Monday, October 6, 2025







আমি পদ্মজা পর্ব-৮৯

আমি পদ্মজা – ৮৯
________
আকস্মিক থাপ্পড়ে রিদওয়ানের ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠে প্রচণ্ড আক্রোশে। সে দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষোভ আড়াল করে। মজিদ হাওলাদার টেবিলে থাপ্পড় দিয়ে চাপাস্বরে বললেন,’ এমন বোকামি কী করে করলি? এখন কে বাঁচাবে?’
রিদওয়ান মাথা নত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। পূর্ণার খবরটা শোনার পর থেকে বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে গেছে। পূর্ণার শরীরে অগণিত প্রমাণ রয়েছে যা রিদওয়ানের জন্য বিপদজনক। মুত্তালিব যেখানে সেখানে ফেলে চলে আসবে জানলে সে এই দায়িত্ব দিত না। কিন্তু যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। এখন তাকে একমাত্র মজিদ বাঁচাতে পারেন। খলিল মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,’ ভাইজান,ও বুঝে নাই। না বুইঝা কইরা ফেলছে।’
মজিদ চেয়ারে বসলেন। জগ থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে বললেন,’ যা করেছে করেছেই! কিন্তু শেষে কী বোকামিটা করলো! লাশ কেউ ঝোপে ফেলে আসে?’
রিদওয়ান মুখ খুললো,’ আমি মুত্তালিব কাকারে বলছিলাম,লাশটা আজমপুর হাওড়ে ফেলে আসতে।’
রিদওয়ানের কথা যেন আগুনে ঘি ঢাললো। মজিদ উঠে দাঁড়ান। রিদওয়ানের পিঠে একনাগাড়ে কয়টা থাপ্পড় বসিয়ে খিটখিট করে বললেন,’ তুই চুপ থাক হারামজাদা!’
রিদওয়ানের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। মজিদ খলিলের দিকে তাকিয়ে বললেন,’এখন এখানে বসে থাকবি? নাকি আমার সাথে যাবি?’
খলিল চট করে উঠে দাঁড়ালেন। মজিদ মাথার টুপিটা ঠিক করে রিদওয়ানকে বললেন,’ তুইও আয় সাথে।’
রিদওয়ান পথ আটকে বললো,’ কাকা,একটা কথা ছিল।’
‘আবার কী বলবি তুই?’
‘গতকাল রাতে ভাঙা ফটকের বাইরে ইয়াকুব আলী আর তার ছেলেকে দেখছি।’
মজিদের চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ইয়াকুব আলী শিক্ষিত মার্জিত একজন ব্যক্তি। যিনি ইসলামের আদর্শে চলাফেরা করেন। নিজের সর্বত্র বিলিয়ে দেন গরীব-দুঃখীদের। কিন্তু মজিদকে টেক্কা দিয়ে মাতব্বরি পদটা ছিনিয়ে নিতে পারেননি। তবে তিনি ক্ষমতাবান ব্যক্তি। মজিদের সামনে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা তার আছে। গত চার বছর ধরে এই মহান ব্যক্তির মুখোমুখি মজিদকে হতে হচ্ছে। চার বছর আগে ইয়াকুব আলী সৌদিতে ছিলেন। সৌদি থেকে এসেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জনসেবা করবেন। এই লোক তার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে মানে তো,বিপদজনক কিছু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ মজিদ আন্দাজ করে নিলেন,সেদিনের সমাবেশের ঘটনা থেকে ইয়াকুব আলীর কিছু সন্দেহ হয়েছে। তিনি রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললেন,’ বিপদের জাল চারিদিকে, তার মধ্যে তুই আবার আরেক অঘটন ঘটালি!’
রিদওয়ান প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,’ আপনি পূর্ণার ব্যাপারটা সামলান। আমি বাকিগুলো সামলে নেব।’
রিদওয়ানের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ মজিদের গায়ে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি কটাক্ষ করে বললেন,’তুই আমার বা* করবি!’

অপমানে রিদওয়ানের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। সে খলিলের দিকে তাকায়। খলিল চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। মজিদ রাগে ফুঁসছেন। তিনি মেঝেতে থুথু ফেলে বেরিয়ে পড়লেন। মজিদের সাথে খলিলও বেরিয়ে গেলেন। রিদওয়ান অনেকক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর জগের পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়ল। রিনু আলগ ঘর ছেড়ে দৌড়ে অন্দরমহলে চলে আসে। সে আলগ ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়েছিল। তারপরই মজিদ,খলিল ও রিদওয়ানের কথা শুনেছে। বাড়িতে আমিনা আর আলো আছে। লতিফা পদ্মজার সাথে গিয়েছে। রিনু রান্নাঘরে এসে চার-পাঁচ গ্লাস পানি খেল। তার বুক কাঁপছে। সে বাকহারা! পূর্ণাকে রিদওয়ান আর খলিল খুন করেছে! এটা শুনে তার মাথা ভনভন করছে।

আজিদের বাড়ির আঙিনা শূন্য! কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আমির চারপাশে চোখ বুলিয়ে সোজা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লো। আসমানি হঠাৎ আমিরকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সে নিজেকে ধাতস্থ করার পূর্বে আমির তার গলা চেপে ধরলো। আসমানি আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব। সে দ্রুত আমিরের হাত চেপে ধরে। আমির দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’ একটা মিথ্যা বললে,সোজা নরকে পাঠিয়ে দেব মা* ঝি।’
আসমানির নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। এক্ষুনি বুঝি দম বেরিয়ে যাবে! তার মুখ দিয়ে ঘ্যারঘ্যার জাতীয় শব্দ বেরিয়ে আসে৷ আমির আসমানির হাঁটুতে লাথি দিয়ে আসমানিকে মাটিতে ফেলে দেয়,তারপর চুলের মুঠি ধরে শক্ত করে। আসমানি কাশতে থাকে। হৃৎপিণ্ড আরেকটু হলে ফেটে যেত৷ শ্বাসনালী ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে আসতো! তার মনে হচ্ছে,সে নতুন জীবন পেয়েছে। আসমানি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। রাগে আমিরের কপালের রগ ভেসে উঠেছে। পারলে সে আসমানিকে পিষে ফেলে! আমির গলার আওয়াজ নীচু করে বললো,’ পূর্ণার সাথে কী হয়েছিল?’
আসমানির চোখ দুটি বড় বড় হয়ে যায়৷ সে আমিরকে যতটুকু চিনে গতকালই আন্দাজ করতে পেরেছিল,আমির দ্রুত সব ধরে ফেলবে। কিন্তু এতো দ্রুত ধরে ফেলবে ভাবেনি। আসমানি কথা বলার জন্য উদ্যত হলো তখন আমির হুমকি দিল,’ একটা অক্ষর মিথ্যে বললে এখানেই পুঁতে যাবো। সত্য বলার সুযোগ দেব না।’

আমিরের কথা শুনে ভয় পেয়ে যায় আসমানি। দুই বছর আগের কথা, তাদের দলের একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। আমির সেই বিশ্বাসঘাতককে যেখানে ধরেছিল সেখানেই মাটি খুঁড়ে পুঁতে এসেছিল! আসমানি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,’ চুল ছাড়ো। কইতাছি।’
আমির আরো শক্ত করে ধরে। আসমানি আর্তনাদ করে উঠলো। সে যত সময় নিবে তত বেশি অত্যাচারিত হবে। তাই দ্রুত সব বলে দিল। আমির আসমানিকে ছেড়ে দেয়। ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ান মালেহা বানু। তিনি আজিদের মা এবং আসমানির শ্বাশুড়ি। আমির চলে যেতে উঠে দাঁড়ায়। আসমানি তড়িৎ গতিতে বলে উঠলো,’ কিছু খাইয়া যাও।’

আমির শুনেও না শোনার ভান করে মালেহা বানুর পাশ কাটিয়ে চলে গেল৷ মালেহা বানু অবাক চোখে আসমানিকে দেখছেন।মাতব্বরের ছেলে তার ছেলের বউকে মারলো কেন? তিনি প্রশ্ন করতে গিয়েও করলেন না। তীব্র কৌতূহল চাপা দিয়ে দরজা ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। শফিক আমিরের হাতে খুন হওয়ার পর মালেহা বানু অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি জানেন শফিক নিখোঁজ। আসমানি এবং আজিদ শফিকের পরিণতি জানে। তারা কেউ শফিককে হারিয়ে একটুও ব্যথিত নয়। পাপের রাজত্বে প্রয়োজনে সহযোগী পাওয়া যায়, আপনজন নয়! মালেহা বানু এ সম্পর্কিত কিছুই জানেন না। তিনি সবসময় নীরব। পাড়া ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। দুই ছেলে অর্থ উপার্জন করছে এইতো অনেক! তিনি রানীর মতো আছেন। আর কী লাগে? তার রাগটা আসমানির উপর। আসমানির সাথে শফিকের দৃষ্টিকটু ঘেষাঘেষি তিনি অনেকবার দেখেছেন! এ নিয়ে কথা শুনাতে গেলে,শফিক ও আজিদ দুজনই ক্রুদ্ধ হতো! তাই তিনি অনেকদিন হলো আসমানির সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছেন।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আজিদের সাথে দেখা হয়। আজিদ আমিরকে দেখে বললো,’হুনলাম,পূর্ণা নাকি খুন অইছে?’

আমির উত্তর দিল না। সে আজিদকে এড়িয়ে যায়। আজিদ ঘাড় ঘুরিয়ে আমিরের উপর কটমট করে তাকায়। সে তার বড় ভাই শফিকের কথা শুনে এদের সাথে যুক্ত হয়েছিল। সেখানে দেখা হয় আসমানির সাথে। আসমানি সুন্দরী। রূপের ঝলকে পুরুষ মানুষকে কাত করার ক্ষমতা তার আছে। আজিদ মাঝেমধ্যে পাতালে যেত তাও আসমানির সাথে সময় কাটানোর জন্য৷ আসমানি একাধারে পাতালের প্রতিটি পুরুষের সাথে রাত কাটাত। আজিদ প্রথম অবাক হয়েছিল,একটা মেয়ে কী করে এতোটা খারাপ হতে পারে? তারপর অবশ্য জেনেছে,আসমানি তার জন্মদাত্রীর মতো হয়েছে। আমিরের দাদি নূরজাহানের সঙ্গী হিসেবে তার একজন বান্ধবী ছিল৷ সেই বান্দবীর মেয়ে আসমানি। মায়ের পেশা মেয়ে পেয়েছে! আসমানি ষোল বছর বয়স থেকেই তার গ্রামে কু-কীর্তি করে বেরিয়েছে। গ্রামের সালিশে যখন তাকে গ্রাম থেকে বের করে দিল,তখন মজিদ হাওলাদার আর আমির হাওলাদার আসমানিকে আজিদের গলায় ঝুলিয়ে দিল। আজিদ এমন একটা মেয়েকে বউ হিসেবে গ্রহণ করতে সংকোচ করেছিল৷ কিন্তু তার বড় ভাই বিয়েটা সমর্থন করে। এখানে আজিদের আর কিছু বলার ছিল না। সে আসমানিকে বিয়ে করে। তবে ইদানীং একটা বাচ্চার জন্য আজিদের মন কাঁদে। আসমানির কখনো বাচ্চা হলে সে মানতে পারবে না,এই বাচ্চা তার। এ নিয়ে সে যন্ত্রণায় আছে। মনে মনে হাওলাদার বাড়ি আর মৃত শফিকের উপর ক্ষিপ্ত সে। গত কয়দিন ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে,মজিদের অনুমতি নিয়ে সে আরেকটা বিয়ে করবে। আজিদ সোজা কলপাড়ে চলে আসে। আজ বিকেলে তাকে রওনা হতে হবে। মালেহা বানুর অসুস্থতা বেড়েছে। শহরের ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

——
তখন সময় বোধহয় রাত নয়টা৷ আমির অন্দরমহলে না গিয়ে সোজা আলগ ঘরে প্রবেশ করলো। গাঢ় অন্ধকারে আলগ ঘর ডুবে আছে। চারিদিক এতটাই নির্জন যে,মনে হচ্ছে মৃত্যু নেমে এসেছে চারিদিকে। খলিল-মজিদ বাড়িতে নেই। তারা লোক দেখানো ভালোমানুষিতে ব্যস্ত৷ দুজনে মোড়ল বাড়ির অভিভাবক হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমির জানে,তারা প্রমাণ লুটপাটে ব্যস্ত। প্রমাণ নষ্ট করা তাদের বাঁ হাতের কাজ! আমির বিছানা হাতড়ে বালিশের নিচ থেকে দিয়াশলাই বের করে হারিকেন জ্বালাল। মগা বিকেলে বেরিয়ে গেছে। তাই আলগ ঘরে সুনসান নীরবতা। নয়তো অন্যবার মগার নাক ডাকার শব্দে আলগ ঘরে টেকা যায় না।

আমির তার খয়েরী শার্টের পকেট থেকে একটা লাল ছোট খাম বের করলো। তারপর হারিকেনের সামনে বসলো। পাশের ঘরে ধপ করে শব্দ হয়। আমির সে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো,বিড়াল ছোটাছুটি করছে। নিশ্চয়ই ইদুর দেখেছে! সে হারিকেন নিভিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। লাল খামটি পায়জামার পকেটে রাখে। অন্দরমহলের চারপাশ ঘিরে জোনাকি পোকারা অনর্থক গল্প করে যাচ্ছে। আমির জোনাকিপোকাদের ভীড়ে দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। আজকের দিনটা অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল! কিছুটা সুন্দর কিছুটা দুঃখের! অথচ সবটাই শব্দহীন। আমির কিছু একটা ভেবে অন্দরমহলে প্রবেশ করে। লতিফা আমিরকে দেখে দৌড়ে এসে পথ আটকে বললো,’ ভাইজান,পদ্মর কী হইলো বুঝতাছি না। কথাবাতা কয় না।’
লতিফা চিন্তিত। আমির প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,’ আমি থাকব এখানে। তুই রান্না বসা।’
কথা শেষ করে উপরে উঠে গেল আমির। লতিফা রান্নাঘরে চলে যায়। আমির আজ পদ্মজার সাথে থাকবে শুনে সে কেন জানি খুব খুশি হলো! পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল,আমির সারাক্ষণ ঘরের ভেতর আঠার মতো লেগে থাকতো। না নিজে বের হতো আর না পদ্মজাকে বের হতে দিতো! এ নিয়ে ফরিনা,রানি,নূরজাহান ও আমিনার কত কথা ছিল! লতিফার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। অতীত এতো সুন্দর কেন হয়?

দ্বিতীয় তলায় উঠতেই আমিরের শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে। বারান্দা জুড়ে উত্তুরে হাওয়া বইছে। আকাশের তারা ও অর্ধচন্দ্রের আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। এমন একটা পরিবেশে মিনমিনিয়ে কেউ কাঁদছে । বড্ড অচেনা এই কান্না! যেন কোনো অশরীরী শত জনমের দুঃখ একসাথে মনে করে কাঁদছে! আমির দ্রুত পায়ে পদ্মজার ঘরে আসে। ঘরের প্রতিটি কোণা অন্ধকারে তলিয়ে আছে। বাতাসে একটা ভারী কান্না ভেসে বেড়াচ্ছে। আমির আন্দাজে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো। বিছানার পাশে একটা টেবিল আছে। সে টেবিলে হারিকেন থাকে আর ড্রয়ারে থাকে দিয়াশলাই। আমির দিয়াশলাই বের করে হারিকেন জ্বালাল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো,দেয়াল ঘেঁষে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে পদ্মজা। সে কাঁদছে! কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার করুণ কান্না এসে আমিরের বুক ভিজিয়ে দেয়। ও বাড়ির অবস্থা ভালো নেই। প্রেমার গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। বাসন্তী পড়েছেন বড় কষ্টে! একদিকে পূর্ণার সমাপ্তি অন্যদিকে প্রেমার গা কাঁপানো জ্বর! মৃদুলের গলা ভেঙে গেছে,বড্ড এলোমেলো হয়ে গেছে সে। বাবা-মায়ের বড় আদরের একমাত্র ছেলে। কখনো মায়ের হাতে মার খেয়েছে কিনা সন্দেহ! তার প্রাপ্তির খাতা সবসময় পরিপূর্ণ ছিল। সে কখনো কষ্টে কাঁদেনি,বাস্তবতা দেখেনি। সোনার চামচে খেয়ে বড় হওয়া আহ্লাদী আদুরে ছেলে! তার জন্য এই ধাক্কাটা মৃত্যুর মতো! সে স্বাভাবিক হতে কত সময় নিবে কে জানে! অথচ সবকিছু ছেড়ে পদ্মজা অন্দরমহলে চলে এসেছে। তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এক জায়গায় সারাক্ষণ বসে ছিল। তারপর হুট করেই অন্দরমহলে চলে আসে। সাথে খন্ড খন্ড মেঘ আষাঢ়ী দুই চোখে জড়ো করে নিয়ে আসে।
আমির কথা বলার জন্য যখন উদ্যত হলো সে টের পেলো তার হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়ছে! এমন কেন হয়? পদ্মজা কোন আসমানের চাঁদ যে তাকে ছোঁয়ার কথা ভাবলেই আমিরের গলা শুকিয়ে আসে! কয়দিনের দূরত্বে, মানুষটার চোখের দিকে তাকাতেও সংকোচ হচ্ছে! অথচ,ফেলে আসা দীর্ঘ ছয় বছরের প্রতিটি রাত দুজন দুজনের বুকের সাথে লেপ্টে কাটিয়েছে। কত উছলে পড়া জ্যোৎস্না রাতে তারা ভালোবাসার গল্প রচনা করেছে! আমির রয়ে সয়ে বললো,’ চলে এলে কেন?’
পদ্মজা মাথা তুলে তাকালো। পদ্মজার চোখের দৃষ্টিতে আমির এলোমেলো হয়ে গেল। বুক প্রবলভাবে কাঁপতে থাকলো। পদ্মজার দৃষ্টির জাল আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে তাকে। সে বিছানার উপর বসলো। বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অথচ পদ্মজা নির্লিপ্ত। পদ্মজার নাকের নাকফুলটা জ্বলজ্বল করছে। নাকফুলটি বিয়ের পর আমির পরিয়ে দিয়েছিল। নাকফুলে গেঁথে দিয়েছিল জনম জনমের ভালোবাসা। অথচ,এখন সেই ভালোবাসা বিষের দাঁনার মতো রূপ নিয়েছে! পদ্মজা এক হাতে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,’ আমি কিছু পেলাম না জীবনে। আব্বার অবহেলা আর নোংরা কথা শুনে কাটিয়েছি ষোলটা বছর। তারপর আমার মা,আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। সে হচ্ছে আরেক বিশ্বাসঘাতক।’
শেষ লাইনটায় ক্ষোভ-অভিমান প্রকাশ পায়। পদ্মজা গলার জোর বাড়িয়ে ‘বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটি উচ্চারণ করলো। আমির চট করে বললো,’ উনি বিশ্বাসঘাতক নন।’
পদ্মজা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো দুই হাতে খামচে ধরে মেঝে। আমিরের দিকে রক্তচোখে তাকায়। তার বুক থেকে আঁচল মেঝেতে পড়ে। সে রাগে দাঁতে দাঁত চেপে আমিরকে বললো,’ করেছে,করেছে। সবকিছুর জন্য আমার মা দায়ী। সব ভুল আমার মায়ের। সে আমাকে জন্ম দিয়েছে। আমাকে আগুনে ঠেলে দিয়ে নিজে চলে গেছে। ছোট থেকে আমাকে বলে এসেছে, সারাজীবন আমার সাথে থাকবে। আমাকে আগলে রাখবেন। যাই হয়ে যাক,সব আমাকে বলবে৷ কিন্তু আম্মা,একটা কথাও রাখেনি। রাখেনি কোনো কথা। প্রতারক,বিশ্বাসঘাতক। সব দোষ আমার মায়ের। সব দোষ…’

