অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-২৬+২৭

0
1038

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৬.

বিয়েতে যেহেতু কিছু করা হয়নি, অতএব হেলাল সাহেব চেয়েছিলেন, মেঘালয়ার গর্ভবস্থায় আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে খাওয়াবেন সঙ্গে দোয়াও নেওয়া হবে মেঘালয়ার জন্য। ইরাজ অমত করেছে এতে। সে আপাতত কোনরকম ঝামেলা চায়না। সবকিছু সুষ্ঠভাবে মিটে গেলে বহুত অনুষ্ঠান করা যাবে; এটাই তার মতামত এবং সিদ্ধান্ত।

হেলাল সাহেব রোজই এসে মেয়েকে দেখে যান। তার পায়ে সুতো নেই। আজও এসেছিলেন, ঘন্টাখানেকের মতো মেঘালয়ার সঙ্গে কাটিয়ে চলে গেলেন নিজের কাজের ব্যস্ততায়। তার পর-পরই হঠাৎ-ই মেঘালয়া উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। কোনকিছুতেই শান্তি লাগছে না। আশেপাশের সবকিছু অসহ্য লাগছে। পাঁচ-মাস চলছে তার গর্ভাবস্থার। খুব বেশি না হলেও পেট বুঝা যায় এখন তার। পায়ের ফোলা কমছে না। ওভাবেই মনমরা হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। খানিকবাদে হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকল ইরাজ।

মেঘালয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দ্রুত কপাল, গলায় হাত রাখল। এলোমেলো চোখে দেখে নিল মেঘালয়াকে। ব্যস্ত হাতে বিছানার ওপর থেকে ওড়নাটা তুলে মেঘালয়ার গায়ে জড়িয়ে দেয় ভালোভাবে। মাথায় ওড়না তুলে দিয়ে, ওড়না ভেদ করে আসা এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে ওড়নার ভেতরে রেখে আবারও ওড়নাটা ভালোভাবে টেনে দিল। শান্ত নজরে তাকাল একবার মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়ার মুখটা ভার। এটা অবশ্য আজকাল সবসময়ের পরিচিত দৃশ্য। ইরাজকে কেন জানি সহ্য করতে পারে না মেঘালয়া। কেন তা অবশ্য জানে না ঠিকঠাক, ইরাজ! সর্বক্ষণ ওমন মুখটা ভার করেই থাকে মেঘালয়া। বিশেষ করে ইরাজ কাছে আসলে। মেঘালয়ার ভারী মুখটা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচে তাকাল ইরাজ। বলল, “ডাক্তার এসেছে, প্রেশার চেইক করবে।ʼʼ

বেরিয়ে গেল কথাটা বলেই। মেঘালয়া এবার তাকায় ইরাজের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার মাথা নত করে বসল। ইরাজ যা-ই করে, সবটাই তার সন্তানের জন্য নিশ্চয়ই! এটা বোঝে মেঘালয়া। ইরাজের এত চিন্তা, ছটফটানি সবটাই নিজের সন্তানকে কেন্দ্র করে!

ডাক্তার বলতে, বড়ো কোন বিশেষ ডিগ্রিধারী ডাক্তার নয়। প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান সম্পন্ন ডাক্তারকে এনেছে ইরাজ, প্রেশার চেইক করার জন্য। মেঘালয়া ভ্রু কুঞ্চন করল, তার তো প্রেশার নেই! ডাক্তার তার হাতের কব্জির কাছে মৃদূ চেপে ধরে প্রথমে পালস-রেট অনুমান করল। পরে প্রেশার মেপে স্ফিগমেনোমিটার নামিয়ে, স্টেথোস্কোপ লাগাল মেঘালয়ার বুকের ওপরে। সেটাও নামিয়ে নীরবে বের হয়ে গেল রুম থেকে। পেছনে যায় ইরাজ। মেঘালয়া চেয়ে রইল সেদিকে।

কিছুক্ষণ বাদে ইরাজ রুমে আসে। বিক্ষিপ্ত লাগছে দেখতে। মেঘালয়া সে-সবে তোয়াক্কা না করে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “কী হয়েছে? ব্লা ড-প্রশার হাই? কী লুকোচ্ছেন?ʼʼ

“কি লুকোবো? চল ডাক্তারের কাছে যাব।ʼʼ

“আমার কী হয়েছে, সেটা আমি শুনব না?ʼʼ

ইরাজ অজ্ঞাত কারনেই জ্বলে উঠল যেন ধপ করে। হাতে থাকা ফোনটা সজোরে ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। মাথার দু-পাশের চুল টেনে ধরল। জোরে জোরে শ্বাস নিল কিছুক্ষণ। মেঘালয়া বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে রয় নাম না জানা কারনে হুটহাট উত্তেজিত হয়ে পড়া ইরাজের দিকে। কী থেকে কী হয়— আজকাল দুজনেই বড্ড উত্তেজিত থাকে সবসময়। তবে ইরাজ যে ছটফটানির মাঝে আছে, এটা চোখে গাঁথার মতো। কিছুটা সময় নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে সোফায় বসল ইরাজ। শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে গা আওলে বসে পরিশ্রান্ত শ্বাস ফেলল কয়েকটা। আগুন নিভে যাওয়ার পর যেমন বাতাসের দমকায় মৃদূ প্রজ্জ্বলিত-নিভু আকারে তাপ ছড়ায়, ইরাজের গলাটা তেমন নিভু আগুনের মতো শান্ত-অটল শুনাল, “চল বের হই।ʼʼ


মৃদূমন্দ এসির হাওয়ার মাঝেও ইরাজকে দেখতে অশান্ত, পরিশ্রান্ত লাগছে। মুখটা শুকনো, চোখে-মুখে কাতরতা। মাথাটা হালকা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। তাকে কিছুক্ষণ পরখ করে দেখলেন ড. শারমিন আরা। দুষ্টু, ছন্নছাড়া, বেপরোয়া এই ছেলেটা কেমন দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন স্বামী ও অনাগত সন্তানের উদ্বিগ্ন বাবা হয়ে উঠেছে! পুরুষ বোধহয় এমনই! যারা একসময় সবকিছুর বাঁধন ছেড়ে, প্রাবহমান স্রোতের মতন তাণ্ডব ছড়িয়ে বেড়ায়, তো সেই পুরুষই সময়ের ব্যবধানে হয়ে ওঠে এক নারীর অবলম্বন, সবটুকু ভরসার জায়গা, কচি হাতগুলোর বেড়ে ওঠার কারিগর। থেমে যায় পুরুষ, রাস্তা বদলে ভিন্ন ধরণে পথ চলতে শুরু করে আপনচিত্তেই।

কিছুক্ষণ ওভাবেই বিবর্ণ ইরাজকে অবলোকন করে, শান্ত স্বরে বললেন, “তুমি এভাবে ডিস্ট্র্যাক্ট হয়ে পড়লে চলবে কী! যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে, সেটার কারন হবে— তোমার এই মনোবলের অভাব, রাজ!ʼʼ

ইরাজ অসভ্যের মতো বলে ওঠে, “আপনি এতদিনে কী এমন করেছেন, ম্যাম! যাতে আমি মনোবল পাব বা শান্ত, নিশ্চিন্ত থাকব? দিন-দিন কনডিশন খারাপ হচ্ছে। তার ওপর নাকি কোন ওষুধ দেওয়া যাবে না। কী করছেন, কী করতে চাইছেন আপনি? যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায় না? কী এমন হয়েছে, পরিকল্পনা কী আপনার?ʼʼ

কথাগুলো বলেই উত্তেজিত শ্বাস ফেলল ইরাজ। ঘাঁড় ঝাঁকাল কয়েকবার। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। শারমিন আরা বললেন, “মূর্খের মতো কথা বলছো তুমি। উত্তেজনা কখনও কোন সমস্যার সমাধান নয়, শিক্ষিত ছেলে তুমি। অথচ এ অবস্থায় নিজের বিচক্ষনতা হারিয়ে বসেছ। এখন সবচেয়ে জরুরী তোমার নিজেকে সামাল দেওয়া। কী করতে বলছ তুমি আমায়, বলো?ʼʼ

ইরাজ করুণ চোখে তাকায়। হঠাৎ-ই ঠান্ডা জলের মতো অভিব্যাক্তিতে প্রায় অনুরোধ করে বলে ওঠে, “ম্যাম! কোনভাবে ওষুধ খাইয়ে বা অন্য কোন উপায় নেই ব্লা ড- প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখার? ম্যাম, আমার বাচ্চা..

“রিল্যাক্স রাজ! শোনো আমার কথা। তুমি যতটা সহজভাবে ভাবছ, তা কেবলই উত্তেজনার বশে। সেভাবে আমি ভাবতে পারি না। আমাকে ছোট্ট একটা সিদ্ধান্ত নিতেও বহুদিক বিবেচনা করতে হবে। গর্ভাবস্থায় সব-ধরণের প্রেশার কন্ট্রোল মেডিসিন সেবন করার নয়। এতে বরং হিতে বিপরীত হবে। যে আশঙ্কা আমি করছি, তা আরও নিশ্চিত হবে। আমি আমার মতো যথাসাধ্য চেষ্টা করব। মেঘালয়ার এই কন্ডিশনটাকে বলা হয়— জেসটেশনাল হাইপারটেনশন। এই ঘটনা ঘটে— পরিবারে কারও এমনটা থাকলে বা পঁচিশ বছরের কম বয়সে গর্ভধারণে এমন হয়ে থাকে। আর তাছাড়া প্রথম গর্ভধারণে ব্লা ড-প্রেশারে গড়মিল প্রায় নারীরই দেখা যায়। তবে ঝুঁকি কমানো যায়, রাজ! বি পজেটিভ।ʼʼ

ইরাজ ব্যাকুল হয়ে উঠল, “সকলেই তো সন্তান জন্ম দিচ্ছে। তাহলে মেঘেরই কেন এমন হচ্ছে, ম্যাম!ʼʼ

শারমিন আরা মৃদূ হাসলেন। পূর্নদৃষ্টি মেলে তাকালেন আকুল হয়ে চেয়ে থাকা ইরাজের দিকে। ইরাজকে সে আগেও বহুবার দেখেছে। পূর্ব-পরিচিত ইরাজ ছিল বেপরোয়া,দাম্ভিক, আর বাঁকানো হাড়ে তৈরী। অথচ এই ইরাজকে তার সাথে কিছুদিন মেলাতে পারেন না তিনি। অশান্ত ইরাজকে আশ্বস্ত করতে শান্ত স্বরে বললেন, “রাজ! তোমার ক্ষিপ্রতা জায়েজ! বাবা তো তুমি! কিন্ত কী বলো তো! সবকিছুর ওপরে লাঠি ঘুরছে সৃষ্টিকর্তার— এটা অস্বীকার করতে পারবে? আমি ডাক্তার; মানছি, তবে তিনি যদি আমার চিকিৎসায় শেফা না দেন তবে আমি কী করে তকদিরে পরিবর্তন আনতে পারি? তুমি তো অবুঝ নও, রাজ! আল্লাহর ফয়সালা এবং আমার চেষ্টা; হতে পারে ভালো কিছুই হলো। ভরসা রাখো।ʼʼ


সম্প্রতি শরীরের অবনতি চোখে পড়ার মতো মেঘালয়ার। পা আরও ফুলে উঠেছে, সঙ্গে মাথা ব্যথার তীব্রতা সময়ের সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যেন! রাত এগারোটার মতো। ইরাজ মেঘালয়াকে খাইয়ে নিজে খেতে বসেছে।মেঘালয়ার পা মেলে দিয়ে বসা বিছানার ওপরে। ইরাজ খেতে খেতে হঠাৎ-ই জিজ্ঞেস করল, “মেঘ! ঘুরতে যাবি?ʼʼ

এমন একটা সময় মেঘালয়া এ কথা শুনে অবাক হলো। এটা অবশ্য ইরাজের পুরোনো অভ্যাস— রাত করে রাস্তায় বিনা গন্তব্যে হাঁটতে বেরোনো। আগেও হল থেকে বাড়ি ফিরলে রাতে এভাবে হাঁটতে হাঁটতে কখনও কখনও মেঘালয়াদের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতো। হাতে থাকত মেঘালয়ার পছন্দের কোন খাবার অথবা মেয়েদের কিছু ব্যবহার্য সামগ্রী। হেলাল সাহবে খুব খুশি হতেন অবশ্য ইরাজের এমন অদ্ভুত সময়ে অদ্ভুত আগমনে। সকলেরই জানা, স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ইরাজ কমই করে। তাই তার এমন রাতবিরাত মেহমান হয়ে আগমন স্বাভাবিক এবং সারপ্রাইজিং বটে। আহ্লাদি মেঘালয়া ইরাজের সঙ্গে ঘুরতে যেতে বায়না করত। তবে আব্বুর কাছে, ইরাজের কাছে বলার সাহস ছিল না মোটেই। হেলাল সাহেব বললেও ইরাজ নিয়ে যেত না। কখনও কখনও মেঘালয়াকে ধমকে জিজ্ঞেস করত, “কেন এ-সময় ঘুরতে যেতে হবে? কিছু লাগলে বল, এনে দিয়ে যাচ্ছি।ʼʼ

আবার কখনও কখনও ধমকাতে ধমকাতে নিয়ে গিয়ে ফুসকা, চটপটি কিছু কিনে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিত। নিজের সঙ্গে মেঘালয়াকে কখনোই ইরাজ একাকী রাখতে চায়নি। এমনটা কেন, তা জানে না কেউ-ই। জানে ওই ত্যাড়া ইরাজ। সে যেখানে মেঘালয়াকে সকল বিপদ ও অনিষ্টর হাত থেকে জোরপূর্বক হলেও বাঁচিয়ে রেখেছে, সেখানে ইরাজও তো মেঘালয়ার প্রেমে পড়েছিল, হতে পারত— ইরাজই মেঘালয়ার জন্য অপ্রস্তুত-বোধের কারন হয়ে উঠল কখনও। এছাড়াও, নিজের অনুভূতিকে কাবুকে রাখতেও, ইরাজের মেঘালয়ার সঙ্গে ঘেষতে আপত্তি ছিল।তার ধরণা ছিল, এভাবে অবাধে চলাফেরা করলে, সে আরও বেসামাল হয়ে যাবে। পরিশেষে, ইরাজের তো হাড় বাঁকা! সে যে সুষ্ঠ, স্বাভাবিক আচরণ ও চিন্তা করবে না; এটাই বরং স্বাভাবিক তার জন্য। মেঘালয়াকে দু মিনিটের মাঝে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, নিজে রাত ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে শেষরাতে বাড়ি পৌঁছেছে।

আজ সেই ইরাজ মেঘালয়াকে সঙ্গে নিতে চাইছে। ঘুরতে যেতে চাইছে। ব্যাপারটা আজব এক অনুভূতি জাগায় মেঘালয়ার মাঝে। ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকায় সে ইরাজের দিকে। বুকটা ধুক করে ওঠে। দেখতে কেমন প্রাণহীন লাগছে সবসময় সাহেব বেশে চলাচল করা ইরাজকে। চোখ বসে গেছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বহুরাতের ঘুম-শূন্যতার সুবাদে এই হাল। জিজ্ঞেস করল, “হঠাৎ এ কথা কেন?ʼʼ

“তোকে নিয়ে একটু ঘুরতে যেতে ইচ্ছে হলো, আর কী!ʼʼ

ইরাজের মুখে আজ এমন একটা কথা এমন অদ্ভুত আবদারের সুরে মেঘালয়ার বুকের কোথাও একটা খালি খালি লাগল আচমকা। হাঁসফাঁস লাগল খুব। দ্রুত বলে উঠল, “কেন, খুব শীঘ্রই হারিয়ে যাবেন আপনি?ʼʼ

প্লেটের ওপর ইরাজের হাতটা থেমে যায় আচমকা। চোখ তুলে তাকায় মেঘালয়ার দিকে। চট করে ঠোঁট প্রসার করে মলিন হেসে উঠল ইরাজ। ওভাবেই বলল, “যে হারায় সে বলে হারায় না, মেঘ! হারিয়ে যাওয়ার পূর্বে খবর পাওয়া যায় না। খবর যা পাওয়া যায়, তা ঘটে না। খবর যতদিন পাওয়া যায় যতদিন, ততদিন কেউ হারায় না।ʼʼ

মেঘালয়া কেবল চেয়ে রইল ইরাজের সজল চোখদুটোর দিকে। সে মুহূর্তে ইরাজ ঝুঁকে বসে খানিকটা। মেঘালয়ার কেন জানি, আরও কিছুক্ষণ দেখতে ইচ্ছে হলো ইরাজের ভগ্ন-সিক্ত চোখদুটো। সে-ও একটু ঘাঁড় বাঁকিয়ে মাথা নিচু করল ইরাজের চোখদুটো দেখার লোভে। ইরাজ খাবার শেষ না করেই অনীহার সাথে হাতটা ধুয়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। হেঁটে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে আস্তে করে ড্রয়ার খুলল। ভরা সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার হাতে তুলে নিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। মেঘালয়া তা দেখে মুখ-চোখ জড়িয়ে বলে উঠল, “আপনি আবার সিগারেট খেতে যাচ্ছেন? খাবেন না সিগারেট, শুনুন আমার কথা? আমি কিন্ত..

ইরাজের কানে আদৌ কথাগুলো গিয়েছে বলে মনে হলো না। সে আপন মনে মৃদূ হেলেদুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। মেঘালয়া মুখটা গম্ভীর করে বসে রয় ওভাবেই। ইরাজ খুব বেশি মানসিক কষ্টে না থাকলে রাতে ধূমপান করে না; তা অজানা নয় মেঘালয়ার। তাহলে কী হয়েছে ইরাজের? মনটা আবার বিষিয়ে উঠল মেঘালয়ার। ইরাজকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও বলে না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়, অথচ সর্বক্ষণ চোখে-মুখে স্পষ্ট ব্যথা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!

শেষরাতের দিকে মেঘালয়ার ঘুম ভেঙে যায়। ঘরে জ্বলে থাকা মৃদূ আলোতে এমনিতেই ঝাপসা লাগছে চোখ নাকি সে দেখছে ঝাপসা; তা ঠাহর করতে পারল না। জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করল। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে যেন, আর বেশিক্ষণ এ শ্বাস-প্রশ্বাসের খেলা চলতে পারবেনা, থেমে যাবে বলে মনে হলো মেঘালয়ার। ধীরে-ধীরে চোখের সামনে অন্ধকার নামতে শুরু করল যেন। শ্বাসের গতি আরও বাড়ল মেঘালয়ার। তবুও যেন রোধ হয়ে আসছে নিঃশ্বাস। আরও খানিকটা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিতে চেষ্টা করে মেঘালয়া। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল ইরাজ। শ্বাসরোধ মেঘালয়ার হয়ে আসলেও, প্রাণটা যেন ইরাজের বেড়িয়ে যেতে নিয়েছিল– এভাবে ব্যাকুল হয়ে পড়ল মুহূর্তের মাঝে। মেঘালয়াকে ধরে দ্রুত বসায়। শুকনো কয়েকটা ঢোক গিলল কেবল, মুখে কিছু বলতে পারল না কিছুক্ষণ। ভাষা মেলাতে পারে না ইরাজ। চোখ-মুখ বিষ্ফোরিত তার। পর্বতের ন্যায় অটল ইরাজ যেন আজ এলোমেলো ঝরনার ন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে, পাহাড়ের ঢালুতে। একহাতে মেঘালয়াকে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে আপাতত টেবিল-ল্যাম্প জ্বালাল। তাতে মেঘালয়া যেন অসহ্য হয়ে উঠল আরও। হাত চোখের সম্মুখে রেখে আলোকে রুখতে চেষ্টা করল। মেঘালয়ার দিকে তাকাতেই ইরাজের হৃদস্পন্দন থেমে রইল কয়েকটা। অতঃপর দ্রিম-দ্রিম করে বাজতে থাকল আবার।

মেঘালয়ার নাক থেকে র ক্ত বয়ে ঠোঁট পার করে থুতনিতে এসে ঠেকেছে। মেঘালয়া কয়েকবার বমি করার লক্ষ্যে ‘ওয়াক’ এর মতো করে ওঠে। অতঃপর করেও ফেলল শেষে। এক-সময় পেট চেপে ধরে কেঁদে ওঠে। অসহ্য ব্যথায় কাতর হয়ে ছটফটানির মাত্রা বাড়ল ক্রমশ মেঘালয়ার। নাক দিয়ে র ক্ত পড়ছে, সঙ্গে চোখটা আরও ঝাপসা হয়ে এলো ধীরে-ধীরে।

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৭. (প্রথমাংশ)

রাতের শেষ প্রহর পেরিয়ে ভোর হতে চলল। খুব বেশি সময় বাকি নেই ফজরের আজান পড়তে। কোথাও কোথাও দূর মসজিদ থেকে ভেসেও আসছে আজানের ধ্বনি। রাত আধার কেটে আলোর ছটা তো প্রকাশ পাবে শীঘ্রই; সেই সাথে যেন ইরাজের ছটফটানি সম-হারে বাড়ছে। পাবলিক হাসপাতাল হওয়ায় লোক সমাগম তুলনামূলক কম। ইরাজ বারান্দায় একাধারে ছটফটে পায়ে পায়চারী করছে। পাশেই এক বেঞ্চে ভেঙে পড়া হেলাল সাহেবকে ধরে বিষণ্ন মুখে বসে রয়েছেন ইমতিয়াজ সাহেব। ইরাজ একা অস্থির নয়। আজ বড়ো আশ্চর্যজনক দৃশ্য হিসেবে চোখে পড়ার মতো ব্যপার হলো— আনতারা খানম যেন সমানতালে অস্থির ইরাজের সঙ্গে সঙ্গে। তার চোখ-মুখে স্পষ্ট উদ্বেগ। বারবার এগিয়ে যাচ্ছেন অবজারভেশন রুমের দ্বারের দিকে। আবার হতাশ হয়ে ফিরে আসছেন।

মেঘালয়া নাক-মুখে র ক্ত উঠে এসেছিল সঙ্গে অস্বাভাবিক পেটের ব্যথা। রাত সাড়ে তিনটার সময় নিয়ে আসা হয়েছে হাসপাতালে। তখনই মেঘালয়াকে ঢুকিয়ে নেওয়া হয়েছে অবজারভেশন রুমে। তখন থেকে ইরাজের এই অশান্ত, এলোমেলো চলন চালু আছে। চোখ-মুখ র ক্ত শূন্য, উদ্দীপনাহীন লাগছে। চেহারাটা ভাঙা, বসে যাওয়া। শারমিন আরা আজ রাতে ডিউটিতে ছিলেন না। তাকে ইরাজ ফোন করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। তিনি এখনও এসে পৌঁছান নি। ইরাজের মাথা আরও গরম হয়ে উঠল।

ফজরের আজান শোনা যায়। ইরাজ একবার ভাবনা-পীড়িত দৃষ্টিতে তাকাল সেই কেবিনের দিকে– যেখানে মেঘালয়াকে অবজার্ভ করা হচ্ছে। অতঃপর ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল মসজিদের উদ্দেশ্যে। হাসপাতালের বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতেই নজরে এলো শারমিন আরা নামলেন নিজস্ব গাড়ি থেকে। ইরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে দাঁড়াল এক পুরুষ। ইরাজ এগিয়ে গিয়ে দাঁত খিঁচে বলল, “ম্যাম! আপনার বিবেক ঘুনপোকায় খেয়েছে? মেঘের কিছু হলে আপনাকে আমি..

শারমিন আরা ইরাজের বাহুতে হাত রেখে সজল চোখে তাকায় ইরাজের বিক্ষুব্ধ চোখের দিকে। ইরাজ নিভে গেল একটু, থামল। শারমিন আরা ডিভোর্সী-নারী। এই শেষ রাতে একজন নারীর পক্ষে পথ পেরিয়ে হাসপাতালে আসা সহজ তো মোটেই নয়। যে ছেলেটি তাকে নামিয়ে দিতে এসেছে, শারমিন আরার ছোটো ভাই শান্ত। সেও পরিচিত ইরাজের। শারমিন আরা বললেন, “কুল, রাজ!ʼʼ

ইরাজ চলে যায় নামাজের উদ্দেশ্যে। শারমিন আরা দ্রুত প্রবেশ করলেন ভেতরে।


সকাল সাড়ে ছয়টা বাজতে চলল। ইরাজ মন্থর পায়ে প্রাণহীনের ন্যায় দরজা খুলে প্রবেশ করল কেবিনে। চোখের কাতরতা আর বুকের ধুকপুকানিতে ইরাজ বিদ্ধস্ত যানবাহনের মতো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে যেন! গিয়ে বসতেই শারমিন আরা বলতে শুরু করলেন,
“রাজ! আমি তো তোমাকে প্রেগন্যান্সির সেই শুরুতেই বলেছিলাম, মেঘালয়ার প্রি-একলাম্পসিয়া দেখা দিতে পারে। কারন প্রথম থেকে ওর ব্লাড-প্রাশার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। আর যা ধারণা করেছিলাম, তা ঘটে গেছে। এখন..

