অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
766

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২৩.

বাতায়নের কোল ঘেঁষে উঁকি দিয়েছে চাঁদ। সন্ধ্যার চাদর জড়ানো আকাশ এখন আঁধারে নিমজ্জিত হয়েছে। অলকানন্দা বসে আছে তার জানালার ধারে। চাঁদের আলো নিবিড় ওষ্ঠে চুম্বন এঁকে দিচ্ছে তার নাকে-মুখে। ছোটো ছোটো ঘাড় অব্দি চুল গুলো উড়ছে নিজের মন মতো। চাঁদের কিরণের সংস্পর্শে এসে শরীরের গহনা গুলো ঝলমল করে উঠছে। গভীর ভাবনায় মগ্ন অলকানন্দা। লক্ষ্মীদেবীর মৃত দেহ দেখে সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি বিহারিণী মহলে। যেমন দ্রুত গিয়েছিল ঠিক তেমন ভাবেই চলে এসেছিল। স্টিফেনও জোর করেনি। বরং অলকানন্দার সিদ্ধান্তকে সে নিবিড় ভাবে সম্মতি প্রদান করেছিল। কিন্তু লক্ষ্মীদেবীর বিয়োগ ব্যাথা বড়ো কষ্ট দিয়েছে অলকানন্দাকে। খারাপ হোক, ভালো হোক সে তো মানুষটাকে আপন ভেবেছিল।

আনমনে যখন গভীর ভাবনায় ব্যস্ত সে, তার নজর হুট করে জানালার বাহিরে যেতেই সে ভ্রু কুঞ্চিত করল। ভরা পূর্ণিমায় খুব পরিচিত মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হতেই সে চমকে উঠল। সে আরও গভীর ভাবে খেয়াল করতেই দেখল যে তার দৃষ্টি ভ্রম দেখছে না, সত্যিই পরিচিত মুখ ওটা। অলকানন্দার বুক কেঁপে ওঠে। স্টিফেন লোকটাকে যতটুকু ধারণা করা যায়, লোকটা খুবই নিষ্ঠুর। যদি নবনীলকে এখানে একবার দেখতে পায় তবে তো হয়তো তাকে জীবিত রাখবে না। লোকটার মনেপ্রাণে কোনো মায়া নেই।

অলকানন্দা দ্রুত উঠে দাঁড়াল। সাবধানী চোখে আশপাশে তাকিয়ে খুব ধীরে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। কর্মচারীর কেউ কেউ আড় দৃষ্টিতে দেখে নিয়েছে তাকে। কিন্তু সেদিকে হুঁশ নেই মেয়েটার। সে যেন নবনীলকে আড়াল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।

বড়ো লোহার দ্বার ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুটো প্রহরী। কোনো নড়চড় নেই, কথা নেই। স্তব্ধ যেন! অলকানন্দা বের হতে নিলেই তারা প্রথম কথা বলে,
“সাহেব বধূ, আপনি এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন?”

অলকানন্দার ভীতু হৃদয় আরেকটু কেঁপে ওঠল। আমতা-আমতা করে খুব সাজিয়ে মিথ্যে কথা বলল,
“আপনাদের সাহেব আমাকে যেতে বলেছিল এই সময়ে চন্দ্রমল্লিকার মাঠে। কিছু দেখাতে নিয়ে যাবেন বোধহয়। সেখানেই যাচ্ছি।”

প্রহরী দু’জন কথাটা খুব একটা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হলো না। দু’জন দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তার মাঝে একজন বলল,
“আমরা তবে এগিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। আর নাহয় গাড়ি নিয়ে যান। এই অন্ধকারে একা যেতে পারবেন না।”

অলকানন্দা পরে গেলে বিপাকে। তাও মিনমিন করে বলল,
“আমি একা যেতে পারব, আপনাদের যেতে হবে না।”

প্রহরী দু’জন আরও কিছু হয়তো বলতো কিন্তু তারা আর কোনো বাঁধা না দিয়ে চুপ করে গেল। অলকানন্দা ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাতেই দেখল তাদের বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ একজন নারী কর্মচারী দাঁড়িয়ে আছেন৷ অলকানন্দা তাকাতেই মহিলা চলে গেলেন। প্রহরীরাও আর কোনো বাঁধা দিলেন না। খুব সাধারণ ভাবেই গেইট খুলে দিয়ে আবার মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে রইলেন। অলকানন্দার কেমন যেন খটকা লাগল ঘটনাটায়। কিন্তু তার মস্তিষ্ক জুড়ে তখন নবনীল এতটাই গ্রাস করে ছিল যে সে দ্রুতই ছুটে গেল সেদিকে।

উজ্জ্বল চাঁদের রূপসী জ্যোৎস্না ফুটেছিল অশ্বত্থ গাছের কোল ঘেষে। সেই জ্যোৎস্নায় স্নান করছে প্রকৃতি। বিরাট শিউলী গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে নবনীল ও অলকানন্দা। নবনীলের চোখ-মুখ মৃত প্রায়। চোখেদের আজ নিজস্ব কোনো ভাষা নেই, প্রাণ নেই। কেমন গা জুড়ে অসহায়ত্ব। অলকানন্দা ক্ষীণ স্বরে সেই নবনীলের পানে তাকিয়ে রইলো। এক, দুই করে ঠিক কতখানি মিনিট অতিক্রম হওয়ার পর নবনীল তার শব্দগুচ্ছ উচ্চারণ করল কণ্ঠে,
“আমার আর কেউ রইল না, নন্দা। না মা, না আপনি। পৃথিবীতে এত একা কেউ থাকতে পারে! পাখিরও বাঁধন প্রয়োজন হয়, শুকনও বাঁচতে চায়। আমার বেলা তবে কিছু নেই কেন?”

মায়া মায়া প্রকৃতিতে বড্ড করুণ শুনালো বাঁচতে চাওয়ার সে আকুতি। অলকানন্দা নিরীহ চোখে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলল,
“সামলে উঠুন। সব ভালো হবে।”

“যে ভালোতে আপনি নেই সে ভালো আমার চাই না। যে ভালোর জন্য আপনাকে হারাতে হয় সে ভালোর কোনো প্রয়োজন নেই আমার।”

“কিন্তু কী করবেন বলুন? ভাগ্যের লিখা তো কেউ বদলাতে পারে না।”

“আপনি আপনার এমন ভাগ্যকে তবে মেনে নিলেন? আমি কী বোকা দেখুন! আমি আরও ভাবছিলাম আপনিও বোধহয় ভালো নেই।”

অলকানন্দা চুপ করে রইল। নবনীল আরেকটু কাছে এলো। অলকানন্দা থেকে এখন তার দূরত্ব ঠিক দু-হাত। সে কেমন রহস্য করে বলল,
“স্টিফেন নামক অত্যাচারী এক লোকের কাছে অলকানন্দা কী চির জীবন বাঁধা থাকবে?”

অলকানন্দা থতমত খেলো। নবনীলের কথায় তার আবার মনে পড়ল স্টিফেনের অত্যাচারী স্বত্বার কথা। নবনীল তখন তাচ্ছিল্য করে বলল,
“যে মানুষ আপনার বোনের এমন অবস্থা করেছে, সে মানুষকে আপনি আপনার এত সুন্দর জীবনটা সোপে দিচ্ছেন। এতটা স্বার্থপর তো আপনি ছিলেন না।”

অলকানন্দার ভিত্তি কেঁপে ওঠল। সত্যিই তো, যে মানুষটা তার বোনের ক্ষেত্রে এত নিষ্ঠুর ছিল, সে মানুষটাকে সে কি-না চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে চাচ্ছে?

নবনীল হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু দূর থেকে ভেসে আসা গাড়ির ইঞ্জিন তাদের সতর্ক বার্তা শোনালো। অলকানন্দা ভীতু চোখে আশপাশ চাইলো। স্টিফেন চলে এসেছে। আর এক মুহূর্ত বাহিরে থাকলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। অলকানন্দা ব্যস্ত হযে পা বাড়াল। যেতে যেতে বলল,
“আপনি এখানে এভাবে আর আসবেন না নবনীল। উনি দেখলে হয়তো আপনার সাথেও খারাপ কিছু করে ফেলবে।”

নবনীল হয়তো আর কিছু বলতো কিন্তু সেই সুযোগ অব্দি পেল না, তার আগেই অলকানন্দা ছুট লাগাল। নবনীল হতাশার শ্বাস ফেলল, আফসোস করে বলল,
“আপনি আর আমার নেই।”

_

স্টিফেন বসে আছে তার ঘরের আরামকেদারায়। অলকানন্দা ভীতু ভীতু পায়ে ঘরে ঢুকল। স্টিফেনের চোখ বন্ধ। ফর্সা গায়ের রঙ লোকটার, চোখের মনিতে কেমন নীলাভ ভাব। দেখতে ভারী সুপুরুষ মনে হয়। দু’বার তাকে ফিরে দেখতেই হবে।

অলকানন্দা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকতেই স্টিফেন স্মিত হাসল। ফিসফিস করে বলল,
“আমার ঘরের নারী আজকাল কী পরের কাছে যাচ্ছে?”

অলকানন্দার পা থেমে গেল। বুক দুরুদুরু করছে তার। লোকটা কী কিছু জেনে ফেলল। স্টিফেন উত্তরের আশা করল না। নিজের মতন দুলতে দুলতে বললেন,
“তোমার আশেপাশে কোনো পুরুষের ছায়াও কিন্তু আমি সহ্য করবো না সানশাইন।”

অলকানন্দা বিমূঢ় চিত্তে দাঁড়িয়ে রইল। স্টিফেন তার দিকে এগিয়ে এলো। খুব নিকটে, খুব কাছে চলে এলো। অলকানন্দার বুকের কম্পন দূঢ় হলো। স্টিফেন আলগোছে অলকানন্দার মাথা থেকে শিউলী ফুলটা ছাড়িয়ে নিল। ফিসফিস করে বলল,
“সানশাইন, বেঁচে গেছ। তোমার শরীর থেকে ঝরা শিউলীর সুবাস আসছে। কোনো পুরুষের নয়।”

অলকানন্দা শ্বাস বন্ধ করে রাখল। স্টিফেন খুব নিবিড় ভাবে ছুঁয়ে দিল অলকানন্দার কোমড়। অতি ঘনিষ্ঠ হয়ে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
“তুমি প্রেম নিয়ে করোনা ছলনা। স্টিফেন সব কিছুর ভাগ দিলেও সানশাইনের এক ফোঁটা ভাগও কিন্তু কাউকে দিবে না।”

_

সকাল হতেই স্টিফেনের তাড়নায় অলকানন্দাকে বেরুতে হলো। কোথায় যেন গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে প্রায় অনেকক্ষণ পর গাড়ি থেকে নামল অলকানন্দা। স্টিফেনের পেছন পেছন যেতেই নন্দা চমকে উঠল। তারা হসপিটালে এসেছে। অন্নপূর্ণা তাদের দেখে হাসছে।

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২৪.

বাহিরে বৃষ্টি পড়ছে, ঘরে কী যেন একটি বাদ্যযন্ত্রে বাজছে কোমল স্বরে গান। আকাশে ঘন কালো মেঘের স্তূপ। থেকে থেকে বজ্রপাত হচ্ছে। প্রকৃতি অজানা তান্ডবে মত্ত। বিরাট বিরাট গাছপালা গুলো তান্ডবীয় বাতাসের কারণে হেলেদুলে পড়ছে।

অলকানন্দা দাঁড়িয়ে আছে তার রুমের জানালার কোল ঘেঁষে। লাল টকটকে একটি শাড়ি জড়ানো শরীরে। মোটা জড়োয়া গহনা সারা অঙ্গে। মেয়েটাকে শহরের কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে স্টিফেন। সেদিন অন্নপূর্ণাকে দেখে আসার সময়ই ভর্তি করিয়ে এসেছে। লোকটাকে দেখে সে অবাকই হচ্ছে। ঠিক বুঝে ওঠতে পারছে না মানুষটা চাচ্ছে কী? কেন এত রূপ প্রদর্শন! কেন ক্ষণে ক্ষণে প্রেম দিচ্ছে কখনো বা কঠোরতা! চাচ্ছে কী সে? কথাখানা ভাবতে ভাবতেই তার নজর বাগানটার দিকে গেল। বিদ্যুৎ চমকানোর ফলে রহস্যজনক মনে হলো এই বাগান নামক গোলকধাঁধা। অলকানন্দার মনে পড়লো বিয়ের প্রথম দিন যে মেয়েটাকে দেখেছে, আজকাল সে মেয়েটাকে আর সে দেখেনা। কেন দেখেনা? কই মানুষটা?

মেয়েটার ভাবনা উদয় হতেই তার ভ্রু কুঁচকে এলো। এতদিনে তার মেয়েটার কথা মনে পড়লো। কোথায় মেয়েটা! অলকানন্দা ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। সুন্দর, রাজকীয় সিঁড়ি গুলো পায়ে মারিয়ে সে বেড়িয়ে গেলো বাড়িটা থেকে। বাহিরে তখন তুমুল বৃষ্টি। মেঘেদের গর্জনও লোমহর্ষক। গমগমে স্বরে ডাকছে আকাশ। অলকানন্দা এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাগনটার পেছনে দাঁড়াল। বৃষ্টির এত বিরতিহীন ধারায় নিমিষেই ভিজে একাকার সে। তবুও সিক্ত শরীরটা নিয়ে এগিয়ে গেল বাগানের এক কোণায় সরু রাস্তাটার দিকে। সিমেন্টে বাঁধাই করা রাস্তা। খুব সরু রাস্তা। এবং বাঁশের কঞ্চি দিয়ে দু’পাশে সুন্দর লাইন করা। এবং সেই কঞ্চি বেয়ে কতগুলো লতাপাতা ডালপালা ছড়িয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে যেন বসে আছে। দুই এক হাত পর পর বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ। লাল টকটকে কৃষ্ণচূড়া, সাদা কৃষ্ণচূড়ায় পরিপূর্ণ গাছগুলো। এক মুহূর্তের জন্য নন্দার মনে হলো সে স্বর্গের কোনো এক দ্বারে এসে যেন উপস্থিত হয়েছে। এত সুন্দর, এত মোহনীয়তা বাগানটা জুড়ে! কতটা যত্নেই না জায়গাটা তৈরী করা হয়েছিল? সরু রাস্তাটা পেরুতে পেরুতেই একবারে শেষ মাথায় চলে এলো নন্দা। শেষের মাথাটা আরও বেশি সুন্দর। মাঝারি আকারের ছোটো একটি জায়গা আছে এখানে খোলামেলা। জায়গাটার চারপাশে কেবল কৃষ্ণচূড়ায় আচ্ছাদিত। কিছু কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে কিছুবা মাটিতে খাচ্ছে গড়াগড়ি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গা। তার সামনেই মাঝারি আকারের সুন্দর ঘাট করে একটা পুকুর। পুকুরের জল গুলো একটু আলাদা যা নন্দা কখনো দেখেনি এর আগে। একদম নীলাভ। মনে হচ্ছে নীল আকাশের এক টুকরো রঙ এসে মিশে গেছে এই বারির শুধায়। অলকানন্দা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চোখ-মুখে তার প্রগাঢ় মুগ্ধতা। এত সুন্দর একটা জায়গা সে কখনো খেয়াল করেনি! আর কেউ কখনো বলেওনি এখানে এত সুন্দর একটা জায়গা আছে। তাছাড়া গাছপালার ঘনঘটার কারণে কখনো বুঝাও যায়নি এখানে কিছু থাকতে পারে এত অসাধারণ। অলকানন্দা যেন মোহগ্রস্ত হয়ে গেল। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জলে। টলমল করছে জলটা। সে এক পা, দু’পা করে এগিয়ে যায় পুকুরের সিঁড়ির দিকে। অসাধারণ এক ঘ্রাণ ভেসে আসে প্রকৃতি থেকে। কী সুন্দর ঘ্রাণ। মাথা ঝিমঝিম করে শরীরটা কেমন ভার হয়ে আসে। সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রাখতেই মুগ্ধ নন্দার বাহু কেউ টেনে ধরে। এত গম্ভীর মোহ কেউ যেন মুহূর্তেই নষ্ট করে দিল। সাথে ভেসে এলো চিৎকার,
“তুমি এখানে কেন এসেছো? কেন হ্যাঁ?”

আকাশের ভয়ানক গর্জনকে ছাপিয়ে গেলো সেই চিৎকার। অলকানন্দার চিত্ত অশান্ত হলো, সাথে ভীতও হলো ভীষণ। কেঁপে উঠল তার সর্বাঙ্গ। ঘোরগ্রস্তের মতন বার কয়েক আওড়ালো,
“কে? কে?”

তন্দ্রাচ্ছন্ন আধো আলো মাখানো প্রকৃতির এক চিমটি আলোর কল্যাণে দেখা গেল স্টিফেনের সুন্দর মুখখানি। যা এখন ভয়ঙ্কর রকমের লাল হয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে মানুষটা। হঠাৎ স্টিফেনের বৃষ্টি ভেজা শরীরটা দেখে অলকানন্দার খেয়াল হলো সেও ভিজে শরীর নিয়ে এখানে এসেছে। তবে তার শরীরে বৃষ্টি লাগছে না কেন! চারপাশে চোখ মেলে তাকাতেই বুঝল, অতিরিক্ত গাছের জন্য বৃষ্টির ছাঁট তেমন জায়গাটাকে স্পর্শ করতে পারছে না। তার মানে উত্তপ্ত রোদ্দুরও ছুঁতে পারে না নিশ্চয় এই মোহনীয় স্থানটা! এত সুন্দর একটি জায়গা অথচ কেউ তাকে দেখালো না? কেন!

অলকানন্দার ভাবনার মাঝে স্টিফেনের আবার রাশভারী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“এখানে কী করিতে আসছো?”

অলকানন্দার ধ্যান ফিরলো। স্টিফেনের দিকে তাকাল সে গাঢ় চোখে। লোকটার পড়ণে এখনও সাহেবী পোশাক। সাদা, ফর্সা দেহ। নীলাভ চোখ জোড়ায় রাজ্যের মায়া, টান, আবেগ। অথচ সেগুলো ছুঁতে পারল না অলকানন্দাকে। সে স্টিফেনের চেয়েও দ্বিগুণ শক্ত কণ্ঠে উত্তর দিল,
“আমার ইচ্ছে, আমি এসেছি। আমি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।”

“তোমার এমন ইচ্ছের জন্য তুমি শাস্তিও পেতে পারো, সানশাইন। বেশি ইচ্ছে কিন্তু মোটেও ভালো নয়।”

অলকানন্দা হাসলো। বহুদিন পর বোধহয় তার চোখে-মুখে দেখা দিল সেই একরোখা ভাব। সে হাসতে হাসতে তাচ্ছিল্য করে বলল,
“শাস্তি! কী শাস্তি দিবেন আমায়! যার জীবনে আপনার মতন একজন মানুষ আছে, তার বোধহয় আর শাস্তির প্রয়োজন নেই।”

অলকানন্দা ভেবেছিল তার কথা শুনে হয়তো স্টিফেন বেজায় রেগে যাবে। তার জন্য ধার্য করা শাস্তিটা বোধহয় দ্বিগুণ করে দিবে মানুষটা। কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। বরং অলকানন্দাকে অবাক করে দিয়ে স্টিফেন হাসল। মানুষটার হাসি বড়ো অমায়িক। সীমাহীন আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরে পড়ার দৃশ্যটা যেমন সুন্দর ঠিক তেমন সুন্দর এই হাসি। অথচ এমন একটা কথা শোনার পর মানুষটার তো হাসার কথা না।

অলকানন্দা চোখ-মুখ কুঁচকালো। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
“আমি কী ভুল বলেছি কিছু?”

“সানশাইন, তবে তুমি স্বীকার করছো আমি তোমার জীবনেরই একটা অংশ? যাক, অবশেষে ভালোবাসায় না থাকি, তোমার ঘৃণাতে আমার ঠাঁই হয়েছে সেটাই বা কম কিসে!”

অলকানন্দা বিমূঢ়। লোকটা এমন একটা সময়ে এমন একটা উত্তর দিবে তা যে ভাবনাতীত ছিল। তাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্টিফেন বলল,
“সানশাইন, তুমি কী জানো, তুমি অসাধারণ সুন্দরী? যাকে দেখলে যেকোনো মানুষের চোখ ঝলসে যায়।”

অলকানন্দা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। স্টিফেন পাঁজা কোলে তুলে নিলো তাকে। নরম, মিষ্টি আবহাওয়ায় খুব গোপনে অলকানন্দার শিরদাঁড়া বেয়ে কম্পন বইয়ে দিয়ে স্টিফেন করে ফেললো খুব ঘনিষ্ঠ একটি কাজ। লজ্জায় লাল হলো আকাশ। ভয়ঙ্কর রাগ করা অলকানন্দাও যেন লজ্জায় মূর্ছা গেল। ঐ যে কথায় আছে, ‘নারী আর কিছুতে আটকায় না, নারী আটকায় ভালোবাসায়।’

_

শরীরে খুব পাতলা, স্লিক বলা হয় যাকে, সেই স্লিকের শাড়ি পরে তৈরী অলকানন্দা। তাকে তৈরী করে দিয়েছে একজন নারী কর্মচারী, তাও স্টিফেনের আদেশে। সোনালী রঙের শাড়িটা জ্বলজ্বল করছে মেয়েটার শরীরে। মনে হচ্ছে বিধাতার কী অপরুপ চিত্র যেন! সে এই শাড়িটা পড়ে তৈরী হয়েছে শহরের কলেজে যাওয়ার জন্য। মহাবিদ্যালয়ে তার প্রথম যাত্রা। বুকে দুরুদুরু কম্পন।

অলকানন্দা তৈরী হয়ে দাঁড়াতেই স্টিফেন ঘরে প্রবেশ করল। সাহেবিয়ানার পুরো ভাব মানুষটার ভেতর। চালচলন, ভাব-গাম্ভীর্যে সুপুরুষ বটে। তাকে দু’বার ফিরে দেখবে না এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে বোধহয়। অলকানন্দা অবশ্য তাকায়নি। সে নিজের মতন একমনে বাহিরে তাকিয়ে আছে। স্টিফেন ব্যস্ত কণ্ঠে তাড়া দিলেন,
“সানশাইন, বের হও দ্রুত, সময় চলে যাচ্ছে।”

অলকানন্দা ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো, যেন সে শুনতে পায়নি কিছু। স্টিফেন দাঁড়াল, ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আজকে থেকে তোমার কলেজ। যাবে না?”

অলকানন্দা নিরুত্তর। স্টিফেন বাঁকা হাসলো, অলকানন্দার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তার মসৃণ কোমড়। সুগন্ধির তীব্র ঘ্রাণটা স্টিফনের মাথা ধরিয়ে ফেলছে। তার পুরুষ স্বত্তাটা বেসামাল হয়ে ওঠেছে। স্টিফেন আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো, প্রায় ফিসফিস করে বলল,
“সানশাইন, তোমার এত কাছে আসতে কেন মন চায়? আমি জানি, তুমি নারী নও সামান্য। হয়তো কোনো একদিন এই তুমিই আমার প্রাণনাশের কারণ হবে, তবুও কেন তোমার প্রতি আমার ঝোঁক! তোমাকে না পেলে আমি জানতামই না, কারো মৃত্যুও এত প্রিয় হতে পারে।”

অলকানন্দা মুখ ঘুরিয়ে নিল। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“সত্যিই, হয়তো একদিন আপনার প্রাণ আমার হাতেই নিঃশেষ হবে।”

অলকানন্দা কথাটা বলতে দেরি অথচ স্টিফেনের ছাড়তে দেরি নেই। সে নন্দাকে প্রায় ছুড়ে ফেলে কেমন অভিযোগ মাখা কণ্ঠে বলল,
“আমার মৃত্যু তোমার চিরস্থায়ী নির্বাসনের কারণ হবে, সানশাইন। মিলিয়ে নিও।”

_

শহুরের চঞ্চল আবহাওয়ায় সাহেবী গাড়িটা এসে থামলো কলেজের সামনে। অলকানন্দার বুকে কেমন অস্বাভাবিক ওঠা-নামা। তা নিয়েই সে নেমে দাঁড়াল। স্টিফেন আসবে বলেও শেষ মুহূর্তে একটি কাজের জন্য আসতে পারেনি। তাই এই নতুন জীবনে তাকে একাই পা রাখতে হলো। অলকানন্দা গাড়ি থেকে নেমে কলেজ ঢুকতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। চারপাশে ছেলে-মেয়েদের ছড়াছড়ি। দলে দলে তাদের কথা চলছে। কলেজের সামনে বিরাট গাড়ি দাঁড় করানো। ছেলেমেয়েদের মাঝে কেমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। অলকানন্দা কাছে যেতে যেতে কানাঘুষাই শুনলো এখন নাকি মিছিল বের হবে। দেশে ব্রিটিশের যে রাজত্ব, তা থেকে পরিত্রাণ পেতেই দলে দলে শহুরে মানুষ লুকিয়ে লুকিয়ে মিছিল মিটিংয়ের আয়োজন করছে। অলকানন্দার বুক কাঁপলো বোধহয়। ব্রিটিশদের বিতাড়িত করার জন্য এসব! তবে কী স্টিফেনও চলে যাবে?

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২৫.

আনন্দপিঠ মহাবিদ্যালয়ের ভেতর অলকানন্দার প্রথম যাত্রা। কিন্তু যাত্রা তেমন শুভ বোধহয় হয়নি। কলেজের ভেতর প্রবেশ করেই মুখ থুবড়ে পড়ল সে। গাছের শুকনো ডালায় লেগে ডান হাতের কনুইয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেল। মুহূর্তেই ঘটে গেল রক্তারক্তি কান্ড। আশেপাশের বিস্মিত দৃষ্টি গুলো মুহূর্তেই একটা অস্বস্তিতে ভরিয়ে দিল অলকানন্দার শরীরের কোণায় কোণায়। পায়ের ব্যাথায় মেয়েটা ওঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেলনা। অলকানন্দা লজ্জায় যখন সংকুচিত হয়ে এলো, ভাবলো এই বোধহয় শহুরে ছেলেমেয়ে হো হো করে হেসে তার মজা উড়াবে। কিন্তু তার সবটুকু ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে একটি হাস্যোজ্জ্বল মেয়ে এগিয়ে এলো। কেমন জামাকাপড় গায়ে তার। মেয়েটা এগিয়ে এসেই হাত বাড়িয়ে দিলো অলকানন্দার দিকে, ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“এই মেয়ে, পড়ে গিয়েছ কীভাবে? উঠো তো দেখি। উঠো।”

অলকানন্দার লজ্জা মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেল। সে ব্যাথাযুক্ত হাতটা এগিয়ে দিল মেয়েটার দিকে, আমতা আমতা করে বলল,
“এখানে শুকনো ডাল, আমি আসলে দেখতে পাইনি।”

মেয়েটা অলকানন্দাকে হেচকা টেনে তুলল। চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“পা-টা ঝারা দেও তো। নাহয় কিন্তু হাঁটতে পারবে না। জোরে জোরে ঝারো।”

অলকানন্দা মেয়েটার কথা অনুযায়ী কাজ করল। ব্যাথায় মৃদু শব্দও করল সে। কিন্তু ঝারা দেওয়ার ফলে ব্যাথাটা যেন লাঘব হলো। হালকা চিন চিন ব্যাথা করলেও তেমন অসহ্যকর ব্যাথা আর অনুভব হলোনা। অলকানন্দা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ।”

“নতুন নাকি?”

মেয়েটার প্রশ্নে অলকানন্দা উপর-নীচ মাথা দুলালো। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“হ্যাঁ, নতুন।”

“আমিও তোমাদের বর্ষেরই কিন্তু ছাত্রী পুরোনো।”

মেয়েটার কথার আগামাথা না বুঝেই অলকানন্দা ভ্রু কুঁচকালো। সংশয় মাখা কণ্ঠে বলল, “মানে!”

“বুঝোনি তো? আসলে আমি গত তিন বছর যাবত একই ক্লাসে আছি। পরীক্ষা না দিলে যা হয় আরকি। সে হিসেবে তোমাদের বড়ো।”

অলকানন্দা ড্যাবড্যাব করে তাকাল, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বুঝতে পারার ভঙ্গিতে বলল, “ওহ্!”

“তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে!”

অলকানন্দা থতমত খেলো। অস্ফুটস্বরে বলল, “হ্যাঁ।”

“তোমার নাম কী?”

“অলকানন্দা। আপনার?”

“ললিতা।”

অলকানন্দা এবার ললিতা নামক মেয়েটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করল। মেয়েটা অত্যন্ত রকমের সুন্দর না। শ্যামলা গড়ন। কেমন ঢোলা মতন একটি জামা পড়নে। ছেলে ছেলে হাবভাব মেয়েটার মাঝে। ললিতা তাড়া দিল,
“চলো, যাবে না ক্লাসরুমে? তাড়াতাড়ি চলো।”

_

অপরিচিত জায়গায়, অপরিচিত টেবিলটাতে বসে আছে নন্দা। তার সাথেই বসা ললিতা নামক মেয়েটা। তাদের বেঞ্চে আর কেউ বসেনি। ললিতা ক্লাসের ছেলেদের সাথেও বেশ আন্তরিকতার সাথে কথা বলছে যা অন্য কোনো মেয়ে করছে না। বরং তারা নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে আর কেমন চোখে যেন অলকানন্দার দিকেও তাকাচ্ছে। অলকানন্দার ভীষণ রকমের অস্বস্তি হলো, প্রায় ফিসফিস করে ললিতাকে ডাকল,
“একটু শুনেন…..”

ললিতা তখন বিপরীত দিকে ছেলেদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত। অলকানন্দার ডাক শুনে পিছে তাকাল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“এই মেয়ে, আপনি আপনি করে বলছো কেন? তুমি করেই বলো না।”

অলকানন্দা ঘাড় কাত করল, ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,“আচ্ছা, বাকি মেয়েরা কারো সাথে মিশছে না কেন? ওরা আমাদের এক টেবিল পরে গিয়ে বসেছে কেন? এখানে কী এমন নিয়ম?”

অলকানন্দার কথায় যেন বেশ মজা পেল ললিতা। তাই তো উচ্চস্বরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে পেছনের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে বসে পা দুলাতে দুলাতে বলল,
“এখানের নিয়ম হলো, মানুষ সুখী মানুষদের পছন্দ করেনা। এই যে দেখো, আমি কথায় কথায় হাসছি, আনন্দ করছি, এটা ওদের পছন্দ নয়। ওরা সুখী মানুষ দেখলেই মুখ চোখ বিকৃত করে ফেলে। এখন সুখী মানুষের সাথে তুমি বসেছো মানে তুমিও তো সুখী মানুষ, তাই কেমন আড়চোখে তোমাকে দেখছে। ঐ আরকি, আমার সাথে বসলে তারা সবাইকেই অমন চোখে দেখে।”

নন্দা অবুঝ নয়ন যুগল মেলে তাকিয়ে রইলো। শহুরে মেয়েরা কী তবে কারো সুখ পছন্দ করেনা? এ আবার কেমন কথা! ললিতা অলকানন্দা সংশয় ভরা মুখমন্ডল দেখে হাসলো। অলকানন্দার গাল টিপে বলল,
“তুমি ভীষণ মিষ্টি তো!”

অলকানন্দা লাজুক হাসল। কোমল স্বরে উত্তর দিল, “ধন্যবাদ।”

তন্মধ্যেই তাদের কক্ষে প্রবেশ করলেন একজন শিক্ষক, যাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল সকলে। এবং সমস্বরে চেঁচিয়ে বলল,
“শুভ সকাল, স্যার।”

অলকানন্দাও তাদের সাথে সাথে একই বাক্য উচ্চারণ করল। তার বড়ো মনে পরলো গ্রামের সেই পাঠশালা, বিদ্যালয়ের কথা। ‘স্যার’ কথাটার মাঝে সে আন্তরিকতার আভাস পেল না। কেমন কর্কশ! ইংরেজী তার কাছে সর্বদাই আবেগ বিহীন শব্দ। যা উচ্চারণ করার সময় শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেই প্রভাব পড়ে না। বরং কেমন তেঁতো শোনায়! অথচ বাংলা ভাষার কী মাধুর্যতা! ‘মাস্টারমশাই’ বলে ডাক দেওয়ার সময়ই বুকটা সম্মানে ভরে যায়।

উপস্থিত শিক্ষক সকলের শুভেচ্ছার উত্তর দিয়ে বসার আদেশ করলেন। অলকানন্দা কলেজে সবার শেষে ভর্তি হয়েছে বিধায় সে এখানের নতুন মুখ। সেই জন্যই শিক্ষকের দৃষ্টি প্রথমে তার দিকেই পড়ল। লোকটা চোখ মুখ কুঁচকে পেন্টের বেল্ট একটু উপরে উঠাতে উঠাতে নন্দার উদ্দেশ্যে বললেন,
“অ্যাই, তুমি কী নতুন?”

নন্দা তৎক্ষণাৎ ওঠে দাঁড়াল। মাথা উপর-নীচ নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, মাস্টারমশাই।”

নন্দা কথাটা বলতেই পুরো কক্ষে যেন হাসির স্রোত বয়ে গেল। হাসল না কেবল ললিতা। শিক্ষকও যেন পছন্দ না করল না এই ডাক। মুখ চোখ কেমন অন্ধকার করে বললেন,
“অনলি স্যার ডাকবে, নো মাস্টারমশাই ফাস্টারমশাই।”

অলকানন্দা কিছুটা লজ্জাই অনুভব করল এসবে। সে কোনোমতে দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে মাথা নাড়াল। শিক্ষক তাকে বসতে বলেই বক্তব্য শুরু করলেন। নন্দা যতটুকু বুঝল, ভদ্রলোকের নাম নরেণ ঘোষ। ইংরেজির শিক্ষক সে। কথাবার্তায় কেমন যেন বোকা বোকা হাবভাব থাকলেও পড়াশোনা দুর্দান্ত বুঝান। অলকানন্দার হুট করে মুমিনুল ইসলামের কথা মনে পড়ল। মানুষটা সেদিন তাকে বাঁচাতে গিয়ে তো প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল, এখন কেমন আছেন সে? ভালো আছেন তো! নন্দা তো একটিবারও খোঁজ নিল না মানুষটার। কী পাষাণ সে! তার ভীষণ কান্না পেল কিন্তু নতুন জায়গায় বোকার মতন কান্না করলে সে হাসির পাত্রী হয়ে যাবে। সেই কথা ভেবেই আর কাঁদল না। প্রায় বেশ খানিকটা সময় নিয়ে নরেণ ঘোষ নামক মানুষটা পড়া বুঝাচ্ছেন। কিন্তু এখানে কেউ যে তেমন মনযোগ দিয়ে পড়া বুঝছে, তা মনে হচ্ছে না। যে যার মতন কথা বলছে ছোটো ছোটো শব্দে। মেয়েরা একজন আরেকজনের শাড়ি, চুল নিয়ে কথা বলছে। ছেলেরা কেউ কেউ একজন আরেকজনের সাথে নীরব মারামারিতে অংশগ্রহণ করেছে আর কেউবা কিছু নিয়ে করছে ঘোর আলোচনা। ললিতাও পা দুলাচ্ছে আর হালকা আওয়াজে শিষ বাজাচ্ছে। তন্মধ্যেই শ্রেণীকক্ষের বাহিরে একটি চিকন করে ছেলে এলো। ছিমছাম দেহটা তার। এসে নরেণ ঘোষকে পাত্তা না দিয়েই গলা ছেড়ে হাঁক ছেড়ে ডাকল,
“ও ললিতা দি, সুদীপদা ডাকছে তোমায়। একটু এসো তো।”

ললিতাও তড়িৎ গতিতে ওঠে দাঁড়াল। ব্যস্ত কণ্ঠে শিক্ষককে বলল,
“স্যার, আসি।‘

শিক্ষকের আর কিছু বলার প্রয়োজন হয়নি। তার আগেই ললিতা ধুপধাপ পায়ে বেরিয়ে গেল। নন্দা সবটাই বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখল। এখানে ওরা পড়াশোনা সংবলিত বিষয় নিয়ে এত উদাস কেন! ললিতা নামের মেয়েটা এত ভালো হওয়া সত্বেও শিক্ষককে সম্মান করেনা। এ আবার কেমন জীবন!

অলকানন্দার ভাবনার মাঝে নরেণ ঘোষ নাক-মুখ কুঁচকে বলে উঠল,
“ইডিয়েট গার্ল।”

_

ক্লাস শেষ হতেই সকলে দল বেঁধে অলকানন্দার নিকট এলো। ও মাত্রই তৈরী হয়েছে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ললিতা নামের মেয়েটা আর এলো না। কেমন অদ্ভুত চালচলন মেয়েটার! সকলকে নিজের কাছে আসতে দেখে অলকানন্দা ভ্রু কুঁচকালো। তাকিয়ে রইল প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে।

এমন সময় সব মেয়ে গুলোর মাঝে থেকে একটি মেয়ে কথা বলল,
“নাম কী তোমার?”

“অলকানন্দা। তোমার?”

“সরস্বতী। তোমার বিয়ে হয়ে গেছে?”

মেয়েটার প্রশ্নে অলকানন্দা কিছুক্ষণ মৌন থেকে ধীরে উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”

“তাহলে তুমি ললিতার সাথে মিশছো কেন? ও কী ভালো মেয়ে?”

সরস্বতীর ফিসফিস কথায় অলকানন্দা ভ্রু কুঁচকালো। সরস্বতীর পাশের মেয়েটাও তাল মিলিয়ে বলল,
“ওর সাথে মিশবে না, খারাপ হয়ে যাবে পরে। ও মেয়ে মোটেও ভালো না।”

অলকানন্দা মহা সংশয়ে পড়ল। ললিতাকে তার মোটেও খারাপ মনে হয়নি। তবে মেয়ে গুলো এমন বলছে কেন? নিজের কৌতূহল দমন করতে না পেরে সে নিজেই প্রশ্ন করল,
“ললিতা খারাপ কই? খারাপ কিছু তো দেখিনি।”

অলকানন্দার এমন প্রশ্ন যে মেয়েগুলো পছন্দ করেনি তা তাদের চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সরস্বতী তো চোখ-মুখ কালো করে প্রায় বিরক্ত কণ্ঠে বলেই ফেলল,
“তুমি কী ভাই! দেখছো না ও কেমন সব ছেলেদের সাথে মেলামেশা করে। ছেলেদের সাথে মেলামেশা করে, এদের চরিত্র কী ভালো হবে বলো? তাও আবার এ ক্লাসে তিনবছর। করে রাজনীতি। পোশাক দেখেছো? আবার থিয়েটারও করে। এসব কী ভালো মেয়েদের লক্ষণ?”

অলকানন্দা হাসলো, প্রায় খোঁচা মারা কণ্ঠে বলল,
“কারো বদনাম করাও কী ভালো মেয়েদের লক্ষণ নাকি?”

মেয়ে গুলো এমন অপ্রতুল কথায় চুপসে গেলো। মুখ ভেংচি দিয়ে যে যার মতন চলে গেলো। অলকানন্দার বুঝতে বাকি রইল না যে তাকেও খারাপ মেয়ের দলে ফেলে দেওয়া হয়েছে আজ থেকে। অলকানন্দা হাসল। ধীর পায়ে শ্রেণীকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো নন্দা। ললিতাকে চারপাশে খুঁজেও আর পেল না। ধীর পায়ে হেঁটে সে কলেজের বাহিরে আসতেই পরিচিত মুখ দৃষ্টিগোচর হলো। বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “নবনীল!”

নবনীল ততক্ষণে নন্দার দিকে এগিয়ে এসেছে, নীল রাঙা এক পাঞ্জাবি পরিহিত। চোখেমুখে নির্লিপ্ততা। কাছে এসেই প্রশ্ন করল,
“ভালো আছেন?”

“আছি।”

নবনীল আশেপাশে তাকাল। গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“শুনলাম আপনার স্বামী নাকি এখানে ভর্তি করিয়েছে আপনাকে, তাই দেখতে এলাম। আপনার ভালো থাকার মহিমা। বেশ ভালোই তো আছেন দেখছি।”

“আপনি চাননি ভালো থাকি?”

নবনীল থতমত খেলো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“চাইবো না কেন?”

“তবে এভাবে জিজ্ঞেস করলেন যে?”

নবনীল চুপ করে রইল। যেন নন্দা তার সাথে এভাবে কথা বলবে কখনো সে ভাবেইনি। তন্মধ্যেই কোথা থেকে যেন ললিতা চলে এলো। হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী মেয়েটার। নন্দার পাশে এসে ঝলমলে কণ্ঠে বলল,
“আরে নন্দু, যাওনি?”

“এইতো, যাবো এখন।”

“ইনি কে?” নবনীলকে দেখিয়ে প্রশ্ন করল সে। নন্দা কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিল,
“পরিচিত।”

নবনীল যেন থমকে গেল। সে এমন কেউ যার পরিচয়ও অলকানন্দা নামক মেয়েটা দিতে পারেনা! যার কোনে মূল্য আদৌও নেই মেয়েটার কাছে! বাহ্! এই ব্যাথা যেন নবনীলের জন্য ভারী হলো, সে চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“কেবল পরিচিত একজন মানুষকে এতটা সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আসছি।”

ছেলেটা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। কথাটা বলেই গটগট পায়ে চলে গেল। অলকানন্দা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুকের কোণায় ব্যাথাদের নীরব উঁকিঝুঁকি দেখা দিল। কিন্তু কী আর করার? নারীর কাছে স্বামী ও সংসার ধর্মের চেয়ে যেন বড়ো কিছু নেই।

অলকানন্দার ভাবনার মাঝেই ললিতা প্রশ্ন করল,
“ছেলেটা কী রাগ করল?”

“না বোধহয়। আপনি কোথায় ছিলেন?”

ললিতা হাসল। নন্দার গাল টেনে বলল,
“আবারও আপনি বলছো কেন? আমি তোমার সই হই। কেমন সই জানো? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চোখের বালি’ পড়েছিলে? আমি তোমার তেমন সই, যাকে হয়তো কোনো একদিন তোমার চোখের বালি মনে হবে।”

কথাটা মেষ হতেই কেমন অদ্ভুত হাসল ললিতা। নন্দার মস্তিষ্ক ছুঁতে পারেনা বোধহয় সাবধানে বাণী।

_

সন্ধ্যা নববধূ বেশে লাজুক হয়ে যেন বসে আছে গগণ বক্ষে। টুকরো টুকরো মেঘেরা দলবদ্ধ হয়ে জমে আছে এখানে ওখানে। নন্দার গাড়ি সবেই প্রবেশ করেছে বিরাট দরজার কোল ঘেঁষে। তন্মধ্যেই সে আধো আলো অন্ধকারে একটি মেয়ে অবয়ব বেরিয়ে যেতে দেখল বাড়ি ছেড়ে। অলকানন্দা ভ্রু কুঁচকালো। এ বাড়িতে বাহিরের মেয়ে তো প্রবেশ করার কথা না। তবে!

গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই তার কানে হরেক রকমের শব্দ ভেসে এলো। কেমন গান বাজনার সুর ভেসে আসছে। অলকানন্দা বাড়িতে ঢুকতেই দেখলে রান্নাঘরে সকল কর্মচারী ব্যস্ত নিজেদের মতন। আর গানের সুর স্পষ্ট হলো। ঘুঙ্গুরের শব্দও স্পষ্ট ভাবে ভেসে এলো। এ বাড়িতে কেউ নাচছে গাইছে! কে তারা!

নন্দা কর্মচারীকে ডাকল, শুধাল,
“কে নাচছে?”

“আজকে বাইজি এসেছে, সাহেব বধু। সাহেবরা সকলে সেখানে।”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে