আড়ালে অনুভবে পর্ব-১৯

0
1755

#আড়ালে_অনুভবে
#সাদিয়া_আফরিন_প্রতিভা
#পর্বঃ১৯ (বোনাস পার্ট) (বিদ্রঃ পরার অনুরোধ রইলো)

সুপ্তি:সরি সরি,আসলে ও বুঝতে পারেনি। অরিস তোমাকে কতোবার বলেছি এভাবে দৌড়োবে না।

বাচ্চা ছেলেটি মাথা নিচু করে থাকে।ইশার সেদিকে খেয়াল নেই।সে তো সুপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে।পাচ বছর পর নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড কে দেখছে সে।আনমনেই বিড়বিড়ালো, “সুপ্তি!”

ইশার কথা কারোর কানে পৌছোলো না।ইশা এবার অবাক দৃষ্টিতে তাকালো অরিস এর দিকে। ঠিক তখনি পিছন থেকে অঙ্কিত একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে এদিকে এলো,
সুপ্তি:দেখেছো অরিস?কিপ্তি কি সুন্দর গুড গার্ল হয়ে থাকে আর তুমি শুধু ছটফট করো।একদম ব্যাড বয় এর মতো।

অঙ্কিত:মোটেই না।আমার বাবাই কি ব্যাড বয়? (কিপ্তি কে কোল থেকে নামিয়ে বললো)

অরিস:না আমি গুড বয়। (বেশ ভাব নিয়ে বললো)
এদের কথা শুনে ইশা আনমনেই মুচকি হেসে উঠলো।এই পিচ্চি দুটোকে একদম ছোট্ট বেলায় দেখেছিলো।তারপর আর দেখার ভাগ্য হয়নি।

কিপ্তি:মাম্মাম আমরা আঙ্কেল এর কাছে যাবো না?

সুপ্তি:হ্যা মাম্মাম যাবো তো।অঙ্কিত চলো, আপনাকে আবারো সরি বলছি কিছু মনে করবেন না প্লিজ।

ইশা: ন না আমি কিছু মনে করিনি।

উজ্জ্বল:কি হলো ইশা দাঁড়িয়ে পরলে কেনো চলো।

ইশা:হ হ্যা চ চলো।

কথাটা বলেই কেবিন এর দিকে এগোলো ইশা আর উজ্জ্বল।যতই কাছে যাচ্ছে ততই যেনো বুকের ধুকধুকানি টা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
অবশেষে এসে পৌছোলো কেবিন এর সামনে। উজ্জ্বল এবার দড়জা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো।ইশাও ঞ্চের দিকে তাকিয়েই ভিতরে ঢুকলো কিন্তু চোখ তুলে তাকাতেই শ্বাস আটকে গেলো তার।নিজের অজান্তেই দু পা পিছিয়ে দেওয়াল এর সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাড়ালো সে।
পাশ থেকেই একজন ডঃ বলে ওঠে,

ডক্টর: ভালোই হলো আপনারা চলে এলেন ডঃ ইশা এন্ড ডঃ উজ্জ্বল। ইনি ই হলেন ডঃ নিরব মানে আপনাদের পেশেন্ট।মেইনলি ডঃ ইশার পেশেন্ট। রাতের বেলা হঠাত করেই সেন্সলেস হয়ে যায়। আমরা যতটা আন্দাজ করছি ব্রেইন এ অতিরিক্ত প্রেশার পরার ফলে পেইন হয়।আর তা সজ্য করতে না পেরেই জ্ঞান হারায় উনি।দেখুন আপনারা তো ওনার কন্ডিশন জানেন ই,এখন..

ইশা:গিভ মি টেন মিনিটস প্লিজ।
কথাটা বলেই দৌড়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলো ইশা।উজ্জ্বল কিছুই বুঝতে পারলো না তবুও বেশি কিছু না ভেবে নিরব কে চেক করতে শুরু করে।
এদিকে ইশা ছুটে নিজে কেবিনে ঢুকে দড়জা বন্ধ করে দিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পরে।হাত পা কাঁপছে তার।দু হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে,ঠোট দুটো ও অসম্ভব কাঁপছে তার।মনে পরে যায় সেদিনের কথা,,

পাচ বছর আগে সেদিন নিরব এর কথা শুনে আর এক মুহূর্তও ও বাড়িতে থাকেনা প্রভা।ডিভোর্স পেপার এ কাপাকাপা হাতে সাইন করে বেড়িয়ে আস্র বাড়ি থেকে।কিছুটা হাটার পর ই হঠাত করে সামনে থেকে হুট করে একটা গাড়ি আসতে দেখে।সে চাইলে সরে যেতে পারতো তবে সেই সময় তার আর বাচার ইচ্ছে ছিলো না।তাই মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে নেয়।
যখন তার জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে হসপিটাল এ আবিষ্কার করে।এটা বাংলাদেশ নয়,বিদেশ এ। আয়নায় নিজের মুখ দেখেই আতকে ওঠে সে।পরবর্তিতে ধীরে ধীরে জানতে পারে সেদিন এক্সিডেন্ট এর পর সে ছিটকে একটি নদীর পাশে গিয়ে পরে।ঠিক সেই সময় উজ্জ্বল সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে সপরিবারএ এয়ারপোর্ট যাচ্ছিলো। প্রভা কে ঐ অবস্থায় দেখতে পেয়ে দ্রুত হসপিটাল এ নিয়ে যায়।সেখানে অপারেশন এর মাধ্যমে সে বিপদমুক্ত হয় ঠিক ই কিন্তু তার মুখ বাজেভাবে ক্ষতবিক্ষত ছিলো যার কারণে যে কেউ দেখতে ভয় পাবে।পরবর্তিতে ডক্টর রা প্লাস্টিক সার্জারির সিদ্ধান্ত নেয়।যেহেতু উজ্জ্বল বিদেশেই চলে যাচ্ছিলো তাই তখন প্রভা কে সঙ্গে নিয়েই যায়।প্রভা সেই সময় সেন্সলেস ছিলো।বিদেশে এনে প্লাস্টিক সার্জারি করানো হয়।
এক্সিডেন্ট এর প্রায় এক মাস পর প্রভার জ্ঞান ফেরে।সেই সময় থেকে উজ্জ্বল এর পুরো পরিবার তাকে আলাদা করে দেখেনি।নিজের মেয়ের মতো দেখেছে।প্রথমে তারা নাম জিজ্ঞেস করলে প্রভা কোনো উত্তর দেয় নি।পরবর্তিতে জানায় তারা যে নাম দেবে তাই।তখন উজ্জ্বল এর মা প্রভার নাম দেয় মাহমুদা তাসনিম ইশা।
উজ্জ্বল যখন জানতে পারে ইশা মেডিকেল স্টুডেন্ট তারপর সে ওর পরাশোনা আবারো শুরু করায়।যার কারণে ইশা আর এই পজিশন এ আসতে পেরেছে।
ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে ইশা।কান্নাগুলো বর্তমানে দলা পেকে যাচ্ছে।বিডিতে এসে নিরব এর সঙ্গে দেখা হয়েও যেতে পারে এমন ধারণা তার আগেই ছিলো কিন্তু নিরব তো আর তাকে চিনতে পারবে না।তবে পাচটে বছর পর মানুষটাকে এই অবস্থায় দেখতে হবে তা ওর কল্পনার ও বাহিরে ছিলো।এবার বুঝতে পারছে সুপ্তি আর অঙ্কিত ও নিরব কেই দেখতে এসেছে।ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ইশা।সে জানে নিরব এর কন্ডিশন কেমন।
চিৎকার করে কাদতে কাদতে বলে ওঠে,
ইশা:কেনো?কেনো আমার সঙ্গে সব সময় এমনটা হয়?কি পাপ করেছি আমি আল্লাহ?কেনো আমায় প্রতিবার এমন লড়াইয়ের সম্মুখিন হতে হয়?আমি তো কখনো মানুষটার খারাও চাই নি।আমি তো চেয়েছি সে ভালো থাকুক।তাহলে কেনো?কেনো…. (আবারো কেঁদে ওঠে প্রভা)
।।
।।
সবে মাত্র জ্ঞান ফিরলো নিরব এর।তার পাশেই বসে আছে ডক্টর জিসান।এই লোকটা নিরব কে নিজের ছেলের চেয়ে কোনো অংশে কম।চোখে দেখে না।এই হহসপিটাল এ জয়েন্ট করার পর এই তিন বছর ধরে দেখে আসছে সে নিরব কে।ছেলেটাকে দেখেই প্রতিবার তার মনে হয় যেনো পাথর দিয়ে তৈরি।প্রয়োজন ছাড়া কারোর সঙ্গে কথা বলে না।তবুও যেনো এক অন্যরকম মায়া কাজ করে এই ছেলেটার প্রতি।

জিসান:নিরব তুমি একজন ডঃ হয়ে কি করে এতোটা অসাবধান হতে পারো?তুমি নিজেও যানো তো।আর জন্য প্রেজেন্ট এ ব্রেইন এ প্রেশার নেওয়া কতটা ক্ষতিকর।

নিরব:জানি ডক্টর।আর এটাও জানি আপনারা যে এতো কিছু করছেন তার কোনোটাই কাজে লাগবে না,শুধু শুধুই এতো চেষ্টা করছেন আপনারা।আরে যেখানে আমার নিজের ই জীবনের প্রতি কোনো মায়া নেই।আমি নিজেই কোনো ট্রিটমেন্ট করাতে চাই না সেখানে আপনি কেনো এতো ট্রেন্সড হচ্ছেন!

জিসান:জীবনটা এতো সহজ নয় নিরব।এতো সহজেই জীবনের মায়া ছেড়ে দিচ্ছো?আরে মানুষ বেচে থাকার জন্য কতো যুদ্ধ করে সেখানে তুমি কি করছো?

নিরব মুচকি হাসে।

জিসান:নিরব তুমি হাসছো?আচ্ছা নিজের কথা নাই ভাবলে নিজের পরিবারের কথা তো ভাবো।

নিরব:আমার পরিবার!হা হা হা… আমার কেউ নেই ডক্টর।আমার কিছু হলে কারোর যায় আসেনা।কেউ বিন্দুমাত্র কষ্ট পাবেনা।ও হ্যা, একেবারে কেউ কষ্ট পাবেনা সেটা বললে ভুল হবে,হাতে গোণা কয়েকজন হয়তো কষ্ট পাবে তবে তারাও সময়ের ব্যাবধানে ঠিক হয়ে যাবে।
অবশ্য আমার জন্য কারো কষ্ট না পাওয়াই ভালো।আমি মানুষটা বড্ড খারাপ ডক্টর।তাই তো সব কাছের মানুষেরা আমায় ছেড়ে চলে যায়। একজন যে আমার উপর ভীষণ অভিমান করেছে।তাই তো আমায় ছেড়ে চলে গেলো।তবে এখন সেও চায় আমি তার কাছে চলে আসি।আমিও বড্ড ক্লান্ত ডক্টর,বড্ড ক্লান্ত।এই আড়ালে অনুভবের দিন কাটাতে কাটাতে আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি।তবে হয়তো আর বেশিদিন এই যন্ত্রণা সজ্য করতে হবেনা।একবার আমি তার কাছে চলে যাই,তার সব অভিমান দূড় করেই ছাড়বো।

জিসান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।নিরব এর মুখে এমন কথা সে আগেও শুনেছে তবে এই কথার মানে সে বুঝতে পারে নি।তবে এটুকু বুঝেছে কেউ একজন আছে যার জন্য নিরব প্রতিমুহূর্তে তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে।সেই অজানা মানুষটির উপর মাঝেমধ্যে ভিষণ রাগ হয় জিসান এর।পরক্ষণেই নিজের করা ভাবনায় নিজেই অবাক হয়ে যায়।

_______🌼
“ছেড়ে দাও আমায়,ছেড়ে দাও বলছি।আমি আপুর কাছে যাবো।ছেড়ে দাও না প্লিজ,প্লিজ”

হসপিটার এর বেডে বসে পাগলের মতো কথাগুলো বলে নিজের হাত পাশে থাকা নার্সদের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে সিনথিয়া।চোখ থেকে অনবরত পানি পরছে তার।
সিনথিয়াকে এই অবস্থায় দেখে দ্রুত ভিতরে আসে অঙ্কিত সঙ্গে সুপ্তিও।

সিনথিয়া:ভাইয়া দেখ না ওরা আমায় আপউর কাছে যেতে দিচ্ছেনা।আমি আপুর কাছে যাবো। আমায় আপুর কাছে নিয়ে চলনা।আপু নিশ্চই আমায় খুজছে তাই না,যেতে দে না আমায়।কেনো আটকে রেখেছিস এভাবে।

অঙ্কিত:চুপ কর সিনথু,দোহাই লাগে।তুই কেনো বুঝতে পারছিসনা তোর আপু আর নেই।

সিনথিয়া:নাহহহহ,মিথ্যে কথা বলছিস তুই।তোরা আমায় যেতে দিবিনা তো?ঠিক আছে আমিও দেখবো কি করে আটকে রাখিস আমায়।

কথাটা বলেই হাত পা ছিটিয়ে বারবার পাশে থাকা নার্সদের আঘাত করতে লাগলো।তৎখনাক একজন ডক্টর এসে জোড় করে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দেয়।যার ফলে মুহূর্তেই বেড এ লুটিয়ে পরে সিনথিয়া।

অঙ্কিত:ডক্টর আর কতোদিন এমনভাবে চলবে? আমি যে বোনটার এমন অবস্থা আর সজ্য করতে পারছিনা।

ডক্টর:দেখুন মিঃ অঙ্কিত।সিনথিয়া ব্রেইন এ অতিরিক্ত আঘাত পাওয়ার ফলে প্রায় পাচ বছর কোমায় ছিলো।পাচ বছর পর ওর জ্ঞান ফেরে।আর তারপর থেকে এই একমাস এমনটাই চলছে। এমনভাবে বারবার ওনার ব্রেইন এ প্রেশার ক্রিয়েট হলে আমরা কতোদিন ওনাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো জানিনা।

অঙ্কিত:আপনি এসব কি বলছেন ডক্টর।প্লিজ এমনটা বলবেন না।আপনি যদি বলেন আমরা ওকে দেশের বাহিরে নিয়ে যাবো।

ডক্টর:তাতেও কোনো লাভ হবে না। আসলে মেইন প্রবলেম টা এটাই যে,উনি বিশ্বাস ই করছেন না যে ওনার আপু আর নেই।আর যতদিন পর্যন্ত উনি এটা বিশ্বাস না করবেন ততদিন আমরা কিছুই করতে পারবোনা।তাই বলছি,আপনারা এমন কিছু করুন যার ফলে উনি সবটা বিশ্বাস করে নেন।এটাই ওনার একমাত্র ট্রিটমেন্ট। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন।

অঙ্কিত:থ্যাংক ইউ ডক্টর।আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করছি।

#চলবে

[বিদ্রঃগতপর্বের লাস্ট প্যারায় আমি ভুল কঅরে ইশা এবং উজ্জ্বল এর জায়গায় প্রভা ও নিরব কিখে ফেলেছিলাম।তার জন্য সবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।ওখানে ইশা এবং উজ্জ্বল একসঙ্গে লিফট এ উঠলো এটা হবে❤️❤️]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে