। একটা সময় স্পর্শের চোখে পড়লে তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে যায়। স্থান দেয় নিজের বুকে। কয়েকবছর পর আবীরের যখন একটা কিডনি পঁচে যায় তখন স্পর্শের ব্যাকুলতা দেখে আবীর একমুহূর্তের জন্য ভেবেছিল স্পর্শ তার আপন মায়ের পেটের ভাই। ডক্টরকে বলে ” প্রয়োজন হলে আমার একটা কিডনি দিয়ে দেবো তবুও আমার ভাইকে বাঁচান।
আফসোস রক্তের গ্রুপে মিল না থাকায় ডক্টর তা করতে পারেনি। তবে কিডনি পাওয়া গেছিল।
স্পর্শের ভালোবাসার প্রতিটি মুহূর্তের কৃতজ্ঞ থাকে আবীর। হয়তো নিজের ভাই ও এতটা ভালোবাসে না।
আবীর হাঁটু গেড়ে স্পর্শের কবরের পাশে বসে।
” ভাইয়া আপনি এতটা দ্রুত আমাকে একা করে চলে যাবেন আমি কখনো ভাবতেই পারিনি। আপনিই ছিলেন আমার শেষ ঠিকানা। আমার মা বাবা, ভাই বোন সবই ছিলেন আপনি। আমি কী করে কাটাবো এই জীবন?
মাধবীলতার কবরে এসে বলতে থাকলো,
” ছোটবেলা থেকে কখনো নিজের পরিবারকে দেখিনি। কে ছিল বাবা আর কে-ই বা ছিল মা। সবকিছুই আমার অজানা। বড় বোন কী সেটাও বুঝতাম না। প্রথমে পেয়েছি পিতার সমতূল্য এক বড় ভাই। আর তারপর আপনাকে। আপনাকে পাওয়ার পর বুঝতে পারি বড় বোনের ভালোবাসা আসলে কতটা মিষ্টি। মা না থাকলেও মায়ের অনুপস্থিতির কষ্ট টা হয়তো একমাত্র বড় বোনই ভুলিয়ে দিতে পারে। আপনাদের পেয়ে কপালে সুখটা হয়তো একটু বেশিই ছিল। কিন্তু এতো সুখ কপালে থাকলো না। কষ্টের দারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাই জানে সুখ তার জীবনে কতটা দামী। যাকে দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না।
সাগর আবীরের কাঁধে হাত রেখে বলে,
” ভাই আর এভাবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ বলুন? তারচেয়ে স্যার এবং ভাবীর জন্য মন খুলে দোয়া করুন। যারা চলে যাওয়ার তারা আজ হোক বা কাল! একদিন ঠিকই চলে যাবে। চলুন বাড়ি ফিরে যাই।
আমীর দাঁড়িয়ে চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে পকেট থেকে একটা ছোট্ট চিঠি বের করে সাগরের হাতে দিলেন।
” আবীর ভাই এটা কী?
” এই চিঠি টা নানুর হাতে দেবেন।
” এতকিছুর মাঝে চিঠি লিখলেন কবে।
” হুজুর যখন ভাইয়ার লাশের গোসল করাচ্ছিল, সেই সময় লিখেছি।
” কিন্তু আমি কেনো? আপনিই তো দিতে পারবেন।
” না রে ভাই আমি দেবো না। তুমি বরং যাও।
” আপনি কোথায় যাবেন?
” আমি এইতো আসছি। তুমি এগোতে থাকো। আমি একটু পরেই এসে যাব।
” ঠিক আছে ভাই দেরি করবেন না।
আবীর একটা শুকনো হাসি উপহার দিলো। সাগর চলে যায়। আবীর শেষবারের মতো স্পর্শ আর মাধবীলতার কবরের দিকে তাকিয়ে উল্টো পথে হাঁটা ধরে।
স্পর্শ আর মাধবীলতাকে একলা ফেলে সবাই চলে যায়। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, ” তোমার #একটুখানি_ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি কাটিয়ে দেবো তোমারি পাশে সারাটি জীবন।
এদিকে মিহির কোলে থাকা স্পর্শের মেয়ের খিদে পাওয়ার কেঁদে ওঠে সে। বাচ্চার কান্নার শব্দে সবাই তাকায় মিহির দিকে। এতক্ষণ কেউই খেয়াল করেনি। মিথিলা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
” এই বাবু টা কার গো মিহি সোনা?
