আমার তুমি ২ পর্ব-৩৮+৩৯

0
99

#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৩৮
#জান্নাত_সুলতানা

সাদনান ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রিয়তা সেদিকে তাকিয়ে আছে।পুরুষ টার গায়ে গাঢ় নীল রঙের টি-শার্ট। সব সময় পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা কুচকুচে কালো অল্পস্বল্প ভেজা চুল গুলো ভ্রু জোড়ার উপর এসে পৌঁছেছে। চোখের লম্বা ঘন পাপড়ি গুলো চোখ বন্ধ থাকায় দারুণ দেখতে লাগছে। সরু নাকটার নিচে সব সময় খবরদারি করতে থাকা চিকন পাতলা অধর জোড়া আপাতত বন্ধ আছে।
প্রিয়তা পাশের দোলনায় বারকয়েক তাকিয়ে কিছু সময় লাগিয়ে সব পর্যবেক্ষণ করলো।তারপর নিজের হাত টা সাদনানের গালে রাখলো।সাদনান প্রিয়তার চেয়ে একটু বেশি ফর্সা। কিন্তু ছেলে যেনো বাবার কার্বন কপি হলে গায়ের রং টা মায়ের মতো হবে বলে প্রিয়তার মনে হচ্ছে।
প্রিয়তার হাতের স্পর্শে সাদনান নড়েচড়ে প্রিয়তার হাত টা টেনে ধরে জড়িয়ে নিলো বুকে।একবার পিটপিট করে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুম জাড়ানো কণ্ঠে বলল,

-“আমার জান।
এতো দেখো না।নিজে কে সামলাতে পারলে আমাকে কিন্তু পারবে না। আর আমি এখন বেসামাল হতে চাইছি না।”

প্রিয়তা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে।ঘুমিয়ে গিয়েও শান্তি দিচ্ছে না। অদ্ভুত লোক।

——

-“না আব্বা কাঁদে না।
মা চলে আসবে।”

কিসের কি মেয়ে তার ঠাশঠাশ করে গলা ফাটিয়ে কেঁদে চলছে।সাদনান অনেক্ক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। সাদনানের এবার নিজে কে বড্ড অসহায় লাগলো।প্রথমে কাঁদে নি বলে কত কি করতে হলো।আর এখন বেশি কাঁদার জন্য মনে হচ্ছে ডক্টর দেখাতে হবে। প্রিয়তা এখন নিচে আছে।
ছেলে বাবু টা সারা’র কাছে রয়েছে। প্রিয়তা শরীর ভীষণ দুর্বল। যদি প্রিয়তার মতে সে সুস্থ। কিন্তু সাদনান কিছুতেই তা মানতে রাজি নয়।প্রিয়তা কে কিছু করতে হয় না।শাশুড়ী, চাচী শাশুড়ী, ফুপি শাশুড়ী সবাই যেনো শাশুড়ী নয় মায়ের মতো আগলে সেবাযত্ন করছে।যদিও আগে প্রিয়তা নিজে কে এ বাড়ির বউ কম মেয়ের মতোই থেকেছে। কিন্তু এখন সব কিছু যেনো দিগুণ হচ্ছে। কত আদর যত্ন ভালোবাসে সবাই। আর এখন তো আম্বিয়া মির্জাও আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়েছে। হবে না বা কেনো নাতির ঘর আলো করে দুই দুই টা জীবন্ত পুতুল এনে দিয়েছে যে।নাতির জীবন পূর্ণ হয়েছে। এতেই তিনি প্রচুর খুশি।
এখন প্রায় বেলা বারোটা বাজে। প্রিয়তা কে খবর পাঠানো হয়ে গিয়েছে।নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। তাছাড়া বাড়িতে কতবড় অনুষ্ঠান। ছেলেমেয়ের আকিকা দিয়ে নাম রাখবে আজ।অবশ্যই আরো আগেই রাখতো কিন্তু প্রিয়তা অসুস্থ বিধায় এতো দিনে এসে রাখছে।
সাদনান মেয়ের দিকে কতক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে রুম হতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই প্রিয়তা রুমে প্রবেশ করলো।গায়ের ওড়না সোফায় রাখে।সাদনান এগিয়ে এসে প্রিয়তার বরাবর দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

-“বারণ করেছিলাম নিচে না যাওয়ার জন্য।
বাবু কখন থেকে কান্না করছে।”

প্রিয়তা মেয়ে কে কোলে নিতে নিতে সাদনান এর কথা কে সম্পূর্ণ এড়িয়ে বলল,

-“সবাই চলে এসছে।
আপনি গোসল করে রেডি হয়ে নিন।মা বলেছে একটু পর এসে ওদের শরীর মুছিয়ে দিবে।”

সাদনান কিছু সময় বউয়ের মুখপানে তাকিয়ে রইলো।আগের মতো আর হ্যাংলা পাতলা নেই সাদনানের ছোট জান।এখন অনেক টাই শরীরের পরিবর্তন এসছে।সাদনান কে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সাদনান মুচকি হাসলো তারপর ঝুঁকে বউয়ের ফোলা ফোলা গালে টুপটাপ কয়েকবার চুমু খেয়ে পাশ থেকে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
প্রিয়তা ফ্যাল ফ্যাল করে সাদনান এর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।
কিছু সময় পর মুচকি হেঁসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রিয়তা থমথমে খেলো।মেয়ের মুখ হতে আঙ্গুল বের করে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

-“বাপকা বেডি।
বাপ কাহিনি করবে মেয়ে সেসব দর্শক হয়ে এনজয় করবে।”

——-

পুরো বাড়ি রমরমা পরিবেশ।
রিধি ওয়াজিদ ছাড়া সবাই উপস্থিত রয়েছে আজ।মাইশার ছেলে মিশান মায়ের কাছ ঘেঁষে বসে আছে। ছোট সায়রা কে মিশান এর নিকট দারুণ মায়াবী লাগে। যেনো জীবন্ত পুতুল একটা।বাবা-র মতো ধবধবে সাদা কুচকুচে কালো চুল।গোলাপি ঠোঁট। এমন মানুষ তো সে টিভিতে দেখেছে। কার্টুন নাম এদের। কিন্তু তার মা বলেছে ওর নাম সায়রা।আর মিশান এর বোন হয়।কিন্তু মিশান মানতে রাজি নয়।ছোট মামা বলেছে সায়রা ওর বউ।কিন্তু এটা কাউ কে সে জানায়নি। মনে মনে রেখেছে। চার বছর এর মিশান যথেষ্ট বড় হয়েছে। কিছু টা গম্ভীর।
রাত প্রায় অনেক টা হয়েছে।খাবার শেষ হতে অনেক সময় বাকি।সবাই খাওয়ার পর বাড়ির মহিলারা খেতে বসছে।যদিও প্রিয়তা কে খাবার খেয়ে নেওয়ার জন্য অনেক বার সবাই বলেছে কিন্তু খায় নি প্রিয়তা।সাদনান ছেলে কে নিয়ে উপরে রুমে চলে গিয়েছে। মাইশা আগে খেয়ে নিয়েছে সেইজন্য সায়রা কে কোলে নিয়ে বসে আছে।
প্রিয়তা খাবার শেষ হতে হতে সায়রা ঘুমিয়ে পড়লো।প্রিয়তা মেয়ে কে নিয়ে উপরে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।
সাদনান মাত্রই ছেলের কে দোলনায় শুইয়ে বিছানা ঠিকঠাক করছিল।আর তক্ষুনি প্রিয়তা রুমে এলো।মেয়ে কে দোলনায় শুইয়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে যেতেই সাদনান বলে উঠলো,

-“ওকে বিছানায় দাও।”

প্রিয়তা কোনো প্রতিত্তোর করে না।মেয়ে কেও দোলনায় রেখে কাবাড থেকে রাতের পোষাক নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো। সাদনান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। হঠাৎ আজ হলো কি?
সব সময় মেয়ে কে বিছানায় রাখে।মেয়ের প্রতি যেনো প্রিয়তার ভালোবাসা একটু বেশি। হয়তো মেয়ে তার এ ক’দিনে অনেক টা কষ্ট পৃথিবীতে আসার পর পেয়েছে সেইজন্য মেয়ে কে যতটা পারে নিজের সাথে সাথে রাখে।যদিও ছেলে কেও সে একই নজরে দেখে তবে রাতে মেয়ে কে সে নিজের সাথে বিছানায় রাখে। আর আজ হঠাৎ দোলনায়?
সাদনান বেশি কিছু না ভেবে দরজা বন্ধ করে এলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত বাজে বারোটার বেশি। প্রিয়তার রাতের ঔষধ আছে। সেগুলো বেড় করে নিয়ে সোফায় বসতেই প্রিয়তা ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলো।গায়ে তার কালো একটা লং নাইটি।সাদনান ভ্রু কুঁচকালো। আজ অনেক দিন বাদে প্রিয়তা এগুলো পড়লো।প্রেগন্যান্সির সময় ঢিলাঢালা গেঞ্জি পড়তো।কাল রাতেও তাই পড়েছে।
সাদনান মনে মনে বারকয়েক নিজে কে শাসিয়ে নিলো।মাত্র তো এক মাস হয়েছে সুস্থ হয়েছে মেয়ে টা।যদিও পুরোপুরি সুস্থ এখন হয় নি।যতটা সম্ভব বউ কে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।সাদনান চায় না ওর জন্য বউ তার কষ্ট পায়।

-“এদিকে এসো।
ঔষধ খেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো।
আমি একটা জরুরি কল রয়েছে সেটা শেষ করে আসছি।”

-“মিথ্যা বলছেন আপনি।
আপনার এসিস্ট্যান্ট সন্ধ্যায় সব মিটিং টাইম ঠিক করে নিয়েছে।”

সাদনান চোর ধরে পরে গেলো যেমন ভাব করে সাদনানের মুখভঙ্গি এখন তেমন ভাব করে রেখেছে। প্রিয়তা ততক্ষণে ঔষধ খেয়ে পানির গ্লাস সেন্টার টেবিলে রেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল বিনুনি করে নিলো।হাত পায়ে রাতের কিছু প্রসাধনী ব্যবহার করতে লাগলো।
সাদনান এর এপর্যায়ে এসে নিজে কে সামলনো দায় হয়ে পড়লো।আস্তে করে ঢোক গিলে এগিয়ে গিয়ে বউ কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে উন্মুক্ত ঘাড়ে লম্বা সরু নাকটা ঘষতে লাগলো।
প্রিয়তা এসবে পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু আজ অনেক দিন পরে মানুষটার এমন স্পর্শে শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো।চোখ বন্ধ করে ভালোবাসার মানুষ টার স্পর্শ গুলো অনুভব করতে লাগলো।প্রিয়তা চোখ বন্ধরত অবস্থায় বলে উঠলো,

-“ভালোবাসি মন্ত্রী সাহেব।”

সাদনান বউয়ের সম্মতি পেয়ে আরো কিছু টা চেপে ধরলো বউ কে নিজের সাথে।অতঃপর আস্তে আস্তে টুপটাপ বৃষ্টির ন্যায় চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো বউয়ের গাল, গলা, ঘাড়ে।
তারপর নিজের দিকে ফিরিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে নিজের ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে বউয়ের ওষ্ঠদ্বয়ে রাজত্ব চালালো। সময় নিয়ে ছেড়ে দিয়ে বউ কে পাঁজা কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজের সম্পূর্ণ ভর প্রিতার উপর ছেড়ে দিয়ে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে উঠলো,

-“সরি জান।”

#চলবে…

#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৩৯
#জান্নাত_সুলতানা

-“তুমি তুরাগ কে কেনো মেরেছো?”

বাবা-র প্রশ্নে মিশান আঁড়চোখে একবার মফিজুর মির্জার কোলে বসে থাকা তুরাগ এর দিকে তাকালো।
তুরাগ একদম চুপটি করে বসে আছে। চোখ গুলো লাল হয়েছে। হাতের আঙ্গুলে একটা ব্যান্ডেজ লাগনো।
যেটায় সে একটু আগে কামড়ে দিয়েছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে এসে সায়রা কে কোলে নিয়ে বসে থাকা সারা’র পাশে বসে ছোট সায়রার হাত ধরতে দেখে ভীষণ রাগ হলো।কিন্তু তখন কিছু করতে পারে নি লিভিং রুমে সবাই ছিল বলে।আর যখন ব্রেকফাস্ট করে যে যার মতো চলে গেলো তখনই সুযোগ বোঝে তুরাগ এর আঙ্গুল কামড়ে দিয়েছে। তুরাগ সে কি গলা ফাটিয়ে কেঁদে ওঠে ছিলো।কিন্তু মিশান নিজের রাগ মিটিয়ে তবেই ছেড়েছিল।ততক্ষণে পুরো বাড়ির মানুষ একত্রিত হয়ে অবস্থা বুঝতে পেরে তুরাগ এর হাতে বরফ লাগালো।তিন্নি তো কেঁদেকুটে নাজেহাল অবস্থা করে ফেলেছে নিজের। এটা দেখে অবশ্যই মিশানের খারাপ লেগেছে। কারণ তিন্নি মিশান কে অনেক আদর করে মিশান নিজেও তিন্নি কে অনেক ভালোবাসে।মিশান তখন সব খারাপ লাগা পেছনে ঠেলে যখন পালানোর ধান্ধায় কারণ সে বুঝতে পেরেছিল কপালে আজ শনি রবি সব আছে। কিন্তু পালানোর আগেই আয়ান কোথা থেকে এসে ছেলে কে ধরে টেনে নিয়ে গেলো সবার মাঝে।
সেই থেকে সবাই বলে যাচ্ছে কিছু না বলার জন্য। বাচ্চা মানুষ বুঝতে পারে নি।কিন্তু আয়ান কারোর কথা না শুনেই উপরোক্ত প্রশ্ন টা করে। কিন্তু মিশানের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে এবার রেগে গেলো।ছেলের হাত টেনে ধরে সবাই কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-“সবার আদরে আদরে আজ ওর এই অবস্থা। হিংসুটে হয়েছে একটা। ওর স্বভাব না যতদিন পরিবর্তন হবে ততদিন ওর মির্জা বাড়ি আসা বন্ধ। সবার সাথে মিলেমিশে থাকার মতো বাচ্চা ও নয়।”

সবাই শত চেষ্টা করেও আয়ান কে আটকাতে পারলো না। বাধ্য হয়ে মাইশাও পেছন পেছন চলে গেলো।যাওয়ার আগে অবশ্য বলে গেলো আয়ানের রাগ পড়ে গেলো ওকে বোঝাবে।
অগত্যা সবাই তাই মেনে নিলো।

—–

কবির তিন্নি দুপুরে খাবার খেয়ে নিজেদের বাড়ি চলে গেলো।আরো কিছু দিন থাকার জন্য ইচ্ছে ছিলো তিন্নির। কিন্তু কবির এর ভার্সিটি তারউপর সকালের ঘটনা নিয়ে একটু মন খারাপ।কিন্তু সেই খারাপ লাগা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি।আয়ান কবির এর সাথে ফোন করে কথা বলেছে। এতে আরও সবাই নিশ্চিত হয়েছে আয়ান তাহলে রাগ করে নি।ছেলের বিচ্ছু পানায় একটু অতিষ্ঠ সেইজন্য তাছাড়া এরপর মিশান যদি একটু ভয় পায় সেইজন্য এমন টা করে।
তিন্নি কবির যাওয়ার পর প্রিয়তা সায়রা আর প্রহর কে কাজের লোকের কাছে রেখে ছাঁদে গেলো।
অনেক দিন পর ছাঁদে এসছে। প্রায় বছর ঘনিয়ে আসতে চলে।ছাঁদে নানারকম ফুল রয়েছে। প্রিয়তা সারা কে নিয়ে সেগুলো কিছু গাছ থেকে ছিঁড়ে আনলো।
দু’জন মিলেমিশে কিছু ক্যান্ডেল আর ফুল দিয়ে রুম টাকে সাজিয়ে নিল।
আয়না ছোটখাটো একটা কেক্ বানিয়ে দিলো।প্রিয়তা অবশ্য জানতো না বোন তার কেক্ বানিয়েছে।অবশ্য এটা করাতে প্রিয়তার বেশ সুবিধায় হলো।শুধু শুধু তো আর উইশ করা যায় না।
বিকেলে নাস্তা করে ছেলে মেয়ে কে খাইয়ে সালেহা বেগম আর রোজিনা বেগম এর কাছে রেখে সুফিয়া বেগম এর সাথে রাতের রান্না করতে গেলো।অবশ্য কাজের লোক সব গুছিয়ে রেখেছে। শুধু রান্না টা বাড়ির যেকোনো মহিলা কে করতে হয়।কাজের লোকের হাতের রান্না কেউই তেমন একটা পছন্দ করে না।বিশেষ করে আম্বিয়া মির্জা আর জাফর মির্জা।
রাত সাত টা বাজার পর থেকেই বাড়ির সব পুরুষ এক এক করে বাড়ি আসতে লাগলো।
প্রথমে আজ্জম মির্জা আর মফিজুর মির্জা। তারপর রাহাত।তার কিছু সময় পর রাহান।রাত নয়টা নাগাদ সবাই বাড়ি চলে এলো।শুধু সাদনান এলো না। সে এতো দ্রুত আসেও না।অবশ্য প্রিয়তা অসুস্থ যখন ছিল তখন কোথাও যায় নি।আর গেলোও খুব দ্রুত ফিরে আসতো।প্রিয়তা নিজের ছেলে মেয়ে কে নিয়ে আগে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।রোজিনা বেগম অবশ্য বাচ্চাদের সাথে রইলো।

——-

কালাম খান নাতির হাতের অবস্থা দেখে অনেকটা মনঃক্ষুণ্ন হলেন।অফিস থেকে ফিরার পর নাতি কে নিজের সাথেই রাখলেন। রাতে খাবার নিজে খাইয়ে নিজের সাথে রুমে নিয়ে চলে গেলো।
তুরাগ বাবা মায়ের চেয়ে বেশি দাদার সাথে সাথে থাকে।দাদার সাথে তার গলায় গলায় ভাব।দাদা তার সব আবদার পূরণ করে। বাড়িতে বাড়তি মানুষ না থাকায় খেলার সাথে টাও দাদাই হয়েছে।
তিন্নি কে বেশি জ্বালায় না তুরাগ। তিন্নি নিজের মতো করে সংসার এর সব সামলাতে পারে।তবে ছেলে না জ্বালালেও ছেলের বাপ যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণে তিন্নি কে ঠিকই বিরক্ত করে। তিন্নির অবশ্য এসব ভালোই লাগে। মানুষ টা ওকে ভালোবাসে ভাবলেই শরীর মন সব জুড়িয়ে যায়।আগের সব না পাওয়া ভালোবাসা এই মানুষ টা পুষিয়ে দেয়।সাথে শশুর নামক বাপ তো রয়েছে। পুত্র বধূ কম নিজের মেয়ের মতো দেখে।
রাত তখন দশ টার কোঠা ছাড়িয়েছে।কবির কিছু প্রশ্ন তৈরি করছে।বরাবরই প্রশ্ন তৈরী করার কাজ টা কবির পায়।যদিও এই সাবজেক্টের কবির এর ডিপার্ট্মেন্টের আর দু’জন প্রফেসর রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন প্রিন্সিপাল সহ সবাই ধরে বেঁধে প্রশ্ন তৈরী করার দায়িত্ব কবির কে দিয়ে দেয়।
কবির অনেক সময় নিয়ে প্রশ্ন গুলো তৈরী করলো।তিন্নি তখন বিছানায় ঠিকঠাক করে নিজেও পরিপাটি হয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কবির এর রুম টা বেশ বড়সড়।অর্ধেক টায় একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি বলা চলে।কবির সেখানে বসেই কাজ করছিল।তবে তিন্নির ডাক শুনে প্রশ্ন গুছিয়ে নিজের কালো ব্যাগ টায় রাখতে রাখতে জানালো,

-“আসছি বউ।”

তিন্নি মুচকি হাসে।এই ডাকটা আজ চার বছর ধরে শুনে আসছে কিন্তু আজও শুনলে মনে হয় এই প্রথম শুনলে।সেই প্রথম দিনের মতোই অনুভূতি হয়।
কবির ওয়াশ রুম হতে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে বিছানায় এলো।তিন্নি তখন পা গুটিয়ে বসে আছে। কবির ঠিক তিন্নির বরাবর বসে ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,

-“কি ব্যাপার?
মন খারাপ?”

-“নাহ।
ভাবছি!”

-“কি?”

-“তুরাগ বড়ো হচ্ছে।”

-“হ্যাঁ তো?”

কবির যে তিন্নির কথা বুঝতে পারছে না তেমন নয়।কিন্তু কবির চাইছে তিন্নি বলুক। নিজের মুখে বলুক। আবদার করুক।একটু তো ভালোবাসার মানুষ টার সাথে জোর খাটায়।কিন্তু তিন্নি তো কখনো কিছু জোর করে না।কবির যেভাবে বলে সেভাবে সব মেনে নেয়।প্রথম প্রথম তিন্নি যখন কবির এর মুখের উপর কোনো কথা বলতো না তখন কবির এর বেশ ভালোই লাগতো।ভাবতো হয়তো ওকে তিন্নি ভালোবেসে সম্মান করে সব কিছু মেনে নেয় অথবা সঠিক বলেই হয়তো সম্মতি দেয়।যদিও তিন্নি অল্পতেই খুশি হয়ে যায়।কিন্তু কবির এর মন খুশি হয় না।সে চায় তিন্নি নিজেও জোর করে। ভালোবেসে কিছু আবদার করে।
কিন্তু তিন্নি মুখ ফুটে কিছু বলার বা চেয়ে নেওয়ার মেয়ে নয় কবির এটা বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে এই কয়েক বছরে।
কবির নিজে থেকে তিন্নি কে কাছে টানলো।গভীর আলিঙ্গন করে শুধালো,

-“একটা প্রিন্সেস চাই?”

তিন্নি মুচড়ালো।কবির এর উন্মুক্ত কাঁধে অধর স্পর্শ করলো।কবির বুঝি নিজের উত্তর পেলো।তড়িৎ বউ কে আগলে নিলো।তিন্নি নিজেও স্বামী নামক ভালোবাসার মানুষ টার সঙ্গ দিলো।

—–

সাদনান বাড়ির ফিরে প্রিয়তা কে লিভিং রুমে পেলো।গেইট বন্ধ করে এগিয়ে এসে বউয়ের সামনে দাঁড়ালো।প্রিয়তা চোখ লেগে এসছিল।মাথা সোফায় এলিয়ে দেওয়া ছিল।কিন্তু সামনে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে সামনে সাদনান কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি খেলো গেলো।
বসা ছেড়ে ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-“আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি।”

সাদনান মাথা নেড়ে প্রিয়তা কে জিগ্যেস করলো,

-“তুমি খেয়েছো?
বাবুরা কোথায়?”

-“মনির কাছে রয়েছে।
আমি খেয়েছি।”

-“তাহলে চলো।
আমি খেয়ে এসছি।”

প্রিয়তা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সাদনান ওকে টেনে নিয়ে উপরে যেতে লাগলো।
রুমে এসে লাইট অন করার জন্য সাদনান হাত বাড়াতেই প্রিয়তা সাদনান কে টেনে ধরলো।বিছানার উপর থেকে ড্রেস নিয়ে সাদনানের হাতে দিয়ে বলল,

-“ফ্রেশ হয়ে আসুন।
সারপ্রাইজ আছে।”

সাদনান ভ্রু কুঁচকালো। বউ তার বড়ো হলো কি?মনে হচ্ছে না। কেমন বাচ্চাদের মতো করে।ক’বছরে কম তো আর বাচ্চামো করে নি।কিন্তু সাদনানের হঠাৎ মনে হলো।কাজের চাপে সে কিছু ভুলে গিয়েছে। কিন্তু কি?
মনে পড়লো না। ওয়াশ রুমে গিয়ে বলিষ্ঠ শরীরে পানির ঝাপটা গায়ে পড়তে কিছু মনে পড়লো।ঝটপট ড্রেস চেঞ্জ করে ওয়াশ রুম হতে বেরিয়ে এসে দেখলো প্রিয়তা প্রায় অনেক গুলো সুগন্ধি যুক্ত ক্যান্ডেল রুমে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছে।
সাদনান কিছু টা ছুটে গেলো প্রিয়তার কাছে। পেছন থেকে পেট জড়িয়ে ধরে শুন্যে তুলে নিলো।
চুলের ফাঁকে মুখ গুঁজে অপরাধী কণ্ঠে বলে উঠলো,

-“আ’ম এক্সট্রিমলি সরি জান।
ইশ কি করে ভুলে গেলাম আমি?”

প্রিয়তা নিজে কে ছাড়িয়ে নিয়ে সাদনান এর দিকে ফিরে এক হাতে মোম অন্য সাদনান এর গালে রেখে বলল,

-“এতো বছরে একবারও তো আমার মনে থাকতো না।
কিন্তু আপনার ঠিকই মনে থাকতো।আমার একটু খারাপ লেগেছে। কিন্তু আপনার কাজের এতো চাপ তাই বেশি খারাপ লাগে নি।বিশ্বাস করুন একটুই খারাপ লেগেছে।বেশি না।”

সাদনান প্রিয়তার কথা শুনে শব্দ করে হাসলো।তবে পরক্ষণেই প্রশান্তির হাসি হাসলো।বউয়ের হাত থেকে ক্যান্ডেল পাশের টেবিলে রেখে বউ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

-“ধনবান এই দিনে আমার জীবনে এসে আমার জীবন টা এভাবে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়ার জন্য।”

প্রিয়তা কিছু বললো না। কিছু সময় চুপ থেকে সাদনান জিগ্যেস করলো,

-“ওদের ফিডার দিয়ে এসছো?”

-“হ্যাঁ।
সব নিয়েছে মনি।”

সাদনান বউয়ের মাথায় চুমু খেলো।
শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো।
আস্ত একটা ভালোবাসার, মায়ার রাজ্য এই তিনটা মানুষ ওর জীবনে। যেখান থেকে চাইলেও আর কোনো দিন বেরিয়ে আসতে পারবে না।

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে