ইতি উতি সংসার পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
186

#ইতি_উতি_সংসার
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

রেবেকার বাবা মা যখন তার শ্বশুর বাড়ির গেটে পৌছেছে তখন রাত তিনটে পার হয়েছে।বার কয়েক ফোনে কল এবং ডাকাডাকির পরেও কেউ গেট খুলল না।তখন বাধ্য হয়েই জোরে জোরে শব্দ করলো রাজু সাহেব এবং সি এন জি চালক।আশেপাশের মানুষ জেগে গেছে অথচ বের হতে চায় না সুমনের মা। কিন্তু অনবরত ডাকাডাকির কারণে বাধ্য হয় বের হতে। রেবেকার মা কখনো এই বাড়িতে আসেনি।সে ছোটাছুটি করতে থাকে কোথায়, কোন ঘরে আছে তার মেয়ে।এক সময় পেয়েও যায়।রেবেকা তখন জ্বরে কাহিল হয়ে অনবরত গোঙাচ্ছে। পা ফুলে গেছে, মেয়ের মাথার নিচে হাত দিতেই আঁতকে উঠল ওর মা।কারণ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে যে। সুমনের মা তখন ব্যস্ত সবাইকে থামাতে।উচ্চবাচ্য করতেও পিছপা হয় না।কেবল রেবেকার মা তার স্বামীকে বলল,

“রেবুর বাবা, মেয়েরে কি মা’রতে চান? না চাইলে এক্ষুণি হাসপাতালে চলেন।”

“কি হইছে ওর?ও ঠিক আছে?”

“কিচ্ছু ঠিক নাই।ওর পা ফুলে গেছে আপনি দেখেন না?ওর শরীরে জ্বর, মাথার নিচে রক্ত।”

আবোলতাবোল বলতে থাকে রেবেকার মা।বুদ্ধি করে এই মুহুর্তে পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে দুই একজন ধরে তুলে দেয় সি এন জিতে। এক কালে লাল শাড়ি পরে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে আসা মেয়েটা আজ রক্তাক্ত অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে বাবা মায়ের সাথে। রেবেকাকে নিয়ে যখন হাসপাতালে পৌঁছেছে তখন পুরো শহর যেন ঘুমিয়ে। কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে দেখে ভীষণ বকাবকি করলেন।পায়ের হাঁড় ভেঙ্গে গেছে মেয়েটার। যতদ্রুত সম্ভব অস্ত্র পাচার করতে হবে। ভয়ে সিটিয়ে গেলেন রেবেকার মা বাবা। কাঁদতে কাঁদতে কল দিলেন তার ছেলেদের। রেবেকার দুই ভাই চাকরিসূত্রে শহরের বাইরে থাকে। বোনের এমন খবর পেয়ে এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলেন না।নিজ নিজ স্ত্রীকে বললেন সকাল হলে সন্তান নিয়ে চলে যেতে তাদের গ্রামের বাড়ি।দুই ভাই ফোনে কথা বলে আজানের পূর্বেই মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটলেন বোনের কাছে।

ব্যথানাশক দেওয়ার পর রেবেকা ঘুমালো। তার দুই চোখে যেন ঘুমের রাজ্য নেমে এসেছে। ঘুম ভাঙলো ভাইদের কথায়।আজকেই অপারেশন করতে হবে। ছোটো ভাই সবার জন্য নাস্তা আনতে গেলে বড় ভাই গেলেন ব্যাংকে টাকা তুলতে।এসময়ে একটা বারের জন্যও সুমনকে কল দেওয়া হয়নি।রেবেকার মনে পড়লো তার কথা কিন্তু ছোটো ভাইয়ের রাগ অনেক।একটা বার যদি রেগে যান তাহলে সুমনকে আঘাত করতেও চিন্তা করবেন না। অপারেশনের পূর্বে ছোটো ভাই এসে তার পাশে বসে বলল,

“ওই বাড়িতে এতো অবহেলা কেন বলিস নি আমাদের?”

রেবেকা চমকে যায় ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনে।তার দুই চোখে ভয় দেখা দেয়। ভাঙ্গা গলায় বলে উঠে,

“সুমন খুব ভালো ছেলে ভাইয়া।ওর কোনো দোষ নেই।”

“দোষ নেই?তবে এখনো কেন এলো না?”

“ও কি জানে?”

রেবেকা নিজেই প্রশ্নটা করে থমকে গিয়েছে।সত্যি তো! সুমন কি জানে যে তার স্ত্রী হাসপাতালে? কিন্তু চিন্তা করার সময় নেই এখন। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে।পায়ের হাড় যে জায়গা চুত্য হয়ে গেছে।

পুরো রাত এপাশ ওপাশ করেও ঘুম হয়নি সুমনের।মায়ের থেকে গতকাল শুনেছিল রেবেকা অসুস্থ কিন্তু কতোটা কি হয়েছে তা জানার জন্য যতো বার কল দিয়েছে ততবার বড় ভাবী রিসিভ করেছে।জানিয়েছে রেবেকা ঘুমাচ্ছে।কিন্তু এতোটা ঘুম কিসের মেয়েটার?রেবেকার ঘুম ভীষণ হালকা।সামান্য ডাক কিংবা স্পর্শে তার ঘুম ভেঙ্গে যায় সেই মেয়েটা ফোনের শব্দেও জেগে উঠছে না?

সকাল সাতটা বাজতে না বাজতেই অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো সে। নয়টার সময় অফিস পৌঁছে নিজের মনকে আর মানাতে পারলো না। ছুটি নিয়ে চলে গেল বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি পৌঁছানোর পূর্বে বার কয়েক কল দিলো রেবেকার ফোনে কিন্তু অপর পাশ থেকে কেউ কল রিসিভ করলো না।বাড়ির সামনে বাইক থামিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে মাকে ডাক দিলো।

“তুই আমাকে আর মা বলে ডাকিস না সুমন। যদি ওই বউ আনিস তো!”

“বউ আনিস তো মানে মা?রেবেকা কোথায়?তুমি না গতকাল বললে ও একটু অসুস্থ? কোথায় ও?”

“কল পাড়ে আছাড় পড়ে একটু ব্যথা পাইছিল। এটা আর এমন কি?কিন্তু তুই জানিস? রাত তিনটার দিকে ওর বাপ মা এসেছিল,সেই রাতেই ওকে নিয়ে গেছে।”

সুমন জুতোর ফিতেটা মাত্র খুলতে বসেছিল কিন্তু মায়ের কথা শুনে দ্রুত বেরিয়ে গেল। প্রথমে কল দিলো রেবেকার ফোনে কিন্তু ফোন বন্ধ।রেবেকার বাবার ফোনে কল দিয়েও লাভ হলো না।শেষ মেষ শ্বাশুড়ির নাম্বারে কল দিয়ে খবর পেল তারা হাসপাতালে আছে। হাসপাতালের ঠিকানাটা নিয়ে দ্রুত সেখানে পৌঁছে গেল সে। রেবেকাকে অপারেশন থিয়েটার থেকে ততক্ষণে বের করা হয়েছে। পায়ে রড পড়ানো হয়েছে তার। প্রচন্ড যন্ত্রণায় তার মুখশ্রী যেন নীল বর্ণের হয়ে গেছে।সুমন কিছুই বলল না যখন তার দুই সুমন্ধী তাকে নানান কথা শোনালো। ছোটো ভাই তো সরাসরি ডিভোর্সের কথা বলতেও একবার চিন্তা করলো না।সুমন মাথা নিচু করে কেবল শুনেই গেল।বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে রেবেকার বাবা মাকে নিয়ে তাই বড় ভাই বাড়ির দিকে গেল। ভদ্রলোক সুমনকে বিশ্বাস করেন। তাছাড়া স্বামী স্ত্রীর মাঝে বোঝাপড়ার ব্যপারটাও তো আছে।ছোটো ভাইকে চোখ রাঙিয়ে যেতেও ভুললেন না।সুমন অপেক্ষা করলো তাদের চলে যাওয়া পর্যন্ত। কেবিন ফাঁকা হলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে।তার দুই চোখের পানি যেন আজ বাধন ছাড়া হয়েছে।রেবেকা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো,
“তার ব্যক্তিগত পুরুষ কাঁদছে।পুরুষের কান্না এতো সুন্দর কেন হয় যখন সে প্রিয় মানুষের জন্য কাঁদে?”
ক্যানোলাযুক্ত হাত দিয়ে রেবেকা স্পর্শ করে সুমনের হাত। সেই হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের কপালে ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সুমন।

“আমায় মাফ করে দিও। আমি তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি।”

“তেমন কিছুই নয়।ঠিক হয়ে যাবো।কিন্তু একটা কথা বলতে চাচ্ছি।আমি এই কয়েকদিন আমার বাবার বাড়ি থাকতে চাই।”

সুমন হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না।কেবল স্ত্রীর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর রেবেকাকে তার বাবার বাড়িতেই নেওয়া হলো।এই সময়টায় সুমন হাসপাতাল থেকেই অফিস করেছে।বাড়ি ফেরার পাঁচ দিন পর সুমনের মা এসে হাজির হলো রেবেকাদের বাড়িতে।সেদিন ছুটির দিন ছিল। সুমন নিজ হাতে ডাব কেটে এগিয়ে দিচ্ছিলো রেবেকার দিকে।

“ঘরজামাই হয়ে গেলি শেষ পর্যন্ত?”
“ঘরজামাই কেন হতে যাবো মা?”
“তাহলে বাড়ি যাস না কেন?এখান থেকে অফিস করছিস, বাজারে যাচ্ছিস অথচ বাড়িতে গিয়ে একটা বার মায়ের সাথে দেখা করতে পারিস না?”

সুমন মায়ের দিকে তাকায়।হতাশায় ছেয়ে গেছে তার অন্তর।রেবেকার বাবার বাড়িতে রাতে কেবল কয়েকটা ঘন্টা থাকার সুযোগ পায় সে। সাতটায় বের হয়ে অফিস করে আবার ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। এখানে আসার একটা মাত্র কারণ হচ্ছে এই অসুস্থ সময়ে রেবেকা যেন একটু স্বস্তি পায়। তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি দুজনেই বয়স্ক।সারা দিনে রেবেকার দেখাশোনার জন্য একজন মেয়েকে ঠিক করা হয়েছে কিন্তু রাতের বেলা বয়স্ক দুজনের কষ্ট হবে ভেবে সুমন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্লান্তিকে সায় দিচ্ছে না।অথচ তার মা উল্টো বুঝে বসে রইল।

“মা রেবেকা যে ব্যথা পেয়েছিল আমাকে কেন বলোনি?”
“একটু ব্যথায় কি হয়?”
“মাথার পিছনে তিনটে সেলাই আর পায়ে রড লাগাতে হয়েছে ওকে।এতো কেন বিরক্ত তুমি?”
সুমনের মা কিছু বলল না।যেমন এসেছিল তেমন ফিরে গেল।বেয়াই বেয়াইনের শত অনুরোধও রাখলো না। যাওয়ার সময় বলে গেল নিশ্চয়ই তার ছেলেকে যাদু টোনা করা হয়েছে। সুমন সেসবে কোনো ধ্যান দিলো না।অপর দিকে বোনের প্রতি ভালোবাসা দেখে রেবেকার দুই ভাইয়ের রাগ পড়ে গেল।তার বাবা মা তো শুরুর দিন থেকেই বুঝেছিল ছেলেটার দোষ নেই।কিন্তু রেবেকার মনে শান্তি রইল না। কেবল তার অল্প দিনের সংসারের দিকে টান তৈরি হলো দ্বিগুণ ভাবে।

রেবেকা সুস্থ হওয়ার পর সুমন তাকে নিয়ে শহরে নতুন করে সংসার পাতলো।কিন্তু যোগাযোগ হলো না মায়ের সাথে।একদিন জানতে পারে মায়ের আদরের বড় বৌ, যে বাবার বাড়ি থেকে এতো এতো জিনিস নিয়ে এসেছিল, স্বামী বিদেশ থেকে আসার পর সে পৃথক হয়ে গেছে।তার মা একা একাই এখন থাকছে।এমন কথা শুনে সুমন মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেও ভদ্রমহিলা রাজি হলো না।সে কোনো ভাবেই আর ছেলেদের সাথে থাকবেন না। বাকীটা জীবন এভাবেই কাটাবেন।মায়ের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো সুমন।একটা সময় ভাবলো অন্তত খরচটুক তো নিবে।একজন কাজের লোক রাখবে কিন্তু তার মা তাতেও নারাজ।কেবল এক দিন রান্না করে তিন দিন খাচ্চে তবুও ছেলেদের কাছে হাত পাততে রাজি নয়।

রেবেকা সেদিনের পর শ্বাশুড়ির সাথে আর কোনো কথা বলেনি।যার জন্য সে মরতে বসেছিল তাকে কোনো ভাবেই মাফ করে দেওয়া যায় না।কিন্তু সুমনের কথা চিন্তা করে তার মন দুর্বল হয়।হয়তো সুমন চায়, রেবেকা নিজ শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলুক এবং মনোমালিন্য মিটিয়ে নিক কিন্তু মুখে বলতে পারে না।রেবেকার নিজেরো ইচ্ছে হয় না এই বিষয়ে কথা বলতে। সময়ের স্রোতে স্মৃতির উপরে অভিমানের পাল্লা কমে যাবে হয়তো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে এই ইতি উতি সংসারে।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে