Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"আমি পদ্মজাআমি পদ্মজা পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

আমি পদ্মজা পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

আমি পদ্মজা – ৪৩
_________________
পাখিদের কলতানে পদ্মজার ঘুম ভাঙল। পদ্মজা জানালার ফাঁক গলে আসা দিনের আলো দেখতে পেল। সে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। অন্যদিন ফজরের আযানের সাথে সাথে উঠে পড়ে। আজ দেরি হয়ে গেল!
‘পূর্ণাকে তুলে নিয়ে যা। একসাথে অযু করে নামায পড়তে বস।’
হেমলতার কণ্ঠ শুনে পদ্মজা ঘুরে তাকাল। তিনি কোরঅান শরীফ পূর্বের জায়গায় রেখে বললেন, ‘পূর্ণাকে একটু বুঝ দিস। নামায পড়তে চায় না।’
‘আচ্ছা,আম্মা।’
পদ্মজা পূর্ণাকে ডেকে নিয়ে কলপাড়ে যায়। এরপর দুই বোন একসাথে নামায পড়তে বসল। নামায শেষ করে হেমলতার সামনে এসে দাঁড়াল পদ্মজা। হেমলতা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজা হেমলতার চোখ দেখে বলল, ‘আম্মা, তোমার চোখ এমন লাল হলো কেন?’
হেমলতা দুই চোখে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘রাতে ঘুমাইনি তাই।’
পদ্মজা উৎকণ্ঠা,’কেন? কেন ঘুম হয়নি? কীরকম দেখাচ্ছে তোমাকে। বিছানায় পড়াটাই শুধু বাকি।’
কিছু চুল পদ্মজার মুখের উপর চলে এসেছে। হেমলতা তা কানে গুঁজে দিয়ে আদরমাখা কণ্ঠে বললেন,’আজ আমার মেয়ে চলে যাবে। তাই আমি সারারাত জেগে আমার আদরের মেয়েকে দেখেছি।’
হেমলতার কথা শুনে পদ্মজা আবেগী হয়ে উঠে। হেমলতাকে জড়িয়ে ধরে কান্নামাখা কণ্ঠে বলল, ‘আমার খুব মনে পড়ে তোমাকে। চলো আমার সাথে। একসাথে থাকব। তোমার না ইচ্ছে ছিল,আমাকে নিয়ে শহরে থাকার।
‘পাগল হয়ে গেছিস! মেয়ের জামাইর বাড়িতে কেউ গিয়ে থাকে? ২-৩ দিন হলে যেমন তেমন।’
হেমলতার শরীরের উষ্ণতা পদ্মজাকে ওম দিচ্ছে। মায়ের উষ্ণতায় কী অদ্ভুত শান্তি! পদ্মজা কান্না করে দিল। হেমলতা পদ্মজার মুখ তুলে বললেন, ‘সকাল সকাল কেউ কাঁদে? বাড়ির বউ তুই, শ্বাশুড়ি কী করছে আগে দেখে আয়। যা।’
পদ্মজা আরো কাঁদতে থাকল। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল মুছছে। আবার ভিজে যাচ্ছে। বুকটা হাহাকার করছে। কত দূরে চলে যাবে সে!
কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায়। পিছন থেকে শোনা যায়,হেমলতা বলছেন,
‘বাচ্চাদের মতো করছিস কিন্তু।’
পদ্মজা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে। ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত করল। এরপর রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। পদ্মজা ঘর ছাড়তেই হেমলতার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তিনি দ্রুত জল মুছেন। পালঙ্কের দিকে চেয়ে দেখেন,পূর্ণা চিৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে। কখন ঘুমাল? হেমলতার হাসি পেয়ে গেল। তিনি কাঁথা দিয়ে পূর্ণাকে ঢেকে দিলেন।

পদ্মজা রান্নাঘরে ঢুকতেই ফরিনা মুখ ঝামটালেন,’আইছো ক্যান? যাও ঘুমাও গিয়া।’
‘কখন এতো দেরি হয়ে গেছে বুঝিনি।’ মিনমিন করে বলল পদ্মজা’
‘বুঝবা কেন? মা আইছে তো। হউরির লগে তো আর মায়ের মতো মিশতে মন চায় না।’
পদ্মজা অবাক হয়ে তাকাল। আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,’আমিতো মিশতেই চাই। আপনি সবসময় রেগে থাকেন।’
‘মুখের উপরে কথা কইবা না। যাও এহন।’
পদ্মজা ঘুরে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। ফরিনা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন,’কইতেই যাইবাগা নাকি? জোর কইরা তো কাম করা উচিত। এই বুদ্ধিডা নাই?’
পদ্মজা স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিদিন সে কাজ করার জন্য জোরাজুরি করে,কিন্তু ফরিনা করতে দেন না। এজন্যই সে এক কথায় চলে যাচ্ছিল। আর এখন কী বলছেন! সে ব্যাপারটা হজম করে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। ফরিনা গলার স্বর পূর্বের অবস্থানে রেখেই বললেন,’ হইছে,কাম করতে হইব না। এরপর তোমার মায়ে কইবো দিনরাত কাম করাই তার ছেড়িরে। যাও। বারায়া যাও।’
পদ্মজা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লতিফা ঠোঁট চেপে হাসছে। ফরিনার এমন ব্যবহারের সাথে সে অভ্যস্ত। বেশ অনেকক্ষণ পর পদ্মজা বলল, ‘আম্মা,আমি করবটা কী?’

পদ্মজা মাথা থেকে ঘোমটা সরে গেছে। মুখটা দেখার মতো হয়েছে। ফরিনা পদ্মজার মুখ দেখে হেসে ফেললেন। আবার দ্রুত হাসি লুকিয়েও ফেললেন। এই মেয়েটাকে তিনি অনেক আগেই ভালোবেসে ফেলেছেন। এতো শান্ত,এতো নম্রভদ্র! হেমলতাকে হিংসে হয়। হেমলতার গর্ভকে হিংসে হয়। পদ্মজার ঢাকা যাওয়া নিয়ে প্রথম প্রথম ঘোর আপত্তি ছিল ফরিনার। কিন্তু এখন নেই। উপর থেকে যাই বলুন না কেন, তিনি মনে মনে চান পদ্মজা পড়তে যাক। অনেক পড়ুক। অনেক বেশি পড়ুক। এই মেয়ের জন্ম রান্নাঘরে রাঁধার জন্য নয়। রানীর আসনে থাকার জন্য। পদ্মজা ফরিনার দুই সেকেন্ডের মৃদু হাসি খেয়াল করেছে। সে সাহস পেল। ফরিনার কাছে এসে দাঁড়ায়। ফরিনা চোখমুখ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,’ঘেঁষতাছো কেন?’
পদ্মজা শিমুল তুলোর ন্যায় নরম স্বরে বলল,’আমার খুব মনে পড়বে আপনাকে। আপনার বকাগুলোকে। আপনি খুব ভালো।’
ফরিনা তরকারিতে মশলা দিচ্ছিলেন। হাত থেমে যায়। পদ্মজার দিকে তাকান। পদ্মজা বলল, ‘আমি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরব আম্মা?’

ফরিনা কিছু বলতে পারলেন না। এই মেয়েটা এতো অদ্ভুত, এতো ভালো কেন? পদ্মজার চোখের দিকে চেয়ে অনুভব করেন, কয়েক বছরের লুকোনো ক্ষত জ্বলে উঠেছে। ক্ষতরা পদ্মজার সামনে উন্মোচন হতে চাইছে। কোনোভাবে কী যন্ত্রনাদায়ক এই ক্ষত সারাতে পারবে পদ্মজা? ভরসা করা যায়? পদ্মজার মায়ামাখা দুটি চোখ দেখে বুকে এমন তোলপাড় শুরু হয়েছে কেন? ৩২ বছর আগের সেই কালো রাত্রির কথা কেন মনে পড়ে গেল? যে কালো রাত্রির জন্য আজও এই সংসার,এই বাড়িকে তিনি আপন ভাবতে পারেন না। প্রতিটি মানুষের সাথে বাজে ব্যবহার করেন। সেই যন্ত্রণা কেন বুক খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে?

উত্তরের আশায় না থেকে পদ্মজা জড়িয়ে ধরল ফরিনাকে। ফরিনা মৃদু কেঁপে উঠলেন। এরপর পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পদ্মজা ফরিনার বুকে মাথা রাখতেই টের পেল,ফরিনার বুক ধুকধুক, ধুকধুক করছে।

______________
হাওলাদার বাড়ির থেকে ডানে দুই মিনিট হাঁটার পর ঝাওড়া নামের একটি খালের দেখা পাওয়া যায়। খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে হাওলাদার বাড়ির সবাই। ট্রলার নিয়ে মাঝি অপেক্ষা করছে। ট্রলারটি হাওলাদার বাড়ির। পদ্মজা পরনে কালো বোরকা। লাবণ্য যাবে না। সকাল থেকে তার ডায়রিয়া শুরু হয়েছে। তিন-চার দিন পর আলমগীর ঢাকা নিয়ে যাবে। আজ আমির আর পদ্মজা যাচ্ছে। প্রেমা,প্রান্ত,মোর্শেদ,বাসন্তী সবাই সকালেই এসেছে। সবার সাথে কথা হয়েছে। পূর্ণা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। হেমলতা পদ্মজার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু দিলেন। তারপর বললেন,’ঠিক মতো পড়বি,খাবি। স্বামীর খেয়াল রাখবি। কাঁদবি না কিন্তু। একদম কাঁদবি না।’
‘তুমি কাঁদছো কেন আম্মা?’
‘না,না কাঁদছি না।’ বলেও হেমলতা কেঁদে ফেললেন। পদ্মজার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। বোরকা ভিজে একাকার। একদিকে মা অন্যদিকে তিন ভাই-বোন কেঁদেই চলেছে। হেমলতা নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন,পারছেন না। পদ্মজা বলল, ‘আর কেঁদো না আম্মা। তুমি অসুস্থ।’

হেমলতা ঢোক গিলেন কান্না আটকাতে। তারপর বললেন, ‘কাঁদব না। সাবধানে যাবি। দেরি হচ্ছে তো। আমির,নিয়ে যাও আমার মেয়েকে। যা মা। সাবধানে যাবি। নিয়মিত নামায পড়বি।’

পদ্মজা হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। পদ্মজার দেখাদেখি আমিরও করল। বাড়ির সব গুরুজনদের সালাম করে ট্রলারে পা রাখতেই হেমলতার কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দমালা ভেসে আসে,’আমার প্রতিটা কথা মনে রাখবি। কখনো ভুলবি না। আমার মেয়ে যেন অন্য সবার চেয়ে গুণেও আলাদা হয়। শিক্ষায় কালি যেন না লাগে।’
পদ্মজা ফিরে চেয়ে বলল, ‘ভুলব না আম্মা। কখনো না। তুমি চোখের জল মুছো। আমাদের আবার দেখা হবে।’

হেমলতা তৃতীয় বারের মতো চোখের জল মুছেন। এরপর হাত নেড়ে বিদায় জানান। ট্রলার ছেড়ে দেয়। পদ্মজা এক দৃষ্টে হেমলতার দিকে তাকিয়ে থাকে। হেমলতা চেয়ে থাকেন পদ্মজার দিকে। দুজনের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছে। কাঁদছেন মোর্শেদ। তবে পদ্মজার জন্য কম,হেমলতার জন্য বেশি। হেমলতার দিনগুলো এখন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। আরো কাঁদছেন ফরিনা। প্রতিদিন বাড়িজুড়ে একটা সুন্দর মুখ,সুন্দর মনের জীবন্ত পুতুল মাথায় ঘোমটা দিয়ে আর হেঁটে বেড়াবে না। আবারও মরে যাবে তার দিনগুলো। হারিয়ে যাবে সাদা কালোর ভীড়ে।

মাদিনী নদীর ঠান্ডা আদ্রতা বাতাসে মিশে ছুঁয়ে দিচ্ছে পদ্মজার মুখ। জল শুকাতে শুকাতে আবার ভিজে যাচ্ছে। আমির পদ্মজার কোমর এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,’এবার তো থামো।’
আমিরের আলত ছোঁয়ায় পদ্মজা আরো প্রশ্রয় পেয়ে কাঁদতে থাকল। আমির বলল, ‘এ তো আরো বেড়ে গেছে! থামো না। আমি আছিতো। আমরা ছয় মাস পর পর আসব। অনেকদিন থেকে যাবো।’
‘সত্যি তো? কাজের বাহানা দেখাবেন না?’
‘মোটেও না।’ আমির পদ্মজার চোখের জল মুছে দিল। এরপর চোখের পাতায় চুমু দিল। পদ্মজা নুয়ে যায়। বলল, ‘নদীর পাড় থেকে কেউ দেখবে।’
‘কেউ দেখবে,কেউ দেখবে,কেউ দেখবে! এই কথাটা ছাড়া আর কোনো কথা পারে আমার বউ?’
পদ্মজা আমিরের দিকে একবার তাকাল। এরপর চোখের দৃষ্টি সরিয়ে বলল, ‘আমরা ট্রলার দিয়ে ঢাকা যাব?’
‘সেটা সম্ভব না। কিছুক্ষণ পরই ট্রেনে উঠে যাবো।’

আমির পদ্মজাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়াতেই, আমিরকে হতবাক করে দিয়ে পদ্মজা ট্রলারের ভেতর ঢুকে গেল।

চলবে….
®ইলমা বেহরোজ

আমি পদ্মজা – ৪৪
____________________
ট্রেনের বগিতে হেঁটে সামনে এগোচ্ছে আমির। তার এক হাতে লাগেজ অন্য হাতে পদ্মজার হাত। শক্ত করে ধরে রেখেছে,যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। পদ্মজার মুখ নিকাবের আড়ালে ঢেকে রাখা। সে এদিকওদিক তাকিয়ে আমিরকে প্রশ্ন করল,’খালি সিট রেখে আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘কেবিনে।’
ততক্ষণে দুজন ৭৬ নাম্বার কেবিনের সামনে চলে আসে। আমির দরজা ঠেলে পদ্মজাকে নিয়ে ঢুকল। চারটা বার্থ। চারজনের কেবিন বোঝাই যাচ্ছে। পদ্মজা বলল, ‘আরো দুজন আসবে কখন? ট্রেন তো ছেড়ে দিচ্ছে।’
‘চার বার্থই আমাদের।’
পদ্মজা ডান পাশের বার্থে বসতে বসতে বলল, ‘অনেক খরচ করেছেন।’
আমির লাগেজ জায়গা মতো রেখে পদ্মজার পাশে বসল। বলল, ‘নিকাব খুলো এবার। কেউ আসছে না।’

পদ্মজা নিকাব খুলল। ঝমঝম শব্দ তুলে ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। আমির জানালা খুলে দিতেই পদ্মজার চুল তিরতির করে উড়তে থাকল। পদ্মজা দ্রুত দুই হাত মুখের সামনে ধরে, বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। আমির বাম পাশের বার্থে বসে হাসল। বলল, ‘হাত সরাও। দেখি একটু বউটাকে।’
পদ্মজা দুই হাত সরাল। ঠোঁটে আঁকা হাসি। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। চুল অবাধ্য হয়ে উড়ছে। আমির এক হাতের উপর থুতুনির ভর দিয়ে বলল,’এই হাসির জন্য দুনিয়া এফোঁড়ওফোঁড় করতে রাজি।’
পদ্মজা দাঁত বের করে হাসল। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। আমির পদ্মজার পাশে এসে বসে,পদ্মজার চুল খোঁপা করে দিল। তারপর বলল, ‘ এবার বোরকাটা খুলে ফেল। গরম লাগছে না?’
পদ্মজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আমির বলল,’কেউ আসবে না পদ্মবতী। পৌঁছাতে বিকেল হবে। নিশ্চিন্তে শুধু বোরকা খুলতে পারো। আর কিছু খুলতে হবে না।’
পদ্মজার কান রি রি করে উঠে। আমিরের উরুতে কিল দিয়ে বলল,’ছিঃ।’
আমির উচ্চস্বরে হেসে উঠল। পদ্মজা ভ্রুকুটি করে বোরকা খুলে। এরপর জানালার ধারে বসে বলল, ‘আমরা যে বাড়িতে যাচ্ছি,আর কে কে থাকে?’
‘একজন দারোয়ান আর একজন বুয়া আছে। যে বাড়ি না তোমার বাড়ি।”
‘উনারা বিশ্বস্ত?’
‘নয়তো রেখে এসেছি?’

পদ্মজা কিছু বলল না। আমির পদ্মজার পাশ ঘেঁষে বসল। পদ্মজার কানের দুলে টোকা দিয়ে, কোমর জড়িয়ে ধরল। পদ্মজা মেরুদণ্ড সোজা করে বসে। শীতল একটা অনুভূতি সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। চোখ বুজে স্বভাববশত বলে উঠে, ‘কেউ দেখবে!’
আমির ভ্রুকুঞ্চন করে চোখ তুলে তাকায়। পদ্মজা বুঝতে পারে, সে ভুল শব্দ উচ্চারণ করে ফেলেছে। জিহ্বা কামড়ে আড়চোখে আমিরকে দেখে হাসার চেষ্টা করল। আমির বেশ অনেকক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, পদ্মজার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে বলল, ‘দেখুক। যার ইচ্ছে দেখুক।’

দরজায় টোকা দিচ্ছে কেউ। শব্দে পদ্মজার ঘুম ছুটে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে,মনে পড়ছে না। আমিরের কোলে তার মাথা ছিল। মানুষটা এতক্ষণ বসে ছিল? পদ্মজাকে এভাবে উঠতে দেখে আমির ইশারায় শান্ত হতে বলল। পদ্মজা দ্রুত নিকাব পড়ে নেয়। এরপর আমির দরজা খুলল। ঝালমুড়ি নিয়ে একজন লম্বা ধরণের লোক দাঁড়িয়ে আছে। নাকটা মুখের তুলনায় একটু বেশি লম্বা। আমির বলল, ‘এভাবে অনুমতি না নিয়ে টোকা দেয়া অভদ্রতা। আমাদের দরকার পরলে আপনাদের এমনিতেই খুঁজে নিতাম। আর এমন করবেন না। আপনার জন্য আমার বউয়ের ঘুম ভেঙে গেছে। নিন টাকা। ঝালমুড়ি দেন।’
লোকটি বেশ আনন্দ নিয়ে ঝালমুড়ি বানিয়ে দিল। বোধহয় আর বিক্রি হয়নি। হতে পারে আমিরই প্রথম কাস্টমার। লোকটি চলে গেল। আমির কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। তারপর পদ্মজাকে বলল, ‘ একজন লোক ঝালমুড়ি বিক্রি করতে এসেছিল। এই নাও খাও। এরপর আবার ঘুমাও।’

দুজনে একসাথে ঝালমুড়ি খেতে খেতে সুখ-দুঃখের গল্প শুরু করে। আমির তার শহুরে জীবনের গতিবিধি বলছে। কখন কখন বাসায় থাকে। কীভাবে ব্যবসায় সময় দেয়। পদ্মজা মন দিয়ে শুনছে। একসময় পদ্মজা বলল, ‘একটা কথা জানার ছিল।’
‘কী কথা?’
“আমার মনে হচ্ছে,আপনাদের বাড়িতে লুকোনো কোনো ব্যাপার আছে। শুধু মনে হচ্ছে না , একদম নিশ্চিত আমি।’
আমির উৎসুক হয়ে ঝুঁকে বসল। আগ্রহভরে জানতে চাইল,”কীরকম?’
পদ্মজা আরো এগিয়ে আসে। আকাশে দুপুরের কড়া রোদ। ছলাৎ করে রোদের ঝিলিক জানালায় গলে কেবিনে ঢুকে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। বাতাস ভ্যাপসা গরম। মাঝে মাঝে শীতল,ঠান্ডা। সেসব উপেক্ষা করে পদ্মজা তার ভেতরের সন্দেহগুলো বলতে শুরু করল,’রুম্পা ভাবিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আমি নিশ্চিত। কেন বন্দি করে রাখা হয়েছে সেটা দাদু জানেন। উনি সবসময় রুম্পা ভাবির ঘরের দরজায় নজর রাখেন। আমি অনেকবার ঢুকতে চেয়েছি,পারিনি। বাড়ির পিছনের জঙ্গলে কিছু একটা আছে। সেটা ভূত,জ্বীন জাতীয় কিছু না। অন্যকিছু। এমনটা মনে হওয়ার তেমন কারণ নেই। আমার অকারণেই মনে হয়েছে, জঙ্গলটা আপনাঅাপনি সৃষ্টি হয়নি আর ভয়ংকরও হয়নি। কেউ বা কারা এই জঙ্গলটিকে যত্ন করে তৈরি করেছে। ভয়ংকর করে সাজিয়েছে। এছাড়া, বাড়ির সবাইকে আমার সন্দেহ হয়। এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?’

আমির একটুও অবাক হলো না,মুখের প্রকাশভঙ্গী পাল্টালো না। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘জানি আমি এসব।’
পদ্মজা আমিরের দুই হাত খামচে ধরে এক নিঃশ্বাসে বলল,’আমাকে বলুন। অনুরোধ লাগে,বলুন। আমি শুনতে চাই। অনেকদিন ধরে নিজের ভেতর পুষে রেখেছি।’
আমির অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। বলল,’আমার ধারণা তোমার ধারণা অবধিই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে কিছু জানি না। এই রহস্য খুঁজে বের করার ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও আমি হজম করেছি। আমার ইচ্ছে মাটিচাপা দিয়েছি।’
আমিরের গলাটা কেমন শুনাল। পদ্মজা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,’কেন? কেন দিয়েছেন?’
আমির হাসল। বলল,’ধুর! এখন এসব গল্প করার সময়? শুনো, এরপর কী করব….’
পদ্মজা কথার মাঝে আটকে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল,’কথা ঘুরাবেন না। আমি খেয়াল করেছি,হাওলাদার বাড়ির প্রতি আপনি উদাসীন। কোনো ব্যাপার পাত্তা দেন না। সবসময় বাড়ির চেয়ে দূরে দূরে থাকেন। কোনো ঘটনায় নিজেকে জড়ান না। কেন নিজেকে গুটিয়ে রাখেন?’
আমিরের দৃষ্টি অস্থির। সে এক হাতে বার্থ খামচে ধরার চেষ্টা করে। ঘন ঘন শ্বাস নেয়। পদ্মজা খুব অবাক হয়! আমিরের এতো কষ্ট হচ্ছে কেন?
পদ্মজার উৎকণ্ঠা, ‘কী হলো আপনার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?’
‘না! কিছু হয়নি। এই পদ্মজা?’

আমির চট করে পদ্মজার দুই হাত শক্ত করে ধরল। চোখ দুটিতে ভয়। পদ্মজা আমিরের চোখের দিকে তাকাল। আমির বলল,’আমার তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে। অনেকবার বলতে গিয়েও পারিনি। আজ যখন কথা উঠেছে…আচ্ছা পদ্মজা, আমার পরিচয় জেনে আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? আমি তোমাকে হারালে একাকীত্বে ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হয়ে যাব। আমার জীবনের একমাত্র সুখের আলো তুমি।’
পদ্মজার হৃৎপিণ্ড থমকে গেল। সে পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছে না। আমির উত্তরের আশায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে। পদ্মজা ধীর কণ্ঠে বলল,’লুকোনো সব কথা বলুন আমাকে। আপনি আমার স্বামী। আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাবি না আমি। বিশ্বাস করুন!’
আমির নতজানু হয়ে বলল,’আমি আমার আব্বার অবৈধ সন্তান। আমার জন্মদাত্রী জন্ম দিয়েই মারা যায়। দিয়ে যায় অভিশপ্ত জীবন।’

পদ্মজা দুই পা কেঁপে উঠে। মাথা ভনভন করে উঠে। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত গড়িয়ে যায়। আমির ঢোক গিলে আবার বলল,’আমার জন্মদাত্রী মারা যাওয়ার পর আব্বা আমাকে নিয়ে আসেন। আমার বর্তমান আম্মা আমাকে দেখে খুব রেগে যায়। কিছুতেই আমাকে মানতে চায়নি। তখন ছেলেমেয়ে ছিল না আম্মার। তাই মাস ঘুরাতেই আমাকে মেনে নিল। ছেলের মতো আদর শুরু করল। এসব দাদুর মুখে পরে শুনেছি। আব্বা আমাকে তুলে এনে জায়গা দিলেও সন্তানের মতো ভালোবাসেননি কখনো। যখন আমার এগার বছর আমি আর রিদওয়ান একসাথে জানতে পারি,আমি আব্বার অবৈধ সন্তান। আব্বা আবার রিদওয়ানকে খুব আদর করতেন। রিদওয়ান ছোট থেকেই আমার সাথে ভেজাল করতো। ঝগড়া করতো। যখন এমন একটা খবর জানতে পারল,ও আরো হিংস্র হয়ে উঠে। আমি তখন অনেক শুকনো আর রোগা ছিলাম। রিদওয়ান স্বাস্থ্যবান, তেজি ছিল। আব্বার এমন ছেলেই পছন্দ। কেন পছন্দ জানি না। উনিশ থেকে বিশ হলেই রিদওয়ান খুব মারতো। আব্বার কাছে বিচার দিলে রিদওয়ান আরো দশটা বানিয়ে বলতো। তখন আব্বা আমাকে মারতেন। রিদওয়ান একবার আমাকে জঙ্গলে বেঁধে ফেলে রেখেছিল। দেড় দিন পড়ে ছিলাম। রাতে ভয়ে প্যান্টে প্রস্রাব করে দিয়েছি। মুখ বাঁধা ছিল। তাই এতো চিৎকার করেছি তবুও কেউ শুনেনি। ভয়ে বুক কাঁপছিল। মনের ভয় মিশিয়ে ভয়ংকর ভয়ংকর ভূত,দানব দেখেছি। বাঁচানোর মতো কেউ ছিল না। দেড়দিনের সময় আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন,ফকির মিয়া নামে একজন,উনি আমাকে জঙ্গলে বাঁধা অবস্থায় পান। বাড়িতে বৈঠক বসে। রিদওয়ানকে দুটো বেতের বারি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। রিদওয়ান এক তো বলিষ্ঠবান তার উপর আমার দুই বছরের বড়। কিছুতেই পেরে উঠতাম না।পানিতে ঠেসে ধরে রেখেছে অনেকবার। ওর মস্তিষ্ক অসুস্থ। আমার জীবন জাহান্নাম হয়ে উঠে। আম্মাকে বললেও আম্মা বাঁচাতে পারতেন না। সবসময় নিশ্চুপ। কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য যখন আমার পনেরো বয়স শীতের রাতে পালিয়ে যাই। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ক্ষেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। এরপরদিন চোখ খুলে দেখি,আমি হাওলাদার বাড়িতে। আমার সামনে রিদওয়ান, আব্বা,চাচা,আম্মা সবাই। বুঝে যাই,আমার কোনো জায়গা নাই আর। এখানেই থাকতে হবে। যতই কষ্ট হউক থাকতে হবে।’

আমিরের কণ্ঠে স্পষ্ট কান্না। চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। পদ্মজা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। আমির অশ্রুসজল চোখ মেলে পদ্মজার দিকে তাকাল। হেসে ফেলল। পদ্মজার দুই চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,’আরেএ পাগলি! কাঁদছো কেন? এসব তো পুরনো কথা। আমার পড়াশোনাটা আবার চলছিল ভালোই। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম। এ দিক দিয়ে বুদ্ধিমান ছিলাম। সবসময় ভালো ফলাফল ছিল। এজন্য কদর একটু হলেও পেতাম। যখন আমার আঠারো বয়স বাড়িতে অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করি। রাত করে অদ্ভুত কিছুর শব্দ শুনি। জঙ্গলে আলো দেখতে পাই। চাচাকে প্রায় রাতে জঙ্গলে যেতে দেখি। রিদওয়ান আর চাচা মিলে কিছু একটা নিয়ে সবসময় আলাপ করতো। ওদের চোখেমুখে থাকতো লুকোচুরি খেলা। আমি একদিন রাতে চাচাকে অনুসরণ করি। প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পর চাচা দেখে ফেলে। এই ভুলের জন্য কম মার খেতে হয়নি সেদিন! তবুও বেহায়ার মতো কয়দিন পর আবার অনুসরণ করি। রিদওয়ান পিছনে ছিল দেখিনি। আব্বা সেদিন অনেক মারল। দা ছুঁড়ে মারেন। এই যে থুতুনির দাগটা,এটা সেই দায়ের আঘাত। একসময় আব্বা আমাকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন। বললেন, আমাকে শহরে পাঠাবেন। পড়ালেখার জন্য। কোনো ব্যবসা করতে চাইলে তারও সুযোগ করে দিবেন। আমি যেন এই বাড়ি আর বাড়ির আশপাশ নিয়ে মাথা না ঘামাই। আমি মেনে নেই। রিদওনায়ের সাথে থাকতে হবে না আর। এর চেয়ে আনন্দের কী আছে? চলে আসি ঢাকা। শুরু হয় নিজের জায়গা শক্ত করার যুদ্ধ। এখানে এসেও অনেক অপমান সহ্য করতে হয়। তবুও থেমে যাইনি। যুদ্ধ করে চলেছি। আমাকে বাঁচতে হবে। মানুষের মতো বাঁচতে হবে। কারো লাথি খেয়ে না। যখন আমার তেইশ বছর,তখন থেকে আমার কদর বেড়ে যায়। ব্যবসায় মোটামুটি সফল হয়ে যাই। ভাগ্য ভালো ছিল আমার। অতিরিক্ত পরিশ্রম আমাকে নিরাশ করেনি। তখন আব্বা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রিদওয়ান আগের মতো হাত তুলার সাহস পায় না। সেই আমি আজ এই জায়গায়। এখন আমার যে অবস্থান হাওলাদার বাড়ির কারোর সাহস নেই আমার চোখের দিকে তাকানোর। আমি চাইলেই শোধ নিতে পারি। কিন্তু নেব না। তারা থাকুক তাদের মতো। রিদওয়ান ছোটবেলা যা করেছে, মেনে নিয়েছি। এখন তোমার দিকেও নজর দিয়েছে। ওর নজর আমার বাড়িগাড়ি,অফিস-গোডাউনেও আছে। আমি টের পাই। ও পারলে আমাকে খুন করে দিত। কিন্তু পারে না। আমার ক্ষমতার ধারেকাছেও ওর জায়গা নেই। এখন আমার নিজের এক বিশাল রাজত্ব আছে। আমার অহংকার করার মতো অনেক কিছু আছে। হাওলাদার বাড়ির কেউ কেউ মিলে আমাকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করছে। আমি নিশ্চিত। তাই হাওলাদার বাড়িতে আমি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। আম্মা ছাড়া ওই বাড়ির সবার ভালোবাসা মুখোশ মাত্র। আমার দরকার ছিল একজন ভালো মনের সঙ্গিনী। আমি পেয়ে গেছি আর কিছু দরকার নেই। আমি আমার অর্ধাঙ্গিনীকে তার আসল সংসারে নিয়ে যাচ্ছি। এখন আমার মন শান্ত। কোনো চিন্তা নেই। খুব বেশি সুখী মনে হচ্ছে।’

আমির পদ্মজার হাতে চুমু খেল। পদ্মজা তখনও কাঁদছে। সে আচমকা আমিরকে জড়িয়ে ধরল। গভীরভাবে,শক্ত করে। এরপর কান্নামাখা কণ্ঠে বলল,’আমি কখনো আপনাকে কষ্ট দেব না। কোনোদিন না। কেউ আপনাকে ছুঁতে আসলে আমি তার গর্দান নেব। আমি উন্মাদ হয়ে তাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করব।’
‘কারো সেই ক্ষমতা নেই আর। মিছেমিছি ভয় পাচ্ছো।’
পদ্মজা আরো শক্ত করে ধরার চেষ্টা করে। আমির পদ্মজার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,’এই প্রথম আমার বউয়ের গভীর আলিঙ্গন পেলাম। ভালো লাগছে। ছেড়ো না কিন্তু।’

_____________
প্লাটফর্মে হাঁটছে ওরা। আমির পদ্মজার এক হাত ধরে রেখেছে। খুব দ্রুত হাঁটছে। পদ্মজা তাল মেলাতে পারছে না। চেষ্টা করছে। মোটরগাড়ি নিয়ে একজন কালোচশমা পরা লোক অপেক্ষা করছিল। আমির সেখানে গিয়ে থামে। লোকটা সালাম দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল। ব্যাগ জায়গামতো রাখে। আমির আগে পদ্মজাকে উঠতে বলল। পদ্মজা অবাক হয়। এরকম গাড়ির সাথে সরাসরি পরিচয় নেই তার। কিন্তু প্রকাশ করল না। আমিরের কথামতো গাড়িতে উঠে বসল। এরপর আমির উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করে। আমির পদ্মজাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,’আমাদের নিজস্ব গাড়ি। কথা ছিল কিন্তু, আমার গাড়ি দিয়ে রাতবেরাতে যখন তখন ঘুরতে বের হবো।’

পদ্মজা কিছু বলল না। সে উপভোগ করছে নতুন জীবন। ঘন্টাখানেকের মধ্যে একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থামে। কালো চশমা পরা লোকটা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে আমিরের ডান পাশের দরজা খুলে দিল। আমির পদ্মজাকে নিয়ে নামল। পদ্মজা বাড়িটা দেখে মুগ্ধ হয়। দ্বৈত(ডুপ্লেক্স) বাড়ি। একজন দারোয়ান দৌড়ে এসে সালাম দিল। পদ্মজার সাথে পরিচিত হলো। এরপর আসে একজন মধ্যবয়স্ক নারী। ইনি বোধহয় বাড়ির কাজের লোক। সবাই একসাথে বাড়ির ভেতর ঢুকল। পদ্মজা তার নতুন বাড়ি মন দিয়ে দেখছে। পূর্ব দিক থেকে সদর দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল বিশাল বৈঠকখানা উত্তর দক্ষিণে লম্বা। দক্ষিণ পাশে বারান্দা তাতে নানা ধরনের ফুল ফুটে আছে টবের মধ্যে, মনে হবে যেন একটা ছোটোখাটো বাগান। বৈঠকখানার দক্ষিণ পশ্চিম কোণার দিকে বেশ বড় শোবার ঘর। পদ্মজা প্রশ্ন করার আগে আমির বলল,’না,এটা আমাদের ঘর না।’

উত্তর পশ্চিম কোণার দিকে রান্নাঘর এবং টয়লেট। আর এই দুয়ের মাঝে মানে বৈঠকখানার পশ্চিম দিকের মাঝখানটায় খাওয়ারঘর(ডাইনিং)। বৈঠকখানার মাথার উপর দিকে তাকালে সেখানে সোনালী কালারের ঝাড়বাতি ঝুলছে। বৈঠকখানার উত্তর দিকে একটা সিড়ি সাপের মত পেঁচিয়ে উপর দিকে উঠে গেছে। আমির পদ্মজাকে নিয়ে সেদিকে হাঁটে। সিঁড়ি পেরুনোর পর হাতের বাঁ দিকে অনেক বড় একটা শোবার ঘর। দামী,দামী জিনিসে সৌন্দর্য আকাশছোঁয়া। দুজন একসাথে ঢুকে। পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে সবকিছু দেখছে। আমির বলল,’গোসল করে নাও?’

পদ্মজা বোরকা খুলে কলপাড় খুঁজতে থাকল। আমির গোসলখানার দরজা খুলে দিয়ে বলল,’এইযে এদিকে।’

দুজন একসাথে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলো। পদ্মজা দুই তলাটা আরেকটু দেখার জন্য ডানদিকে মোড় নিল। প্রথমে চোখে পড়ল বড় ব্যালকনি। এরপর আরেকটা শোবার ঘর। ব্যালকনিতে লতাপাতার ছোট ছোট টব।
______________

বিরাট অট্টালিকায় সুখের সাথে কেটে যায় পাঁচ মাস। লাবণ্য দেশ ছেড়েছে দুই মাস হলো। বুয়া কাজ ছেড়েছে তিন মাস। পদ্মজা আর কাজের লোক নিতে দিল না। সে এক হাতেই নাকি সব পারবে। তবুও আমির একটা ১২-১৩ বছর বয়সী মেয়ে রেখেছে সাহায্যের জন্য। ভোরের নামায পরে রান্নাবান্না করে পদ্মজা। এরপর শাড়ি পাল্টে নেয়। কলেজে যাওয়ার জন্য। আমিরকে ব্লেজার,টাই পরতে সাহায্য করে। প্রথম যেদিন আমিরকে ব্লেজার পরতে দেখেছিল,অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,’এই পোশাকের নাম কী? আপনাকে খুব বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।’
আমির হেসে জবাব দিয়েছিল, ‘ব্লেজার। বাইরে থেকে আনা।’
এমন অনেক কিছুই পদ্মজার অজানা ছিল। সবকিছু এখন তার চেনাজানা। এই বিলাসবহুল জীবন বেশ ভালো করেই উপভোগ করছে। মানুষটা সারাদিন ব্যস্ত থাকে। তবুও ফাঁকেফাঁকে টেলিফোনে যোগাযোগ করে। পদ্মজাকে নিয়ে গোডাউন দেখিয়েছে,অফিস দেখিয়েছে। সবকিছু সাজানো, গোছানো। গোডাউনে বিভিন্ন ধরণের পণ্য। কত কত রকমের দ্রব্য। পদ্মজা জীবনে ভালোবাসা এবং অর্থ দুটোই চাওয়ার চেয়েও বেশি পেয়েছে।

সকাল নয়টা বাজে। আমির তাড়াহুড়ো করছে, তার নাকি আজ দরকারি মিটিং আছে। পদ্মজা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে দৌড়ে দৌড়ে খাবার পরিবেশন করছে। আমির দুই তলা থেকে নেমেই বলল,’আমি গিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। কলেজ চলে যেও।’
‘আরেএ,খেয়ে যাবেন তো।’
‘সময় নেই। আসছি।’
‘খেয়ে যান না।’
‘বলছি তো,তাড়া আছে। জোরাজুরি করছো কেন?’
আমির দ্রুত বেরিয়ে যায়। পিছু ডাকতে নেই,তাই পদ্মজা ডাকল না। মনাকে ডেকে বলল,’খেয়ে নাও তুমি।’

মনা পদ্মজার সাহায্যকারী। পদ্মজার ছোটখাটো ফরমায়েশ পালন করে। পদ্মজা বৈঠকখানায় গিয়ে বসে। আজ কলেজে যেতে ভালো লাগছে না। ভোরে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি। অকারণে মন বিষণ্নতায় চেয়ে আছে। অকারণেও না বোধহয়! আমির বিরক্ত হয়ে কথা বলেছে,এজন্যই বোধহয় মন আকাশে বৃষ্টি নেমেছে। পদ্মজা পুরোটা দিন উপন্যাস পড়ে কাটিয়ে দিল। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে কলিং বেল বাজে। পদ্মজা দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দিল। আমির দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে বাতাস। পদ্মজা বলল, ‘আসুন।’
আমির ভেতরে আসে না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তাকিয়ে আছে পদ্মজার দিকে। পদ্মজা কপাল কুঁচকাল। বলল,’কী হলো? আসুন।’
আমির চট করে পদ্মজাকে কোলে তুলে নিল। পদ্মজা চেঁচিয়ে উঠে বলল,’কেউ দেখবে।’
আমির মনাকে ডাকল,’মনা? কই রে? দেখে যা।’
‘আপনি ওকে ডাকছেন কেন?’
‘এবার কাউকে দেখাবই।’
‘উফফ! আল্লাহ,ছাড়ুন।’
‘মনা? মনা?’

মনা দুই তলা থেকে নেমে আসে। আমির মনাকে দেখে বলল,’এই দেখ তোর আপারে কোলে নিয়েছি। দাঁড়া,তোর সামনে একটু আদর করি।’
পদ্মজা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। চাপাস্বরে বলল,’মনা কী ভাববে! আমি আর বলব না,কেউ দেখবে। ছেড়ে দিন।’
আমির পদ্মজাকে নামিয়ে দিল। মনা কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। আমির বলল,’যা ঘরে যা।’
মনা যেন এইটা শোনার অপেক্ষায় ছিল। দৌড়ে চলে যায়। পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আমিরকে গুরুজনদের মতো বলল,’আক্কেলজ্ঞান কখন হবে আপনার? বয়স তো কম হলো না।’
অবিকল পদ্মজার কথার ধরণ অনুসরণ করে আমির বলল,’আর কতদিন কেউ দেখবে কথাটা মুখে থাকবে? বিয়ের তো কম দিন হলো না।’
‘আপনি…আপনি কালাচাঁদ না কালামহিষ।’
‘এটা পূর্ণা বলতো না? হেহ,আমি মোটেও কালো না।’
‘তো কী? এইযে দেখুন,দেখুন। আমার হাত আর আপনার হাত।’
পদ্মজা হাত বাড়িয়ে দেখায়। আমির খপ করে পদ্মজার হাত ধরে চুমু খেয়ে বলল,’এই হাতও আমার।’
পদ্মজা বলল,’ঠেসে ধরা ছাড়া আর কিছু পারেন আপনি? ছাড়ুন।’
আমির পদ্মজার হাত ছেড়ে দিয়ে হাসতে থাকল।

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

আমি পদ্মজা – ৪৫
___________________
দেখতে দেখতে চলে এসেছে শীতকাল। সকাল দশটা বাজে। অথচ,কুয়াশার চাদরে চারিদিক ঢাকা। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা। মনটা কু গাইছে। বুকে অজানা একটা ঝড় বইছে। স্থির হয়ে কোথাও দাঁড়াতে পারছে না। ঢাকা আসার পর থেকে নিয়মিত পূর্ণার লেখা চিঠি পেত। প্রায় চার মাস হলো বাড়ি থেকে কোনো চিঠি আসছে না। পদ্মজা নয়টা চিঠি পাঠিয়েছে। একটারও উত্তর আসেনি। বাড়ির সবার কথা খুব মনে পড়ছে। ব্যালকনি ছেড়ে রুমে চলে আসে পদ্মজা। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়। একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখে। হাওলাদার বাড়িতে টেলিফোন এনেছে। পূর্ণা হাওলাদার বাড়িতে এসে পদ্মজার সাথে যোগাযোগ করে। পদ্মজা কথা বলতেই ওপাশ থেকে পূর্ণার উল্লাস ভেসে আসল, ‘আপা? আপা আমি তোমার গলার স্বর শুনতেছি। তুমি শুনছো?’
‘শুনছি। কেমন আছিস? আম্মা কেমন আছে? বাড়ির সবাই ভালো আছে?’
‘সবাই ভালো। তুমি কেমন আছো? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার গলার স্বর শুনছি!’
‘আচ্ছা,শোন?’
‘বলো আপা।’
‘আশেপাশে কেউ আছে?’
‘খালাম্মা আছে।’
‘এই বাড়িতে আর আসবি না। আমি যতদিন না আসব। মনে রাখবি?’
‘কেন? কেন আপা?’
‘মানা করেছি,শুনবি।’
‘আচ্ছা,কিন্তু আমি ভেবেছিলাম এবার প্রতিদিন দুলাভাইয়ের বাড়িতে আসব। আর তোমার সাথে কথা বলব। ধুর!’
‘আবার যখন আসব আমাদের বাড়িতে টেলিফোন নিয়ে আসব। এরপর প্রতিদিন আমাদের কথা হবে। এখন আমার মানা শোন।’
‘টাকা কই পাবে?’
‘সেদিন উনি বলেছেন, নিয়ে আসবেন। আমি মানা করেছিলাম। বললেন, তুমি আনন্দে থাকলেই আমার সুখ। তোমার সুখের জন্যই এখন আমার সব। আর কী বলার?’
‘দুলাভাই খুব ভালো তাই না আপা?’
‘হুম। আম্মার শরীর সত্যি ভালো আছে?’
‘আছে। আগের চেয়ে ভালো।’
‘খেয়াল রাখিস আম্মার।’
‘রাখব।’

বাতাসটা বেড়েছে। পদ্মজার গা কাঁটা দিচ্ছে। আচমকাই ঘুমটা ভেঙে যায়। চট করে উঠে বসে। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল,টেলিফোন নেই। একদম বাস্তবের মতো অনুভূতি হচ্ছিল। পদ্মজা দেয়াল ঘড়িতে দেখে, এগারোটা বাজে। টেলিফোন পুরো দেশে হাতেগোনা কয়জনের বাসায় আছে। সেখানে গ্রামে টেলিফোনে যোগাযোগ করা যাবে ভাবা হাস্যকর।

পদ্মজা বিছানা ছেড়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসে। কপালে হাত দিয়ে দেখে গায়ে জ্বর এসেছে।পূর্ণার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রান্নাঘরে যেতে যেতে ডাকল,’মনা?’

পরক্ষণেই মনে পড়ল,মনা বাসায় নেই। দুইদিন আগে বাড়িতে গিয়েছে। খুব একা লাগছে তার। সবকিছুই রান্না করা আছে। আর কী রাঁধবে? এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়া যায়। পদ্মজা এক কাপ চা নিয়ে ড্রয়িংরুমের জানালার পাশ ঘেঁষে বসল। গ্রামের সোনালি দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। মোর্শেদ প্রথম যেদিন সোয়েটার কিনে দিয়েছিলেন সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে। সকাল সকাল উঠে খেজুরের রস দিয়ে পিঠা খাওয়া। কত লোভনীয় সেই দিনগুলো। কলিং বেল বেজে উঠল।

অসময়ে কলিং বেল শুনে পদ্মজা অবাক হলো। আমিরতো এখন আসবে না। দুই ঘন্টা আগেই বের হলো। তাহলে কে এসেছে? গায়ে শাল টেনে নিল সে। এরপর দরজা খুলল। দরজার সামনে আমির দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা অবাক হয়ে জানতে চাইল,’এতো দ্রুত?’
‘তৈরি হও,বাড়িতে যাব।’
পদ্মজা চোখের পলক ফেলে আবার তাকাল। বলল,’বাড়িতে মানে অলন্দপুর?’
আমির দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল,’হুম। দ্রুত যাও। শাড়ি পাল্টাও।’
পদ্মজার উৎকণ্ঠা,’হুট করে যে! কোনো খারাপ খবর?’

আমির হেসে বলল,’তেমন কিছুই না। কয়দিন ধরে দেখছি মন খারাপ করে বসে থাকো। তাই হুট করে যাওয়ার কথা ভাবলাম। তোমার কলেজ তো শীতের বন্ধই আছে। আমি এক সপ্তাহর জন্য ম্যানেজারকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আর আলমগীর ভাইয়া এসেছে। কোনো চিন্তা নেই। এবার দ্রুত যাও। ট্রেন বারোটায়। আজকের শেষ ট্রেন কিন্তু এটাই। আমি তৈরি আছি। শুধু লাগেজে দুই তিনটা শার্ট ঢুকিয়ে নিলেই হবে।’

পদ্মজা আর কিছু বলল না। ছুটে যায় দুই তলায়। তার হৃৎপিণ্ড খুশিতে দামামা বাজাচ্ছে। দশ মিনিটের ব্যবধানে শাড়ি পাল্টে, লাগেজও গুছিয়ে ফেলে। দুজন বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য অলন্দপুর। দীর্ঘ আট মাস পর জন্মস্থান, জন্মদাত্রী, জন্মদাতা,ভাই-বোন সবাইকে দেখতে পাবে পদ্মজা। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা এতোটাই কাজ করছে যে,শীতের প্রকোপ টের পাচ্ছে না সে।

কেবিনে ঢোকার পর থেকে বার বার এক কথাই বলে চলেছে পদ্মজা,’কতদিন পর যাচ্ছি! আম্মা হুট করে আমাকে দেখে জ্ঞান না হারিয়ে ফেলে। পূর্ণা নিশ্চিত জ্ঞান হারাবে।’
আমির হাসল। পদ্মজার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,’আসো গল্প করি।’
পদ্মজার তাকাল। তার চোখ দুটি হাসছে। চিকমিক করছে। সে প্রশ্ন করল,’আলমগীর ভাইয়া আমাদের বাসায়ই উঠবেন?’
‘না। অফিসেই থাকবে।”
‘রানি আপা ভালো আছে? কিছু বলছে?’
আমির চুল ঠিক করতে করতে ব্যথিত স্বরে বলল,’ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। বাচ্চা নষ্ট করতে দিল না। এরপর মৃত বাচ্চা জন্ম দিল। এখন অবস্থা আরো করুণ। ঘরেই বন্দী।’
‘ইশ! খারাপ লাগে ভাবলে। মানুষের কপাল এতো খারাপ কী করে হয়!’

___________________
মোড়ল বাড়ির সড়ক দেখা যাচ্ছে। পদ্মজা খুশিতে আত্মহারা। দ্রুত হাঁটছে। সে কখনো বাহারি শাড়ি, বোরকা পরে না। আজ পরেছে। শাড়ি বোরকা দুটোতেই ভারী কাজ,চকচক করা ছোট-বড় পাথর।। দেখলে মনে হয়,হীরাপান্না চিকচিক করছে। সে তার মাকে দেখাতে চায়,সে কতোটা সুখী। কোনো কমতি নেই তার জীবনে। মোড়ল বাড়ির গেইট ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সব আনন্দ,উল্লাস নিভে যায়। পূর্ণা,প্রেমা দাঁড়িয়ে আছে। দুজনকে চেনা যাচ্ছে না। শুকিয়ে কয়লা হয়ে গেছে।
চোখ গর্তে ঢুকে গেছে। গাল ভাঙা। গায়ে শুধু হাড্ডি। মনে হচ্ছে কতদিন অনাহারে কাটিয়েছে। পূর্ণা পদ্মজাকে দেখেই ‘আপা’ বলে কেঁদে উঠল। ছুটে না এসে মাটিতে দপ করে শব্দ তুলে বসে পড়ল। প্রেমা দৌড়ে এসে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে থাকল। পদ্মজা বাকরুদ্ধ। অজানা
আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে আসছে। চোখ দুটো খুঁজতে থাকল মাকে। পদ্মজা আমিরের দিকে তাকাল। আমিরের চোখ অস্থির। পদ্মজা প্রেমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আড়চোখে দেখে,পূর্ণা হাউমাউ করে কাঁদছে। কেন আসছে না ছুটে? কীসের এতো কষ্ট ওর?

পদ্মজা এগিয়ে আসে। পূর্ণাকে টেনে তুলে ক্ষীণ স্বরে বলল,’এতো শুকিয়েছিস কেন? আম্মা…আম্মা ভালো আছে?’

‘আপা…আপারে।’ বলে পদ্মজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল পূর্ণা। পদ্মজা ঘরের ভেতর তাকায়। কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। অজ্ঞাত ভয়ে গলা দিয়ে কথা আসছে না তার। পূর্ণাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে ঘরের ভেতর ঢুকল পদ্মজা। সদর ঘরে চেনা অনেকগুলো মুখ। প্রতিবেশী সবাই। আপন মানুষগুলো কোথায়? পদ্মজা আরো দুই পা এগিয়ে আসে। উঠান থেকে মনজুরার কণ্ঠ ভেসে আসে,’পদ্ম আইছে,পদ্ম…’

সদর ঘরের মধ্যখানে পাটিতে শুয়ে আছেন হেমলতা। গায়ের উপর কাঁথা। মেরুদণ্ড সোজা করে শুয়ে আছে। গোলাপজলের ঘ্রাণ চারপাশে। পদ্মজার বুকের হাড়গুলো যেন গুড়োগুড়ো হতে শুরু করল। বুকে এতো ব্যাথা হচ্ছে! সে হেমলতার পাশে বসল। নিস্তরঙ্গ গলায় ডাকল,’আম্মা? ও আম্মা?’

হেমলতা পিটপিট করে তাকান। চোখ দুটি ঘোলা। গাল ভেঙে গেছে। চোখ দুটি গভীর গর্তের আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার পথে। পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। চিনতে পারলেন না। পদ্মজা হেমলতার এক হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু দিল। দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে হেমলতার হাতে। তাতেও হেমলতার ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি নিজের মতো ঘরের ছাদে তাকিয়ে আছেন। মনজুরা সদর ঘরে ঢুকেই বিলাপ শুরু করেন মাত্র,পদ্মজা জোরে চেঁচিয়ে উঠল,’চুপ করো। কেউ কাঁদবে না। চুপ করো।’

সবার কান্না থেমে যায়। পদ্মজা হেমলতাকে বলল,’ও আম্মা? কথা বলো? আমি…আমি তোমার পদ্মজা। তোমার আদরের পদ্মজা।’

‘আম্মা চারমাস ধরে কাউকে চিনে না আপা।’ পূর্ণা ডুকরে কেঁদে উঠল। পদ্মজার চোখ পড়ে সদর ঘরের কোণে। মোর্শেদ কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন। মানুষটাকে চেনা যাচ্ছে না একদমই। পিঠের হাড্ডি ভেসে আছে। পদ্মজা বাকহীন হয়ে পড়েছে। কিছু বলবে নাকি কাঁদবে? বুকে কেমন যেন হচ্ছে! শরীরের শক্তি কে যেন শুষে নিয়েছে। পদ্মজা দুই হাতে হেমলতার মাথা তুলে ধরল। হেমলতা তাকান। নিষ্প্রাণ চাহনী। হেমলতার মাথাটা পদ্মজা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। আকুল ভরা কণ্ঠে বলল,একবার কথা বলো আম্মা? একবার দুই হাতে জড়িয়ে ধরো।’

হেমলতার হাত দুটো নেতিয়ে আছে মাটির উপর। পূর্ণা খেয়াল করে হেমলতার হাত দুটি কাঁপছে। চেষ্টা করছে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরার কিন্তু পারছেন না। তাহলে কী পদ্মজাকে চিনতে পেরেছেন? পদ্মজা কাঁদতে থাকল। অনেকে অনেক কিছু বলছে। কারো কথা কানে ঢুকছে না। শুধু বুঝতে পারছে,এই পৃথিবীর বুক থেকে তার মা হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে হেমলতা। হারিয়ে যাচ্ছে তার কল্পনার রাজ্যের রাজরানী। স্বপ্ন তো সব পূরণ হয়নি! এ তো কথা ছিল না। তবে কেন এমন হচ্ছে? পদ্মজার বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় সারা শরীর বিষিয়ে যাচ্ছে। কাঁপা ঠোঁটে হেমলতার পুরো মুখে চুমু খেল পদ্মজা। ভারি করুণ ভাবে বলল,’ও আম্মা? কোথায় হারালো তোমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি,ঝাঁঝালো কণ্ঠ?’

কেটে যায় অনেকটা মুহূর্ত। কাছের মানুষেরা ছাড়া আর কেউ নেই। কারো মুখে রা নেই। হেমলতার মতোই সবাই বাকহীন, স্তব্ধ। কেউ খায়নি। বাসন্তী গুপ্ত ব্যাথা নিয়ে রেঁধেছেন। প্রেমা-প্রান্ত,আমির ছাড়া কেউ খেল না। পদ্মজাকে অনেক জোরাজুরি করেছে আমির। পদ্মজা খেল না। আমিরও আর ঘাঁটল না। পদ্মজা জানতে পারল, দুই মাস ধরে হেমলতা বিছানায় পড়ে আছেন। এক দুটো কথা বলেন মাঝে মাঝে। চারদিন ধরে তাও বলেন না। গতকাল ভোরে মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়েছে। এমন অবস্থা হয়েছিল, সবাই ভেবেছিল আত্মাটা বেরিয়েই যাবে। হাওলাদার বাড়ি থেকে সবাই দেখতে আসে। তখন জানা যায়,আলমগীর ঢাকা যাচ্ছে। মোর্শেদ অনুরোধ করে বলে,পদ্মজা আর আমিরকে খবর দিতে। ওরা যেন দ্রুত চলে আসে। রাতের ট্রেনে সকালে গোডাউনে পৌঁছে আলমগীর। আমিরকে সব বলে। আমির সব শুনে আর দেরি করেনি। পদ্মজাকে নিয়ে চলে আসে। পথে কান্নাকাটি করবে,তাই কিছু বলেনি। পদ্মজা এতসব জেনে কিছু বলল না। অভিমানের পাহাড় তৈরি হয়েছে মনে। কারো কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। সারাক্ষন চেষ্টা করছে,হেমলতার সাথে কথা বলার। হেমলতা কিছুতেই কথা বলছেন না। একটু-আধটু পানির বেশি আর কিছুই খাচ্ছেন না। গায়ে মাংস বলতে নেই। চামড়া ঝুলে গেছে। পদ্মজা হেমলতার পুরো শরীর মুছে দিয়ে কাপড় পাল্টে দিল। এরপর শোয়া অবস্থায় অযু করাল। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে আরো একবার আকুতি করল,’একবার কথা বলো আম্মা। একবার ডাকো পদ্মজা বলে।’

হেমলতা তাকালেন। কিছু বললেন না। তাকিয়েই রইলেন। মাঝরাতে সবাই যখন ঘুমে,পদ্মজা জেগে। ক্লান্ত হয়ে সবার চোখ দুটি লেগে গেলেও,তার চোখ দুটি পলকও ফেলছে না। মনে হচ্ছে,কে যেন চারপাশে ঘুরছে তার মাকে নিয়ে যেতে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক,শেয়ালের হাঁক ছাপিয়ে সে যেন কারো পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। অবচেতন মন, আজরাইলের উপস্থিতি অনুভব করছে। পদ্মজার বুকে ভয় জেঁকে বসে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। এদিকওদিক তাকিয়ে কেঁদে অনুরোধ করে,’অনুরোধ করছি,আমার মাকে কষ্ট দিবেন না।’

মুখে হাত চেপে কান্না আটকানোর প্রচেষ্টায় বার বার ব্যর্থ হতে থাকল পদ্মজা। কাঁদতে কাঁদতে কণ্ঠ নিভে এসেছে। ঠান্ডায় শরীর জমে গেছে। চোখটা লেগেছে মাত্র,তখনি দপদপ একটা শব্দ ভেসে আসে। পদ্মজা চমকে তাকাল। হেমলতা হাত দিয়ে মাটি থাপড়াচ্ছেন। শরীর কাঁপছে। পদ্মজার নিঃশ্বাস থেমে যায়। হেমলতার এক হাত শক্ত করে ধরে কেঁদে উঠে বলল, ‘আম্মা,আম্মা যেও না আমাকে ছেড়ে। ও আম্মা। আম্মা…আমার কষ্ট হচ্ছে আম্মা। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে? আম্মা পায়ে পড়ি আমাকে ছেড়ে যেও না। আম্মা…আম্মা।’

পদ্মজা দ্রুত হেমলতাকে জড়িয়ে ধরে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সবার ঘুম ছুটে যায়। একসাথে করুণ কান্নার স্বরে ভেসে উঠে মোড়ল বাড়ি। পদ্মজা কাউকে অনুরোধ করে বলে,’নিয়েন না আমার আম্মাকে। কষ্ট দিচ্ছেন কেন এতো? আমার আম্মার কষ্ট হচ্ছে। আম্মা। ও আম্মা। আম্মা আমাকে ছেড়ে যেও না।’

পদ্মজা কাঁদতে কাঁদতে সূরা ইয়াসিন পড়া শুরু করল। হেমলতা শেষবারের মতো উচ্চারণ করেন,’লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’

শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আত্মাটা বেরিয়ে যায়। শরীরের কাঁপাকাঁপি থেমে যায়। দেহটা শুধু পড়ে রয় পরিত্যক্ত বস্ত্রের মতো। পদ্মজা দেহটাকে খামচে জড়িয়ে ধরে আম্মা বলে চিৎকার করে উঠল। আশেপাশের সব বাড়ি থেকে মানুষ ছুটে আসে। পূর্ণা কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারায়। ফজরের আযান পড়ছে। আমির পদ্মজাকে হেমলতার থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিছুতেই প্রাণ বিহীন দেহটা পদ্মজা ছাড়তে চাইল না। যেন তার ডাকেই ফিরে আসবে হেমলতা। এমন কী হতে পারে না? হেমলতা কথা বলে উঠলেন। আবার হাঁটলেন। পদ্মজাকে ধমকে বললেন,’চুপ! এতো কীসের কান্না? আমার মেয়ে হবে শক্ত আর কঠিন মনের। এতো নরম হলে চলবে না।’

এটা শুধুই কল্পনা। আত্মা একবার দেহ ছেড়ে দিলে আর ফিরে আসে না। আপন ঠিকানায় ফিরে যায়। হেমলতা নামে মানুষটার আয়ুকাল এতটুকুই ছিল। তিনি উড়াল দিয়েছেন পরকালে। রেখে গেছেন আদরের তিন কন্যা। আদরের কন্যাদের ছেড়ে তো কখনো দূরে থাকতে পারতেন না! এবার কীভাবে চলে গেলেন? তিনি নিশ্চয় মৃত্যুর সাথে কঠিন যুদ্ধ করেছেন! পেরে উঠেননি।

__________________
ভোরের আলো ফুটতেই পদ্মজা নিজেকে শক্ত করল। গোসল করে এসে কোরআন শরীফ নিয়ে বসল। হেমলতা বলতেন,’মা-বাবা মারা গেলে কান্নাকাটি না করে লাশের পাশে বসে কোরঅান শরীফ পড়া ভালো। এতে করে কবরে আযাব থাকলে কম হয়। (এই কথার কোনো সত্যতা নেই। তবে অনেক গ্রামাঞ্চলের মানুষ এই কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।)

সে প্রতিটা অক্ষর পড়ছে আর কাঁদছে। জীবনের আকাশের সাতরঙা রংধনু নিভে গেছে। আর কখনো উঠবে না। কোনোদিন না। মোর্শেদ পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখের জল মুছছেন। আবার ভিজে যাচ্ছে। গোসলের পর হেমলতার মুখটা উজ্জ্বল হয়েছে। ঠোঁটের কোণে যেন হাসি লেগে আছে। পদ্মজা হেমলতার মৃত দেহের সামনে এসে দাঁড়ায়। সাদা কাপড়ে মোড়ানো লম্বা দেহটা দেখে বুকটা হাহাকার করে উঠে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,’আমি জানি,তোমার রুহ আমার পাশেই আছে। এভাবে কথা না ভাঙলেও পারতে আম্মা। বলেছিলে, কখনো কিছু লুকোবে না! বেহেশতে ভালো থেকো আম্মা। আমি পূর্ণা,প্রেমা,প্রান্তকে দেখে রাখব।’

এরপর হাটুভেঙে খাঁটিয়ার সামনে বসল। হেমলতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,’আল্লাহকে বলে খুব দ্রুত আমাকে নিতে এসো কিন্তু।’

আমির,হিমেল সহ আরো দুইজন খাঁটিয়া কাঁধে তুলে নিল। কালিমা শাহাদাত বলতে বলতে তারা সামনে এগোয়। পূর্ণাকে তিনজন মহিলা ধরে রেখেছে। সে হাত পা দিয়ে ঝাঁপিয়ে চেষ্টা করছে ছোটার। তার ইচ্ছে হচ্ছে মৃত দেহটাই আঁকড়ে ধরে রাখতে। পদ্মজা মাটিতে বসে পড়ে। কী যেন বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে! আম্মা…আম্মা বলে দুই হাতে মাটি খামচে ধরে। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে, বিড়বিড় করে,’আমার আম্মাকে কষ্ট দিও না মাটি। একটুও কষ্ট দিও না। আমার আম্মাকে যত্নে রেখ। হীরের টুকরো তোমার বুকে ঘুমাতে যাচ্ছে। কষ্ট দিও না…কষ্ট দিও না।’

__________
হাড় কাঁপানো শীতে কাঁপছে পদ্মজা। সন্ধ্যে থেকে খুব ঠান্ডা পড়েছে। এক কাপড়ে মাটিতে মা একা আছে ভেবে পদ্মজার অশান্তি হচ্ছিল। তাই কম্বল নিয়ে রাতের বেলা ছুটে আসে মায়ের কবরে। সদ্য হওয়া কবরের কাঁচা মাটির ঘ্রাণ আসছে। পদ্মজা কম্বল দিয়ে মায়ের কবর ঢেকে দিল।এরপর দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,’আম্মা…মনে আছে তোমার? যখন আমি ছোট অনেক। আব্বা আমার গায়ের কম্বল নিয়ে গিয়েছিল। তখন তুমি তোমার শাড়ির আঁচল দিয়ে সারারাত আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলে? মনে আছে? আমাকে কেন সেই সুযোগ দিলে না? কেন বললে না,তুমি মরণ রোগে আক্রান্ত। আমার জীবনে অভিশপ্ত আক্ষেপ কেন দিয়ে গেলে আম্মা? কেন পেলাম না আমার মাকে সন্তানের মতো আদর করার সুযোগ ? কোন দোষে আমার সঙ্গ তুমি নিলে না?
মৃত্যুর আগে নিজের মেয়ের সাথে এতো বড় অনাচার করে গেলে আম্মা! বিশ্বাসঘাতকতা করলে। আমিতো তোমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম। কখনো কোনো বিষয়ে জোর করিনি। জোর করে জানতে চাইনি। আমি বিশ্বাস করতাম তুমি সব বলবে আমায়। তুমি নিজে আমাকে বার বার বলেছো,তোমার জীবনের এক বিন্দু অংশ থাকবে না যা আমাকে বলবে না। তবে কেন সেই কথা রাখতে পারলে না? আমার কষ্ট হচ্ছে আম্মা। তুমি অনুভব করছো? আমি তোমার বুকে শুয়ে অভিযোগ তুলছি, তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো! আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছো দশ মাস। তুমি পারতে,আমাকে বলতে। তুমি পারতে আমাকে বিয়ে না দিয়ে নিজের কাছে রাখতে। তুমি পারতে আমাকে আরো দশ মাস আমার মায়ের সঙ্গ দিতে। আমি এতো আক্ষেপ নিয়ে কী করে বাঁচবো আম্মা?’

কয়েকটা শেয়াল দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝরাতে কবরে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেউ কাঁদতে পারে,এমন হয়তো কখনো দেখেনি তারা। পদ্মজা হেমলতার কবরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর অশ্রু বিসর্জন করছে। আত্মহত্যা পাপ না হলে হয়তো এই পথই বেছে নিত সে। মোর্শেদ,আমির টর্চ নিয়ে পদ্মজাকে খুঁজতে খুঁজতে কবরে আসে। হেমলতার কবর দেখে মোর্শেদ দূর্বল হয়ে পড়েন। পদ্মজার সাথে সাথে তিনিও কাঁদতে থাকেন। আমিরের শব্দভান্ডারে স্বান্ত্বনা মজুদ নেই। সে সাহস করতে পারল না কথা বলার। কান্না থামিয়ে পদ্মজা মুখস্থ সূরা ইয়াসিন পড়তে থাকল। সে চায় না তার মায়ের বিন্দুমাত্র কষ্ট হউক কবরে। সন্তানের আমল নাকি পারে,মৃত মা-বাবার শাস্তি কমাতে। যদি কোনো পাপের শাস্তি হেমলতার আমলনামায় থেকে থাকে তা যেন মুছে যায় পদ্মজার কণ্ঠের মধুর স্বরে। ধীরে ধীরে পদ্মজার কণ্ঠ কমে আসে। ঠান্ডায় জমে যায়। চোখের মণির রং পাল্টে যায়। আমির দ্রুত পদ্মজাকে কোলে তুলে নিল। এরপর মোর্শেদকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। হেমলতা পড়ে রইলেন একা একা। শেয়ালগুলি একসাথে চেঁচিয়ে উঠল। মৃত্যুর মতো সত্য আর নেই। জন্মালে মৃত্যুর স্বাদ উপভোগ করতেই হবে।

________________
হেমলতার ঘরে পদ্মজা আর পূর্ণা বসে আছে, দরজা বন্ধ করে। পুরো বিছানা জুড়ে হেমলতার পরনের কাপড়চোপড়। এসবই শেষ স্মৃতি। পূর্ণা দুটো শাড়ি বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে থেমে থেমে কাঁদছে। পদ্মজা মাটিতে বসে আছে। উসকোখুসকো চুল। পূর্ণা আর কাঁদতে পারছে না। বুক ফেটে যাচ্ছে তবুও শব্দ বেরোচ্ছে না। পদ্মজা হেমলতার চুড়ি দুটো হাতে নিয়ে বলল,’আম্মা বলে এখন কাকে ডাকব? পূর্ণা আমাদের আম্মা কই গেলো?’

পূর্ণা বিছানা থেকে নেমে আসে। পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা স্বরে বলল,’আল্লাহ কেন এমন করলো আপা? আমাদের প্রতি একটু দয়া হলো না।’
‘এই ঘরটায় আর আসবে না আম্মা!’
‘আপা,আম্মা আসে না কেন? আপা…আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আমাকে মেরে ফেলো।’
‘কাঁদিস না বোন। আমাদের সবার আবার দেখা হবে পরকালে। এরপর আর মৃত্যু নেই। অনন্তকাল একসাথে থাকব। ঠিক দেখা হবে।’

পালঙ্কের উপর একটা পুরনো খাতা। পদ্মজা হাত বাড়িয়ে নিল। পূর্ণা এই খাতার প্রতিটি অক্ষর আগেই পড়েছে। তাই আর ঘাঁটল না। সে ক্লান্ত দেহ নিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে। পদ্মজা খাতার পৃষ্ঠা উল্টায়,

আমার আদরের পদ্মজা,

আজ পনেরো দিন তোর বিয়ের। প্রতিটা রাত আমার নির্ঘুমে কাটে। পুরো বাড়িজুড়ে তোর স্মৃতি। স্মৃতিগুলো আমায় বিষে জর্জরিত করে দেয়। মেয়ে হয়ে জন্মালে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যেতেই হয়। তবুও মানতে কষ্ট হচ্ছে,আমার মেয়ে সারাজীবনের জন্য অন্যের ঘরে চলে গিয়েছে। বলেছিলাম,আমার জীবনের বিন্দুমাত্র অংশ তোর অজানায় রাখব না। সেই কথা রাখতে আমি লিখতে বসেছি। স্বপ্ন ছিল,তোকে অনেক পড়াব। অনেক…অনেকদিন নিজের কাছে রাখব। কিন্তু মানুষের সব স্বপ্ন কী পূরণ হয়? দীর্ঘ দুই বছর আমার শরীরে বাসা বেঁধে ছিল এক রোগ। প্রাথমিক অবস্থায় ছিল। কিন্তু পাত্তা দেইনি। যখন তোর মেট্রিক পরীক্ষার জন্য আকবর ভাইজানের বাড়িতে গেলাম তখন একজন ভালো ডাক্তারের সাথে আমার দেখা হয়। তিনি আকবর ভাইজানের বন্ধু। দেখা করতে এসেছিলেন। তখন তুই পরীক্ষা কেন্দ্রে ছিলি। উনার নাম আসাদুল জামান। বিলেত ফেরত ডাক্তার। কথায় কথায় আমার সমস্যাগুলোর কথা বলি। তিনি খালি চোখে আমাকে দেখেন। কিছু প্রশ্ন করেন। উনার ধারণা জানান, আমি পারকিনসন্স ডিজিস নামক প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত। যার ৮০ ভাগ লক্ষণ আমার সাথে মিলে যায়। তিনি দ্রুত আমাকে পরীক্ষা করতে বলেন। এই রোগের চিকিৎসা তো দূরে থাক দেশে এই রোগ পরীক্ষার কেন্দ্রও হাতেগোনা ১-২ টা আছে। সেদিনটা আমার জীবনের বড় ধাক্কা ছিল। আমি দিকদিশা হারিয়ে ফেলি। আমি মারা গেলে আমার তিন মেয়ের কী হবে? কী করে বাঁচবে? ভয়ানক এই রোগ নিয়ে তোর সামনে হাসতে আমার ভীষণ কষ্ট হতো। তবুও হাসতে হতো। মুহিব খুব ভালো ছেলে। তাই তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেইনি। আমি মারা যাওয়ার আগে তোর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম। বিয়ে ঠিক করে ফিরে আসি গ্রামে। প্রতিটা দিন,প্রতিটা মুহূর্ত অসহনীয় যন্ত্রনায় কাটতে থাকে। আসাদুল জামান ঢাকার এক হাসপাতালের নাম লিখে দিয়েছিলেন। যেখানে এই রোগের পরীক্ষা করা হয়। ১০০ ভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরীক্ষা করানোটা জরুরি। তার জন্য কেউ একজনকে দরকার পাশে। তোর আব্বাকে সব বলি। সব শুনে তোর আব্বা হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে! আল্লাহর উপর ভরসা রেখে,চলে যাই ঢাকা। আমি তখন হুঁশে ছিলাম না। মৃত্যু আমার পিছনে ধাওয়া করছিল। তাই মাথায় আসেনি,আমি না থাকলে আমার মেয়েদের কোনো ক্ষতি হতে পারে। ঢাকা যাওয়ার পথে আল্লাহর কাছে আকুতি করি,যেন পরীক্ষায় কিছু ধরা না পড়ে। বিয়েটা ভেঙে দিতে পারি। আর আমার মেয়েদেরকে নিয়ে আরো কয়টা বছর বাঁচতে পারি। কিন্তু আল্লাহ শুনলেন না। তিনি দয়া করলেন না মা! জানতে পারি,আমার হাতে সময় কম। এ রোগের নিরাময় নেই। যেকোনো বছরে যেকোনো মুহূর্তে মারা যেতে পারি। এই কথা শোনা আমার পক্ষে সহজ ছিল না। ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোদের কথা মনে পড়তেই আবার নিজেকে শক্ত করে নিয়েছি। যতদিন বাঁচব শক্ত হয়ে বাঁচব। তোর জীবন গুছিয়ে দিয়ে যাব। আমি পেরেছি। তোর বিয়ে হয়েছে। ভালো ছেলের সাথে। সুখে আছিস। এইতো শান্তি। আমার ভাবতে কষ্ট হয়, একদিন তোকে, তোদের সবাইকে আমি ভুলে যাব। এখন তো কথা ভুলে যাই। তখন নিজের নাড়ি ছেড়া সন্তানদের মুখও অচেনা হয়ে যাবে। কী নির্মম তাই না মা?

তুই ঢাকা চলে গিয়েছিস অনেকদিন হলো। আমার মনে হচ্ছে,আমাদের আর দেখা হবে না। আমার শরীরের অবস্থা ভালো না। আজ নাকি প্রান্তকে চিনতে পারিনি আমি। বেশ অনেক্ষণ ওর চেহারাটা আমার অচেনা লেগেছে। কী অদ্ভুত! ভুলে যেয়ে আবার মনে পড়ে। হাত, পা, মাথা মুখের থুতনি, চোয়াল মাঝে মাঝে খুব কাঁপে। ধীরে ধীরে শরীরের ভারসাম্য একদম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লাহাড়ি ঘরে গিয়েছিলাম,হুট করে চৌকির উপর থেকে পড়ে গিয়েছি। পূর্ণার সে কী কান্না! মেয়েটা খুব কাঁদুনে হয়েছে। একদমই হাঁটতে ইচ্ছে করে না। শক্তি কুলোয় না। তোর কথা খুব মনে পড়ে। বৃদ্ধ হয়ে তোর শরীরে ভর দিয়ে হাঁটার ইচ্ছে ছিল মনে। পেটের চামড়ার ফোস্কার মতো কী যেন হয়েছে। চুলকায়, ব্যাথা করে। রাতে ঘুম হয় না যন্ত্রনায়। তোর আব্বা আমার অশান্তি দেখে ঘুমাতে পারে না। বাসন্তী আপা সব জানে। মানুষটা অনেক ভালো। ভুল তো সবাই করে। এমন কেউ আছে? যে জীবনে ভুল করেনি। বাসন্তী আপার রান্না নাকি অনেক মজার হয়। খুব ভালো ঘ্রাণ হয়। প্রান্ত,প্রেমা সারাক্ষণই বলে। কিন্তু আমি সেই ঘ্রাণ পাই না। ঘ্রাণশক্তিটাও লুপ্ত হয়ে গেছে। কয়দিন ধরে টয়লেটও হচ্ছে না। খাবার গিলতে পারি না। কোন পাপে এমন করুণ দশা হলো আমার? বোধহয়, আর শক্তি পাবো না লেখার। পুরনো সবকিছু স্থায়ীভাবে ভুলতে আর কতক্ষণ? সব লক্ষণ তো জেঁকেই বসেছে শরীরে। বাকি শুধু দুনিয়াটাকে ভুলে যাওয়া। আজ সারারাত জেগে আরো কিছু কথা লিখতে চাই। সেদিন আমি জলিল আর মজনুর ছেলেকে খুন করেছি। ছইদ তার আগেই খুন হয়ে গিয়েছিল। আটপাড়ার বড় বিলের হাওড়ের টিনের ঘরে ওরা তিনজন সবসময় জুয়া খেলে,গাঁজা খায়। সেদিনও গাঁজা খেয়ে পড়েছিল। গিয়ে দেখি ছইদের লাশ এক কোণে পড়ে আছে। দা হাতে দাঁড়িয়ে আছে তোর দেবর রিদওয়ান। ও আমাকে দেখে পালিয়ে যায়। এরকম দৃশ্য দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি তবুও থেমে থাকিনি। ঘুমন্ত জলিল আর মজনুর ছেলেকে বেঁধে….। বাকিটুকু বললাম না। শুধু এইটুকু বলব, আমি যখন জলিল আর মজনুর ছেলেকে কোপাচ্ছিলাম তখন রিদওয়ান ঘরের এক পাশে লুকিয়ে ছিল। সে সব দেখেছে। আমি বের হতেই সে উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করে। আজও জানতে পারিনি,সে কেন ছইদকে খুন করেছে। তুই ঢাকা চলে গিয়েছিস ভেবে শান্তি লাগছে। রিদওয়ান ভয়ংকর মানুষ। তার খুন করার হাত বলছে,এটা তার প্রথম খুন নয়। সাবধানে থাকবি। আমিরকে সাবধানে রাখবি। তোর শ্বাশুড়িকে কাঁদতে দেখেছি। উনাকে আপন করে রাখবি।

আর লেখা যাচ্ছে না। হাত কাঁপছে। কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে চারিদিক। এই খাতাটা প্রান্তের। লুকিয়ে নিয়ে এসেছি। আমার সব শাড়ির সাথে ট্রাঙ্কের ভেতর যত্নে রাখছি। আমার অনুপস্থিতিতে যখন পড়বি কাঁদবি না একদম। জীবনে বড় হবি। আমি না থাকলে মৃত্যুর কামনা করবি না। এটাও এক ধরণের পাপ। আল্লাহর যখন ইচ্ছে হবে মৃত্যু দিবেন। তিনি যে কারণে সৃষ্টি করেছেন,তা পূরণ হলেই মৃত্যু ধেয়ে আসবে। শুধু মৃত্যুর কথা স্বরণ রাখবি। কোরঅানের পথে চলবি। কোনো পাপে জড়াবি না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবি না। আমাদের আবার দেখা হবে। আমার মায়ের সাথে আবার দেখা হবে। তুইতো আমার মা। আমার পদ্মজা। আমার সাত রাজার ধন। আমার তিন কন্যা আমার অহংকার। আমার বেহেশত। ভালো থাকবি। খুব ভালো থাকবি। মা কিন্তু দেখব। কান্নাকাটি করতে দেখলে ওপারে আমার শান্তি হবে না। তাই কাঁদবি না। আল্লাহ হাফেজ।’

পড়া শেষ হতেই খাতাটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে পদ্মজা। হাতপা ছুঁড়ে আম্মা,আম্মা বলে কাঁদতে থাকে। তার আর্তনাদে চারিদিক স্তব্ধ হয়ে যায়।

………

পদ্মজার মাথার ছায়া এভাবেই হারিয়ে যায়। পদ্মজা কী হয়ে উঠতে পারে নিজের ছায়া নিজে? পারবে ভাই-বোনদের আগলে রাখতে? বাকি রহস্যের কিনারায় পৌঁছাতে? সব প্রশ্নের উত্তর আছে দ্বিতীয় খন্ডে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