পদ্মজা অস্থির হয়ে পড়েছে। তার নিঃশ্বাস এলোমেলো। সে বিপর্যস্ত। কাঁদতে কাঁদতে হুট করে আমিরের দিকে তাকিয়ে সে হাসলো। বললো,’ সবাই কী ভেবেছে? আমাকে কষ্ট দিয়ে কাঁদাবে? আমি কাঁদব না। কিছুতেই কাঁদব না।’
কাঁদব না বলেও আবার কাঁদতে শুরু করলো। কষ্টের মাত্রা পেরিয়ে গেলে,মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সে তার জীবনের ছোট ঘটনাগুলোকে বড় করে ভাবতে থাকে।সারাক্ষণ বিলাপ করে আর কাঁদে। পদ্মজার অবস্থা এখন ওরকম! সে তার চেনা সত্ত্বা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। পদ্মজার কান্না শুনে আমিরের মাথা ফেটে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে বলতে চাইছে, পদ্মবতী, কান্না থামাও। কান্না থামাও তুমি। আমি সহ্য করতে পারছি না৷ এতো কেন কষ্ট তোমার? তুমি পদ্মবতী নাকি কষ্টবতী?
মনের কথা মনে রয়ে গেল। আমির পারলো না কিছু বলতে। সে বিছানার মাঝে গিয়ে বসলো। দুই হাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে৷ ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেয়। আত্মগ্লানি তাকে গ্রাস করে ফেলেছে৷ সে যেন অদৃশ্য কোনো শেকলে বন্দী। পদ্মজার আর্তনাদ, বিলাপ গুমরে গুমরে কেঁদে ঘরের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমির টের পাচ্ছে! আর টের পাচ্ছে বলেই,মনে হচ্ছে তার মস্তিষ্কে কেউ যেন রড দিয়ে পিটাচ্ছে। সে জানালার বাইরে তাকায়৷ রাতের লক্ষ তারাতেও যেন বেদনার গুঞ্জন। হৃদয়ের শহর খাঁখাঁ করছে। ইচ্ছে হচ্ছে,অন্যবারের মতো পালিয়ে যেতে। কিন্তু আজ সে পালাবে না। সে পালাতে চায় না। তার ভেতরটা তিরতির করে কাঁপছে। মোলায়েম বাতাসের ঝংকারে রগে রগে শিরশির অনুভুতি হচ্ছে। আমির পদ্মজার দিকে তাকায়। নিজের মাথার চুল আরো জোরে টেনে ধরে। পদ্মজা পা ছড়িয়ে বসলো। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজলো। আমির পদ্মজার উপর চোখ রেখে নিজের হাত কামড়ে ধরে। সে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, সে কি নিজের সিদ্ধান্তে অটল? হ্যাঁ/না,/হ্যাঁ/না একটা সিদ্ধান্তের ব্যবধান মাত্র। তাহলেই মনের যুদ্ধের সমাপ্তি! খুব দ্রুত উত্তর আসে হ্যাঁ! মুহূর্তে অদৃশ্য ভারী দেয়াল ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। পৃথিবীর সব ফুল জেগে উঠে। শান্ত সমুদ্রের ঢেউ যেন বিকট শব্দ তুলে আছড়ে পড়ে তীরে। আমির বিছানা থেকে নেমে পদ্মজার দুই বাহু চেপে ধরে দাঁড় করায়। পদ্মজা দরজার বাইরে তাকিয়ে আছে। তার বার বার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। একবার পূর্ণাকে দেখছে তো অন্যবার পারিজাকে। দুজনই রক্তাক্ত অবস্থায় তার সামনে আসে। পদ্মজা খামচে ধরে আমিরের চোখমুখ। নখের আঁচড়ে গাল ছিঁড়ে নেয়। আমির তার দুই হাতে পদ্মজাকে বুকের সাথে চেপে ধরলো। পদ্মজা আবার কান্না শুরু করে।

আমির পদ্মজাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো,’একটু শান্ত হও…একটু!’
পদ্মজা এতক্ষণ আমিরকে টের পায়নি। এখন টের পাচ্ছে। সে এক ঝটকায় আমিরের হাত দূরে সরিয়ে দেয়। তারপর বিছানার মাঝে গিয়ে বসলো। আমির পদ্মজার সামনে এসে বসে৷ আমিরের মুখটা দেখে মনে পড়ে যায় প্রথম দিনের কথা। যেদিন পাতালে আমিরের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল। আমির নগ্ন মেয়েগুলোকে বেল্ট দিয়ে পিটাচ্ছিল! পদ্মজার রক্ত ছলকে উঠে। তার বোনের সাথেও কি এমন হয়েছে? কিছু বুঝে উঠার পূর্বে পদ্মজা আমিরের গলা চেপে ধরলো। আমির হকচকিয়ে গেলেও বাঁধা দিল না। পদ্মজা আমিরের মুখের উপর ঝুঁকে কিছু একটা বিড়বিড় করে। যা অস্পষ্ট। বিড়বিড় করতে করতে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে দুই হাতে আমিরের গলা চেপে ধরে রাখে। আমির গলায় প্রচণ্ড চাপ অনুভব করে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। চোখ বুজতেই যন্ত্রণায় চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে। পদ্মজা আমিরের গলা ছেড়ে দিল। দূরে সরে বসলো। আমিরের শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখে ফিক করে হেসে দিল। তারপর আবার নীরব হয়ে গেল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে,হেমলতার মৃত মুখ,পারিজারর মৃত মুখ,পূর্ণার মৃত মুখ! পূর্ণা একটা গাছের সামনে বসে কাঁদছে। এইতো তার চেয়ে মাত্র কয়েক দূরেই সেই গাছটা। পারিজা একটা বাড়ির ছাদে বসে আছে। তার গলা থেকে রক্ত ছুঁইয়ে- ছুঁইয়ে পড়ছে! পদ্মজা থম মেরে সেখানে তাকিয়ে রইলো। অদ্ভুত স্বরে কেঁদে উঠলো। আমির নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিল। পদ্মজা কান্না থামিয়ে অবাক চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছু দেখছে! আমির পদ্মজার কাছে এসে বসে। পদ্মজার এক হাত মুঠোয় নিয়ে আঙুলগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। পদ্মজার মুখের উপর কয়টা চুল উড়ে বেড়াচ্ছে৷ আমির অবাধ্য চুলগুলোকে পদ্মজার কানে গুঁজে দিল৷ পদ্মজার চোখ,নাক,গাল,ঠোঁট পর্যবেক্ষণ করে আমির উঁকি দিল অতীতে। গল্পটা ভীষণ ব্যক্তিগত। পদ্মজা একবার বিরক্ত হয়ে রাগী স্বরে বলেছিল,’আরেকটা চুমু দিলে আমি বাড়ি ছেড়ে কিন্তু চলে যাব।’
আমির পদ্মজার কথায় থমকে যায়। তখন ঢাকায় নতুন নতুন তাদের সংসার। পদ্মজা ভার্সিটিতে পড়ছে। আগামীকাল তার পরীক্ষা তাই সে পড়ছিল। কিন্তু আমির সেদিন বাড়িতে ছিল। আর সারাক্ষণ পদ্মজাকে বিরক্ত করে যাচ্ছিল। পদ্মজার মুখের সামনে গিয়ে একবার নাকে চুমু দেয় তো আরেকবার গালে। বারংবার পদ্মজা পড়ার খেই হারিয়ে ফেলছিল। সে ভীষণ রেগে যায়। আর কথাটা বলে ফেলে। আমিরতো বরাবরই রাগী। সে তাৎক্ষনিক রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা সময় বাড়ি ফেরে তাও পদ্মজার সাথে কোনো কথা বললো না। পদ্মজা তো অবাক। সে কথা বলতে গেলে, হু হ্যাঁ ছাড়া আমির কিছু বলে না। পদ্মজা মুখে কিছু বলতে লজ্জা পায়৷ তাই সে বিভিন্নভাবে আমিরের আকর্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করেছে। আমির প্রথম পদক্ষেপে নরম হয়ে গেলেও প্রকাশ করলো না। সে গম্ভীর হয়ে থাকে। চুপচাপ খেয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। অথচ অন্যবার পদ্মজাকে টেনে নিয়ে যায়,তারপর একসাথে ঘুমায়। আমিরের আচরণে পদ্মজা মনে ব্যথা পায়। একটা কথার জন্য এরকম কেউ করে? পদ্মজা অভিমানে বৈঠকখানায় বসে থাকে। আমির এদিকে চিন্তিত৷ রাত বাড়ছে,পদ্মজা আসে না কেন? সে ভাবলো,পদ্মজা এসে ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলে তার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করবে। তখন সে কিছু একটা চেয়ে বসবে। কিন্তু তার অর্ধাঙ্গিনী তো ঘরেই আসছে না! আমির বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। সিঁড়ি ভেঙে নামার সময় দেখে পদ্মজা সোফায় গাল ফুলিয়ে থম মেরে বসে আছে! রাগ ভাঙানোর বদলে উল্টো রাগ করে বসে আছে। কি অদ্ভুত! আমির খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে বললো,’ রাত কয়টা বাজে কারো খবর আছে? কেউ কি ঘরে যাবে না?’
পদ্মজা অভিমানী স্বরে বললো,’ কেউ তাকে পাত্তা না দিলে সে কেন ঘরে যাবে?’
আমির হেসে ফেললো। সে পদ্মজার সামনে এসে বসে। পদ্মজার চোখে জল চিকচিক করছে। আমির পদ্মজার হাতে চুমু দিয়ে বললো,’ কী বাচ্চাকাচ্চা বিয়ে করলাম রে। একটুতে কেঁদে দেয়।’
‘তো ছেড়ে দিন না।’
আমিরের চোখ দুটি বড় বড় হয়ে যায়! পদ্মজা এতো কথা কবে শিখলো। কী অভিমান তার! আমির হাসি দীর্ঘ করলো। পদ্মজার মুখের উপর ঝুঁকে বললো,’ মৃত্যুর আগে ছাড়ছি না। পরপারে যদি আবার দেখা হয় তখনও তোমার পিছু নেব।’
আমিরকে মুখের উপর ঝুঁকতে দেখে পদ্মজা লজ্জা পেয়ে গেল।

ও বাড়ির প্রতিটি ইট তাদের ভালোবাসার স্বাক্ষী। সবখানে ভালোবাসা লেপ্টে লেপ্টে আছে। আমির বর্তমানে ফিরে আসে। সে রান্নাঘরে যায়। লতিফাকে বলে গরম পানি আর ছোট তোয়ালে নিয়ে আসে। পদ্মজার মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে। তার চোখ দুটির উপর যেন ভারী পর্দা টানানো। এই জগতের কিছু দেখছে না। সে চোখ বুজলো। তার হাঁটু থেকে পা অবধি কাঁদা লেগে আছে। আমির ভেজা তোয়ালে দিয়ে পদ্মজার হাত-পা মুছে দিল। তারপর লতিফাকে ডেকে আনে। লতিফা পদ্মজাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। সে পদ্মজাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমির লতিফাকে বললো,’ কয়দিনে ঠিক হয়ে যাবে। শোন তোর সাথে কিছু কথা আছে।’
লতিফা উৎসুক হয়ে তাকায়। আমির বললো,’ পদ্মজার যত্ন নিবি। রাধাপুরের রঞ্জন মিয়ারে চিনিস না?’
লতিফা বললো,’ চিনি।’
‘উনি নিজের হাতে বাদামের তেল বানান। খাঁটি বাদামের তেল। পদ্মজা চুলে বাদামের তেল দেয়। উনার কাছ থেকে সবসময় বাদামের তেল আনবি। আর, ওর পিঠের হাড়ে মাঝে মাঝে ব্যথা হয়। ছোটবেলা কোথাও আঘাত পেয়েছে। যখন ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটবে বুঝবি,পিঠের হাড়ে যন্ত্রণা হচ্ছে। তখন ধরে নিয়ে সরিষা তেল ডলে দিবি আর গরম সেঁক দিবি। তিনবেলা নিজ দায়িত্বে জোর করে খাওয়াবি। আর পিঠের দিকে কিন্তু খেয়াল অবশ্যই রাখবি।’
লতিফা জানে না তাকে কেন এই দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে৷ সে প্রশ্নও করলো না। বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। পদ্মজা আবার মিনমিনিয়ে কাঁদছে। অস্পষ্ট স্বরে পূর্ণাকে ডাকছে। লতিফা পদ্মজার শাড়ি ও বিছানার চাদর পাল্টে দিল৷ শাড়ি পাল্টানোর সময় যখন পদ্মজা অর্ধনগ্ন তখন সে লতিফাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘পূর্ণা..পূর্ণা…বোন আমার।’

লতিফা চমকে গেল। তাকে পদ্মজা পূর্ণা বলছে কেন? পদ্মজার কান্না শুনে আমির ছুটে ঘরে আসে। পদ্মজা আমিরকে দেখেই,টেবিল থেকে হারিকেন নিয়ে তার উপর ছুঁড়ে মারে। তারপর চিৎকার করে বললো,’ খুনী,ধর্ষক, জানোয়ার…জানোয়ার….।’
পদ্মজার চিৎকারে অন্দরমহল কেঁপে উঠে। হারিকেনের কাচের উপর ব্যবহৃত প্লাস্টিক আলাদা হয়ে গিয়েছিল। তাই পদ্মজা চিকন তার দিয়ে সেটি জোড়া দেয়। তারের একাংশ খাড়া হয়ে ছিল। সেই খাড়া অংশ আমিরের চোখের পাশে ঢুকে পড়ে। আরেকটু হলে চোখ গলে যেত। সঙ্গে সঙ্গে আমির মেঝেতে বসে পড়লো। দুই-তিন ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসে। লতিফা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। পদ্মজা রাগে কিড়মিড় করতে করতে চাদর ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে। আমির লতিফাকে বললো,’ পদ্মজাকে দেখ তুই।’
তারপর সে অন্য চোখে পথ দেখে সোজা কলপাড়ে চলে যায়। চোখের পাশে আঘাত পেলেও চোখের ভেতর ভীষণ ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। খলিল-রিদওয়ান সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছে। এসেই পদ্মজার চিৎকার শুনে। পদ্মজার চিৎকার কোনো স্বাভাবিক মানুষের মতো না। তাছাড়া তারা দুজনই পদ্মজাকে ও বাড়িতে কাঁদতে দেখেনি। অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখেছে। খলিল রিদওয়ানকে বললো,’ এই ছেড়ি পাগল হইয়া গেল নাকি?’
রিদওয়ান হেসে বললো,’ আরো আগে হওয়ার কথা ছিল আব্বা।’

আমিরকে কলপাড়ে দৌড়ে যেতে দেখে রিনুও পিছনে যায়। সে কল চাপে। আমির উন্মাদের মতো চোখে পানি দিতে থাকে। তার চোখ জ্বলে যাচ্ছে। যাক, সে তো এটাই চায়! হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃত সব ছারখার হয়ে যাক!
পদ্মজা লতিফার হাত খামচে ধরে। তার চোখমুখ অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সে চাপা স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘আমার বোনকে কে খুন করেছে? কার আদেশে হয়েছে?’
পদ্মজার চাহনি দেখে মনে হচ্ছে,লতিফা যদি প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারে তাহলে পদ্মজা তাকেও খুন করে ফেলবে। লতিফা পদ্মজার সাথে বাড়ি ফেরার পর রিনু লতিফার কাছে ছুটে আসে। সে যা যা শুনেছে সব লতিফাকে বলে। লতিফা এখন সব জানা সত্ত্বেও বলতে চাইছে না। সে বললো,’ শাড়িডা আগে পিন্দো। ঠান্ডা লাগব।’
পদ্মজা লতিফার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। সে লতিফার হাত খামচে ধরে রাখা অবস্থায় বললো,’ কী জানো তুমি? বলো আমাকে।’

যতক্ষণ লতিফার মুখ থেকে কিছু না শুনবে ততক্ষণ লতিফার হাত পদ্মজা ছাড়বে না। তার নখ লতিফার হাতের চামড়া ভেদ করেছে। লতিফা সংক্ষেপে দ্রুত সব বললো। সব শুনে পদ্মজা লতিফার হাত ছেড়ে নিজের হাত নিজে খামচে ধরে। মুখ দিয়ে ‘ইইইই’ জাতীয় শব্দ করে রাগে কাঁপতে থাকে। লতিফা ভয় পেয়ে যায়। সে পদ্মজার মাথায় হাত রাখে,পদ্মজা সেই হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। লতিফা দূরে সরে আসে। পদ্মজা শূন্যে তাকিয়ে নিজেকে স্থির করলো। তারপর চুপচাপ শাড়ি পড়ে শুয়ে পড়ে। লতিফা ধীর পায়ে পদ্মজার পায়ের কাছে এসে বসলো।

ঘন্টাখানেক পার হওয়ার পর আমির ঘরে আসে। আমিরকে দেখে লতিফা বেরিয়ে যায়। আমির এক চোখে ঝাপসা দেখছে। সে ধীরপায়ে পদ্মজার পায়ের কাছে এসে বসলো। চোখ ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশ দেখে আবিষ্কার করলো, পুরো ঘর জুড়ে গাঢ় বিষাদের ছায়া। এ ঘরে আনন্দরা আসে না অনেকদিন! আমির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পদ্মজার পায়ের আঙুল ফুটিয়ে দিল। কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মৃদুলের মতো হাউমাউ করে যদি কান্না করা যেত! আমির ঠোঁট কামড়ে ধরে। দুই গাল বেয়ে আষাঢ়ের বৃষ্টি নামে। সেই বৃষ্টিতে পদ্মজার দুই পা স্নান করে। তাদের জীবনের সব সুর,ছন্দ এক থাবায় কে ছিনিয়ে নিল? কেন হলো না দীর্ঘ সংসার! তবে কেন হয়েছিল,পাপ-পবিত্রের মিলন? শূন্যে অভিযোগ তুলেও উত্তর মিলে না। আমির তার চোখের জল মুছে ফেললো। তারপর পদ্মজার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। একবার ভাবলো,পদ্মজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে। তারপর আবার ভাবলো, যদি পদ্মজার ঘুম ভেঙে যায়। পাশেও শুয়ে থাকতে পারবে না। তাই চুপচাপ দূরত্ব রেখে শুয়ে থাকে। শেষ রাতে পদ্মজা ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠে। সে স্বপ্নে শুধু রক্ত দেখছে। রক্তের সাগর,রক্তের নদী,রক্তের পুকুর! পদ্মজা ভয়ে চট করে চোখ খুলে। সে ঘুমাচ্ছে না বরং বার বার পূর্ণার সাথে সাক্ষাৎ করছে! পাশ ফিরে দেখে আমির শুয়ে আছে। তার চোখ দুটি বোজা। গত দিনগুলোতে সে ঘুমায়নি। পদ্মজার সংস্পর্শে আসতেই তাকে ঘুম জেঁকে ধরেছে। পদ্মজা আমিরকে দেখে থমকায়। আমিরের এক চোখ ফুলে গেছে। পদ্মজা আলতো করে আহতস্থান ছুঁয়ে দেয়। কী যেন মনে পড়তেই অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়ে। আমির চোখ খুললো। সে পদ্মজার পিঠের উপর নির্বিকারভাবে চেয়ে রইলো।

ফজরের আযানের সুর ভেসে আসে কানে। বিষাদ রাঙা ভোরের আলো ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরের ভেতর। আমির উঠে বসে। পদ্মজা আবার ঘুমিয়েছে। ঘুমের মাঝে বিড়বিড় করছে। আমির কান পেতে শুনে,পদ্মজা পূর্ণাকে কিছু বলছে! সে তার পায়জামার পকেট থেকে লাল খামটি বের করে বালিশের কভারের ভেতর রেখে দিল। তারপর বিছানা থেকে নেমে পদ্মজার মুখের সামনে চেয়ার নিয়ে বসলো। ভোরের মায়াবী আলোয় পদ্মজার বিষণ্ণ মুখটা আরো বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। আমির সাবধানে পদ্মজার কপালে চুমু দিল,হাতে চুমু দিল। তারপর মিষ্টি করে হেসে বললো,’ তুমি চাও বা না চাও,পরপারে দেখা হলে আবার তোমার পিছু নেব।’

চলবে…
®ইলমা বেহেরোজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