মাথার উপর কাঠপোড়া রোদ। রোদে ফর্সা মুখ কালো হয়ে গেছে।যেতে হবে সেগুনবাগিচা।ঢাকা শহরে এতো অলিগলির প্যাঁচ যে কিছুতেই টিউশনির বাসা খুঁজে পাচ্ছি না।
ঘন্টাখানিক খুঁজাখুঁজির পর অবশেষে টিউশনির বাসায়।
প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে :
– বাবা তোমার নাম?
– অরণ্য।
-কত সেমিষ্টার?সিজিপিএ? আপাতত আমার বিষয়ে আন্টির সব জানাশোনা শেষ।
– জ্বী আন্টি পারলে আমি প্রতিদিন আসবো আর ঘণ্টা দুয়েক বেশি পড়াতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।
আন্টি আমার রেসপন্স দেখে ভীষণ খুশি। আন্টি হচ্ছেন এই বাসার মেইন কর্তা। যে বাড়িতে মেইন কর্তা নারী হয় সেখানে পুরুষ হয়ে থাকে বোকাসোকা। ঠিক ধরেছেন, আঙ্কেল রাষ্ট্রীয় এক ব্যাংকে চাকরি করে শুধু টাকার ব্যয় বহন করায় উনার দায়িত্ব আর বাদবাকি আন্টির।
ঢাকা শহরে এই সিস্টেমই বেশিরভাগ ফ্যামিলিতে দেখে আসছি।
সবকিছু ঠিকঠাক মনের মতো একটা টিউশনি পেলাম।
অর্পা! তোর স্যারকে নাস্তাটা দিয়ে আয় তো।
আমি একটু বিজি। ছাত্রীর নাম অর্পা।
দেখতে সুন্দরী কিন্তু একটু মোটা। এই মেয়ের বয়স হলে মনে হয় আরো মোটা হবে। তখন সবাই হয়তো মুটকি বলে ক্ষেপাবে। যাকগে ওদিকে আমার ভ্রূক্ষেপ নেই। টিউশনি করাতে আসছি সোজা পড়াবো, কে মোটা না চিকনা সেটা দেখার আপাতত আমার সময় নেই।
.
– স্যার নাস্তা
– ধন্যবাদ। চা আর নুডলস এর নাস্তা।
আমি বললাম চা এর সাথে একটু বিস্কিট হলে মন্দ হত না। ছাত্রী বিস্কিট আনলো।
রসায়ন পড়াচ্ছি। সাইন্সের স্টুডেন্ট, ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। ছাত্রী মিডিয়াম, সাইন্সের স্টুডেন্ট এরকম মিডিয়াম হলে কি চলে? ছাত্রী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো।
কয়েকদিন যাবার পর আন্টির হঠাৎ জেরা। তো বাবা তোমার বাবা- মা এর বিষয়ে তো বললে না। আমি সরল ভঙ্গিতে উত্তর দিলাম :আব্বু FW আর আম্মু HW Instructor হিসেবে নিযুক্ত আছে। আন্টি ওয়াও রিয়েক্ট দিলেন! দুজনের মিলে তো তাহলে মাসিক অনেক সেলারী হয়? জ্বী আন্টি তা তো অবশ্যই। আমি হাতের ঘড়িটি উল্টিয়ে শার্টের কলারটিতে নতুন ভাঁজ দিয়ে আর একটু ভাব নিলাম।বাঙালীদের এই একটি স্বভাব কিছু ইংরেজি ওয়ার্ড শুনলেই মুগ্ধ হয়ে যায় অথচ তার বাংলা মিনিং নিতান্তই সরল যেমন :আন্টি কিছু না বুঝেই ওয়াও রিয়েক্ট দিলো।এরপর থেকে নিয়মিত টিউশনিতে আসি।
.
