#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
১৩.
আকাশে সাদা তুলোর ন্যায় মেঘের দল ভেসে বেড়াচ্ছে নিজ আনন্দে। তাদের কোনো বাঁধা ধরা নিয়ম নেই, থেমে থাকার ভয় নেই। তাদের গন্তব্যহীন কেবল পথ চলা। যেখানে ঠাঁই হয়নি পিছুটানের। সেই মেঘপুঞ্জের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অলকানন্দার দৃষ্টি স্থির, কথারা নিশব্দ। সে অনুভব করছে কেবল, তাকে ছুঁয়ে যাওয়া শীতল বাতাসের অস্তিত্ব। অনেকদিন বোধহয় প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়া হয়নি তার। আজ সকল না হওয়া কাজ সে একটু একটু করে সম্পূর্ণ করে অনুভব করতে চায়।
সময়টা অপরাহ্ন। ‘বিহারিণী মহলের’ সামনের খোলামেলা জায়গায় একটু ছোটোখাটো আয়োজন করা হয়েছে। আজকে ইংরেজি সাহেবেরা আসবে এই মহলে। এখানের কিছু জমিজমা নিয়ে কথা হবে। অলকানন্দার ঘাড়েই তাই দায়িত্ব পড়েছে। যেহেতু এখন বিচারকার্য তার উপর তাই সে-ই গ্রামের মানুষদের সকল ভালো-মন্দে সাথে থাকবে। সুরবালার নেই কোনো আপত্তি। বরং সে নিজের পুত্রবধূকে ভালো একটা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে সুন্দর করে। কপাল অব্দি ঘোমটা টানা। চন্দনের ফোঁটা কপালের মাঝ বরাবর যেন চন্দ্রবিন্দুর ন্যায় শোভা বাড়াচ্ছে।
জায়গাটা নির্দেশ দিয়ে দিয়ে পরিপাটি করিয়েই ক্ষান্ত হলো অলকানন্দা। অতঃপর হাফ ছেড়ে বসলো আরামকেদারা খানায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই মহলের চারদিকের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। ঝলমল করে ওঠলো চারপাশ। অলকানন্দা হাঁক ছেড়ে বাড়ির এক কর্মচারীকে ডাকল,
“মোহিনী, এক গ্লাস জল দিয়ে যাও তো।”
ডাক শেষ হওয়ার মিনিট দু’য়ের মাঝেই জল চলে এলো। অলকানন্দা সেটা হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে খেয়াল করল জলটা মোহিনী নয়, কৃষ্ণপ্রিয়া এনেছে। তার সাথে দাঁড়িয়ে আছে মনময়ূরী ও পানকৌড়ি। অলকানন্দা ভ্রু কুঁচকালো। এরা তিনজন একসাথে মানে কোনো না কোনো ঝামলা তো আছেই। কিন্তু তবুও সে কিছু বললো না। এগিয়ে দেওয়া জলের গ্লাসটা হাতে নিয়ে আয়েশ করে পান করলো পুরোটা জল। কৃষ্ণপ্রিয়া হাত বাড়িয়ে খালি গ্লাসটা নিতেই মনময়ূরী কথা বলল,
“বৌঠান, তোমার চরিত্র বলতে কিচ্ছুটি নেই তাই না?”
অলকানন্দা এমন একটা কথা শুনেও অবাক হলো না। বরং বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিল,
“আমার নাহয় নেই, তোমার আছে তো? তাতেই হবে।”
“ঘরের পুরুষ, বাহিরের পুরুষ, কাউকেই তো ছাড়ছো না। কিছু তো লজ্জা আনো ভেতরে।”
ময়ূরীর কথায় হো হো করে হেসে উঠলো অলকানন্দা। রহস্য করে বলল,
“সব পুরুষকে না ছাড়লেও তোমার পুরুষকে ছেড়ে দিয়েছি, এতে কী তুমি খুশি নও?”
ময়ূরী থমকে গেলো। অলকানন্দার ইশারা বুঝতে তার বাকি রইলো না। চিত্ত স্থির থেকে চঞ্চল হলো। কিছু একটা হারানোর ভয় কার বুকে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠলো সাথে অলকানন্দার প্রতি নিবিড় ক্ষোভ বেরিয়ে এলো। সে হিংস্র চোখে চেয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“চরিত্রহীন…”
“তোমার স্বামী নিলাম না, তোমার ভাগের সোহাগ নিলাম না, সব চাইলেই আমার হতো তবুও চাইলাম না তাও এমন নামকরণ? কলঙ্ক লাগাচ্ছো? পরে সত্যি সত্যি কলঙ্কিনী হতে গেলে কিন্তু তোমার কপাল পুড়বে ঠাকুরঝি। তুমি কী তা চাও?”
ময়ূরী আর কোনো উত্তর দিল না। স্বামী হারানোর ক্ষীণ ভয় তার বুকের মাঝে উঁকিঝুঁকি দিয়ে উঠল। সে তো জানে, তার স্বামীর মনে এই মেয়েটার খুব নিবিড় একটা বসবাস হয়তো আছে। প্রকাশ করেনি মানুষটা কিন্তু ঠিকই আছে হয়তো।
“বড়দি, তুমি কী একটু বেশিই করছো না? একটা মেয়ে হয়ে এতটা ক্ষমতা দেখানো কী তোমার উচিত হচ্ছে বলো?”
“উচিত হচ্ছে না বলছো?”
কৃষ্ণপ্রিয়ার প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন ছুঁড়লো অলকানন্দা। কৃষ্ণপ্রিয়া কর্কশ কণ্ঠে বলল,
“না, হচ্ছে না।”
“উচিত না হলেও এ ক্ষমতা আমি দেখাবো ছোটোবউ। তুমি বরং তোমার স্বামী সামলে রাখো। যাকে দেবতার স্থান দিয়েছো সে না আবার তোমারই বড়ো ক্ষতিটা করে।”
“কোনো ক্ষতিই সে আমার করবে না, বড়দি। তোমার তো স্বামী মারা গেছে তাই তুমি স্বামী সোহাগিনীর সুখ সইতে পারছো না।”
কৃষ্ণপ্রিয়ার কথায় আবারও খিলখিল করে হাসলো অলকানন্দা, হাসতে হাসতে প্রায় লুটোপুটি খাওয়ার জোগাড় তার। সে মুখ চেপে ধরে হাসি সংযত করার চেষ্টা চালালো। কিয়ৎপরিমাণ চেষ্টার পর সে সফলও হলো। তার হাসি কমে এলো, চোখ জুড়ে টলমল করে ওঠলো অশ্রু দানা। সে অনামিকা আঙুল দিয়ে সেই অশ্রু কণিকা মুছতে মুছতে বলল,
“তোমার দিদি মোহমালা কোথায় কৃষ্ণা? এতদিন যাকে আশ্রয় দিয়েছো তোমার বাড়িতে আজ তোমার বিপদে সে কোথায়?”
কৃষ্ণপ্রিয়া ভ্রু কুঁচকালো। অলকানন্দার কথা বুঝতে না পেরে বলল,
“ও তো ওর শ্বশুর বাড়ি গিয়েছে। এতদিন পর স্বামী ফিরিয়ে নিয়েছে এমন সময় আসা সাজে নাকি? সবাইকে নিজের মতন পাষণ্ড ভেবো না, বড়দি।”
“ভাবছি না ছোটোবউ, ভাবছি না বলেই তোমাকে সাবধান করছি। আর আমি খুব ভুল না করলে মোহমালা দিদি খুব শীগ্রই তোমার কাছে আসবে। অপেক্ষা করো।”
“বড়দি, মিছিমিছি আমার দিদির গায়ে কলঙ্ক লেপো না। সবাই তোমার মতন না।”
“হ্যাঁ, সেটা জানি। সবাই আমার মতন না বলেই তোমার কপাল পুড়বে। নাহয় তো তুমি বেঁচেই যেতে।”
কথা কাটাকাটি আরেকটু বাড়ার আগেই ইঞ্জিন চালিত গাড়ির শব্দ হলো। তারা দূর থেকেই জানান দিল এক ঝাঁক ভিনদেশী পুরুষ নিয়ে তারা হাজির হচ্ছে। থেমে গেল বাড়ির রমণীগণ। নবনীল বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে। অলকানন্দাও ওঠে দাঁড়াল। মেয়েরা সকলে অন্দরমহলের দিকে গিয়ে দাঁড়াল কেবল অলকানন্দা ছাড়া। আর নন্দন মশাই, নবনীল তারা বাহিরে এলো। বাড়ির ভেতরের দিকে দাঁড়াল ময়ূরীর স্বামী প্রসাদ আর পানকৌড়ির স্বামী ধ্রুবলালও।
মিনিট খানেক পেরুতেই সাহেবদের গাড়ি বিশাল কারুকাজ শোভিত লোহার গেইট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। অলকানন্দার বুকে দুরুদুরু কম্পন। নবনীল হয়তো বুঝলো সে কম্পন। অতঃপর সে ফিসফিস করে ভরসা দিয়ে বলল,
“পা যেহেতু এগিয়েছেন, ভয় কিসের? পুরো পৃথিবী আপনার বিপরীতে চলে গেলেও একটা কথা মনে রাখবে- আমি আছি আপনার সাথে।”
অলকানন্দা ক্ষীণ হাসলো। কোমল কণ্ঠে বলল,
“আপনি আছেন বলেই একটু ভয় কম পাচ্ছি।”
নবনীল ঘাড় কাঁত করলো। মেয়েটার কৃতজ্ঞতায় থাকতে পেরে যেন তার জীবন প্রায় ধন্য। তন্মধ্যেই সাহেবরা সকলে একসাথেই প্রবেশ করলেন। অলকানন্দাসহ বাকি সকলেই দু-হাত জোর করে তাদের সাদরে আমন্ত্রণ করল। সকলের মুখে গম্ভীরতা থাকলেও অ্যালেন নামের লোকটার মুখে প্রাণোচ্ছল হাসি। সে হাসি বিস্তৃত করেই অলকানন্দার উদ্দেশ্য বলল,
“শুভ সন্ধ্যা, বিউটিফুল। ভালো আছেন আপনি?”
অলকানন্দা কৃত্রিম হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে ঘাড় কাঁত করে বলল,
“বসুন, বসুন। সকলে বসুন।”
অ্যালেন নামের ফর্সা ধবধবে পুরুষটা অন্যেদের দিকে তাকাল, অনুমতি দিয়ে বলল,
“সিট এভ্রিওয়ান। সিট।”
সকলে বসলো। অলকানন্দার ভীষণ অস্বস্তি হলেও সে বসলো। বসতে বাধ্য। কারণ অ্যালেন নামক লোকটা তাকেই সর্বেসর্বা ভাবছে তাই না চাইতেও বসতে হবে। তাছাড়া আজকের কথাবার্তা হবে গ্রামের মানুষদের ফসলি জমি নিয়ে যেখানে সাহেবরা নিজেদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করতে চায়। গ্রামের বেশ অনেক গুলো পরিবার এই জমির উপর নির্ভরশীল। জমিটা সাহেবদের দখলে চলে গেলে তাদের জীবন-যাপনে বড়ো দুর্ভোগ নেমে আসবে যে!
সকলে কুশলাদি বিনিময় করার পরই কথা শুরু করল। শুরু হলো যুক্তিতর্ক। অলকানন্দা প্রথমে চুপ ছিলো, কথা বলছিলেন নন্দন মশাই। কিন্তু হুট করে সাহেবদের মাঝেই বসে থাকা মিস্টার স্টিফেন নামের লোকটা নন্দন মশাইকে বিশাল অঙ্কের একটা প্রস্তাব দিলেন। যদি জমিটা তাদের দেওয়া হয় তবে তার বিনিময়ে নন্দন মশাইদের বিরাট অঙ্কের টাকা দেওয়া হবে। অলকানন্দা চাইলো তার খুড়োশ্বশুরের পানে। লোকটা যা লো-ভী, রাজি না হয়ে যায়! অলকানন্দার ভাবনা সত্যি করে দিয়ে নন্দন মশাইয়ের চোখে মুখে দেখা দিল খুশির চিলিক। সে প্রায় রাজি হয়ে যাবে হাবভাব। এবার মুখ খুলল অলকানন্দা,
“মিস্টার স্টিফেন, দুঃখিত আপনাকে আমরা সে-ই জমি দিতে পারবো না। সে আপনি যত টাকাই আমাদের প্রস্তাব দেন না কেন আমরা আমাদের জমি ছাড়ছি না। গ্রামের কৃষকরা আমাদের উপর ভরসা করে চেয়ে আছেন। তাদের ভরসার দাম কোনো টাকার অঙ্ক পরিপূর্ণ করতে পারবেনা। দুঃখিত।”
সাহেবদের মাঝে অনেকে বাংলা ততটা জানেনা বলে তাদের বুঝতে অসুবিধা হলো তাই যারা বাংলায় পারদর্শী তারা সেটা বুঝিয়ে দিল। নিজেদের মাঝে চলল আলোচনা। মিস্টার স্টিফেন যখন বুঝতে পারলেন তার প্রস্তাব অলকানন্দা প্রত্যাখান করেছে তখনই সেই সাদা রুদ্রমূর্তির ন্যায় মানুষটা খ্যাপে ওঠলেন। কিছুটা হিংস্র হয়ে বললেন,
“আপুনি (আপনি) বাড়াবাড়ি করিতেছেন। আমরা চাইলেই এই জমি কাড়িয়া নিয়া যাইতে পারি। তবুও আমরা আপোনাদেরকে মানি অফার করিয়াছি, ভাবিয়া লন।”
“ভাবাভাবির কিছু নেই মিস্টার স্টিফেন, আমরা টাকা চাইনা। আমাদের জমি আমাদেরই থাকবে।”
স্টিফেন নামের লোকটা এবার দাঁড়িয়ে গেলেন। কিছুটা রুক্ষ স্বরে বললেন,
“ডোন্ট ক্রস ইউ’র লিমিট। আদারওয়াইজ…”
স্টিফেনের কথা শেষ করার আগেই অ্যালেন প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আদার ওয়াইজ হোয়াট? স্টিফ, কাম ডাউন। রেসপেক্ট হার।”
স্টিফেনের রঙচঙে রাগ এবার বিস্মিয়ে পরিবর্তন হলো। সে প্রায় বিস্মিত স্বরে বলল,
“তুমি জানো অ্যালেন তুমি কী বলছো? আর ইউ ম্যাড? হু আর সি? তাকে কেন রেসপেক্ট করিব আমি? সে আমাদের সাথে রুড আচরণ করিতেছে।”
“কাম ডাউন, স্টিফ। সে তার গ্রামের মানুষদের ভালোর কথা ভাবিয়া এসব বলিয়াছে। ডোন্ট এংগ্রি। সি ইজ সাচ অ্য বিউটিফুল এন্ড স্ট্রং লেডি। ইউ নো, সি ইজ অনলি সিক্সটিনথ ইয়ার ওল্ড।”
স্টিফ আবার অবাক হলো বোধহয়। অবাক হয়ে বলল, “অনলি সিক্সটিনথ!”
“ইয়েস।”
স্টিফেনের চোখে এবার অবাক ভাব। ষোলো বর্ষীয়া একটা মেয়ে কি-না তার সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়েছিল সে ভাবতেও যেন পারছে না। তাছাড়া এই দেশ সম্পর্কে তাদের যতটুকু ধারণা সেই ধারণায় এতটুকু একটা মেয়ের এমন সু-উচ্চ সাহসিকতার পরিচয় কোথাও উল্লেখ্য নেই। স্টিফেন আনমনে বললেন,
“ইম্প্রেসিং!”
তন্মধ্যেই তরঙ্গিণী বাড়ির কিছু কর্মচারীকে নিয়ে হাজির হলো যাদের হাতে ছিল খাবারের স্তূপ। হরেক রকমের খাবার নিয়ে সকলে রাখল সাহেবদের সামনের ছোটো টেবিলটাতে। পুরো টেবিল মুহূর্তেই খাবার দিয়ে পূর্ণ হয়ে গেলো। সেখানে অনেক আমিষ খাবার থাকায় অলকানন্দা ওঠে দাঁড়াল। বিনীত স্বরে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনারা আহার করুন আমি অন্দরমহলে যাচ্ছি। আসলে আমার আমিষের ধারে কাছে থাকা অনুচিত।”
স্টিফেন এবার আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল, “হোয়াই?”
“কারণ আমি বিধবা। আর আমাদের স্বামী মারা যাওয়ার পর এসব খাবার থেকে দূরে থাকতে হয়। নাহয় আমরা অশুদ্ধ হয়ে যাবো।”
অলকানন্দার উত্তরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো স্টিফেন। অ্যালেনের মুখে হাসির রেখা। বুক ভরে গেছে মুগ্ধতায়। তার সামনে দাঁড়ানো নারীটার মাঝে যেন একা আকাশ পরিমাণ মুগ্ধতা।
_
গ্রামের মানুষদের আরও একটা দারুণ খবর দিয়ে এবার অলকানন্দা সকলের পছন্দের আসনে পাকাপোক্ত ভাবে আরোহন করলো। সকলের মুখে মুখে তার জয়ধ্বনি। সাহেবরা এতদিন যে জমি আটকে রেখেছিল সেটা কৃষকদের দিয়ে দিবে জানিয়েছেন। আনন্দের সীমা রইলো না কারো। এ যেন এক অসম্ভব কিছু সম্ভব হওয়া। চারদিকে অলকানন্দার একটা জয়ধ্বনি পড়ে গেল যেন!
নিজের বিছানায় শুয়ে আছে অলকানন্দা। মিলাচ্ছে তার ছোটো জীবনের বিরাট হিসাব-নিকাশ। হুট করে তার এত অবহেলিত জীবনটা এতটা উঁচুতে উঠে গেলো সে ভাবতেও পারছে না। তবে খুব দ্রুত উঁচুতে উঠে না আবার মুখ থুবড়ে পড়তে হয় সে-ই ভয়ে কাঁপছে তার বুক। মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু বোধহয় হতে চলেছে। তার ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে একটা খবর এলো। অলকানন্দার বাড়ি থেকে খবর এসেছে। অলকানন্দার ছোটো বোনটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
#চলবে
#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
১৪.
দামোদর গ্রামের পাশ দিয়ে বিশাল এক দিঘি স্রোতশূন্য হয়ে নিবিড় ভাবে অবস্থান করেছে। রোদের আলোতে দিঘির জল অপরূপ সুন্দর লাগে। একদম স্বচ্ছ, পরিষ্কার। কিন্তু আকাশ বাদলা হলেই দিঘির জল গুলো কালো কুচকুচে লাগে। কেমন কুৎসিত! দিঘির জলের এ পরিবর্তনকে গ্রামবাসী বহু বছর যাবত অলৌকিক কিছু ভেবে আসছে যার জন্য তারা প্রায় প্রতি তিথিতে গঙ্গাপূজা করে। তাদের বিশ্বাস, অলৌকিক কিছুর পুজো করলে তা কখনো আর হিংস্র হয়ে কারো বিপদ ঘনিয়ে আনবে না। শুধু তাই না, তারা এই দিঘির কয়েক প্রান্তে বিশাল ঘাটও নির্মাণ করিয়েছে জমিদার সুদর্শনকে বলে। একটি ঘাট ছিল প্রচন্ড রাজকীয়। গ্রামের দক্ষিণ দিকে সে ঘাটটি পড়েছিল। জমিদার বাড়ির কাছাকাছি। বিরাট কারুকার্জ শোভিত সেই ঘাট ছিল বিদেশি কোনো পাথরের। রাত হলেই যেন সে পাথর থেকে আলো ছড়াতো। দামোদর গ্রামে সেটা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে ধরা হয়েছিল। এত সুন্দর জিনিস তারা এর আগে কখনোই দেখেনি যে! তাদের ধারণা দিঘিটি অলৌকিক বলে পাথর গুলোও এমন আলো ছড়ায়। অথচ এটিকে বলা হয় ‘মার্বেল পাথর’। যার আলাদা নিজস্বতা আছে। কিন্তু গ্রামবাসী সেটা মানতে নারাজ। এই ঘাটেই বিকেল হলে বিভিন্ন বাড়ির বউ, মেয়েরা লুকিয়ে আসে, এত অসাধারণ দৃশ্য দেখার উত্তেজনা তারা দমিয়ে রাখতে পারেনা। আজ সেই দিঘির পাশ কেটেই গঙ্গাপুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশাল আয়োজনেই হচ্ছে সে পুজো। এই দিনটাতে গ্রামের সকলেই এখানে উপস্থিত থাকে। এমনকি মেয়ে বউরাও।
অলকানন্দাও এখানে এসেছে। যদিও সে নব বিধবা, নিয়ম অনুসারে সন্ধ্যার পর তার ঘর ছেড়ে বাহির হওয়া উচিত নয় কিন্তু অলকানন্দা এসব নিয়ম খুব কম মান্য করে বলেই এখানে এসেছে। তার উপর তার একটা প্রয়োজনীয় কাজও আছে। তার মেঝো বোনটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা সেটা নিয়েও এখানের দায়িত্বরত দারোগা বাবুর সাথে কিছু কথা বলবে সে। আর সেই দারোগা বাবু আজ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন।
বিশাল এক আয়োজনে মুখরিত দিঘির চারপাশ। চারদিকে মশালের লালাভ আগুন সেই মুখরিত পরিবেশকে করেছে উজ্জ্বল। অলকানন্দারা পুরো পরিবারসহ পুজোতে আসতেই তাদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ। কেউবা বসার জায়গা করে দিল, কেউবা এগিয়ে দিল জল, কেউবা ব্যস্ত হাতে শুরু করল বাতাস। অলকানন্দা চারপাশে চাইলো, তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টি অনেক মহিলাদের। সদ্য বিধবা মেয়ে এমন ভাবে সবকিছুতে নিজে আধিপত্য বিস্তার করিয়েছে এটা আবার কিছু নারীর সহ্যও হলোনা। তাই তো কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা এগিয়ে এলেন। তাদের শরীরে শোভা পাচ্ছিলো নানা রকমের গহনা। সব স্বর্ণেরই। তারা এগিয়ে এসে প্রণাম ঠুকলো ‘বিহারিণী মহলের’ সকলের উদ্দেশ্যে। সকলে সাদরে প্রণাম গ্রহণও করলো। তন্মধ্যেই সম্ভ্রান্তশালী এক নারী সুরবালার উদ্দেশ্যে বলল,
“দিদি, আপনার পুত্র তো কয়েকমাস আগেই মারা গেল তাই না?”
সুরবালার মুখটা এতক্ষণ যাবত হাসিখুশি থাকলেও কথাটা শুনে হাসিটা কিঞ্চিৎ থিতিয়ে এলো। সে ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল,
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আপনার সদ্য বিধবা বউ এই রাতের বেলা এখানে উপস্থিত হয়েছে যে! যতই হোক, নিয়মকানুন বলেও তো কিছু আছে তাই না? বিধবা মেয়েদের তো একটু বাছ-বিচার মানতে হয়।”
অলকানন্দা মহিলাটার পানে চাইলো। মহিলাটার চোখ-মুখে কেমন নিবিড় ক্ষোভের ছোঁয়া। অথচ অলকানন্দা মহিলাটাকে চেনে না। তবে তার জন্য মহিলার এমন আচরণের কারণই বা কী! নবনীল অলকানন্দার পাশেই ছিল। অলকানন্দার মনের জেগে ওঠা প্রশ্নটা বুঝতে তার বেশি সময় লাগল না। তাই তো সে এক গাল হেসে অলকানন্দাকে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
“তোমার শ্রেণীতে পড়ে প্রতিমা আছে না? প্রতিমার মা উনি।”
অলকানন্দা এবার মহিলার ক্ষোভের কারণ বুঝলো। শীতল কণ্ঠে বলল, “ওহ্।”
কিন্তু থেমে নেই মহিলা। সে একের পর এক ধর্ম বাক্য পাঠ করেই যাচ্ছেন। সুরবালা বিরক্ত হলেন। কপাল কুঁচকে বললেন,
“দিদি, যার ভালো সে বুঝে নিবে, তাই না?”
ভদ্র মহিলার উৎসাহ নিয়ে জ্ঞান বাক্য পাঠ করা সেখানেই থেমে গেলো। সুরবালার কথায় সে প্রায় বিরক্ত হয়েই বলল,
“দিদি, সময় থাকতে সামলান। নাহয় পস্তাতে হবে।”
সুরবালা দেবী যেন গায়েই মাখলেন না সে কথা। তার ভাব ভঙ্গিতে প্রশ্রয় না পেয়ে ভদ্রমহিলা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলেন। সুরবালা তা দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কঠিন স্বরে বললেন,
“মানুষরা কেন যেন অন্যের ভালো সহ্য করতে পারেনা কে জানি!”
সুরবালার কথাটা সহ্য হলো না পানকৌড়ির। সে মুখ ঝামটি মেরে বলল,
“বড়োমা, তুমি তোমার পুত্রবধূকে একটু বেশিই উপরে তুলে ফেলছো। মানুষ তোমাকে ভালোে জন্যই সাবধান হতে বলছে। তুমি বুজছো না। পরে সময় গেলে হা হুতাশ করবে।”
“রক্ষা করো মা আমার। এত ভালো তোমাদের করতে হবেনা।”
পানকৌড়িও আর কথা আগাতে পারল না। মনময়ূরী অন্যদিনের মতন তার সাথে যোগ দেইনি তাই কথা আগানোর ভরসাও সে পেল না। তন্মধ্যেই ইংরেজি সাহেবরা উপস্থিত হলেন সে অনুষ্ঠানে। অলকানন্দা আজ কপাল অব্দি ঘোমটা দেয়নি যার ফলস্বরূপ তার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গোলগাল কিশোরী চেহারা। সাহেবরা অনুষ্ঠানে প্রবেশ করতেই গ্রামবাসীরা সকলে স্থান ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। একেকজন ভয়ে প্রায় জবুথুবু হলো। কেউ কেউ বসার জায়গা পরিষ্কার করে দিল। তন্মধ্যেই পুজোর জন্য তুলে আনা এক কলস জল নিয়ে যাওয়ার সময় কিশোর ছেলে পা পিছলে পড়ে গেলো। মাটির কলস ভেঙে চুরমার। ততটুকুতেও ক্ষান্ত হয়নি, কলসের বেশি খানিকটা জল গিয়ে পড়লো সাহেবদের মাঝে একজনের শরীরে। সে ক্ষ্যাপে গেলেন। শক্ত বুট জুতা পরিহিত পা নিয়েই জোরে একটা লাথি দিল ছেলেটার বুকে। আৎকে উঠলো সকলে। আর্তনাদ করে উঠল ছেলেটা। অলকানন্দাও এমন নৃশংসতায় বাক্ হারা প্রায়। সাহেব দ্বিতীয় বারের মতন লাথি দিলেন ছেলেটার পেটে যার দরুন ছেলের নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরা শুরু হল। তৃতীয় বারের মতন পা আগাতে নিলেই রুখে দাঁড়াল অলকানন্দা। বজ্রকণ্ঠে বলল,
“আর এক পা-ও আগাবেন না সাহেব। খবরদার।”
সাহেব থেমে গেলেন। অলকানন্দা এতক্ষণে খেয়াল করল এটা আর কেউ না, মিস্টার স্টিফেন। অলকানন্দা ভারী অবাক হলো। লোকটাকে সে একটু কঠিনই ভেবেছিল কিন্তু তাই বলে এতটা মায়াদয়াহীন মানুষ!
স্টিফেনের পা থেমে গেলে। শুভ্রা রাঙা শাড়ি পরিহিতা শুভ্র নারী অলকানন্দার চোখ-মুখে উপচে পড়া তেজ দেখে সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। বেশ তাচ্ছিল্য করে বললেন,
“আপনি বাড়াবাড়ি করিতেছেন একটু বেশি।”
“এই গ্রামের মানুষ গুলোর দায়িত্ব আমার। তাদের ভালোর জন্য আমি কেবল একটু না, অনেকটাই বাড়াবাড়ি করতে পারি, সাহেব।”
মিস্টার স্টিফেন হো হো করে হেসে উঠলেন। অলকানন্দার বাঁধন না মেনেই ছেলেটার বুকে শক্ত এক লাথি দিলেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
“এত সাহস দেখাইতেছেন? আমি কিন্তু সেই সাহস দুই মিনিটেই ভেনিশ করিয়া দিতে পারিব। দেখিবেন?”
অলকানন্দার মাঝেও একটা তেজ কাজ করল। সে রণমুর্তি ধারণ করে বলল,
“দেখি সাহস।”
অ্যালান থামানোর চেষ্টা করলো স্টিফেনকে কিন্তু সে থামলো না। তার চোখের ইশারা পড়তেই একটা লোক সেখান থেকে প্রস্থান নিলো। তার মিনিট দুইয়ের মাঝেই সে লোকটা একটা বিধ্বস্ত মেয়েকে উপস্থিত করালো। তেরো কিংবা চৌদ্দ বর্ষীয়া হবে! পোশাক ছেঁড়া, ছিন্নভিন্ন অবস্থা।
অলকানন্দা চমকে গেলো নিজের বোনকে দেখে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“অন্নপূর্ণা!”
#চলবে
#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
১৫.
বিমূঢ় চিত্ত নিয়ে হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে অলকানন্দা। তার দৃষ্টি অস্থির। ছুটে গিয়ে নিজের ছোটো বোনটাকে দু’হাতে জাপ্টে ধরল। সময়টা তখন রাতের শুভারম্ভ। আকাশে বাতাস গুমোট করা একটা উষ্ণতার ছোঁয়া। গ্রামবাসীর হৈ হুল্লোড় করা অনুষ্ঠান প্রায় থিতিয়ে এসেছে। অলকানন্দা নিজের বোনের ধ্বংসাবশেষ টুকু ভীষণ যত্নে বুকের মাঝে আকড়ে ধরল। ছোটো বোনের এমন দশায় সে দিক ভ্রষ্ট। ছুটে এলো সুরবালা, নবনীলও। অলকানন্দা বিচলিত কণ্ঠে বার কয়েক ডাকল নিজের বোনকে,
“অন্নপূর্ণা, এই অনু, চোখ খোল। দিদি ডাকছি তো।”
অন্নপূর্ণার বিশেষ ভাবান্তর হলো না। সে নিভু নিভু চোখে বার কয়েক তাকাল কেবল। একটা শীতল রাগ অলকানন্দার শিরদাঁড়ায় প্রবাহিত হলো। সে কিছুটা তীক্ষ্ণ স্বরে মিস্টার স্টিফেনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনি আমার বোনের এ অবস্থা করেছেন! আপনি!”
স্টিফেন উত্তরে কেবল মুচকি হাসলেন। ভিনদেশী এই সুপুরুষের হাসি বড্ড চমৎকার লাগল। বেশ গভীর ভাবে খেয়াল করলে বোঝা যায় লোকটার বা’গালে একটা ছোটো গর্ত হয় হাসলে যা আরও চমকপ্রদ লাগে। সচারাচর অতিব ফর্সা রঙের পুরুষের মুখে মায়া খুঁজে পাওয়া যায় না কিন্তু স্টিফেনের মুখে একটা নিবিড় মায়া দেখতে পাওয়া যায়। অন্যান্যদের মতন তার চুল গুলো লালচে কিংবা ধূসর হলদেটে রঙের না। তার চুল কালো রঙেরই তবে সাধারণ বাঙালিদের মতন অত কুচকুচে কালো না। আর চোখের পাপড়ি গুলো বেশ ঘন। এমন চোখ পুরুষদের চেয়ে নারীদের বেশি মানায়। কারণ নারীদের চোখ কথা বলার জন্য ব্যবহৃত একটি গোপন অঙ্গ। নারীর চোখ হাসে, কাঁদে কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। পুরুষদের চোখ সবসময় থাকে কঠিন, তীক্ষ্ণ, খা খা মরুভূমির মতন। অথচ স্টিফেনের ক্ষেত্রে পুরো বিপরীত। বরং মনে হচ্ছে এমন ঘন পাপড়ি যুক্ত চোখ তাকে ছাড়া আর কাউকেই মানাবে না।
অলকানন্দা হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু তার আগেই তাকে থামিয়ে দিল নবনীল, সাবধানী কণ্ঠে বলল,
“ভেবে করবেন কাজ, নন্দা। আপনি, আমি যত বড়ো মানুষই হইনা কেন, ওদের সামনে কিছুই না। ওদের ক্ষমতা একবার দেখানো শুরু করলে আমরা ধোপে টিকবো না।”
অলকানন্দার শরীরে তখন উপচে পড়া জেদ কিন্তু সে বরাবরই বুদ্ধিমতী, তাই সংবরণ করলো নিজের জেদ। কণ্ঠ কঠিন রেখেই সাহেবকে শুধালো,
“আপনার কোনো সমস্যা থাকলে সেটা তো আমার সাথে মিস্টার স্টিফেন, তবে আমার বোনের এমন অবস্থার কারণ?”
অ্যালেন কিছু একটা বলতে চাইলেন অলকানন্দাকে কিন্তু স্টিফেন থামিয়ে দিল তাকে। বাঁকা হেসে বলল,
“রাজার আসনে বসতে হলে রাজনীতি জানতে হয় সানশাইন। আপনি রাজনীতিতে বড্ড কাঁচা। রাজার চতুরতা থাকতে হয়, কেবল সাহসিকতা দিয়ে কিছু হয় না, নাথিং। গ্রো আপ, যুদ্ধ বাকি আপনার।”
অলকানন্দা তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইলো। স্টিফেন এত ভালো বাংলা বলতে পারেন কেউ বুঝবেই না যে যে ভিনদেশী! খুব পরিপক্ব বাংলা বলেন উনি। আগে তেমন খেয়াল না করলেই তার মুখে বাংলাটা শুনতে বেশ সুমধুর লাগে! আর তার কথার গম্ভীর্যতা বহুদূর প্রসারিত।
অলকানন্দা ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকতে থাকতে স্টিফেন সেখান থেকে প্রস্থান নিলেন। অ্যালেনসহ বাকিরাও তার পিছে পিছে চলে গেলেন। পিছনে রেখে গেলেন বিস্মিত কিছু নয়ন।
_
মাথার উপর নিশ্চুপ ভাবে ঘুরছে স্থির তিন পাখা যুক্ত যন্ত্রখানা। তার নিচে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো মানুষ। ফ্যাসফ্যাসে গলায় এক কোণায় কাঁদছে অলকানন্দার মা। থেমে থেমে সেই মিহি কান্নার স্বরই ঘর জুড়ে শোনা যাচ্ছে। তন্মধ্যেই অলকানন্দার বাবা নিতাই দাস খেঁকিয়ে উঠলেন অকথ্য ভাষা ধরে,
“মা গী মহিলা, তুই রাখতে পারিস নাই আমার মাইয়াটারে সামলাইয়া? খান কি বানাইয়া ছাইড়া দিলি। কে বিয়া করবো অহন ওরে? তার উপর কলঙ্ক মাথায় নিয়া ডুইবা না মইরা ও বিছানাতে শয্যাশায়ী হইছে। কোনো লাজ লজ্জা নাই মা গীর ভিতরে।”
নিতাই দাস আরও কিছু বলতেন কিন্তু থামিয়ে দিলেন সুরবালা দেবী। সাবধানী কণ্ঠে বললেন,
“নিতাই বাবু আপনার ভাষা সংযত করুন।”
“ভাষা সংযত করতে কইতাছেন? সংযত! এক মাইয়া কলঙ্ক পাইলো আরেক মাইয়া বেধবা হইয়া….”
“আরেক মেয়ে বেধবা হয়ে তোমার কোনো ক্ষতিই করেনি, বাবা। আর না তোমার ঘাড়ে গিয়ে উঠেছে। তাই নিজেকে দুঃখী প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই।”
অলকানন্দার শক্ত জবাবে তাজ্জব নিতাই দাস। তার বড়ো মেয়ে মুখের উপর এমন শক্ত জবাব দিতে পারে তার এটা অবগতই ছিলো না বোধকরি। নন্দন মশাই এই যেন মোক্ষম সময় পেলেন। নিতাই দাসকে নালিশের বার্তা দিলেন,
“অবাক হচ্ছেন নাকি বেয়াই মশাই? এটা আপনার মেয়েই যে বড়োদের শাসন, আচার-আচরণ না মেনেই করছে যা ইচ্ছে তা।”
নিতাই দাস ক্ষুব্ধ হলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বাজখাঁই গলায় বললেন,
“এত অধঃপতন হইছে তোর? মাইয়া মানুষের কণ্ঠ উঁচুতে উঠলে তাকে কী বলে জানিস? তাকে বে….”
“খবরদার, বাবা। তোমার মুখ থেকে আরেকটা অসম্মানজনক শব্দ বেরুলে তা তোমার জন্য বিপদ আনবে।”
অলকানন্দার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের সাবধানী বাণী নিতাই দাসের রাগকে দ্বিগুণ করে তুললো। সে মেয়েকে মারার জন্য উদ্যত হতেই অলকানন্দা শক্ত কণ্ঠে বাড়ির কর্মচারীকে ডাকল,
“গোবিন্দ কাকা, গোবিন্দ কাকা।”
অলকানন্দার কণ্ঠ তখন কিছুটা উঁচুতেই। তার ডাকে গোবিন্দ কাকা নামক ষাটোর্ধ্ব মানুষটা তার স্থুলাকার দেহটা নিয়ে খুব দ্রুতই উপস্থিত হলেন। এসেই মাথা নত করে বললেন,
“জি বউমা, আদেশ করুন।”
অলকানন্দা তেজস্বিনী চোখে চাইলো নিজের বাবার পানে। কন্যার চোখে তখন উপচে পড়া ক্রোধানল। সেই ক্রোধান্বিতা কন্যা নিজের বাবার দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,
“গোবিন্দ কাকা, আপনি এক্ষুণি উনাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিবেন। আর উনাকে যেন এই বাড়ির চারপাশে না দেখা যায় সেটা সকলকে জানিয়ে দিবেন। আমার হুকুম।”
নিতাই দাস আকস্মিক মেয়ের আচরণে বাক্যহারা হয়ে গেলেন। অবাক দু’টো চক্ষু মেলে কেবল বিস্মিত ভঙ্গিতে দেখলেন তার শান্ত মেয়েটার হুট করে বিরাট পরিবর্তনের সামান্য উদাহরণ। তার ধ্বনিরা হামাগুড়ি দিয়ে যেন বারংবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। সে চেয়েও কিছু বলতে পারল না।
অলকানন্দার মা সইলেন না মেয়ের কঠোরতা। মেয়ের কাছে ছুটে এসে মেয়ের বাহুতে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললেন,
“পাগল হলি নাকি, নন্দু? তোর জন্মদাতা লোকটা। তুই কীভাবে এমন আচরণ করলি উনার সঙ্গে? একটু বাঁধলো না?”
“না মা, বাঁধেনি। যে পিতা কন্যার সুখ দুঃখ না বুঝে কেবল নিজের আত্ম অহংকারকে বড়ো করে দেখে, কন্যার মনে সে পিতার কোনো স্থান নেই। বিধবা হয়েছিলাম বলে যে পিতা কন্যাকে বলেছিল অন্যায় সব মুখ বন্ধ করে সহ্য করতে, সে পিতার আসন আমার কাছে নেই। যেই পিতা নিজের কন্যার দুঃসময়ে কেবল কলঙ্কের কথা ভেবে ডুবে মরতে বলেন তাকে পিতার আসনে বসানো পৃথিবীর বৃহৎ তম ভুলের মধ্যে অন্যতম একটি ভুল।”
নিতাই দাস তখন প্রায় হতভম্ব। গোবিন্দ কাকা শুনলেন অলকানন্দার কথা। কিছুটা টেনেই মানুষটাকে বের করে নিয়ে গেলেন। অলকানন্দার চোখ টলমল করছে তবে সে কাঁদলো না। বাবাকে আজ এমন পরিস্থিতিতে না ফেললে হয়তো অন্নপূর্ণার মৃত্যুর কারণ হবে বাবা। কখনো কখনো একটু ভালোর জন্য কঠিন হতে হয়।
_
অন্নপূর্ণাকে নেওয়া হলো শহরের একটি চিকিৎসালয়ে। পুরুষ ডাক্তার চিকিৎসা করে বিধায় প্রায় অনেকের ছিল অমত কিন্তু শুনলো না অলকানন্দা সেই বাঁধা। ছুটলো শহরে। অন্নপূর্ণা তখনও জ্ঞানশূন্য। অলকানন্দা শহরের চিকিৎসালয়ে উঠতেই চিকিৎসা শুরু হয় অন্নপূর্ণার। ডাক্তার জানায় মেয়েটার জিহ্বা কেটে ফেলা হয়েছে।
#চলবে