ইরাবতী পর্ব -০৫ এবং শেষ পর্ব

0
2111

#ইরাবতী
#পর্ব-৫ এবং শেষ
লিখাঃঅরণ্য

সেদিন ইরা সারাদিন একপ্রকার ঘরেই বসেছিলো।কেমন জানি লজ্জা করছে তার।এক রাতেই কেমন জানি ম্যাচিউরিটি ফিল আসছে তার ভেতর।গোসল করে থ্রি পিস পরে কোনোরকম খাবার খেয়ে সারাদিন রুমেই কাটিয়েছে।বিভোরের সামনে তো দূর কারো সামনেই যেতে পারছেনা।

সারাদিন রুমে বসে গেমস খেলে কাটিয়ে রাতের বেলা খাবার টেবিলে সবার সামনে আসতেই হলো।এবাড়ির পুরনো নিয়ম রাতে সবাই একসাথে খাবে।রাতে ঘুমানোর আগে মামী ইরাকে ডাক দিয়ে একটা ওষুধের প্যাকেট দিলো।বলে গেলো ঘুমানোর আগে খেয়ে নিস।বিভোর দিয়েছে!

ইরা প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে প্যাকেটটা হাতে নিলো।উপরে লেখাই আছে জন্মবিরতিকরণ পিল।লোকটা দুনিয়ার সবাইকে মাইকিং করে জানাবে নাকি কাল রাতে কি হয়েছে!কোনো রকম প্যাকেট ছো মেরে নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা অফ করে দিলো সে।মামী হাসতে হাসতে শেষ!

একদিন যেহেতু কলেজ মিস দিয়েছে কাল যেতে হবে।সো সকালে উঠতেই বিভোরের সাথে দেখা হয়ে গেলো।কোনো রকম খেয়ে দেয়ে নয়টার দিকে বের হয়ে গেলো তারা।ইরা বাইকের পেছনে বসে আছে।কলেজটা বেশ দূরেই।বাতাসের ধাক্কায় বিভোরের গায়ের পরিচিত পারফিউমের গন্ধ ইরার নাকে বিধছে।রাস্তা হালকা ভাঙা থাকায় ইরার বসতে কষ্ট হচ্ছে।হঠাৎ স্পিডব্রেকারে হালকা নড়ে উঠে বাইক আর ইরা একদম বিভোরের পেট জড়িয়ে ধরে ফেলে।একসময় হাতটা সরিয়ে ফেলবে এমন সময় বিভোর বললো,

-এভাবেই ধরে থাক।সামনে রাস্তায় কাজ চলছে।পরে যাবি।

ইরা ওভাবেই ধরে আছে।বিভোরের মনে অন্যরকম অনুভূতি দোলা দিচ্ছে।ভালোবাসার ফিলিংস এটা।

কলেজে পৌছে গেইটে নামিয়ে দিতেই আশে ইরা খেয়াল করলো আশেপাশের মেয়েরা হা করে বিভোরের দিকে তাকিয়ে আছে।কারণটা কি!ইরা এবার খেয়াল করলো।বিভোর একটা নেভি ব্লু শার্ট পড়েছে কালো জিন্সের সাথে।বাতাসে সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।যে কোনো মেয়েরই মাথা নষ্ট হয়ে যাবার কথা।অতএব ইরা একটু চোখ রাঙিয়ে আশেপাশে পরোখ করে নিলো।পেছনের থেকে হেলমেট টা ধপাশ করে বিভোরের মাথার মধ্যে পড়িয়ে দিলো।আর গিজগিজ করতে করতে ক্লাসের দিকে হাটা শুরু করলো সে।বিভোর থ মেরে দাঁড়িয়ে আছে।তার পাগলীটা কি জেলাস!হাহ,,ভালোই তোহ।

প্রতিদিনের মতো বুনির পাশে বসলো সে।বুনি কেনো যেনো খুব খুশি।বারবার সবাই জিজ্ঞাস করছে কি হয়েছে।কিন্তু কাউকেই জবাব দিচ্ছে না।মুচকি হেসেই যাচ্ছে।ইরা পাশে বসতে ইরার কানে কানে বললো,,

-দোস্ত একটা খুশির খবর আছে রে।

-তাতো বুঝতেই পারছি।মুচকি হাসি দেখে।তা কি হয়েছে বলে উদ্ধার কর।

-দোস্ত আমি প্রেগন্যান্ট।

-কিইহ!তুইও।তুই না বলেছিলি অনার্সে উঠে বাচ্চা নিবি।তোর তো বয়স অল্প।কষ্ট হবে না?