ইদানীং আপ্যায়নটা একটু বাড়ছে প্রথমত কিছু মনে করেনি যা দিতো তাই খেতাম। তবে মাসেকখানি ধরে আপ্যায়নের ম্যানুটা বাড়ছে তো বাড়ছেই। প্রথম প্রথম চা, বিস্কিট সাথে আরো হাবিজাবি দিতো কিন্তু এখন প্রায়ই ডিনার নয়তো লাঞ্চের
অফার দেয় বেশিরভাগই খাই না। তাই বলে পরের বাসায় এভাবে একসাথে খাওয়াদাওয়া আমার রুচিতে ঠিক সাধছে না। একটা আত্মমর্যাদাবোধ বলে তো কিছু আছে।প্রায়ই অর্পা আমি আর আন্টি ঢাকার ভিতরেই বিকেলে একটুআধটু ঘুরতে বের হই।অবশ্য আমার ইচ্ছায় না আন্টির পীড়াপীড়িতে যেতে বাধ্য হই। বুঝলে অরণ্য ? অর্পার বাবার হাতে যা কাজ আমাদেরকে সময় দিবে কিভাবে? তুমি কিছু মনে করো না। ঠিক আছে আন্টি চলেন সামনে হাঁটি। এভাবেই চলতে থাকে, প্রায়ই আন্টি মার্কেটে নিয়ে যেতো এটা সেটা ছোটখাটো জিনিষ কিনে দিতে। আমি জোরাজুরি করতাম ওসবের কী প্রয়োজন?
.
একবার একটি দামী ঘড়ি গিফট করে। বিভিন্ন ব্যান্ডের ঘড়ি পরা আমার রীতিমত একটা শখ। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, হাত খরচের একটা আলাদা ব্যাপারস্যাপার তো থাকেই। আর কেউ যদি টিউশনির বিনিময়ে স্বেচ্ছায় দিতে চায় তাহলে নিতে আপত্তি কিসে? অর্পা প্রায়ই খুব সাজুগুজু করে পড়তে বসতো। সাজলে অর্পাকে অপরূপ লাগতো যদিও সে হালকা মোটা ছিলো।হয়তো তার মা বলেছে এই দেখ অর্পা! টিচারের সামনে সাজুগুজু করে থাকবি। একদিন কৌতূহলবশত জিগ্যেস করি, আচ্ছা তুমি কি বাসাতে রোজই এভাবে সাজুগুজু করে থাকো? জ্বী মানে স্যার!! আমার সাজতে ভালো লাগে, মেয়ের লাজুক হাসি। মানে কী? তাই বলে এভাবে, হয়তো ঠিক। মেয়েদের এই বয়সে কতরকমের পছন্দ থাকে।আমি সাতপাঁচ অন্যকিছু না ভেবে পড়াতেই মনোযোগী।আমার প্রয়োজন হাত খরচের টাকা আরো দুটি টিউশনি করাই কিন্তু এটি সবথেকে ব্যতিক্রম। মনে হয় নিজের বাসায় আছি আমার কতো ডিমান্ড! মা- মেয়ের উভয়েরই সে কী দেখভাল!
মনে মনে বলি ওরকম টিউশনি সাত জনমেও হয়তো ভাবিনি।
একদিন অর্পা হুট করে বলে বসে স্যার আমি আপনার সাথে ক্যাম্পাসে ঘুরতে যাবো আমাকে নিবেন না? জ্বী আচ্ছা মানে! কী মানে মানে? অর্পা ক্যাম্পাসে যেতে চাচ্ছে তুমি তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসো সবসময় কী ঘরে বসে থাকলে চলে? আন্টির সম্মতিতে সেদিন অর্পাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসি। চারদিকে বন্ধুদের কী বিস্ময়কর চাহনি আমার সাথে অর্পাকে দেখে। সরাসরি কিছু বলতে সাহস করেনি কিন্তু রাতে যখন হলে ফিরি বন্ধুদের সে কী উল্লাস? মামা পার্টি হবে পার্টি কোনো কথা হবে না। বহুদিন পর তোকে মেয়ের সাথে ঘুরতে দেখলাম। আরেকজন বলে ওঠলো: অরণ্য মেয়ের সাথে ঘুরছে? কী কস মামা? কার সাথে? সূর্য আজকে কোন দিকে উঠলো? এটা সেটা আরো কত কী?
.
ভার্সিটি লাইফে বন্ধুদের মাঝে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো কারো কোনো উপলক্ষ এলেই কেউ ট্রিট দেউক আর না দেউক এই মামা ট্রিট চাই, আজ রাতে জম্পেশ একটা পার্টি হবে ইত্যাদি বলবেই। উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ আর উচ্চতা প্রায় ৬ ফিট হওয়া সত্তেও ক্যাম্পাসে এখনো একটা গার্লফ্রেন্ড জুটেনি।হবেই বা কিভাবে? কোনো মেয়ের সাথে আলাদা গল্পগুজব, আড্ডা দেওয়া, ওভাবে কখনো সময় করা আমার পক্ষে সম্ভবই ছিলো না। বলতে পারেন একপ্রকার ইন্ট্রোভার্ট টাইপের। সব কিছুর তর্কাতর্কিতে সমান পারদর্শী হলেও মেয়েদের ব্যাপারে সেই ছোট থেকেই আমার একটা আলাদা জড়তার কাজ ছিলো। এটা একটা বিশেষ রোগও বলা যায়, যারা মেয়ে দেখলেই দূরে দূরে থাকে। তবে এদের সংখ্যা খুব কম, পরিবেশের সাথে একসময় তারা ঠিকই মানিয়ে যায়। তখন তাকে আশেপাশের মানুষ বলে কিরে তোর তো বিশাল পরিবর্তন দেখছি।
.
সেদিন অর্পাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে এসে শরীরে রীতিমত ঘাম ঝরেছিলো, নার্ভাসনেস ৯৯ এ পৌঁছেছিলো। অর্পা তো বলেই ফেললো, স্যার আপনি কি আনইজি ফিল করছেন? ইটস ওকে নো পব্লেম, আমি ঠিক আছি বলে মুখরক্ষা করলাম। সেদিন থেকে মেয়েদের ব্যাপারে এতোটা আর জড়তা কাজ করেনি তবে পুরোপুরি সারেনি। আজ টিউশনির বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলো। বাবা অরণ্য! তুমি আমার ছোট বাচ্চাটাকে এখন থেকে অর্পার সাথে একটু দেখিয়ে দিয়ো কেমন? এবার কিন্ডারগার্ডেনে ভর্তি করাবো। রিটেনে এলাও হতে হবে যে। আর তোমার সম্মানীটাও তো খুব কম। এতো কম দিয়ে কি ঢাকা শহরে চলে।
তোমাকে বরং এই মাস থেকে দশ হাজার করে দেই? হাত খরচটাও ঠিকমতো চলুক। যেদিন থেকে টাকার অংকটা বাড়িয়ে দিলো প্রথমত মনে মনে খুশি হলেও আমার মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে লাগলো। আমি আবার কারো কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছি না তো? আরে দূর কী সব চিন্তা করি, তাঁরা বড়লোক তাঁদের কাছে এসব টাকা হাতের ময়লা। এরপর থেকে অর্পা আমার সাথে প্রায়ই ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসে। ভ্রাম্যমাণ একটা গার্লফেন্ডও পাওয়া গেলো। বন্ধুরা এ নিয়ে কত টিপ্পনী। আরে দূর কী ছাইপাঁশ ভাবী? সে তো আমার ছাত্রী, ছাত্রীকে ছাত্রীর মতোই দেখতে হবে আর আমি শিক্ষক। শিক্ষকের কাজ পাঠ্যদান আর কিছু ভাবা নয়।
অর্পা এবার সেকেন্ড ইয়ারে। সে আর তেমনটা নেই তার পোশাকআশাক, শারীরিক ভাষা, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছু পাল্টিয়েছে।স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আমাকে ঘিরে মা- মেয়ের স্পেশাল পরিকল্পনা আছে।কিন্তু আমি তো তাঁদের মতো নই। আমাকে এগুতে হবে, অনেক বড় হতে হবে। চলার পথে এসব বিষয়ে জড়িয়ে আটকিয়ে থাকা মানে দেখেশুনে সাপের লেজে পা দেওয়া।
.
অবস্থার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে যখন আন্টি
একদিন বলে আচ্ছা অরণ্য! তোমার বাবা- মা কে তো একদিন আমাদের বাসায় আনলে না। উনারা আসুক, ঢাকা শহরটাও ভালো করে দেখে যাক। আমি মনেমনে হাসি, আন্টি আপনি যা চিন্তা করছেন তা আপনার কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থাকুক, বাস্তবতায় না আসি।
এরপর থেকে গুণেগুণে তিনদিন টিউশনিতে যাই।চতুর্থ দিন আন্টিকে একটি মেসেজ পাঠিয়ে অর্পা ও তার মায়ের নাম্বার ব্ল্যাকলিস্টের কারাগারে নিক্ষেপ করি। গুড বাই আন্টি! অর্পার প্রতি যত্ন নিয়েন। My father is a farming worker( FW) and my mother is a House wife(HW).They have a dream with surroundings me and never judge a book by it’s cover.
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি বাহিরে বের হই।নতুন টিউশনির সন্ধান এসেছে। এখন মধ্য দুপুর, সূর্য ঠিক মাথার উপর। চোখের সামনে কড়া রোদ চিকমিক করছে……
.
Saimum Sharif