Monday, October 6, 2025







বাড়িএকজীবনএকজীবন পর্ব ৪

একজীবন পর্ব ৪

একজীবন
পর্বঃ ৪

-‘আর কত ঘুমাবি, উইঠা মুখহাত ধুইয়া নে যা! আইসা পরসি পরায়…’

দাদীর চিল্লাপাল্লাতে ঘুমটা কেটে গেল আমার। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কখন ঝিমিয়ে গিয়েছিলাম নিজেও বলতে পারবনা। ট্রেনের বাথরুম থেকে একরকম ফ্রেশ হয়ে এলাম হাতমুখ ধুয়ে, সিটে এসে বসতেই পাশ থেকে টিস্যু বাড়িয়ে দিলো কেউ একজন…ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম আর কেউনা দাদীর আনিস দাদাভাই আমার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে বসে আছেন! টিস্যুতে চেপে মুখটা হালকা মুছতে না মুছতেই ঝিকঝিক শব্দে ট্রেনটা থেমে যেতে শুরু করলো।

-‘দাদী আপনে অরুরে নিয়ে এক রিকশায় যান, আমি আরেকটা নিয়া আসতেসি। আপনেদের ত বাজার টাজার ও করতে হইবো, অনেকদিন ত বাড়িতে থাকেন না। আমি নিয়া আসতেসি সব, আপনেরা আগাইতে থাকেন।’- ট্রেন থেকে নেমে রিকশা ডেকে বললেন আনিসভাই। তারপর দাদীকে আর আমাকে তুলে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে সাবধানে চালাতে বলে বাজারের দিকে হাঁটা ধরলেন।

-‘আফনেরা কি ডাক্তর সাবের বাড়িতেই যাইবেন নাকি অন্য জাগাত যাইবেন?’- খানিক বাদে রিকশাওয়ালা প্রশ্ন করলেন।

-‘না,না! আমাগ বাড়িত যামু, তুমি চালাও আমি কইয়া দিতাসি রাস্তা’- দাদী তড়িৎ গতিতে জবাব দিলেন।

-‘ডাক্তার সাহেবটা আবার কে দাদী?’- আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম।

-‘ওমা! আফায় যে কি কয়…আফনেগো যে রিশকাত তুইল্লা দিলো…’

-‘মিয়া তুমি বেশি কতা কইওনা ত, মন দিয়া রিশকা চালাও’- দাদীর রামধমকে রিকশাওয়ালা কথা শেষ করতে পারলোনা।

-‘কিগো দাদী? উনারে কথা শেষ করতে দিলেন না ক্যান?’- দাদীর দিকে তাকালাম আমি।

-‘আরে এরা কী কয় না কয়! অই আনিসের দাদায় ডাক্তর আছিলো, কবিরাজি করত আরকি! হেইল্লিগা জিগাইসে কই যামু…’- দাদী নিচুগলায় উত্তরটা দিয়েই আরেক প্রসঙ্গে চলে গেলেন।

-‘শুন, তুই বাড়িত যায়া শুইয়া ঘুম দিবি একটা। আনিসে বাজার আনলে আমি রান্ধন বাড়ন শ্যাষে ডাক দিমুনে…’

-‘না আমি ট্রেনে বহুত ঘুমাইসি দাদী! আপনে ঘুমায়েন বাড়িতে যাইয়া, আমি রানতে পারব!’

-‘দাদী! ও দাদী! বাজার আনসি, এইগুলা রাখো আর একটু পানি খাওয়াও! এত্ত গরম আজকে বাইরে…’

উঠানে আনিসভাইয়ের গলা পেয়ে দৌড়ে রান্নাঘর ছেড়ে দাদীর ঘরে গেলাম আমি। দাদী তো ঘুমে কাদা! শেষমেশ পানির জগ আর গ্লাস হাতে আমাকেই বের হতে হলো

-‘দাদী ঘুমায়। আমার কাছে দেন ব্যাগ গুলা সব, পানিটা ধরেন’- গ্লাসটা ভরে বাড়িয়ে দিলাম আনিস সাহেবের দিকে।

-‘শুকরিয়া!’- বলে উঠানের দাওয়ায় বসেই এক ঢোকে পানিটুকু সাবাড় করলেন আনিস, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-

-‘আচ্ছা আমি আসি তবে! কিছু লাগলে জানাবেন আমাকে…উমম…জানাবেন কীভাবে আপনার কাছে তো ফোন-টোন ও নাই…- ক্যাবলাকান্তের মত মাথা চুলকাতে লাগলেন উনি।

-‘সমস্যা হবেনা, দাদী আছেন ত! এমনিতেই যথেষ্ট।করেছেন, আর অযথা ঋণ বাড়াবেন না প্লিজ!’

আনিস বোকাচন্দের মত খানিক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বাইরের দিকে পা বাড়ান।

বাজারের ব্যাগটা নিয়ে পেছনে ঘুরতে না ঘুরতেই বোকাচন্দের গলা কানে আসে আমার-

‘আচ্ছা, আপনার সাথে কথা ছিলো…সময় হবে এখন?’

-‘হ্যা বলুন!’- ঘুরে দাঁড়ালাম আনিস সাহেবের মুখোমুখি।

-‘আসলে মানে…খুবি বিব্রতকর পরিস্থিতি। কিন্তু আপনার মতটা সবচে ইম্পরট্যান্ট তাই…’

-‘এত ইতস্তত করার কিছু নাই বিশ্বাস করেন! যে বিশাল উপকার আপনি করেছেন আমার, এরপর যদি বলেন এখন বিনিময়ে আপনার দাসীবৃত্তি কর‍তে হবে আমি তাতেও রাজি…’

-‘দাসীবৃত্তির প্রয়োজন নেই, ঘরকন্না টুকু করতে পারলেই চলবে’- ফট করে কথাটা বলে বসলেন আনিস! আমি চমকে চোখ ওঠাতেই উনার চোখে চোখ পড়ে গেলো, আমার চোখের ভেতর দিয়ে একেবারে যেন অন্তরের মাঝখানে ভেদ করছে ঐ দৃষ্টি! পুরোপুরি বোবা হয়ে গেলাম।

-‘মার্জনা করবেন! মুখ ফসকে…আসলে আমার এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি! আসলে ট্রেনে দাদীর কথাগুলিও ত সত্যি…আমি নিজের হয়ে প্রতিজ্ঞা করতে পারি আমার কাছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় থাকবেন আপনি…কিন্তু খশরু বদটার নজর একবার এই বাড়িতে পরলে… মানে আমি আসলে…’

-‘আমি রাজি!’- কোনোক্রমে শব্দদুটো বলে বাজারের ব্যাগটা ডানহাতে চেপে রান্নাঘরের দিকে দৌড় লাগালাম। পেছনের বোকাচন্দ তখনোও দেবদারু গাছের মত সোজা হয়ে দাঁড়ানো।

কী ছাই রান্না করব, বুকের ভেতর ভূমিকম্প চলছে যেন! অদ্ভুত তো! একরকম নিরুপায় হয়েই বছর চল্লিশের বুড়ো (যদিও দেখতে আরো কম বয়সী লাগে!), গ্রামের স্কুলের অঙ্ক মাস্টারের গলায় জীবনের নামে ঝুলে পরতে হচ্ছে মাত্র পনের বছর বয়সে আমায় অথচ খারাপ লাগার লেশটুকু মাত্র নেই! তা নেই নাহয় এক কথা, খারাপ লাগছে না মানলাম কিন্তু ভাল কেন লাগছে এটাই ত ছাই বুঝে পাচ্ছিনা! দ্রুমদ্রুম শব্দে যেন কেউ ঢাক পেটাচ্ছে হৃদপিণ্ডটার ওপরে, হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে- এই বুঝি এক অসহায় মেয়ে যে কীনা বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে তার লক্ষণ? আমি তো জানি এসব প্রেমে পড়বার লক্ষণ, ভালবাসার কুঁড়ি ফোটার লক্ষণ… জীবনের নতুন অধ্যায়ের প্রথম সূর্যোদয়ের লক্ষণ!

‘হলুদ বাটো,মেন্দি বাটো,বাটো ফুলের মৌ
বিয়ার সাজে সাজবে কইন্যা,নরম নরম বৌ- গো!’

-ভোরবেলা থেকে বাজতে বাজতে এই বিচ্ছিরি, ক্ষ্যাত গানটা একদম কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে! আজ সকালে আমার গায়ে হলুদ, আর বিকেলেই বিয়ে! ওদিকে বাবা, ছোটমা আর খশরুদের কী অবস্থা জানিনা, এদিকে সেই টেনশনে দাদী রীতিমত অস্থির! খশরু গ্রামে ফিরে আসার আগে কোনোরকমে বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে, তাই এত তাড়াহুড়ায় সব করা হচ্ছে। এর মধ্যেই কোত্থেকে নতুন শাড়ি কাপড়, এক সেট স্বর্ণের গয়না আর বিয়ের বাজারের ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে! দাদীর সোনারভাই আনিসই বোধহয় করেছে সব।

দুপুরের দিকেই বরযাত্রী এসে পৌঁছলো, এদিকে ভোরবেলা পুকুরের ঠান্ডা পানিতে গোসল আর তারপর ভেজা হলুদ মাখামাখির পর ঠান্ডা লেগে আমার বারটা বেজে গিয়েছে! কোনোরকমে ‘হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো’ করতে করতে কবুল কবুল বলে ফেললাম…ব্যাস! ক্যাবলাকান্ত মাস্টারটার সাথে জীবন গেঁথে গেলো আমার!

মেয়েপক্ষ বলতে এক দাদী, তা তিনি একাই একশো! কেঁদে কেটে বাড়ি মাথায় তুলে নিলেন! এক ফাঁকে আমায় দূরে ডেকে নিয়ে বললেন-

‘আল্লাহর রহম আছে নাতিন তর উপরে, খরশু বজ্জাতটায় অহনো আসেনাই! ভালয় ভালয় বিয়াটা মিটসে, এখন আইলেও ঝাঁটাপিটা কইরা অরে দূর কইরা দিমু!’

সত্যি বলতে এই খশরুর ব্যাপারটা নিয়ে আমারো বেশ ভয় ছিলো মনে মনে,আল্লাহ মালিক! সব ভালয় ভালয় হয়েছে… কে জানে সামনে এখন কী অপেক্ষা করছে কিন্তু অন্তত খশরু শয়তানটার বদনজর থেকে তো বাঁচা গেলো- এইই বা কম কী!

চৌদ্দ রকমের রীতিনীতি শেষে গ্রাম সম্পর্কের ভাবীরা আর আমার ছোট ননদ আমায় ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো। মিশু- মেয়েটার নাম, আমার ননদ হয় যে সম্পর্কে। বেশ হাসিখুশি আর চঞ্চল, বছরখানেক আগেই বিয়ে হয়েছে ওর। আমাকে বাসরঘরে বসিয়ে দিয়ে হাত ধরে কলকল করে বলল-

‘তুমি তো আমার চে বয়সে ছোটই মনেহয়! তা যাইহোক, দাদাভাইয়ের বউ মানে আমার ভাবী তুমি! একটা কথা বলি মনে রাইখ, এই বাড়িতে কেউই তুমার আপন না এক দাদাভাই ছাড়া! দাদাভাই বড় একলা মানুষ, দুনিয়াতে ওর সবচে কাছের ছিলাম আমি। আমার বিবাহের পর…যাকগা, তোমার যেমন দাদাভাই ছাড়া কেউ নাই দাদাভাইএর ও কিন্তু তেমন তুমি ছাড়া কেউ নাই! সব ভাইঙ্গা বললাম না, দুইদিন গেলে আপনাতেই বুঝবা! খালি মনে রাইখো, মেয়ে মানুষ আর যাই সহ্য করুক, স্বামীর অপমান সহ্য করা তার সাজে না! আসি!’

সারাদিনের ধকলে আমার মাথা কাজ করছিলো না, তার ওপর জ্বর-ঠান্ডা বসে গেছে বুকে। মিশুর কথার পুরো মর্মার্থ উদ্ধার করার আগেই গুটগুট করে বোকাচন্দর এসে হাজির! আরে আজব তো, বুকের ভেতর আবার কে যেন হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে খেলছে…

-‘আপনাকে তো ধড়াচূড়া পরিয়ে নাজেহাল করে রেখেছে, ডানের দরজা দিয়ে বেরোলে কিছুদূরেই বাথরুম পাবেন। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন!’- হাবলাচন্দ্রের এই হচ্ছে প্রথম কথা বউ-এর প্রতি।

শাড়িকাপড় ছেড়ে সুতি থ্রি-পিস পরে হাতমুখ ধুয়ে এলাম, বেশ ফ্রেশ লাগছে এখন! যদিও মাথাটা দপদপ করে ব্যথা করছে, আর সম্ভবত জ্বর ও আসছে! ঘরে ঢুকতেই দেখি হুলুস্থুল কাণ্ড, মেঝে জুড়ে বিছানা পাতা!

-‘ইয়ে মানে, লাইট টা নিভিয়ে দিলেই ভাল হবে, বাইরে ত সকলে আছে! আমি নিচে বিছানা পেতে নিয়েছি, আপনি খাটে ঘুমিয়ে যেতে পারেন!’- ক্যাবলার দ্বিতীয় কথা বাসর রাতে!

-‘আচ্ছা, ধন্যবাদ! আর একটা কথা, সম্পর্কে আর বয়সে আমি আপনার অনেক ছোট, আমাকে তুমি করে ডাকলে খুশি হবো!’

-‘ওহ..থ্যাংকু! হ্যা সেটাই ভাল হবে, নয়ত বাকি সবাই সন্দেহ করবে আবার’ বলে বোকারামের মত একটা হাসি লটকে আমার দিকে তাকিয়ে রইল ক্যাবলা হাবাটা।

-‘কিছু বলবেন?’

-‘ অ্যা! না মানে.. না কিছুনাহ!’- বলে লাইট নিভিয়ে মেঝেতে শুয়ে পরলেন উনি, খানিক বাদেই মিহি নাক ডাকার শব্দ কানে এলো!

ভোরবেলা চোখ মেলতেই নিজেকে এক অদ্ভুত অবস্থায় আবিষ্কার করলাম! খাটের হেডরেস্টে মাথা রেখে হেলান দিয়ে বসে আছেন আনিস সাহেব আর তার পায়ে মাথা রেখে এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলাম আমি! ধড়মড়িয়ে উঠতে গিয়ে টের পেলাম আনিসের হাতের আঙুলের ভেতর আমার একগোছা চুল আটকে আছে। চুলে টান পরতেই ‘ওহ, মাগো!’- বলে জট ছাড়াবার জন্য হাত বাড়ালাম আর ঠিক সেই সময়েই আনিসও হুড়মুড় করে উঠে নড়েচড়ে বসতে গেলেন- কপালে কপালে গুতো খেয়ে তবে শান্ত হলাম দু’জনেই!

-‘আপনি ত মহাবদ! চোরের মত খাটে চলে এসছেন! আপনি না মেঝেতে বিছানা করলেন তবে আবার…’

-‘আরে আরে! আস্তে আস্তে! সারারাত ত জ্বরের ঘোরে নেচে-কুঁদে অস্থির হয়েছ! শেষে উপায় না পেয়ে তোমার মাথায় জলপট্টি দিতে হয়েছে আমায়! যত খারাপ ভাবছো অতটা খারাপ না, নয়ত জ্বরের ছুতো দিয়ে চাইলে তোমার গা-হাত-পা কিংবা পুরো শরীরই মুছিয়ে দিতে পারতাম… ডাক্তার হিসাবে সেটুকু করলেও রোগী হিসেবে আমায় পরে চার্জ করতে পারতে না কিন্তু তুমি!’- শেষ অংশটুকু ভেজা বেড়ালের মত মিনমিন করে বলেই আমার চোখের একদম ভেতর দিয়ে অন্তরের ভেতর সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ছুড়ে দিলো লোকটা। উফ! অসহ্য!

-‘করেন তো প্রাইমারি স্কুলে অঙ্কের মাস্টারি, আর মেয়েমানুষ দেখলে গা-মোছানো ডাক্তার হতে ইচ্ছে করে? তা এতই যখন বিনাবাধায় নারী রোগী ছুয়ে দেখার শখ তখন ডাক্তারিটা পড়লেও তো পারতেন! আপনার খায়েশ ও পূরণ হতো, আমারও এখন কিছু সুবিধে হতো…’

কথা শেষ না হতেই খেয়াল করি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আনিস!

-‘জ্বরের ঘোরে মাথাটাও গেছে আপনার! দুইটা ঔষধ দিচ্ছি, এটা খাবার পর খাবেন সকালে। আর এই লাল পাতাটা এন্টিবায়োটিক, তিন দিন দেখুন জ্বর কমে কিনা। না কমলে তখন এটা খেতে হবে…যেহেতু এন্টিবায়োটিক তাই এটার সাতদিনের কোর্স পুরো কমপ্লিট করবেন যদি খান!’- বলে আমার দিকে দুটো ঔষধের পাতা বাড়িয়ে দিলেন উনি। জ্বরের চোটে জিহ্বা শুকিয়ে আসছিলো আমার, ঔষধ দুটো হাতে নিয়ে পাশে রেখে দিলাম।

তিনদিন দেখা লাগলো না, বিকেলের মধ্যেই জ্বরটা নেমে এলো আমার। মাস্টার সাহেবের ঔষধ তো দেখছি ভালই কাজ করেছে! বাড়িটা এখনো কাছের আত্নীয় স্বজনে ভরা, দুপুরের খাবার শেষে সবাই যে যার মত গড়িয়ে নিচ্ছিল। পুরনো আমলের বড় দোতলা বাড়ি…ছাদে যাবার জন্য প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি- এই প্যাটার্নটা আমার ভীষণ পছন্দের! সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে ছাদে উঠে গেলাম, এমাথা-ওমাথা বারকয়েক চক্কর দিয়ে উত্তরের রেলিং ধরে দাঁড়াতেই চোখ আটকে গেলো একটা টিনশেড একচালা ঘরের দিকে… প্রায় বিশ পঁচিশ জন মানুষের জটলা ঘরের সামনে। আর ঘরের জানালা দিয়ে একটা পরিচিত মুখের আদল দেখা যাচ্ছে…আনিস সাহেব! এই লোকের ত এখন স্কুলে থাকার কথা! কৌতূহলের কাছে পরাজিত হয়ে পায়েপায়ে নিচে নামলাম আমি, টিনের ঘরটার জানালার পাশ দিয়ে উঁকি দিতেই চোখ ছানাবড়া হবার উপক্রম! একজন একজন করে লোক আসছে যারা কিনা নানা রোগের রোগী আর আনিস মাস্টার তাদের ঔষধ পথ্য ধরিয়ে দিয়ে বিদেয় করছেন! এই লোকের দাদা নাকি কবিরাজ ছিল, সেও কি মাস্টারির পাশাপাশি কবিরাজি ব্যবসা ধরলো নাকি? আমি ধৈর্য ধরে জানালার পাশে অপেক্ষা করতে থাকলাম লোকজন কমে যাবার এবং আনিস মাস্টারের চলে যাবার। নিতান্ত থাকতে না পেরে বারকয়েক উঁকিঝুঁকি মেরেছি যদিও!

খানিক্ষণ বাদে লোকজন কমে এলে আনিস মাস্টার ও বেরিয়ে গেলেন, যাবার সময় দরজায় সাইনবোর্ড লটকে গেলেন- ‘আজকের মত রোগী দেখা শেষ’। অদ্ভুত ব্যাপার, ঘরের দরজা না আটকেই কেবল ভেজিয়ে রেখে গেলেন। যাকগে! আমার সুবিধাই হলো, পা টিপে টিপে ঘরটাতে ঢুকে গেলাম!

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ঘরটাতে ভালমত চোখ বুলালাম। একটা টেবিল সাথে চেয়ার, গোটা দুয়েক বড় কাঠের আলমারি, একটা স্টেথোস্কোপ, অনেক রকম ঔষধপত্র…মানে পুরো একটা ডাক্তারের চেম্বার যেন! টেবিলটার ওপরে একটা সীলমোহর, ওল্টাতেই নাম নজরে এলো

‘ডক্টর আনিসুর রহমান
M.B.B.S,……

কীহ! এই লোক এম.বি.বি.এস করা ডাক্তার!

-‘আমি নাহয় চোরের মত মেঝে ছেড়ে খাটে যাই, তুমি যে ডাকাতের মত একজনের ঘরে ঢুকে বসে আছো?’- একটা গম্ভীর গলায় ঘরটা গমগম করে ওঠে যেন। চমকে আমার হাত থেকে সীলমোহরটা মেঝেতে পড়ে যায়, ঘাড় ঘুরাতেই দেখি আনিস লোকটা ফিচলে হাসি মুখে ঝুলিয়ে দাঁড়ানো আমার পেছনে!

-‘আমি মানে…আমি! আপনি এখানে কী করেন? আপনি ডাক্তার হলেন কবে?’

-‘কীহ! উলটে আমার ওপরেই চোটপাট দেখাচ্ছে মেয়ে!’

-‘না মানে, দাদী ত বলেছিলো আপনি গ্রামের স্কুলের অঙ্ক মাস্টার! আমি তো তাই… ‘

-‘দাদী এসব বলেছিল! অঙ্ক আমার দুই চোখের বিষ! আমি মেডিকেলে পড়েছি তারপর এখানে এসে প্র‍্যাক্টিস করছি তা-ও বছরখানেক হবে!’-উনি অবাক গলায় বলেন।

-‘কী অদ্ভুত! দাদী তবে এতবড় মিছে কথা…কী বললেন? মাত্র বছরখানেক আগে আপনি পাশ করে বেরিয়েছেন? আপনার না চল্লিশ বছর বয়েস! এতদিন লাগে বুঝি ডাক্তারি পড়তে!’

হোহো করে হেসে দিলেন লোকটা!

-‘এইসব আবোলতাবোল কথা কে বলেছে তোমাকে? দাদী?’

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই মাথা চুলকে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে কিছু একটা চিন্তা করেন উনি।তারপর বলেন-

‘আচ্ছা বেশ, চলো দেখি দাদীর বাড়িতে যেয়ে সব খোলাসা করে আসি!’

-‘হ কইসিই ত! আনিসের বয়স কম আর আনিসে গেরামের সেরা ডাক্তর- হেইডা কইলে কি তর ছোটমায় জীবনে আনিসের লগে তরে বিয়া দিতে রাজি হইত মুখপুড়ি? হের বইনের মাইয়ার জন্য পোলাডারে ধইরা বাইন্ধা নিয়া যাইত না? এইল্লিগা মিছা কথা কইসি!’- পান চিবুতে চিবুতে গাল নেড়ে নেড়ে বললেন দাদী।

-‘আমাকে ত বলতে পারতেন দাদী!’- আমি আহত গলায় বললাম।

-‘ক্যা! তরে কমু ক্যা? ডাক্তার শুইনা বিয়া করবি তাইজন্যি? হুহ! ধন-সম্পদ দেইখা যে বিয়া হয় হেইডা বিয়া না, হেইডা কিনাবেচা! এইযে তুই আনিসরে বুইড়া মাস্টার জাইনাও বিয়া করলি হের মানে কি হইল ক’ তো? হের মানে হইল আজকা যদি আনিসের কিছু হইয়াও যায়, আনিসে যদি আর ডাক্তরি করবার নাও পারে তাও তুই হের লগে জোড়া বাইন্ধা থাকবি! কারণ হের বিদ্যা বুদ্দি দেইখা তুই হেরে বিয়া করস নাই, মন দেইখা করসস… মন! হেরে ভালবাইসা করসস…’

-‘ধুর! দাদী আপনে এত আবুলতাবুল বকতে পারেন!’

-‘আসবে তুমার মনের মানুষ সই লো,
হাতে নিয়া মালা…
কুঞ্জবনে যায়া সই…’

দাদী মাথা নেড়ে নেড়ে গান ধরলেন, ওদিকে হোহো শব্দে হেসে চলেছেন ক্যাবলাকান্ত আনিস… আর এদিকে চূড়ান্ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমার ত্রাহি ত্রাহি দশা!

-‘আমার বয়স এখনো তিরিশ হয়নাই! সার্টিফিকেটে আরেকটু কম…’- রাস্তায় বের হয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে লোকটা।

আমি মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছি, কী একটা ভীষণ অদ্ভুত অবস্থা! উনার পেছন পেছনই যাচ্ছিলাম, মাটির দিকে চোখ ছিল বলে বুঝিনি সামনে যে বাঁশঝাড়, দু’পা ফেলতেই ডান হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টানে কেউ ঝাড়ের ভেতর নিয়ে যায় আমাকে। এক টুকরো কাপড় দিয়ে মুখটা পেঁচিয়ে ধরে কেউ, কানের কাছে দুর্গন্ধে ভরা একটা মুখের অস্তিত্ব ফিসফিস করে-

‘খবরদার টু শব্দ করবিনা! শালী…! এক্কারে কল্লাটা ফালায়া দিমু!’

খশরু!

আমার হাত পা অবশ হয়ে আসে, শরীরের সর্বশক্তি একত্রিত করে চিৎকার দেয়ার শেষ সাহসটুকু সঞ্চয় করতে চাই আমি …

কপি/শেয়ার না করার জন্য অনুরোধ করা হলো

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