Monday, October 6, 2025







আমি পদ্মজা পর্ব-১১+১২

আমি পদ্মজা – ১১
___________
মাঘ মাস চলছে। কেটে গেছে চার মাস। শুষ্ক চেহারা আর হিমশীতল অনুভব নিয়ে পদ্মজা বসে আছে নদীর ঘাটে। গুনে গুনে তিন নম্বর সিঁড়িতে। নাকের ডগায় মেট্রিক পরীক্ষা। দিনরাত পড়তে হচ্ছে। নিয়ম করে প্রতিদিন ভোরে পড়া শেষ করে পদ্মজা। এরপর ঘাটে এসে বসে নিজের অনুভূতিদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। কখনো উদাস হয়ে আবার কখনো লাজুক মুখশ্রী নিয়ে ভাবে কারো কথা। সেই যে চিঠি দিয়ে হারালো আর সাক্ষাৎ মিললো না তার। কখনো কী মিলবে? তিনি কী আসবেন? এক চিঠি প্রতিদিন নিয়ম করে পড়ে পদ্মজা। ধীরে ধীরে অনুভব করে তার মধ্যে আছে অন্য আরেক সত্ত্বা। যে সত্ত্বা প্রতিটি মেয়ের অন্তঃস্থলের গভীরে জেঁকে বসে থাকে ভালবাসার অনুভূতি নিয়ে। পূর্ণা আসল শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে। দুই দিন আগে তার অষ্টম শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। হিমেল হাওয়ার হাড় কাঁপানো শীতে পূর্ণা থেমে থেমে কাঁপছে।

‘আপা?’

পদ্মজা তাকাল। মৃদু হেসে বলল, ‘কী?’ পরপরই আবার উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘আম্মা আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে?’
পূর্ণা পদ্মজার পাশ ঘেঁষে বলল,’না, আম্মার কিছু হয় নাই।’

পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে বলল,’আম্মা সারাদিন সেলাইর কাজ করে। একদিকে তাকিয়ে থাকে, এক জায়গায় বসে থাকে। এজন্যই শরীরে এতো অশান্তি। দূর্বল হয়ে পড়ছে। আব্বারে বলিস, আম্মারে নিয়ে সদরে যেতে। আমার কথা তো আব্বা শুনবে না।’
‘আচ্ছা।’

দুজন নদীর ওপারে চোখ রাখল। অতিথি পাখির মেলা সেখানে। রোমাঞ্চকর আকর্ষণ। এত পাখি দেখে মন ভরে গেল। পাখিদের কলকাকলিতে এলাকা মুখরিত। এপার থেকে শোনা যাচ্ছে। কোত্থেকে দৌড়ে আসে প্রান্ত। সে চার মাসে শুদ্ধ ভাষা রপ্ত করে নিয়েছে ভালভাবে। এসেই বলল, ‘আপারা কী করো?’
পূর্ণা বলল,’পাখি দেখি। আয়, দেখে যা।’

প্রান্ত দূরে চোখ রাখল। সকালের ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা নদীর ওপার। পাখিদের ভাল করে চোখে ভাসছে না। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব। তাই পাখির কলকাকলি শোনা যাচ্ছে দারুণভাবে। প্রান্ত বলল, ‘বড় আপা,একটা পাখি ধরে আনি?’
‘একদম না। পাখি ধরা ভাল না। অতিথি পাখিদের তো ভুলেও ধরা উচিত না। ওরা আমাদের দেশে অতিথি হয়ে এসেছে।’
প্রান্ত চুপসে গেল৷ এরপর মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,’আচ্ছা,ঠিকাছে।’

‘তোরা এইহানে কী করস?’

মোর্শেদের কণ্ঠস্বর শুনে তিনজন ফিরে তাকাল। প্রান্ত হাসিমুখে ছুটে এসে বলল, ‘আব্বা,আমি আজ তোমার সাথে মাছ ধরতে যাব।’
মোর্শেদ প্রান্তকে কোলে তুলে নেন। এরপর বললেন,’তোর মায় আমার লগে কাইজ্জা করব।’
‘আম্মারে, আমি বলব।’
‘আইচ্ছা যা, তুই রাজি করাইতে পারলে লইয়া যামু।’

পদ্মজা চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠল। মোর্শেদ গত দু’মাস ধরে প্রান্তকে চোখে হারাচ্ছেন। ছেলে নাই বলেই হয়তো!প্রতিটা বাবা-মায়ের একটা ছেলের আশা থাকে।
হেমলতা পর পর তিনটা মেয়ে জন্ম দিলেন। এ নিয়ে মোর্শেদ অভিযোগ করেননি। তবে, মনে মনে খুব করে একটা ছেলে চাইতেন। প্রান্তকে যখন প্রথম আনা হলো, মোর্শেদের খুব রাগ হয় ভিক্ষুকের ছেলে বলে। সময়ের সাথে সাথে প্রান্তকে চোখের সামনে ঝাঁপাতে, লাফাতে দেখে ছেলের জন্য রাখা মনের শূন্যস্থানটা নাড়া দিয়ে উঠল। মোর্শেদ দু’হাত বাড়িয়ে দেন অনাথ ছেলেটির দিকে। এখন দেখে আর বোঝার উপায় নেই, মোর্শেদ আর প্রান্তের মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। মোর্শেদ কাঠখোট্টা গলায় দুই মেয়েকে বললেন,’সদরে যাইয়াম। দুইডার লাইগা চাদর আনতাম না সুইডার?’

পদ্মজা কথাটা শুনে চমকাল। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পেলে মানুষ কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। পদ্মজার অবস্থাও তাই হলো। খুশিটা প্রকাশ করার মতো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। স্নায়ু কোষ থমকে গেছে। শীতের তান্ডবে প্রকৃতি বিবর্ণ অথচ তার মনে হচ্ছে, বসন্তকাল চলছে। ঢোক গিলে ঝটপট উত্তর দিল,’আব্বা,তোমার যা পছন্দ তাই এনো আমার জন্য।’

খুশিতে পদ্মজার গলা কাঁপছে। মোর্শেদ অনুভব করলেন সেই কাঁপা গলা। গত সপ্তাহ রমিজের মেয়ে এক ছেলের সাথে রাত কাটাতে গিয়ে ধরা পড়ে। অলন্দপুরে সে কী তুলকালাম তাণ্ডব! ছেলেটাকে ন্যাড়া করে জুতার মালা পরিয়ে চক্কর দেওয়ানো হয়েছে পুরো অলন্দপুর। আর মেয়ের পরিবারকে সমাজ থেকে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। পদ্মজা এতো সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও আজও কোনো চারিত্রিক দোষ কেউ দিতে পারেনি। মেয়েটার দ্বারা কোনো অনৈতিক কাজ হয়নি। তার ঘরে যেন সত্যি একটা পদ্মফুলের বাস। মোর্শেদ পদ্মজাকে নিয়ে দোটানায় ভোগেন। খারাপ ব্যবহারটা আগের মতো আসে না। তিনি দ্রুত জায়গা ত্যাগ করেন।

_____________
পরদিন সকাল সকাল কলস ভরে খেজুরের মিষ্টি রস নিয়ে আসেন মোর্শেদ। প্রেমা খেজুরের রস দেখেই মাকে বলল, ‘আম্মা,পায়েস খাবো।
‘আচ্ছা, খাবি।’

সূর্য অনেক দেরিতে উঠল। প্রকৃতির ওপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়ে। সূর্যের আলোতে কোনো তেজ নেই। চার ভাই-বোন কাঁচা খেজুরের রস নিয়ে উঠানে বসল পাটি বিছিয়ে। খেজুরের কাঁচা রস রোদে বসে খাওয়াটাই যেন একটা আলাদা স্বাদ,আলাদা আনন্দ। মোর্শেদ নারিকেল গাছে উঠেছেন। পায়েসের জন্য নারিকেল অপরিহার্য উপকরণ। আচমকা পদ্মজা প্রশ্ন করল, ‘আজ কী সোমবার? ‘
পূর্ণা কথা বলার পূর্বে হেমলতা বারান্দা থেকে বললেন, ‘আজ তো সোমবারই। কেন?’
পদ্মজা খেজুরের বাটি রেখে ছুটে আসল বারান্দায়।
‘আজ স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল আম্মা। ঝুমা ম্যাডাম বলেছিলেন,গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। সবাইকে যেতে বলেছেন।’
‘আমায় বলে রাখতি। সামনে পরীক্ষা। গুরুত্বপূর্ণ দেখে পড়া দিবেন এজন্যই ডেকেছেন। তাড়াতাড়ি যা। এই পূর্ণা, তুইও যা।’

দুই বোন বাড়ি থেকে দ্রুত বের হলো। সূর্য উঠলেও কনকনে শীতটা রয়ে গেছে। দুজনের গায়ে মোর্শেদের আনা নতুন সোয়েটার। পদ্মজা যখন মোর্শেদের হাত থেকে সোয়েটার পেল আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারেনি। মোর্শেদের সামনে হাউমাউ করে কান্না করে উঠে৷ মোর্শেদ অপ্রস্তুত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ফিরেন অনেক রাত্রিরে। পূর্ণা বলল, ‘আব্বার পছন্দ ভালো তাই না আপা?’
‘কীসের পছন্দ?’
‘সোয়েটার গুলো কী সুন্দর।’

পদ্মজা হাসল। সামনের ক’টি দাঁত ঝিলিক দিল। হাতের ডান পাশে ধানক্ষেত। ধান গাছের ডগায় থাকা বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশির রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে। অনেকে হাতে কাঁচি নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে ধান কাটার। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ। হঠাৎ পূর্ণা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপারে, লিখন ভাই।’

পদ্মজার নিঃশ্বাস গেল থমকে। মুহূর্তে বুকের মাঝে শুরু হয় তাণ্ডব। পূর্ণার দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাল পদ্মজা। লিখন ব্যস্ত পায়ে এদিকে আসছে। পাশে মগা।
পদ্মজা অজানা আশঙ্কায় চোখ ফিরিয়ে নিল। পূর্ণাকে বলল, ‘এখানে আর এক মুহূর্তও না।’ কথা শেষ করে পদ্মজা স্কুলের দিকে হাঁটা শুরু করল। পূর্ণা অবাক হয়। কিন্তু, এ নিয়ে রা করল না। লিখন পিছন পিছন আসছে। পদ্মজার বুক কাঁপছে বিরতিহীন ভাবে। চাহনি অশান্ত।

চলবে…

আমি পদ্মজা – ১২
___________
বট গাছের সামনে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে লিখন।
শীতের শুষ্কতায় বটগাছের অধিকাংশ পাতা ঝরে পড়েছে। লিখনের কাছে শীতকাল খুবই অপছন্দের ঋতু। শীত চরম শুষ্কতার রূপ নিয়ে প্রকৃতির ওপর জেঁকে বসে থাকে যা সহ্য হয় না লিখনের। ঠান্ডা লেগেই থাকে। ছোট থেকে কয়েকবার নিউমোনিয়ায় ভুগেছে। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে রুক্ষতা, তিক্ততা ও বিষাদের প্রতিমূর্তি শীতকাল। তখন পদ্মজা এতো দ্রুত হাঁটছিল যে মনে হচ্ছিল, সে পালাতে চাইছে। লিখন আর এগোয়নি। পালাতে দিল পদ্মজাকে। মগা বলেছে, পদ্মজার লোকসমাজের ভয় খুব। তাই লিখন এই নির্জন মাঠের পাশে বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা এ পথ দিয়েই বাড়ি ফিরবে। তখন যদি একটু কথা বলা যায়।

পদ্মজা জড়সড় হয়ে হাঁটছে। আতঙ্কে ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। বার বার জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে।
পদ্মজা মিনমিনে গলায় পূর্ণাকে ডাকল, ‘পূর্ণা রে…”

পূর্ণা তাকাল। পদ্মজা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভয় হচ্ছে। উনি মাঝপথে দাঁড়িয়ে নেই তো?’

পূর্ণা চরম বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘থাকলে কী হয়েছে? খেয়ে ফেলবে?’

পদ্মজা আর কথা বলল না। পূর্ণার সাথে কথা বলে লাভ নেই। তখন লিখন শাহকে পাত্তা না দেয়ার জন্য পূর্ণার খুব রাগ হয়েছে। পদ্মজা বরাবরই মাথা নিচু করে হাঁটে। তাই লিখন শাহকে দেখতে পেল না। পূর্ণা দূর থেকে দেখতে পেল। কিন্তু এইবার আর আগে থেকে বলল না পদ্মজাকে। সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ভাবে, লিখন শাহ্ যখন আপার সামনে এসে দাঁড়াবে কী যে হবে!

লিখন-পদ্মজার দূরত্ব মাত্র কয়েক হাত। তখন পদ্মজা আবিষ্কার করল লিখনের উপস্থিতি। ওড়নার ঘোমটা চোখ অবধি টেনে নেয় দ্রুত। ভয়ে-লজ্জায় সর্বাঙ্গে কাঁপন ধরে। লিখনের পাশ কাটার সময় পুরুষালি একটি কণ্ঠ ডেকে উঠল, ‘পদ্ম।’

পদ্মজা দাঁড়াতে চায়নি। তবুও কেন জানি দাঁড়িয়ে গেল। লিখন দুয়েক পা এগিয়ে আসল। পূর্ণা ঠোঁট টিপে সেই দৃশ্য গিলছে। লিখন উসখুস করছে। কথা গুলিয়ে ফেলেছে। পদ্মজা লিখনকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। লিখন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখল। পূর্ণা বলল, ‘আমাকে বলুন, আমি বলে দেব।’

লিখন পকেট থেকে একটা চিঠি বের করল। এরপর অনুরোধ স্বরে বলল,’দয়া করে, তোমার বোনকে দিও। আমি কাল বিকেলে ঢাকা চলে যাব।’
পূর্ণা হাসিমুখে চিঠি নিল। এরপর বলল, ‘আপা আপনার আগের চিঠিটা প্রতিদিন পড়ে।’

লিখনের ঠোঁট দু’টি হেসে উঠল। পূর্ণা দৌড়ে ছুটে গেল পদ্মজার দিকে। লিখন আর পিছু নিল না। পূর্ণা আসতেই পদ্মজা ধমকে উঠল, ‘কী কথা বলছিলি এতো? কেউ দেখলে কী হতো? তুই আম্মার কথা কেন ভাবছিস না।’

পদ্মজার কাঁদোকাঁদো স্বরে পূর্ণা চুপসে গেল। সত্যি কী সে বেশি করে ফেলল? পূর্ণা চোখ নামিয়ে চুপচাপ হেঁটে বাড়ি চলে আসে। চিঠির কথা পদ্মজাকে বলা হয়নি।

____________
গোধূলি বিকেল। হেমলতা পদ্মজাকে ফরমায়েশ দেন, ‘পদ্ম, কয়টা টমেটো নিয়ে আয়।’
‘আচ্ছা আম্মা।’

পদ্মজা লাহাড়ি ঘরের ডান দিকে হেঁটে আসে। দু’মাস আগে মোর্শেদ এ’দিকের সব ঝোপজঙ্গল সাফ করে টমেটোর ছোটখাটো ক্ষেত করেছেন। লাল টকটকে টমেটো। হেমলতা রান্নার ফাঁকে বারান্দার দিকে উঁকি দিলেন। মোর্শেদ আর প্রান্ত কিছু নিয়ে বৈঠক করছে।
হেমলতা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়েন। বাসন্তী নামক মানুষটা কী জন্যে ত্যাগের স্বীকার হলো? জানতে ইচ্ছে করলেও হেমলতা প্রশ্ন করেন না। তবু এতটুকু বুঝেছেন মোর্শেদের বাইরের ঘোর কেটে গেছে। যার ফলস্বরূপ সংসারে তার মন পড়েছে। হেমলতাকে খুব সমীহ করে চলেন। তবে হেমলতা জানেন, মোর্শেদ পদ্মজাকে নিজের মেয়ে হিসেবে এখনো বিশ্বাস করেননি। তা নিয়ে মাঝে মাঝে খোঁচা দিতেও ভুলেন না।

পদ্মজা সাবধানে ক্ষেতের মধ্যিখানে আসল। টমেটো ছিঁড়তে গিয়ে তার লিখনের কথা মনে হলো। মনে মনে ভাবে, কেন এসেছেন তিনি? কি বলতে চেয়েছিলেন?
জানার জন্য পদ্মজার মনটা ব্যকুল হয়ে হয়ে উঠল।

‘আপা,একটা কথা বলি?’

পদ্মজা চমকে তাকাল। হঠাৎ পূর্ণার আগমনে ভয় পেয়েছে। বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, ‘বল।’
‘রাগ করবে না তো?’
পদ্মজা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। বলল, ‘করব না।’
পূর্ণা লিখনের দেয়া চিঠি দেখিয়ে বলল, ‘লিখন ভাইয়ার চিঠি।’

পদ্মজা ছোঁ মেরে চিঠি নিল। পূর্ণা অবাক হলো। মনে মনে খুশি হলো পদ্মজার আকুলতা দেখে। পদ্মজা দ্রুত চিঠির ভাঁজ খুলল। পূর্ণা বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে, কেউ আসছে নাকি! পদ্মজা পড়া শুরু করল।

প্রিয় পদ্ম ফুল,

চার মাস কেটে গেল। চার মাসে একটুর জন্যও অবসর মেলেনি। কিন্তু মনে ছিল এক আকাশ ছটফটানি। তোমার মনের কথা তো জানাই হলো না। তোমাদের অলন্দপুরের প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছেলের স্বপ্ন তোমাকে ঘরে তোলার। তাই সারাক্ষণ ভয়ে ছিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে কেউ তুলে নেয়নি তো! তিন দিনের সময় নিয়ে চলে এসেছি। শুধু একবার দেখতে আর জানতে, তুমি কী আমার জন্য অপেক্ষা করবে? মেট্রিক পরীক্ষা অবধি অপেক্ষা করলেই হবে। এরপর আমি আমার মা আর বাবাকে নিয়ে তোমার মায়ের কাছে আসব। উনার কাছে অনুরোধ করব, তোমার পড়া শেষ হলে যেন আমার সাথেই বিয়ে দেন। তখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পারব। এখন অনিশ্চয়তায় ভুগছি। আমি গুছিয়ে লিখতে পারছি না আজ। কয়েকটা চিঠি লিখেছি। একটাও মনমতো হয়নি। অনুগ্রহ করে তুমি মানিয়ে নিও।

ইতি
লিখন শাহ্

______________

বাড়ির সবাই ঘুমে। পদ্মজা চুপিচুপি উঠে বসল পড়ার টেবিলে। রাত অনেক। গাছের পাতায় নিশ্চয় শিশির বিন্দু জমছে। এরপর ভোররাতে টিনের চালে শিশিরকণা বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির মতো ঝরবে। গাঁ হিম করা ঠান্ডা। তা উপেক্ষা করে পদ্মজা হাতে কলম তুলে নিল। সাদা কাগজে লিখল, অপেক্ষা করব আমি। এরপর কাগজটা ভাঁজ করে বালিশের তলায় রেখে শুয়ে পড়ল।

ফজরের নামায পড়ে চার ভাইবোন পড়তে বসল৷ পড়ায় মন টিকছে না পদ্মজার। বই আনার ছুতোয় পদ্মজা রুমে গেল। রাতের লেখা কাগজটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে জানালার বাইরে ফেলে দিল। এরপর আবার নতুন করে লিখল, আমার আম্মা যা চান তাই হবে।

পড়াশেষে নিয়মমাফিক ঘাটে আসল পদ্মজা। হাতের মুঠোয় তিনটা চিঠি। দু’টো লিখনের। একটা তার লেখা। পূর্ণাও পাশে। প্রেমা, প্রান্ত বাড়িজুড়ে ছুটাছুটি করছে। সামনের কোনোকিছু ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। সবকিছুই অস্পষ্ট। কুয়াশার স্তর এত ঘন যে, দেখে মনে হচ্ছে সামনে কুয়াশার পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। সেই পাহাড় ভেদ করে একটা নৌকা এসে ঘাটে ভীরে। নৌকায় লিখন আর মগা। আকস্মিক ঘটনায় পদ্মজার পিল উঠল চমকে। পালানোর মতো শক্তিটুকু পায়ে নেই।
লিখন মায়াভরা কণ্ঠে পদ্মজার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমি বাধ্য হয়ে এসেছি। আজ বিকেলে চলে যাব। মগা বলল, প্রতিদিন সকালে ঘাটে নাকি বসো তুমি। তাই এসেছি।’

পদ্মজা মনে মনে সূরা ইউনুস পড়ছে। ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে। মা দেখে ফেললে কী হবে? বা অন্য কেউ? একটু সাহস যোগাতেই নিজের লেখা চিঠি সিঁড়িতে রেখে, পদ্মজা ছুটে গেল বাড়িতে। পূর্ণা বড় বড় চোখে শুধু দেখল। লিখন নৌকা থেকে নেমে চিঠিটা হাতে তুলে নিল। ভাঁজ খুলে একটা লাইন পেল শুধু। লিখনের মুখে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। পূর্ণার কৌতূহল হলো চিঠিতে কী আছে জানার জন্য। তবে তা প্রকাশ করল না। শুধু বলল, ‘আপা আপনার কথা প্রতিদিন ভাবে।’

____________

১৯৯৬ সাল। পদ্মজা থেমে থেমে কাঁপছে। হাঁটুর উপর মুখ লুকিয়ে রেখেছে। তুষার কালো চাদর তার গায়ে টেনে দিল। পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। বিষাদভরা কণ্ঠে বলল, ‘ সেদিন আমার লেখা প্র‍থম চিঠিটা কুটিকুটি কেন করেছি,জানি না। ইচ্ছে হয়েছিল তাই করেছি। তবে জানেন, আমি একদম ঠিক করেছিলাম। সেদিন যদি আমি কথা দিয়ে দিতাম। আমার কথা ভঙ্গ হতো।’

পদ্মজা হাসল৷ তুষার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পদ্মজার দিকে। এরপর বলল, ‘লিখনের সাথে আর দেখা হয়নি?’

পদ্মজা হাতের কাঁটা অংশে ফুঁ দিয়ে বলল, ‘হয়েছিল।’

‘তাহলে, কথা ভঙ্গ হতো কেন বললেন?’

পদ্মজা তুষারের দিকে তাকাল। এরপর আবার হাঁটুতে মুখ লুকালো। এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট করে করে দশ মিনিট কেটে গেল। পদ্মজার সাড়া নেই। তুষার ডাকল, ‘পদ্মজা? শুনতে পাচ্ছেন?’
‘পাচ্ছি।’
‘আপনার কী কষ্ট হচ্ছে?’
‘হচ্ছে।’
‘মুখ তুলে তাকান।’

পদ্মজা ছলছল চোখে তাকাল। তুষার উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘কী সমস্যা হচ্ছে?’

তুষারের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে পদ্মজা ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমার আম্মা আমার সাথে কেন বিশ্বাসঘাতকতা করল?’

তুষার চমকাল। হেমলতা নামে মানুষটার সম্পর্কে যা জানল, তাতে তার নামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা শব্দটা যায় না। পরপরই নিজেকে সামলে নিল। এমন কেইস শত শত আছে। ভাল মানুষের খারাপ রূপ। তুষার সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘কী করেছেন তিনি?’

পদ্মজা উত্তর দিল না। ফ্লোরে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজল। তুষার গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পদ্মজা এখন আর কিছু বলবে না। সে ক্লান্ত। অতীত হাতড়াতে গিয়ে মনের অসুস্থতা বেড়ে গেছে তার। তুষার পদ্মজার মুখের দিকে তাকাল। আঁচল সরে গেছে বুক থেকে। চাদরের অংশ ফ্লোরে পড়ে আছে। তুষার চাদরটা টেনে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল, পদ্মজার গলায় কালো-খয়েরি মিশ্রণে কয়টা দাগ। গলা টিপে ধরার দাগ! তুষার হুংকার ছাড়ল, ‘ফাহিমা?’

ফাহিমা কাছেই ছিল। ছুটে আসল। তুষার বলল, ‘আপনি আসামীর গলা টিপে ধরেছেন?’

ফাহিমা চট করে বলল, ‘না, স্যার। প্র‍থম থেকেই গলায় দাগ গুলো দেখছি। প্রশ্নও করেছি। মেয়েটা উত্তর দিল না।’

তুষার কপাল ভাঁজ করে ফেলল। হাজারটা প্রশ্নে মাথা ভনভন করছে। মস্তিষ্ক শূন্য প্রায়। পদ্মজা যতটুকু বলেছে তার পরবর্তী সাত বছরে কী কী হয়েছিল, না জানা অবধি শান্তি মিলবে না। মাথা কাজ না করলে তুষার সিগারেট টানে। তাই বেরিয়ে গেল।

চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