#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
৪.
শেষ অবধি নিস্তার হয়নি আর মেঘালয়ার। বসেছে বিয়ের কনের সাজে। সামনেই বসে আছেন, হেলাল সাহেব। আজও তাকে দেখতে মোটেও খুশি লাগছে না। ঘরোয়া বিয়ে যেমন হয়, তেমনই সাধারন ভাবে আয়োজন করা হয়েছে। কাজী সাহেব এসে বসে আছেন। দুপুর গড়াতে যাচ্ছে। ব্যাবসায়িক পরিচিত যে কয়েকজন এসেছিলেন, তাদের খাবার পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। সে-সব ভালোভাবে মিটে গেলেও বিপত্তি তো বাঁধারই ছিল। যেখানে বর স্বয়ং ইরাজ খান, সেখানে সুষ্ঠভাবে সবটা ঘটতে পারে না। বিকেল তিনটে পেরিয়ে চারটে বাজতে চলল। তবে এখন অবধি ইরাজের দেখা পাওয়া যায়নি এ অলি-গলির আশেপাশেও।
মেঘালয়া সামান্য আশার আলো দেখতে পেল যেন। ইরাজ হয়ত আসবে না। আর আজকের বিয়েও হবে না। আরও অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরও ইরাজের দেখা পাওয়া গেল না। মেঘালয়ার খুশি বাঁধ মানছে না। নিজের মনেই এই খুশিকে উপভোগ করতে করতে আচমকা আব্বুর দিকে নজর গেল। মানুষটা বড়ো উশখুশ করছে। অস্থির দেখাচ্ছে তাকে খুব। আর হাই-প্রেসারের রোগীর জন্য এটা মোটেও ভালো বার্তা বয়ে আনবে না। কেমন পাল্টে গেল মেঘালয়ার মনোভাব। আব্বুকে ওভাবে ছটফট করতে দেখে, এবার কেন জানি সেও চাইতে শুরু করল, ইরাজ জলদি পৌঁছাক এখানে। ইমতিয়াজ সাহেব বরাবর ছেলেকে ফোনে ব্যার্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, ছেলের পাত্তা নেই।
হেলাল সাহেব আরও কাঁতর হয়ে উঠলেন এবার। হয়ত আজও তার সম্মানহানীর দিন। আজও জঘন্যভাবে বেঁচে থাকা বাকি মানটুকু হারাতে চলেছেন তিনি। লোকে বলাবলি শুরু করেছে, পালানো মেয়েকে উদ্ধার করে আবার বিয়ের পিড়িতে বসিয়েছে হেলাল আকবর শাহ। মানসিক পীড়া উঠে গেছে ইতোমধ্যে তার মাঝে।
ইরাজ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ঘটনাস্থলে এলো, সন্ধ্যারও খানিক সময় পর। তার হাতে আঘাতের চিহ্ন, কপালের ডান পাশে খানিকটা জখম হয়ে আছে। চুল উশকো-খুশকো। শরীরে বরের পোষাক নেই, বরং সাধারন শার্ট-প্যান্ট পড়েই হাজির হয়েছে বর। ইমতিয়াজ খান এসব নিয়ে আর ব্যস্ত হলেন না। তার ছেলের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নিত্য ঘটনা এসব।
মেঘালয়া অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল ইরাজের পানে একবার। আবারও একবার আশায় বুক বাঁধল, হয়ত ইরাজ এবার সামনা-সামনি আব্বুকে বোঝাবে, বিয়েটা ভেঙে যাবে।
ইরাজ এসে নিরবে বসল কাজীর সামনের চেয়ারে। অতঃপর গাঢ় দৃষ্টি নিবন্ধ করল, হেলাল সাহেবের পানে। মানুষটা কেমন মিইয়ে গেছে, সম্মান হারানোর আতঙ্কে। ইরাজ শান্ত দৃষ্টিতে চোখ ফিরিয়ে কাজীর দিকে চেয়ে, ওনাকে কার্যক্রম শুরু করতে ইশারা করল। মেঘালয়ার বুকটা ছলকে ওঠে। ইরাজের অস্বীকৃতি, শেষ ভরসা ছিল। ইরাজ বাঁধা না দিয়ে চালিয়ে যেতে দিচ্ছে কেন!
