#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
৩.
রাত গভীর। হাসপাতালের দেয়ালগুলো সহ নিস্তব্ধতায় গুম। মেঘালয়ার মনটাও সাথে গুমোট হয়ে উঠল, এই রাতে নিস্তব্ধতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ইরাজ বসে আছে, তবে বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা বলছে না। মুখটা অতিরিক্ত গম্ভীর করে মাথাটা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। মেঘালয়া একবার তাকাল সেদিকে, তৎক্ষনাৎ আবার চোখ ঘুরিয়ে নিলো।
মেঘালয়ার বুকটা ভারী অনুভূত হলো। কি এমন করেছিল! তাবিরকে ভালো লাগত। তাবিরই বলেছিল, ওর সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার কথা। আব্বুকে বললে কখনোই মানত না, বিধায় পালিয়ে গিয়েছিল। তবুও প্রথমদিকে যেতে চায়নি। কিন্ত ভালোবাসার প্রমান দিতে, যেতে হলো শেষমেষ। চট্রগ্রাম পৌঁছে কিছু স ন্ত্রা সের হাতে পড়েছিল ওরা। তখন সেই দু র্বৃ ত্তগুলো শর্ত আরোপ করল, মেয়েটিকে ওদের হাতে তুলে দিলে, তাবিরের জান ভিক্ষা দেবে। মেঘালয়ার দৃঢ় বিশ্বাস, তাবির কখনোই এ শর্তে রাজি হবে না। বিশ্বাস মোতাবেক সর্বদা বাস্তবতার ধারা প্রবাহিত হয় না। তাই-তো তাবির মেঘালয়াকে ওখানেই জিম্মি রেখে নিজের জান বাঁচিয়ে পালিয়ে গেল। মেঘালয়া আজ নিজেও মানে, ও আসলেই মূর্খ এবং নির্বোধ। আব্বু তো ভুল কিছু বলেনি!
আচমকা ইরাজের রাশভারী কণ্ঠস্বরে মেঘালয়ার ভাবনার সুঁতো ছিঁড়ল, ‘ওঠ, উঠে বস।’
মেঘালয়া কথাটা ঠিক বুঝতে না পেরে, চেয়ে রইল ইরাজের দিকে। ইরাজ এবার ঝাঁঝাল স্বরে ধমকে ওঠে, ‘কানে শুনিস না? নাকি ধরাম করে এক থাপ্পড় লাগিয়ে কানটা ক্লিয়ার করতে হবে? আই সেইড, সিট আপ। ড্যাম!’
মেঘালয়া কোনরকমে উঠে বসল। আবার শুয়ে পড়ল। ইরাজ আবারও সেই ভারী স্বরেই বলল, ‘যা। তোর বাপ বাইরেই বসে আছে। গিয়ে বল, তুই আমাকে বিয়ে করতে চাস না। নয়ত আমি তোকে খু ন করে রেখে যাব এখানে।’
মেঘালয়া ভ্রু কুঞ্চিত করে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল ইরাজের ক্রোধান্বিত মুখের দিকে। অতঃপর তাচ্ছিল্য করে বলে উঠল, ‘প্রয়োজন পড়লে বি ষ খেয়ে নেব। এমনকি আপনি লাগেনই আমার কাছে এত বিষাক্ত। আপনার কেন মনে হয়, আপনাকে বিয়ে করার জন্য আমি ব্রত পালন করছি?’
‘তবে চুপ করে আমার চেহারা গিলছিস কেন গিরগিটির মতো? এতে যে, তোর নিরবতা সম্মতির লক্ষন হিসেবে ধরে, তোর বাপ বিয়ের তোড়-জোড় শুরু করে দিয়েছে!’
ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিলো মেঘালয়া, ‘আপনি তো সর্ব-মহান মনে করেন নিজেকে। আর বেশ দাপটে চলেন। এই শুভ কাজটাও না-হয় আপনার দ্বারাই সম্পন্ন হোক!’
