Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"অলকানন্দার নির্বাসনঅলকানন্দার নির্বাসন পর্ব-২০+২১+২২

অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব-২০+২১+২২

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২০.

অবিরত ঝরছে বর্ষণ ধারা। বাহিরের মৃদুমন্দ সমীরণে উড়ছে মুক্ত পাখির ন্যায় ঘরের বাতায়ন ঘেষা ভারী, মোটা সুতোর কারুকাজ শোভিত পর্দা গুলো। বাহিরের নিভু সন্ধ্যার সময়ের কিছু অস্বচ্ছ নীলাভ আলো এসে আলিঙ্গন করছে ঘরের বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা অলকানন্দার কোমল, মায়াময়ী মুখটাকে। নীলাভ আলোতেও বোধহয় একটা বিশেষ মায়া জড়ানো আছে, যেটা কারো শরীরে প্রতিচ্ছবি ঘটালে তা আরও আকর্ষিত হয়ে ওঠে।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা চোখে-মুখে লাগতেই অলকানন্দার ঘুম ভেঙে এলো। পায়ের মাঝে করা তীব্র যন্ত্রণাতেও সে হুট করে আরাম বোধ করছে। যা তার ঘুম আরও দ্রুত ভাঙিয়ে দিল। এত তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা হুট করে এত শীতল হয়ে এলো কেন! সাথে সাথে অলকানন্দা চোখ মেলল, আঁধার মায়াময় রুমটাতে তখন নিস্তব্ধতা খেলা করছে। অলকানন্দা নিজের পায়ের কাছটাতে তাকাতেই দেখল কেউ একজন বসে আছে। অলকানন্দা ভ্রু কুঁচকালো, প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“কে?”

সেকেন্ডের মাঝেই ঘরের চারপাশ আলোকিত করে আলো জ্বলে ওঠলো। হলুদ, সাদার মিশেলে কত গুলো আলো। চকচক করে ওঠলো পুরো রুম। অলকানন্দা অপলক দৃষ্টিতে রুমের চারপাশে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। খুব দামী কোনে পাথর দিয়ে তৈরী করা বাড়িটা। রুমের মাঝেও সাদা ঝলমলে পাথরের ছোঁয়া। মাথার উপর বিরাট বাতি। সে চেনে এটা, এটাকে ঝাড়বাতি বলে। কী ভয়ঙ্কর সুন্দর বাতি! ঘরটাও বিশাল বড়ো। সেখানে বিশাল খাট হতে শুরু করে বই রাখার আলমারি অব্দি সকল জিনিসই অবস্থিত। গোছানো, পরিপাটি কক্ষ। কোথাও খুঁত খোঁজার উপায় নেই। কোথাও ত্রুটি নেই। অলকানন্দা চোখ ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে চোখ গেল ঘরের এক পাশে আরাম করে বসে থাকা স্টিফেনের দিকে। অলকানন্দার পায়ের কাছে বসে আছে বউ মতন একটা মেয়ে। সাজ পোশাকে বলছে কর্মচারী। আর ঠিক সেই মেয়েটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একজন মহিলা হাসি হাসি মুখে। অপূর্ব সুন্দর সেই নারীর হাসি তবে নারীর গায়ের রঙ ঠিক ততটাই কুৎসিত। শরীরে খুব দামী শাড়ি জড়ানো। ঢাকাই মসলিন হয়তো। নরম কাপড় গুলো! অলকানন্দা শুনেই এসেছে এ কাপড়ের কথা, একদিন কৃষ্ণা অবশ্য দেখিয়েছিল তাই চিনতে অসুবিধা হয়নি। সেই কালো মতন নারীটি গাঢ় নীল রঙের ঢাকাই মসলিন শরীরে জড়িয়েছেন , সাথে যুক্ত আছে অনেক নামী-দামী গহনা। তার শরীরে জ্বলজ্বল করছে সকল সৌন্দর্যতা। অলকানন্দার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে কোথায় এসেছে! তার কল্পনার দুনিয়া থেকেও বেশি চমৎকার এই বর্তমান। যা অবিশ্বাস্যকর।

অলকানন্দাকে চেয়ে থাকতে দেখে হাসলেন সেই নারী। অলকানন্দার কিছুটা কাছে এসে খুব আদুরে কণ্ঠে বললেন,
“কী দেখছো, নন্দু?”

অলকানন্দা চমকালো এহেন সম্বোধনে। প্রথম দেখায় কেউ এত ভালোবেসে ডাকতে পারে! এই অকল্পনীয় নারীকে না দেখলে বুঝতোই না সে।

“আমাকে ঠিক চিনতে পারছ না, তাই তো?”

মহিলার দ্বিতীয় প্রশ্নে অলকানন্দার ধ্যান ভাঙলো। আমতা-আমতা করে বলল,
“সত্যিই চিনতে পারছি না। দুঃখীত।”

অলকানন্দার নিরীহ স্বীকারোক্তিতে মহিলার ঠোঁটের হাসি আরও প্রশস্ত হলো। সে ইশারা করতেই অলকানন্দার পায়ের কাছে মেঝেতে বসা মেয়েটা ওঠে দাঁড়াল। মেয়েটা জায়গা ছাড়তেই মহিলা আরেকটু এগিয়ে এলো। অলকানন্দার মাথায় খুব যতানে হাত বুলিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে বললেন,
“আমি স্টিফেনের মা। তোমারও মা। কেমন?”

অলকানন্দা মহিলার কথা শুনে তৎক্ষণাৎ স্টিফেনের দিকে তাকাল। লোকটার সাথে এই মহিলার তেমন কোনো মিলই নেই। লোকটার গায়ের রঙ অসম্ভব রকমের ফর্সা। চুল গুলো কালো বাদামির মিশেলে। চোখের মনি’র রঙটা একটু অস্বাভাবিক। কেমন নীলাভ ভাব। আর আচার আচরণে তো আরও বেশি বিপরীত। মহিলার মুখে হাসি লেপ্টানো অথচ স্টিফেন সবসময় থাকে গম্ভীর। কোন দিক দিয়ে লোকটা এই মহিলার ছেলে হলো সে বুঝেই পেল না।

স্টিফেন এবার ওঠে দাঁড়াল। গম্ভীর পুরুষ মানুষ সে, সবসময় তার মুখে একটা নিবিড় গাম্ভীর্যতা লেপ্টেই থাকে। ওঠে অলকানন্দার দিকে তাকিয়ে রাশভারি কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“পায়ের ব্যাথা এখন কী কমেছে? জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন তো!”

অলকানন্দা মুখ ভেংচি দিতে গিয়েও নিজেকে সংযত করল। যে মানুষ বিয়ে করে বউকে নিয়ে বাড়ির চৌকাঠ অব্দি এসে দাঁড়ায়নি, সে মানুষের মুখে এমন একটা প্রশ্ন বেমানানই। তবুও ভদ্রতার খাতিরে অলকানন্দা প্রতিত্তোর করল,
“কমেছে।”

ব্যস্, স্টিফেনের শান্ত ভঙ্গিতে আবার প্রস্থান ঘটলো। মমতাময়ী সে নারী এখনও দাঁড়িয়ে আছেন। তার ছেলে ঘর ছেড়ে বেরুতেই সে কিছুটা ব্যাখ্যার স্বরেই বললেন,
“স্টিফেন ওর বাবার মতন হয়েছে। তা মা, তুমি ঠিক আছো তো?”

অলকানন্দা মাথা নাড়াল। তন্মধ্যেই স্টিফেনের ডাক ভেসে আসতেই সে ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেলো। অলকানন্দা সবটা চুপ করেই পর্যবেক্ষণ করল। কক্ষ খালি হতেই এতক্ষণের চুপ করে থাকা কর্মচারী মেয়েটা কথা বলল,
“আপনি তো নাকি পাশের গেরামের? আপনার নাকি জামাই মরছে মাস খানেক আগে? আপনারে সাহেব কী দেইখা বিয়া করলো? আর আপনিও বা কেমন! বেধবা মেয়েমানুষ হইয়াও বিয়া করলেন আবার?”

বাহিরে খুব দূরে কোথাও ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে। কর্মচারীর কথা গুলো সেই বজ্রপাতের চেয়েও বোধহয় ভয়ঙ্কর শোনালো। কিন্তু অলকানন্দাও চুপ থাকার পাত্রী নয়। মুখটাকে বেশ কঠোর করে সে জবাব দিল,
“তোমাদের সাহেবকে নিশ্চয় ভালো করেই চেনো? যদি আমি তার কানে তুলি এই কথাগুলো তবে কী পরিণতি হবে জানো তো?”

অলকানন্দা মোক্ষম জায়গায় মোক্ষম কথাটা বলেছে যার ফলস্বরূপ মেয়েটা ভয়ে গুটিয়ে এলো। ভীতু ভীতু তার নড়বড়ে দৃষ্টি নিয়ে কম্পনরত স্বরে বেশ অনুনয় করে বলল,
“সাহেব বধূ, আমার ভুল মাফ কইরা দিবেন। আর কখনোই আমি আপনারে এগুলা বলমু না। সাহেবরে কিছু জানাবেন না। তাহলে আমারে প্রাণে মারতে তার এক মুহুর্তও লাগবে না।”

মেয়েটা কথাটা বলেই অলকানন্দার পায়ের কাছে এসে হা হুতাশ করতে লাগল। একটু আগে যে মেয়েটার চোখে ছিল তাচ্ছিল্য ঠিক কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে সেই মেয়েটার মুখেই ভয়ের প্রলেপ। স্টিফেন নামক মানুষটা কতটা ভয়ঙ্কর তা এই ঘটনা অনুভব করলেই বোঝা যায়।

অলকানন্দার মায়া হলো, কোমল কণ্ঠে বলল,
“সবাই ই বাঁচতে চায়। তুমি যেমন এখন বাঁচতে চাইছো ঠিক আমিও চেয়েছি আর সেজন্যই এই পথ। কখনো নিজের জায়গায় থেকে অন্যকে বিচার করো না। মানুষ কতটা খারাপ পরিস্থিতিতে থাকতে পারে তা আন্দাজ না করেই কিছু বলা উচিত না। তুমি যাও।”

মেয়েটা শুকরিয়া আদায় করতে করতে রুমটা ত্যাগ করল। অলকানন্দার দৃষ্টি ভাবুক। সে যখন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তখন স্টিফেনের মাকে একবারও দেখেনি, তবে উনি ছিলেন কোথায়? আর সেই বউটা? তার সাথে অস্বাভাবিক কাণ্ড করা বউটাও বা কে?

অলকানন্দার দৃষ্টি যায় নিজের পায়ের দিকে, ফোসকা পড়ে আছে ডান পায়ের তালুতে। দুধ আলতার থালাটা মাত্রাতিরিক্ত গরম ছিল যার ফলস্বরূপ এই দশা। বা’হাতের মাঝামাঝি অংশও কিছুটা চোট পেয়েছে বরণডালার আঘাতে। এত ব্যাথা সইতে না পেরে অবশেষে সে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এখন অবশ্য তেমন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে না শরীরে। ব্যাথার স্থানে কী একটা যেন মালিশ করেছে, হয়তো সেজন্যই ব্যাথা লাগছে না।

অলকানন্দা বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়াল, পায়ে চাপ পড়াতে কিঞ্চিৎ ব্যাথা অনুভব হলো তবে সে পাত্তা দিল না সেই ব্যাথা। ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে সে জানালার কোণ ঘেঁষে দাঁড়াল। বৃষ্টির ধারা অবিরতই রইলো। কোনো বিশ্রাম নেই তার। অলকানন্দা কোমল হাতটা বাড়িয়ে দিল জানালার বাহিরে। বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা গুলো যেন নতুন এক আশ্রয় পেয়ে উন্মাদ হয়ে জমতে শুরু করল ওর হাতের মুঠোয়। মেয়েটা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই আঁধারে। তন্মধ্যেই আবার বজ্রপাত হলো, চারপাশে বিদ্যুৎ চমকালো খুব নিখুঁত ভাবে। পৃথিবীতে যেন ছুঁয়ে গেলো কোনো পরশ পাথরের খোদাই করা আলো। যে আলোয় পৃথিবী হয়ে ওঠেছিল উজ্জ্বল আর দীপ্তিময়। সেই আলোতেই অলকানন্দা দৃষ্টিগোচর হলো বাহিরের অবস্থানটা। যেখানে এই তিমিরাচ্ছন্ন প্রকৃতিতে বৃষ্টি বিলাস করছে একটা নারীর লতার মতন অঙ্গ। অলকানন্দা চিনতে ভুল হলো না নারীটিকে। যার জন্য তার পায়ের পাতায় এই অসহ্যকর ব্যাথা, নারীটি সে-ই। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা নারীটির কোনো হুশ নেই। সে নিজের মতন আহ্লাদে আটখানা হয়ে ভিজছে। হৈ হৈ করছে। অলকানন্দাও নিবিড় ভাবে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। ঠিক মিনিট পেরুতেই মেয়েটা কী মনে করে যেন উপরে তাকাল। উপরে তাকাতেই অলকানন্দার চেহারা দৃষ্টিগোচর হতেই সে রেগে গেল। চারপাশ হাতড়ে কী যেন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে। আঁধারের মাঝে অলকানন্দা স্পষ্ট দেখতেও পাচ্ছে মেয়েটা ঠিক কী করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিরাট একটা শব্দ হলো অলকানন্দার জানালায়। আকস্মিক এমন শব্দে ভীত হয়ে যায় অলকানন্দা। মেয়েটা পাথর ছুঁড়েছে।

অলকানন্দা ভীতু নয়ন জোড়া নিয়ে পিছনে যেতেই কারো শরীরের সাথে শক্ত-পোক্ত একটা ধাক্কা খেল। যার জন্য তার ভয়টা বাড়াবাড়ি রূপ নিল। সে ছিটকে দূরে সরে যেতে নিলেই ভরাট পুরুষ কণ্ঠ কানে বাজলো,
“কুল ডাউন। কী হয়েছে এখানে? এমন শব্দ হলো কিসের?”

প্রশ্নটা করেও দাঁড়িয়ে নেই স্টিফেন। পা চালিয়ে সে জানালা দিয়ে তাকাল। মুহূর্তেই কুল বলা মানুষটা নিজেই রণমুর্তি ধারণ করল। ভরাট কণ্ঠে চেঁচিয়ে ডাকল,
“দেবু, দেবু, কোথায় তুই? দেবু……”

হাঁক পারতে পারতেই স্টিফেন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অলকানন্দা জানালা দিয়ে তাকাল। ততক্ষণে দেবু নামক লোকটাও চলে এসেছে মেয়েটার কাছে। আর কিছু সেকেন্ডের মাঝেই স্টিফেনও উপস্থিত হয় সেখানে। সেখানে পৌঁছেই সে বিশাল দানবীয় এক চড় বসায় দেবু নামক লোকটার গালে। কিছুটা ধমকা ধমকিও হয় যা বৃষ্টির ছাঁট পেরিয়ে অলকানন্দার কর্ণ অব্দি পৌঁছুতে পারল না। কিন্ত বৃষ্টির মাঝেই অলকানন্দা সেই মেয়েটার কেমন হিংস্রতা ভরা দৃষ্টি দেখতে পেল। যেন মুহূর্তেই ধ্বংস করে দিবে তাকে সেই চোখ। অলকানন্দা জানালা ছেড়ে এসে বিছানায় বসল। বুকের মাঝে তার অস্বাভাবিক ঝর। এই দৃষ্টি তার বড্ড চেনা। বড্ড পরিচিত। কিন্তু এখানে সে এই পরিচিত দৃষ্টির খোঁজ নিতে পারবেনা। সে যে বড়ো গোলকধাঁধায় পরেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

_

রাত তখন মাঝামাঝি। হেমন্তের আকাশ বহু বৃষ্টির পর ক্লান্ত, গম্ভীর। চাঁদও অভিমানী মুখ ঢেকেছে মেঘমালাদের কালো বস্ত্রে। অলকানন্দা বসে দারুণ এক টেবিলের সামনে চেয়ার পেতে। উদ্দেশ্য- নবনীলের কাছে পত্র লিখবে। মনের মাধুরী মিশিয়ে সে পত্র খানা লিখল ঠিক। সবার শেষে এক বুক আশা নিয়ে নবনীলকে লিখল “পত্র দিও”।

চিঠি লিখা শেষ। কত এলোমেলো অনুভূতি লিখেছে সে দোয়াতের কালিতে। লিখতে লিখতে কখনো ভাগ্যের কোঠরতায় কেঁপেও ওঠেছে। কিন্তু চিঠিটা ভাঁজ করার আগেই কেউ একজন কী ভীষণ নিষ্ঠুরতায় টেনে নিল সে চিঠি। যেন দুমড়ে মুচড়ে ফেলতে চাচ্ছে অলকানন্দার অনুভূতি। অলকানন্দা পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল স্টিফেন। লোকটার চোখ বরাবরের মতন প্রাণহীন নয় আজ কেমন ক্ষুব্ধ। কিছুটা টলছেও মানুষটা। জড়িয়ে আসা কণ্ঠে এলোমেলো ভাবে চিঠিটা পড়লো সে। বাংলা ভাষা সম্পর্কে খুব বেশি অবগত ছিলো না বিধায় কত জায়গায় পড়তে পড়তে হোঁচট খেল। তবুও পড়লো। অতঃপর পড়া শেষ হতেই সে হো হো করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে কী নির্মম ভাবে দুমড়ে মুচড়ে ফেলল চিঠিটা। তারপর জানালার বাহিরে ছুঁড়ে মেরে ব্যঙ্গ করে বলল,
“তোমারে কেউ পত্র দিবে না, সানশাইন। নোবডি। তোমার চিঠির প্রাপক তার স্থানে নেই। কীভাবে চিঠি দিবে?”

অলকানন্দার চিত্ত অস্থির হয়ে এলো। নবনীল জায়গায় নেই মানে? তবে কী লোকটা নবনীলেরও কোনো ক্ষতি করে ফেলল! অলকানন্দার ভাবনার মাঝেই স্টিফেন অলকানন্দা খুব কাছে চলে এলো। খুব ব্যাক্তিগত ভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“লেটস্ গো, সানশাইন। মধুচন্দ্রিমা সেরে ফেলি।”

অলকানন্দা বাঁধা দিত চাইল কিন্তু এই সুঠাম দেহী মানুষটার কাছে তার শক্তি বড়োই নগন্য। অলকানন্দার চোখে অশ্রু এলো। এই যন্ত্রণার ছোঁয়া তার চেনা। এই কঠোর ছোঁয়া তার পরিচিত। তাকে সুদর্শন কিংবা স্টিফেন, কেউ-ই ভালোবেসে ছোঁয়নি। কেউ না। সে যেখানে গিয়েছে সেখানেই কেবল পুরুষের মুগ্ধতা, মায়া আর কাম হয়েছে। কারো ভালোবাসা হতে পারেনি।

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২১.

একটি ক্লান্ত দিন, তৃষ্ণার্ত দুপুর, শূন্যতার চাদর জড়িয়ে ডাকছে বিষাদ। সুখ ছেড়ে যাওয়ার গল্প কোথাও লুটিয়ে পড়েছে অবেলায় , কোথাও বা দুঃখরা রূপকথা থেকে বাস্তবে পরিণত হয়েছে। চারদিকে প্রগাঢ় একাকীত্ব, ভালো না থাকার কবিতা। সূর্য তখন বিমূঢ়, মেঘ গুলো ভেসে বেড়াচ্ছে উদ্দেশ্যহীন। এমন একটা দিনে অলকানন্দা ভারী রকমের মন খারাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার শ্বশুরবাড়ির বিরাট দালানের ছাঁদে। গরম লাগছে শরীরে তবে তা যেন বাস্তবতার চেয়ে কমই যন্ত্রণা দিচ্ছে। বিয়ে হয়ে যাওয়ার আজ পঞ্চমতম দিন। শরীরে বৈবাহিক চিহ্ন নির্লজ্জের মতন মাথা তুলে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ওরা ভালোবাসার দাগ নয়, ওরা যন্ত্রণার ছোঁয়া। অলকানন্দা তপ্ত শ্বাস ফেলল। সুদূরে তাকাতেই তার দৃষ্টি আনমনা হলো। কিছু একটা পরিচিত দেখতে পেয়েই বক্ষ পিঞ্জিরাবদ্ধ মন পায়রা ছটফটিয়ে উঠলো। অলকানন্দা ছুটে গেলো দ্রুত। মোটা মোটা, ত্রিভুজাকৃতির সিঁড়ি পেরিয়ে সদর দরজার বাহিরে চলে গেল। গেইটে প্রহরী ঝিমুচ্ছে গভীর ক্লান্তিতে। অলকানন্দা সাবধানী পায়ে বেরিয়ে গেল বিশাল লোহার গেইট ছেড়ে। সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত কাঙ্খিত পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে পিছ ঘুরে, অলকানন্দা হাঁপিয়ে উঠেছে। কণ্ঠ কাঁপছে, তবুও মেয়েটা ডাক দিল,

“নবনীল…….”

নিঃস্ব চোখে চাইলে পরিচিত পুরুষ। মনে হলো মন পুড়ে যাওয়ার শ্মশানে ভালোবাসার আশায় চেয়ে থাকা যেন কালো কুচকুচে কাকটা। তার চোখে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মরুভূমি। সে শুধালো নরম কণ্ঠে,
“ভালো আছেন, নন্দা?”

অলকানন্দার কি জানি কি হলো! বুক চাপরে কান্নারা হাউমাউ করে ওঠল। কণ্ঠ চাইলো খানিক চিৎকার করতে। সে পারল না সেই চাওয়া পূরণ করতে। কান্না আটকানোর প্রচলিত চেষ্টায় আটকে গেল শ্বাস-প্রশ্বাস। অন্তরটা যেন ছিঁড়ে নিচ্ছে কেউ। কিন্তু তবুও জোর করে উচ্চারণ করল,
“আছি, খুব ভালো-ই আছি।”

নবনীল হাসলো। খুব অদ্ভুত ভাবে এই উত্তপ্ত গরমে লোকটা চাদর জড়িয়ে আছে! কেন আছে? অলকানন্দার মনের মাঝে প্রশ্নরা হামাগুড়ি খেলো কিন্তু তারা উত্তরের আশায় আর বেরিয়ে এলো না। নবনীল থেকে অলকানন্দার দূরত্ব তিন-চার হাত হবে কিন্তু মনে হচ্ছে তাদের দূরত্ব আকাশ থেকে মাটির দূরত্বের সমান। হাহাকার করে ওঠল চারপাশ। খুব গোপনে অস্বীকার করা অনুভূতিরা যে খুব গোপনেই মারা যাবে তা যে অলকানন্দার অজানা ছিল। কথা বলার প্রবল ইচ্ছে ছোটো মেয়েটাকে চুপ থাকতে দিলনা। কিশোরী মন, উজ্জীবিত আবেগ আর তার সয় না গোপনে। তারা বাহিরে আসতে চায়, সেই চাওয়া নিয়ে চালায় আন্দোলন, হৈ হৈ করে শব্দরা বেরিয়ে আসে,
“আপনি ভালো আছেন, নবনীল?”

নবনীল হো হো করে হেসে উঠলো। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হাসির কথাটা তার সামনে চলে এলো। এমন মধুময় হাসি! যেন চিরজীবন পাড় হবে স্ব আনন্দে এমন হাসির জোরে। অথচ দুর্ভাগ্য দেখো! চিরজীবন তো দূর, কয়েক মিনিটও এই হাসি দেখার সৌভাগ্য নেই অলকানন্দার।

“ভালো থাকার বন্দোবস্ত করে দিলেন, আর ভালো থাকবো না ভেবেছেন?”

বড়ো অমানবিক ঠেকল কথাখানি। যেন এই কথার বিপরীতে থাকা একটা গোপন কথা ডালপালা মেলে বলছে, “অলকানন্দা, তুমি ভালো রাখোনি, ভালো রাখলে না।”

অলকানন্দা হতাশার শ্বাস ফেলল, অসহায় কণ্ঠে বলল,
“সেদিন আপনার অভাবে একটি অলকানন্দা ঝরে গিয়েছিল, আপনি কী তা জানেন, নবনীল?”

“কোন অলকানন্দা ঝরে ছিল সেদিন? শুনি একটু! যে অলকানন্দার কপালে আজ শোভা পাচ্ছে মুগ্ধতা, যে অলকানন্দার শরীর আজ শোভা পাচ্ছে স্বামী প্রীতি, সেই অলকানন্দা বুঝি? শুনেছি ঝরে যাওয়া মানে মৃত্যু, অথচ এই অলকানন্দা সেই প্রচলিত কথা মিথ্যে করে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, ঝরে যাওয়া মানে মুক্তি। অলকানন্দা তার সাদা শাড়ির বাধ্য আস্তরণ থেকে মুক্তি পেয়েছে, অলকানন্দা তার সকল না চাওয়া থেকে মুক্তি পেয়েছে, খাঁচার ভেতর পোষ মানিয়ে রাখতে চাওয়া একটি উড়তে চাওয়া পাখি আজ উড়তে পেরেছে। কোথায় ঝরে গিয়েছেন অলকানন্দা? সব দিকে দেখি আপনার সুখের আগমনী ঢাক বাজছে। কোথায় তবে আপনার বিসর্জনের সুর? চারদিকে গোধূলির আলো, চারদিকে অলকানন্দার ভালো থাকা রঙিন হয়ে ফুটে ওঠেছে। কোথায় তবে অলকানন্দার মূর্ছে যাওয়া?”

নবনীলেন মুখে লেপ্টে আছে বাঁকা হাসির রেখা। যা তীরের মতন বিদ্ধ করেছে অলকানন্দার বক্ষ। সে নিবিড় কণ্ঠে বলল,
“আমার আপনাকে প্রয়োজন ছিল, নবনীল।”

“আফসোস, নন্দা! আমি কেবল আপনার প্রয়োজন হয়েই রইলাম, প্রিয়জন হওয়া- সে তো মোর সাধ্য নহে আর নাহি আছে মোর ভাগ্য। আপনি আমার কাছে সবসময়ের জন্য অপরিচিতই রইলেন।”

অলকানন্দার কান্না পেল। ভীষণ রকমের কান্না। যে কান্না ভাসিয়ে নিয়ে যায় সকল সুখ, সকল শোক। কিন্তু তার আর কান্না করা হলো না। সে বরং কেমন যেন কঠিন হয়ে গেলো। যে মানুষ তার দূর্দশা শুনেও এমন তাচ্ছিল্য ছুড়তে জানে সে মানুষকে কান্না দেখানো কেবল বৃথা কাজ। নবনীল কেমন শান্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো অলকানন্দার দিকে। যেতে যেতে বলল,
“আমি আপনার সাথে আছি, নন্দা। আপনার অমন খারাপ সময়ে হয়তো থাকতে পারিনি, তবুও আমি আছি। আমি আছি তীর্থের কাকের মতন। আমি শেষ বেলাতেও শকুন হয়ে মৃতদেহ থেকে যেমন সে বেঁচে থাকার খাদ্য কুড়িয়ে নেয় আমি আপনার থেকে বেঁচে থাকার কারণ কুড়িয়ে নিব। কিন্তু দুর্ভাগ্য দেখুন! আমি মানুষ হয়ে একটিবার আপনার ভালোবাসা কুড়িয়ে নিতে পারলাম না। আমার মানব জন্ম বৃথা নন্দা, আমার মানব জন্ম বৃথা।”

অলকানন্দা মুখ ঢেকে ফেলে। তুমুল কালো মেঘের পর যেমন বৃষ্টি ঝরে তেমন অলকানন্দার অশ্রুরা বাঁধ ভাঙে। সে-কি হাহাকার! কী যন্ত্রণা! অলকানন্দার বাহুতে তখন দূঢ় ছোঁয়া পায়। অলকানন্দা চমকে উঠে। বিস্ময় নিয়ে পিছে তাকাকেই দৃষ্টিগোচর হয় স্টিফেনের মুখমন্ডল। ফর্সা মুখটা লালাভ হয়ে আছে চোখেমুখে একটা কাঠিন্য ভাব। কণ্ঠ কিছুটা রুক্ষ করে সে প্রশ্ন করল,
“কী সমস্যা, সানশাইন?”

অলকানন্দা তার বাহুতে থাকা হাতটা ঝারা দিয়ে ফেলে দিতে চায় কিন্তু পারেনা। স্টিফেনের ছোঁয়া গভীর হয়। অলকানন্দাকে বুকে জড়িয়ে নেয় জোর করে। আবার প্রশ্ন তুলে,
“কী হইয়াছে তোমার?”

অলকানন্দা জবাব দেয়না, হাসফাস করে কেবল। স্টিফেন শান্ত চোখে তাকায় মেয়েটার দিকে, কোমল কণ্ঠে বলে,
“কান্নার সময় কারো স্বান্তনা পেলে ভালো লাগে। তুমি তো দেখি তা-ও জানোনা। চলো, ঘরে ফিরিয়া চলো।”

স্টিফেন ‘চলো’ কথাটা মুখেই বলল কিন্তু অলকানন্দার আর হাঁটতে হয়নি। কিছুটা টেনেই সে নিয়ে গেল তাকে।

বন্ধ রুমে অলকানন্দার ক্লান্ত দেহখানি পড়ে আছে বিছানায়। নবনীলের ভাষ্যমতে কপাল জুড়ে থাকা মুগ্ধতা এলোমেলো হয়ে আছে। নবনীলের তাচ্ছিল্যে বলা স্বামী প্রীতি যন্ত্রণার মতন বিঁধে আছে শরীরে। আহা সুখ! নবনীল এমন সুখ দেখলে নিশ্চয় এত গুলো কথা বলতে পারতো না।

স্টিফেন সাহেবী শার্ট-প্যান্ট পড়ে আবার ঘরে প্রবেশ করল। স্টিফেনকে দেখে অলকানন্দা বিপরীত দিকে ফিরে শুলো। তা দেখে হাসলো স্টিফেন। বুটে শব্দ তুলে এগিয়ে এলো। খুব সন্তপর্ণে অলকানন্দার পায়ে হাত দিল। শীতল হাতের স্পর্শ পেতেই মেয়েটা কেঁপে ওঠল। পা-টা টেনে নিতে চাইলেও পুরুষালী শক্তির কাছে সে নেহাৎই তুচ্ছ একটি নারী। স্টিফেনের রাশভারী কণ্ঠে বাক্যের স্রোত,
“হ্যাপি বার্থডে, নন্দা। শুভ জন্মদিন।”

অলকানন্দা দারুণ ভাবে চমকে গেল। অপ্রত্যাশিত কথাটি অনাকাঙ্খিত সময়ে শুনে সে যেন আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে চলে গেলো। অবাক হয়ে বলল,
“আমার আজ জন্মদিন!”

“তুমি জানো না?”

অলকানন্দা ডানে-বামে মাথা নাড়াল। যার অর্থ সে ‘জানেনা’। স্টিফেন স্মিত হাসল। লোকটা যে হাসতেও পারে তা আজ জানল অলকানন্দা। কিন্তু খুব গভীর ভাবে খেয়াল করলে বুঝা যায় মানুষটার হাসি গাঢ় আর কেমন মোহনীয় যেন। ঘোর লেগে যাওয়ার মতন। অলকানন্দা বিছানা ছেড়ে ওঠতে নিলেই রুমঝুম করে ওঠলো তার পায়ের স্বর্ণের মোটা নুপুর জোড়া। অলকানন্দা আরেক দফা বিস্মিত হলো। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“আমার নুপুর প্রিয় আপনি জানতেন?”

“ইয়েস মাই সুইটহার্ট, আমি এটাও জানি যে- তোমার নবনীল নামক ছেলেটাও প্রিয়। কেবল প্রিয় নই আমি।”

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

২২.

হেমন্তের আকাশে কতগুলো অনির্দিষ্ট মেঘ ভেসে যায়। যাদের কোনো নিজস্ব ঠিকানা থাকেনা, নিজস্ব ঘর থাকেনা। নেই তাদের পিছুটান। একমাত্র মানবজাতি সামনে এগুতে পারেনা পিছুটানের জন্য কিন্তু মেঘেদের তেমন ভয় নেই। তারা নিজ আনন্দে যেখানে ইচ্ছে ছুটে বেড়াতে পারে। মাটির সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই বিধায় হয়তো এই কাজটা তারা ভালো করতে পারে। কারণ যারই মাটির সাথে সম্পর্ক তৈরী হয়, তাদের শিকড়ই বহুদূর চলে যায়। তাই চাইলেও তারা আর পিছুটান ফেলে চলে যেতে পারে না। সংসারের নিয়মই যে বড়ো অদ্ভুত, তুমি চাইলেও নিয়ম অমান্য করে, মায়া কাটিয়ে বাঁধনহারা হতে পারবে না। এই সংসার তার বাঁধন ছাড়ে না, ছাড়তে চায় না।

অলকানন্দার পড়নে কলাপাতা রঙের একটি ঢাকাই মসলিন শাড়ি। মোটা গহনা তার অঙ্গ জুড়ে সৌন্দর্য বর্ধন করছে। মোটা সিঁদুরে তাকে কিশোরী লাগছে না মোটেও। সতেরোর আভাস তার শরীর জুড়ে। হুট করে যেন কিশোরী মেয়েটা বড়ো হচ্ছে খুব গোপনে। ভিনদেশী পুরুষের ছায়ায় কিশোরী যেন হয়ে উঠেছে স্বামী সোহাগি এক অপরূপা। তাহার রূপের অন্ত নেই। অলকানন্দা তৈরী হয়ে বসে আছে নিজের ঘরে। স্টিফেন তাকে কোথাও একটা নিয়ে যাবে বলেছে আর তাই সে তৈরী হয়েছে। যেতে চায়নি সে কিন্তু তার শাশুড়ির জোড়াজুড়িতে রাজি হয়েছে। দু’জন কর্মচারী মেয়েই তাকে সাজিয়ে দিয়েছে। অলকানন্দার প্রচন্ড রকমের বিরক্ত লাগছে। এ বাড়িতে কেউ কারো সাথে তেমন কথা বলে না। সকলে চুপচাপ নিজের মতন থাকেন। তার শাশুড়ি বিভাবরী দেবী খুবই স্বল্পভাষী মানুষ। মিশুক স্বভাবের হলেও তিনি কথা বলেন কম। আর বাকি যারা আছে বাড়িতে তারা হলো কর্মচারী। খুব অদ্ভুত ভাবে কর্মচারীর কেউ অলকানন্দাকে সোজা চোখে দেখে না। কেমন যেন বাঁকা ভীতু ভীতু চোখে তাকায়। হয়তো সেদিনের মেয়েটাকে শাসন করার কথাটা এরা সবাই জেনেছে তাই এমন অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে তাকে দেখে। নিজেকে বড়ো আবেগহীন লাগে আজকাল। কেমন যেন বাঁধাধরা নিয়ম। পানসে বিকেলের মতন বিরস, মধ্য রাতের মতন নিশ্চুপ এই জীবন। অথচ সপ্তদশী একটি কন্যার জীবন হওয়ার কথা ছিল স্রোতস্বিনী নদীর মতন প্রবল উচ্ছ্বাস মাখা, হৈচৈ পূর্ণ, চঞ্চল। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিরে। কিছু খুঁজে না পেয়ে অলকানন্দা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। আশেপাশে কাউকে না পেয়ে সদর দরজা পেরিয়ে পা রাখে সে সান দিয়ে বাঁধাই করা বাড়ির পেছনের দিকে বিশাল বাগানটায়। বিকেলের পরিবেশে ঘুঘু তখন সুর তুলেছে তারা বর্ণ বিহীন কণ্ঠে। চারদিকে কিচিরমিচির শব্দ। পাখিরা উড়ে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যে। আজ বাতাস নেই চারপাশে। কেমন যেন শুনশান সবটা! অলকানন্দা চারপাশে তাকায়। গোল বাগানটার একদিকে সরু রাস্তা গিয়েছে তাও বিভিন্ন বনালি ঔষুধী গাছে ভরা। অলকানন্দার মন সদা কৌতূহলী। কৌতূহল নিয়ে সে রাস্তাটার দিকে পা রাখে। কিন্তু এগিয়ে আর যেতে পারে না। তার আগেই ভেসে আসে পরিচিত পুরুষের রাশভারী কণ্ঠ,
“বিউটিফুল লেডি! কোথায় যাইতেছেন?”

নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে পিছুডাকটা ভয়াবহ শোনালো। মনে হলো চুরি করতে এসে খুব বাজেভাবে ধরা পড়ে গিয়েছে। অলকানন্দা আকস্মিক ডাকে কেঁপেও উঠল কিঞ্চিৎ। অতঃপর অ্যালেনের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি কণ্ঠে বলল,
“ভালো লাগছিল না বলে হাঁটতে এসেছিলাম।”

”আপনাকে স্টিফেন ডাকিতেছে। আসুন আমার সাথে। লেটস্ গো।”

অলকানন্দা অস্বস্তি নিয়ে ফিকে হাসি দিল। আমতাআমতা করে বলল,
“চলুন।”

অ্যালেন সামনে এগিয়ে গেল। খুব অদ্ভুত ভাবে নন্দা খেয়াল করল, অ্যালেন তার দিকে তাকাচ্ছে না। যতবার কথা বলছে মাটিতে দৃষ্টি রেখেই বলছে। যেন সে তাকিয়ে ফেললে গুরুতর কোনো পাপ হয়ে যাবে তার! অথচ অলকানন্দারা ছোটোবেলা থেকে জেনে এসেছে ভিনদেশী পুরুষ মানুষ খারাপ হয়। তাদের চরিত্রে সমস্যা হয়। অথচ অ্যালেনকে দেখলে কথাটা মোটেও সত্য বলে মনে হয়না। অ্যালেন তার চেয়ে বয়সে অনেক বেশি বড়ো হওয়া স্বত্তেও সবসময় একটা শ্রদ্ধা ভাব লোকটার ভেতরে।

অলকানন্দা বাড়ির বাহিরে দাঁড় করা একটি গাড়ির সামনে এলো। সাহেবদের কালো রঙের ছোটোখাটো সাহেবী গাড়ি। স্টিফেন দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির সামনে। অলকানন্দাকে দেখেই সে গাড়ির একপাশের দরজা খুলল, ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“তাড়াতাড়ি আসো, দেরি হচ্ছে।”

অলকানন্দা উঠে বসল। চার-পা সংযুক্ত যানবাহনে সে জীবনের প্রথম উঠল। কী অদ্ভুত অনুভূতি হলো বুকের মধ্যিখানে। সে যেমন পরিবারের মেয়ে, তেমন পরিবারে থেকে গাড়িতে ওঠার কথা কখনো সে ভাবেনি অথচ আজ এই অকল্পনীয় জিনিসটাই সত্যি হলো। সে তার নিজের স্বামীর গাড়িতে উঠেছে। স্বামী! শব্দটা বড়ো নিষ্ঠুর ঠেকলো অলকানন্দার কানে। স্বামী নামক মানুষ গুলো বড়ো ভয়াবহ তার কাছে। গাড়ি ছুটে চলেছে আপন বেগে। স্টিফেনের হাতে একটি সংবাদপত্র, যেখানে তার সম্পূর্ণ ধ্যান দেওয়া। গাড়ি ছুটতে ছুটতে এক গ্রাম পেরিয়ে আরেক গ্রামে প্রবেশ করল। অলকানন্দার পরিচিত গ্রাম, প্রাণের ভিটেমাটি। যেখানে সে ষোলোটি বছর নানান স্মৃতি বুকে জড়িয়ে বড়ো হয়েছে। এককালীন প্রশান্তির জায়গা। আজ প্রশান্তি লাগছে না অবশ্য। গায়ে কাঁটার মতন বিঁধছে এ গ্রামের নির্মল হাওয়া। শরীর-মন অজানা আতঙ্কে শিরশির করে উঠছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে কিছুদিন আগের সেই কালো রাতের কথা। যে রাত পৃথিবীর বুকের ফুটন্ত এক অলকানন্দা ফুলকে পায়ে পিষিয়ে থেতলে ফেলেছে। যা রাত ভীষণ বাজে ভাবে কলঙ্ক লেপেছে অভাগিনীর কপালে। এ গ্রাম বড়ো পাষাণ, এ গ্রাম অলকানন্দার চির অপরিচিত। এই গ্রাম অলকানন্দাকে মনে রাখেনি, ভালোবাসেনি।

খুব গোপনে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল অলকানন্দার ডান চোখ বেয়ে। হৃদপিন্ডের গতি যেন ক্রমাগত বাড়ছে। তার পাশের মানুষটাও বোধহয় শুনতে পারে হৃদপিন্ডের এই অস্বাভাবিক কম্পন। অলকানন্দা চোখ বন্ধ করতেই অনুভব করল তার ডান হাতে শক্ত হাতের ছোঁয়া। বিপরীত হাতটা কিছুটা উষ্ণ। দ্রুত গতিতে সে চোখ মেলে তাকাতেই স্টিফেনের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। লোকটার চোখে-মুখে প্রগাঢ় গাম্ভীর্যতা, কণ্ঠও সেই গাম্ভীর্যতার ছাঁপ,
“ভয় পাচ্ছো? ভুলে যেও না, তোমার আমি আছি।”

অলকানন্দা থমকে যায়। অনেক অনেক দিন যাবত কত গুলো কষ্ট বয়ে বেড়ানো জীবনটা হয়তো ভরসার হাত খুঁজেছিল, যে হাত হয়ে এসেছিল নবনীল। আজ স্টিফেনের কথায় সে স্টিফেনকে না, খুব করে যেন নবনীলকে অনুভব করল। বুকের মাঝে তীক্ষ্ণ ব্যাথারা উঁকিঝুঁকি দিল। ইশ, এটাই কী তবে ভালোবাসা? যার অভাবে বুকের মাঝে বৈশাখের সর্বনাশা ঝড়ের মতন তান্ডব বয়ে চলে? এটাই কী ভালোবাসা? যাকে কখনো ছুঁতে না পেরেও অনুভবে রেখে দেওয়া যায় প্রতি মুহূর্তে?

অলকানন্দার দৃষ্টি স্থির। স্টিফেন ছেড়ে দিল মেয়েটার হাতটা। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আমার মাঝে অন্য কাউকে খুঁজো না, সানশাইন, আমার যে কষ্ট হয়।”

অলকানন্দা চমকে উঠল। লোকটা মনের কথা পড়ে ফেলতে পারে। যে কথা লুকানোর জন্য অলকানন্দার এত আয়োজন, সে-ই কথা মানুষটা পড়ে ফেলে। অলকানন্দার ভয় হয়। তাকে সবটা কেউ পড়ে ফেলছে এটা মোটেও সুখকর নয়। বরং সবটা পড়ে ফেলার পর সে ফেলনা যাবে এটাই ভাববার বিষয়। আচ্ছা, স্টিফেনের কাছ থেকে ফেলনা যাওয়ার পর নবনীল কী তাকে প্রচুর মূল্যবান ভেবে আদৌও তুলে নিবে? আগলে রাখবে নিবিড় ছায়ায়? আঁতকে ওঠে অলকানন্দা। এমা, ছিহ্! ছিহ্! সে কিনা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে তৃতীয় একজন পুরুষের কথা ভাবছে! তার চরিত্রে সে এমন অপবিত্রতা কীভাবে লাগাচ্ছে! এই কলঙ্ক তো চির জীবনের দাগ হয়ে থেকে যাবে।

গাড়ি তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে থামে। অলকানন্দা গাড়ি থেকে বেরুতে চায় না। তার ঠিক ভরসা হয়না এই গ্রামের মাটিতে পা রাখতে। মনেহয়, এই বুঝি গ্রামের মানুষ গুলো হৃদয়হীন দৈত্য হয়ে ওঠবে, ছিনিয়ে নিবে অলকানন্দার প্রাণের প্রদীপ। এই বুঝি তারা মিশিয়ে দিবে তাকে এই মাটিতে। ভয় হয় মেয়েটার, বাঁচার ইচ্ছে নিয়ে মারা যাওয়া কষ্টের আর সে এই কষ্ট কখনো চায়না। স্টিফেন ভরসা দিয়ে বলে,
“নামো, আমি থাকতে একটা পিপড়াও তোমার কাছে আসতে পারবে না। আর ভয় না, যাই হোক, নিজেকে রাণীর মতন প্রদর্শন করো যেন মানুষ মাথা নত করতে বাধ্য হয়। ভীতুদের কোনো মহত্ত্ব নেই কিন্তু যারা সাহসী, তারাই দৃষ্টান্ত তৈরী করতে পারে। আসো, সবসময় মনে রাখবে তুমি রাণী, তোমার ক্ষমতা তোমার স্বামী। কেউ তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না। স্টিফেনকে পেরিয়ে নন্দার কাছে যাওয়াটা অসম্ভব রকমের কাজ।”

এই একটু ভরসার আশায় অলকানন্দা ক্ষুধার্থ চোখে তাকিয়ে ছিল আশা বিহীন। তার আশা শূন্য নদীতে আশার এমন বাঁধ ভাঙা বি স্ফো র ণ দেখে সে স্তব্ধ। এতটা আশ্রয়স্থল হয়ে তার জীবনে কেউ কখনো আসেনি। সে কেবল অনির্দিষ্ট স্রোতে ভেসে গিয়েছে। কখনো স্রোতের তোপে একূলে থেমেছে কখনো বা অকূলে, তাকে কেউ নিজ ইচ্ছায় রেখে দেয়নি। এমনকি নবনীলও না। নবনীল সবসময় এগিয়ে যেতে বলেছে, কিন্তু কখনো পাশে থাকবে বলেনি। অথচ এই হিংস্র মানুষটা কেমন ভরসা দিচ্ছে। ভরসাহীন মেয়েটার এমন ভরসা হয়ে এলে সে তো দিক শূন্য হয়। ভালো খারাপের প্রতিযোগীতায় সে কেবল বেঁচে থাকতে চায়।

অলকানন্দা গাড়ি থেকে নামতেই চক্ষু চড়কগাছ। তারা দাঁড়িয়ে আছে বিহারিণী মহলের সামনে। পা দু’খানা কাঁপছে তার। এই মহলে তো তার আর ফেরার কথা ছিল না তবে ভাগ্য দেবতা তার প্রতি এ রুষ্ট হলেন কেন? তার না চাওয়া কাজটাই কেন তাকে করতে হলো?

স্টিফেন অলকানন্দার হাত ধরে দাঁড়াল। বিহারিণী মহলের সামনে প্রচুর ভীড়। পুরো ভীড়টা জুড়ে কেমন মানুষ হারানোর শোক। চারপাশে আগরবাতির তীক্ষ্ণ ঘ্রাণ ভেসে আসছে। বাড়িতে আবার নতুন করে কেউ মারা গেল? কিন্তু কে! বুক কাঁপছে মেয়েটার। এ বাড়ির প্রতিটি মানুষকেই সে আপন ভেবেছিল, তাই কারো প্রস্থান সে মেনে নিতে পারবে না। তার পা কাঁপছে, ঠিক মতন মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি অব্দি নেই মেয়েটার। গ্রামবাসীর দৃষ্টি এখন অলকানন্দার দিকে। বিস্মিত, স্তব্ধ চোখে তারা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। অলকানন্দার সেদিকে হুঁশ নেই, সে ভীত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাড়িটার দিকে। বাড়িটার সামনের জায়গায় সাদা কাপাড়ে জড়ানো একজন মানুষ চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন। কে সে? কার এমন চির বিদায় ঘটলো? কার জীবন গেল স্থায়ী অবসানে!

ভীড়ের মাঝে উঁকিঝুঁকি দিয়েই মেয়েটা আৎকে উঠলো। লক্ষ্মীদেবীর কোমল মুখটা চিরতরে ঘুমিয়ে গিয়েছে। আজ মানুষটার ভেতর কোনো কোঠরতা নেই, কোনো তেজ, রাগ কিছু নেই। নন্দাকে দেখে আজ কেউ হৈহৈ করছে না। কেউ আর তীক্ষ্ণ কথার বাণও ছুঁড়ে মারছে না। অলকানন্দার চোখ ঝাপসা হলো। মনে পড়লো বিয়ের দিনের কথা। যেদিন সে এ বাড়িতে পা রাখল? এই লক্ষ্মীদেবী খুশিতে আটখানা হয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছিলেন। তারপর যেন কী হলো! মানুষটা আর হাসেনি কখনো। দিন-রাত কেবল খোঁটা দিতে শুরু করল! আজ হঠাৎ মানুষটার বিদায়ে সব খারাপ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অলকানন্দা চোখ বন্ধ করল। সে কাল ভ্রম নাকি কল্পনা থেকে লক্ষ্মীদেবীকে নিজের বাড়ির সামনে দেখেছিল। এক মুহূর্তের জন্য বোধহয়। এটা কী সত্যি ছিল না কেবলই ভ্রম! অলকানন্দার শরী্র ভার হয়ে এলো। কী যেন একটা ভেবে স্টিফেনের দিকে তাকাতেই খেয়াল করল মানুষটার চোখ হাসছে।

#চলবে

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