আমি পদ্মজা – ৮৭
_________
পদ্মজা দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফরিনার কবরের পাশে গেল। সাথে নিয়ে এসেছে গোলাপ, জারবেরা,গাঁদা ও চন্দ্রমল্লিকা গাছের চারা। ফরিনার কবরের চেয়ে একটু দূরে গর্ত খুঁড়লো। প্রথমে গোলাপ গাছের চারা রোপণ করে। রিদওয়ান অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে পদ্মজাকে দেখে সেকেন্ড তিনেকের জন্য দাঁড়ালো। তার চোখেমুখে আনন্দের ছাপ! তারা গত দুইদিন পদ্মজার উপর কোনো রকম চাপ প্রয়োগ করেনি এবং বাজে আচরণও করেনি! পদ্মজা প্রথম যখন ব্যাপারটা ধরতে পারলো অবাক হয়েছিল। পরে আন্দাজ করে নিয়েছে, আড়ালে নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্র চলছে! পদ্মজা স্বাভাবিক আচরণ করলেও ভেতরে ভেতরে সর্বক্ষণ ওঁৎ পেতে থেকেছে। সাবধান থেকেছে।কিন্তু কোনো আক্রমণ এখনো আসেনি। রিদওয়ান পদ্মজার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও সেদিকে গেল না। পদ্মজার উদ্দেশ্যে শিস বাজিয়ে যেখানে চাচ্ছিল সেদিকে চলে যায়। পদ্মজা শিস শুনেও তাকালো না। সে বুঝতে পেরেছে শিসটা কে দিয়েছে! পদ্মজা আরেকটা গর্ত খুঁড়লো চন্দ্রমল্লিকার জন্য।
আমির জানালা খুলে বাইরে তাকালো। সঙ্গে-সঙ্গে চোখেমুখে এক মুঠো বাতাস আর তীব্র আলো ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমির চোখ ছোট ছোট করে ফেললো। তারপর চারপাশে চোখ বুলাল। অন্দরমহলের কারো উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না। কারো সাড়া শব্দও নেই। বাড়িটা মৃত হয়ে গেছে! একসময় কত শোরগোল ছিল! শাহানা,শিরিন,রানি,লাবণ্য,ফরিনার মতো ভালোমনের সহজ-সরল মানুষগুলো ছিল। এখন কেউ নেই! লাবণ্যর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল,হয়েছে কী? লাবণ্য নিজের ভাইকে ছাড়া কী করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল! আর রানি? রানি ভাগ্যের সাথে অভিমান করে কোথায় হারিয়ে গেল? আদৌ বেঁচে আছে ? নাকি অভিমানের পাল্লাটা এতোই ভারী যে সইতে না পেরে নিজেকে উৎসর্গ করেছে? আমিরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে ফরিনার কবরের দিকে তাকালো। পদ্মজা বাঁশের কঞ্চি নেয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে মাত্র। তার সাদা শাড়ির আঁচল মাটি ছুঁইছুঁই। শাড়ির একপাশে কাদা মাখানো। সাদা শাড়ি পরা অবস্থায় পদ্মজাকে দেখে আমিরের আত্মা স্তব্ধ হয়ে যায়! সে চেয়ার খামচে ধরে। বুকের ভেতর সূচের মতো তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রণা শুরু হয়। ক্ষণ মুহূর্তের পার্থক্যে সেই যন্ত্রণা বুক ছাপিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাখ্যাতীত যন্ত্রণার অনুভতিতে তার ভেতরটা গাঁট হয়ে যায়।
সে তিনরাত, দুইদিন পাতালঘরে থেকে আজ সকালে বেরিয়ে এসেছে। অন্দরমহলে না গিয়ে সোজা আলগ ঘরে চলে আসে। মগার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। মগা আমিরকে তার পাশে শুতে দেখে চমকায়। তবে উদ্ভ্রান্ত আমিরের সাথে কথা বলার সাহস হয় না। সে মেরুদণ্ড সোজা করে চুপচাপ শুয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর আমির ঘুম ঘুম চোখে বললো,’আমি যে এখানে আছি কেউ যেন জানতে না পারে।’
মগা সোজা থেকেই চোখ ঘুরিয়ে আমিরের পিঠের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আইচ্ছা।”
আমির ঘুমিয়ে পড়ে। এইতো কিছুক্ষণ আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। শরীরে এক ফোঁটাও শক্তি ছিল না। দুইদিন শুকনো খাবার আর দুই বোতল পানি খেয়ে কাটিয়েছে। মগা আমিরের মুখ দেখে বুঝতে পারে, আমির ক্ষুধার্ত! সে অন্দরমহল থেকে পিঠা এনে দেয়। লতিফা গতকাল বিকেলে পিঠা বানিয়েছিল। আমির বিনাবাক্যে পিঠা খেল। তারপর জানালা খুলে পদ্মজার পরনে সাদা শাড়ি দেখে থমকে গেল,স্তব্ধ হয়ে গেল। আমিরের বুকের ভেতর থেকে কেউ একজন বললো, “এই চোখ গলে যাক। দৃষ্টি কমে যাক। সাদা রঙ এতো বিচ্ছিরি কেন?”
আমির অযত্নে বড় হওয়া মাথার চুলগুলো এক হাতে টেনে ধরে হা করে শ্বাস নিল। জানালা দিয়ে আসা আলোয় মগা আবিষ্কার করলো,আমিরের হাতে অগণিত কামড়ের দাগ! তাও সে চুপ থাকলো। আগ্রহ চাপা দিল। আমির হাতে কামড় দেয়ার জন্য হা করে তখন মগার উপস্থিতি টের পায় আর থেমে যায়। তার চোখ দুটি অস্বাভাবিক রকমের লাল! মগা চোখের দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে। আমির পানি পান করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে।
পূর্ণা হাওলাদার বাড়িতে ঢুকেই আলগ ঘরের সামনে আমিরকে দেখতে পায়। আমিরকে দেখে অজানা,বোবা একটা অনুভূতি কুন্ডলী পাকিয়ে পূর্ণার বুকের ভেতর ঢুকে পড়ে। সে দৌড়ে আসে। পূর্ণাকে আসতে দেখে,আমির তার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে, হাসি হাসি মুখ করার চেষ্টা করলো। পূর্ণা আমিরের সামনে এসে দাঁড়ায়। সে অবাক চোখে আমিরকে দেখে৷ আমিরের মাথার চুল লম্বা হয়েছে। চুলগুলো আগে চিকচিক করতো এখন কেমন ময়লা দেখাচ্ছে! দাঁড়ি-গোঁফের জন্য গাল দেখা যাচ্ছে না। শুকিয়েছে অনেক। আমিরকে দেখে পূর্ণার চোখেমুখে যে আনন্দটা আগে ফুটে উঠতো সেটা আজ নেই। বরং বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে! আমিরকে দেখেই পূর্ণার চোখ দুটি বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে।
পূর্ণার আমিরের জন্য মায়া হয়। আমির কখনো তার বোনের জামাই ছিল না,বড় ভাই ছিল! তাই অনুভূতিটা ছোট বোনের মতোই রক্তাক্ত।
পূর্ণা পাংশুটে স্বরে বললো,’আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না ভাইয়া।’
পূর্ণার কথা শুনে আমির অবাক হলো না। সে শুনেছে, পূর্ণা একরাত এখানে ছিল। তাহলে পদ্মজা নিশ্চয়ই কিছু বলেছে। পূর্ণা আবার বললো,’ এতো নিখুঁত অভিনয় কেউ করতে পারে না। তোমার ধমক,উপদেশ, ভালোবাসা কিছু অভিনয় ছিল না। এতটুকু আমি বুঝতে শিখেছি। তুমি চাইলে সব খারাপ কাজ ছেড়ে দিতে পারবে। ভাইয়া দয়া করে তুমি আমার ভালো ভাই-ই থাকো!’
পূর্ণা কেঁদে দিল। সে কান্না ছাড়া অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। আমির সবসময় পূর্ণার মাথায় হাত রেখে উপদেশ দেয়,স্বান্তনা দেয়। অভ্যাসমতো আজও পূর্ণার মাথায় হাত রাখতে গেল,কিন্তু রাখলো না। থেমে গেল। যদি পূর্ণা এই ছোঁয়াকে অপবিত্র মনে করে! আমির নিজের হাত গুটিয়ে নিল। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,’ মৃদুল নাকি আজেবাজে কথা বলেছে?’
পূর্ণার বুকের ভেতরে থাকা টনটনে অভিমানটা কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,’কথা ঘোরাচ্ছ কেন ভাইয়া?’
আমির নিরুত্তর। পূর্ণা বললো,’ তোমার নাকি মন নেই? মায়াদয়া নেই? তুমি নাকি পাষাণ, নিষ্ঠুর!’
এতো করুণ কারো কণ্ঠ হয়? বোন বলছে, তুমি নাকি পাষাণ,নিষ্ঠুর! উত্তরে কী বলবে আমির? হ্যাঁ আমি পাষান বলবে? নাকি চুপ থাকবে? আমির বুঝতে পারলো না। পূর্ণা আমিরের নিশ্চুপ থাকাটা পছন্দ করছে না। শ্যামবর্ণের আমির হাওলাদারকে একসময় পূর্ণা পছন্দ না করলেও এখন আত্মার সাথে মিশে গিয়েছে। আমির বাচাল প্রকৃতির মানুষ। সারাক্ষণ কথা বলে। কিন্তু আজ তার মুখে কথা নেই। সে নির্জীব, নিষ্ক্রিয়। পূর্ণা সাবধানে ভেজা কণ্ঠে বললো,’ আমিও কি তোমাকে ঘৃণা করব ভাইয়া?’
আমির ছটফট করতে থাকে। তার পা দুটি অস্থির,চোখের দৃষ্টি অস্থির। কপালে ছড়িয়ে থাকা কয়টা চুল টেনে ধরে। পূর্ণা গাঢ় স্বরে বললো,’আপা খুব কষ্টে আছে ভাইয়া। আপা ছোট থেকে কষ্ট পেয়ে আসছে। এখনো পাচ্ছে। আর কতদিন কষ্ট পাবে?কবে সবকিছু ঠিক হবে?’
আমির চটজলদি উত্তর দিল,’,দুইদিন!’
পূর্ণা ভ্রু কুঁচকাল। বললো,’ দুইদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে?’
আমির কথা বললো না। তবে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। পূর্ণার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। তবে কি,আমির সবকিছু ছেড়ে দিতে যাচ্ছে! পূর্নার ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হয়। সে খুশিতে বাকবাকুম হয়ে যায়। বললো,’সত্যি?’
আমির ধীরসুস্থে বললো,’আমাদের কী কথা হয়েছে পদ্মজাকে বলো না এখন।’
‘বলব না,ভাইয়া। ভুলেও বলব না।’
আমিরের সাথে পূর্ণার বেশিক্ষণ কথা হলো না। আমির চুপচাপ,বিষণ্ণ। পূর্ণা অনুমতি নিয়ে পদ্মজার কাছে চলে যায়। আমির বারান্দা থেকে চেয়ার নিয়ে বাইরে এসে বসলো। লতিফা মগাকে বাজারে পাঠানোর জন্য আলগ ঘরে আসে। ঘর থেকে বাইরে তাকিয়ে আমিরকে দেখতে পেল। আমিরকে দেখে সে প্রাণ ফিরে পায়! উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ঘর থেকে চিৎকার করে ডাকলো,’ভাইজান।’
আমির তাকালো। লতিফা ছুটে বাইরে আসে। সে গত দুইদিন পাতালঘরের আশেপাশে গিয়ে ঘুরঘুর করেছে কিন্তু আমিরের দেখা পায়নি। পদ্মজার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা না বলা অবধি সে কিছুতেই শান্তি পাবে না!
পদ্মজা চারা লাগানোর পর আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে গোড়ার মাটি শক্ত করে দিল। এরপর গোড়ায় পানি দিল। তারপর গাছকে খাড়া রাখার জন্য বাঁশের কঞ্চি ব্যবহার করে। কাজ শেষ করে হাত ধুয়ে উঠতেই পূর্ণার গলা ভেসে আসে,’আপা?’
পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। পূর্ণার চোখ দুটি মারবেলের মতো গোল গোল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্মজার বুঝতে পারলো,তার পরনের সাদা শাড়ি দেখে পূর্ণা অবাক হয়েছে! পূর্ণা এগিয়ে এসে রাগী স্বরে বললো,’সাদা শাড়ি পরছো কেন আপা? তুমি কি বিধবা?’
পদ্মজা বালতি হাতে নিয়ে বললো,’বিধবা হলেই মানুষ সাদা শাড়ি পরে? এমনি পরা যায় না?’
‘বিবাহিতারা সাদা শাড়ি পরতে পারে না। আবার এমন শাড়ি! অন্য কোনো রঙই নাই।’
‘বলছিলাম না,এই বাড়িতে না আসতে? আমিতো আগামীকাল সকালেই যেতাম।’
‘তুমি শাড়ি পাল্টাও।’
পদ্মজা ভ্রুকুটি করে বললো,’তুই তো ক্যাটকেটে হয়ে গেছিস। সংসার করবি কী করে?’
‘আপা তুমি এই সাদা শাড়ি এক্ষুনি পাল্টাবে।’
পূর্ণাকে বাচ্চাদের মতো জেদ করা দেখে পদ্মজা হাসলো। বললো,’কেন ভালো দেখাচ্ছে না?’
পূর্ণা চোখ ছোট ছোট করে বললো,’না,দেখাচ্ছে না। ভূতের মতো দেখাচ্ছে।’
পূর্ণার দৃঢ়কণ্ঠ! তাকে এখন যাই বলা হউক সে শুনবে না। আগামীকাল বিয়েটা হয়েই গেলে পদ্মজার শান্তি। পদ্মজা অন্দরমহলের দিকে যেতে যেতে বললো,’ঘরে আয়।’
‘আগে বলো,শাড়ি পাল্টাবা?’
পদ্মজার পূর্ণার দিকে তাকালো। পূর্ণা রাগী রাগী ভাব আনার চেষ্টা করে। পদ্মজা হাসলো। বললো,’ঘরে চল। পাল্টাব।’
পূর্ণা পদ্মজাকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আজকের দিনটা আসলেই সুন্দর! যা চাচ্ছে তাই হচ্ছে! সে উল্লাসিত। পদ্মজা বললো,’ বাড়ি ছেড়ে এলি কেন? মৃদুল এসে তোকে না দেখলে মন খারাপ করবে।’
‘করলে করুক!’
ঘরে এসে পূর্ণা জোর করে পদ্মজাকে কালো শাড়ি পরিয়ে দিল। পদ্মজাও মেনে নিল। যদি মৃদুল আজ আসে আগামীকাল আল্লাহ চাইলে পূর্ণার বিয়ে হবে। তারপর চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি। এরপর আর কোনোদিন দেখা হবে নাকি পদ্মজা জানে না! সজ্ঞানে,পরিকল্পিতভাবে সে যা করতে যাচ্ছে,তাতে আবার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই
আজ আর কালকের দিনটা শুধু পূর্ণার মতোই হউক! পূর্ণা পদ্মজাকে শাড়ি পরানো শেষে বললো,’কত সুন্দর লাগছে! আর তখন কী একটা মরা রঙের শাড়ি পরেছিলে। দেখতে খুব খারাপ লাগছিল।’
‘আসলেই দেখতে খারাপ লাগছিল?’
পূর্ণা অসহায় চোখে তাকায়। সে কী করে বলবে, তার আপাকে সবকিছুতেই ভালো দেখায়। কিন্তু সাদা রঙটা যে অশুভ ইঙ্গিত দেয়!
পূর্ণার মনের অবস্থা পদ্মজা যেন উপলব্ধি করতে পারে। সে পূর্ণাকে বিছানায় বসিয়ে বললো,’ আজ আমার বোনকে খুব বেশি সুন্দর লাগছে।’
পূর্ণা লজ্জা পেল। পদ্মজা বললো,’ কী খাবি?’
পূর্ণা আয়েশ করে বসে বললো,’
‘খাব না। খেয়ে আসছি।’
‘ভাপা পিঠা খাবি? লুতু বুবু বানিয়েছে।’
‘না আপা কিছুই খাবো না। আপা?’
পূর্ণা চাপাস্বরে ‘আপা’ ডাকলো। পদ্মজা উৎসুক হয়ে তাকালো। পূর্ণা বললো,’ বাড়ির মানুষদের কী অবস্থা?’
‘জানি না। খাওয়ার সময় শুধু দেখা হয়। তারাও কিছু বলে না আমিও না।’
পূর্ণা প্রবল উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলো,’ওদের নিয়ে কী পরিকল্পনা করেছো?’
পদ্মজা তার পরিকল্পনা চেপে গেল,’এখনো ভাবিনি। তুই তোর বিয়েতে মন দে। নামায-রোজা কিন্তু কখনো ছাড়বি না। ভদ্রভাবে থাকবি। মাথা ঢেকে রাখবি সবসময়। আর অন্যায় করবি না আর কখনো সহ্য করবি না। ঠিক আছে?’
পূর্ণা গর্ব করে বললো,’আমি গত দুইদিন এক ওয়াক্ত নামাযও ছাড়িনি। এখনো দুপুরের নামায পড়ে আসছি।’
‘এইতো,ভালো মেয়ে। ভালো বউও হবে।’
পূর্ণার চোখভর্তি কাজল। ডাগরডোগর চোখ দুটি কাজলের ছোঁয়াতে ফুটে আছে। সোজা সিঁথি করে লম্বা চুল বেণী করা। কানে সাত রঙের গোল আকৃতির দুল। গায়ের ওড়নায় পাথরের কাজ। হাতে ঝনঝন করছে কাচের চুড়ি। সত্যি খুব সুন্দর লাগছে। পদ্মজা মুগ্ধ হয়। সে পূর্ণার এক হাতের উল্টোপাশে চুমু দিয়ে বললো,’ সত্যি আজ খুব বেশি সুন্দর লাগছে! নজর না লাগুক। মাশা-আল্লাহ।’
পূর্ণা মনে মনে ভীষণ খুশি হয়। গড়গড় করে উগড়ে দেয় ভেতরের সব কথা,স্বপ্ন,আশা। তার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে,সে যেন বহু বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে। বা একটা রঙিন ফড়িং বোতল থেকে মুক্ত হয়ে আকাশে উড়ছে। পূর্ণাকে এতো খুশি দেখে পদ্মজার মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। তার কোমল হৃদয়টা পূর্ণার মনখোলা হাসি দেখে খুশিতে কেঁদে উঠে।
সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে পূর্ণা অন্দরমহল থেকে বের হয়। পদ্মজা মগাকে ডেকে বললো,পূর্ণাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে। পূর্ণা জেদ ধরে,’আমি একা যেতে পারবো আপা। সন্ধ্যা তো হয়নি।’
পূর্ণার জেদকে পদ্মজা পাত্তা দিল না। তাই পূর্ণা মগার সাথে যেতে রাজি হয়৷ পূর্ণা যাওয়ার আগে শক্ত করে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরলো। পদ্মজা পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,’সকালেই আসব।’
পূর্ণা পদ্মজার দিকে মুখ তুলে তাকায়। বললো,’তোমার সুখই আমার সুখ আপা। তুমি আমার মা,তুমিই আমার ভালোবাসা।’
পূর্ণা কেন এতো ভালোবাসে? পদ্মজার বুক ভরে যায়। সে পূর্ণার গাল ছুঁয়ে বললো,’আম্মাকে তোর মাঝে খুঁজে পাই আমি। যখন শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি আমার মাও চলে যাবে।’
পূর্ণার কান্না পায়। সে আবার পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে। দুই বোনের বুকের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। পদ্মজা বেলা দেখে তাড়া দিল,’ বাড়ি যা। সন্ধ্যা হয়ে যাবে।’
‘আরেকটু জড়িয়ে রাখি।’
পূর্ণার মায়াময় আবদার! পদ্মজা কী বলবে খুঁজে পায় না। পূর্ণাকে বুকের সাথে শুধু চেপে ধরে রাখে। আকাশপানে চেয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে,তার বোনটা যেন সুখী হয়। মৃদুলের ভালোবাসায় পূর্ণার জীবনটা যেন পূর্ণ হয়ে উঠে।
হাওলাদার বাড়ি থেকে দুই মিনিট দুরত্বে গিয়ে পূর্ণার মনে পড়ে,সে মৃদুলের কথা আমিরকে বলেনি। এমনকি বিয়ের কথাও বলেনি! পদ্মজা আমিরকে কিছু বলবে না পূর্ণা জানে। এখন যদি সেও না বলে,কাল যদি আমির তাদের বাড়িতে না যায়? পূর্ণা হাঁটা থামিয়ে মগাকে বললো,’এখন বাড়ি যাব না। আমাকে আবার ও বাড়িতে যেতে হবে।’
‘রাইত হইয়া যাইব।’
‘তুমি যাও। আমি আমির ভাইয়ার সাথে দেখা করব।’
মগা কান চুলকাতে চুলকাতে বললো,’পরে আমি তোমারে দিয়া আইতে পারতাম না। বাজারে যামু।’
‘তুমি বাজারে যাও। আমাকে ভাইয়া দিয়ে আসবে।’
‘আইচ্ছা,তাইলে আমি যাই।’
মগা বাজারের দিকে চলে যায়। পূর্ণা আবার হাওলাদার বাড়িতে আসে। হাওলাদার বাড়ির সুপারি গাছগুলো মৃদু বাতাসে দুলছে। বাতাস শীত বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পূর্ণা তার ওড়না ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল। আলগ ঘরের আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সন্ধ্যার আযানের সুর ভেসে আসে কানে। দিনের আলো বিদায় নিচ্ছে,ফিরে আসছে গাঢ় অন্ধকার। আলগ ঘরের সবকটা ঘরে পূর্ণা আমিরকে খুঁজলো। ধান রাখার ঘরে গিয়ে সে একটু ভয় পেয়েছিল বৈকি! সেই ঘরে জানালা নেই। তাই ঘরটি অন্ধকারে ডুবে ছিল। ঘরে প্রবেশ করতেই একটা কালো বিড়াল ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটিতে। পূর্ণার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। বুকে থুথু দিয়ে দ্রুত সে ঘর থেকে বের হয় আসে। প্রতিটি ঘরে আমিরকে খোঁজে। কিন্তু কোথাও আমিরকে পেল না। অন্দরমহলে গেল নাকি?
পূর্ণা যখন আলগ ঘর থেকে বের হতে যাবে তখন দেখলো, খলিল হাওলাদারের সাথে বোরকা পরা একটি মেয়ে। তারা দ্রুত হাঁটছে। মেয়েটির হাতে চাপাতি! পূর্ণার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। শিরশির করে উঠে বুকের ভেতরটা। খলিল চোরের মতো চারপাশ দেখছে আর হাঁটছে। পূর্ণা নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। খলিল মেয়েটিকে নিয়ে অন্দরমহলে না গিয়ে অন্দরমহলের পিছনে যাচ্ছে।
পূর্ণার মনে প্রশ্ন জাগে,তারা কি পাতালঘরে যাচ্ছে? সাথে মেয়েটি কে? খলিলের মতো খারাপ লোকের সাথে একটা মেয়ে জঙ্গলের দিকে কেন যাবে? মেয়েটির হাতে চাপাতি-ই বা কেন? পূর্ণার মাথায় প্রশ্নগুলো আসতেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। শিরদাঁড়া উঁচিয়ে আলগ ঘর থেকে বের হলো। একবার ভাবলো,পদ্মজাকে গিয়ে বলবে। কিন্তু তারপর ভাবলো, ততক্ষণে যদি মেয়েটি হারিয়ে যায়। মেয়েটির সম্পর্কে বোধহয় পদ্মজা জানে না। তাই তাকে বলেনি! মেয়েটি যদি পদ্মজার কোনো ক্ষতি করে বসে! কিছু করার আগে জানতে হবে মেয়েটি কে? এই বাড়ির সাথে তার কী সম্পর্ক! পূর্ণা বুকে থুথু দিয়ে খলিলের পিছু নিল। সে ঠোঁট টিপে সাবধানে এগিয়ে যায়৷ উত্তেজনায় তার হাত-পা কাঁপছে। কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। বার বার ঢোক গিলছে। ততক্ষণে আকাশ তার ঝাঁপি থেকে অন্ধকার নামিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো পৃথিবী গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। পূর্ণা যত এগুচ্ছে তত কাঁপুনি বাড়ছে৷ নিঃশ্বাস নিচ্ছে ঘনঘন। একবার ভাবলো,চলে যাবে। কিন্তু কৌতূহল তাকে জাপটে ধরে রেখেছে। তাই পিছু হটতে পারলো না। চারপাশ নির্জন,ছমছমে! খলিল মেয়েটিকে নিয়ে অন্দরমহলের পিছনে চলে যেতেই পূর্ণা দৌড়ে শেষ মাথায় আসে। অন্দরমহলের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সাবধানে জঙ্গলের দিকে উঁকি দেয়। খলিল বোরকা পরাহিত মেয়েটিকে নিয়ে জঙ্গলের মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি চারপাশে চোখ বুলিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা চাবি বের করে মেয়েটির হাতে দিলেন। তারপর চাপাস্বরে কিছু বললেন। মেয়েটিও যেন কিছু বললো! পূর্ণা রাতের জঙ্গল ভয় পায়। একটু পর গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে যাবে চারপাশ। তার ভীতু মন কিছুতেই খলিলের পিছু পিছু জঙ্গলের ভেতর যেতে সায় দিবে না! তাই পূর্ণার বোকা মস্তিষ্ক বুদ্ধি করলো,সে দূর থেকে খলিলের উপর পাথর ছুঁড়ে মারবে। পাথর কে মেরেছে সেটা দেখার জন্য খলিলের সাথে মেয়েটিও তাকাবে। আর তখনই পূর্ণা মেয়েটির মুখ দেখে নিবে আর দৌড়ে পালাবে। যে ভাবনা সে কাজ! পূর্ণা চারপাশে চোখ বুলিয়ে ছোট একটা পাথর কুড়িয়ে নিল। তারপর খলিলের উপর ছুঁড়ে মারলো। পাথরটি সোজা খলিলের ঘাড়ের উপর পড়লো। খলিল চমকে তাকালেও মেয়েটি তাকায়নি। মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চুপচাপ থাকাটা বলে দেয়,সে সাবধানী মানুষ! শত্রুর উদেশ্য বুঝার ক্ষমতা আছে! পূর্ণার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। খলিল পূর্ণার দিকে তেড়ে আসার আগে পূর্ণা ছুটে পালাতে উল্টোদিকে দৌড় দেয়। কিন্তু শেষ রক্ষে হলো না। আচমকা সেখানে রিদওয়ান উপস্থিত হয়। জাপটে ধরে পূর্ণাকে।
পূর্ণা চিৎকার দেয়ার পূর্বে রিদওয়ান মুখ চেপে ধরলো। মেয়েটি রিদওয়ানকে দেখে জঙ্গলের ভেতরে চলে যায়। খলিল রিদওয়ানের দিকে এগিয়ে আসেন।
পূর্ণা ছটফট করছে ছোটার জন্য। কিন্তু রিদওয়ানের বিশাল দেহের সাথে সে পারছে না। রিদওয়ান খলিলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো,’ ওরে নিয়ে বাড়ির সামনে দিয়ে আসতে না করছিলাম না? বাড়িতে মানুষ নাই বলে এমন অসাবধান হবেন?’
খলিল কৈফিয়তের স্বরে বললেন,’ না পাইরা আইছি।’
রিদওয়ান আগুন চোখে জঙ্গলের দিকে তাকালো। তারপর নিজের গলার মাফলার দিয়ে পূর্ণার মুখ বেঁধে দিল। আর খলিলের গলার মাফলার দিয়ে পা বাঁধলো। পূর্ণার দুই হাত পিছনে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো। তারপর জোর করে পূর্ণাকে জঙ্গলের ভেতর নিয়ে যায়।
ভয়ে পূর্ণার বুক কাঁপছে। শরীর অবশ হয়ে আসছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে ছোটার জন্য। রিদওয়ান টেনে হিঁচড়ে পূর্ণাকে পাতালঘরের সামনে নিয়ে আসে। পূর্ণা চোখ ঘুরিয়ে দানবের মতো দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় গাছ দেখে শিউরে উঠে। মুখ দিয়ে “উউউউ” ধরণের শব্দ করতে থাকে। তখন একটা গর্ত থেকে মেয়েলি স্বর ভেসে আসে,’ চাবি কাজ করতাছে না।’
কণ্ঠ স্বরটি পূর্ণার খুব বেশি পরিচিত মনে হয়! পূর্ণা উৎসুক হয়ে সেখানে তাকালো৷ খলিলের হাতের টর্চের আলোয় পাতালে যাওয়ার সিঁড়ি চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়। সেই দৃশ্য দেখে পূর্ণার পা থেকে মাথার তালু অবধি কেঁপে উঠে। সে পদ্মজার কাছে পাতালঘরের বর্ণনা শুনেছে কিন্তু এখন সরাসরি দেখছে! অনুভূতি ব্যাখ্যা করার মতো না! তার বুকের ভেতরে দামামা বেজে চলেছে! রিদওয়ান পূর্ণাকে টেনেহিঁচড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামিয়ে আনে। পাতালঘরে প্রধান দরজায় সামনে এসে দাঁড়ায়।
মেয়েটির হাত থেকে চাবি নিয়ে খলিল দরজা খোলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনিও পারলেন না। টর্চের আলো মেয়েটির পায়ের কাছে পড়ে আছে। পূর্ণা চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে মেয়েটির মুখ দেখার জন্য। মেয়েটির মুখ অন্ধকারে তলিয়ে আছে। খলিল হাত নাড়াচাড়া করাতে টর্চের আলো অস্থির হয়ে এদিকসেদিক ছুটছে। একসময় আলো মেয়েটির মুখের উপর পড়লো আবার তাৎক্ষণিক সরেও গেল। চোখের পলকের গতিতে আলো সরে গেলেও পূর্ণা দেখে ফেললো মেয়েটির মুখ!
পূর্ণার মনে হলো,আশেপাশে কোনো বজ্রপাত পড়লো মাত্র! তার চোখ দুটি বড় বড় হয়ে যায়। সে জোরে জোরে লাফাতে থাকলো। রিদওয়ান পূর্ণাকে ঠেসে ধরে। পূর্ণা গোঙাতে শুরু করে। সে মেয়েটির উদ্দেশ্যে কিছু বলছে। কিন্তু মুখ বেঁধে রাখার জন্য কথাগুলো গোঙানোর মতো মনে হচ্ছে। রিদওয়ান পূর্ণাকে বিশ্রী কয়েকটা গালি দিয়ে খলিলকে রাগী স্বরে বললো,’এখনো খোলা হয়নি?’
খলিল হাওলাদার বললেন,’চাবিডা কাম করে না।’
‘আপনি এই মা** হাত ধরেন। আমি দেখতাছি।’
খলিল পূর্ণার হাত ধরলেন। রিদওয়ান চাবি দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে। পূর্ণা মেয়েটির দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে। খলিল মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললেন,’ তোর ওড়না দে। এই ছেড়ির হাত বান্ধা লাগবো।’
মেয়েটি তার মাথার ওড়না খুলে পূর্ণার হাত বাঁধার জন্য আসতেই খলিল পূর্ণার হাত ছেড়ে দিলেন। পূর্ণা সাথে সাথে তার দুই হাতে খামচে ধরলো মেয়েটির দুই গাল। একটা গালিও দিল। কিন্তু সেই গালি স্পষ্ট উচ্চারণ হলো না। খলিক পূর্ণাকে জোরে লাথি দিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেললেন। শুকনো পাটকাঠির মতো পূর্ণা এক লাথিতে মিইয়ে গেল। শরীরের শক্তি কমে গেল। তারপর খলিল আর মেয়েটি মিলে পূর্ণার হাত শক্ত করে বাঁধলো। পূর্ণার কোমর ব্যথায় টনটন করে উঠে৷ গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
রিদওয়ান চেষ্টা করেও চাবি কাজে লাগাতে পারলো না। তীব্র রাগ নিয়ে সে বললো,’ দরজার চাবি এটা না।’
‘আমির তো এইডাই দিল।’ বললেন খলিল।
রিদওয়ানের মাথা গরম হয়ে যায়। সে ছুঁড়ে ফেলে চাবি। পা দিয়ে মেঝেতে লাথি দেয় কয়েকবার। তারপর দুই হাত তুলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কয়েকবার শ্বাস নিল। তারপর পূর্ণার সামনে বসে খলিলের উদ্দেশ্যে বললো,’ এই মেয়ের কোনো ব্যবস্থা করতে হবে আব্বা।’
খলিল বললেন,’কী করবি?’
রিদওয়ান কিছু একটা চিন্তা করলো। তারপর পূর্ণার মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে পূর্ণাকে প্রশ্ন করলো,’আব্বার পিছু নিয়েছিলে কেন? কতটুকু জানো তুমি?’
পূর্ণা সর্বপ্রথমে মেয়েটির উদ্দেশ্যে থুথু ফেললো। তারপর রাগে কিড়মিড় করে রিদওয়ানকে বললো,’ জারজের বাচ্চা থুথু দেই তোর মুখে আর তোর বাপের মুখে।’
রিদওয়ান হাসলো। দ্রুতগতিতে মেঝেতে পা ভাঁজ করে বসলো। তারপর পূর্ণার মুখর উপর ঝুঁকে তুই-তুকারি করে বললো,’ আমিরের মুখেও দিবি?’
পূর্ণা চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। রিদওয়ান হাসি হাসি মুখ রেখে খলিলের দিকে তাকালো। বললো,’কুমারী মেয়ের থুথুও মজা কী বলেন আব্বা?’
খলিলের উত্তরের আশায় না থেকে রিদওয়ান পূর্ণার মুখের একদম কাছে এসে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো। রিদওয়ান উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে পূর্ণা শরীর ঘৃণার রি রি করে উঠলো। রিদওয়ান এক হাতে ঠেসে ধরে পূর্ণার মুখ। তারপর পূর্ণার ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে পূর্ণার গায়ের গন্ধ শুঁকে। তাকে উন্মাদের মতো দেখাচ্ছে। পূর্ণার জান বেরিয়ে যাওয়ার যোগাড়! রিদওয়ানের ভারী দেহের ভরে তার শরীরের হাড্ডি বিষিয়ে উঠছে। একটুও নড়তে পারছে না। চোখ ফেটে জল পড়ছে৷ রিদওয়ান পূর্ণার জামার পিঠের চেইন খুলে পূর্ণার ঘাড়ে চুমু দিল৷ সাথে সাথে ঘৃণায় পূর্ণা চোখ বন্ধ করে ফেললো। তখন চোখের সামনে ছবির মতোন ধরা দেয় মৃদুলের মুখটা। কোথায় সে? সে কি এসেছে? সে কি অনুভব করছে,তার প্রিয়তমা এক হায়েনার শিকার হয়েছে? পূর্ণার মনটা হুহু করে কেঁদে উঠে। ভেতরে ভেতরে সে আর্তনাদ করে ডাকলো, তার দ্বিতীয় মাকে! যাকে সে আপা বলে ডাকে!
রিদওয়ান পূর্ণার মুখ ছেড়ে চট করে উঠে দাঁড়ালো। গায়ের কাপড় খুলতে খুলতে খলিলকে বললো,’ দেখবেন? নাকি যাবেন?’
‘কোনো ভেজাল হইবো না তো?’ খলিলের গলার স্বর পাংশুটে।
‘কীসের ভেজাল?’
‘আমির যদি জানে।’
‘কী বলবে ও? বউয়ের প্রতি মায়া দেখায় না হয় বুঝলাম। শালিরে দিয়ে কী দরকার ওর? আর যা নিয়ম তাই হচ্ছে আব্বা। পূর্ণা যখন সব জেনে গেছে ওর বাঁচার অধিকার নাই।’ রিদওয়ান উত্তেজিত। সে কথা শেষ করে পূর্ণার দিকে ঝুঁকলো। পূর্ণা জোরে কেঁদে উঠলো। চিৎকার করে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললো,’ ভাবি,বাঁচাও। দোহাই লাগে,কিছু করো।’
রিদওয়ান ফিক করে হেসে ফেললো। পূর্ণা আরো ঘাবড়ে যায়। সে আকুতি করে মেয়েটিকে বললো,’ভাবি,এভাবে চুপ থেকো না। আল্লাহ সইবে না।’
রিদওয়ান পূর্ণার দুই গাল টিপে ধরে জিহ্বা দিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে গাঢ় স্বরে বললো,’ তোদের মা* বললে তোদের ঘেন্না হয়। আর আসমানিরে মা* বললে ও খুশি হয়৷ সাহায্য চাওয়ারও মানুষ পাইলি না।’
খলিল ব্যাপারটা উপভোগ করছেন। তিনি হেসে আসমানিকে বললেন,’ যখন ছেড়া আছিলাম রিদুর মতো আছিলাম। যে ছেড়ি একবার আমার হাতে পড়ছে কাইন্দা বাপ ডাকছে। ডরায়া মুইত্তা দিছে।’
খলিল কথা শেষ করে হাসলেন। তার হাসির শব্দ ফ্যাচফ্যাচে! খুবই বিশ্রী। আসমানি মৃদু হেসে আবার চুপসে গেল। পাতালঘরের দরজা না খোলাতে সে চিন্তিত। আবার রিদওয়ান এতোটাই উত্তেজিত যে,দরজার সামনে ফাঁকা জায়গায় তার খেল দেখানো শুরু করেছে! দরজা খোলার নামগন্ধ নেই,চিন্তাও নেই! খলিল এক হাতে আসমানিকে জড়িয়ে ধরে একটু দূরে গিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালেন।তারপর আমুদে গলায় বললেন,’ আমার রাজকন্যের মন খারাপ কেরে?
রিদওয়ান পূর্ণার বুকের উপর থাবা দিতেই পূর্ণা আর্তনাদ করে উঠলো ,’আম্মা…আপা….’
রিদওয়ান পূর্ণার বুকের উপর বসে পূর্ণার মুখ চেপে ধরে কিড়মিড় করে চাপাস্বরে বললো,’চুপ,একদম চুপ!’
পূর্ণা স্পষ্ট টের পাচ্ছে তার পৃথিবী বিকট শব্দ তুলে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ওইতো…ওইতো মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে লাল বেনারসি। পূর্ণা চিৎকার করে মৃদুলকে ডাকলো। কিন্তু মৃদুল আসলো না। সে কেন বাঁচাতে আসছে না? কেন আসছে না? মৃদুল হঠাৎ করেই কাঁদতে থাকলো। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লো। তারপর চোখের পলকে সে উধাও হয়ে যায়!
পূর্ণার শরীর কেঁপে উঠে। যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। নিজেকে বুঝায়,তার আপা আসবে, আসবেই! পূর্ণার চোখের পর্দায় পদ্মজার আগমন ঘটে।
পদ্মজা আসছে। হ্যাঁ আসছে, হাতে রাম দা নিয়ে দৌড়ে আসছে। তার চোখের দৃষ্টিতে আগুন। শক্তিশালী বাতাস তাকে আটকানোর চেষ্টা করছে। তার চুলগুলোকে উড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।
সব কিছু ছাড়িয়ে সে ছুটে আসছে। এক কোপে সব জানোয়ারের মাথা শরীর থেকে আলাদা করে দিতে সে আসছে! কিন্তু দেরি করছে আসতে! ভীষণ দেরি করছে! পূর্ণা শব্দ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে, চোখ বুজলো। নিষ্ঠুর মাটি নীরব থেকে দেখে পূর্ণার সতীত্ব হরণ! সময়ের ব্যবধানে বেঁহুশ হয়ে যায় পূর্ণা।
বাপ-বেটা মিলে পর পর দুইবার ধর্ষণ করে। পূর্ণার গলা তৃষ্ণায় চৌচির। প্রাণ ভ্রমর যাই যাই! চোখ দুটি নিভু নিভু। রিদওয়ান দূরে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙছে। খলিল ও আসমানি মিলে পূর্ণার গলায় রশি টেনে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। হত্যার সময় পূর্ণা হাত-পা দাপিয়ে কাতরায়! আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় নিস্তব্ধ প্রগাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতে!
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ
(গল্পের প্রয়োজন অনেক নেগেটিভ দৃশ্য,শব্দ ব্যবহার করতে হলো।)
আমি পদ্মজা – ৮৮
__________
মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যেতেই গাছের পাতাগুলো নড়েচড়ে উঠে। রিদওয়ান চমকে সেদিকে তাকালো। আকাশের অর্ধবৃত্ত চাঁদটি দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোতে রিদওয়ান আবিষ্কার করলো,সে প্রচণ্ড শীতেও ঘামছে। তার পায়ের কাছে পড়ে আছে পূর্ণার লাশ। অন্ধকার, ছমছমে পরিবেশ। শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। রিদওয়ান প্যান্টের পকেট খুঁজে বিড়ি আর দিয়াশলাই বের করলো।
পূর্ণাকে হত্যার পর যখন ভাবলো অন্য মেয়েগুলোর মতো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে পূর্ণার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিবে তখন খলিল উপর থেকে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এসে চাপাস্বরে বললেন,’ কে জানি আইতাছে। মনে কয়,আমির। হুন রিদু,এইবার আমির তোর উপরে চ্যাতলে আমি কিছু করতে পারতাম না। ভাইজানেও করব না। ভাইজানে আমারে আগেই কইছে।’
খলিল হাওলাদার অন্দরমহলে যাচ্ছিলেন। পাতাল ছেড়ে একটু সামনে এগোতেই চোখে পড়ে কে যেন টর্চ নিয়ে এদিকে আসছে। তিনি আন্দাজ করেছেন, অজ্ঞাত লোকটি আমির। তারপরই দৌড়ে আসেন। খলিলের মুখে আমির নামটা শুনতেই রিদওয়ান বুকের ভেতর ভয় জেঁকে বসে।
রিদওয়ান আমিরকে ভয় পেতে চায় না। তবুও ভয় তাকে ছাড়ে না। ভয় পাওয়ার কিছু কারণও রয়েছে। প্রথমত, পারিজার হত্যার ব্যাপারে আমির সব জানে। রিদওয়ান টের পায় আমিরের মনে এই হত্যা নিয়ে ক্ষোভ রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, এই পাপের জগতের জন্য পদ্মজার সাথে তার বিচ্ছেদ হয়েছে। সে এখন বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ছে। জ্বলন্ত কয়লা হয়ে আছে। এখন যদি শুনে,পূর্ণাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে
জ্বলন্ত কয়লা নিজ শক্তিকে আগুন তৈরি করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
রিদওয়ান পূর্ণাকে ধর্ষণের আগে যদিও বলেছিল, আমির শালীর জন্য কিছুই করবে না। কিন্তু রিদওয়ান এখন বুঝতে পারছে, সে তখন উত্তেজিত হয়ে ভুল কথা বলেছে। শালীর জন্য কিছু না করুক, শালীর মৃত্যু আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ নিশ্চয়ই করবে! পূর্ণা পদ্মজার জীবন! আর পদ্মজা আমিরের প্রাণভোমরা! সংযোগ তো আছেই। কিছুতেই ঝুঁকি নেয়া যাবে না। আবার খলিল হাওলাদার বলছেন,এবার আর ছেলের পক্ষ নিবেন না! রিদওয়ান এতো চেষ্টা করেও খলিল-মজিদকে নিজের বশে আনতে পারেনি। সব মিলিয়ে বিপদের আশঙ্কা শতভাগ! রিদওয়ান ভাবলো, আপাতত আমিরকে রাগানো ঠিক হবে না৷ আমিরকে হত্যা করার ব্যাপারে মজিদ,খলিল দুজনকে রিদওয়ান বাগে আনতে পেরেছে। একটা মৃত লাশের জন্য পরিকল্পনা নষ্ট করা উচিত হবে না। আর দুটো দিন সহ্য করতেই হবে আমিরকে।
রিদওয়ান খলিল ও আসমানিকে নিঃশ্বাসের গতিতে বললো,’ তোমরা এখানে থাকো। দড়িটা ওই চিপায় লুকিয়ে রাখো। আমি যে এখানে ছিলাম আমির যেন জানতে না পারে।’
রিদওয়ান পূর্ণার লাশ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তারপর দ্রুত ঘন ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। ঝোপঝাড়ে কেউ থাকলে সেটাও টের পেয়ে যায় আমির। এই ক্ষমতা সে কোথায় পেয়েছে,রিদওয়ানের জানা নেই। তবে আমিরের কাছে শুনেছে,আমির লুকিয়ে থাকা মানুষটির নিঃশ্বাস ও তাকিয়ে থাকাটা অনুভব করতে পারে! তাই রিদওয়ান চোখ বুজে,নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
আমির পাতালে ঢুকলো। খলিল সিঁড়ির দিকে টর্চ ধরলেন। মুখে টর্চের তীব্র আলো পড়তেই আমির কপাল কুঁচকে দুই হাত সামনে বাড়িয়ে আলোর গতিবেগ রোধ করে মুখে অস্ফুট বিরক্তিসূচক শব্দ করল।
খলিল হেসে আমুদে কণ্ঠে বললেন,’ বাবু আইছস নাকি!’
আমির চোখ ছোট ছোট করে ধমকের স্বরে বললো,’আরে এভাবে মুখের উপর টর্চ ধরে রাখছেন কেন?’
খলিল টর্চের আলো দ্রুত অন্যদিকে সরিয়ে নিলেন। আমির তার হাতের চাবি খলিলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,’এইযে চাবি।’
খলিল চাবি হাতে নিয়ে বললেন,’ কুন সময় থাইকা খাড়ায়া আছি। চাবি লইয়া আইয়া ভালা করছো আব্বা।’
‘আনতে গেলেন না কেন?আমি অন্দরমহলেই ছিলাম।’
‘এইতো অহন যাইতে চাইছিলাম।’
আমির টর্চ আসমানির মুখের উপর ধরে বললো,’ তোর এই সময় এখানে কী?’
আসমানি তার বোরকা খুলতে খুলতে বললো,’ রিদওয়ানে ডাকছে।’
‘রিদওয়ান কোথায়?’
‘জানি না। আমারে আইতে কইয়া নিজের আওয়ার নাম নাই। না আইলেও সমস্যা নাই। তুমি আইছো চলবো।’ আসমানি লম্বা করে হাসলো। খলিল বা আসমানি কারো চোখেমুখে একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। আমির আসমানির নোংরা অঙ্গভঙ্গি দেখে হাসলো। আসমানির সামনে সে যতবার আসে ততবার আসমানি বিভিন্নভাবে তাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। গত চার বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে,কিন্তু ফল এখনো পায়নি। আমির আসমানির খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। চাপাস্বরে বললো, ‘খোদার কসম,তোর মতো বে** দুটো দেখিনি।’
আমিরের অপমানজনক কথা আসমানি গায়ে লাগা তো দূরের কথা, কানেই ঢোকায়নি। খলিল দরজা খুললেন৷ তিনজন একসাথে ভেতরে প্রবেশ করলো। দরজা লাগানোর সময় আমির তার টর্চের আলোতে মেঝেতে একটা নুপুর দেখতে পেলো। সে ভ্রুকুটি করে এগিয়ে আসে। হাতে নুপুরটি তুলে নেয়। আসমানি পিছন থেকে বললো,’ আমার নুপুর।’
এই মুহূর্তে রিদওয়ান ঝোপঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে, লাশটার কী করা যায়? পাতালে তো এখন ঢোকা যাবে না। সেখানে আমির আছে। অন্দরমহল থেকে রাম দা আর বস্তা নিয়ে আসতে অন্দরমহলে যাওয়া যায়। তারপর জঙ্গলের পিছনের ভাঙা দেয়াল টপকে ঘাটে চলে গেলেই নিশ্চিত। ঘাটে তাদের ট্রলার আছে। একবার ট্রলারে উঠতে পারলে পূর্ণার লাশ আর কেউ পাবে না। রিদওয়ান হাতের বিড়ি ফেলে পূর্ণার লাশ রেখে দ্রুত অন্দরমহলে যায়। পূর্ণার ফ্যাকাসে মুখের উপর একটা জোনাকিপোকা বসে। জোনাকিপোকার জ্বলে জ্বলে আবার নিভে যাওয়া আলোয় পূর্ণার মুখটা আরো ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে! বুক মোচড় দিয়ে উঠার মতো। পূর্ণার দুই হাত নিস্তেজ হয়ে ঘাসে পড়ে আছে। সারা জনমের জন্য সে ঘুমিয়ে পড়েছে। এই পৃথিবীর বুকে তার একুশ বছরেরই জীবন ছিল। কী হতো যদি আরো কয়টা দিন সে বাঁচতে পারতো?
রিদওয়ান ভীষণ উত্তেজিত। শত-শত খুন করার পর এই প্রথম কোনো মৃত দেহ নিয়ে সে বিপাকে পড়েছে। অন্দরমহলের সামনে এসে দেখে,পদ্মজা দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজার সাথে কথা বলছে প্রান্ত! প্রান্ত কি পূর্ণার খোঁজে এসেছে? রিদওয়ান এক হাতে নিজের ঘাড় ম্যাসাজ করলো। অন্দরমহল থেকে বস্তা বা রাম দা আনা এখন বিপদজনক। পদ্মজা বুদ্ধিমতী, তার রিদওয়ানকে সন্দেহ করার সম্ভাবনা শতভাগ। সন্দেহ না এই মেয়ে নিশ্চিত হয়ে যাবে৷ লতিফাকে দেখা যাচ্ছে না, তাহলে ওকে দিয়ে সাহায্য নেয়া যেত। এখন কী করবে সে? রিদওয়ানের মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। পরক্ষণেই মন বলে উঠলো, সামান্য নারীকে সে কেন ভয় পাবে? তারপর আবার ভাবলো, না এখন আমির বা পদ্মজার মুখোমুখি হওয়া যাবে না,এতে বহু কাঙ্ক্ষিত সাজানো পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। রিদওয়ান উল্টো ঘুরে জঙ্গলে ছুটে আসে। পূর্ণার লাশের পাশে এসে দাঁড়ায়। আরেকটা বিড়ির জন্য পকেটে হাত দেয়। বিড়ি নেই৷ সে পায়চারি করতে করতে ভাবতে থাকলো। কী করা যায়? হুট করে তার মাথা কাজ করে। ট্রলারে করে পূর্ণার লাশ নিয়ে দূরে চলে যাবে। পথে কোনো না কোনো ব্যবস্থা হবে৷ ভাবতে দেরি হলেও কাজে দেরি করলো না। সে পূর্ণার লাশ কাঁধে তুলে নিল। জঙ্গল পেরিয়ে ভাঙা ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাঙা অংশ কম। পূর্ণার লাশ নিয়ে একসাথে বের হওয়া সম্ভব নয়৷ আগে রিদওয়ানকে বের হতে হবে তারপর পূর্ণার লাশ টেনে বের করতে হবে। রিদওয়ান পূর্ণার লাশ রেখে নিজে আগে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হলো। বাইরের দৃশ্য দেখে সঙ্গে – সঙ্গে সে চমকে গেল! বাইরে চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। একজন ইয়াকুব আলী। যিনি গত চার বছর ধরে মজিদ হাওলাদারের মাতব্বর পদের প্রতিদ্বন্ধী। সাথে উনার বিএ পাশ ছেলে ইউসুফ আর রয়েছে চামচা দুজন। তারা এই রাতের বেলা গাঢ় অন্ধকারে এখানে কী করছে? একইদিনে এতো বিপদ! রিদওয়ান তার ঠোঁট ভেজাল। নিজেদের গোলকধাঁধায় আটকে রাখা এলাকা যেন এখন নিজেদের জন্যই গোলকধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে!
কয়দিন আগে ইয়াকুব আলীর এক লোক এখানে এসেছিল। তারপর আমিরের হাতে খুন হলো। আর এখন ইয়াকুব আলী নিজে তার ছেলেকে নিয়ে এসেছেন! কী চাচ্ছে এরা? কিছু কি সন্দেহ করেছে?
যদি নারী পাচার সম্পর্কিত কিছু জেনে থাকে! ভাবতেই রিদওয়ানের হৃৎপিণ্ড ছ্যাঁৎ করে উঠলো। কেউ যেন তার হৃৎপিণ্ডে গরম খুন্তি ছুঁইয়ে দিয়েছে। রিদওয়ান নিজেকে আড়াল করে নেয়। ইয়াকুব আলী চলে যান। রয়ে যায় বাকি তিনজন। তারা চারপাশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দেখছে। এই খবর দ্রুত মজিদ এবং খলিলকে দিতে হবে। রিদওয়ান দ্রুত সরে আসে। পূর্ণার লাশ দেখে সে থমকে দাঁড়ায়। এক মুহূর্তের জন্য সে পূর্ণার কথা ভুলে গিয়েছিল। আগে এই লাশের ব্যবস্থা করতে হবে। এই মুহূর্তে সে একা হয়ে পড়েছে। মজিদ হাওলাদার বাড়িতে নেই। খলিল হাওলাদার আমিরের সাথে পাতালে রয়েছেন। দলের কেউও আপাতত কাছে নেই! সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থা! রিদওয়ান পূর্ণার লাশ আবার কাঁধে তুলে নিল৷ একটা মৃত,নিস্তেজ দেহ নিয়ে টানাহেঁচড়া করে দম বেরিয়ে যাচ্ছে। মাথার রগ দপদপ করছে। এতদিনের অভিজ্ঞতা আজ রিদওয়ানের কোনো কাজেই লাগছে না৷ কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না৷ আচ্ছা,আমির তার জায়গায় থাকলে কী করতো? কিছুতো করতোই৷ রিদওয়ান নিজের উপর বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো,’আব্বা,কাকা ঠিকই বলে। আমিরের মাথার এক ফোঁটা বুদ্ধি আমার মাথায় নাই।’
অনেক ভাবাভাবির পর রিদওয়ান পূর্ণার লাশ একটি গাছের পাশে রাখলো। তারপর শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালো৷ বার কয়েক নিঃশ্বাস নিল এবং ছাড়লো। এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে অন্দরমহলে গেল। সদর ঘরে পদ্মজা বসে আছে। পদ্মজার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রিদওয়ান অবাক হওয়ার ভান ধরে প্রশ্ন করলো,’ এই রাতের বেলা সবাই এমন তব্ধা লেগে বসে আছে কেন?’
পদ্মজা রিদওয়ানের দিকে ঘুরেও তাকালো না। প্রান্ত বললো,’মেজো আপাকে খুঁজে পাচ্ছি ন।’
রিদওয়ান এক গ্লাস পানি খেয়ে হেসে বললো,’ এই মেয়ে বাঁদরের মতো। দেখো,কার বাড়িতে আছে।’
‘আপার আজ কোথাও যাওয়ার কথা না।’
‘যেতেও পারে।’
কথা শেষ করে রিদওয়ান নিজ ঘরে চলে গেল। ঘরে এসেই সে অস্থির হয়ে উঠে। দ্রুত তোষকের নিচ থেকে বড় একটা বস্তা নিয়ে, ছোট করে ভাঁজ করে। তারপর ভাঁজকরা বস্তা শার্টের ভেতর বগলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রাম দা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু রাম দা লুকানোর মতো জায়গা তার শরীরে নেই! সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে সাবধানে আবার জঙ্গলে আসে। পূর্ণার লাশ বস্তার ভেতর ভরে কাঁধে তুলে নেয়। অন্দরমহলের চারপাশ সুপারি গাছে আচ্ছাদিত। সুপারি গাছ আর রাতের অন্ধকারকে কাজে লাগিয়ে রিদওয়ান গেইটের কাছে খুব সহজেই চলে আসে।
গেইটের দারোয়ান মুত্তালিব ঝিমুচ্ছেন। মুত্তালিব মজিদের বিশ্বস্ত দারোয়ান। সে এই বাড়ি সম্পর্কিত সবকিছু জানে। কিন্তু কখনো খুন হতে দেখেনি বা খুন হওয়া লাশও দেখেনি। এমন দায়িত্ব সে কখনো পায়নি। এই বাড়ির গোপনীয়তা গোপন রাখাই তার কাজ। রিদওয়ান বাধ্য হয়ে মুত্তালিবকে নতুন দায়িত্ব দেয়ার জন্য ডাকলো,’ মুত্তালিব কাকা?’
মুত্তালিব পিটপিট করে তাকালেন। রিদওয়ানের মুখটা স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসতেই তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন। রিদওয়ান ইশারায় শান্ত হতে বললো। মুত্তালিব উৎসুক হয়ে তাকালেন। রিদওয়ান তার কাঁধের বস্তা মুত্তালিবের পায়ের কাছে রাখে। মুত্তালিব প্রশ্ন করলেন,’বস্তার ভিতরে কিতা?’
রিদওয়ান শান্তস্বরে জানালো,’ লাশ।’
রিদওয়ান শান্তস্বরে বললেও মুত্তালিবের জন্য এই শব্দটি ভয়ানক ছিল। তিনি চমকে উঠলেন। রিদওয়ান চারপাশ দেখে বললো,’ আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। বিনিময়ে বেতনের চেয়ে তিনগুন পাবেন।’
মুত্তালিবের বেতন সাধারণ বেতনের চেয়ে এমনিতেই তিনগুণ। তার উপর আরো তিনগুণ মানে রাজপ্রাসাদ জেতার মতো! লোভনীয় প্রস্তাব! মুত্তালিবের চোখ দুটি চকচক করে উঠে। অর্থের লোভে মনের ভয় চাপা পড়ে। তিনি অভিজ্ঞ স্বরে সাহস নিয়ে বললেন,’ তুমি খালি কও,বাকি কাম আমার।’
রিদওয়ান আরেকটু এগিয়ে আসে ফিসফিসিয়ে বললো,’ ভ্যানগাড়িটা নিয়ে আসেন। ছন নিবেন বেশি৷ তারপর এই বস্তাটা আজমপুরের হাওড়ে ফেলে আসবেন।’
মুত্তালিব মনে মনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। ভয়টা আবার জেগে উঠে। কিন্তু অর্থের জন্য তিনি জোর করে ভয়কে চাপা দেয়ার চেষ্টা করলেন।এতগুলো টাকা জলে ভাসিয়ে দেয়া যায় না! তার চেয়ে একটা দেহ জলে ভাসিয়ে দেয়াই উত্তম! তিনি ভ্যানগাড়ি নিয়ে আসেন। ভ্যানগাড়িটি হাওলাদার বাড়ির। সাথে অনেক ছনও নিলেন। দুজনের তাড়াহুড়ো করে ছনের ভেতর বস্তা রাখলো। রিদওয়ান বললো,’সাবধানে কাজ করবেন। এমন জায়গায় ফেলবেন যাতে কেউ লাশ খুঁজে না পায়।’
মুত্তালিব চারপাশ দেখে ঢোক গিললেন। তার চোরাচাহনি! তিনি আতঙ্কিত। কিন্তু তা রিদওয়ানের সামনে প্রকাশ করতে নারাজ। তিনি রিদওয়ানকে আশ্বস্ত করলেন,’কোনো ভুল হইবো না। কাম সাইরাই আমি আইতাছি।’
‘সকালেই আপনি আপনার টাকা পেয়ে যাবেন। ‘ বললো রিদওয়ান।
মুত্তালিব হাসি বিনিময় করলেন। তারপর মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে অন্ধকার পথে বেরিয়ে পড়েন।
মুত্তালিবের পা বার বার ফসকে যাচ্ছে। তিনি ভয় পাচ্ছেন। যদি কেউ টের পেয়ে যায় তখন কী হবে? তিনি ঘামছেন,হাতও কাঁপছে। পথে এক দুজন লোকের সাক্ষাৎ পেয়ে তিনি নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি জানেন না,কার লাশ নিয়ে তিনি পথ পাড়ি দিচ্ছেন৷ বার বার মনে হচ্ছে, বস্তার ভেতর থেকে লাশটি বেরিয়ে এসে তার গলা চেপে ধরবে। রক্ত চুষে খাবে! চিরচেনা পথঘাটকে তার পরিত্যাক্ত মনে হচ্ছে। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দে নিজেই উৎকর্ণ হয়ে উঠছেন বার বার। আটপাড়া ছেড়ে নোয়াপাড়ায় আসেন। রাস্তার দুই ধারে গাছ-গাছালি। তারপর যতদূর চোখ যার বিস্তীর্ণ ক্ষেত। তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। ভয়ে বুকে চাপ অনুভব করছেন। আজমপুর যেতে পথে থানা পড়ে। থানার সামনে দিয়ে তিনি কী করে যাবেন? যদি কেউ বুঝে যায়! এই চিন্তায় রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ভয়ে রক্ত হিম হয়ে গেছে। তিনি ক্লান্ত হয়ে গাড়ি থামালেন। মিনিট ছয়েক পথের ধারে বসে বিড়ি ফুঁকলেন। ভয় কিছুতেই কাটছে না। বুকের ভেতর একটা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। টাকার লোভে এতোবড় ঝুঁকি নেয়া ঠিক হয়নি। তিনি ভাবলেন, ও বাড়িতে তো এই কাজ করার অনেক মানুষ আছে। তাকেই কেন এই কাজ দেয়া হলো? এই লাশের সাথে কি কোনো বড় বিপদ জড়িত? মুত্তালিবের লাশের মুখ দেখার কৌতূহল জাগলো। তিনি চারদিক দেখে বস্তার মুখ খুললেন। বেরিয়ে আসে চেনা শ্যামবর্ণের মুখখানা। গলায় গাঢ় দাগ! চোখেমুখে আঁচড়। মুত্তালিব ভয়ে কান্না করে দিলেন। এই মেয়েটাকে তিনি সন্ধ্যাবেলায় দেখেছেন জলজ্যান্ত! এখন মৃত! তিনি বুকে হাত দিয়ে বসে পড়েন। বাতাস ও পাতার ঘর্ষণে সৃষ্ট শব্দে তিনি চমকে উঠেন। প্রস্রাবের বেগ বেড়ে যায়। চোখের পলকে লুঙ্গি ভিজে যায়। তিনি নিজের কাজে নিজে লজ্জিত হোন। লজ্জা,ভয় সব মিলিয়ে মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেছে। আজমপুর যেতে আরো দুই ঘন্টা লাগবে। এতক্ষণ তিনি এই লাশ নিয়ে কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারবেন না। মুত্তালিব দ্রুত বস্তার মুখ বেঁধে ফেলেন। আরেকটু এগিয়ে নোয়াপাড়ার শেষ মাথায় পৌঁছালেন। সেখানে ক্ষেতের পাশে ঘন ঝোঁপঝাড় রয়েছে। এখানে সহজে কারোর আসার কথা নয়। ঝোঁপঝাড়ের ভেতর ছন বিছিয়ে সেখানে বস্তাটি রাখলেন। তারপর বস্তার উপর আরো ছন দিয়ে দ্রুত জায়গা ছাড়লেন।
________
সকাল নয়টা বাজে। পূর্ণার হদিস মিলেনি। পূর্ণা লাপাত্তা,এই খবর পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রেমা ঘরে বসে কান্নাকাটি করছে। মৃদুলও আসেনি। বাসন্তী ও প্রান্ত এদিকওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। তাদের সাথে আরো কয়েকজন রয়েছে৷ সবাই মিলে পূর্ণাকে খুঁজছে। পদ্মজার নানাবাড়ির মানুষজন বলতে, পদ্মজার নানু আর প্রতিবন্ধী হিমেল বেঁচে আছে। তারা দুজনই অনেকদিন ধরে পদ্মজার খালার বাড়ি ঢাকাতে আছে। গ্রামে কাছের আত্মীয় বলতে আর কেউ নেই। হাওলাদার বাড়িতে তো পূর্ণা নেই। পদ্মজা মগার কাছে যখন শুনলো,পূর্ণা আমিরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তাৎক্ষণিক পদ্মজা আমিরকে খোঁজে। সে পাতালঘরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু চাবি না থাকার কারণে যেতে পারেনি। চিন্তায় তার মাথা ব্যথা উঠে গেছে। মজিদ গ্রামের বাইরে ছিলেন। তিনি ভোররাতে ফিরেন। রিদওয়ান ঘরে বেঘোরে ঘুমিয়েছে। দুজনের মধ্যে কারো বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ নেই। তবে পদ্মজা সন্দেহের তালিকায় দুজনকেই রেখেছে৷ বাকি রইলো খলিল আর আমির হাওলাদার। তারা দুজন রাত থেকে চোখের বাইরে আছে। দুজনের সাথে মুখোমুখি হতে হবে। পদ্মজার ধারণা,পূর্ণা বন্দী হয়েছে। তাকে ভয় দেখানোর জন্য এরা পূর্ণাকে বন্দি করেছে। পদ্মজা সরাসরি মজিদ এবং রিদওয়ানকে সকালে প্রশ্ন করেছে। দুজনই উত্তর দিয়েছে,তারা জানে না। আমিরের সাথে সাক্ষাৎ হলেই,নিশ্চিত হওয়া যাবে।
বেলা সাড়ে নয়টায় আমিরের দেখা মিলে। তার পরনে ঢিলা সাদা রঙের পায়জামা আর ফতুয়া। অনেক পুরনো কাপড়! হাঁটার তালে ফতুয়া দুলছে। সে সোজা আলগঘরে আসে। মগার হাতে একটা নীল খাম আরেকটা ছোট কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললো,’ এই কাগজে আলমগীর ভাইয়ার ঠিকানা আছে। ঠিকানায় এই খাম পৌঁছে দিবি।’
মগা বাধ্যর মতো মাথা নাড়ালো। যে ঠিকানা লেখা আছে সে ঠিকানায় পৌঁছাতে মগার ষোল ঘন্টা লাগবে। আমির চারপাশ দেখে বললো,’মরে গেলেও এই খাম অন্য কারো হাতে দিবি না। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে রওনা হবি।’
‘আইচ্ছা।’
আমির ঘুরে দাঁড়ায় চলে যেতে। মগা ডাকলো,’ ভাই?’
আমির তাকালো। মগা বললো,’পূর্ণায় রাইতে তোমার লগে দেখা করতে আইছিল না?’
আমির চোখ ছোট ছোট করে ফেললো। বললো,’ না তো। কেন?’
মগা উসখুস করে বললো,’পূর্ণারে খুঁইজা পাইতাছে না কাইল থাইকা।’
আমির সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সে মগাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখন সেখানে উপস্থিত হয় পদ্মজা। পদ্মজা আমিরের উদ্দেশ্যে বললো,’ আমাকে নিজের দাসী বানাতে আমার বোনকে পথ করেছেন আপনি? পূর্ণা কোথায়?’
পদ্মজার কণ্ঠে তেজের আঁচ পাওয়া যায়। সে রাগান্বিত। আমির আশ্চর্য হয়ে গেল। সে পাল্টা প্রশ্ন করলো,’ আমি কী করে জানবো? পূর্ণা তোমার কাছে গিয়েছিল না?’
মগা বললো,’ ভাই,পূর্ণারে নিয়া বাড়িত যাইতাছিলাম। তখন পূর্ণায় পথে থাইমা কইলো তোমার লগে দেখা করবো। পরে নাকি তুমি হেরে বাড়িত দিয়া আইবা।’
আমির একবার পদ্মজাকে দেখলো তারপর মগার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,’ তারপর এই বাড়িতে আসছিল?’
‘আইছিল মনে কয়।’
‘তুই কোথায় ছিলি?’
মগা মাথা নত করে বললো,’ বাজারে।’
আমির চিন্তায় পড়ে যায়। সে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে বললো,’ আমার সাথে তো পূর্ণার দেখা হয়নি। মগা,তুই পূর্ণাকে নিজ চোখে দেখেছিস এই বাড়িতে ঢুকতে?’
মগা না সূচক মাথা নাড়াল। আমির দ্রুত গেইটের দারোয়ান মুত্তালিবের কাছে যায়। মুত্তালিব পদ্মজাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়ায়। আমির মুত্তালিবকে প্রশ্ন করলো,’ পূর্ণা গতকাল বেরিয়ে যাওয়ার পর আবার বাড়িতে আসছিল?’
মুত্তালিব কোনো রকম দ্বিধা ছাড়া মিথ্যা বললেন,’ না আহে নাই তো।’
পদ্মজা থমকায়। এতক্ষণ ভেবেছিল,পূর্ণা বোধহয় আমিরের হাতে বন্দি আছে। কিন্তু পূর্ণা নাকি আসেইনি! আমির বাইরে বেরিয়ে যায়। পদ্মজা মিনিটের পর মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। পূর্ণার পরিয়ে দেয়া কালো শাড়িটা এখনো তার গায়ে জড়িয়ে আছে। লতিফা ও রিনু পদ্মজার পিছনে এসে দাঁড়ায়। তখন গেইটের ভেতর এসে প্রবেশ করে বিপর্যস্ত প্রান্ত। সে সঙ্গে নিয়ে এসেছে পদ্মজার জন্য মৃত্যুর সংবাদ।
হেমলতার হাতে বানানো শীতল পাটির উপর শুয়ে আছে পূর্ণা। পা থেকে গলা অবধি চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা। পদ্মজা মোড়ল বাড়িতে পা রাখতেই সবাই তার দিকে তাকালো৷ মানুষের ভীড় জমেছে। নোয়াপাড়ার গরীব ঘরের এক ছোট মেয়ে প্রতিদিন ভোরে রান্নার জন্য শুকনো পাতা কুড়ায়। বস্তা ভরে শুকনো পাতা নিয়ে বাড়ি ফেরে৷ সঙ্গে থাকে তার ছোট ভাই। দুজন মিলে নিত্যদিনের মতো আজও পাতা কুড়াতে বের হয়েছিল। ঝোপঝাড়ে ছনের স্তূপ দেখে তারা খুব অবাক হয়। রান্নার কাজে ছন খুব ভালো কাজ করে। তারা ছন সংগ্রহ করতে গিয়ে একটা ভারী বস্তা আবিষ্কার করে। বস্তার মুখ খুলে দুজনই ভয় পেয়ে যায়। দৌড়ে পালিয়ে যায়। এই ঘটনা গ্রামে ছড়িয়ে দেয়। গ্রামের কয়েকজন পূর্ণাকে চিহ্নিত করে। তারপর নিয়ে আসে আটপাড়ায়। পূর্ণার লাশ মোড়ল বাড়িতে নিয়ে আসতে আসতে পুরো গ্রাম পূর্ণার মৃত্যুর খবর জেনে যায়।
মোড়ল বাড়িতে কত রকম মানুষ উপস্থিত হয়েছে। তাও পদ্মজার কাছে চারপাশ জনমানবহীন লাগছে৷ তার চোখ শুষ্ক। প্রেমা বুক ফাটিয়ে কাঁদছে। কাঁদছে বাসন্তী ও প্রান্ত। তারা পারলে জোর করে পূর্ণাকে জাগিয়ে তুলে। পদ্মজা ধীরপায়ে পূর্ণার মাথার কাছে এসে বসলো। পূর্ণার আঁচড় কাটা মুখটা জুড়ে গুচ্ছ,গুচ্ছ মায়া। পদ্মজা এক হাতে ছুঁয়ে দেয় পূর্ণার মুখ। তারপর মৃদুস্বরে ডাকলো,’ পূর্ণা? পূর্ণারে….
পূর্ণা সাড়া দেয় না। সে এখন মৃত একটি লাশ মাত্র। যে কিছুক্ষণের মধ্যে মাটির নিচে চিরজীবনের জন্য চলে যাবে। পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখলো। তাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে। পদ্মজা চারিদিকে তাকিয়েও কোনো মানুষ দেখতে পেল না! অথচ তার চারপাশে মানুষজনের মেলা বসেছে! পদ্মজা পূর্ণার এক হাত মুঠোর নিয়ে চুমু দিল। পূর্ণার আঙুলে চুল প্যাঁচানো। পদ্মজা সময় নিয়ে চুল থেকে পূর্ণার আঙুল মুক্ত করলো। অনেক লম্বা একটা চুল! মেয়ে মানুষের চুল। পূর্ণা মৃত্যুর পূর্বে কোনো মেয়ের চুল টেনে ধরেছিল তা স্পষ্ট! পদ্মজা পূর্ণার কপালে চুমু দিল। তারপর আবার আদুরে স্বরে ডাকলো,’ পূর্ণা?বোন আমার। তোর আপা ডাকছে…তোর পদ্মজা আপা।’
পূর্ণা আর সাড়া দিবে না…কোনোদিন দিবে না! তার দুরন্তপনা জীবনের জন্য থেমে গেছে। পদ্মজা বিশ্বাস করতে পারছে না! সে অস্থির হয়ে উঠে। একটু দূরে সরে বসে। তার নিঃশ্বাস এলোমেলো এবং ভারী। বুকের ভেতর তোলপাড় বয়ে যাচ্ছে৷ তার মস্তিষ্কের স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। সে হামাগুড়ি দিয়ে আরেকটু দূরে সরে যায়। মাথায় হাত দিয়ে বসে। তারপর আরেকটু দূরে সরে যায়! এভাবে যেতে যেতে অনেক দূরে চলে যায়। মানুষ তাকে হা করে দেখছে। কিছুক্ষণ দূরে বসে থেকে চট করে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুতপায়ে পূর্ণার কাছে আসে। পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চারপাশ দেখলো। কী অদ্ভুত! সে এখনো কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। শুধু বাসন্তী, প্রেমা ও প্রান্তকে দেখছে। আর দেখছে ঘুমন্ত পূর্ণাকে। পদ্মজা পূর্ণার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,’ আমার সুন্দর চাঁদ,আজ তোর বিয়ে। মৃদুল…মৃদুল ভাই কোথায়? সে কি আসেনি?’
পদ্মজা চারপাশে চোখ বুলিয়ে মৃদুলকে খুঁজলো। যখন সে মৃদুলকে খুঁজতে লাগলো তখন তার চোখে পড়লো,অনেক অনেক মানুষ এসেছে। এতো মানুষ কখন এলো? মৃদুল কোথায়? পদ্মজা মৃদুলকে খুঁজতে উঠে দাঁড়ায়। মানুষের ভীড়ে ঢুকে সে মৃদুলকে খুঁজতে থাকে। আমির দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুক ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সে এলোমেলো হয়ে যাওয়া পদ্মজাকে দেখছে। পদ্মজা বুকের ভেতর যে সহ্য ক্ষমতা পুষে রেখেছিল, আজ সেটা ধ্বংস হয়ে গেছে৷ এই মুহূর্তে পদ্মজা নিজের মধ্যে নেই৷ একটুও কাঁদছে না। আমিরের ইচ্ছে হচ্ছে,পদ্মজাকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে। যেন সে হাউমাউ করে কাঁদতে পারে। কিন্তু সেই ইচ্ছে প্রকাশের দুঃসাহস আমিরের নেই। সে এগিয়ে এসে পূর্ণার মুখের দিকে তাকালো। পূর্ণা খুন হয়েছে শুনে,আমির রিদওয়ান,খলিল আর মজিদকে সন্দেহ করেছিল। কিন্তু আমিরের জানামতে, এরা এতো বড় ভুল করবে না। তারা কখনো ঝোপঝাড়ে লাশ ফেলবে না। তারা নদীতে ভাসিয়ে দেয়,যাতে প্রমাণ মুছে যায়। কিন্তু পূর্ণার শরীরে এখন অগণিত প্রমাণ পাওয়া যাবে। একজন কুখ্যাত অপরাধী হিসেবে আমির নিশ্চিত, এমন বোকামি একমাত্র প্রথম খুন করা কেউই করবে। অথবা যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে লাশ গুম করার,সে বোকা! অলন্দপুরে তারা ছাড়া আর কে হতে পারে? বাসন্তীর হাতের নাড়াচাড়ায় পূর্ণার পায়ের চাদর সরে যায়। তার এক পায়ের নুপুর দেখে আমিরের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে! সঙ্গে সঙ্গে সে রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো। তার চোখের রং পাল্টে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। এবার সে নিশ্চিত এই কাজ কারা করেছে! আমির দ্রুতপায়ে সবার অগোচরে মোড়ল বাড়ি ছাড়লো। তার গন্তব্য আজিদের বাড়ি।
মৃদুল! সে আজ বেজায় খুশি। ট্রলার নিয়ে এসেছে বউ নিতে। সাথে এসেছে মা-বাবাসহ আত্মীয়স্বজন। গতকাল তার আসার কথা ছিল। কিন্তু আসতে পারেনি। জুলেখা প্রথম রাজি হোননি। যখন দেখলেন মৃদুল সত্যি তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখন তিনি হার মানলেন। বললেন,তিনি এই বিয়েতে রাজি। তিনি ছেলের বিয়েতে থাকতে চান। আর কাছের কয়েজনকে নিয়ে তারপর বউ আনতে যেতে চান। আত্মীয়দের নিয়ে তৈরি হতে হতে রাত হয়ে যায়। তারপর নিজেদের ট্রলার নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বিয়ের উদ্দেশ্যে। জুলেখা এখনো গাল ফুলিয়ে বসে আছেন। তিনি মন থেকে এই বিয়েতে রাজি নন। মৃদুলের তাতে যায় আসে না,তার মা-বাবা বিয়েতে থাকছে এটাই অনেক। আটপাড়ার খালে এসে ট্রলার থামে। খাল থেকে পূর্ণাদের বাড়ি যেতে মিনিট পাঁচেক লাগে। উত্তেজনায় মৃদুলের বুক কাঁপছে। তার ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। যেকোনো কথায় সে হাসছে। ট্রলার থেকে নামার সময় একটা কালো ব্যাগ হাতে তুলে নেয়। মৃদুলকে ব্যাগ নিতে দেখে তার এক ভাই বললো,’ আরে ব্যাঠা, ব্যাগ আমার কাছে দে। তুই জামাই মানুষ।’
মৃদুল দিতে রাজি হলো না। এই ব্যাগে থাকা প্রতিটি জিনিস লাল। সে নিজে পূর্ণার জন্য পছন্দ করে কিনেছে। ব্যাগের সবকিছু দিয়ে আজ পূর্ণা সাজবে। সে নিজের হাতে এই ব্যাগ পূর্ণার হাতে দিতে চায়। মৃদুল নাছোড়বান্দা। তার ভাই তার সাথে তর্ক করে পারলো না। মৃদুল খুশির জোয়ারে ভাসছে। সে সবার আগে আগে হেঁটে যায়। মিনিট দুয়েক হাঁটার পর মোড়ল বাড়ির সামনে সে ভীড় দেখতে পেল। মৃদুল অবাক হলো। গ্রামবাসীকে দাওয়াত দেয়া হলো নাকি? নিজে নিজে উত্তর খুঁজে নিল। দাওয়াতই হবে। পূর্ণা কতো পাগল! মৃদুল হাসলো। কিন্তু সেই হাসি মিলিয়ে গেল বাড়ির কাছাকাছি এসে। বাড়ি থেকে কান্নার স্বর ভেসে আসছে। জুলেখা বললেন,’ বাড়ির ভিতরে কান্দাকাটি হইতাছে না?’
মৃদুল চুপসে গেল। মনে মনে প্রশ্ন করলো, পদ্মজা ভাবির সাথে আবার কিছু হলো নাকি? সে দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে। মানুষজনকে ঠেলেঠুলে পূর্ণার লাশের সামনে এসে দাঁড়ায়। পূর্ণার লাশ দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। খুশিতে মাথা নষ্ট হয়ে গেল নাকি? চোখ কীসব দেখছে! মৃদুল আবার চোখ খুললো। পূর্ণাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখলো। পূর্ণার পায়ে এখনো আলতা লেগে আছে। কাদামাখা লাল টুকটুকে দুটো পা। এই পায়ে হেঁটে দৌড়ে তার কাছে আসার কথা ছিল না? অথচ কেমন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে পূর্ণা! মৃদুল তার হাতের ব্যাগটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। পূর্ণার মাথার কাছে চলে আসে। পূর্ণার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে ছলছল চোখে সবার দিকে তাকায়। বাসন্তী মৃদুলকে দেখে আরো জোরে কাঁদতে থাকলেন। ঘটনাটা বুঝতে মৃদুলের অনেক সময় লাগে। সে পূর্ণার গালে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে পূর্ণাকে ডাকলো। ভালোবাসার মানুষের সাথে সংসার করার আশায় পবিত্র মিলনের আকাঙ্ক্ষায় সে ছুটে এসেছে। কিন্তু সে মানুষটি নাকি মৃত! মৃদুল অবাক চোখে তার মা-বাবার দিকে তাকায়। কেমন স্বপ্ন লাগছে সব! পুলিশ এসে ভীড় কমিয়ে দেয়। লাশের আশপাশ থেকে সবাইকে সরে যেতে বলে। মৃদুল বোকা বোকা চোখে পুলিশদের দিকে তাকায়। একজন পুলিশ তার বাহু ধরে সরে যেতে বললে,মৃদুল পূর্ণাকে অনুরোধ করে বললো,’ পূর্ণা,এই পূর্ণা। উঠো। আমার শেষ কথাটা রাখো। উঠো তুমি। আমি তোমারে নিয়া যাইতে আইছি।’
মৃদুল দ্রুত ব্যাগের চেইন খুললো। তার হাত কাঁপছে। এসব কী হলো? কেন হলো? পৃথিবীটা এরকম করে ভেঙে যাচ্ছে কেন? বুকের ভেতর কীসের এতো শব্দ? সে ব্যাগ থেকে লাল টুকটুকে বেনারসি বের করলো। তারপর সেই বেনারসি পূর্ণার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে পূর্ণাকে বললো,’আমরা যে ঘরে সংসার পাতাম সেই ঘর আমি সাজায়া আইছি পূর্ণা। সুন্দর কইরা সাজায়া আইছি।’
পুলিশ তাড়া দিচ্ছে। কেউ ছোঁয়ার আগে লাশ তারা নিয়ে যাবে পরীক্ষার জন্য৷ খুন হওয়া লাশ ছোঁয়ার অনুমতি নেই। কিন্তু মৃদুল জাপটে ধরে রেখেছে পূর্ণাকে। পদ্মজা দূরে বসে আছে। হাঁটুতে থুতুনি ঠেকিয়ে মৃদুলকে দেখছে। তার ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। যেন সত্যি মৃদুল বিয়ে করতে এসেছে! আর বিয়ে হচ্ছে। মানুষগুলো একবার পদ্মজাকে দেখছে আরেকবার মৃদুলকে! মৃদুলের বাবা মৃদুলকে বলে পূর্ণাকে ছেড়ে দিতে। মৃদুল আরো শক্ত করে ধরে। সে বিড়বিড় করছে। পূর্ণাকে কানে কানে কিছু বলছে।যখন দুজন লোক মৃদুলকে টেনে তুলতে নিল,মৃদুল চিৎকার করে কেঁদে উঠলো,’ পূর্ণা…আমার পূর্ণা। তুমি উঠো না কেন? আম্মা…আম্মা তুমি কই? আম্মা চুড়ি বাইর করো,আলতা বাইর করো আরো কি কি আছে না? সব বাইর করো আম্মা। পূর্ণারে সাজাইবা সবাই। আমি বিয়া করব আম্মা। আম্মা…আম্মা পূর্ণারে উঠতে কও। আম্মা ওরে কারা মারছে? আম্মা.. ‘
মৃদুলের পাগলামি দেখে ভড়কে যান জুলেখা। এতোবড় ছেলে কেমন হাউমাউ করে কাঁদছে! তিনি দৌড়ে মৃদুলের পাশে আসেন। মৃদুল জুলেখার দিকে তাকিয়ে বললো,’ আম্মা মরা মানুষরে বিয়া করা যায় না? আমারে বিয়া দেও আম্মা। তারপর একলগে কবর দেও। আমি ওরে ছাড়া কেমনে থাকুম আম্মা?’
মৃদুল পূর্ণাকে বেনারসি দিয়ে পেঁচিয়ে ফেলে। তাকে মানুষজন খামচে ধরেও আটকাতে পারছে না। সে পূর্ণাকে শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে। তার দুই হাত টেনে ছোটাতে চেষ্টা করে সবাই। কিন্তু পারছে না। মৃদুল কিছুতেই পূর্ণাকে ছাড়বে না। আকাশের মালিক যেন নিজ দায়িত্বে মৃদুলের উপর শক্তির ভান্ডারের সব শক্তি ঢেলে দিয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে,লাশ পঁচে যাবে। তদন্তও ঠিকঠাক হবে না। একজন পুলিশ হাতের লাঠি দিয়ে মৃদুলের পিঠে আঘাত করলো। মৃদুল তাও তার কাজে অটল থাকে। সে হাউমাউ করে কাঁদছে। পূর্ণাকে চিৎকার করে ডাকছে। বুক ফেটে যাচ্ছে তার। সে পূর্ণার মাথায় চুমু দিয়ে পূর্ণাকে বললো,’ কবুল,কবুল,কবুল। আমি কবুল কইছি পূর্ণা। তুমি কও। সবাই হুনছে আমি কইছি। সবাই হুনছেন না? এহন তুমি কও। পূর্ণা…আমারে এতো বড় শাস্তি দিও না পূর্ণা৷ আমারেও সাথে নিয়া যাও।’
মৃদুল মানুষজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,’ আমারেও সবাই কবর দেন। পূর্ণার লগে কবর দেন। দিবেন আপনেরা? আমি কবুল কইছি না? অর্ধেক বিয়াতো হইয়া গেছে। হইছে না?’
মৃদুল কাঁদতে কাঁদতে হাসলো। জুলেখা কান্না শুরু করেছেন। মৃদুলের এমন পাগলামি তিনি সহ্য করতে পারছেন না। ছেলেটা পাগল হয়ে গেল নাকি? তার কলিজার টুকরা এমন করে কাঁদছে কেন! কীসের অভাব তার! নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তিনি মৃদুলকে সুখী দেখতে চান। তিনি মনে মনে চাইছেন,অলৌকিক কিছু হউক,মেয়েটা জেগে উঠুক। মৃদুল হাসুক! মৃদুলের পিঠ ছিঁড়ে যাচ্ছে আঘাতে-আঘাতে। তারা সবাই উন্মাদ এক প্রেমিককে আঘাত করছে যেন পূর্ণাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু মৃদুল তো ছাড়বে না। সে কিছুতেই ছাড়বে না। মৃদুল পূর্ণার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো ‘এই কালি? কালি কইছি তো। গুসা করো…গুসা করো আমার সাথে। গালি দেও আমারে। ও পূর্ণা…ও ভ্রমর। চাইয়া দেহো একবার। আসমানের পরী তুমি…সবচেয়ে সুন্দর মুখ তোমার। হাসো পূর্ণা। হাসো।’
বেশ অনেকক্ষণ ধ্বস্তাধস্তির পর মৃদুলের থেকে পূর্ণাকে সরানো যায়। মৃদুল বন্দী পাখির মতো ছটফট করছে। সে পায়ে মাটি খুঁড়ছে। সবাইকে অনুরোধ করছে তাকে ছেড়ে দিতে। চিৎকার করার কারণে মৃদুলের গলার রগ ফুলে লাল হয়ে গেছে। মানুষের টানাহেঁচড়ায় তার পরনের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গেছে। নিজের অজান্তে এক শ্যামকন্যার প্রেমে উন্মাদ হয়ে ত্যাগ করে সে সর্বসুখ! ত্যাগ করে সকল প্রকার চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন-আশা! এমনও হয়?
চলবে….
®ইলমা বেহরোজ