#ইতি_উতি_সংসার
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-১
“গয়নাটা খুলে দাও বৌমা।এটা তোমার নয়।” চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রেবেকা বলল তার শ্বাশুড়ি মা।বিস্মিত কণ্ঠে রেবেকা ফিরতি প্রশ্ন করলো,
“আমার নয়?”
“না, আমার ছোটো মেয়ের গয়না।তোমাকে কেবল তুলে আনার জন্য দিয়েছিলাম।তুমি এবার দিয়ে দাও তো।”
“কিন্তু মা!”
“কোনো কথা নয়।দ্রুত হাতে, কানে,গলায় যা আছে খুলে দাও।”
হাতে, কানের দুল খুলে শ্বাশুড়ির সামনে টেবিলে রাখলো রেবেকা।বিরক্তির সাথে শ্বাশুড়ি বলল,
“নাকের ফুলটা খুলছো না কেন?সেটাও তো তোমার বাবা দেয়নি।আমার বাড়ি থেকেই দেওয়া হয়েছে।”
নাকের ফুলটা খোলার সময় বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠলো রেবেকার।দুই চোখ ছলছল করে উঠলো। দীর্ঘশ্বাস চাপা রেখে টেবিলের উপর নাকফুলটা খুলে রেখে চলে আসছিল। সেই সময় পুনরায় শুনলো,
” তোমাকে কি ধরে ধরে বলতে হবে?গলার চেইন কে রাখবে?”
“চেইন তো আমার বাবা দিয়েছে মা।এটা কেন দিবো?”
“তোমার বাবা দিয়েছে ঠিক আছে কিন্তু তোমার কাছে রাখার কি দরকার?”
” আমার কাছে দরকার আছে মা।আপনাদের দেওয়া নাকফুলটাও যদি আপনারা নিয়ে যেতে পারেন তাহলে আমি কেন আমার জিনিস দিবো?”
বিয়ে করে আসার পর সাতদিনের মাথায় নতুন বউয়ের কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করেনি ঝুমু বেগম।রাগে তার ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে রেবেকার গালে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারতে।নেহাৎ ছোটো লোকের পরিচয় দেওয়া হবে বলে কিছু বলল না।বিয়েতে মেয়েটার বাবা কিছুই দেয়নি এমন নয়, দুশো মানুষ গিয়েছিল বরযাত্রী হিসেবে।তার ছেলে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে। তাই বলে মেয়ের বাবা কি করে মেয়েকে সাজিয়ে দিলো না?ঘর সাজিয়ে দিলো না?এই যুগে এমন মানুষও আছে?
রেবেকা কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে এলো।প্রেমের বিয়ে নয় তাদের। কয়েক বার দেখাশোনার পর বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের আগে যখন সুমনের সাথে আলাপ হলো তখন দেখেছে সুমন মানুষ হিসেবে ভালো।আজ সকাল অবধিও তার মনে হচ্ছিলো সে ভালো পরিবার পেলো অথচ আজ এক মুহুর্তে সব বদলে গেল।সুমন চাকরিসূত্রে শহরের বাইরে থাকে। গতকাল রাতেই ফিরেছে নিজ কর্মস্থলে আর আজকেই এমন ব্যবহার পেল রেবেকা। গুমরে উঠলো নিজের ভিতরে রেবেকা।এই কথা সে কাকে বলবে?সুমনকে?যদি সে ভুল বুঝে?বাবাকে বললে বাবা নিজ থেকে এসে তাকে নিয়ে যাবে না হয় গয়না পাঠাবে।এতে কি সম্পর্ক নষ্ট হবে না?