-গাধী।কষ্ট কেনো হবে?আমার বয়স বিশ চলে।জানিসই তো দুবছর গ্যাপ দিয়েছি।আমার আজকার কেনো জানি মা ডাক শুনতে ইচ্ছে করে।

-কিন্তু কিভাবে?তিনমাস পরে পরীক্ষা।

-তো কি হয়েছে।পরীক্ষা গোল্লায় যাক।এটার আনন্দ হাজারো পরীক্ষায় ফার্ষ্ট হবার চেয়েও বেশি।মিষ্টি খাবি?এই নে টিফিন বক্সে করে এনেছি।কেউ যেনো না জানে।

ইরার মনে ভাবান্তর শুরু হলো।বাচ্চা!সন্তান আর মা হবার অনুভূতি।আচ্ছা ইরার যদি বাচ্চা হয় কার মতো হবে!বিভোরের মতো নাকি তার মতো।এটা ভেবে মুচকি হাসি দিলো সে।তার খুব লজ্জা লাগছে।নিজের অজান্তেই।ব্যাগের দিকে তাকিয়ে দেখলো পিলের প্যাকেটটা।কি মনে করে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলেদিলো সে।কিছু না ভেবেই।

কলেজ ছুটির পর বিভোর বাইক নিয়ে ওয়েট করছে।ইরাকে আজ থেকে নিয়ে যাবার ডিউটিও তার কাধে পড়েছে।রাস্তায় সামান্য একটু জ্যাম থাকায় বাইক থেমে আছে।পাশের সিএনজি থেকে ইরার ক্লাসের একটা মেম উকি দিয়ে বের হলো।তাকে দেখে ইরা ভয়ে তটস্থ।আবার নাকি অন্য কিছু মনে করে।মাথা নিচু করে বসে থাকে সে।

-ইরা?

-ম্যাম।আসসালামু আলাইকুম।

-কে?হাসবেন্ড?

-ইরা লজ্জামাখা নিরব কন্ঠে বললো।জ্বি মেম।

বাসায় এসে দেখে সব কাজিনরা এসেছে।বছরের শেষের দিকে।সবারই স্কুল বন্ধ।বাড়ির পরিবেশ আগের মতো।বিভোরের মা আসেননি শুধু।

সবাই তাদের নিয়েই ব্যাস্ত।কাজিনরা এটা ওটা জিজ্ঞেস করলেও ইরা কিছুই বলছেনা।সবার এক কথা।ইরা আপু চালাক হয়ে গেছে।রাতে এক ঘরেই থাকতে হলো তাদের।এভাবে চারদিন কেটে গেলো আনন্দ ফুর্তিতে।পঞ্চম দিনে বিভোরের মোবাইলে কল এসেছে।তার এপ্লাই করা জবটা হয়ে গেছে।বেতন আশি হাজার টাকা।এ চাকরী মিস করা যাবে না।সবাইকে জানিয়ে দিলো ফোনে।কাজিনদের একটাই কথা ট্রিট দিতে হবে।সবাই খুশি হলেও ইরার মন খুচখুচ করছে।হারানোর অনুভূতির সাথে ইরা খুব পরিচিত।মাকে হারিয়ে সে যেনো পাথর হয়ে গেছে।আচ্ছা বিভোর ভাইয়ের চাকরী হলে সেও তো চলে যাবে!আবার তো ইরা একা হয়ে যাবে।সেই বিরক্তিকর জীবন।সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে অবশেষে ইরার রুমে আসলো বিভোর।মিষ্টিটা হাতে দিতে গিয়ে ভাবলো খাইয়ে দিবে।ইরা মাথা নিচু করেই ছিলো।উচু করতেই বিভোর থমকে গেলো।ইরা কাঁদছে।

-কি হয়েছে কাঁদছিস কেনো?

-বলবোনা

-বল।নাহয় সবাই ভাববে তোকে মিষ্টি দেই নি বলে কান্না করছিস।

-আপনি কি চলে যাবেন এখান থেকে?

-হ্যা চাকরী হয়েছে।ঢাকা তো যেতে হবেই।

-আবার আসবেন কখন?

-মাস চারেক পরে।এর মধ্যে ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলে মোটমাট ছয় মাস লাগবে।

ইরা আর সহ্য করতে পারলো না।অজ্ঞান হয়ে গেলো।ছোটবেলা থেকে তার প্যানিক এটাকের প্রবলেম।কোনো মানসিক যন্ত্রনা সে নিতে পারে না।বিভোরের কর্মকান্ডে এসব হয়নি কারণ ইরা মনের আড়ালে তাকে ভালোবাসতো।বিভোরের চিল্লাচিল্লিতে সবাই চলে আসলো।মাথায় পানি দিয়ে এটা ওটা করে ইরার জ্ঞান ফেরানো হলো।রাতে বিভোর ইরার পাশেই বসে আছে।ইরার শরীরে হালকা জ্বর।বিরবির করে সবার সামনে একটা কথাই উচ্চারণ করেছে “বিভোর ভাই আপনি যাবেন না”।তাদের ভালোবাসা দেখে সবারই মুখে বেশ হাসি।

মধ্যরাতে ইরার ঘুম ভেংগে গেলো।বিভোর তাক বুকের সোজাসুজি বালিশ রেখে ঘুমিয়ে আছে।এই সুযোগ।আস্তে করে তার মাথার কাছে গিয়ে চুলে হাত বুলালো সে।খুব নরম।সামান্য স্পর্শেই বিভোরের ঘুম ভেঙ্গে গেলো।পাশে ফিরে চোখ খুলতেই ইরার বৃথা ঘুমানোর চেষ্টা তার চোখে পড়ে গেলো।

হুট করে কিছু না ভেবে ইরার উপর উঠে আধশোয়া হয়ে পড়লো।আচমকা এমন ব্যাবহারে ইরা চোখ খুলে তাকিয়ে আছে।

-আমাকে ছাড়া থাকতে পারবি না তাইনা?আমি তো একেবারে চলে যাচ্ছিনা।

রাতের কথা মনে হতেই ইরার বুক হুহু করে উঠলো।আবারো চোখের পাশ দিয়ে পানি পড়ছে।

বিভোরকে একটু ধাক্কা দিতে যাবে এমন সময়ে বিভোর আরেকটু ঝুঁকে ইরার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো।

-ভালোবাসি বউ।আমি যতো দূরেই যাই মনটা তোর কাছেই পরে থাকবে।পরীক্ষাটা দে।তোকেও ঢাকা নিয়ে যাবো।টেনশন নিস না।

ইরা কিছুই বলতে পারলো না।দুহাত দিয়ে বিভোরের পেছনের শার্ট খামচে ধরে মায়া ভরা চোখ নিয়ে ইশারায় বিভোরকে কাছে আসার ডাক দিলো।সে রাতে আবারো এক হলো দুজনে।

তিন মাস পর,,

ইরার পরীক্ষার ঠিক দুদিন আগে মাথা ঘুরে পরে গেলো সে।ডক্টর এসে নানীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে খুশির সংবাদটা দিলো।কিন্তু নানী মোটেও খুশি নন।বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে বিভোরকে ফোন দিলেন উনি।

-এইটা কি করলি বিভোর?

-কি করেছি আমি!কি হয়েছে।এত্তো রেগে আছো কেনো?

-ইরা প্রেগন্যান্ট।তোকে না বলেছিলাম একটা বছর ওয়েট করতে।মেয়েটা কি বাচ্চা পালার জন্য প্রস্তুত?

-কি বলো আমি তো পিল কিনে দিয়েছিলাম।দেখি ইরাকে ফোনটা দাও।ওর খবর আছে।

-না থাক বাদ দে।যা হবার হয়ে গেছে।গাধীটারে কিছু বলি নাই।তোর বাবা মা কে খবরটা দিস নিজে।বুঝিয়ে বলিস একটু।পরীক্ষা শেষ হলে সব যখন জানতে তখন তোদের বাসায় চলে যাবে।ভালোমতো খোজ রাখিস।খুশিতে বেশি হাইপার হোস না।চাকরীতে মন দে।

বিভোরের আর তর সইছেনা।ইরার মুখটা দেখতে মনে চাচ্ছে তার।অথচ এখন কোনো উপায় নেই।তার যে পরীক্ষা।কলটা কেটে ইরার নাম্বারে ফোন দিলো সে।ফোন ধরে ইরা সালাম দিলো।

-তুমি নাকি অসুস্থ?

-হ্যা।ডাক্তার এসেছিলেন।আজ উনি বলেছেন যাষ্ট পেটে ব্যাথা।বেশি করে খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।

-হ্যা।আজ থেকে সাবধানে চলাফেরা করবা।ভারী কিছু উঠানামা করবা না।যা খেতে মনে চায় নানুকে বলবা।আর হ্যা পরীক্ষার টাইমে পড়া যেনো মিস না হয়।

-আচ্ছা ঠিকাছে।এই ওয়েট ওয়েট।এমন একটা ভাব করছেন যেনো আমি প্রেগন্যান্ট!এমন কিছুই না ওকে?

বিভোর ফোনটা কেটে দিলো।তার বউটা তো নিজেই বাচ্চা।অথচ আরেকটা বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে নিজেও জানে না।আপাদত পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত ওয়েট করবে সে।তারপর ছুটে যাবে ইরার কাছে।আপাদত তার মুখ দিয়ে একটা শব্দই বের হচ্ছে ইরার জন্য,,”হাবলু একটা”।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে