#আড়ালে_অনুভবে🌼
#সাদিয়া_আফরিন_প্রতিভা
#পর্বঃ২
কাধে কারোর স্পর্শ অনুভব করতেই পিছনে ফিরে জাপটে ধরে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে।কারণ আমি জানি মানুষটি কে।
সিনথিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলে পাঁচ মিনিট যাবত।ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এই মেয়েটাই একমাত্র আমাকে বুঝতে পারে।
–কেনো বোন?বল না,কেনো আমাকে নিজের মায়ের থেকে এতো কথা শুনতে হয়।বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছে করে দেড়ি করিনি ফিরতে। (কাপা কাপা কণ্ঠে বললাম কথাটা)
–কাঁদিসনা আপু।আমি জানি তো তুই ইচ্ছে করে দেড়ি করিসনি। (সিনথিয়া)
–তবে কেনো আম্মু আমায় এতোগুলো বিষাক্ত কথা শোনালো?আমি কি সত্যি ই এতোটা অপয়া? এটা কি আমার বাবার বাড়ি নয়?আমি শুধুই মামুষের দয়ায় টিকে আছি?কেনো বল না?কেনো আম্মু আমাকে একটুও ভালোবাসতে পারে না? আমি তো কখনো তার কোনো কথার অমান্য করিনি,যা বলেছে তাই করেছি।তবুও কি আমি তার মনে এতটুকু জায়গা তৈরি করে নিতে পারিনি? আমার তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় জানিস তো?আমি কি আসলেই তার আপন মেয়ে?
–আপু চুপ কর প্লিজ।কি যাতা বলছিস তুই?মাথা ঠিক আছে তোর? (রাগী কণ্ঠে বললো প্রথা)
–হাহ,আমি কি কিছু ভুল বলছি সিনথু?নিজের পেটের মেয়ে হলে কি করে কেউ প্রতি মুহূর্তে এমন বিষাক্ত কথা বলতে পারে?এই কথাগুলো যে আমার হৃদয়কে বারবার ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। এতই যখন রাগ তখন জন্মের পর গলা টিপে মেরে ফেললোনা কেনো আমাকে?বল না,কেনো মেরে ফেললো না?
–আপুউউ!তুই কিন্তু এবার মার খাবি। (বেশ জোড়ে কথাটা বললো প্রথা)
আমি আবারো কাদতে কাদতে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।
স্তব্ধ হয়ে দড়জার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে নিশাত। চোখ থেকে আপনা আপনি দু ফোটা জল গড়িয়ে পরলো তার।এবার সে বুঝতে পারছে প্রভা কেনো ওভাবে তাড়াহুড়ো করছিলো।মেয়েটাকে এতবছর ধরে চেন,তার ভালো মন্দ সব জানে অথচ এত বড় একটা কথা জানতে পারলো না।সবসময় হাসিখুশি থাকা মেয়েটার এমন কান্না যেনো সে আর সইতে পারছেনা।মুখ চেপে কান্না নিয়ন্ত্রন করে ছুটে চলে গেলো প্রথার রুম এ।
একটা ইম্পরট্যান্ট নোট প্রভার কাছে থেকে যাওয়ায় বাড়ি ফেরার আগে ওর থেকে সেটা নিতেই এসেছিলো নিশাত।তবে রুমের সামনে আসতেই প্রভা কে কাদতে দেখে থমকে যায় সে। পরক্ষনেই প্রথা কে এই রুম এর দিকে আসতে দেখে আড়ালে লুকিয়ে পরে।আর তারপর দড়জার সামনে দাঁড়িয়েই সমস্ত কথোপকথন শুনে ফেলে।
তবে আর না,আজ যে করেই হোক সব সত্যিটা জেনেই ছাড়বে।
,,
অনেক কষ্টে প্রভার কান্না থামিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসে প্রথা।হাত দিয়ে চোখ মুছে রুমে ঢুকতেই নিশাত কে দেখে চমকে যায় সে। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,
–আরে আপু তুমি?কোনো দরকার ছিলো?আপু তো রুমেই আছে তুমি..
–আমার দরকার টা সাদুর সাথে নয় প্রথা।আমার দরকার টা তোর সাথে। (নিশাত)
–ম মানে? (প্রথা)
–সাদু কাদছিলো কেনো? (প্রথার দিকে তাকিয়ে বলে নিশাত)
–(মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে প্রথা)
নিশাত এবার প্রথার সামনে এসে ওর হাতদুটো হাতের মুঠোয় নিয়ে আকুতির স্বরে বলে,
–দোহাই লাগে তোর বোন।প্লিজ বল আমাকে।আ আচ্ছা প্রভা কি আন্টির আপন মেয়ে নয়? (নিশাত)
–আপুউউউ,এসব কি আজেবাজে বলছো তুমি?প্রভা আপু আমার চাচ্চু আর কাকিমনির আপন মেয়ে। (প্রথা)
–তাহলে সত্যিটা কি?বল প্লিজ। (নিশাত)
–বলছি,চাচ্চু যে এই পৃথিবীতে নেই সেটা যানো? (প্রথা)
–হ্যা সেটাতো জানি। (নিশাত)
–হাহ, চাচ্চু নিজে তো চলে গেলোই তার সাথে সাথে নিজের মেয়ে কেও সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করে গেলো। (প্রথা)
–মানে? (নিশাত)
–আব্বু আর চাচ্চু একসাথেই ব্যাবসা করতেন।আব্বু পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিলনা তবুও চাচ্চু নিজের হাতে আব্বুকে সব কাজকর্ম শেখায়।মূলতা কম্পানি টা চাচ্চুর ই।তবে উনি আব্বু কে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন,ওরা ভাই কম বন্ধু বেশি ছিলো।তাই আব্বুর পড়াশোনা কমপ্লিট হওয়ার পর ই চাচ্চু তাকে ব্যাবসায় যোগ নেই।ব্যাবসার কাজে অনেক সময়ই আব্বু আর চাচ্চু কে দেশের বাহিরে যেতে হতো।প্রভা আপুর যেদিন জন্ম হয় চাচ্চু তখন ব্যাবসার কাজে দেশের বাহিরে ছিলো।আব্বু ই যেতে চেয়েছিলো তবে মিটিং টা অনেক নামিদামি কম্পানির সাথে ছিলো তাই বাধ্য হয়ে চাচ্চুর ই যেতে হয়।
যেদিন চাচ্চুর ফেরার কথা ছিলো সেদিন ই কাকিমুনির লেবার পেইন ওঠে।হসপিটাল এ নিয়ে যাওয়ার পর নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমেই জন্ম হয় আপুর।মা এবং মেয়ে দুজনেই সুস্থ ছিলো। সুখবর টা চাচ্চু কে দেওয়ার জন্য সবাই ফোন করতে থাকে কিন্তু ফোনটা বারবার রিং হয়ে কেটে যায়।যতটা সম্ভব ততক্ষনে চাচ্চুর ফ্লাইট ল্যান্দ করার কথা।আরো এক ঘন্টা পর ও যখন চাচ্চুবকে ফোনে পাওয়া যায় না তখন সবার মাথায় চিন্তা চেপে বসে।ঠিক সেই মুহূর্তেই এমন একটা নিউজ আসে যা সকলের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দেয়।
(একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো প্রথা,তারপর আবারো বলতে লাগলো)
চাচ্চুর ফ্লাইট ক্রাশ করে।আহতদের সংখা খুব ই সল্প ছিলো।বেশিরভাব মানুষ ই নিহত হয়।আর দুঃখের বিষয় তাফ মধ্যে চাচ্চু ও একজন ছিলো। আমাদের সকলকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যায় চাচ্চু।
সেদিন খবরটা পাওয়ার পর ই জ্ঞান হারায় কাকিমুনি।তার জ্ঞান ফেরার পর দেখতে পায় প্রভা আপু কান্না করেই চলেছে।আম্মু প্রভা আপুকে খাওয়ানোর জন্য কাকিমুনির কাছে নিয়ে যেতেই সে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় আপুকে।
নানা ধরণের জঘন্য ভাষায় কথা শোনায় সেই ছোট্ট দুধের শিশুকে।তার মতে আপু অপয়া, অলক্ষনে।চাচ্চুর মৃত্যুর জন্য আপুই দায়ী।
আপুর কান্না আর সজ্য করতে না পেরে আম্মু ওকে বাহিরের দুধ এনে খাওয়ায়।তবুও সেই বাচ্চার কান্না কাকিমুনির মন গলাতে পারেনি।
বাড়িতে নিয়ে আসা হয় আপুকে।কাকিমুনি তো প্রথমে আপুকে অনাথ আশ্রম এই দিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু পরে আর দিতে পারেনি।আরে যতই হোক নারির টান তো।
জানো তো,আপু যখন অসুস্থ হয়ে পরতো কাকিমনি তখন ও ওকে দেখভাল করতো না কিন্তু একা একা চাচ্চুর ছবি বুকে আকড়ে ধরে কাদতো।
আপুর নাম টা পর্যন্ত কাকিমনি রাখে নি।দাদি রেখেছিলো।আর আপুর সাথে মিলিয়েই আমার নাম টাও রাখা হয়।
ও হ্যা,কাকিমুনির আরেকটা মন্তব্য,আব্বু নাকি তাকে দয়া করে এখানে থাকতে দিয়েছে।সে কোনো মতে এটা বুঝতেই রাজি নআ যে ব্যাবসা এবং এই বাড়ি দুটোর উপর ই তার হক বেশি।আর সেই জন্যই প্রতি মুহূর্তে আপু কে নানান ভাবে কথা শোনায়।
থমকে যায় নিশাত।সে জানতো প্রতিভার বাবা বেচে নেই কিন্তু এতো ঘটনার কিছুই সে জানতো না।
,,
বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি।আজ তাকে অনেক বকা দেওয়ার আছে আমার।কেনো আমাকে তার সাথেই নিয়ে গেলো না।
–কি দেখছো হ্যা?খুব আনন্দ লাগছে আমাকে কষ্ট পেতে দেখে?নিজের ই মায়ের কাছ থেকে রোজ রোজ খোটা শুনতে শুনতে আমি হাপিয়ে গেছি বাবা।আত্মহত্যা মহা পাপ নাহলে সেই পদক্ষেপ টাই বেছে নিতাম।তুমি তো সবটাই জানো।তাহলে কেনো আমায় নিয়ে যাচ্ছোনা নিজের কাছে?
____☁️
কাধে কারোর স্পর্শে হকচকিয়ে উঠলাম আমি।
–হেই,আমি।ভয় পাচ্ছো কেনো? (উজ্জ্বল)
–না ভয় পাবো কেনো?বলো,কিছু বলবে?(আমি)
–ইশা,ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড।তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি? (উজ্জ্বল)
–পারমিশন নিচ্ছো কেনো?করো না কি জিজ্ঞেস করবে। (আমি)
–এখানে,মানে বিডি তে তোমার ফ্যামিলি মেম্বার্স কেউ নেই? (উজ্জ্বল)
মুখটা মলিন হিয়ে গেলো আমার।চোখ নামিয়ে উল্টোদিকে ঘুড়ে দাড়ালাম।
–ইটস ওকে ইশা।তুমি না বলতে চাইলে কোন প্রবলেম নেই।তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না আসলে…. (উজ্জ্বল)
–কেউ নেই আমার।অনাথ আমি (উজ্জ্বল এর কথার মাঝেই বলে উঠলাম আমি)
উজ্জ্বল এবার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো।এই পাচ বছরে বেশ কয়েকবার নানান ভাবে জানতে চেয়েছে আমার কাছে তবে আমি তেমন কোনো উত্তর দেই নি আর তাই ওরাও কেউ আমাকে কোনো প্রশ্ন করেনি।
–আমার একটা কথা রাখবে? (আমি)
–হ হ্যা বলো,কি কথা? (উজ্জ্বল)
–আমার অতীত সম্পর্কে কখনো কোনো প্রশ্ন করবেনা প্লিজ। (আমি)
–ইশা আমি.. (উজ্জ্বল)
–আমাকে একটু একা থাকতে দেবে প্লিজ! (আমি)
উজ্জ্বল আর কিছু না বলে চলে গেলো রুম থেকে।আমি চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম এবং বলতে লাগলাম,
–কি করবো বলো?চেষ্টা তো কম করছিনা সব কিছু ভুলে যাওয়ার।তবুও স্মৃতি যে আমার পিছুই ছাড়ছে না।তুমি দূড়ে সরিয়ে দিয়েও আমায় শান্তিতে থাকতে দিলে না। সেই আমার #আড়ালে_অনুভবে হয়ে রয়েই গেলে।
#চলবে