জানালায় দাঁড়িয়ে রেবেকা দূর আকাশের মেঘগুলোকে দেখতে দেখতে ভাবে ‘এখন কি করবো?মা বলেছিল, বাবার বাড়ির কথা শ্বশুর বাড়ি এবং শ্বশুর বাড়ির কথা কখনো বাবার বাড়িতে বলতে নেই।’
রেবেকার উপর তার শ্বাশুড়ি বড় ছেলের বউয়ের সাথে মিলে শুরু করলো নতুন অত্যাচার। বিয়েতে উপহার পাওয়া সকল কিছুই ধীরে ধীরে তার থেকে নিয়ে যেতে লাগলো।এমন কি উপহার পাওয়া বিয়ের শাড়িগুলোও। দীর্ঘশ্বাস বাড়তে থাকে রেবেকার।অপর দিকে সুমন হুট করেই তার সাথে কথা বলাও কমিয়ে দিলো। বিয়ের একুশ দিনের মাথায় রেবেকার রাগ আর সীমায় রইলো না।হুট করেই সে খারাপ ব্যবহার করলো সুমনের সাথে।দুজনের ঝগড়া সীমাবদ্ধ রুমে রইলেও আঁচড় কেটে গেলো রেবেকার মনে।
খেতে বসেও রেবেকাকে শুনতে হলো এই বাটিটা ঝুমু বেগমের বাবার বাড়ি থেকে এসেছে, ওমুক বাটিটা বড় বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে এলো। এসব শুনে একটা সময় খাবার খাওয়ার চাহিদা কমে গেল। সুমনের সাথে মনোমালিন্য এবং তার পরিবারের এমন ব্যবহার আর নিতে না পেরে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লো রেবেকা।কলপাড়ে পড়ে গিয়ে আঘায় পেলেও তার চিকিৎসা করানোর জন্য নিয়ে গেল না কেউ।সুমনকে ওর মা বলল তেমন ব্যথা পায়নি। নাপা খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। রেবেকার সাথে কথা বলতে চাইলে বলল, ‘ওর বিশ্রাম প্রয়োজন, ওকে ঘুমাতে দে।’
সুমনের ভুলটা বুঝি এখানেই হলো।সে মায়ের প্রতিটা কথা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নেওয়াটা। বিশ্বাস না করেও বা কি করতো সে?যে মায়ের কাছে ত্রিশ বছর নিজের গোপন কথা জমা রেখেছে সে মা কেন তার স্ত্রী সম্পর্কে ভুল বলবে? রেবেকা মুখে মুখে তর্ক করে এটা অবিশ্বাস করার ও কিছুই নেই।উচ্চশিক্ষিত মেয়ে, তার পছন্দের অপছন্দের মতামত সে দিবেই। তবুও মনের মাঝে একটা খচখচানি রয়ে গেল মেয়েটার জন্য।মেয়েটা ঠিক আছে তো?মনে পড়ে গেল বিয়ের রাতের সেই লজ্জা রাঙা মুখশ্রীর কথা।মনে পড়লো একে অপরকে বিলিয়ে দেওয়ার লাল, গোলাপি রঙের অনুভূতির কথাগুলো। ফোনের ক্যালেন্ডারের দিকে চাইলো সে। সামনের সপ্তাহে বাড়ি যেতেই হবে।তখন অভিমান করে রেবেকা পালাবে কোথায়?
রাত বাড়তেই রেবেকার যন্ত্রণা বাড়লো।চোখ মুখ নীল বর্ণের হয়ে গেল সেই যন্ত্রণায়।পায়ের ব্যথা কিংবা মাথার যন্ত্রণায় অস্থির রেবেকার গায়ে তখন ভীষণ জ্বর।রাত দুটোর সময় বিছানা হাতড়ে নিজের ফোনটা পেল সে।বাড়ির সবাই তখন যার যার মতোন নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। গলাটা পানির তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে। দুই বার সুমনের ছোটো বোনের নাম ধরে ডাকলেও কেউ এলো না।রেবেকার মনে হলো সে বুঝি আর বাঁচবে না।উপায়ন্তর না পেয়ে সে কল দিলো তার বাবাকে।
এতো রাতে মেয়ের নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন রেবেকার বাবা রাজু সাহেব।উঠে বসে কল রিসিভ করে বললেন,
“কি হয়েছে মা? এতো রাতে কল দিয়েছিস?”
রেবেকা কিছু বলতে পারলো না।সে যন্ত্রণায় আঁতিপাঁতি করছে।তার কণ্ঠস্বর বাবা না বুঝলেও ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে গেল তার মা।মেয়ের এমন যন্ত্রণা দায়ক কণ্ঠস্বর শুনে বললেন,
“তোর কি হয়েছে? তোকে ওরা কেউ কিছু করেছে?এই রেবু?কি হয়েছে মা?”
“আম্মা! পানির জন্য আমার গলা ফেঁটে যাচ্ছে আম্মা।আমাকে একটু পানি দিয়ে যাও।”
“কি হয়েছে তোর?”
“কলপাড়ে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি আম্মা।”
“বাড়ির সবাই কই?তারা জানে না?”
“সবাই ঘুমায়। আম্মা আমার ভয় লাগতেছে।”
রেবেকার বাবা মা অপেক্ষা করে না।পাশের বাড়ির একজনকে ডেকে তুলে তখনি।তার সি এন জি আছে, সেটা নিয়েই সেই গভীর রাতে ছুটে যায় মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। মেয়ে যে তার পানির পিপাসায় অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু ভয় বাধে রেবেকার মায়ের মনে।তার কেন যেন মনে হচ্ছে শেষ অবধি মেয়েটাকে পানিও দিতে পারলো না।
চলবে