ইরাজ উঠে দাঁড়াল। মেঘালয়ার একহাত ধরে টান দিয়ে উঠিয়ে বসাল। মেঘালয়া মৃদূ আর্তনাদ করে ওঠে। ওর মনে হলো, হাতটা যেন আলাদা হয়ে গেছে কনুই থেকে। ইরাজ নিজেই ঝাড়া মেরে ছেড়ে দিলো হাতটা। অতঃপর চিবিয়ে বলল, ‘তুই আমায় পরামর্শ দিবি না। বরং আমি যা বলব, শুনতে হবে তোকে।’
মেঘালয়া তেজী কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘আমি আপনার বাধ্য নই, আর না ভয় পাই আপনাকে। সুতরাং, আপনি আদেশ করবেন না আমায়।’
ইরাজ এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় মেঘালয়ার দিকে। সন্তর্পণে নিজের ক্রোধটুকু এ পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করে গিলে নিলো। চোখে-মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে মেঘালয়ার দিকে ঝুঁকে দাঁড়াল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীর-স্থির কণ্ঠে জানাল, ‘জোর যার, মুল্লুক তার’ শুনিস নি? আর এই সূত্র অনুযায়ী, তোকে আমার কথা শুনতে হবে। নয়ত তুই জানিস, আমি একদম ভালো মানুষ নই।’
মেঘালয়া চোয়াল শক্ত করে চোখ বুঁজে নিলো। ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে-মনে ঠিক করে ফেলল, জীবনে আর যাই-হোক এমন কোন লোকের সঙ্গে এক সূত্রে বেঁধে যাওয়াটা নিতান্তই গজব ছাড়া আর কিছু নয়। আর এতবড়ো গজবে সে নিজেকে কোনক্রমেই পতিত করবে না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইল বেডের ওপর। কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
‘আপনি বললে, ইমতিয়াজ বাবা না করবেন না। আপনিই বললেন— জোর যার, মুল্লুক তার। এ ব্যাপারে নিজের জোরটুকু খাঁটিয়ে আমাকে রেহাই দিন, আর নিজের জোরের প্রমানও।’
ইরাজ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে, দু-ঠোঁটের ভাজে চেপে ধরে, অপর হাত দ্বারা পকেট হাতরে লাইটার বের করল। মেঘালয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আমার বাপ, হেলাল আঙ্কেলকে না করলে, উনার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। আঙ্কেল যেকোন উপায়ে তোকে আমার গলায় ঝোলাতে চায়। তুই নিজে বিয়েতে অস্বীকৃতি জানা, কোন কাজ হলেও হতে পারে।’
মেঘালয়া অনুযোগের সুরে টেনে-টেনে বলল, ‘আপনার আসলেই মনে হয়, আমি আব্বুকে অস্বীকৃতি জানাই নি? সে আজকাল আমার কোন কথাই শুনছে না।’
ইরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ফেলল। ওভাবেই বলল,
‘তোর বাপ তোর কথা আরও শুনবে বলে, তোর মনে হয়? সম্মানের তো ফ্রাইড-রাইস বানিয়ে খেয়ে ফেলেছিস তার। সে-সব আমার দেখার বিষয় না। আজ সোমবার পেরিয়ে গেল। কাল সারাদিন মঙ্গলবার। শুক্রবার, ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হয়েছে বিয়ের। যা করবি, কাল এখান থেকে রিলিজ পাওয়ার পর শুরু করে দে। নয়ত আমার হাতে পড়লে, তুই জানে বাঁচবি না, মেঘ।’
বলেই লাইটারের আগুনে সিগারেট জ্বালায় ইরাজ। লম্বা এক শ্বাস টেনে নিয়ে, গায়ে থাকা জ্যাকেটটা টেনে-টুনে ঠিক করে নিলো। অতঃপর মেঘালয়ার দিকে এগিয়ে এসে মুখে ভেতরে থাকা সবটুকু ধোঁয়া ওর নাকে-মুখে ছাড়ল। মেঘালয়া দম আটকে, সিগারেটের বাজে গন্ধে কেশে ওঠে। তা দেখে ইরাজের ঠোঁটে বিজয়ের হাসি পরিলক্ষিত হয়। চোখ-মুখে দারুন এক দুষ্টু প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে রাতের শেষ প্রহরে বের হয়ে আসল মেঘালয়ার কেবিন থেকে। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখল, কোথাও হেলাল সাহেব আছেন নাকি। দেখল, আপাতত নেই। হতে পারে ওয়াশরুমে অথবা কোথাও হাঁটতে গিয়েছেন। কতক্ষন বসে থাকা যায়। সামনে যত যাই বলুক না! মেয়েকে হাসপাতালে রেখে বাড়িতে থাকা সম্ভব হয়নি। অথচ মেঘালয়া জানতই না, তিনি হাসপাতালেই বসে আছেন।
_
ইরাজ ও মেঘালয়ার সম্বন্ধের ব্যাপারটি আনতারা খানম সহজভাবেই নিয়েছেন। তারা স্বামী-স্ত্রী আসলেই আগে থেকে চাইতেন, মেঘালয়াকে ইরাজের বউ করে আনতে। ব্যাবসা একই। হেলাল আকবর সাহেবের আর কোন সন্তান সন্ততি তো নেই। সবটা মেঘালয়ারই। তাছাড়া, এতো পুরাতন বন্ধুত্ব। সবদিকে বিবেচনা করে, এ সম্পর্কটি দু পরিবারের বন্ধন আরও মজবুত করবে বলেই ধারনা সকলের। আর তো মাত্র, দিন তিনেক আছে মাঝখানে। আনতারা খানম আজ চাইলেন, মেঘালয়াকে বাড়ি গিয়ে একবার দেখে আসতে। যদি মেয়েটি তেমন সুস্থ থাকে, তবে আজই টুকটাক বিয়ের বাজারও করে ফেলতেন সঙ্গে করে।
আনতারা খানম একদম তৈরী হয়েই নিচে নামলেন। ইরাজ নিজের রুমে মরার মতো পড়ে ঘুমাচ্ছে। গতকাল শেষ রাতে বাড়ি ফিরেছে। তিনি বের হতেই যাবেন, সে-সময় বাড়িতে প্রবেশ করলেন, ইমতিয়াজ খান সাহেব। হন্তদন্ত জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় বের হলে এখন আবার?’
আনতারা খানম মৃদূ হেসে বললেন, ‘বউমাকে দেখে আসি। বুঝলে রাজের বাবা! মেঘা ভালো মেয়ে। সে এলে তোমার ছন্নছাঁড়া মারকুটে ছেলের যদি একটু-আধটু হুশ হয়।’
ইমতিয়াজ সাহেব আঁতকে উঠলেন স্ত্রীর কথায় ।আশপাশের লোকের মুখে মুখে মেঘালয়ার কথা। আনতারা গেলে, কারও না কারও মুখে শুনে ফেলতেই পারে কথাটি। আর তাতে, মেঘালয়াকে বাড়ির বউ করে আনতে আজীবনেও রাজী হবে না আনতারা। হেলাল তা কখনোই সহ্য করতে পারবে না। তিনি জানেন, মেঘালয়া ঠিক কতবড়ো বোঝা হয়ে আছে হেলালের কাঁধে।
তিনি কথা কাটানোর উদ্দেশ্যে, বেশ ক্লান্তি ভাব নিয়ে বললেন, ‘সবে বাড়ি ফিরলাম, না জানি একটু সেবাযত্ন করবে। এখন ছুটছো? প্রয়োজন পড়লে আমি গিয়ে নিয়ে আসব মেঘাকে। বাজার সেড়ে নেবে। এখন আমাকে খেতে দাও।’
আনতারা খানম মনঃক্ষুন্ন হলেও, তা প্রকাশ করলেন না। নেহাত গৃহিনী মেয়েলোক, স্বামীর কথা ফেলতে তো পারবেন না। মুখ ভার করে বললেন, ‘তবে আজই কিন্ত যাব একবার মার্কেটে। খেয়ে নাও, আমায় দিয়ে আসবে হেলাল ভাইজানের বাড়ি।’
‘সেই ওই একই কথা? বললাম না যেতে হবে না ওখানে! আমি নিয়ে আসব মেঘাকে।’ আচমকা অজ্ঞাত কারনে ক্ষেপে উঠলেন ইমতিয়াজ খান। যার কারন বুঝতে না পেরে আনতারা খানম হতভম্বের ন্যায় চেয়ে রইলেন স্বামীর দিকে।
