#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
২০.
শুক্রবার দিন। বাড়িতে ইমতিয়াজ সাহেবের এক ব্যাবসায়ীক ক্ষেত্রের পরিচিত লোকের পরিবার আসছে। এরকম মাঝেমধ্যেই অনেকেই আসে। আনতারা খানম বহু দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে শেষমেষ উপস্থিত হলেন মেঘালয়ার রুমের সম্মুখে। মেঘালয়া আনতারা খানমকে দেখে বিশেষ কোন খারাপ ভালো কিছুই প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আজকাল ভয় হয় খুব, সেই সঙ্গে পুরোনো ব্যথা! না জানি কি কথা শুনাতে এসেছে! আনতারা খানম নিরস, গোমরা মুখেই কোন শিরনাম ছাড়াই বললেন,
“গোসল করে একটা শাড়ি পরে নিও। মেহমান আসছে।ʼʼ
মেঘালয়া কিছু বলল না। আনতারা খানম চলে গেলেন। যেহেতু ইরাজের বিয়েতে ঘটা করে অনুষ্ঠান করা হয়নি। আর তাছাড়াও মেঘালয়া বাড়ির বউ। এ এক ঐতিহ্যও বটে, বাড়ির বউ শাড়ি পরবে।
মেঘালয়া অনিচ্ছা সত্তেও শাড়ি বের করতে আলমারী খুলল। শাড়ি আছেই মোটে তিনটা। একটা বিয়ের শাড়ি, সেটা অবশ্য খুব বেশি ভারী সাজের নয়। ইচ্ছে করলে এমনিতেও পড়া যায়। তবুও মেঘালয়া বাকি দুটোর মাঝে দেখল। একটা সেদিন পড়ে গিয়েছিল। এই দুটো শাড়ি মেঘালয়ার আগে কেনা। সে ফুফাতো বোনের বিয়েতে এবং কলেজের বিদায় অনুষ্ঠানে কিনেছিল। সেটাকে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকল।
ইরাজ হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করল। সে আজ সকাল সকাল বেরিয়েছিল কোথাও। মেঘালয়া একবার তাকাল। বড়ো অস্থির আর অগোছালো লাগছে দেখতে ইরাজকে। ঘর্মাক্ত শরীর, এলোমেলো চুল। চমকপ্রদ ভাবে নজরে এলো, ইরাজের হাতের সদ্য হওয়া ক্ষতটি। মেঘালয়া উঠে দাঁড়াল। ইরাজ ব্যস্ত হয়ে কিছু খুঁজছে। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করল, “কী খুঁজছেন? হাত কাটল কী করে?ʼʼ
ইরাজ কেবল প্রথম প্রশ্নেরই জবাব দিল, “স্যাভলন কোথায় রেখেছিস?ʼʼ
“আপনি বসুন, আমি দিচ্ছি।ʼʼ
“ঘরের জিনিস উল্টোপাল্টা করতে বলে কে তোকে?ʼʼ
মেঘালয়া ড্রেসিং টেবিলের কাঁচ খুলে উপরের তাক থেকে স্যাভলন বের করতে করতে বলল, “ঘর উল্টোপাল্টা করার দায়টা একচ্যুয়ালি আপনার। হাতের ব্যাথায় মাথা ঠিক নেই, আমার কথা বলে ফেলেছেন। আমি তো কেবল ঘরের পরিচর্যা করি। সবকিছু তার সঠিক জায়গায় গুছিয়ে রাখি।ʼʼ
মেঘালয়ার শীতল জবাবে ইরাজ মুখ ভার করে আড়চোখে তাকিয়ে রইল। তুলো নেই ঘরে, মেঘালয়া টিস্যুবক্স থেকে কয়েক টুকরো টিস্যু নিয়ে এসে ইরাজের পাশে বসল। ইরাজ খপ করে কেঁড়ে নিল এন্টিসেপটিক এর বোতলটা। বলল, “বহু জ্ঞানের বাণী শুনিয়েছিস। এবার গিয়ে আমার খাবারের ব্যবস্থা কর।ʼʼ
“প্রাথমিক চিকিৎসা আগে দিই। তারপর খাবার।ʼʼ
“না, তোর চিকিৎসা লাগবে না। দেখা যাচ্ছে তোর হাত পড়ে এখানে জীবাণু ইনফ্র্যকশন হয়ে গেল।ʼʼ
মেঘালয়ার এ কথায় রেগে যাওয়ার কথা থাকলেও কেন জানি ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল। ইরাজের হাত থেকে স্যাভলনের বোতল নিয়ে তাতে টিস্যু ভেজাল। ইরাজের হাত ধরতে কেমন দ্বিধা হচ্ছে। যদি হাত ছিটকে নেয়, বা কটুক্তি করে? মেঘালয়া মিনমিন করে বলল, “হাতটা দিন।ʼʼ
মেঘালয়ার ভাবনাকে মিথ্যা করে ইরাজ বিরক্ত মুখে হাত এগিয়ে দিল। স্যাভলন ক্ষততে লাগাতেই ইরাজের বদলে মেঘালয়া মুখ কুঁচকে নিলো। ইরাজ তা দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, “এক প্রাণ-দুই দেহ হয়ে গেল নাকি তোর আমার? আমার বদলে তুই কাঁদছিস কেন?ʼʼ
মেঘালয়া মনে মনে কপাল চাপড়াল। সে নাকি কাঁদছে, আল্লাহ! কী মুসিবত ত্যাড়া লোকের সাথে চলা!