_
অনেকদিন পর খান বাড়িতে প্রবেশ করল মেঘালয়া। তবে আগের দিনের মতো আজ আর হেলাল আকবর শাহ এর মেয়ে হয়ে নয়, খান বাড়ির বউ হয়ে। বুকটা থেকে-থেকে মুচরে উঠছে। আনতারা খানম সাদরে গ্রহন করে নিলেন ছেলের বউকে। বিয়ের সুবাদে ইমতিয়াজ খান এর বোন আশা খানম এবং তার ছেলে-মেয়েরা এসেছে। আনতারা খানমের বোনের বাড়ির লোকজনও এসেছে দুয়েকজন। এখানে আসতে আসতেই প্রায় রাত দশটা বেজে গেছে। তাই গ্রহন পর্ব দ্রুত শেষ করে মেঘালয়াকে রুমে পাঠানো হলো।
ভারী বুক নিয়ে ফুলহীন বাসরে প্রবেশ করল মেঘালয়া। এমনিতেও সজ্জার অভাব নেই ইরাজের রুমটিতে। অতিরিক্ত করে ফুলে সাজানো না হলেও খুব পরিপাটি আর অভিজাত লাগছে দেখতে কক্ষটি। সে-সবে সমীহ না করে ধীর পায়ে গিয়ে রুমের সোফার ওপর বসল মেঘালয়া। এখন আপাতত এ রুমে সে একাই। ইরাজের রুমটি আস্ত এক ফ্লাটের মতো দেখতে লাগছে। একটা রুমের মাঝেই একটা অদৃশ্য বিভাজনের মাধ্যমে দুটো ইউনিটের রূপ দেওয়া হয়েছে। যেটা দেখতে অনেকটা বেডরুমের পাশেই ডাইনিং অথবা লিভিং রুমের মতো লাগছে দেখতে। একাকিত্বের সুযোগে ভারী হয়ে থাকা শব্দহীন আত্মচিৎকার গুলো এবার অশ্রু হয়ে ঝরতে শুরু করল। জীবনে আবেগের বশে করা একটা ভুল আজ প্রিয় বাবার থেকে কত দুরে এনে ফেলেছে ওকে। আবার, যে মানুষটির সান্নিধ্যে পাঠানো হলো এ বাড়িতে, সে নিতান্তই অপছন্দের এক মানুষ।
প্রায় মাঝরাতে রুমে ফিরল ইরাজ। ততক্ষনে মেঘালয়া বিয়ের জন্য পরিহিত ভারী পোষাক খুলে সুতির একটি শাড়ি পড়েছে। যেটি বের করে দিয়ে গেছেন, আনতারা খানম। সান্তনাও দিয়েছেন, ইরাজ চলে আসবে। সকলেই জানে ইরাজ কেমন!
হালকা-পাতলা শরীরে হলুদ এবং লালের সংমিশ্রনে সজ্জিত শাড়িটিতে মেঘালয়াকে দেখতে নেহাত স্নিগ্ধ লাগছে। মাঝারী চুল গুলো হাতখোঁপা করা। ইরাজ রুমে প্রবেশ করে অবশ্য ভুলবসতও একবার মেঘালয়ার দিকে তাকায়নি। এবার দেখা গেল, আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলোতে তার ব্যান্ডেজ লাগানো। সে অবস্থাতেই ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল নিয়ে বেরোল ইরাজ। মেঘালয়া স্তম্ভিত বসে রয়েছে সোফাতে। ইরাজ সাদা রঙা এক টিশার্ট গায়ে চড়িয়ে আচমকা এসে বসল, মেঘালয়ার সম্মুখে থাকা কাউচের ওপর। মেঘালয়া চোখ তুলে তাকায় নি তবে। ইরাজ নিজেও কিছু সময় চুপ থেকে বেজায় ভারী স্বরে বলল,
‘এতটা ত্যাগ স্বীকার করার মতো ছেলে আমি না, এ সকলেই জানে। অথচ তোর বাপের মন রক্ষার্থে আজ তোকে নিজের পরিচয়ে ঘরে তুলতে হলো। প্রেমিক নিয়ে পালিয়েছিস তুই, সে কর্ম ফলাফলের ভাগ আমার সঙ্গে বেটে নেওয়ার কোন যুক্তি আছে তোর কাছে?’
মেঘালয়ার চোখে জমে থাকা অশ্রুকনাগুলো এবার ঝরঝর করে ঝরে পড়ল গাল বেয়ে। তা দেখে বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করে ফেলে ইরাজ। এক পর্যায়ে ধমকে উঠল,
‘স্টপ অল দিস, ননসেন্স। আমার সামনে ন্যাকামি করবি না অন্তত। প্রেমিক নিয়ে পালানো মেয়ে, নাজুক অথবা অবুঝ হয় না, আর না ছিচকাদুনেপনা মানায় তাদের। সে জ্ঞান থাকলে, সব জ্ঞান আছে।’
মেঘালয়া যথাসম্ভব নিজেকে সামলে বলল, ‘ আপনি আজ চাইলে বিয়ে ভাঙতে পারতেন। তা করেন নি কেন?’
ইরাজ তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘তোর বাপে তাইলে এতক্ষনে আমাদের টাটা-বাই করে ওপরে টপকে যেত। দেখেছিলি তখন তোর বাপের শুকনো মুখখানা? সম্মানের তো ভরাডুবি হয়েছে তোর জন্য। অথচ আমি তো আর তোর মত নির্বোধ না, সম্মান বাঁচিয়ে যা হয় তাই করেছি।’
মেঘালয়া ঠোঁট চেপে ধরে নিচের দিকে চেয়ে রইল। ধীর-স্থির কম্পমান কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে আমিও আব্বুর মুখের দিকে চেয়েই বিয়ে করেছি, আপনি আমায় কথা শোনাবেন না।’
পূর্নদৃষ্টি মেলে তাকাল এবার ইরাজ মেঘালয়ার দিকে। খানিক সময় পরখ করে দেখে, তিরস্কারের স্বরে বলল,
‘বুঝের কথা বলতে শিখেছিস? অন্যের সাথে পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে কবুল করেছি আজ। জীবনে, কারও হাতে কর্ক খোলা ড্রিংকের বোতলে চুমুক লাগাই নি। শালা, বউ বিয়ে করলাম কিনা অন্যের আমানত!’
মেঘালয়া গম্ভীর মুখে তাকায় ইরাজের দিকে। ইরাজও তাকাল, মেঘালয়াকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করল। ক্ষ্যাপা স্বরে ধমকে উঠল, ‘ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তাকাবি না আমার দিকে, খবরদার। তোর নজর পড়লে এ জীবনে না জানি আর কত বড়ো-বড়ো ক্ষতিপূরন দিতে হবে। নজর সামলে এ বাড়িতে থাকবি।’
মেঘালয়া এমন কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে? তবে ওর ধারনা, এখন চুপ থাকা শ্রেয়। খুব ভালো বুঝতে পারছে, ইরাজ কোন এক ঝামেলা বাঁধানোর ছুতো খুঁজছে। ইরাজ এবার তাকাল মেঘালয়ার দিকে। এক ভ্রু উঁচিয়ে পরখ করে দেখল ওকে। মেঘালয়া হাসফাস শুরু করেছে। অভদ্রর মতো চেয়ে আছে ইরাজ। কিছুক্ষন ওভাবে দেখে, চোখ ছোট-ছোট করে ফেলল। মুখটা ফিরিয়ে ভারী কণ্ঠে বলল,
‘কোন এক অযুহাতে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকবি। তোকে আমার চোখের সামনে সহ্য হচ্ছে না, মেঘ। কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসি, তার আগে এ বাড়ি থেকে কাল্টি খা।’
মেঘালয়া বুঝল, ইরাজ ক্ষেপে যাচ্ছে। এখন কোন তামাশা করার ইচ্ছে হলো না। মনটা নিজেরও খুব বিপর্যস্ত হয়ে আছে। প্রসঙ্গ বদলাতে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,
‘শরীরে এত জায়গায় আঘাত পেয়েছেন কি করে?’
‘সে যেভাবেই পাই, তোর খুব আনন্দ হচ্ছে, না?
‘হুম, তা তো একটু হচ্ছেই।’ মুখ ফসকে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে মেঘালয়া। বুঝতে পেরে, দ্রুত হাত দ্বারা মুখ চেপে ধরল, ঘাঁড় নাড়ল দুপাশে। অতঃপর মুখে বলল,
‘উহু। খুব কষ্ট হচ্ছে দেখে। ভালো কেন লাগবে? আপনার মতো ক্যাকটাস তো আর না আমি, যে কারও কষ্ট দেখে খুশি লাগবে।’
আবারও ভুল কথা। এবার হয়ত আর রক্ষা নেই মেঘালয়ার। ইরাজ হাত চাপে ধরল মেঘালয়ার। মুচরে ধরল সজোরে। মাড়ি পিষে বলল,
‘একদম ঠিক ধরেছিস। ক্যাকটাস না আমি? দুরে থাকবি আমার থেকে। কাঁটা ফুটে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার ভয় আছে। আর তুই আমার সঙ্গে ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করবি না, এমনকি কথা বলতে আসবি না।’ শেষের কথাটা কেমন অদ্ভুত শোনাল ইরাজের কণ্ঠে।
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাঁড়ে ঝোলানো তোয়ালেটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে, ল্যাম্পটেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার হাতে নিয়ে, রুমের সাথের লাগোয়া প্রকান্ড বেলকনির দিকে পা বাড়াল।
মেঘালয়া সেদিকে আর না তাকিয়ে চোখদুটো বুঁজে নিলো চেপে। হাতের যে স্থানে ইরাজ চেপে ধরেছিল, জ্বলে যাচ্ছে খুব। বুক চিড়ে এক বিক্ষিপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মাথাটা ঝুঁকিয়ে ওভাবেই অনেকক্ষন বসে রইল। মিলছে না যে, এই গড়মিল হয়ে থাকা জটিল জীবনের ধারাবাহিকতার হিসেব! অনেকক্ষন পর, আস্তে করে উঠে গিয়ে রুমে রেখে যাওয়া খাবারের একাংশ খেতে বসে গেল।
ইরাজ সেই কখন থেকে একটা করে বের করছে। আর সমানতালে ধোঁয়া গিলে যাচ্ছে। আজ এই করতে করতেই এক নির্ঘুম রাত কাটবে বোধহয়। কাটা স্থানগুলোতে রাত বাড়ার সাথে সাথে টান ধরেছে। ব্যথা অনুভব হচ্ছে। অথচ শরীরের সে-সব ব্যথাকে পেছনে ফেলে, বুকের মাঝে জড়িয়ে আসা চিনচিনে অনুভূতি বেশি কঠিন হয়ে উঠছে কেন! প্যাকেটের শেষ সিগারেটটিও লাইটারের আগুনের সংস্পর্শে ধঁরল। জ্বলে উঠে, আবার নিভে যায় তা। তা মনোযোগ সহকারে দেখল ইরাজ। লাইটারের আগুনটুকু দু আঙ্গুলে চেপে পিষে নেভাল। আঙুলের স্থানটিও জ্বলে উঠল একটু। তাতে কি যায়-আসে? ব্যাথা যে অন্য কোথাও। এ ব্যাথার চেয়েও অধিক পীড়াদায়ক যেন!
_
ফজরের আজান শোনা গেল। মেঘালয়া দ্রুত চোখ মুছে নেয়। একটা ভুলে কত অবহেলার পাত্রী হয়ে উঠেছে সে। ইরাজও বোধহয় এবার ধোঁয়াকে বিদায় জানিয়ে, রুমের সান্নিধ্যে ফিরল। মেঘালয়া বিছানার একপাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিল। ইরাজ এসে বিছানার কাছে দাঁড়াতেই, উঠে বসল। শড়িটা ঠিক করে নিয়ে দ্রুত উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। ইরাজের সেসবে বিশেষ যায় আসল বলে মনে হলো না। সে ফাঁকা বিছানা পেয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরে ব্যথা হওয়ার সাথে সাথে পুরো রাত না ঘুমানোর কারনে মাথা খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে।
মেঘালয়া অযু করে এসে ফজরের নামায আদায় করে, বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। আজ না-হয় সূর্যাদয় দেখবে। বেলকনিতে সোফা রাখা আছে কয়েকটি। সেখানে বসে পড়ল। ওভাবে কিছুক্ষন থাকতে থাকতে চোখ লেগে যায়, ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল এই অসময়ে।
চলবে..