ইমতিয়াজ খান স্ত্রীর মনোভাব বুঝে, সাফাই গাওয়ার সুরে বললেন, কুটুম বাড়ি বেশি-বেশি যেতে নেই। আদর কমে যায়। খেতে দাও এখন।’
আনতারা খানম এটা বুঝলেন না, বেশি-বেশি কবে গেল ও বাড়িতে। কম করে হলেও ছয়মাস আগে গিয়েছিল, মেঘালয়ার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। তবুও স্বামীর ওপর অভিমানে কিছুই বললেন না আর। চুপচাপ নিজের কাজ করে গেলেন।
_
নিজের রুমে শুয়ে একটা ব্যাপারই ভেবে কুল হারাচ্ছে মেঘালয়া, কি করে বিয়ে বন্ধ করবে! ইরাজের বলা কথাগুলো মনে পড়লেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। বহুক্ষন অস্থির চিত্তে রুমের মাঝেই পায়চারী করে, শেষ অবধি আব্বুর রুমের দিকে পা বাড়াল এবার। আজ না বলতে পারলে, সর্বনাশ যা হওয়ার খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। ইমতিয়াজ খানের কল এসেছিল, আধঘন্টার মধ্যে তিনি স্বয়ং নিতে আসবেন মেঘালয়াকে।
দ্বিধা-সংকোচে পা জড়িয়ে আসছে। কি করে বলবে আবারও কথাটা আব্বুকে জানা নেই। আব্বুর প্রতিক্রিয়াই বা কেমন হবে দ্বিতীয়বার এ-কথা শুনে— তা ভাবলেও পা থেমে আসছে। তবুও কোনমতো গিয়ে দাঁড়াল আব্বুর রুমের সম্মুখে। জড়তাটুকু গিলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। হেলাল আকবর সাহেব ল্যাপটপে কোন কাজে ব্যস্ত। মেঘালয়া মাথা নত করে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কেবল। সেকেন্ড কয়েক মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না। কিছু বলতেই যাবে, তখনই ভারী স্বরে হেলাল সাহেব বলে উঠলেন,
‘তুমি যা বলতে এসেছ, তা না আমি মানব, আর না এমন কথা শুনতে পর্যন্ত চাই। এই তিনদিনে আর একবারও যদি এমন কোন কথা নিয়ে আমার কাছে এসেছ, বিশ্বাস করো মেঘ, যা আমি এই কয়েকদিনে এখনও অবধি করিনি তা করতে দ্বিধা করব না। তোমাকে ত্যাগ না করে বসি আমি আর কোন অবাধ্যতা দেখলে। কথাটা খেয়ালে রেখে তুমি যেকোন কিছু করতে পারো।’
এরপর আর বলার মতো থাকে কি কিছু? মেঘালয়ার পা জোড়া আটকে গেল আড়ষ্টতায়। কেবল ছলছল চোখে প্রিয়তম আব্বুর কঠোর মুখশ্রীর দিকে চেয়ে রইল। এই আব্বুর অতি প্রশ্রয় ওকে বিগড়েছে জীবনে। তাই-তো এত বড়ো একটা কাজ করে ফেলতে খুব বেশি ভাবতে হয় নি। আব্বুর এমন কঠোর রূপ দেখা হয়েছিল না আগে। ও ভাবেও নি সম্মানহানীর দায়ে হেলাল আকবর শাহ এতটা শক্ত হয়ে উঠবেন। আবারও সেই রাশভারী কণ্ঠস্বর শুনতে পেল মেঘালয়া,
‘নিজের রুমে যাও, তৈরী হয়ে নাও। ইমতিয়াজ চলে আসবে।’
নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো মেঘালয়া। এবার আর মন মানছে না। ইরাজকে বিয়ে করার চেয়ে হয়ত নরক-বাস উত্তম। অথচ শেষ অবধি কি ওকে তাই-ই করতে হবে? আর ভাবতে পারল না সে। দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে মেঝেতে আহাজারী করতে লুটিয়ে পড়ল।
চলবে..