মেঘালয়া এতক্ষণে জিজ্ঞেস করল, “কী করে কাটল হাত?ʼʼ
“তোর পুরোনো আশিককে আজ এ বাজারে পেয়েছিলাম।ʼʼ
মেঘালয়া দ্রুত মাথা উঁচিয়ে তাকাল, “মারপিট করে এসেছেন আপনি?ʼʼ
“মারপিট করব কী উপলক্ষ্যে?ʼʼ
মেঘালয়া চোখের পাতা ঝাপটাল কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বলল, “তারপর?ʼʼ
“তারপর এগিয়ে গেলাম। কানে কানে একটা তরতাজা খবর দিয়ে এসেছি।ʼʼ
মেঘালয়া প্রশ্নাত্মক নজরে ভ্রু কুঁচকে রইল। ইরাজ কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে মেঘালয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, “বলেছি, প্রেম তো তুই করেছিস, বাসর রাতের বেনিফিটটুকু কিন্ত আমিই গিলেছি। আমি ব্যাবসায়ী মানুষ তো, লসের পক্ষে নেই।ʼʼ
মেঘালয়া এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গেল। কিছু মুহূর্ত পার হতেই যেন জ্ঞান ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নত করে নিলো। আচমকা হাসি এসে জড়ো হলো ঠোঁটের কোণে। তবে ভাবনায় কিছু আসতেই কপাল কুঁচকে তাকাল, “আর তারপর মেরেছেন?ʼʼ
“উফফ! তার জন্য তোর এই দরদ! মানুষের পিরিত দেখতেও ভালো লাগে। শালা, আমরাই কী ছিঁড়লাম জীবনে!ʼʼ
মেঘালয়া কটমটিয়ে চেয়ে ক্ষতর স্থানে চেপে ধরল। ইরাজ মৃদূ চিৎকার করে উঠল, “খান্নাস!ʼʼ
“আমি শুধু জানতে চাইছি কাটল কী করে?ʼʼ
“বাড়িতে ঢোকার সময় আম্মা একটা দা আর নারিকেল দিল শরীরচর্চা করার জন্য। শালার, নারকেল এত সফ্ট, আর দা’তে নেই ধার। ছুটে এসে হাতে লেগেছে। দা’য়ে অন্তত তোর মুখের মতো ধার থাকলেও এই ঘটনা ঘটত
না।ʼʼ
মেঘালয়া ভাবল, এলো নিজের ত্যাড়ামির জোরে শক্ত পোক্ত নারকেধকেও সফ্ট বানিয়ে ছেড়েছে। কোনহাতে দা ধরেছিল, ডানহাতে কী করে লাগল। বলল, “তা ভালো। তবে যদি আপনার মুখের মতো ধার থাকতো— না জানি হাতটাই কেটে পড়ে যেত।ʼʼ
ইরাজ হাত ছাড়িয়ে নিলো, গম্ভীর মুখে তাকাল। উঠে চলে যেতে অগ্রসর হলো। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করে, “খাবার কী রুমে এনে দেব?ʼʼ
“খাব না। বাইক ধুয়ে আসি, বাপ অপেক্ষা করছে।ʼʼ
“খাওয়ার চেয়ে জরুরী?ʼʼ
“আপাতত।ʼʼ
নিচে নামতেই আনতারা খানম গালি ঝারলেন কয়েকটা। দামড়া ছেলেকে খাওয়ার জন্য তাড়তে হয়। ইরাজের শরীর অবধিও বোধহয় পৌঁছাল না কথাগুলো। ডেটলের সুরক্ষা আছে তার চারপাশে, মানুষের কথার পরিপেক্ষিতে। নির্লিপ্ত হেঁটে হেলেদুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। ইমতিয়াজ সাহেব অপেক্ষারত সেখানে। গাড়ি ধোয়া দিবস আজ বাপ ছেলের। তার হাত কেটেছে তা জানেন না আনতারা। ডানহাতে ক্লান্তি আসায় বামহাতে চেষ্টা করতে গিয়েই এই আকামটা হয়েছে। বামহাতে এমনিতেই স্বাভাবিকই জোর কম। নারকেলে কোঁ প দিতে গিয়ে ব্যালেন্স ছুটে গিয়ে ডানহাতে লেগেছে। তারপর বাঁকি নারকেল গুলো ইমতিয়াজ সাহেব ভেঙেছেন, ইরাজকে পাঠিয়েছেন সেবা নিতে। সেই নারকেল দিয়ে আনতারা বানাবেন মিষ্টি জাতীয় কোন খাবার।
মেঘালয়া শাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। এ বাড়িতে থাকলে যে-কেউ অলস হয়ে উঠবে। আগে তিনজন, এখন চারজনের পরিবার। সারাদিনে বাড়তি কোন কাজ নেই। এবং যা আছে আনতারা ও আয়েশা করে ফেলে। আনতারা মেঘালয়াকে ডাকেন না কোন কাজে। সে সারাদিন রুমের মাঝে পড়ে থাকে।
গোসল শেষে মেঘালয়া চুল ঝারতে ঝারতে বের হলো। পরনে তার আসমানী ও সাদার মিশ্রনে সজ্জিত একটি শাড়ি। কলেজের পোশাকটাও এ দুই রঙা ছিল বলে, সকলে এই রঙা শাড়ি কিনেছিল বিদায় অনুষ্ঠানে। মেঘালয়া এ সুযোগ পেয়েছিল কারন— তার থেকে ইরাজ তখন বহু দূরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
ইরাজ রুমে ঢুকেই মেঘালয়াকে ওমন অর্ধজড়ানো শাড়িতে ভেজা চুলগুলো আনমনে তোয়ালেতে ঘষতে ঘষতে এগিয়ে আসতে দেখল। তড়াক করে পুরুষ হৃদয় থমকে যায় যেন! পা উঠল না ইরাজের। শাড়ির কুচি অবধি ঠিক থাকলেও ওপরে কোনরকম শাড়ির আচলটা চিকন করে বুকের মাঝ দিয়ে কাঁধে তুলে রাখা। আচমকাই ইরাজের মনে হলো, মেঘের শরীরে মেঘবরণ শাড়ি। না না, ঝড়ো মেঘ নয়; বরং শরতের আকাশে নীল-আসমানী ও সাদার জড়াজড়িতে ভেসে বেড়ানো পেঁজা তুলোর মতো মেঘ! মেঘালয়াকে ইরাজ আজই প্রথম, প্রথমবারের মতো এভাবে দেখল।
ইরাজ ঠিকমতো আগেও কোনদিন মেঘালয়ার দিকে তাকাত না। তার অনুভূতির সঙ্গে তার আচরণ মেলে নি কোনদিন। সে সংকোচই কাটিয়ে উঠতে পারত না। মনে হতো মেঘালয়াতে আটকে সে বড়ো অবাঞ্ছিত কাজ করে বসেছে। মনকে সংযত না করতে পারলেও, নিজের আচরণ ও নজরকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল সে কষে। যখন মেয়েটার মায়ায় পড়েছিল ইরাজ, অধিকার হানা দিয়েছিল এই মেয়ের জন্য— তখন মেঘালয়া চৌদ্দ বছরের কিশোরী। খুব ছোটো না হলেও যুবতী ছিল না সে। যাকে ইরাজ সর্বদা রক্ষা করেছে, তার প্রতি অধিকার না জেগে যেত কোথায়?
আজ সেই মেঘালয়া তার বউ রূপে, তার ঘরে, এমন নারীবেশে দাঁড়িয়ে। পুরুষ মনে ধাক্কা লাগল কোথাও একটা। তবে কতক্ষণ, তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যে অসীমের মতোই। দ্রুত নজর ফিরিয়ে নিয়ে চারদিকে অপ্রস্তুত দৃষ্টি ফেলল। মেঘালয়া ইরাজকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ইরাজের শরীর ভেজা। হাতে পায়ে ময়লা লেগে আছে। রেগে উঠল মেঘালয়া,
“এভাবে রুমে ঢুকেছেন? সবে সবকিছু পরিষ্কার করে গোসলে ঢুকেছি। বেক্কল ব্যাটাছেলে।ʼʼ
ইরাজ গম্ভীর কণ্ঠে ভার মুখে শুধাল, “শাড়ি কেন পরেছিস?ʼʼ
মেঘালয়া তাকাল ইরাজের এমন রাশভারী গলা শুনে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজের দিকে খেয়াল দিতেই লজ্জায় ভেঙে পড়ল মেঘালয়া। তড়িৎ গতিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত শাড়ির আঁচল জড়িয়ে নিল শরীরে। তারপর আড় আড়ষ্টতায় বুদ হয়ে মৃদূ স্বরে জবাব দিল, “মামনি বলেছে।ʼʼ
ইরাজ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “কোন দুঃখে?ʼʼ
“বাড়িতে মেহমান আসার দুঃখে।ʼʼ
“মেহমান আসলে শাড়ি পরতে হয়; কোন বলদের হাতে, কোন কিতাবে ছাপা হয়েছে এই বাণী?ʼʼ
মেঘালয়া প্রতিবাদ করে ওঠে, “আপনার মতো পানসে তো আর না লোকে। অন্তত আমি তো মোটেই না। ওয়েট ওয়েট.. নিজে তো বাইরে বের হওয়ার সময় সাহেব সেজে বের হন। ছোটোবেলার থেকে অত্যাচার করে যাচ্ছেন, এটা করতে পারবা, সেটা করা যাবে না..
কথা ফুরোলো না। ইরাজের গম্ভীর মুখের দিকে চোখ যেতেই থেমে গেল মেঘালয়া। ইরাজ তীর্যক দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে মেঘালয়ার চোখের দিকে। মেঘালয়া এলোমেলো হয়ে উঠল। সে ইরাজের সম্মুখে আবারও অভিযোগ করে উঠেছে, যদিও কথাগুলো সে জটিল কিছু ভেবে বলেনি। কিন্ত ইরাজ তো বাঁকা! ইরাজ ভ্রু উঁচিয়ে আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল, “এরপর?ʼʼ
মেঘালয়া মাথা নত করে নিলো। ইরাজ আবার বলল, “কন্টিনিউ! আর কী কী করেছি, বল? আমারও মনে নেই অত, বল শুনে মনে করি।ʼʼ
মেঘালয়া মুখ খোলার আগেই ইরাজ হনহন করে বাথরুমের দিকে চলে গেল। মেঘালয়া হতাশ এক শ্বাস ফেলল।
চলবে..
#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
২১.
অতিথিদের বিদায় দিতে সন্ধ্যা হলো। তারা আজই ধেখল ইরাজের বউকে। মেঘালয়ার জন্য কিছু উপহারও এনেছে বটে, তবে সেটা খুলে দেখার অবকাশ পায়নি মেঘালয়া। ইরাজ সেই সকাল থেকে এখনও অভুক্ত। আনতারা খানম নিজের ব্যস্ততায় সারাদিনে ব্যাপারটি খেয়াল না করলেও, এবার চিৎকার করা শুরু করলেন। তবে সেটার অধিকাংশ দোষটাই বেঁকে গিয়ে পড়ছে মেঘালয়ার উপর। সে তার স্বামীর যত্ন নেয় না! মেঘালয়া শুনেও কোন জবাব দিল না।
কেবল টেবিল থেকে খাবার বেড়ে নিয়ে উপরে চলে গেল। সে জানে, ইরাজ কেন খায়নি। হাতের ক্ষত ডানহাতের তালু জুরে। সেখানে চামচ দিয়ে খাওয়ারও উপায় নেই। আনতারা খানম জানেন না এ বিষয়ে। ইরাজ বিশেষ প্রয়োজন মনে করেনি তাকে জানানোর। শুধু শুধু উত্তেজিত হয়ে পড়বে।
মেঘালয়া রুমে এসে দেখল, ইরাজ রুমে নেই। খাবারের প্লেটটি টেবিলের উপরে রেখে, বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল ইরাজের পেছনে। মেঘালয়া অবিশ্বাস্য নজরে তাকায়— ইরাজ আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে কেবল। হাতে সিগারেট নেই। কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করল যেন! ইরাজকে সিগারেট খেতে দেখলে সে নিজের ভেতরে অদ্ভুত এক চাপ অনুভব করে আজকাল। মেঘালয়া মৃদূ স্বরে ডেকে বলল, “খাবার এনেছি।ʼʼ
“রেখে দে। পরে খেয়ে নেব।ʼʼ
“উহু, এক্ষুনি।ʼʼ
ইরাজ দেহ সামনে রেখে কেবল ঘাঁড়টা ঘুরিয়ে তাকাল, “বাধ্যতামূলক?ʼʼ
“অনেকটা তাই-ই।ʼʼ
ইরাজ, এর পরিবর্তে কোন কঠিন কথা না বলে বরং নিজের অপারগতা প্রকাশ করল, “হাতে খেতে পারব না, আম্মা খাইয়ে দিলে খাচ্ছি, রেখে দে।ʼʼ
মেঘালয়া বিষ্মিত হয়। সে ইরাজকে খাওয়ার বাধ্যতা দিয়েছে, অথচ তার পরিপেক্ষিতে ইরাজের এমন শান্ত উত্তরে মেঘালয়া ভড়কে গেল। সে যা বলতে চাইছে, তা মুখে এসেও আটকে যাচ্ছে বারবার। সংকোচবোধটুকু কাটিয়ে উঠতে পারছে না মেঘালয়া। একসময় ইতস্তত করে বলে ফেলল, “আমি খাইয়ে দিই, যদি আপনার আপত্তি না থাকে!ʼʼ
ইরাজ কিছুটা সময় নিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। কিছু না বলে বরং নিঃশব্দে রুমে গিয়ে সোফার উপরে বসল খাবারের সম্মুখে।
মেঘালয়া খাবার তুলে মৃদূ কাঁপা হাতে ইরাজের সম্মুখে ধরে। তার ছোট্ট হাতের ছোটো এক লোকমা খাবার ইরাজ মুখে তুলে নেয়। মেঘালয়ার হাত তো কাঁপছে মৃদূ, তবে তার বুকের কম্পনে সে যে আন্দোলিত হয়ে উঠছে প্রতিক্ষণে, তা কী বুঝল সামনের অভিমানী, ত্যাগী পুরুষটি! অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে ক্রমশ ভেতরটা মেঘালয়ার। ইরাজ নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় খেয়ে যাচ্ছে। মেঘালয়ার নিরব ছটফটানি হয়ত তার বুঝি দৃষ্টিগোচর হয়নি? মেঘালয়ার মস্তিষ্কের সংবেদনশীল জায়গাগুলো বিভিন্ন রকম বার্তা জানিয়ে যায় তাকে— সামনে বসে থাকা এই পুরুষটি তার স্বামী এবং তারই গালে আজ সে খাবার তুলে দিচ্ছে নিজ হাতে। চোখটা বুজে ফেলল। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে তর ক্রমশ। আগে ইরাজের সম্মুখে আসলে এমন হতো না। তবে আজকাল হয়! আড়ষ্টতা হানা দেয় বড্ড।
“এক প্লেট খাবার কী সারারাত ধরে খাওয়ানোর পরিকল্পনা আছে, তোর? দিচ্ছিস মিনিট বিশেক পর পর এক লোকমা! বেশি করে দে, পাখির আহার করাচ্ছে যেন!ʼʼ
ইরাজের বিরক্ত হয়ে দেওয়া ধমকে মেঘালয়া চোখ তুলে তাকাল। আবার সঙ্গে সঙ্গে নজর নত করে যথাসম্ভব বড়ো এক লোকমা তুলে ইরাজের সামনে ধরলে ইরাজ তা নেয়। তার কাঁপা হাতে দেওয়া খাবারের অনেকটা ঠোঁটের আশেপাশে লেগে গেছে ইরাজের। তা দেখে এক অদ্ভুত কাজ করে বসল মেঘালয়া। চট করে শাড়ির আচলটা তুলে ইরাজের মুখটা মুছিয়ে দিল।
ইরাজ শান্ত নজর মেলে তাকালে দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। মেঘালয়ার নিজের কর্ম মনে পড়ে বড্ড অপ্রস্তত হয়ে উঠল। ইরাজের ওই দৃষ্টি যা বলছে, তাতে আরও ছটফটিয়ে উঠল মেঘালয়া। ইরাজের দৃষ্টিতে স্পষ্ট আক্রোশ। যেন ডেকে বলছে, আজ এভাবে যত্ন করছিস আমার, এক সময় মরণসম যন্ত্রণা দিয়েছিস এই তুই-ই, মেঘ!
মেঘালয়ার আস্তে করে মাথাটা নত করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ভাবছেন?ʼʼ
ইরাজ ওর নত মুখটার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে জবাব দেয়, “ভাবছি না।ʼʼ
“অতীতে ডুব দিয়েছেন!ʼʼ
“না চাইতেও।ʼʼ
“ভুলে যাওয়াও তো যায়!ʼʼ
“চেষ্টা করিনি কখনও।ʼʼ
“পুষে রেখেছেন কেন?ʼʼ
“ভুলে গিয়ে কী হবে?ʼʼ
মেঘালয়া চোখ তুলে তাকাল। আর বসে থাকা সম্ভব হলো না তার। বাকি খানিকটা খাবার সহ প্লেট নিয়েই উঠে চলে গেল রুমের বাইরে। ইরাজ অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মেঘালয়ার চঞ্চল পায়ে উঠে চলে যাওয়ার পানে। ইরাজের সেই নজরে মিশে আছে— অল্প প্রাপ্তির আনন্দ, অজানা তৃপ্তি, এক অদম্য দৈহিক চাহিদা আর খানিকটা বিষাদ!
—
ঘড়িতে রাত বারোটা। বিছানা ঠিকঠাক করে দিয়ে মেঘালয়া ইরাজকে ডাকার উদ্দেশ্যে ইরাজের দিকে তাকাল। দেখল— ইরাজ হাতের ক্ষতর দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বসে আছে। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “ব্যাথা করছে হাতে?ʼʼ
ইরাজ তাকাল, “হু।ʼʼ
মেঘালয়া হেঁটে গিয়ে বসল পাশে। চট করে ইরাজের হাতটা ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। ইরাজ চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায় মেঘালয়ার দিকে। মেঘালয়ার সেসবে তোয়াক্কা নেই। সে বরং ইরাজের হাতের ক্ষততে মনোযোগী। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “দা’তে কেটেছে বুঝতে পারছেন? মরিচা থাকলে সমস্যা হতে পারে। আমি দেখছি কোন ব্যথার ওষুধ আছে কি-না রুমে!ʼʼ
বলেই উঠতে উদ্যেত হলো মেঘালয়া। ইরাজ হাত চেপে ধরে মৃদূ টান দিলে অগত্যা ধপ করে বসে পড়ে। ইরাজ ভারী আওয়াজে বলে উঠল, “তুই এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন! বাদ দে। এসব যত্ন-ফত্ন সইবে না আমার নষ্ট শরীরে।ʼʼ
মেঘালয়া ইরাজের দুর্বোধ্য চোখে চোখ রেখে বলল, “আপনার নষ্ট হওয়ার কারন যদি আমি হই, তবে তা সারিয়ে তুলতে আমার বিকল্প নেই।ʼʼ
ইরাজ হাসল, “সারিয়ে তোলার চেষ্টা কেন? সহানুভূতি?ʼʼ
“আপনি অবুঝ!ʼʼ
“হু, যেমন তুই ছিলি।ʼʼ
“শাস্তি দিচ্ছেন?ʼʼ
“উহু, আরেকবার নিজেকে দুর্বল করতে চাইছি না।ʼʼ
হুট করে মেঘালয়া বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। ইরাজের কলারের প্রান্ত চেপে ধরে ইরাজকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। অস্থির স্বরে বলে উঠল, “এভাবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে কী প্রমাণ করতে চান? আপনি ব্যর্থ প্রেমিক? আর আপনার অপরাধী আমি? এত অভিমান? এত ত্যাগ? সকল পুরুষই কী এমন অভিমানী হয়? কিসের ক্ষোভ পুষে রেখেছেন নিজের মাঝে? যেখানে আজও অন্যের দ্বারা পাওয়া আমার খানিকটা আঘাত সহ্য করতে পারেন না, সেখানে নিজে কেন আক্রোশ আর অভিযোগ পালছেন আমার জন্য? কী করেছি আমি?ʼʼ
