Monday, October 6, 2025







আমি পদ্মজা পর্ব-৪৮+৪৯

আমি পদ্মজা – ৪৮
____________________
ঘটনাটি পদ্মজার চোখে পড়তেই ছুটে আসে। রানি আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব। সে পূর্ণাকে তুলতে দৌড়ে আসতে গিয়ে শাড়ির সাথে পা প্যাঁচ লাগিয়ে পূর্ণার চেয়ে ঠিক এক হাত দূরে ধপাস করে পড়ল! এ যেন ধপাস করে পড়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যুবকটি হাসবে নাকি সাহায্য করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সেকেন্ড দুয়েক ভেবে মনস্থির করল, হাসা ঠিক হবে না। সাহায্য করা উচিত। কলপাড় থেকে এক পা নামাতেই পদ্মজা চলে আসে। পূর্ণাকে তোলার চেষ্টা করে। যুবকটি রানিকে সাহায্য করে উঠার জন্য। পদ্মজা উদ্বিগ্ন হয়ে পূর্ণাকে প্রশ্ন করল,’খুব ব্যথা পেয়েছিস?’
পূর্ণার মুখ ঢেকে আছে রেশমি ঘন চুলে। আড়চোখে একবার যুবকটিকে দেখল। এরপর মিনমিনিয়ে বলল,’না।’
ফরিনা ছুটে এসে বললেন,’এইডা কেমনে হইলো। এই ছেড়ি এমনে আইলো কেন? ও ছেড়ি কোনহানে দুঃখ পাইছো?’
পূর্ণা নরম কন্ঠে বলল,’চাচি,ব্যাথা পাইনি।’
‘পাওনি মানে কী? সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছো না। পদ্মজা,ওকে নিয়ে যাও। কাদা মেখে কী অবস্থা!’ বলল আমির।
রানি পদ্মজা আর আমিরকে দেখে প্রচন্ড অবাক হয়েছে! খুশিতে তার কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমিরের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল,’দাভাই? তুমি আইছো! পদ্মজা, এতোদিনে আমরারে মনে পড়ছে?’
পদ্মজা মৃদু হেসে বলল,’তোমাকে সবসময়ই মনে পড়ে আপা। আমরা পরে অনেক গল্প করব। পূর্ণাকে নিয়ে এখন ভেতরে যাই।’

পদ্মজা এবং ফরিনা পূর্ণাকে ধরে ধরে অন্দরমহলে নিয়ে গেল। পিছু পিছু রানিও গেল। যুবকটি আমিরের সামনে এসে দাঁড়াল। হেসে বলল,’আসসালামু আলাইকুম আমির ভাই। চিনতে পারতাছেন?’
আমির যুবকটিকে চেনার চেষ্টা করল। এরপর বলল,’মৃদুল না?’
‘জি ভাই।’
আমিরের হাসি প্রশস্ত হলো। মৃদুলের সাথে করমর্দন করে বলল,’সেই ছোটবেলায় দেখেছি। কতবড় হয়ে গেছিস। চেনাই যাচ্ছে না।’
‘আমার ঠিকই আপনারে মনে আছে।’
আমির মৃদুলের বাহুতে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে বলল,’ছোটবেলা তো তুমি করে বলতি। এখন আপনি আপনি বলছিস কেন?’
মৃদুল এক হাতে ঘাড় ম্যাসাজ করে হাসল। এরপর বলল,’১৬-১৭ বছর পর দেখা হইছে তো।’
‘তো কী হয়েছে? তুমি বলে সম্বোধন করবি। গোসল করছিলি নাকি?’
‘জি।’
‘কাপড় পাল্টে আয়,অনেক আলাপ হবে।’
‘আচ্ছা ভাই।’

আমির নারিকেল গাছের পাশে তাদের ব্যাগ দেখতে পেল। এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা নিল,এরপর অন্দরমহলের দিকে গেল।

বৈঠকখানায় পদ্মজা বসে আছে। পূর্ণার কোমরে,পায়ে গরম সরিষা তেল মালিশ করে দিয়ে বিশ্রাম নিতে বলেছে। হুমকিও দিয়ে এসেছে,ঘর থেকে বের হলে একটা মারও মাটিতে পড়বে না। পূর্ণা মুখ দেখে মনে হয়েছে,আর বের হওয়ার সাহস করবে না। বেশ জোরেই পড়েছিল। পা,কোমর লাল হয়ে গেছে। এই বাড়িটা মৃতপ্রায়। আগে তাও মানুষ আছে বলে মনে হতো। এখন মনেই হয় না এই বাড়িতে কেউ থাকে। নির্জীব, স্তব্ধ। রান্নাঘর থেকে বেশ কিছুক্ষণ পর পর টুংটাং শব্দ আসছে। ফরিনা এবং আমিনা তাড়াহুড়ো করে রান্না করছেন। আমির বের হয়েছে। বাড়িতে মাত্রই এলো আর কীসের কাজে বেরিয়েও পড়ল। স্তব্ধতা ভেঙে একটা ছোট বাচ্চা দৌড়ে আসে পদ্মজার কাছে। বাচ্চাটার কোমরে, গলায় তাবিজ। তাবিজের সাথে ঝনঝন শব্দ তোলা জাতীয় কিছু গলায় ঝুলানো। পদ্মজা বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিল। রানি বৈঠকখানায় এসে বাচ্চাটিকে বলল,’আলো আম্মা,এদিকে আয়। তোর গায়ে ময়লা। পদ্ম মামির কাপড়ে লাগব।’
পদ্মজা আলোর গাল টেনে বলল,’কিছু হবে না। থাকুক।’
এরপর আলোর গালে চুমু দিল। আলোর দুই বছর। রানির মেয়ে হয়েছে শুনেছিল পদ্মজা। কিন্তু আসতে পারেনি দেখতে। এবারই প্রথম দেখা। পদ্মজা বলল,’আলো ভাগ্যবতী হবে। দেখতে বাপের মতো হয়েছে।’

বাপের মতো হয়েছে কথাটি শুনে রানির মুখ কালো হয়ে যায়। তার প্রথম বাচ্চা মারা যাওয়ার এক বছরের মাথায় সমাজের নিন্দা থেকে বাঁচাতে খলিল হাওলাদার রানির জন্য পাত্র খুঁজতে থাকলেন। কিন্তু কেউই রানিকে বিয়ে করতে চায় না। সবাই জেনে গিয়েছিল,রানি অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়েছে। এরপর বাচ্চাটা মারাও গেল। কোনো পরিবার রানিকে ঘরের বউ করতে চাইছিল না। এদিকে বিয়ে দিতে না পেরে সমাজের তোপে আরো বেশি করে পড়তে হচ্ছিল। খলিল হাওলাদার পিতা হয়ে রানিকে ফাঁস লাগিয়ে মারতে চেয়েছিলেন। তখন মজিদ হাওলাদার মদনকে ধরে আনলেন। মদন,মগার বাবা মা নেই। দুই ভাই এই বাড়িতেই ছোট থেকে আছে। এই বাড়ির সেবার কাজে নিযুক্ত। বাধ্য হয়ে মদনের সাথে বাড়ির মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়। মদন কামলা থেকে ঘর জামাই হয়। রানি মন থেকে মদনকে আজও মানতে পারেনি। কখনোও পারবেও না। ঘৃণা হয় তার। মাঝে মাঝে আলোকেও তার সহ্য হয় না। আলোর মুখটা দেখলেই মনে হয়, এই মেয়ে মদনের মেয়ে। কামলার মেয়ে!
আলো আধোআধো স্বরে বলল,’নান্না,নান্না।’
পদ্মজা আদুরে কণ্ঠে বলল,’নানুর কাছে যাবে?’
আলো পদ্মজার কোল থেকে নামতে চাইল। পদ্মজা নামিয়ে দিল। আলো দৌড়ে রান্নাঘরে যায়। রানি বলল,’আম্মার জন্য পাগল এই ছেড়ি। সারাবেলা আম্মার লগে লেপ্টায়া থাকে।’
‘তুমি নাকি আলোকে মারধোর করো?’
রানি চমকাল। প্রশ্ন করল,’কেলা কইছে?’
‘শুনেছি। আলো একটা নিষ্পাপ পবিত্র ফুল। ওর কী দোষ?’
রানি চুপ করে রইল। পদ্মজা বলল,’সব রাগ এইটুকু বাচ্চার উপর ঝাড়া ঠিক না আপা।’
‘আমার কষ্টডা বুঝবা না পদ্মজা।’
‘বুঝি। এতোটা অবুঝ না আমি। আলো মদন ভাইয়ার মেয়ে এটা ঠিক। কিন্তু তোমারও তো মেয়ে। তোমার গর্ভে ছিল। তোমার রক্ত খেয়েছে দশ মাস।’
‘আমি কী আমার ছেড়িরে ভালোবাসি না? বাসি। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়। জানো পদ্মজা,আবদুল ভাইয়ের কথা মনে হইলে আমার সব অসহ্য লাগে। একলা একলা কাঁনদি। তহন আলো কানলে…আমি ওরে এক দুইডা থাপ্পড় মারি। পরে আফসোস হয় কেন মানলাম ছেড়িডারে। ও তো আমারই অংশ।’
‘নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করো। নিয়তির উপর কারো হাত নেই। অতীত ভুলতে বলব না। কিছু অতীত ভুলা যায় না। কিন্তু চাইলেই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে বাঁচা যায়। নিজেকে মানিয়ে নাও। আলোর প্রতি যত্নশীল হও। মানুষের মতো মানুষ করো। একটা মেয়েকে নিয়ে সমাজে বাঁচা যুদ্ধের মতো। গোড়া থেকে খেয়াল দাও।’
‘তোমার কথা হুনলে বাঁচার শক্তি পাই পদ্মজা।’

পদ্মজা হাসল। বৈঠকখানায় আমির এসে প্রবেশ করল। তার পিছু পিছু মৃদুল। মৃদুলকে দেখে রানি হাসল। পদ্মজাকে দেখিয়ে বলল,’এইযে এইডা হইছে,পদ্মজা। তোর ভাবি।’
মৃদুল পদ্মজাকে সালাম করার জন্য ঝুঁকতেই পদ্মজা বলল,’না,না। কোনো দরকার নেই। বসুন আপনি।’
মৃদুল বসল। এরপর পদ্মজাকে বলল,’আপনের কথা কথা অনেক শুনছি। আজ দেখার সৌভাগ্য হলো।’
আমির পদ্মজাকে বলল,’ওর নাম মৃদুল। রানির মামাতো ভাই। ছোটবেলা আমাদের বাড়িতে কয়দিন পর পর আসতো। যখন আট-নয় বছর তখন দূরে চলে যায়। আর দেখা হয়নি। চাইলেই দেখা হতো। কেউ চায়নি। তাই দেখাও হয়নি।’
‘কোথায় থাকেন?’ জানতে চাইল পদ্মজা।
‘জি ভাবি,রামপুরা।’
রামপুরার কথা পদ্মজা শুনেছে। তাদের জেলার শহর এলাকার নাম রামপুরা। সবাই চিনে এই এলাকা। ছেলেটার চেহারা উজ্জ্বল, চকচকে। হাসিখুশি! আলাপে আলাপে জানতে পারল,মৃদুল পদ্মজার চেয়ে দুই বছরের বড়। মেট্রিক ফেইল করার পর আর পড়েনি। মিয়া বংশের ছেলে। কথাবার্তায় শুদ্ধ-অশুদ্ধ দুই রূপই আছে। আর ভীষণ রসিক মানুষও বটে!

খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর পদ্মজা দোতলায় গেল। সাথে আমির রয়েছে। নূরজাহান বেশ কয়েক মাস ধরে অসুস্থ। শরীরের জায়গায় জায়গায় ঘা। চামড়া থেকে দূর্গন্ধ বের হয়। সারাক্ষণ যন্ত্রনায় আর্তনাদ করেন। নূরজাহানের ঘরে ঢুকতেই নাকে দূর্গন্ধ লাগে। পদ্মজা নাকে রুমাল চেপে ধরে। নূরজাহান বিছানার উপর শুয়ে আছেন। সময়ের ব্যবধানে একেবারে নেতিয়ে গিয়েছেন। বয়সটা যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। হাড্ডি ভেসে আছে। লজ্জাস্থান ছাড়া পুরো শরীর উন্মুক্ত। এক পাশে লতিফা দাঁড়িয়ে আছে। নূরজাহানের মাথার কাছে একজন কবিরাজ বসে রয়েছেন। একটা কৌটা থেকে সবুজ দেখতে তরল কিছু নূরজাহানের ক্ষত স্থানগুলোতে লাগাচ্ছেন। পদ্মজা নূরজাহানের বাম পাশে গিয়ে দাঁড়াল। নাক থেকে রুমাল সরিয়ে দূর্গন্ধের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। ডাকল,’দাদু? দাদু…শুনছেন।’

নুরজাহান ধীরে ধীরে চোখ খুলেন। পদ্মজা প্রশ্ন করল,’খুব কষ্ট হয়? কোথায় কোথায় বেশি যন্ত্রণা হয়?’
নূরজাহান শুধু তাকিয়ে রইলেন। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পদ্মজার বুকটা হাহাকার করে উঠল। বয়স্ক একজন বৃদ্ধা কত কষ্ট করছে! লতিফা বলল,’দাদু কথা কইতে পারে না। খালি কান্দে।’
নূরজাহানের অসহায় চাহনি দেখে পদ্মজার চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। সে নূরজাহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’আল্লাহর নাম স্বরণ করেন। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য্য ধরুন।’
তারপর লতিফাকে বলল,’ভালো করে খেয়াল রেখো উনার।’
আমির বেশ অনেকক্ষণ নূরজাহানের সাথে কথা বলল। নূরজাহান জবাব দেন না,শুধু উ,আ শব্দ করেন। আমিরের দুই চোখ বেয়ে জল পড়ে। পদ্মজার ভালো লাগে না দেখতে। সে আমিরকে বুঝিয়ে,শুনিয়ে বাইরে নিয়ে আসে। বারান্দা পেরোনোর পথে রুম্পার ঘরের দরজা খোলা দেখল পদ্মজা। যাওয়ার সময় তো বন্ধই ছিল। পদ্মজা ঘরের ভেতর উঁকি দেয়। দেখল,কেউ নেই। পালঙ্কও নেই। সে আমিরকে প্রশ্ন করল,’রুম্পা ভাবি কোথায়?’
আমিরও এসে উঁকি দিল। খালি ঘর। সে অবাক স্বরে বলল,’জানি না তো।’
পদ্মজা চিন্তায় পড়ে গেল। হেমলতা মারা যাওয়ার পর গ্রামে আর থাকেনি। শহরে ফিরে যায়। এক মাসের মাথায় জানতে পারল, সে গর্ভবতী। গর্ভাবস্থার প্রথম পাঁচ মাস খুব খারাপ যায়। প্রতি রাতে হেমলতাকে স্বপ্নে দেখতো। ছয় মাসের শুরুতে ফরিনা নিয়ে আসেন গ্রামে। এ সময় পদ্মজার একজন মানুষ দরকার। কাছের মানুষদের দরকার। তাই আমিরও নিষেধ করেনি। তার মধ্যে আবার মারা গেলেন মোর্শেদ। পদ্মজা আরো ভেঙে পড়ে। কাছের মানুষদের সহযোগিতায়, বাচ্চার কথা ভেবে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে। সফলও হয়। তখন পদ্মজা অনেকবার চেষ্টা করেছে রুম্পার সাথে দেখা করার। মদন আর,নূরজাহানের নজরের বাইরে গিয়ে কিছুতেই সম্ভব হয়নি। এরপর কোল আলো করে এলো ফুটফুটে কন্যা। পদ্মজা তারপরও চেষ্টা চালিয়ে গেল। রুম্পাকে নজরবন্দি করে রাখাটা খটকা বাড়িয়ে দেয়।

একদিন সুযোগ আসে। সেদিন রাতে নূরজাহান, মদন, আমির,রিদওয়ান,আলমগীর সবাই যাত্রাপালা দেখতে যায়। বাড়িতে বাকিরা থাকে। দুই তলায় শুধু পদ্মজা তার মেয়ে পারিজা আর ফরিনা ছিল। ফরিনার দায়িত্বে পারিজাকে রেখে রুম্পার ঘরে যায় পদ্মজা। রুম্পা তখন প্রস্রাব,পায়খানার উপর অচেতন হয়ে পড়েছিল। পদ্মজা নাকে আঁচল চেপে ধরে সব পরিষ্কার করে। রুম্পার জ্ঞান ফেরায়। জানতে পারে তিন দিন ধরে রুম্পাকে খাবার দেয়া হচ্ছে না। পদ্মজা খাবার নিয়ে আসে। রুম্পাকে খাইয়ে দেয়। কথা বলার সুযোগ হওয়ার আগেই ফরিনার চিৎকার ভেসে আসে। ফরিনার কাছে পারিজা আছে! পদ্মজার বুক ধক করে উঠে। ছুটে বেরিয়ে আসে। ঘরে এসে দেখে ফরিনা নেই। ফরিনার আর্তনাদ ভেসে আসছে কানে। পদ্মজা সেই আর্তনাদের সাথে দুমড়ে,মুচড়ে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে উল্টিয়ে পড়ে। তবুও ছুটে যায়। ফরিনার কান্নার চিৎকার অনুসরণ করে অন্দরমহলের বাইরে বেরিয়ে আসে। চাঁদের আলোয় ভেসে উঠে তার তিন মাসের কন্যার রক্তাক্ত দেহ। ফুটফুটে কন্যা! ছোট ছোট হাত,পাগুলো নিথর হয়ে পড়ে আছে। সময় থেমে যায়। মনে হয়, নিশুতি রাতের প্রেতাত্মারা একসঙ্গে, একই স্বরে চিৎকার করে কাঁদছে। পদ্মজার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায়। কোন পাষাণ মানবসন্তান তিন মাসের বাচ্চার গলায় ছুরি চালিয়েছে? তার কী হৃদয় নেই? পদ্মজা মেয়ের নাম ধরে ডেকে চিৎকার দিয়ে সেখানেই লুটিয়ে পড়ে।
পুলিশ আসে,তদন্ত হয়। ফরিনা দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায়। তিনি হাত বাড়িয়ে দেখেন,পারিজা নেই। দ্রুত উঠে বসেন। পদ্মজা নিয়ে গেল নাকি খুঁজতে থাকেন। বারান্দা থেকে বাইরে চোখ পড়তেই দেখলেন,একজন মোটা, কালো লম্বা চুলের লোক দৌড়ে পালাচ্ছে। খালি জায়গায় কাঁথায় মোড়ানো কিছু একটা পড়ে আছে। ফরিনা ছুটে বাইরে আসেন। নাতনির রক্তাক্ত দেহ দেখে চিৎকার শুরু করেন। পুলিশ কোনো কিনারা খুঁজে পায়নি। এরপরের দিনগুলো বিষাক্ত হয়ে উঠে। পদ্মজা মাঝরাতে চিৎকার করে কেঁদে উঠত। খাওয়া-দাওয়া একদমই করতো না। মাঝরাতে মেয়ের কবরে ছুটে যেত। আমির পদ্মজাকে নিয়ে হাওলাদার বাড়ি থেকে দূরে সরে আসে। প্রায় এক বছর পদ্মজা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। এরপর বুকে ব্যথা নিয়েই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,একদিন ফিরবে অলন্দপুর। সেই নিষ্ঠুর খুনিকে শাস্তি দিবেই। জানতে চাইবে,কীসের দোষে তার তিন মাসের কন্যা বলি হলো?

কেউ জানুক আর নাই বা জানুক,পদ্মজা জানে হাওলাদার বাড়িতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য,পারিজার খুনিকে বের করা। সে শতভাগ নিশ্চিত এই বাড়ির কেউ না কেউ জড়িত এই খুনের সাথে। শুধু বের করার পালা। পুরনো কথা মনে পড়ে পদ্মজা দুই চোখ বেয়ে জল গড়াতে থাকল। আমির জল মুছে দিল। এরপর বলল,’বোধহয় তিন তলায় রাখা হয়েছে।’

পদ্মজা তিন তলার সিঁড়ির দিকে তাকাল। শুনেছে,তিন তলার কাজ নাকি সম্পূর্ণ হয়েছে। অনেকগুলো ঘর হয়েছে। সে আর কথা বাড়াল না। এখন গোসল করা উচিত। আযান পড়বে। আজ রাত থেকেই সে নিশাচর হবে। এক মুহূর্ত নষ্ট না করে,সব রহস্যের জাল কাটতে হবে। এটাই তার নিজের সাথে নিজের প্রতিজ্ঞা। আমির ডাকল,’কী হলো? কী ভাবো?’
পদ্মজা আমিরের দিকে একবার তাকাল। এরপর চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,’কিছু না। ঘরে চলুন।’
‘কিছু তো ভাবছিলে।’
‘এতদিনের জন্য আসছি গ্রামে। চাকরিটা থাকবে তো?’
‘থাকবে না কেন? রফিক কতোটা সম্মান করে আমাকে দেখোনি? আর তোমার যোগ্যতার কী কমতি আছে? যেখানে ইচ্ছে সেখানেই চাকরি হবে।’
পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। আমিরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,’আপনি যেখানে ইচ্ছে সেখানে চাকরি করতে দিবেন?’
আমির হেসে ফেলল। বলল,’তা অবশ্য দেব না।’

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

আমি পদ্মজা – ৪৯
__________________
পড়ন্ত বিকেলের শীতল বাতাসে শরীর কাঁটা দিচ্ছে। পদ্মজা শাল গায়ে জড়িয়ে নেয়। নিচতলায় এসে ফরিনার ঘরে যায়। ফরিনা কাঁথা সেলাই করছিলেন। পদ্মজাকে দেখে দুই পা ভাঁজ করে বসলেন। বললেন,’তুমি আইছো!’
পদ্মজা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,’জি আম্মা। কাঁথা সেলাই করছিলেন নাকি। আমি সাহায্য করি?’
‘না,না তুমি এইসব পারবা না। সুঁই লাগব হাতে।’
‘কিছু হবে না আম্মা। প্রতিদিনই সেলাই করা হয়।’
ফরিনা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,’তুমি কাঁথা সিলাও?’
পদ্মজা হেসে বলল,’ওই একটু।’
‘কেরে? আমরা থাকতে তুমি সিলাও কেরে? তোমার সৎ আম্মায় তো নকশিকাঁথা সিলায়। হে থাকতে তোমার সিলাই করা লাগে কেরে?’
পদ্মজা ফরিনার হাত থেকে সুঁই টেনে নিয়ে বলল,’আব্বা মারা যাওয়ার পর দুই বছর আমি কেমন অবস্থা ছিলাম জানেনই তো। সে অবস্থায় আমার পক্ষে আমার পরিবারের জন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না। তখন উনি(বাসন্তী) পর হয়েও,সৎ মা হয়েও নিজের ঘাড়ে সব দায়িত্ব তুলে নিলেন। কিন্তু উনি যতটুকু করতেন ততটুকুতে পরিবার চলতে গিয়ে হিমশিম খেতো। তাই আমিও চেষ্টা করেছি একটু যদি নকশিকাঁথার পরিমাণটা বাড়ানো যায়।’ পদ্মজার ফুলের পাপড়ির মতো ফোলা ফোলা দুটি ঠোঁটে অল্প হাসি। সেই হাসিতে পরমা সুন্দরীর মুখমন্ডল অল্প আভায় আলোকিত। ফরিনা অবাক হয়ে সেই হাসি দেখেন। মন দিয়ে কাঁথায় ফুল তুলছে পদ্মজা। দাঁত দিয়ে সুতা কেটে ফরিনার দিকে তাকাল সে। পদ্মজার নিখুঁত চোখ-নাক। ফরিনা তাকিয়েই আছেন। পদ্মজা ডাকল,’আম্মা?’
ফরিনার সম্বিৎ ফিরল। তিনি প্রশ্ন করলেন,’তুমি নাকি শহরে কাম করো?’
পদ্মজা হাসল। বলল,’হুম,করা হয়। প্রেমা,প্রান্ত দুইজনই পড়াশোনা করে। পড়ালেখার কত খরচ! আর পূর্ণা তো পড়ালেখার চেয়ে বেশি খরচ করে ফেলে শাড়ি-অলংকার কিনতে গিয়ে। আম্মা নেই। বাধা দিতে কষ্ট হয়। আর উনি নিজের সব সঞ্চয় উজার করে দেন আমার তিন ভাই বোনকে। টাকা তো থাকে না। তাই চাকরি নিতে হলো। দুই বোনের বিয়ে দিতে হবে না? আমার তো ফরজ কাজ বাকি। তার জন্য টাকা জমাতে হচ্ছে। আর,উনার নকশিকাঁথার টাকার সাথে বেতনের কিছুটা অংশ মিলিয়ে পাঠিয়ে দেই। বেশ ভালোই চলছে। উনি আছেন বলেই আমার মাথার উপরের চাপটা কমেছে।’
‘হ,বাসন্তী অনেক ভালা।আমি হের চেয়ে চার বছরের বড়। মেলা সম্মান করে আমারে। আচ্ছা,আমির তোমারে বাইরে কাম করতে দিছে?’
এ প্রশ্নে পদ্মজা কপাল চাপড়ে বলল,’আর বলবেন না আম্মা! কী যে যুদ্ধ করতে হয়েছে। শেষমেশ রাজি হয়েছেন। কিন্তু উনার অফিসে নাকি চাকরি করতে হবে। উনার অফিসে চাকরি নিলে উনি আমাকে কোনো কাজ করতে দিতেন? টাকা ঠিকই মাস শেষে দিতেন। ঘুরেফিরে, স্বামীর টাকায় বাপের বাড়ি খায় কথাটা আত্মসম্মানের সাথে লেগে যেত। এ নিয়ে তিনদিন আমাদের ঝগড়া ছিল। আলাদা থেকেছি,কেউ কারো সাথে কথা বলিনি।’
ফরিনা বেশ আগ্রহ পাচ্ছেন। উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন,’এরপরে কী হইলো? কাম করতে দিছে কেমনে?’
‘এরপর… তিন দিন পর এসে বলল,চাকরি পেয়েছে একটা। ছয় ঘন্টা কাজ। হিসাব রক্ষকের পদ। বেতন ভালো। জানেন আম্মা,আমি ভীষণ অবাক হয়েছি! এতো কম সময়ের চাকরি আবার বেতনও তুলনায় বেশি। এরপর জানতে পারি,উনার পরিচিত একজনের অফিসে চাকরি বন্দোবস্ত উনিই করেছেন। উনি চান না আমি বেশি সময় বাইরে থাকি। আবার জেদ ধরেও বসে ছিলাম। এভাবেই সব ঠিক হয়। ইনশাআল্লাহ আম্মা,পূর্ণার বিয়েটা ধুমধামে হয়ে যাবে। প্রেমার তো দেরি আছে। অনেক পড়বে ও।’
ফরিনা পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এরপর বললেন,’আল্লাহ হাজার বছর বাঁচায়া রাখুক।’
‘আম্মা,রুম্পা ভাবি কী তিন তলায়?’
‘হ।’
‘আজ দেখতে যাব ভাবছি। চাবি কার কাছে?’
ফরিনা মুখ গুমট করে বললেন,’হেই ঘরে যাওনের দরকার নাই। রিদওয়ান চাবি দিব না। ওরা আর আমারারে দাম দেয় না। যেমনে ইচ্ছা চলে।’
‘দিবে না মানে কী? আপনি গুরুজন আপনাকে দিতে বাধ্য।’
‘চাইছিলাম একবার,যা ইচ্ছা কইয়া দিছে।’ ফরিনার মুখে আধার নেমে আসে। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে আবার বললেন,’চাবি চাওনের লাইগগা রিদওয়ান হের আম্মারেও মারছে।’
পদ্মজার চোখ দুটি বড় বড় হয়ে যায়,’সেকী! মায়ের গায়ে হাত তুলছে?’
ফরিনা কাঁথা সেলাই করতে করতে বললেন,’নিজের মা আর কই থাইকা! এই ছেড়ার মাথা খারাপ। অমানুষ।’
‘বাড়ির অন্যরা কিছু বলেনি?’
‘অন্যরা কারা?’
‘আব্বা,চাচা,বড় ভাই কেউ কিছু বলেনি?’
‘বাকিদের কথা জানি না। তোমার শ্বশুর তো নিজেই শকুনের বাচ্চা।’
পদ্মজা চমকে তাকাল। ফরিনাও চকিতে চোখ তুলে তাকান। তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। দুজন দুজনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। পদ্মজা প্রশ্ন করার আগে ফরিনা বললেন,’পূর্ণায় গাছে উঠছে। সকালে আছাড়ডা খাইল বিকেল অইতেই গাছে উইট্টা গেছে। ছেড়িডারে কয়ডা মাইর দিও।’
পদ্মজা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে,তার শ্বাশুড়ি আগের কথাটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। সে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে পারল না। মৃদু কণ্ঠে বলল,’আমি আসি আম্মা।’
‘যাও।’
পদ্মজা দরজা অবধি এসে ফিরে তাকাল। ফরিনা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলেন। পদ্মজা ঘর ছাড়তেই তিনি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। পদ্মজা উদাসীন হয়ে হাঁটছে। ফরিনা কেন নিজের স্বামীকে শকুনের বাচ্চা বললেন? পদ্মজা দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। এখন এসব ভাবা যাবে না। রিদওয়ানের কাছ থেকে চাবি নিতে হবে। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে রিদওয়ানের ঘরের সামনে আসে। দরজায় শব্দ করতেই ওপাশ থেকে রিদওয়ানের কণ্ঠ ভেসে আসে,’কে?’
পদ্মজা জবাব না দিয়ে,আরো জোরে শব্দ করল। রিদওয়ান কপাল কুঁচকে দরজা খুলল। পদ্মজাকে দেখে কপালের ভাঁজ মিলিয়ে যায়। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। মোটা হয়েছে আগের চেয়ে। গালভর্তি ঘন দাঁড়ি। এক দুটো চুল পেকেছে। সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,’আরে বাপরে,পদ্মজা আমার দুয়ারে এসেছে!’
পদ্মজা সোজাসুজি বলল,’রুম্পা ভাবির ঘরের চাবি দিন।’
রিদওয়ান দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। বলল,’এতদিন পর এসেছো আবার আমার ঘরের সামনে। ভেতরে আসো,বসো। এরপর কথা বলি।’
‘আমি আপনার সাথে কথা বলতে আসিনি। দয়া করে চাবিটা দিন।’
‘চাবি তো দেব না।’
‘কী সমস্যা?’
রিদওয়ান পদ্মজার কাঁধে হাত রেখে বলল,’আরে,ঘরে আসো তো আগে।’
পদ্মজা এক ঝটকায় রিদওয়ানের হাত সরিয়ে দিল। চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল,’চাবি দিন।’
‘চোখ দিয়ে তো আগুন ঝরছে। কিন্তু আমি তো ভয় পাচ্ছি না। চাবি আমি দেব না।’
‘দেবেন না?’
রিদওয়ান আড়মোড়া ভেঙে আয়েশি ভঙ্গিতে বলল,’ না।’
পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। চলে গেল। রিদওয়ান পিছু ডেকেছে। সে শুনেনি। মগাকে দিয়ে পাথর নিয়ে তিন তলায় আসে। মদন একটা ঘরের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে ছিল। পদ্মজা বুঝতে পারে,তাহলে এই ঘরেই রুম্পা আছে। সে দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই মদন বলল,’কিছু দরকার ভাবি?’
পদ্মজা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,’তালা ভাঙব। মগা,তালা ভাঙ।’
মদন দরজার সামনে দাঁড়ায়। বলে,’রিদওয়ান ভাইয়ের কাছে চাবি আছে। তার কাছ থাইকা লইয়া আসেন। তালা ভাইঙেন না।’
‘উনি আমাকে চাবি দেননি। তাই আমি তালা ভাঙব। আপনি সরে দাঁড়ান।’
‘না ভাবি,এইডা হয় না। আমার উপরে এই ঘরডার ভার দিছে ।’
‘আপনি সরে দাঁড়ান।’ পদ্মজা কথাটা বেশ জোরেই বলল। মদন হাওলাদার বাড়ির বউয়ের সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পাচ্ছে না। সে দৌড়ে নিচে যায়। বাড়ির সবাইকে গিয়ে বলে পদ্মজা তালা ভাঙছে।
খলিল,আলমগীর, আমির,রিদওয়ান,ফরিনা,আমিনা ছুটে আসেন। ততক্ষণে পদ্মজা তালা ভেঙে ফেলেছে। আমির হন্তদন্ত হয়ে এসেই প্রশ্ন করল,’তালা ভাঙলে কেন?’
‘আপনার ভাই আমাকে চাবি দেননি। আমার রুম্পা ভাবির সাথে দেখা করার ইচ্ছে হচ্ছিল তাই ভেঙেছি।’
‘এইডা অসভ্যতা। তোমারে ভালা ভাবছিলাম। ছেড়ি মানুষের এতো তেজ, অবাধ্যতা ভালা না।’
পদ্মজা এক নজর খলিলকে দেখল। এরপর রুম্পার ঘরে ঢুকল। রুম্পা ঘরের মাঝে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। লম্বা চুল এখন ঘাড় অবধি! কে কেটে দিয়েছে? যেন চুল না ময়লা ঝাড়ু। পদ্মজা দৌড়ে রুম্পার পাশে এসে বসে। রুম্পার শাড়ি ঠিক করে দিয়ে ডাকল,’ভাবি? ভাবি? শুনছো ভাবি? ‘
রুম্পার সাড়া নেই। গলায়,হাতে,পায়ে মারের দাগ। ফরিনা দেখে চমকে যান। রুম্পার এক হাত চেপে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন,’কেলায় মারছে বউডারে? আল্লাহ গো,কেমনে মারছে। রক্ত শুকায়া পাথথর হইয়া গেছে। এর লাইগগা আমরারে রুম্পার কাছে আইতে দেও না তোমরা? বউডা তোমরারে কী করছে? পাগল মানুষ।’ ফরিনা বাড়ির পুরুষদের দিকে চেয়ে কেঁদে বললেন।

আমিনা দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বরাবরই অন্যরকম মানুষ। অহংকারী, হিংসুক। অন্যদের ভালো দেখতে পারেন না। রানির জীবনটা এভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আরো বেশি খামখেয়ালি হয়ে উঠেছেন। পদ্মজা আমিরের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল,’আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? অন্যরা পাষাণ। আপনি তো পাষাণ না। ভাবিকে বিছানায় তুলে দিন।’

পদ্মজার কথায় আমির রুম্পাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। আমির, ফরিনা ছাড়া বাকি সবাই বিরক্তিতে কপাল ভাঁজ করে চলে যায়। তারা অসন্তুষ্ট। খলিল যাওয়ার আগে বিড়বিড় করে পদ্মজাকে অনেক কিছু বললেন। পদ্মজা সেসব কানে নেয়নি। সে শুধু অবাক হয়। মানুষগুলোর প্রতি ঘৃণা হয়। সে রুম্পার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। আমিরকে বলে,কবিরাজ নিয়ে আসতে। আমির চলে যায়। ফরিনার কাছ থেকে পদ্মজা জানতে পারল,তিনি দুই বছর পর রুম্পাকে দেখছেন! কী অবাক কান্ড! কখন চুল কাটা হয়েছে জানেন না। পদ্মজা জানতে চাইল,’কেন এতো ভয় পান বাড়ির পুরুষদের? একটু শক্ত করে কথা বলে ভাবিকে দেখতে আসতে পারলেন না? ভাবির মা বাপের বাড়ি কোথায়? উনারা মেয়ের খোঁজ নেন না?’
‘রুম্পার মা বাপ নাই। ভাই আছে দুইডা। ভাইগুলা আগেই খোঁজ নিত না। পাগল হুনার পর থাইকা নামও নেয় নাই।’
‘মানুষ এতো স্বার্থপর কী করে হয় আম্মা?’

ফরিনা রুম্পার শাড়ির ময়লা ঝেড়ে দেন। ঘরদোর পরিষ্কার করেন। রুম্পার জ্ঞান ফিরে। কিন্তু কথা বলার শক্তিটুকু নেই। সে ড্যাবড্যাব করে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন পদ্মজার জন্য অপেক্ষায় ছিল। পদ্মজার জন্যই বেঁচে আছে! কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। কতদিন ধরে তাকে পানি ছাড়া কিছু দেওয়া হচ্ছে না। ক্ষুধার চোটে বালি খেয়েছে। ঘরের এক কোণে বালির বস্তা রাখা। পেট খারাপ হয়ে পুরো ঘর নষ্ট করেছে। বমি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গতকাল থেকে সে অজ্ঞান। তবুও কেউ এসে দেখেনি। পদ্মজার চোখের জল আপনাআপনি পড়ছে। রুম্পার কষ্ট তাকে দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে। সে মনে মনে শপথ করে,রুম্পাকে নিয়ে যাবে শহরে। ফরিনা ও পদ্মজা মিলে রুম্পাকে গোসল করাল। এরপর নতুন শাড়ি পরিয়ে,গরম গরম ভাত খাওয়াল। চুলে তেল দিয়ে দিল। খাওয়া শেষে রুম্পা বিছানায় নেতিয়ে পড়ে। শরীরের শক্তিটুকু আসতে সময় লাগবে। একটু ঘুমালেই হতো। পদ্মজা রুম্পার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’ঘুমাও ভাবি।’
রুম্পার দূর্বল দুটি হাত পদ্মজার হাত শক্ত করে ধরতে চাইছে। পদ্মজা টের পেল। সে রুম্পার দুই হাত শক্ত করে ধরে বলল,’তোমাকে ছেড়ে যাব না। থাকব আমি।’
রুম্পার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পদ্মজা মুছে দিল। ফরিনাকে বলল,’আম্মা আমি আমার ঘর থেকে আমার কোরঅান শরীফ আর জায়নামাজ নিয়ে আসি। আর উনাকে বলে আসি আপাতত আমি রুম্পা ভাবির সাথে থাকব।’
‘যাও তুমি। আমি এইহানে আছি।’
পদ্মজা বেরিয়ে গেল। বারান্দা পেরোবার সময় আলগ ঘরের সামনের উঠানে চোখে পড়ল। সেখানে পূর্ণা,রানি বাচ্চাদের নিয়ে গোল্লাছুট খেলছে। পূর্ণার পরনে শাড়ি! মেয়েটা এতো দস্যি হলো কী করে? সে চোখ সরিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেল। সন্ধ্যার আযান পড়ার বেশি দেরি নেই।

_______________
রানি এক দলের নেতা,পূর্ণা অন্য দলের। দুই দলের নাম শাপলা আর গোলাপ। প্রতি দলে ছয়জন করে। বাচ্চাগুলোর বয়স ৯-১০ এরকম।
আলো আলগ ঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। মৃদুল আলগ ঘর থেকে বেরিয়ে বলল,’এই বাচ্চারা আমিও খেলতাম।’
রানি বলল,’না,না। তোরে নিতাম না।’
পূর্ণা মৃদুলকে দেখেই অন্যদিকে চাইল। তার ভীষণ লজ্জা করছে,মৃদুলের সামনে পড়তে! মৃদুল আরেকটু এগিয়ে এসে বলল,’ডরাইতাছোস? ডরানিরই কথা। এই মৃদুলের সাথে কেউ পারে না। আর তুই তো মুটকি। কেমনে পারবি?’
‘আমি তোর চার মাসের বড়। সম্মান দিয়া কথা ক। মাঝখান থাইকা সর। খেলতে দে।’
‘ধুর,তোর ছেড়ির এখন খেলার সময়। আর তুই খেলতাছস। সর। এই এই,বোয়াল মাছ। তোমার দলের একটারে বাদ দিয়া আমারে লও। এই মুটকিরে একশোটা গোল্লা না দিলে আমি বাপের ব্যাঠা না।’

পূর্ণা হা করে তাকায়। তাকে বোয়াল মাছ ডাকা হচ্ছে! এজন্য তার দিকে তাকিয়ে বাচ্চারাও হাসছে! দেখতে চকচকে সুন্দর হয়ে গেছে বলে কী,যা ইচ্ছে ডাকার অধিকার বাঘিনী পূর্ণা দিয়ে দিবে? কখনো না। সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,’আমাকে আপনার কোন দিক দিয়ে বোয়াল মাছ মনে হচ্ছে?’
পূর্ণাকে কথা বলতে দেখে মৃদুল হাসল। রসিকতা করে বলল,’আরে কালি বেয়াইন দেখি কথা কইতেও পারে।’
পূর্ণা আহত হলো। এক হাতে নিজের গাল ছুঁয়ে ভাবল,সে কী কালি ডাকার মতো কালো? বাঘিনী রূপটা মুহূর্তে নিভে গেল। তার চোখ দুটি ছলছল করে উঠে। যাকে পছন্দ করলো,সে-ই কালি বলছে। পূর্ণা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। রানি বলল,’মৃদুইললে সর কইতাছি। খেলতে দে।’
‘আমিও খেলাম। এই আন্ডা তুই বাদ। তোর বদলে আমি বেয়াইনের দলের হয়ে খেলাম।’

মৃদুলের এক কথায় ন্যাড়া মাথার ছেলেটি সরে দাঁড়ায়। মৃদুল খেলার নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়াল। এরপর পূর্ণাকে বলল,’কালি বেয়াইন তুমি আগে যাইবা? নাকি আমি আগে যামু?’
পূর্ণা মিনমিনিয়ে বলল,’আমি খেলব না।’
রানি দূর থেকে বলল,’দেখছস মৃদুইললা তুই খেলার মাঝে ঢুকছস বইললা পূর্ণা খেলত না। সবসময় কেন খেলা নষ্ট কইরা দেস তুই?’
মৃদুল সেসব কথায় ভ্রুক্ষেপও করল না। সে রসিকতার স্বরেই বলল,’আরে বেয়াইনের শক্তি ফুরায়া গেছে। আর খেলতে পারব না। এই আন্ডা তুই আয়। বেয়াইন খেলব না। তুই আইজ হারবিরে আপা।’
রানি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,’আমার দলই জিতব।’
‘আগে আগে চাপা মারিস না। আমার মতো দেখায়া দে। এই পেটওয়ালা তুই আগে যা।’

পূর্ণা ব্যথিত মন নিয়ে আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের পথে পা রাখে। সে কালো সে জানে! কিন্তু কেউ কালি বললে তার খুব খারাপ লাগে। আল্লাহ কেন তাকে সৌন্দর্য দিলেন না? একটু ফর্সা করে দিলে কী হতো? তার আপার মতো কালো রঙে সবাই সৌন্দর্য কেন খোঁজে পায় না? পূর্ণা দুই হাত দিয়ে দুই চোখের জল মুছে। অভিমানী মন থেমে থেমে কাঁদছে। এই শাড়ি তো মৃদুলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই পরেছিল সে। দরকার নেই এই চকচকে পুরুষ। কেউ তাকে কালি বললে সে ভীষণ রাগ করে! ভীষণ।

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