#আড়ালে_অনুভবে 🌼
#সাদিয়া_আফরিন_প্রতিভা
#পর্বঃ১_সূচনা_পর্ব
“নিজের বাড়িতে থেকে দিনের পর দিন একটি বাহিরের মেয়ের দ্বারা ঘৃণ্যতম ভাষায় অপমানিত হয়েছি আমি।আর সেই মেয়েটা আর কেউ নয়,যাকে আমি নিজের আপন ছোট বোন মনে করতাম সে।আমার স্বামী সব শুনেও কোনো প্রতিবাদ করেনি।তবুও আমি কিচ্ছুটি বলিনি,মুখ বুজে সজ্য করেছি।শুধুমাত্র তাকে ভালোবাসতাম বলে।
আচ্ছা,নিজের বাড়িতে চোখের সামনে নিজের স্বামীকে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে দেখলে আপনার মনের অবস্থা কেমন হতো আপু?ইচ্ছে করতো তার সাথে মানিয়ে গুঝিয়ে সংসার করার?তবুও আমি চেষ্টা করেছি।শুধুমাত্র তাকে ভালোবাসতাম বলে।কিন্তু সেই মানুষটি ই যখন মিথ্যে পরকিয়ার দায় দিয়ে ডিভোর্স দিতে চায়,তখন কি তার সাথে মানিয়ে নেওয়া যায়?”
স্তব্ধ হয়ে যায় মিসেস নূহা।তার প্রশ্নের প্রতিউত্তরে এমন একটা কথা শুনতে হবে তা ওনার ধারণার ও বাহিরে ছিলো।
–কি বলছো তুমি। (বেশ অবাক হয়ে প্রশ্নটি করলেন নূহা)
–ঠিক ই বলছি আপু।
–তুমি তো এতো বছরে কখনো এসব কথা বলোনি আমাদের। (নূহা)
–নিজের বিশাক্ত অতীত এর কোন ছায়া বর্তমান জীবনে রাখতে চাই নি আমি।আর আপনারাও কখনো তেমন ভাবে জানতে চান নি তাই..
“ইশা আমাদের ফ্লাইট এর টাইম হয়ে গেছে তারাতারি এসো।”
আমার কথার মাঝেই নিচ থেকে ডাক দিলো উজ্জল।সত্যি ই ফ্লাইট এর টাইম হয়ে গেছে খেয়াল ই ছিলো না।
–আপু এখন আসছি।বাকি কথা নাহলে ফইরে এসেই বলবো।ভালো থাকবেন আপনি।
–যদি সেই মানুষটার সঙ্গে আবারো দেখা হয়ে যায়? (নূহা)
বুকটা ধক করে উঠলো আমার।পরক্ষনে নিজেকে সামনে ঠোটের কোণে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে বললাম,
–ওসব কথা এখন থাকনা আপু।আসছি আমি।
নূহা আপু মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।ইতিমধ্যে উজ্জ্বল আরো দু বার ডাক দিয়েছে।আমি পার্স টা নিয়ে পা এগোলাম সদর দড়জার দিকে।সিড়ি দিয়ে নিচে নামতেই সানা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।
–এই পাগলি তুই এমন ভাবে কাঁদছিস কেনো?আমি কি সারাজীবন এর জন্য চলে যাচ্ছি নাকি?আরে আমি তো কিছুদিন এর মধ্যেই চলে আসবো।
–আপু তোমাকে ছাড়া আমার একটুও ভালো লাগে না।তাড়াতাড়ি চলে আসবে কিন্তু। (সানা)
–একদম।তুই চোখের পলক ফেলবি তার মাঝেই আমি চলে আসবো।
সানার থেকে বিদায় নিয়ে এগোলাম মিসেস রুকসানা রায়হান এর কাছে।
–আসছি মামনি।
–তাড়াতাড়ি চলে আসিস মা।আর খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করিস কিন্তু।অনেক মিস করবো তোকে। (রুকসানা)
–আম্মু তোমাদের কথা শেষ হলে এখন ওকে ছাড়ো। আমাদের ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে (উজ্জ্বল)
মামনির থেকে বিদায় নিয়ে উঠে বসলাম গাড়িতে। উজ্জ্বল ব্যাগ দুটো গাড়ির ডেক্স এ রেখে আমার পাশে এসে বসলো।
৩০ মিনিট বাদেই আমরা পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্ট এ।সেখানকার যাবতীয় কাজ সেরে নিয়ে উঠে গেলাম বিমান এ।দশ মিনিট এর মাথায় সেটি উড়ে চললো দূড় আকাশের মেঘগুলোর মাঝে।চোখ বন্ধ করে ভাবনার সাগড়ে ডুব দিলাম আমি।
_____☁️
–প্রভা,আজকে যে টাকলু স্যার কে দেখলাম না। মরছে টরছে নাকি? (সুপ্তি)
–ঐ,তোর মুখে কি কিছুই আটকায় না শালি। স্যার এর মৃত্যু কামনা করিস!ছিহঃ ছিহঃ। (নিশাত)
–এই তোরা থাম।আমি তো শুনলাম স্যার এর নাকি বিয়ে লাগছে। (বিরক্তির ভঙ্গিতে বললাম আমি)
–কিইইইইইহহহহহহহ! (সুপ্তি+নিশাত চিল্লিয়ে বললো কথাটা)
–আল্লাহ গোওওও,আমার কান শেষ।এমনে চিল্লাইস কেন হারামি! (আমি)
–সুপু,আমাকে একটু চিমটি দে না। (নিশাত)
–নিশু বেইবি,আমি নিজেই সপ্নের মধ্যে আছি।তুই আমাকে একটা চিমটি দে। (সুপ্তি)
–চুউউউউউপপপপপ।আরে আমার জানেমান রা আগে তো শোন স্যার এর বিয়ে কার সাথে।
–কার সাথে? (নিশাত)
–কার সাথে? (সুপ্তি)
–ডোলায়ায়া ম্যামমম।
–সুপু আমারে ধর… (বলেই মাথা ঘুড়ে আমার কাধে পরে যেতে নিলো নিশাত)
–কুল কুল বেইবি।আমার ও এই অবস্থাই হইছিলো যখন শুনছি।
–কেমনে কি। (সুপ্তি)
–দিস ইজ কলড টুরু লাভ।
–ছাতার লাভ😑,আমি যে কবে পামু এমন টুরু লাভ করা পাবলিক। (নিশাত)
–রিলেক্স বেইবি।টাইম আমাদের ও আসবে। (সুপ্তি)
–সুপুউউ,সাদুউউউউ! (চিৎকার দিয়ে বললো নিশাত)
–আবার কি হলো?
–কুলফিইইইইই।আমি কুলফি খাবো,চল চল।
তিন জনে চলে গেলাম সেখানে।তিনটে কুলফি কিনে হাটা ধরলাম রাস্তার পাশ থেকে।একবার ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে।ইশশ,এতো দেড়ি হয়ে গেলো কখন।
আমি এবার ওদের দুজনের পাশ থেকে দ্রুত পা চালাতে লাগলাম।একটু দেড়ি হয়ে গেলে আবার হাজারো অপৃতিকর কথা শুনতে হবে,যার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে আমার নেই।
রাস্তার পাশ থেকে কানে ব্লুতুথ হেডফোন গুজে ফোন এ মুখ ডুবিয়ে আনমনে হেটে যাচ্ছিলো নিরব।আশেপাশে খুব একটা নজর নেই তার।
–সাদু তুই এভাবে দৌড়োচ্ছিস কেনো? (সুপ্তি)
–বাসায় ফিরতে লেট হয়ে যাবে তাই।
–তো দু মিনিট লেট হলে এমন কি হবে? (নিশাত)
–ও তুই বুঝবি না।
কথাটা বলেই আরো দ্রুত হাটা শুরু করলাম।ঘড়ির দিকে তাকিয়েই হাটছি এখন।হুট করে কোনো শক্ত বস্তুর সাথে ধাক্কা খেয়ে হাতের কুলফি টা ছিটকে পরলো আমার।
পিছনে ফিরে তাকাতেই আমার চোখ মারবেল এর আকার ধারণ করলো।হাসি ও পেলো প্রচুর।তবে এই সিরিয়াস মোমেন্ট এ হাসা যাবে না।
সামনে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তবে তার মুখিটা দেখা যাচ্ছে না।দেখা যাবে কিকরে?তার সারা মুখে যে কুলফির ছড়াছড়ি।
নিরব রাগে তরতর করে কাপতে লাগলো।একহাতে ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরে অন্য হাত দিয়ে মুখটা মুছলো।
–হোয়াট দা হেল!এই মেয়ে চোখে দেখোনা তুমি? অন্ধ নাকি? (নিরব)
আসলে সম্পূর্ন দোষ টা আমার ই।কিন্তু এখন কিছুতেই তা শিকার করা যাবে না।
–আজব লোক তো আপনি।একে তো আমার কুলফি টা পরে গেলো আপনার জন্য।তার উপর এখনা আমাকেই দোষারোপ করছেন।আমার ১০ টাকা ফেরত দিন এখন।
–হোয়াট! (নিরব)
–ক ক কিসের হোয়াট হ্যা?আমার টাকা ফেরত নয়তো মামলা করবো আপনার নামে।
–কিহ!মামলা?নাইছ জোকস।এই মেয়ে তুমি যানো তুমি কার সাথে কথা বলছো? (নিরব)
–এই থামুন তো আপনি।দেখে তো বড়লোক ঘড়ের ই মনে হচ্ছে।তাহলে ১০ টাকা দিতে এতো হাত কাপে কেনো হ্যা?কিপটা বিলাই কোথাকার!
নিরব এবার হতভম্ব হয়ে গেলো।এই মেয়ে জাস্ট ১০ টাকার জন্য এমন করছে।মাই গড।আর ঝামেলা না বাড়িয়ে মানিব্যাগ থেকে ১০০ টাকার নোট বের করে সামনে ধরলো।
–থাক থাক আর অতো দয়া দেখাতে হবে না।আসছে নবাব সাহেব,দয়া দেখাতে।লাগবেনা আপনার টাকা।হুহ..
কথাটা বলেই পিছন দিকে হাটা শুরু করলাম। কি বললাম না বললাম কিছুই জানিনা।শুধু জানি এখান থেকে পালাতে হবে।
নিরব এবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললো,
–এই মেয়ে তোমার কি মাথায় সমস্যা? (নিরব)
–আপনার মাথায় সমস্যা।শুধু মাথায় কেনো? মুখ,চোখ,কান,নাক,হাত,পা সুবকিছুতে সমস্যা আপনার। (পিছনে ফিরে রাগি লুকে কথাটা বলে আর একঅ মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে এলাম ওখান থেকে)
নিরব এখনো ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।তখন ই পিছন থেকে একটা ছেলে ছুটে এসে বললো,
–কিরে নির?কতক্ষন ধরে খুজছি তোকে।আর তুই ওর সাথে কি কথা বলছিলিস? (নিলয়)
–তুই ওকে চিনিস? (ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো নিরব)
–হ্যা চিনি তো।ও তো প্রভা। (নিলয়)
–ফুল নেইম! (নিরব)
–উমমম,হ্যা সাদিয়া আফরিন প্রতিভা। আমার বাড়ির দু বাড়ি পর ই তো ওর বাসা।(নিলয়)
–সাদিয়া আফরিন প্রতিভা,সাদিয়া,দিয়া..(আনমনে বিড়বিড়ালো নিরব)
অন্যদিকে,
বাড়ির দরজার সামনে এসে কোমড়ে হাত গুজে হাপাতে লাগলাম।একপ্রকার দোড়ের প্রতিযোগীতা দেওয়ার মতো করে বাড়িতে এসেছি।হাপাতে হাপাতে হাতের ঘড়িটার দিকে তাকাতেই মুখটা মলিন হয়ে উঠলো।এখন না জানি কি কি শুনতে হবে আমায়।কাপা কাপা হাতে কলিং বেল দিতেই আম্মু গম্ভির মুখ নিয়ে দড়জা খুললো।আমি মাথা নিচু করে বাড়িতে ঢুকতেই আম্মু বলে উঠলো,
–কটা বাজে?
–আ আসলে আম্মু..
–তুমি কি পেয়েছো হ্যা?এই বাড়ির একটা নিয়ম রয়েছে।এটা তোমার নিজের বাড়ি না যে যখন খুশি যাবে আর যখন খুশি আসবে।খেতে পাচ্ছো, পড়তে পারছো।তাতেও কি এতটুকু কৃতজ্ঞতা নেই?
–নিশ্চুপ
–এখন আর দাঁড়িয়ে থেকে কি করবে?যাও ঘড়ে যাও।এই কথা আমার দ্বিতীয়বার না বলতে হয়।
কথাটা বলেই চলে গেলো আম্মু।চোখ দুটো ঝাপসা হিয়ে উঠলো আমার।কোনোরকম দৌড়ে রুমে গিয়ে দড়জা আটকে ফ্লোরে বসে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
–কেনো?কেনো আমাকে রোজ রোজ এমন কথা শুনতে হবে?আমি কি এতটাই অপয়া?এটা কি আমার বাড়ি নয়?আমি মানুষের দয়াতে থাকি! কেনো কেনো?কেনো নিজের জন্মদাত্রী মায়ের মুখে প্রতিদিন এমন ধারালো কথা শুনতে হয় আমায়?
_______☁️
–ইশা? (উজ্জ্বল)
উজ্জ্বল এর কথায় ধ্যান ভাঙলো আমার।চোখ খুলতেই দেখি বিমান এয়ারপোর্ট এ ল্যান্ড করেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নেমে এলাম।
উজ্জ্বল কিছু বলছে না আমায়,কারণ ও বুঝতে পারছে আমার অবস্থাটা।এই মানুষটার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্তেও এতোটা বোঝে আমায়।সত্যি ই আমি ভাগ্যবতি,এমন একজন বন্ধু পেয়ে।
এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা।গাড়ি আগে থেকেই রেডি করা ছিলো।
জানালা খুলে দিয়ে মাথা সামান্য বাহিরে নিয়ে এলাম,গাড়ি কিছুদুর এগোতেই সবকিছু চিনতে পারলাম আমি।
এই তো সেই শহর যেখানে আমি জন্মেছি,বড় হয়েছি।হাজার ধরণের মানুষের সাথে পরিচয় হিয়েছে এই শহরের কোনো এক প্রান্তেই।
অনেকটা বদলে গেছে রাস্তাঘাট,তবুও আমার চিনতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
এক দিন নয়,এক মাস নয়,এক বছর নয় দীর্ঘ পাচ বছর পর পা রাখলাম এই দেশ,এই শহরের মাটিতে।
তবে কি আবারো সেই অতীত কড়া নাড়বে আমার জীবনের দড়জায়?
#চলবে