Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"আমি পদ্মজাআমি পদ্মজা পর্ব-৪০+৪১+৪২

আমি পদ্মজা পর্ব-৪০+৪১+৪২

আমি পদ্মজা – ৪০
_________________

রানির অবস্থা বেগতিক। খলিল হাওলাদার দরজা বন্ধ করে এলোপাথাড়ি মেরেছেন। কারো কথা শুনেননি। রিদওয়ান বাড়ির কাজের মানুষদের হুমকি দিয়েছে, রানি গর্ভবতী এই খবর বাইরে বের হলে সব কয়টাকে খুন করবে। মগা,মদন,লতিফা,রিনু ভয়ে আধমরা। তারা নিঃশ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছে। কেউ যদি বাইরে এই খবর বের করে, নিশ্চিত সবাই তাদেরই ভুল বুঝবে। রানি মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে গেছে। সারা গায়ে মারের দাগ। ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে। আমিনা রানিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন। খলিল হাওলাদারকে বার বার পাষাণ বাপ বলে আখ্যায়িত করছেন। পদ্মজা পরিষ্কার কাপড়,পানি এনে ফরিনার হাতে দিল। ফরিনা রানির মুখে পানি ছিটিয়ে দেন। রানি কিছুতেই চোখ খুলছে না। লাবণ্য ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রানির সাথে তার সবসময় ঝগড়া হয় ঠিক। তবে ভালোও তো বাসে। দরজা বাইরে থেকে শুনেছে রানির চিৎকার। রানি চিৎকার করে ডাকছিল, ‘আম্মা,দাভাই,লাবণ্য কই তোমরা? আব্বা মাইরা ফেলতাছে। বাঁচাও তোমরা আমারে। লাবণ্য কই তুই? আম্মা….।’

দরজায় সবাই মিলে অনেক ধাক্কা দিয়েছে,ডেকেছে, খলিল হাওলাদার সাড়া দেননি। এক নিঃশ্বাসে মেরে গেছেন। রানিকে মাটিতে ফেলে জোরে জোরে লাথি মেরেছেন। রাগের বশে রানির তলপেটে বেশি আঘাত করেছেন। আর রানি আকাশ কাঁপিয়ে কেঁদেছে। কেউ পারেনি ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে। পদ্মজা আমিরের পাঞ্জাবি দুই হাতে খামচে ধরে কান্নামাখা কণ্ঠে অনুরোধ করেছে, ‘আল্লাহর দোহাই লাগে আপনি এসব থামান। চেষ্টা করুন।’

আমির অনেক চেষ্টা করেছে দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করার। পারেনি। যখন করাত আনার জন্য প্রস্তুত হয় তখন খলিল হাওলাদার বেরিয়ে আসেন। রানির গলার স্বর থেমে যায়। আর শোনা যাচ্ছে না। সবাই ভেতরে প্রবেশ করে দেখে, রানি উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শরীর রক্তাক্ত। আমিনা ‘রানি’ বলে চিৎকার করে উঠেন। ছুটে আসেন রানির কাছে। মগাকে পাঠানো হয়েছে আবার কবিরাজকে নিয়ে আসতে। এতো কিছু হয়ে যাচ্ছে,নূরজাহান একবারও নিচে নেমে আসেননি। রানি গর্ভবতী শুনে সেই যে উপরে গিয়েছেন তো গিয়েছেনই! আর আসার নাম নেই। এতো চেঁচামিচি শুনেও কী আসতে ইচ্ছে হয়নি? এতোই কঠিন মন!

কবিরাজ আসার অনেকক্ষণ পর রানি চোখ খুলে। ফরিনা আমিনাকে বললেন, ‘ছেড়ির বিয়া দিতে কইছিলাম। দিলি না। ছেড়ির কথা হুনছিলি তোরা। এহন তো মজা বুঝতেই হইবো। বিশ বছরের যুবতী ছেড়ি এখন বাপের ঘরে থাহে?’
আমিনা কিছু বলতে পারলেন না। আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন। মজিদ ঘরে প্রবেশ করেন। ফরিনাকে কিজ্ঞাসা করলেন, ‘মেয়েকে জিজ্ঞাসা করো,এই আকামের সাথী কে?’

পদ্মজা ধীরপায়ে পালঙ্কের পাশে এসে দাঁড়ায়। মাথায় ঘোমটা টানা। ফরিনা রানিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাচ্চার বাপ কেডায়?’
রানি কিছু বলছে না। ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে। চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে। ফরিনা তেজ নিয়ে বললেন, ‘কী রে ছেড়ি? এহন কথা আয় না কেন? বাচ্চার বাপের নাম কিতা? কইবি তো। বিয়া তো দেওন লাগব।’
তবুও রানি চুপ। তার কান্নার বেগ বেড়ে গেছে। মজিদ হাওলাদার লাবণ্যকে ডাক দিলেন, ‘লাবণ্য?’
লাবণ্য কেঁপে উঠল। মজিদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর তো জানার কথা। একসাথে থাকিস। কার সাথে রানির সম্পর্ক ছিল?’
লাবণ্য মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। আড়চোখে রানিকে দেখে। রানি অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য বুঝে উঠতে পারছে না,তার কী বলা উচিত? মজিদ ধমকে উঠলেন, ‘লাবণ্য, সত্য বল। কিছু লুকানোর চেষ্টা করবি না। তাহলে তোরও এই দশা হবে।’

লাবণ্য ভয়ের চোটে গড়গড় করে বলতে থাকল, ‘আপার সাথে আবদুল ভাইয়ের প্রেম আছে। দুইজনে প্রায়ই দেখা করে বাড়ির পিছনে। খালের পাড়ে। অনেক বছর হইছে প্রেমের।’

রানির কান্নার শব্দ বেড়ে যায়। ফরিনা ঝাঁঝালো কণ্ঠে রানিকে বলেন, ‘এই ছেড়ি চুপ কর! এহন মেলাইতাছস কেরে? কুকাম করার সময় মনে আছিলো না? আমরারে কইতে পারলি না তোর আবদুলরে পছন্দ। আর আবদুলই কেমন ধাঁচের মানুষ? প্রস্তাব লইয়া আইতে পারে নাই? তোরে ডাইকা লইয়া কুকাম কইরা বেড়াইছে।’
‘নিজের বাড়ি বানায়া প্রস্তাব লইয়া আইবো কইছিল।’ রানি কাঁদতে কাঁদতে বলল। ফরিনা পাল্টা বললেন, ‘কয়দিন তর সয় নাই? শরীর গরম হইয়া গেছিল বেশি? খারাপ ছেড়ি কোনহানের।’
আমির ঘরে ঢুকতেই মজিদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আবদুলরে ধরে নিয়ে আয়।’
আমির অবাক হয়ে বলল,’আবদুল করছে এই কাজ? ও তো এমন না।’
‘মুখ দেখে বোঝা যায় কে কেমন?’

আমির উত্তরে কিছু বলল না। রানি আহত দূর্বল শরীর নিয়ে দ্রুত বিছানা থেকে নামে। আমির ঘর থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়িয়েছে সবেমাত্র। রানি আমিরের পায়ে ধরে বসে পড়ে। আকুতি করে বলল, ‘দাভাই, উনারে কিছু কইরো না। উনারে মাইরো না। আমি তোমার পায়ে পড়ি। ও কাকা,আমারে মারো। উনারে মাইরো না।’
‘কী পাগলামি করছিস? পা ছাড়,রানি।’
‘দাভাই, দোহাই লাগে।’

আমির রানিকে দুই হাতে তুলে দাঁড় করাল। এরপর কোমল কণ্ঠে বলল, ‘কিছু করব না। শুধু নিয়ে আসব। বিয়ে পরিয়ে দেব।’
‘সত্যি দাভাই?’
‘সত্যি।’

রানি হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছে। আমির বেরিয়ে যায়। মজিদ চোখমুখ কঠিন অবস্থানে রেখে ঘর ছাড়েন। রানি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নিলেই পদ্মজা ধরে ফেলে। আমিনা,ফরিনা এগিয়ে আসেন। তারপর রানিকে ধরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। বিয়ে হবে শুনে ভেতরে ভেতরে রানির খুব আনন্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগের সব মার, ব্যাথা তুচ্ছ মনে হচ্ছে। রানি আবদুলকে এতো বেশি ভালোবাসে যে,আবদুলের এক কথায় সে বিয়ের আগে ঘনিষ্ঠ হতে রাজি হয়। যখন যেখানে যেতে বলেছে,তখন সেখানেই গিয়েছে। দ্বিতীয়বার ভাবেনি। অন্ধভাবে ভালোবেসেছে। কতদিনের স্বপ্ন! কত আশা! পূরণ হবে অবশেষে। রানি নিজের অজান্তে বাঁকা হাসে। তৃপ্তিকর হাসি! কিছু পাওয়ার হাসি! উপস্থিত আর কেউ খেয়াল না করলেও, সেই হাসি পদ্মজা খেয়াল করে। এই হাসি বেশিক্ষণ থাকল না। বিকেলবেলা আমির দুঃসংবাদ নিয়ে ফিরল। আবদুল খুন হয়েছে গত রাতে! মাদিনী নদীতে লাশ পাওয়া গেছে। আবদুলের বাড়িতে পুলিশের ভীড়! রানির কানে কথাটা আসতেই এক চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।জীবনের সুখের আলো নিভে যায়। নিভে যায় স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছের প্রদীপ।

পদ্মজা এই খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিটা মৃত দেহ নদীতেই কেন পাওয়া যায়? এতে কী প্রমাণ পানির সাথে ধুয়ে যায়? আগের খুন গুলোর খুনি কী এই আবদুলের খুনি? পদ্মজা চেয়ার টেনে বসে। মাথা ব্যাথা করছে খুব। রগ দপদপ করে কাঁপছে। চোখ বন্ধ করে ভাবে, এই অলন্দপুরে পাপের সাম্রাজ্য কারা তৈরি করেছে? ভাবতে গেলে শরীর কেমন করে! শূন্য হাত নিয়ে ভাবনা থেকে বের হতে হয়। কূল কিনারা পাওয়া যায় না।

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

আমি পদ্মজা – ৪১
___________________
সূর্যমামার ঘুম ভাঙতে তখনো বাকি। তবে তার আগেই ডাকাডাকি করে সবার ঘুম ভাঙানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে পাখিরা। পদ্মজা স্বামীর বুকের ওম ঝেড়ে ফেলে অজু করে আসে। এসে দেখে তার সোহাগের স্বামী এখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। পদ্মজা ডেকে তুলে, একসাথে ফজরের নামায আদায় করে। নামায শেষ করেই আমির ঘুমিয়ে পড়ে। পদ্মজা রান্নাঘরে যায়। গিয়ে দেখে,ফরিনা বেগম এখনও আসেননি। আজ মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল। উত্তেজনায় পদ্মজার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। সে পায়চারি করতে করতে লাবণ্যর ঘরের সামনে আসে। দরজা খোলা। পদ্মজা বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, রানি মাটিতে বসে আছে। উদাস হয়ে কিছু ভাবছে। রাতে ঘুমায় না। নিজের মতো জগত করে নিয়েছে। খাবার রেখে যাওয়া হয়,যখন ইচ্ছে হয় খায়। পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এরপর জায়গা ত্যাগ করল। রানি অন্য কাউকে দেখলে খুব রেগে যায়। তাই এই ভোরবেলা তার সামনে না যাওয়াই মঙ্গল। পদ্মজা সদর ঘরে পায়চারি করতে থাকল। ফরিনা বেগম তাসবিহ পড়তে পড়তে সদর ঘরে প্রবেশ করেন। পদ্মজাকে দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘উইট্টা পড়ছ তুমি! চুলায় আগুন ধরাইছো?’

পদ্মজা অপরাধীর মতো মাথা নত করে ‘না’ উচ্চারণ করল। ফরিনা এ নিয়ে কথা বাড়ালেন না। মৃদু কণ্ঠে আদেশ করলেন, ‘লাবণ্যরে ডাইককা তুলো গিয়া। ছেড়িডা আইজও মানুষ হইলো না। ভোরের আলো ফুইটা গেছে। হে এহনও ঘুমায়।’
‘আচ্ছা,আম্মা।’

পদ্মজা আবার লাবণ্যর ঘরের সামনে আসল। এবার আর বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে চলে যায়নি। ভেতরে ঢুকল। পদ্মজা আওয়াজ করে দরজা খুলে। তাও রানির ভাবান্তর হলো না। সে যেভাবে মাটিতে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল,সেভাবেই রয়েছে। পদ্মজা রানির দিকে চেয়ে চেয়ে পালঙ্কের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এরপর লাবণ্যকে ডাকল, ‘এই লাবণ্য। লাবণ্য?’
লাবণ্য আড়মোড়া ভেঙে ঘুমু ঘুমু চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, ‘উ?’
‘আজ ফলাফল। আর তুই ঘুমাচ্ছিস।’
পদ্মজার কথা বুঝতে লাবণ্যর অনেক সময় লাগল। যখন বুঝতে পারল লাফিয়ে উঠে বসল। বুকে হাত রেখে, হাসঁফাঁস করতে করতে বলল, ‘কী বললি এটা! দেখ কলিজাডা লাফাইতাছে। কী ভয়ানক কথা মনে করায়া দিলি, উফ!’
পদ্মজা হাসল। বলল, ‘কলিজা লাফায় না,বুক ধুকপুক করে।’
‘হ,ওইটাই…ওইটাই। আমি ফেইল করব। রানি আপার মতো মাইর খাব দেখিস। আমার শ্বাস কষ্ট হইতাছে।’ লাবণ্য ভয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সে আতঙ্কে আছে। এই চিন্তায় রাতে ঘুম আসেনি। ঘুমাতে ঘুমাতে মাঝরাত হয়ে গেছে। পদ্মজা লাবণ্যর ছটফটানি দেখে ভয় পেয়ে যায়। স্বান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘এমন কিছুই হবে না, দেখিস। বেহুদা চিন্তা করছিস। সূর্য উঠে যাবে। নামায পড় জলদি। আল্লাহর কাছে দোয়া কর।’
লাবণ্য হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে,কলপাড়ে ছুটে যায়। এইবার পদ্মজা হেসে ফেলল। রানির দিকে চোখ পড়তেই হাসিটা মিলিয়ে যায়। রানি কাঁদছে। পদ্মজা দুই পা রানির দিকে এগিয়ে আবার পিছিয়ে যায়।
আবার এগিয়ে যায়। রানির পাশে বসে ডাকল, ‘আপা?’
রানি চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে তাকায়। পৃথিবীর সব কষ্টরা বুঝি এক জোট হয়ে রানির চোখে ভীড় জমিয়েছে। রানি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট এতোডা যন্ত্রনা কেন দেয় পদ্মজা? তুমি তো অনেক জ্ঞানী। সবাই তোমারে বুদ্ধিমতী কয়। তুমি একটা বুদ্ধি দেও না। এই কষ্টের পাহাড় কমানোর বুদ্ধি। আমারে দেখায়া দিবা শান্তির পথ?’
মানুষের কতটা কষ্ট হলে এভাবে শান্তি খুঁজে? পদ্মজার চোখ টলমটল করে উঠে। সে ঢোক গিলে বলল, ‘পুরনো স্মৃতি মুছে সামনের কথা ভাবো। নামায পড়ো, হাদিস পড়ো,কোরআন পড়ো। একদিন ঠিক শান্তি খুঁজে পাবা।’
‘আমার মতো পাপীরে আল্লাহ কবুল করব?’
‘আল্লাহ তায়ালার মতো দয়াবান, উদার আর কেউ নেই। পাপ মুছার জন্য অনুতপ্ত হয়ে সেজদা দিয়েই দেখো না আপা। ক্ষমা চেয়ে দেখো। আল্লাহ ঠিক তোমার জীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনবেন। সেদিন বুঝবে,আল্লাহ তোমার সেজদা কবুল করেছেন।’
রানি জানালার বাইরে তাকায়। আমগাছের ডালে চোখ রেখে বলল, ‘কেন এমনডা হইলো আমার সাথে?’
“ব্যভিচার করেছো আপা। বিয়ের আগে এভাবে…! আপা এসব ভেবো না আর। যা হওয়ার হয়েছে।’
‘দুনিয়াত আর চাওনের বা পাওনের কিচ্ছু নাই আমার।’
‘আখিরাতের জন্য সম্পদ জমাও এবার।’
রানি অন্যরকম দৃষ্টি নিয়ে পদ্মজার দিকে তাকায়। পদ্মজা মাথায় সোজা সিঁথি করে সবসময়। এক অংশ সিঁথি দেখা যাচ্ছে। বাকিটুকু শাড়ির আঁচলে ঢাকা। মেয়েটা এত স্নিগ্ধ, এতো সুন্দর, এতো পবিত্র দেখতে! দেখলেই মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। পদ্মজা বলল,’আখিরাতের সম্পদ এবাদত, খাঁটি এবাদত।’
‘তুমি খুব ভালো পদ্মজা।’ রানি মৃদু হেসে বলল। তার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। পদ্মজা অপ্রস্তুত হয়ে হাসল। বলল,’এখন নামায আদায় করতে পারবে? তাহলে পড়ে নেও।’
‘ ওইদিনডার পর আর গোসল করি নাই।’
‘আজ করবে কিন্তু।’
‘করব।’
‘আসি?’
‘আসো।’
পদ্মজা বেরিয়ে আসে। দরজার বাইরে পা রাখতেই রানির কান্নার স্বর কানে আসে। পদ্মজা থমকে দাঁড়ায়। পিছন ফিরে একবার রানিকে দেখে। রানি হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। পদ্মজা মনে মনে প্রার্থনা করে, ‘আল্লাহ,ক্ষমা করে দাও রানি আপাকে। শান্তির পথে ফিরে আসার রহমত দাও।’

__________________
বাড়ির সবাই মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আমির সেই সকাল দশটায় বের হয়েছে। এখন বাজে,দুপুর তিনটা। লাবণ্য মিনিটে মিনিটে গ্লাস ভরে পানি খাচ্ছে। আর বার বার টয়লেটে যাচ্ছে। পদ্মজা ঝিম মেরে বসে আছে। হেমলতা সবসময় পদ্মজাকে বলতেন, মেট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়ার জন্য। পদ্মজার একবার মনে হচ্ছে সে ফার্স্ট ডিভিশন ফলাফল করবে। আরেকবার মনে হচ্ছে, সেকেন্ড ডিভিশনে চলে যাবে। সে এক হাতের আঙুল দিয়ে অন্য হাতের তালু চুলকাচ্ছে। এই মুহূর্তে মাকে খুব মনে পড়ছে। কতদিন হলো,দেখা হয় না। প্রথম প্রথম মায়ের জন্য প্রায় কাঁদতো সে। এখন অবশ্য মানিয়ে নিয়েছে। আছরের আযান পড়ছে। এখনও ফিরেনি আমির। পদ্মজা নামায পড়তে চলে যায়। নামায পড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এরপর যা দেখল, খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে সে। আমিরের সাথে হেমলতা, পূর্ণা এসেছে। দুজনের পরনে কালো বোরখা। তিনজন আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে আসছে। মাথার উপর কড়া রোদ নিয়ে মরুভূমিতে সারাদিন হাঁটার পর পথিক তৃষ্ণার্ত হয়ে পানির দেখা পেলে যেমন আনন্দ হয়,ঠিক তেমন আনন্দ হচ্ছে পদ্মজার। ইচ্ছে হচ্ছে দুই তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে যেতে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। পদ্মজা উন্মাদের মতো দৌড়াতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় উল্টে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। তবুও দৌড় থামল না। সদর ঘরের সবাইকে তোয়াক্কা না করে বাড়ির বউ ছুটে বেরিয়ে যায়। হেমলতা কিছু বুঝে উঠার আগেই তার নয়নের মণি ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে। পদ্মজার ছোঁয়ায় চারিদিকে যেন বসন্ত শুরু হয়। পূর্ণা পদ্মজাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে, ফোঁপাতে থাকল। পদ্মজা হেমলতার বুকে মাথা রেখে পূর্ণাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘এতদিনে আসতে মনে হয়েছে তোমাদের? এভাবে পর করে দিলে আম্মা? আর পূর্ণা,তুইতো আসতে পারিস। বোনকে মনে পড়ে না?’

শাড়ির আঁচল টেনে পদ্মজার মাথার চুল ঢেকে দিলেন হেমলতা। এরপর বললেন, ‘মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আসা কী এতই সোজা?’
‘তাহলে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর কী দরকার? যদি মা-বাবা সহজে না আসতে পারে।’
‘আপা..আমার তোমাকে খুব মনে পড়ে।’ পূর্ণা বাচ্চাদের মতো করে কাঁদছে। পদ্মজা পূর্ণার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ‘আমারও মনে পড়ে।’
হেমলতা পদ্মজার চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, ‘৭৫০ মার্ক পেয়েছিস। স্টার মার্ক। ফার্স্ট ডিভিশন। এই খুশিতে আর কাঁদিস না।’
পদ্মজার চোখভর্তি জল। গাল,ঠোঁট চোখের জলে ভেজা। এমতাবস্থায় হাসল। তাকে মায়াবী ভোরের শিশিরের মতো দেখায়। হেমলতা অন্দরমহলের সদর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেন, হাওলাদার বাড়ির বাকিরা তাকিয়ে আছে। তিনি পদ্মজাকে সরিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে আসেন। ফরিনা বেগমের মুখ দেখে পদ্মজার ভয় হচ্ছে। উনার মুখ আগে আগে ছুটে। আম্মাকে কিছু বলবেন না তো?
হেমলতা সবাইকে সালাম দিয়ে বললেন, ‘আমির ধরে নিয়ে আসলো।’
মজিদ হাওলাদার বিনীত স্বরে বললেন, ‘এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আজ আসবেন আগে জানলে, গরু জবাই করে রাখতাম।’
হেমলতা হাসলেন। বললেন, ‘বলেছেন, এই অনেক।’
‘বললেই হবে না। করতে হবে। কয়দিন কিন্তু থেকে যাবেন।’
‘এটা বলবেন না। আজই ফিরতে হবে আমার। কিছুক্ষণ থেকেই চলে যাব।’
‘প্রথম বার আসলেন আর কিছুক্ষণ থেকেই চলে যাবেন?’
‘আবার আসব। অনেকদিন থেকে যাবো।’
‘আজকের রাতটা থেকে যান।’
‘আম্মা আজ থেকে যাও,আমার সাথে।’ পদ্মজা অনুরোধ করে বলল।

হেমলতা হাসলেন। ফরিনা কিছু বলছেন না। ভ্রুকুটি করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হেমলতাকে ভেতরে ভেতরে ভয় পান। কেমন ধারালো চোখের দৃষ্টি। যেন, একবার তাকিয়েই ভেতরের সব দেখে ফেলতে পারে। আর চোখমুখের ভাব দেখলে মনে হয়, কোন দেশের রাজরানি। তার উপর আমির দরদ দেখিয়ে শ্বাশুড়ি নিয়ে এসেছে। ফরিনা বিরক্ত হচ্ছেন। হেমলতা ফরিনার দিকে তাকাতেই ফরিনা চোখ সরিয়ে নেন। হেমলতা ফরিনাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপা,কথা বলছেন না যে? আমার উপস্থিতি বিরক্ত করেছে খুব?’
হেমলতার কথার ফরিনা সহ উপস্থিত সবাই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ফরিনা হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, ‘কী বলছেন আপা? বিরক্ত হইতাম কেরে? এই পরথম আইছেন। খুশিই হইছি।’
‘তাই বলুন।’
‘ দরজায় দাঁড়ায়া গপ আর কতক্ষণ হইবো। ঘরে আহেন।’ ফরিনা দ্রুত সটকে পড়েন। সদর ঘরে আগে আগে হেঁটে আসেন। হাঁপাতে থাকেন। বিড়বিড় করেন, ‘মহিলা এত্ত চালাক। সত্যি সত্যি সব বুইঝা ফেলে।’

হেমলতা সবার আড়ালে শাড়ির আঁচল মুখে চেপে সেকেন্ড দুয়েক হাসলেন। হেমলতাকে হাসতে দেখে, পদ্মজাও হাসল। সবাই সদর ঘরে এসে বসে। লাবণ্য ও পদ্মজার ফলাফল দেওয়ার উপলক্ষে শিরিন,শাহানাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। তারা এখন হাওলাদার বাড়িতেই আছে। দুই বোন হেমলতা,পূর্ণার জন্য নাস্তা তৈরি করতে রান্নাঘরে গেল। লাবণ্য দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছে। আমির এখনও লাবণ্যর ফলাফল কাউকে বলেনি। সে সদর ঘর থেকে লাবণ্যকে ডাকল, ‘লাবণ্য? এই লাবণ্য? শুনছিস? এদিকে আয়। আজ তোর খবর আছে।’
আমিরের কথা শুনে লাবণ্যর বুকের ধুকপুকানি থেমে যায়। এখুনি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে অবস্থা। নিশ্চিত ফেইল করেছে! লাবণ্য চিৎ হয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে থাকে,কখন সে মারা যাবে। আমির আবার ডাকল, ‘বেরিয়ে আয় বলছি। নয়তো দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকব। তখন কিন্তু গায়ে মার বেশি পড়বে।’
লাবণ্য তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামে। গায়ের ওড়না ঠিক করে দরজা খুলে। সদর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে নামাযের সব সূরা পড়তে থাকে।
আমির চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতেই লাবণ্য কেঁপে উঠে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘আগামী বছর মেট্রিকে পাশ করাম, কসম!’
‘এই বছরই তো পাশ করেছিস! তাহলে আগামী বছর আবার মেট্রিক দিবি কেন?’

লাবণ্য চকিতে তাকাল। তার মুখটা হা হয়ে যায়। লাবণ্যর মুখের ভঙ্গি দেখে সবাই হাসল। লাবণ্য খুশিতে কেঁদে দিল। আমির লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে,মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’আরেকটুর জন্য ফেইল করিসনি।’
লাবণ্য হাসতে হাসতে কাঁদছে। লাবণ্যর পাগলামি দেখে আমিরও হাসছে। তখন সদর ঘরে প্রবেশ করে রিদওয়ান হাওলাদার। হেমলতা রিদওয়ানের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকান। হেমলতার চোখে চোখ পড়তেই রিদওয়ান বিব্রত হয়ে উঠে। চোখ সরিয়ে নেয়। একটু পর আড়চোখে তাকিয়ে দেখে,হেমলতা তখনও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন। রিদওয়ান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। এ যেন সাপুড়ে ও সাপের খেলা।

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

আমি পদ্মজা – ৪২
_________________
রাতের খাবার শেষ হয়েছে সবেমাত্র। এশার আযান পড়েছে অনেক আগে। পূর্ণা পদ্মজা ও লাবণ্যকে পেয়ে পুলকিত। আনন্দ বয়ে যাচ্ছে মনে। একটু পর পর উচ্চস্বরে হাসছে। হেমলতা একবার ভাবলেন নিষেধ করবেন,এতো জোরে হাসার জন্য। এরপর কী ভেবে আর নিষেধ করলেন না। তিনি বাড়ির বড়দের সাথে কথা বলছেন। আমির সবার মনোযোগ পাওয়ার জন্য বলল, ‘আমার একটা কথা ছিল।’
সবাই আমিরের দিকে তাকাল। আমির নির্দ্বিধায় বলল,’আগামীকাল ফিরব আমি।’
হেমলতা বললেন,
‘ঢাকায়?’
‘জি। পদ্মজাকে নিয়েই যাব। সাথে লাবণ্যও যাবে। দুজনকে কলেজে ভর্তি করে দেব।’
লাবণ্য পূর্ণার পাশ থেকে উঠে এসে,আমিরের পাশে দাঁড়াল। আবদার করে বলল, ‘দাভাই,তুমি কইছিলা আমি পাশ করলে,আমারে দেশের বাইরে পড়তে পাঠাইবা।’
‘ছেড়ি মানুষ বাইরে যাইতি কেন? কইলজাডা বড় হইয়া গেছে?’ রেগে বললেন ফরিনা।
লাবণ্য মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে আমিরকে বলল,’কথা রাখতে হইবো তোমার।’
আমিরে একবার মজিদকে দেখল। এরপর লাবণ্যকে বলল,’সত্যি যেতে চাস?’
‘হ।’
লাবণ্যর মাথায় গাট্টা মারল আমির। এরপর বলল, ‘আগে শুদ্ধ ভাষাটা শিখ। এরপর দেশের বাইরে পড়তে যাবি।’
লাবণ্য আহ্লাদিত হয়ে বলল, ‘পদ্মজা শিখায়া দিব।এইডা কোনো ব্যাপার না দাভাই।’
‘আপাতত ঢাকা চল। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে অভ্যস্ত হ। এরপর সত্যি পাঠাব।’
‘তুই পাগল হইয়া গেছস বাবু? এই ছেড়িরে একা বাইরে পাডাইয়া দিবি?’
‘জাফর ভাই আছে,ভাবি আছে। সমস্যা নেই আম্মা। একটাই তো বোন আমার। নিজের মতো পড়াশোনা করুক।’

ফরিনা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন। মজিদ কথা বলছেন না। মানে তিনিও আমিরের দলে। তাহলে আর কথা বলে কী হবে? এই সংসারে এমনিতেও তার দাম নেই। কেউ কথা শুনে না। নিজের মতোই বকবক করেন। ফরিনা উঠে চলে যান। হেমলতা বললেন,’কালই চলে যেতে হবে? দুই-তিন দিন পর হবে না?’

আমির নম্র ভাবে বলল, ‘না আম্মা। আমি আট বছর হলো ঢাকা গিয়েছি। এর মধ্যে এই প্রথম তিন মাসের উপর গ্রামে থেকেছি। ব্যবসা ফেলে এসেছি। আমার অনুপস্থিতিতে আলমগীর ভাইয়া সামলে ছিল। এখন তো ভাইয়াও চলে এসেছে। আর আমার ব্যবসা আমারই সামলানো উচিত। যত দ্রুত সম্ভব যেতে চাই। আপত্তি করবেন না।’
হেমলতা পদ্মজার দিকে চেয়ে বললেন,’তাহলে আগামীকালই যাচ্ছো?’
‘জি। আব্বা,আম্মাকে তো অনেক আগেই বলেছি। পদ্মজাও জানে। কিন্তু পদ্ম ভাবেনি সত্যি সত্যি যাব। দেখুন, কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কাল চলে যাব বলেই আজ আপনাকে নিয়ে এসেছি। আজ রাতটা মেয়ের সাথে থাকেন। আবার কবে দেখা হয়!’
হেমলতা বেশ অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থাকেন। তারপর বললেন,’তোমাদের কীসের ব্যবসা আজও জানলাম না।’
মজিদ অবাক হয়ে বললেন,’আত্মীয় হলেন এতদিন এখনও জানেননি মেয়ের জামাই কীসের ব্যবসা করে! বাবু, এটাতো বলা উচিত ছিল?’
‘আমিতো ভেবেছি জানেন। তাই বলিনি। আম্মা,আমাদের এক্সপোর্ট ইমপোর্ট বিজনেস। মানে মালামাল বিভিন্ন দেশে আমদানি -রপ্তানি করা হয়। এ কাজে আব্বা,রিদওয়ান, ভাইয়া,চাচা আছে। তাছাড়া, নিম্নমানের দেশগুলো থেকে কম দামে পণ্য এনে উন্নত দেশগুলোতে বেশি মূল্যে বিক্রি করি। সব পণ্য গোডাউনে রাখা হয়। আমাদের অফিসও আছে। গোডাউন আর অফিসের সব কাজ আমাকে সামলাতে হয়। বলতে পারেন, আমারই সব।’
‘অনেক বড় ব্যাপার।’ হেসে বললেন হেমলতা। তিনি জানতেন না আমির এতোটা বিত্তশালী। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট বিজনেস কম কথা নয়। এ সম্পর্কে মোটামুটি তিনি জানেন। কলেজ থাকাকালীন জেনেছেন।

পদ্মজাকে পূর্ণা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। পদ্মজা বলল,’কথা বলছিস না কেন?”
‘কাল চলে যাবা আপা?’
‘তাই তো কথা হচ্ছে।’
‘আমার খুব মনে পড়ে তোমাকে।’
‘কাঁদছিস কেন? আসব তো আমি।’
‘সে তো অনেক অনেক মাস পর পর।’

পদ্মজা কিছু বলতে পারল না। হেমলতা কথা বলছেন আমির আর মজিদের সাথে। খলিল,আলমগীর নীরব দর্শক হয়ে বসে আছে। বিকেল থেকে রিদওয়ানের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মজা হেমলতার উপর চোখ রেখে পূর্ণাকে প্রশ্ন করল,’আম্মা খুব শুকিয়েছে। খায় না?’
‘না। মাঝে মাঝে সারাদিন পার হয়ে যায় তবুও খায় না।’
‘জোর করে খাওয়াতে পারিস না?’
‘ধমক মারে। শুনে না কথা।’
‘আম্মা ঘাড়ত্যাড়া।”
‘ঠিক বলেছো।’
‘উনি কেমন? ঝগড়া করে আম্মার সাথে?’
‘উনিটা কে?’
‘আব্বার প্রথম বউ।’
‘তুমিতো দেখতেও যাওনি।’
‘শ্বশুরবাড়ি থেকে চাইলেই যাওয়া যায় না। বল না,কেমন? আদর করে তোদের?’
‘ভালো খুব। সহজ,সরল। আম্মাকে খুব মানে। প্রেমা-প্রান্তকে অনেক আদর করে। দেখতেও খুব সুন্দর। আগে সাপুড়ের বউদের মতো সাজতো। আমার পছন্দ না বলে এখন আর সাজে না।’
‘তুই নাকি খুব খারাপ ব্যবহার করিস?’
‘এখন করি না। তুমি কাকে দিয়ে এতো খোঁজ রাখো?’
‘সে তোর জানতে হবে না। তাহলে উনি ভালো তাই তো?’
‘হুম।’
‘মিলেমিশে থাকিস তাহলে।’
‘ঢাকা যাওয়ার আগে দেখে যাও একবার।’
‘বাপের প্রথম বউকে দেখার ইচ্ছে নেই আমার।’ পদ্মজা থমথমে স্বরে বলল।
পূর্ণা বলল,’আচ্ছা। আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাব।’
‘হুম ঘুমাবি। আম্মার খেয়াল রাখবি। আম্মাকে দেখে মনে হচ্ছে,কোনো বিষয় নিয়ে খুব চিন্তা করে। সারাক্ষণ ভাবে। তুই কথা বলবি,সময় দিবি।’
‘আমি তোমার মতো সব সামলাতে পারি না।’
‘চেষ্টা করবি। ভোরে উঠে মগা ভাইয়াকে পাঠাব। আব্বা আর প্রেমা-প্রান্তকে নিয়ে আসতে। সবাইকে চোখের দেখা দেখে যাব।’

পূর্ণা পদ্মজাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কান্না পাচ্ছে খুব। কত দূরে চলে যাবে তার আপা! পদ্মজা অনুভব করে পূর্ণার ভেতরের আর্তনাদ। সে পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘খুব দ্রুত আসব।’

______________
পদ্মজা মাঝে শুয়েছে। তার দুই পাশে হেমলতা আর পূর্ণা। পূর্ণা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে পদ্মজাকে। আর পদ্মজা হেমলতার এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। হেমলতা নিরবতা ভেঙে পদ্মজাকে বললেন,’পদ্ম?’
‘হু,আম্মা?’
‘ শহরে নিজেকে মানিয়ে নিবি। শক্ত হয়ে থাকবি। আর মনে রাখবি, কেউ কারোর না। সবাই একা। সবসময় নিজের উপর বিশ্বাস রাখবি,নিজের উপর আস্থা রাখবি। সৎ পথে থাকবি। কখনো কারো উপর নির্ভরশীল হবি না। যদি তুই কারো উপর ভালো থাকার দায়িত্ব দিয়ে দিস,কখনো ভালো থাকবি না। নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব নিজেরই নিতে হয়। নিজেকে কখনো একা ভাববি না। যেখানেই থাকি আমি, আমার প্রতিটা কথা তোর সাথে মিশে থাকবে। ছায়া হয়ে থাকবে। আল্লাহ সবাইকে কোনো না কোনো উদেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। সেই উদ্দেশ্য সফল হলে আর বেঁচে থাকার মানে থাকে না। মৃত্যুতে ঢলে পড়ে। আমার ইদানীং মনে হয়, আমার দায়িত্ব ছিল তোকে জন্ম দেয়া,বড় করে তোলা,বাস্তবতা দেখানো। সেই দায়িত্ব কতটুকু রাখতে পেরেছি জানি না। কিন্তু তোর দায়িত্ব অনেক বড় কিছু!’
পদ্মজা চাপা স্বরে বলল,’কী সেটা?’
‘জানি না।’
‘তুমি এতো কী ভাবো আম্মা? মুখটা এরকম ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে কেন? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করবে। আমি পরেরবার এসে যেন দেখি,মোটা হয়েছো।
হেমলতা হাসলেন। সাদা ধবধবে দাঁত ঝিলিক মারে। তিনি পদ্মজাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,’পরেরবার যখন আসবি একদম অন্য রকম দেখবি।’
‘কথা দিচ্ছো?’
‘দিচ্ছি।’
পদ্মজা হাসল। পূর্ণা বলল,’আমাকেও জড়িয়ে ধরো আপা।’

পদ্মজা পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে। আর হেমলতা দুই মেয়েকে একসাথে জড়িয়ে ধরেন। তারপর বললেন,’এবার চুপচাপ ঘুম হবে। কোনো কথা না।’

মাঝরাতে হেমলতার ঘুম ভেঙে যায়। তিনি চোখ খুলে কান খাড়া করে শুনেন,কেউ হাঁটছে। কাঁথা গা থেকে সরিয়ে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামেন। সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েন। পায়ের শব্দটা যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে যান। সাদা পাঞ্জাবি পরা একটা পুরুষের অবয়ব দেখতে পান। তিনি তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকলেন,’রিদওয়ান? ‘

রিদওয়ান কেঁপে উঠে পিছনে ফিরল। চোখ দুটি বড় বড় হয়ে যায়। সে যে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে,দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হেমলতা প্রশ্ন করলেন,’এত রাতে এখানে কী করছো?’
‘জ…জি হাঁটছিলাম।’
‘এতো রাতে?’
‘প্রায়ই হাঁটি। জিজ্ঞাসা করতে পারুন অন্যদের।’
হেমলতা রিদওয়ানকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করে নিয়ে বলল,’ কোনোভাবে আমাকে খুন করতে এসেছো কী?’
রিদওয়ান থতমত খেয়ে গেল। বলল, ‘ন..না না! আপনাকে কেন খ..খুন করতে যাবো?’
‘প্রমাণ সরাতে।’ হেমলতার সহজ কথা।
রিদওয়ান হঠাৎই অন্যরকম স্বরে কথা বলল, ‘সে তো আমিও একজন প্রমাণ। স্বচক্ষে দেখা জ্বলজ্বলন্ত প্রমাণ। আপনিও আমাকে খুন করে প্রমাণ সরাতে পারেন। যেহেতু দুজনই একই পথের। কাউকে কারোর খুন করার প্রয়োজন নেই। আমি এখানে অন্য কাজে এসেছি।’
হেমলতা কঠিন চোখে তাকান। পরপরই চোখ শীতল করে নিয়ে বললেন,’শুভ রাত্রি।

রিদওয়ান হেসে হেলেদুলে হেঁটে চলে যায়। হেমলতা ঘরের ঢুকার জন্য ঘুরে দাঁড়ান। হাঁটার পূর্বেই শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান। ভাগ্যিস আওয়াজ হয়নি! তিনি হাতে ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করেন। বাম হাতের মাংস পেশি শক্ত হয়ে আছে। হাত নাড়াতে কষ্ট হয়। ভর দিয়ে উঠা আরো কষ্টদায়ক। তিনি ওভাবেই বসে থাকলেন অনেকক্ষণ।

চলবে….
®ইলমা বেহরোজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