সুবর্ণা বলল,
” স্যার এবং মাধবীলতা আপুর রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতি। তাদের একমাত্র মেয়ে।
মিথিলা সঙ্গে সঙ্গে বাবুকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। মিথিলা প্রাণভরে তাকিয়ে রয়েছে বাচ্চাটার দিকে। মনে হচ্ছে স্পর্শ আর মাধবীলতা দুজনেই বেঁচে রয়েছে। কারণ স্পর্শ আর মাধবীলতার দুজনেরই বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই বাচ্চার মাঝে। কেননা স্পর্শের ডান হাতে ছ’টা আঙুল ছিল যেটা মেয়েটারও রয়েছে। আর চেহারা একদমই মাধবীলতার মতো। মিথিলা বাবুটার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
” ভাইয়া আমি তোকে কথা দিলাম তোদের শেষ স্মৃতিকে আমি সারাজীবন নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখবো আমার বুকে। আজ থেকে আমার দু’টো সন্তান। মিথিলা বাবুকে আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে নিজের বুকের সুধা পান করাতে লাগলো।
সবাই চুপ করে বসে রয়েছে। নানুর চোখের পানি তো শুকিয়েই গেছে। এমন সময় সাগর এসে নানুর হাতে আবীরের দেওয়া চিঠি টা ধরিয়ে দেয়।
” নানু এটা আবীর ভাইয়া আপনাকে দিয়েছে।
নানু চিঠি টা তার ছোট ছেলেকে দিয়ে বলল পড়ে শোনাতে।
তিনি চিঠি টা খুলল।
” নানু আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি ভাবিনি এভাবে ভাইয়া আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আমি তোমাকে কখনোই বলে একা চলে আসতে পারতাম না। তাই না বলেই পালিয়ে গেলাম। আমি ছিলাম সামান্য একটা রাস্তার ছেলে। না ছিল কোনো বাড়ি, না ছিল কোনো ঠিকানা আর না ছিল কোনো অভিভাবক। কোনো এক রাতে ভাইয়া আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিজের রাজপ্রাসাদে নিয়ে যায়। সে আমাকে বাঁচতে শেখালো! জীবনযুদ্ধে কীভাবে লড়াই করতে হয় শেখালো। সে না থাকলে হয়তো একদিন আমার মরা দেহটা কোনো এক রাস্তার ধারে পড়ে থাকতো। হয়তো শেয়াল কুকুরে মিলে ছিঁড়ে খেতো আমার দেহটা। যখন একটা বাড়ি পেলাম, যখন একটা ঠিকানা পেলাম, যখন একজন অভিভাবক পেলাম। তখনই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। আবারো হারিয়ে ফেললাম সবকিছু। যে শহরে আমার বেঁচে থাকার মানুষটা নেই, যে শহরে আমাকে বাঁচতে শেখানোর মানুষটা নেই, যে শহরে আমার মাথার ছাদ নেই। সেই শহরে আমারও কোনো স্থান নেই। জীবনে যতটুকু সময় বেঁচে থাকবো, ততটুকু সময় তার স্মৃতিটুকু নিয়েই নাহয় বেঁচে থাকবো। আর ভাইয়ার শেষ স্মৃতিকে আগলে রেখো। তার জীবনে কখনো এতটুকু অন্ধকার নামতে দিও না। আমি চলে গেলাম অচেনা, অজানা এক গন্তব্যে।যদি বেঁচে থাকি তাহলে দেখা হবে কোনোদিনও। আর যদি না হয় তাহলে ভেবে নিও তোমার গুড্ডু সোনার কাছে তোমার এই অভাগা নাতিটাও চলে গেছে। ভালো থেকো। তোমাদের সকলের #একটুখানি_ভালোবাসা ‘র জন্য আমি সারাটি জীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
চিঠি টা শেষ হতেই নানু নিঃশব্দে কেঁদে ওঠে।
” তোরা সবাই আমাকে এভাবে একা করে ছেড়ে যাচ্ছিস। কেন তুইও চলে গেলি দাদু ভাই? এসব দেখার আগে আমার মৃত্যু কেনো হলো না?
রাত তখন গভীর। রাস্তার এক ধারে রক্তাক্ত দেহ পড়ে রয়েছে। ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। মানুষজন ভিড় জমিয়েছে। লোকটির মুখ থেকে একটাই বাক্য বেড়িয়ে এলো ” আমি আসছি ভাইয়া। আপনাকে ছাড়া আমার জীবন অচল “।
শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। লাশটা হয়তো শায়িত হবে অচেনা কোনো এক কবরস্থানে।
গভীর রাতে বাড়ির কারোর চোখেই ঘুম নেই। নানু বারবার জপে যাচ্ছে, ” আমার গুড্ডু সোনা তুই ফিরে আয় আমার বুকে “।
কিন্তু সে তো আর ফিরবার নয়। চিরতরে হারিয়ে গেছে এক অজানা গন্তব্যে। যে ঠিকানা থেকে হাজার চেষ্টা করলেও কাউকে ফিরিয়ে আনা যায় না। দু’টুকরো ভালোবাসা শুয়ে রয়েছে একে অপরের পাশে।
সবকিছু শেষ হয়ে গেলেও স্পর্শ আর মাধবীলতার ভালোবাসা হয়তো শেষ হবেনা কখনো। বেঁচে থাকুক তাদের ভালোবাসা।
সমাপ্ত।