কথা শেষ করতে দেয়না ইরাজ। বলে ওঠে, “এখন কী অবস্থা, ম্যাম!ʼʼ

শারমিন আরা ইতস্তত করলেন। এই ছেলের যা মেজাজ। না জানি কথাটা শুনে কিভাবে নেবে। তবুও বলতে শুরু করলেন, “মেঘালয়ার ব্লাড-প্রেশার অনিয়ন্ত্রণে। মাঝেমধ্যেই খিঁচুনি হচ্ছে। নাক-মুখে রক্ত আসছে। আর বাচ্চার গঠন সুষ্ঠুভাবে হয়নি।ʼʼ

কোনদিন কোন রোগীর কন্ডিশন জানাতে ডাক্তার হিসেবে এমন দ্বিধা কাজ করেনি তার, অথচ ইরাজের সামনে ব্যাপারটা খুলতে মুখে বাঁধছে যেন। থেমে থেমে বললেন কথাগুলো শারমিন আরা। ইরাজ শান্ত নজরে তাকিয়ে বলল, “ভনিতা না করে খুলে বলুন, এখন কী করা যায়। কী হয়েছে?ʼʼ

চরম অসভ্যের মতো শোনাল ইরাজের কথা। শারমিন আরা একটা শ্বাস নিয়ে বললেন, “তোমার বাচ্চা বাঁচার সম্ভাবনা টেন-পার্সেন্ট। আর যেহেতু প্রি একলাম্পসিয়া শুরু হয়েছে, প্রসবের সময় খিঁচুনি উঠবে প্রায় নিশ্চিত। আর তখন বাচ্চা ও মা দুজনের লাইফ-রিস্ক রয়েছে। যদি কোনভাবে কেউ একজন বেঁচেও যায়, সে মেঘালয়া হলে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়বে। আর বাচ্চা প্রতিবন্ধী হতে পারে। কারণ, বাচ্চার বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়নি। মেঘালয়া গর্ভধারণের শুরু থেকে শারীরিকভাবে ফিট ছিল না। আর… মেঘালয়ার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ। আ’ম সিওর তোমারটা পজেটিভ। বাচ্চার বর্ধণ ও শারীরিট পরিপক্কতায় বাঁধা হয়েছে ব্যাপারটি, সঙ্গে মেঘালয়ার শারীরিক কন্ডিশনকে আরও বিগড়েছে।ʼʼ

ইরাজের বুকটা কেঁপে উঠল বোধহয়! মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠল, তবুও অটল চাহনিতে জিজ্ঞেস করল, “কেন এসব হচ্ছে?ʼʼ

“হতে পারে পারিবারিক ইতিহাস রয়েছে এমন। বংশগতি বোঝো তো! হার্ট ফেইলিওর বা উচ্চ রক্তচাপ রোগ গুলো বংশগতির ধারায় প্রবাহিত হওয়ার মতো ম র ন ঘা তি রোগ।ʼʼ

এই কথাটুকুর পরিপেক্ষিতে ইরাজের মাথায় হুট করে এলো, মেঘালয়ার আম্মুও মেঘালয়ার ছোটো ভাইয়ের প্রসবের সময় খিঁচুনিতে মা-ছেলে দুজনেই মারা গিয়েছিল। এ-কথা এতদিন মাথায়ই আসে নি ইরাজের। শারমিন আরা বলতে লাগলেন,

“প্রথম গর্ভধারণে প্রেশারটা অনিয়ন্ত্রিত হতে বেশির ভাগ নারীরই দেখা যায়। মেঘালয়া পঁচিশ বছরের কম সময়ে গর্ভাধারণ করেছে, এখানেও এ অবস্থা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যায়। আর তাছাড়া তুমি খোঁজ নিয়ে দেখো, পরিবারে আর কারও হাইপারটেনশন আছে কিনা!ʼʼ

মেঘালয়ার গোটা পরিবারটাই হাইপারটেনশনের রোগী। হেলাল সাহেবের হাই-প্রেশার আছে, মেঘালয়ার মা তো জীবনটাই দিয়ে গেলেন। এ-কথা মাথায় আসতেই ইরাজ উদ্ভ্রান্তের মতো বলে ওঠে, “আমার বাচ্চা লাগবে না। আপনি মেঘালয়াকে ঠিক করুন। বাচ্চা দরকার নেই তো, ম্যাম! আমার জন্যই হয়েছে সব। আমিই করেছি এসব। মেঘের গর্ভধারণে আমি শালা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম। বুঝেই উঠতে পারিনি আমার এক খুশির জন্য আমার জীবনের বেঁচে থাকার অবলম্বনকে কোরবানী করতে হবে। শালা, বোকা ইরাজ! জীবনে তোর হারানোর শেষ নেই। আর তার কারণগুলো তুই নিজেই।ʼʼ

পাগলের মতো ছটফট করতে করতে এসব প্রলাপ বকতে শুরু করল ইরাজ। উঠে দাঁড়াল, কেবিন থেকে বেরিয়ে একদৌঁড়ে গেল মেঘালয়ার কেবিনের দিকে। ওয়ার্ডবয় ওর উত্তেজনা দেখে বাঁধা দিতে আসলে এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। মেঘালয়া প্রায় অচেতন পড়ে আছে বেডে। ইরাজ গিয়ে দাঁড়াল মেঘালয়ার বেডের পাশে। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল মেঘালয়ার অচঞ্চল, অর্ধবোজা চোখের দিকে। মেঘালয়ার হাতটা মৃদূ নড়ে ওঠে। ইরাজ তা চেপে ধরে বসে পড়ল চেয়ারে। মেঘালয়ার মুখে কাতর হাসি। মলিন চোখদুটো চেয়ে আছে ইরাজের দিকে, মুখে হাসি লেপ্টে আছে তার। ইরাজের বুকের ভেতর সূঁচাল ব্যথা অনূভূত হয়। হৃদযন্ত্রটা লাফিয়ে উঠল ধকধক করে। চোখ লাল হয়ে উঠল। নির্নিমেষ চেয়ে রইল মেঘালয়ার তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটের দিকে। কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা বুঝে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষারত রয় ইরাজ।

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৭ (বর্ধিতাংশ).

“আমার বাচ্চা ঠিক আছে?ʼʼ

মেঘালয়ার ক্ষীণ স্বরে বলা কথাটা ইরাজকে কঠিন এক ধাক্কা মারে। তা হয়ত বোঝা গেল না তার উদ্দীপনাহীন চেহারায় তাকিয়ে। কোন জবাব না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ইরাজ মেঘালয়ার শুকনো মুখটার দিকে। ওই মুখটাকে সজীব দেখতে ইরাজ এরকম হাজার বাচ্চার মায়া ত্যাগ করবে নির্দ্বিধায়; তা হয়ত জানবে কেউ কোনদিন! হঠাৎ-ই এমন কিছু বলে ওঠে ইরাজের ভেতরে আন্দোলিত মস্তিষ্কটা। একটা ঢোক গিলল ইরাজ। ইরাজের এই পরিশ্রান্ত, কাতর চাহনি! মেঘালয়ার ভেতরে ঝড় তুলছে। অথচ মেয়েটার শরীর সায় দিচ্ছে না। মেঘালয়ার চোখের কোণায় জলের ফোঁটা চিকচিক করে ওঠে। আস্তে করে বলল, “ডাক্তার যাই বলুক,আমার বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে নিন। পাঁচটা মাস ধরে ধারণ করেছি ওকে, হারাতে পারব না..ʼʼ

ইরাজ দিয়াশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে উঠল বোধহয়, “আর আমি যে তোকে ছয়- সাতটা বছর ধরে ধারণ করে আসছি! খু ন করে ফেলব একদম! আবেগ দেখাচ্ছিস? শালা, স্বার্থপর রে! সব স্বার্থপর! এই এই, এই মেঘ, এই! তোদের আমাকে পাথর মনে হয়? আমি শিলাখন্ড? আমার মায়া নেই, হারানোর ভয় নেই, আমার ব্যথা লাগে না, তাই না?ʼʼ

টপ করে আরেক ফোঁটা জল ছিটকে পড়ে ইরাজ নামক কঠিন ছেলের চোখের কোণ পেরিয়ে। মেঘালয়া বিভ্রান্ত হয়ে চেয়ে রয় সেদিকে! তার হৃদযন্ত্রের স্পন্দন থামল, আবার শুরু হলো ধুকপুক করে। ইরাজকে পাগলের মতো লাগছে। যেন তার শরীরে জলন্ত কয়লার সেঁক দেওয়ার হচ্ছে, ওভাবে ছটফট করতে থাকল ইরাজ। আকষ্মিক ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসল ইরাজের বিক্ষুব্ধতা। শীতল চোখে চেয়ে শান্ত আওয়াজে প্রশ্ন করে, “আমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে হয় না তোর, তাই না? এজন্য চলে যেতেও ভয় নেই।ʼʼ

আবার ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠল। মেঘালয়ার হাতটা ঝারা মেরে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিদ্ধস্ত পাগলাটে ভাবে বলতে থাকে,

“আরে তোরা তো পারিস, বাল। ইরাজ পারে না। ইরাজ বারবার আটকে পড়ে একই জালে। শালা ইরাজ ভয় পায়, ইরাজরা সবকিছুর ওপরে তোদের মতো মেঘেদের নিজের সাথে চেপে ধরে ক’দিন বাঁচতে চায়! ইরাজ হারাতে চায় না, কিন্তু তোদের হারিয়ে যেতে কত আয়োজন!ʼʼ

চিৎকার শুনে শারমিন আরা এসে দাঁড়ালেন কেবিনে। ইরাজের বাহুতে হাত রাখতেই ছিটকে সরিয়ে দেয় ইরাজ হাতটা। জোরে জোরে শ্বাস ফেলে মেঘালয়ার দিকে চেয়ে।
মেঘালয়া ফুঁপিয়ে উঠল, হাতটা প্রসারিত করল ইরাজের দিকে। শব্দ করে শ্বাস নিল। ইরাজের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে মুহূর্তের মাঝে। দৌঁড়ে গিয়ে মেঘালয়ার হাতটা চেপে ধরে। আচমকা মেঘালয়া ক্যানোলা লাগানো হাতটা ব্যথা লাগা সত্ত্বেও তুলে ইরাজের শার্টের কলার চেপে ধরে মৃদূ টান দেয়। ইরাজ আরও খানিক ঝুঁকে যায় মেঘালয়ার দিকে। ইরাজের চোখের স্থির চাহনি। অথচ মেঘালয়ার চোখ কাঁপছে। চোখে টলমলে পানি, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকায় তা ছিটকে পড়ছে মুখের চারদিকে। ইরাজের চোখের দিকে চোখ রেখে ভাঙা স্বরে বলে, “এসব কেন বলছেন? আমি দেখেছিলাম ইরাজের চোখে বাবা হবার আনন্দটুকু।ʼʼ

পরস্পরের মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া দুটো রুহুর বিচ্ছেদের পূর্বক্ষণ বোধহয় এমনই বিপর্যস্ত হয়! এমনই গুমোট যন্ত্রণারা বোধহয় ধোঁয়ার কুণ্ডলি হয়ে বাতাসে বিষাদ ছড়ায়! কেবিনে যে শারমিন আরা দাঁড়ানো তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই এক সম্ভাব্য বিদায়ী পথযাত্রী ও আরেক বিদ্ধস্ত, সর্বস্বান্ত পুরুষ! ইরাজ মলিন হাসল, “মেঘ! তুই বোকা, অন্ধ নাকি স্বার্থপর? সবসময়ই স্বার্থপর! ইরাজের বাপ হওয়ার আনন্দটুকু না দেখে বরং ইরাজকে দেখলে আজ তোর বুক কাঁপতো হয়ত চলে যাওয়ার কথা ভাবলে। বাপ হওয়ার আনন্দের কথা ভাবছিস? আমি ভাবছি, কেউ আমায় রেখে চলে যাবে, অথচ তার সাথে থাকার ছিল আমার, সে অনুযায়ী আমার তো পরপারের নেশা ধরে যাবে রে, মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়া ডুকরে কেঁদে ওঠে, বুক চেপে ধরে হাঁপানীর মতো করে শ্বাস নেয়। থেমে থেমে বলে, “আমার কিছু হবে না। আপনি..

ইরাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল আবার, ইরাজের ধমক গর্জনের মতো শোনায়, “আমি কী? কী করব আমি? তোর বাচ্চা সাথে নিয়ে সরাজীবন তোর মুখটা মনে করতে করতে জীবন পার করব? পাগলে ** আমায়? ইরাজের এত খারাপ দিন আসেনি, বাল। ইরাজ সবসময় সুখী ছিল, থাকবে। তোর ওসব ঝোলা টেনে নিয়ে বেড়ানোর মধ্যে নেই ইরাজ..

আনতারা খানম এলেন সেখানে। দৃশ্যটা তার বুকের ভেতরে নাড়িয়ে তোলে। তার ছেলের কী হবে— এই মেয়েটার সঙ্গে খারাপ কিছু হলে! ইরাজকে টেনে একটু পিছিয়ে নিয়ে গেলেন। ইরাজের বুকের উঠা-নামা আর সর্বস্বান্ত চোখের চাহনি! আনতারা করুণ দৃষ্টিতে তাকায় ছেলের দিকে। গিয়ে মেঘালয়ার পাশে বসে অর্ধসিক্ত চোখে চেয়ে মেঘালয়ার মাথা মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ইরাজ সরে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। শারমিন আরা এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। কপট রাগ দেখিয়ে ধমকে বললেন, “রাজ! এ কেমন অসভ্যের মতো আচরণ? ব্যাড-টেমপার হলেই সব সমাধান হয়ে যাবে? আমরা দেখব কী করা যায়! তুমি শান্ত হও।ʼʼ

ইরাজ মুখটা বিকৃত করে উগ্র হয়ে তাকাল শারমিন আরার দিকে, “কী দেখবেন? হেলাল আকবরের মেয়ের আমাকে ছেড়ে পালানোর অনুষ্ঠান দেখবেন? রিপোর্ট দেখিনি আমি? আমি নাহয় বোকা শালা, মূর্খ তো না! প্রেশার ১৮০/১৩০। দুইশো ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন? হেলাল আকবরের মেয়ের র ক্তে মাখা থেমে যাওয়া দেহ থেকে বাচ্চা বের করে ইরাজের হাত দেবেন? পরিকল্পনা কী আপনার?ʼʼ

ইরাজকে উন্মাদের মতো লাগে। এক একটা প্রশ্নে কেবিন কেঁপে উঠছে। হেলাল সাহেব এগিয়ে আসে, পেছনে ইমতিয়াজ সাহেব। ছেলেকে বাঁধা দিলেন না। ক্লান্ত চোখে চেয়ে দেখলেন ছেলেকে। ইরাজ আবার পাগলের মতো করতে শুরু করে, ম্যাম! কখন সার্জারী শুরু হবে? জলদি করুন তো!ʼʼ

পাগলের মতো মাথা দুলিয়ে, হাত নাড়ায়, “যান যান, ব্যবস্থা করুন। এখানে দাড়িয়ে থাকবেন না। যান তো, বাল!সময় যাচ্ছে শুধুশুধু।ʼʼ

ডাক্তার কেবিনে প্রবেশ করে। ইরাজকে বলল,এভাবে এবোর্শোন করানো অনৈতিক। আপনি ধৈর্য্য ধরুন। সবে পাঁচ-মাস শেষের দিকে।

ইরাজ বকে ওঠে, “এ শালা ডাক্তাররা তো আইনের লোকের থেকে বড়ো বা** হয়ে গেছে। রিপোর্ট লিখাতে গেলে আগে আঘাত দেখাতে হয়। আঘাত পাওয়ার আগে ব্যবস্থা নেই! তো মরলে তারপর প্রমাণ হাতে নিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন? শালা তোর ডাক্তারীর ..

এগিয়ে যায় ইরাজ ডাক্তারের দিকে তেড়ে। ইরাজের বিশ্বাস, এভাবে এই আবেগী কথোপকথনের মাঝে খারাপ কিছু ঘটবে মেঘালয়ার সঙ্গে। ও মোটেই আলাপ বাড়াতে চায় না। হেলাল সাহেব এসে ইরাজকে সামলাতে চেষ্টা করে। ইরাজ অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে ওঠে ডাক্তারটিকে। পুরো কেবিনে এলোমেলো এক অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায়।

অথচ শারমিন আরা স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। এরকম কত কেইস প্রতিনিয়ত হেন্ড্যল করতে হয়। অথচ এতটা অস্থির লাগে নি কখনও ভেতরে। আসলে ইরাজের মতো জটিলতম অনুভূতিতে মাখা, পাগল পুরুষের দেখা পায়নি যে! যার কথার মর্ম উদ্ধার করতে গেলে সে কথার মাঝে ডুবে যেতে হয়। হুট করে শারমিন আরা নিজ মনেই নিজের ভাগ্যের ওপর হেসে উঠলেন। এক মেয়ে মৃ ত্যুপথযাত্রী। তার অর্ধাঙ্গ যেন খোদার কাছ থেকেও মেয়েটাকে ছিনিয়ে আনতে যুদ্ধ করতে চায়! সে নিজেও তো নারী, তবে সে জীবিত থাকতে কেন তাকে স্বামী নামক পুরুষটা কাছে রাখেনি এভাবে ধরে! পুরুষ বৈচিত্র জাত। একই জাতের মাঝে কতরকম বিভেদ! তবে ইরাজ যেন একটু বেশিই ব্যতিক্রম সত্তার। যার সবকিছুতে ভাবার বা বোঝার মতো কিছু লুকায়িত।

মেঘালয়া হঠাৎ-ই কেঁদে ওঠে। অতঃপর আস্তে করে চোখটা উল্টে ঝাপসা চোখে চোখটা বুজে নেয়। আনতারা কান্নাজড়ানো কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, “আল্লাহ!ʼʼ

ইরাজের বিশ্বাস বাস্তবে রূপ নিল বোধহয়! ইরাজ ধপ করে নিভে যায়। শান্ত হয়ে উঠল একদম! শরীরের ভর ছেড়ে দাঁড়াল। হেললা সাহেব ইরাজকে ছেড়ে চমকিত হয়ে তাকায় মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়ার ব্লিডিং শুরু হয়েছে। শারমিন আরা সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড়ে গেলেন সেদিকে। মেঘালয়ার কব্জিতে হাত রাখলেন। কয়েক মিলি সেকেন্ড পালস রেট না পেয়ে ডাক্তারী ভুলে একজন সাধারণ মানুষের মতো তার কলিজাটাও ছলাৎ করে ওঠে। কেন! হয়ত ওই-যে এগিয়ে না এসে বরং প্রাণহীনের ন্যায় পিছিয়ে গিয়ে উদ্ভ্রান্ত নজরে তাকিয়ে থাকা তেজী পুরুষটার কথা ভেবে? আবার পেলেন পালস রেট। তবে খুবই ধীর গতিতে চলছে তা। রক্তক্ষরণ চলছে, মেঘালয়া অচেতন। তিনি তাকালেন ডাক্তারটির দিকে। চোখের ইশারায় কথা বিনিময় হয় এক মুহূর্ত। জরুরী ভিত্তিতে সার্জারীতে নিতে ডাক্তারটা বেরিয়ে যায় হন্তদন্ত পায়ে ব্যবস্থাপনার কাজে।

ইরাজ এগিয়ে এলো না। ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে পেছনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে আড়চোখে চেয়ে রইল মেঘালয়া জ্ঞানহীন মুখটার দিকে। রোবটের মতো সেই দৃষ্টি। যাতে উদ্বেগ, উদ্দীপনা, মানসিক কোন অনুভূতি দেখা গেল না। কেবল ভরাট, সজল চোখে চেয়ে রয় ইরাজ। তার পাপ-পূণ্যের ঘড়া পূর্ন হয়েছে। সে তার সমস্ত সম্পদ হারিয়ে সর্বস্বান্ত আজ। তার কাছে হারানোর মতো কিছু নেই যেখানে, তার মানে সে-ই তো সিকান্দার। সে বাদশাহ। আজ সব হিসেব মিলে গেছে যেন তার জীবনের। আর চাওয়া-পাওয়ার নেই কিছু। সব পেয়েছে সে। সব আজ তার হয়েছে। নির্বিকার, অনুভূতিহীন চাহনিকে চোখের পাতার ঝাপটায় ঢেকে ফেলে আস্তে করে চোখটা বুজে নিল ইরাজ।

ওভাবেই শান্ত হয়ে বসে পড়লেন আরেকটা মানুষ। মেয়ের জন্মদাতা। যাদের জন্য ত্যাগ নিতকর্ম মাত্র। এই-যে মেয়ের বাবা তিনি, তাই তো আজ হারানোর যন্ত্রণায় তার কাতর হওয়া চলবে না। তার অভিযোগ করার নেই। তার বিলাপ করার নেই। সে কেবল সইবে, দেখবে, আর বুকটা চেপে ধরে মাটিতে পড়ে রইবে। মেয়েদের জীবন যদি ত্যাগের আরেক রূপ হয়, তবে সেই মেয়ের জনক হয়ে তার কতখানি ত্যাগী হতে হবে তা বেশ বুঝেছেন হেলাল সাহেব। তাই তিনি আজ চেঁচাবেন না, আহাজারী করবেন না শুধু দেখবেন। তবে সবশেষে তার নিজেকে বড়ো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহীতা হিসেবে নিজের প্রতি গর্ব করতে খুব ইচ্ছে হলো, তিনি তার পাগলিকে ভুল পুরুষের হাতে দেননি। এ-ই তো মেয়ের বাবা জীবনের সার্থকতা!

আনতারা খানম বসে রইলেন ওভাবেই। মেঘালয়ার প্রতি নিজের ক্ষোভগুলো ভাঙতে শুরু করেছিল, ধীরে-ধীরে ইরাজের জীবনের খুশি ফিরতে দেখে। তিনি তো কখনও মেঘাকে খারাপ চোখে দেখতে চাননি! অথচ ছেলের বুকের হাহাকারের সামনে সব তুচ্ছ। যে মেয়েটা ছেলেকে এতো কষ্ট দিয়েছে, তাকে মেনে নিতে মা হিসেবে বুকে বেঁধেছে বারবার। আবার যখন সেই মেয়েই ছেলের জীবনের সুখগুলো একটু একটু করে ফিরিয়ে দিতে শুরু করেছে, তখন মায়ের অভিমান টিকে নাকি? ইরাজের ভালো থাকার কারণ যেখানে মেঘালয়া— সেখানে মেঘালয়াকে ভালো রাখা তো আনতারার মাতৃত্যের কর্তব্য। যেদিন শুনলেন, মেঘালয়া গর্ভবতী, এ এক অনবদ্য খুশি ছিল তার জন্য।

অথচ এই-যে মেঘালয়ার গর্ভকালীন অসুস্থতা তাকে প্রতিক্ষণে পুড়াচ্ছে! এভাবেই তিনি চারটা সন্তানকে হারিয়েছেন। কেউ গর্ভপাতে, তো কেউ জন্মের পর। তবেই তো ইরাজ একা আজ! মায়ের কাছে সন্তানের নিথর শরীর! কাল রাত থেকে সেই সকল পুরোনো যন্ত্রণাগুলো তার ভেতরটাকে তছনছ করে দিচ্ছে। তিনি এত বছর পর মেঘালয়ার দিকে তাকিয়ে প্রতিবার সেই যন্ত্রণা তাজা অনুভব করছেন। তার পাগল ছেলে, তার ছেলের র ক্তে গড়া তারই একাংশ মেঘালয়া বয়ে চলেছে ভেতরে। আর সয়ে বেড়াচ্ছে, অতুলনীয় শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা। বহুবছর আগের মাতৃত্য হারানোর চটা পড়া যন্ত্রণাগুলো আজ আবার তাজা হয়ে উঠেছে মেঘালয়াকে দেখে। ঝরঝর করে বেয়ে পড়ল গুমোট যন্ত্রণা গুলো জলের ধারায়।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে