অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-০৫

0
1050

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

৫.

হেলাল সাহেব চাননি, বিধায় ইমতিয়াজ খানের বাড়িতেও বিশেষ কোন আয়োজন করা হয়নি। এভাবেই নিরবতার মাঝে কেটে গেছে সারাদিন। বাড়ি থেকে মেহমান যারা এসেছিল, তারাও বিদায় হয়েছে। মেঘালয়া রাতের খাবার শশুর-শাশুরির সঙ্গেই খেল। তবে ইরাজের দেখা নেই। রাত বারোটা বাজতে চলেছে ঘড়ির কাঁটায়। ইমতিয়াজ সাহেব অপেক্ষায় থেকে, এক পর্যায়ে মেঘালয়াকে পাশে বসিয়ে খেয়ে নিলেন। তিনি ছেলের স্বভাব সমন্ধে অবগত হলেও, নতুন ছেলে-বউয়ের সামনে আজ সামান্য লজ্জাবোধ করলেন। যদিও ইরাজের অনুপস্থিতিতে মেঘালয়া সারাদিন বেশ সাচ্ছন্দ্যেই আছে।

মেঘালয়া খেয়ে উঠে রুমে গেল। এতক্ষনে তার ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস থাকলেও, জীবনটা আর আগের মতো সুখী ও সুন্দর নেই। আস্তে করে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল বেলকনিতে। আজ প্রকৃতিতে বেশ ভালোই ঠান্ডা বাতাস বইছে। ওড়নাটা, মাঝে মাঝে শরীর ছুঁয়ে যাওয়া দমকা হাওয়ার তরে উড়ছে। অদ্ভুত অনুভূতিরা এসে বুকে জড়ো হলো। আচমকা চোখের সম্মুখে ভেসে উঠল সেই ভুলে ভরা সময়ের ধারাটুকু।

তাবিরের সঙ্গে মেঘালয়ার পরিচয়, কলেজের বড়ো ভাই হিসেবে। অতঃপর একদিন তাবির প্রপোজ করে বসল মেঘালয়াকে। বান্ধবীদের সকলের বয়ফ্রেন্ড আছে। তার ছিল না। আর তাবিরকে সকলে যথেষ্ট স্মার্ট বলেও জানে কলেজে। সবাই যখন নিজেদের বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারে বলত, ডেটে যেত। এসব দেখে, শুনে— মেঘালয়ার চরম কৌতুহল হতো। বলতে গেলে শখে পড়ে একদিন হুটহাট গ্রহন করে ফেলল তাবিরের প্রস্তাব। শুনতে হাস্যকর লাগলেও, মেঘালয়াকে হেলাল সাহেব বড়ো আহ্লাদের সাথে পালন করেছিলেন। যার কারনে সে বয়সের তুলনায় বিকশিত হয়ে ওঠেনি বাস্তবতা অথবা বাহিরের পরিবেশের সঙ্গে। নয়ত তেমন কোন জটিল অনুভূতি ছাড়া কোন সম্পর্কে জড়ানোর পর কেউ, কখনোই এমন পদক্ষেপ নিয়ে নেয় না। সবকিছুতে প্রশ্রয় পেতে পেতে মেঘালয়ার সেই আহ্লাদি, বাচ্ছা মানসিকতাটা যেন রয়েই গিয়েছিল।

তাবির হঠাৎ-ই কিছুদিন ধরে দুরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে বলত। অথচ মেঘালয়া বাবার অনুমতি পাবে না বলে মানা করে দিয়েছে বারবার। তাবির এবার সে-সব বাদ দিয়ে একদিন প্রস্তাব করে বসল, তাকে যদি মেঘালয়া সত্যিই ভালোবেসে থাকে, তবে তার সঙ্গে পালাতে হবে। সে-সময় মেঘালয়ার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। তবে সে দেখেছে, বান্ধবীদের অনেকে নিজের ভালোবাসার প্রমান দিতে হাত কা টে, অথবা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করে। তবে তবুও সে চেয়েছিল না এমন একটা কাজ করতে। তাবির তাকে নানান কথা বলে উশকানি দিতে থাকল, ‘সে শুধুই মাত্র তার আব্বুর চালিত এক ব্যাটারি ওয়ালা পুতুল। তার নিজস্ব কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো আত্মনির্ভর্শীলতা নেই।’

আর এই কথাটিই মেঘালয়ার জিদে আঘাত করে বসল। সে সেদিনই তাবিরকে কথা দিয়ে দিলো, পরীক্ষা শেষ হতেই সে যাবে তাবিরের সঙ্গে। সে পারে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে। এটা প্রমান করে ছাড়বে, সে আব্বুর ব্যাটারি চালিত পুতুল নয়।

এতটুকু ভাবতেই মেঘালয়ার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসল। নজর উঁচিয়ে আকাশের পানে তাকাল। আজ অর্ধচাঁদ শোভা পাচ্ছে আকাশে। চেয়ে রইল চাঁদের দিকে।

রাত একটার কাছাকাছি সময়ে বাড়িতে প্রবেশ করে ইরাজ। ইমতিয়াজ সাহেব বসার রুমে সোফায় বসে ছিলেন। ইরাজ ঢুকতেই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘তোর পরিবর্তন কি আশা করা যায়, রাজ?’

ইরাজ দাঁড়াল। পেছন ফিরে দেখল বাবাকে। অতঃপর দায়সাড়া ভঙ্গিতে ঘাঁড় দুলিয়ে বলল, ‘উহু।’

ইমতিয়াজ সাহেব অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, ‘তোমাকে ছোটবেলা থেকে সবকিছুতে স্বাধীনতা দেওয়ার পরিণতি এটা?’

ইরাজ ভ্রু কুঁচকে, ঠোঁট বাঁকায়। দাম্ভিকতার সাথে বলে ওঠে, ‘তুমি স্বাধীনতা না দিলে, আমি পরাধীন?’

ইমতিয়াজ সাহেব মৃদূ ধমকে উঠলেন, ‘এখন আর ছন্নছাড়া জীবনযাপন চলবে না, সেটা বুঝিস না তুই! আগের মতো ব্যাচেলর না তুই আর। তোর পথ ও মুখ চেয়ে কেউ বসে থাকার মতো এসেছে, তোর ঘরে।’

ইরাজ তাচ্ছিল্য করে হেসে ওঠে। ওভাবেই বলল, ‘ঘরে আমি নিয়ে আসিনি, আর না সে এসেছে। তোমার এনেছ। ড্যাড, আমি অবাক হচ্ছি আসলেই, যে তুমি আমার কাছে সংসার-ধর্ম পালনের আশা রাখছ?’

ইমতিয়াজ সাহেব মুখ কুঞ্চিত করলেন বিরক্ততে। বললেন, ‘মেঘা এই ভুলটা না করলে, তুই ওকে ভালোভাবে গ্রহন করতি?’

ইরাজ সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। পেছনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইমতিয়াজ সাহেব। যাদের দুজনকে এমন অদ্ভুতভাবে এক ঘরে বন্দি করে দিয়েছেন তারা, এই দুই পথের পথচারীর শেষ পরিণতি কী আসলে?

রুমে গিয়ে পরনে থাকা পোশাক পরিবর্তন করে, টাউজার পরে গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল ইরাজ। মেঘালয়া ইরাজের উপস্থিতি বুঝতে পারলেও, কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আপন মনে রাতের আকাশ দেখতে ব্যস্ত সে।

কিছুক্ষন ওভাবেই কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ-ই পেছন থেকে গম্ভীর গলায় আওয়াজ এলো, ‘রুমে যা।’ তীক্ষ্ণ আদেশের স্বর। যেখানে ঝরে পড়ছে হয়ত, কতশত লুকায়িত ক্ষোভ আর আক্রোশ।

মেঘালয়া আকাশের দিকে চেয়ে থেকেই উত্তর দিলো, ‘বেলকনি যথেষ্ট বড়ো। আমি থাকলেও, আপনার এখানে থাকার মতো জায়গা আছে নিশ্চয়ই!’

ইরাজ এতক্ষনে তাকাল মেঘালয়ার দিকে। কিছুক্ষন চুপচাপ চেয়ে থেকে, আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করল। রুমের আলো নেভানো। মৃদূ লাল আলো জ্বলছে সেখানে সেই আলোই ঝাপসা আলো ছড়াচ্ছে, বেলকনিতে। আলো-আঁধারের এই অদ্ভুত সংমিশ্রনে পরিবেশটাকে খুব রহস্যময় লাগছে। ইরাজের হাতে সিগারেটের প্যাকেট। আকাশের দিকে তাকিয়ে, হাতে সেই প্যাকেট নাড়াচাড়া করতে-করতে শীতল স্বরে বলল,

‘আমার চোখে, তুই কাঁটার মতো বিঁধে থাকা, এক যন্ত্রনা মাত্র। যথাসম্ভব, এই আমি থেকে দুরে রয়ে এই যন্ত্রনা খানিক কম কর।’

মেঘালয়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায়। এত ঘৃনা ইরাজের— মেঘালয়ার ওপর? কই আগে তো এমন ছিলো না! ইরাজ মেঘালয়াকে আগে পড়েই খুব শাসন এবং কড়া চোখে দেখেছে। এজন্য দুজন দুজনের কাছে নেগেটিভ দুটো চরিত্র হয়ে উঠেছিল। অথচ আজকাল ইরাজের আচরণে যা প্রকাশ পায়, তা ভয়ানক আক্রোশ অথবা ঘৃনার চেয়েও বেশি কিছু। আগে কখনও এমন কিছু লক্ষ্য করে নি মেঘালয়া ইরাজের চোখে। এখন যে হিংস্রতা পরিলক্ষিত হয়, তা আসলেই নতুন লাগে যেন!

চুপচাপ চলে এলো রুমে। বিছানায় শুতে গিয়েও আবার থেমে যায়। যে লোক, বারান্দায় একসঙ্গে থাকা সহ্য করতে পারছে না, সে এক বিছানা ভাগাভাগি করে নিশ্চয়ই ঘুমাতে পারবে না? আর বাসর রাতেও যতক্ষন মেঘালয়া বিছানায় ছিল, ইরাজ রুমেই আসে নি। ধীর-স্থীর পায়ে রোবটের মতো হেঁটে গিয়ে সোফায় বসল। জীবনটা খুব জটিল লাগে আজ কয়েকটা দিন। খুব সুখে ও আহ্লাদে পালিত হওয়া মেঘালয়া যেন, বাস্তবতার শিকলে বন্দি হয়ে পড়ছে সময়ের আবর্তনে! বুক ফেটে যাচ্ছে, অথচ আজ আর চোখ দিয়ে পানি ঝরল না। বুকে পাথরের মতো শক্ত কিছু চেপে আছে যেন! ওভাবেই আলোহীন রুমে বসে রইল সোফার ওপর।

ইরাজ পকেট থেকে কোন এক তরলের বোতল বের করে। কর্ক খুলতেই ঝাঁঝাল গন্ধ নাকে এসে ঠেকে। অপর হাতের আঙুলের ভাজে জলন্ত সিগারেট। বোতলে ঠোঁট লাগিয়ে কয়েক ঢোক গিলে, তা মুখ থেকে নামাল। গলা দিয়ে পুড়তে পুড়তে নামছে। সিগারেটের ধোঁয়া টেনে নিলো এবার শ্বাস ভরে। নেশালো তরল ও ধোঁয়ার কুন্ডলি কি আসলেই সক্ষম ভেতরের আগুনের বহর কমাতে? ধিক-ধিক করে জ্বলছে ভেতরে।

ওভাবেই কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। আরও কয়েক ঢোক গিলতেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। থামল না ইরাজ। আবার চুমুক দেয় বোতলের মুখে। সিগারেট পুড়তে পুড়তে শেষ হয়ে এসে, আগুন হাতে লাগছে। সেখানে হয়ত এতক্ষনে ফোসকা পড়ে গেছে। তাতে ইরাজের, বিশেষ কোন যায়-আসল বলে মনে হলো না। বোতল শেষ, ইরাজের হিতাহিত জ্ঞানও বোধহয় লোপ পেয়ে এলো এবার। এলোমেলো পায়ে রেলিং ছেড়ে এসে সোফায় বসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে, ধপ করে পড়ল মেঝেতে।

শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকায় মেঘালয়া। দৌড়ে গেল বেলকনিতে। ইরাজ পড়ে আছে। মেঘালয়া টেনে তোলার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই, ইরাজ হাত উঁচিয়ে ধরে। থেমে গেল মেঘালয়া। নিজেই ওঠার চেষ্টা করে ইরাজ। একসময় উঠে দাঁড়ালও। নেশার চেয়ে জিদ মনে হলো, শরীরে এখনও খানিকটা বেশিই ইরাজের। নেশা, জিদে মরিচা ধরাতে পারে নি তবে! ওভাবেই এলোমেলো পায়ে হেঁটে রুম অবধি এলো। মেঘালয়া পেছনে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রুম অবধি এলেও বিছানায় আর পৌঁছানো হলো না। তার আগেই আবার পড়তে নিলে এবার মেঘালয়া এসে ঝাপটে ধরে। ইরাজ টাল-মাতাল অবস্থায়ও ওকে সরানোর চেষ্টা করে। মেঘালয়ার নাকে এসে বিশ্রী গন্ধ ঠেকল। নাক-মুখ কুঞ্চিত করে তীর্যক কণ্ঠে বলে উঠল,

‘ছেড়ে দিলেই তো হুড়মুড়িয়ে পড়বেন। তবুও ভাব কমছে না! আপনাকে স্পর্শ করার বিরহে মরে যাচ্ছি না আমি। আপনাকে বিছানা অবধি নিয়ে ছেড়ে দেব। এবার ছটফটানি বন্ধ করুন।’

ইরাজের মনেহয় কানেই গেল না কথাগুলো। ছিটকে সরে গেল। মাতাল কণ্ঠে, দম্ভ করে বলে ওঠে, ‘এরকম বোতল আরও কয়েকটা পেটে পড়লেও, আমি এতটা মাতাল কখনোই হব না; যে আমার তোর সাহায্য লাগবে। দুরে থাকতে বলেছি না তোকে আমার থেকে? নির্লজ্জ মেয়েলোক।’

মেঘালয়া কথাগুলো শুনে, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ইরাজ নিজেই কোনমতো হেঁটে গিয়ে বিছানায় ধপ করে পড়ল। মেঘালয়া কপাল কুঁচকে চেয়ে রয়। ওর ধারণা ছিল, ইরাজের স্বভাব-চরিত্রে দোষ আছে। তাই বলে, এমন ঘরে বসে নেশা করার মতো নিকৃষ্টতম অভ্যাস আছে; তা জানত না। দেখল, ইরাজ কিছু বিরবির করছে। ও শুনেছে, নেশা করলে মানুষ বাহ্যিক জ্ঞান হারায়। তখন সত্যি কথা বলে। কোন সত্যি শোনার আশায়, ইরাজের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ইরাজ মাতাল কণ্ঠে মেঘালয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘তুই চলে যা, মেঘ। আমার কাছে থাকলে, এভাবে নিত্য-নতুন ভাবে জ্বলবি কেবল। আমি ধ্বংসাত্বক। আমার সংস্পর্শে কেবল, ব্যথা ছাড়া আজ আর তোর জন্য তেমন কিছু নেই। দুরে চলে যা। মুক্ত হয়ে যা…

থমকে দাঁড়িয়ে রইল মেঘালয়া। ইরাজের কথাগুলো বোধগম্য হচ্ছে না। কেমন ধোঁয়াশা, এই গোটা ইরাজটাই ধোঁয়াশা কেবল!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে