অলৌকিক (১ম পর্ব)
ইশরাত জাহান দিনা
আমার ওয়াইফ মিলিকে আজকাল আমার একটু ভয় ভয় লাগে। এই ভয় আগে ছিলো না। নতুন হয়েছে। বিয়ের আগেও শুনেছিলাম মিলির ওপর জ্বীনের আছর আছে। সেই জ্বীন চায় না মিলির কারো সাথে বিয়ে হোক। এজন্যই মিলির প্রথম স্বামী বিয়ের পরদিন স্ট্রোক করে মারা যায়। আসলে স্ট্রোক একটা উছিলা, ঐ জ্বীন মিলির বরকে মেরে ফেলেছিলো। নাহলে সুস্থ সবল মানুষ কেনো হঠাৎ বিয়ের রাতে স্ট্রোক করতে যাবে।
অনেকেতো নাকি এটাও বলত যে মিলির সাথে ঐ জ্বীন নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ক করে। মিলির পেটে ঐ জ্বীনের বাচ্চাও ছিল। সেটা পরে মিলি নষ্ট করেছে। এসব আমি শুনেছিলাম মিলির সাথে আমার বিয়ের কথা যখন চলছিলো সে সময়।
আমি অবশ্য এসব জ্বীন ভুতে বিশ্বাস করি না। তাইতো এসব কথায় কান না দিয়ে মিলিকে বিয়ে করেছি। তবে এখন মাঝে মাঝে ওকে আমার ভয় লাগে।
আমার পরিচয় দিয়ে নিই। আমি মোকাদ্দেস। গরীব পরিবারের ছেলে। অবশ্য পরিবার বলতে তেমন কেউ নেই আমার। মা বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন লঞ্চ ডুবিতে। আমার দাদা বাড়ি ছিলো বরিশাল। আমরা থাকতাম ঢাকায়। বাবা একটা ছোট চাকরি করতেন। একবার আমার দাদি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নানিমা সেসময় আমাদের দেখতে ঢাকায় এসেছেন। চার বছরের আমাকে নানির কাছে রেখে মা আর বাবা গেলেন বরিশালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাড়ি পৌঁছানোর আগেই লঞ্চ ডুবিতে মারা যান দু’জনেই।
সেই থেকে নানির কাছে রয়ে গেলাম। সেই নানিও মারা গেলেন আমার চৌদ্দ বছর বয়সে। আমার মা ছিলেন নানির একমাত্র সন্তান। তাই কাছের বলতে আর কেউ রইলোনা । দাদী অসুস্থ মানুষ,থাকেন চাচাদের সংসারে। আমাকে রাখবেন কিভাবে। নানী মারা যাবার পর দূর সম্পর্কের এক মামার কাছে থেকে এস এস সি পাস করে ঢাকা চলে আসি। এখানে এসে টিউশনি করে, মানুষের দোকানে কাজ করে বি এ পাস করেছি। এখন একটা বিস্কিট কোম্পানির কেরানির পোস্টে চাকরি করছি।
বিয়ে থা করার কথা ভাবতে ভাবতে বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। আসলে আমার জন্য যে মেয়ে দেখবে এমন কাছের কেউ নেই। একরুম আর বারান্দাওয়ালা একটা বাসায় একাই থাকি। নিজেই রান্না করে খাই। কেরোসিনের চুলায় ভাত, আলু সিদ্ধ,ডিমভাজি করে খাই। মাঝে মাঝে বাইরে হোটেলেও খেয়ে নিই যখন রান্না করতে ভালো লাগে না। তো একদিন অফিস থেকে ফিরে ভাত রাঁধতে গিয়ে মার পড়ে হাত পুড়ে গেলো। পরদিন অফিসে গেলে আমার কলিগ রাকিব ভাই বললেন,
এভাবে কি চলে নাকি মিয়া, এবার একটা বিয়েশাদী করে ফেলেনতো।
আমাকে মেয়ে দেবে কে?
কি যে বলেন। এই দেশে মেয়ের অভাব আছে নাকি। আপনি শুধু হ্যা বলেন।
আমি কি বলব । শুধু হাসলাম,যার মানে দেখেন।
খুব সুন্দর একটা মেয়ে আছে। সিনেমার নায়িকাদের মতো দেখতে। বাবার অবস্থাও ভালো। দেখলেই পছন্দ হবে আপনার।
এমন মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দেবে?
কথাতো এইখানেই ভাই। আপনাকে খুলেই বলি তবে। বিয়েশাদীর ব্যাপার। লুকিয়ে রাখা ঠিক হবে না। মেয়েটার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সংসার হয়নি একদিনও।
আমি একটু দমে যাই।
ওহ। একদিনো সংসার হয়নি কেনো?
ছেলেটা বিয়ের রাতেই মারা যায়। স্ট্রোক করেছিল।
ইশ! খুব দুঃখজনক ঘটনা।
হুম আরও দুঃখজনক হলো এই ঘটনার পর সবাই ভাবতে শুরু করল মেয়েটার কোনো দোষ আছে। অলক্ষুনে মেয়ে আরকি। ওর জন্য বরটা মারা গেছে।
এমন আবার হয় নাকি এখনও। এসব কুসংস্কার এখন কেউ মানে?
আপনার যা কথা! হয় মানে। অহরহ হচ্ছে। কত বিচিত্র কারণে যে মেয়েদের বিয়ে ভাঙে। এই যে এই মেয়েটার আর বিয়েই হচ্ছে না। পাত্র পক্ষ আসে,দেখে পছন্দ করে কিন্তু এসব কথা শোনার পর বিয়ে ভেঙে দেয়।
এটাতো ঠিক না। জীবন মৃত্যু সব খোদার হাতে। কে কখন মারা যাবে কেউ বলতে পারে না। এই যে আমি আপনার সাথে কথা বলছি, এখুনি আমার মৃত্যু হতে পারে। সেখানে আপনার তো কোনো হাত নেই।
আপনি এভাবে ভাবছেন কিন্তু সবাইতো এমন করে ভাবতে পারে না। আপনাকে একটু হলেও চিনি বলেই এই মেয়ের কথা বললাম। মেয়ের বাড়ির লোকজন মেয়েটাকে নিয়ে ভীষণ টেনশনে আছে। বিবাহযোগ্য মেয়েকে আর কতদিন ঘরে রাখবে। আপনি দেখেন। মেয়ে যদি পছন্দ হয়তো কথা ফাইনাল করব। পছন্দ না হলে আরও মেয়ে আছে।
আমার একটু আগ্রহ হলো। মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। মেয়ে নাকি ভীষণ সুন্দরী। সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ সব মানুষেরই কম বেশি আছে। আমিও এর বাইরে না। আর তাছাড়া আমার যেহুতু এসব কুসংস্কার নিয়ে মাথাব্যথা নাই তাই বললাম,
এই মেয়েটাকেই দেখি তাহলে।
আচ্ছা আমি ডেট ঠিক করে জানাব। মেয়ের বাসায় কথা বলে নিই।
পরদিন অফিসে যেতেই রাকিব ভাই বললেন,
ভাই তৈরি থাইকেন। আগামী শুক্রবার মেয়ে দেখতে যাব।
শুক্রবার বিকেলে রাকিব ভাই সহ মিলিদের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। দোতলা ছিমছাম একটা বাড়ি। দোতলা পুরোপুরি কমপ্লিট হয়নি। বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে একপাশে ছোট একটা ফুলের বাগান। আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়ালের চারপাশ ধরে নানান রকম ফলের গাছ। দোতলা এখনো কমপ্লিট হয়নি। দুটো ঘরের কাঠামো তুলে রাখা হয়েছে।
আসার পথেই মিষ্টি কিনে এনেছি। সেগুলো একটা কমবয়সী মেয়ে এসে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেছে। বসার ঘরে মিলির বাবা আর বড় ভাই আছেন। আমাকে টুকটাক প্রশ্ন করলেন।
তা বাবাজি বাড়ি কোথায় আপনার?
জ্বী বরিশালে।
চাকরি যেন কোথায় করেন।
আমি কোম্পানির নাম বললাম।
এটার অফিস কোথায়?
গাজীপুরে।
বাবাজি যেন কি পাস দিছেন?
বি,এ পাস করেছি।
মাশাআল্লাহ।
বাড়িতে কে কে আছেন?
কাছের বলতে তেমন কেউ নাই। এক দূর সম্পর্কের মামা আছেন। দাদী আর চাচারা আছেন। খুব একটা যোগাযোগ নেই।
আচ্ছা।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে মিলি ঢুকল শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে।
আসসালামুআলাইকুম।
রাকিব ভাই জোরে সালামের উত্তর দিলেন।
ওয়ালাইকুমুস সালাম।
মিলির কন্ঠস্বর ভীষণ মিষ্টি। যেন রিনিঝিনি করে কাঁচের চুড়ির আওয়াজ তুলছে।
আমি মুখ তুলে মিলির দিকে তাকালাম।
বড় করে ঘোমটা টানা। চেহারা দেখা যাচ্ছে না।
মিলির এক ভাবি ঢুকল পেছনে পেছনে। উনি মিলি বসার পর পেছন থেকে ঘোমটা একটু টেনে মুখটা বের করে দিলেন।
রাকিব ভাই বললেন,
মাশাআল্লাহ।
আমি হা হয়ে গেলাম।
এতো সুন্দর দেখতে কোনো মানুষ হয় নাকি!এই মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দেবে এনারা?
ভাবি বললেন,
আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।
রাকিব ভাই বললেন,
আপনার পুরো নামটা যেন কি?
মোছাঃ শাহরিন মিলি।
সুন্দর নাম।
রাকিব ভাই আমাকে বললেন,
ভাই কিছু জানতে চাইলে বলেন।
আমি রাকিব ভাইকে বললাম,
আমার তেমন কোনো প্রশ্ন নাই।
মিলি ওর ভাবির কানে কানে কি যেন বলল।
উনি বললেন,
আপনারা বরং নিজেরা একা কথা বলুন।
আমাকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হলো। কিছুক্ষণ পরেই মিলি এলো।
আপনি ভালো আছেন?
জ্বি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
আলহামদুলিল্লাহ।
আমার সম্পর্কে সবকিছু জানেনতো?
জ্বি শুনেছি।
আপনার বিয়েতে আপত্তি নেই?
নাহ। অতীত নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আপনি হয়তো আমার সম্পর্কে সবটা জানেন না। আমি খুব সাধারণ পরিবারের ছেলে। ছোটখাটো একটা চাকরি করি। গাজীপুরে একটা একরুমের বাসায় ভাড়া থাকি। আমার সম্পত্তি বলতে কিছু নাই,মানে জমিজমার কথা বলছি। আপনি বিয়েতে রাজীতো?
আমার আপত্তি নেই।
তাহলে দিনতারিখ ঠিক করে ফেলি?
জ্বি, বাবার সাথে কথা বলুন।
সাতদিনের মধ্যে মিলির সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। মিলিকে নিয়ে উঠলাম আমার একরুমের ছোট্ট বাসায়।
♠️চলবে…..