মেঘালয়ার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল এ পর্যায়ে। আরও অনেক কিছু বলতে চেয়েও পারল না। ইরাজ অদ্ভুত কণ্ঠে আস্তে করে বলল, “তুই নিজের ওপর থেকে আমার অধিকার কেড়ে নিয়েছিস। তুই আমার সত্তাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিস। তুই নিজের মনে অন্য কারও কলঙ্ক ছেপেছিস, হোক সেটা সত্য বা মিথ্যা। তুই আমায় গলা কাটা কবুতরের মতো ছটফট করিয়েছিস রাতের পর রাত।তোকে দেখলে আজ কেবল যন্ত্রণা অনুভূত হয়। মিশ্র এক যন্ত্রণা! তা কেমন যন্ত্রণা, আমি আজকাল নিজেও বুঝতে পারি না। কোন কিছুর হাহাকার, নিদারুন শূন্যতার যন্ত্রণা।ʼʼ
মেঘালয়ার চোখ চিকচিক করে উঠল। কম্পিত স্বরে জোর দিয়ে বলল, “তাহলে তো আমার শাস্তি কোনদিন শেষ হবে না নিশ্চয়ই! অথচ আমি আর নিতে পারছি না, এক মুহূর্তও না। আপনি থাকুন আপনার অভিযোগ আর যন্ত্রণা গুলোকে আঁকড়ে ধরে, আমি নিজেকে নিয়ে একাই চলার রাস্তা দেখি।ʼʼ
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় মেঘালয়া। উত্তেজিত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে অগ্রসর হয়। পেছন থেকে ইরাজ উঠে গিয়ে খপ করে মেঘালয়া চুলে মুঠি চেপে ধরল। ঘুরিয়ে নিল নিজের দিকে। চোখ লাল হয়ে আছে ইরাজের। মুখের কাঠামো শক্ত। মেঘালয়া চোখ বুঁজে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। শ্বাসগুলো স্রোতের মতো তেড়ে এসে ধাক্কা খায় ইরাজের বুকে। দাঁতের মাড়ি চেপে বলল ইরাজ, “বিছানায় যা।ʼʼ
মেঘালয়া বিষ্মিত হলো হঠাৎ-ই এমন কথায়। রুষ্ঠ নজরে তাকাল ইরাজের দিকে, “বিছানায়? কেন? ঘৃনা লাগবে না আপনার? অপনার তো আমার স্পর্শেও গা পুড়ে যায়? ছাড়ুন, নয়ত হাতটাও জ্বলে যাবে।ʼʼ
মেঘালয়া ছাড়া পেতে ছটফটিয়ে উঠল। ইরাজ আরও শক্ত করে হাতটা চেপে ধরে বলল, “কথা কম বল। যা বললাম, কর। জবরদস্তি করলে ব্যাপারটা ভালো দেখাবে না।ʼʼ
মেঘালয়া খানিক অবাক হয়ে বলল, “জবরদস্তি মানে?ʼʼ
ইরাজ চোখ রাঙিয়ে উঠল, “ছটফট না করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়।ʼʼ
মেঘালয়া নাকের পাটা ফুলিয়ে অভিমানী স্বরে বলে উঠল, “কোন প্রয়োজন হবে না তার। এতদিন যেমন সোফায় থাকতে পেরেছি, আজ বিশেষ কোন সমস্যা হতো না থাকতে। তবে আমি আর এ রুমেই থাকতে ইচ্ছুক নই। তাই সোফা হোক বা বিছানা; যায় আসে না।ʼʼ
ইরাজ চোখ বুজে শ্বাস ফেলল কয়েকটা ঘন ঘন। অতঃপর চোখ খুলে মেঘালয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “একবার যখন আমার নামের সঙ্গে জড়িয়েছে তোর জীবন, এবার ভালো থাক বা শাস্তিতে; আমাকে এড়িয়ে চলার সাধ্য তোর নেই। সে সুযোগ ইরাজ তোকে কোনদিন দেবে না।ʼʼ
“তবে কী প্রতি মুহূর্তে আপনি এভাবে শাস্তি দেবেন আমায়, আর আমি সয়ে যাব?ʼʼ
ইরাজ আস্তে করে সামান্য ঝুঁকে মেঘালয়ার কাধ অবধি মুখ নামিয়ে নিয়ে এলো। মেঘালয়ার ঘাঁড়ে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা চুলের মাঝে নাক ঘষে নিভু স্বরে বলল, “আমি যদি শাস্তি দেই, তোকে অবশ্যই সইতে হবে। এবং সয়ে এখানেই থাকতে হবে।ʼʼ
মেঘালয়ার কানে কথাটা পৌঁছেছে কি-না কে জানে! সে বরং বিষ্ময় ও আড়ষ্টতায় একাকার হয়ে টান হয়ে দাঁড়াল। শিউরে উঠল পুরো শরীর। আস্তে করে কেবল বলল, “থাকব না আপনার সাথে। থাকুন আপনি আপনার..
কথা শেষ করতে দিল না ইরাজ। ঘাঁড় থেকে মুখ তুলে বড়ো দুহাতের আজলায় মেঘালয়ার ব্যথিত মুখটা তুলে নিল। হাতের কাটায় ছোঁয়া লাগাতে নাক কুঁচকে ফেলল। সেই হাতটা আলতো করে শাড়ির ফাঁক গলিয়ে কোমড়ের দিকে পেটে রাখল। মেঘালয়া চোখ জোড়া চেপে বুজে নেয়। ভারী শ্বাস ওঠা-নামা করে বুকে। ইরাজ ওভাবেই বামহাতের তর্জনী আঙুল চেপে ধরল মেঘালয়ার ঠোঁটে। নিমেষেই মিইয়ে যায় মেঘালয়া। ইরাজ আবারও বলে উঠল, “বিছানায় যাবি, নাকি তুলে নিয়ে যাব?ʼʼ
মেঘালয়ার কিছু বলতে চায়। ইরাজ আরও খানিকটা চেপে ধরল আঙুলটা। দাঁত চেপে মৃদূ আওয়াজে বলল, “চুপ! তোর পুরুষ মনে হয় না, আমাকে? তুই শাড়ি পরে ঢং করে ঘুরে বেড়াবি আমার সামনে, গালে তুলে খাইয়ে দিবি পাশে বসে, আবার দরদ দেখাতে আসবি.. আমি কী নিজের মস্তিষ্ককে বেধে রাখব দড়ি দিয়ে? কে বলেছিল শাড়ি পরতে তোকে? বেসামাল হয়ে গেছি, এবার সামলা আমায়! নাকি এ দ্বায়ভার আর কারও ওপর চাপাব?ʼʼ
মেঘালয়া কথাটা বুঝতে পেরে নাক ছিটকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বিরবির করে বলে ওঠে, “ছিহঃ অশ্লীল!ʼʼ
ইরাজের মুখে দুষ্ট হাসি ফুটে ওঠে। ওভাবেই পেছাতে পেছাতে নিয়ে গিয়ে মেঘালয়াকে বিছানার সঙ্গে ঠেকাল। মেঘালয়ার চোখে-মুখে ভীতি। বাঁধা দিতে গিয়ে, তবুও বাঁধা দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে ইরাজ যে কথা বলেছে, তাতে কোন স্ত্রী-ই হাজার ভয় বা কষ্ট হলেও নিজের স্বামীকে বাঁধা দেবে না!
মেঘালয়া বিছানাতে অর্ধশোয়া। ইরাজ মেঘালয়ার ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, “যেকোন ভাবে যখন বউ হয়েছিস! আমি অস্থির হলে শান্ত করার দায়িত্বটুকু তো তোকেই নিতে হবে। গেট রেডি!ʼʼ
চলবে..