অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-১০+১১

0
1070

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১০.

ইরাজ ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে রইল নির্বিকার চিত্তে। আনতারা খানম থমথমে চেহারা, অপ্রসন্ন নজরে পরখ করে দেখলেন মেঘালয়ার আপাদমস্তক। চরম অনীহার সঙ্গে ওকে উপেক্ষা করে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন ইরাজের পাশে। মেঘালয়া মুখটা ছোটো করে মাথাটা নত করে নিলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলো। এরই মাঝে ইরাজের চড়া কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,

‘মেঘ!’

মেঘালয়া খানিক সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তবে পিছনে ফিরল না। ইরাজ স্বাভাবিক স্বরেই আদেশ করল,

‘আব্বুকে ডেকে নিয়ে আয়, জলদি যা।’

মেঘালয়ার ভিতরে তোলপাড় চলছে। যা শুরু হয়েছে আনতারা খানমের চোখে ভেসে থাকা আক্রোশের আগুন থেকে। ইরাজের কথা অমান্য করে এবার আর তামাশা বড়ো করতে চাইল না মেঘালয়া। এমনিতেই এ বাড়ির এমন কঠোর নিরবতা ওর চঞ্চলতা কেঁড়ে নিতে যথেষ্ট। হাতে থাকা ফুসকার প্যাকেটটি পাশে রেখে ইমতিয়াজ সাহেবের রুমের দিকে অগ্রসর হলো।

আনতারা খানম বসলেন ছেলের মুখোমুখি। খানিক বাদে ভরাট গম্ভীর গলায় বললেন, ‘রাজ! তুই কি মেনে নিয়েছিস পরপুরুষের সঙ্গে ভেগে যাওয়া ওই মেয়েটিকে?’

ইরাজ চেপে চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। ভারী এক ঢোক গিলে, চোখ খুলে তাকাল। শান্ত স্বরে বলল, ‘আমার চেয়ে সম্মানের পরোয়া তুমি বেশি করো, মম!’

‘মম’ ডাকটা ইরাজ ছোটো বেলা থেকেই ক্ষেপে গেলে বা অসন্তুষ্ট হলে ডাকে। আর ইমতিয়াজ সাহেবকে ড্যাড ডাকে যতক্ষন মনটা ভালো থাকে। তা আনতারা খানম বেশ জানেন। ইরাজের ‘আম্মা’ ডাকে মধু মিশ্রিত থাকলেও, ‘মম’ ডাকে আনতারা খানম কেবলই ছেলের সঙ্গে নিজের দুরত্বের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পান। আচমকা তাকালেন তিনি ছেলের দিকে। চোখে চোখ পড়ে যায়। ইরাজ অদ্ভুত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে তারই দৃষ্টি বরাবর। আনতারা খানম কিছু বলার আগেই ইরাজ বলল,

‘কদিন আগে বিয়ে করে বউ ঘরে তুললাম, তারপর কোমরে লাথি দিয়ে সেই বউ বিদায় করব। লোকে কারন জানতে চাইলে বলব, বউ লোকের সাথে ভেগে গিয়েছিল। তা অবশ্য জানতাম আগে, তবে খারাপ লাগাটা বিয়ের পর কাজ করেছে তাই বউ বাড়ির বাইরে। ঠিক আছে না মম?’

আনতারা খানম চাপাস্বরে অভিযোগ করে, ‘তোরা বাপ-ছেলে জানলেও আমি জানতাম না। আর জানলে..

কথা শেষ করতে না দিয়ে ইরাজ বলে উঠল, ‘এজন্যই জানানো হয়নি তোমায়। রাত দুটো পার হয়ে যাচ্ছে। খাবার দেবে অথবা আমি রুমে যাব!’

আনতারা খানম ছেলের গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। বুঝতে চেষ্টা করলেন ছেলের ভেতরে প্যাচ লেগে থাকা জটিলতাকে। বরাবরের মতোই ব্যর্থ তিনি।

ইমতিয়াজ সাহেব এসে বসলেন চেয়ারে। যে কারনে মা-ছেলের আলাপে সমাপ্তি ঘটে। তাকে দেখেই আনতারা খানমের মুখ শক্ত হয়ে ওঠে। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কাজের ব্যস্ততা দেখালেন। মেঘালয়া পেছন থেকে চলে যেতে নেয়। তখনই ইরাজ ডেকে উঠল,

‘এদিকে আয়।’

মেঘালয়া নিচু স্বরেই দিল, ‘ক্ষুধা নেই তেমন। আ তাছাড়া..

ইরাজ মেঘালয়ার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালে, মেঘালয়া কথার মাঝেই চুপ হয়ে গেল। ইরাজ ঘাঁড় ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোকে এদিকে আসতে বলেছি। তুই ক্ষুধার ফিরিস্তি শোনাচ্ছিস কোন সুখে?’

সেসময় ইমতিয়াজ সাহেব ধমকে উঠলেন, ‘মেঘা! ক্ষুধা নেই এটা কেমন কথা? আর ক্ষুধা না থাকলেও খেয়ে ঘুমাবে। এদিকে এসো।’

মেঘালয়া অগত্যা এসে দাঁড়াল সেখানে। আর তখনই আনতারা খানম এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন। মেঘালয়া এসে দাঁড়াতেই তিনি সকলকে উপেক্ষা করে হনহন করে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। ইমতিয়াজ সাহেব কেবল এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেঘালয়া মাথাটা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। ইরাজ আচমকা ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। মুখ-চোখ শক্ত করে করে ধমকে উঠল,

‘মাঝরাতে ইন্ডিয়ান ড্রামা সিরিয়াল দেখতে টেবিলে বসলাম নাকি? খাবার দিবি তো দে জলদি, বা ল ডা।’

মেঘালয়া দ্রুত ইরাজের দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখল। চোখে-মুখে এক অবর্ননীয় ক্ষুদ্ধতাকে ঠেসে বসে রয়েছে ইরাজ। খাবারের ঢাকনা উঠিয়ে দেখল, দুরকমের তরকারী। সেটা ইরাজের প্লেটে উঠিয়ে দেওয়ার সময় আগে বড়ো চিংড়ি মাছের তরকারীটাই উঠিয়ে দিল। ইরাজ খাওয়া থামিয়ে দেয়। মেঘালয়া একটু থমকে উঠল। না জানি আবার কি কথা শোনাবে। ইমতিয়াজ সাহেব দ্রুত বলে উঠলেন,

‘রাজের এলার্জি আছে পাগলী। চিংড়ির গন্ধও সহ্য করতে পারবে না।’

তিনি একটু ভয় পেলেন। এমনিতেই ছেলের মন মেজাজ ভালো নয়, তা তার অজানা নয়। এখন আবার মেঘালয়াকে উল্টোপাল্টা কিছু বলে না বসে! অথচ এমন কিছুই হলো না। ইরাজ নির্বিকার শান্তভাবে নিজের প্লেটটি বাবার দিকে সরিয়ে দিয়ে, বাবার প্লেট টেনে নিলো। ইমতিয়াজ সাহেব মেঘালয়াকে ইশারা করলেন, অন্য পাত্রে থাকা মুরগীর মাংস ইরাজকে উঠিয়ে দিতে।

আনতারা খানম রুমে এসে ধপ করে বসে পড়লেন বিছানার ওপর। চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। বুকটা আজ কেনো জানি জ্বলছে ভীষন। বুকে হাত রেখে কিছুসময় চোখ বন্ধ করে অনুভব করলেন বুকের জ্বলন। একসময় আবিষ্কৃত হয় তার এই জ্বলন, ইরাজকে হারিয়ে ফেলার ভীতি থেকে জন্মেছে। ইরাজের আগে ও পরে বহুবার গর্ভপাত হওয়ায়, ইরাজ ভাই-বোনহীন একা আজ। ওই ইরাজ যে কতটা দামে কেনা কলিজার একমাত্র রত্ন তা কেবল আনতারাই জানেন। এজন্যই তো ছোটবেলা থেকে ইরাজকে কোনদিন কোনকাজে বাঁধা প্রদান করেননি। যা যখন যেভাবে চেয়েছে ইরাজ কেবল তা হাজির করা হয়েছে ওর সম্মুখে। আজ হঠাৎ-ই সেই ইরাজকে হারানোর আশংকা জেগেছে মায়ের মনে।

ইরাজ কোথায় হারিয়ে যাবে? বউয়ের মায়ায়! মন সায় দেয় আনতারার— একদম তাই। ইরাজ মেঘালয়াকে এ কদিনে আনতারার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। বউয়ের জন্য মায়ের সাথে নিরবে লড়ছে। মেঘালয়াকে যেন আজ তার চেয়েও অধিক প্রাধান্য দিয়েছে ইরাজ! আনতারা খানম হঠাৎ-ই এক ভাবনায় আবারও থমকে উঠলেন, বুকটা ভার হলো। তিনি যখন চলে এলেন ডাইনিং রুম থেকে, তখনও ইরাজ তাকে থামায়নি! গভীর এক ক্ষত অনুভূত হলো বুকের ভেতরটায়। প্রায়প্রিয় পুত্র রত্নকে হারানোর এক নিরব আর্তনাদ বুকটা ছিদ্র করে চাইল যেন!

রুমে এসে রোজকার মতোই সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে বেলকনিতে চলে যায় ইরাজ।

মেঘালয়া বুকে পাথর চেপে আছে। সে আসলেই জানত না সাংসারিক জীবনটা এমন নিষ্ঠুর আর কঠিন। কেমন যেনো লাগছে সবকিছু। এসবের সাথে মেঘালয়া একদম পরিচিত নয়। সে তো আব্বুর কাছে দেবীর মতো ছিল। যাকে আব্বু মুরগীর ডিম থেকে ফোঁটা সদ্যজাত ছানার মতো পাখার নিচে আগলে রেখেছিল। অথচ এই ভালোবাসাকে তাবির বলেছিল— ব্যাটারি চালিত পুতুল। আজ আরও একবার ঘৃনা হলো তাবিরের ওপর। খুব মন চাইল, আব্বু নামক ওই রাগী মানুষটির পাখার তলে গুটিশুটি মেরে আরও একবার আশ্রয় গ্রহন করতে। আবারও আব্বুর পুতুল হয়ে থাকতে। তবে কি মেঘালয়া আসলেই নির্বোধ! নিজের সুখের মহল হারিয়ে এই চারদেয়ালের শশুরবাড়ি নামক নিষ্ঠুর আলয়ে বন্দিনী হয়ে গিয়েছে? কুশনে মুখ চেপে চাপাস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। অস্পষ্ট স্বরে ‘আব্বু’ বলে ডেকে উঠল। ওপাশ থেকে আব্বুর জবাব নেই। খুব জানতে ইচ্ছে হলো, একাকী আব্বুটাও কি এখন এই মাঝরাতে মেঘালয়ার কথা ভেবে ছটফট করছে!

_

সপ্তাহখানেক ওভাবেই কেটে গেছে। এ বাড়িতে নিতান্তই আবর্জনার মতো রয়ে গেছে মেঘালয়া। ইরাজকে বুঝতে পারে না মেঘালয়া। আনতারা খানম সর্বদা মেঘালয়াকে এড়িয়ে নিরবে নিজের দায়িত্ব পালন করেন নিত্যদিন। যেন এ বাড়িতে মেহমান তিনি, কেবলই সবটা দায়িত্ব তার। মন থেকে কিছু করেন না মোটেই।

মেঘালয়াথ রাতে দেরীতে ঘুমানো আজকাল প্রায় অভ্যাসই হয়ে গিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হতে বেলা দশটা বেজে গেল। উঠে দেখল রুমের জানালার পর্দা বাতাসে সরে যাওয়ার কারনে ঘরজুরে সূর্যের ঝাঁঝাল আলোয় মাখামাখি। সে নিজে এবং ইরাজও আলোতে খুব একটা আরামবোধ করে না। একবার তাকাল ঘুমন্ত ইরাজের দিকে। আলোতে নাক ছিটকে চোখ জড়িয়ে বিরক্ত মুখে শুয়ে আছে উপুর হয়ে। নিরস মুখে ইরাজকে দেখে নিয়ে আস্তে করে হেঁটে গিয়ে জানালার পর্দাগুলো টেনে দিল। ঘড়িতে দশটা পার হচ্ছে।

দ্রুত কোনমত চোখে-মুখে পানি দিয়ে নিচে নেমে এলো। রান্নাঘরে এককোনে গিয়ে দাঁড়াল। আনতারা খানম তার সহকারীকে নিয়ে রান্নায় ব্যস্ত। মেঘালয়াকে দেখেও গ্রাহ্য করলেন না। মেঘালয়া কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইল নিরবে। আনতারা খানম কাজের মেয়ে আয়েশাকে কিছু আদেশ করলে, মেঘালয়া ইশারায় আয়েশাকে থামিয়ে দিল। নিজে তা করতে যায়। তখনই আনতারা খানম কঠিন স্বরে বললেন,

‘মেঘা! আদিক্ষেতা দেখিও না তো মা। দেখছ তো সাহায্য করার লোক আছে। আর না থাকলেও আমি নিজের কাজ করে নিতে পারি। উপরে যাও। এ বাড়ির কোনকাজে প্রয়োজন নেই তোমাকে।’

মেঘালয়ার কাছে কথাগুলো বড্ড অগোছালো লাগল। শান্ত শীতল স্বরে প্রত্যাখান জানালেন আনতারা। পা উঠল না তার সেখান থেকে। এই আনতারার নিজের মেয়ে ছিল না। তেমনই মেঘালয়ার মা ছিল না। তবে যতবার, যতক্ষণ সময় মেঘালয়া আনতারা সহচর্যে থাকত, সে কখনোই মায়ের অভাব বোধ করেনি। আজ হঠাৎ-ই ভাবনায় এলো, তবে কি সম্পর্ক বদলেছে! আগে আনতারা মামনি ছিল। আজ কি শাশুড়ি হয়ে গিয়েছে! কয়েক দিনের ব্যাবধানে সবকিছু এভাবে পাল্টে যায় নাকি? আব্বু তবে ঠিকই
বলত— মেঘালয়া দুনিয়াটাকে কিঞ্চিত পরিমাণও জানে না। তবে এখন ধীরে-ধীরে জানতে শুরু করেছে। সেই ভুলে ভরা রাতের পর থেকে মেঘালয়ার জীবনে কেবলই বাস্তবতার কঠোর তাণ্ডব চলছে। আব্বুর কথা মনে পড়ল। দেখতে ইচ্ছে করল মানুষটিকে আজ। বুকে হামলে পড়ে অভিযোগ করতে ইচ্ছে করল,

‘আব্বু! তুমি না মেয়ের ভালোর জন্য সবটা করলে! তবে কেন তোমার মেয়ে একদমই ভালো নেই? শশুরবাড়ি তো ভালো থাকার জায়গা নয়, আব্বু। তার ওপর তোমার মেয়ের করা ভুল পিছুই ছাড়ছে না।’

গলার কাছে আটকে এলো ব্যথাগুলো জড়ো হয়ে। ধীর-স্থির পা ফেলে সেখান থেকে চলে এলো মেঘালয়া। রুমে এসে দেখল ইরাজ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। সেখানেও রোদ। রুমে ফিরে এসে সোফাতে বসল। আজকাল মেঘালয়ার বারবার একই কথা মনে হয়, সেই আহ্লাদী মেঘালয়া খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে অনেক বেশি বড়ো হয়ে গিয়েছে। বুক ফুলিয়ে বড়ো করে এক শ্বাস নেয় সে। যন্ত্রনাগুলো ভেতরে কবর দেওয়ার চেষ্টা করে। হঠাৎ-ই উঠে ইমতিয়াজ সাহেবের রুমের দিকে গেল। তবে ব্যর্থ হলো। তিনি নেই অর্থাৎ আজ হয়ত জরুরি কাজ পড়ায় জলদি বেরিয়ে গেছেন।

আবারও রুমে ফিরে এসে বসে পড়ল সোফায়। অনেকটা সময় কেটে গেল। আনতারা খানম মোটেই ডাকতে এলেন না সকালের খাবারের জন্য। মেঘালয়ারও ক্ষুধা মরে যায়। সে নিস্তব্ধতার চাদরে নিজেকে ঢেকে বসে রইল নির্বিকার বহুক্ষন। বেশ অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর সম্বিত ফিরল। আচমকা উঠে ওয়ারড্রোব থেকে নিজের নিত্য পরিহিত কাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকল।

খুব শীঘ্রই যোহরের আজান হবে। সেসময় ঘুম ভাঙে ইরাজের। উঠে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজের ওপরই বিরক্ত হয় সে। মুখে ‘চ্যাহ’ এর মতো শব্দ করে বসা থেকে দাঁড়াল। নিজের টাওয়াল খুঁজল। পেল না। মেজাজ আরও চটে যায় এবার। বাথরুমের দিকে নজর যেতেই দেখল তা ভেতর থেকে লক করা। এবং সেখান থেকে শাওয়ারের শব্দ আসছে। ভ্রু জড়িয়ে দাঁতে দাঁত পিষে চেয়ে রইল সেদিকে। ভারী পায়ে হেঁটে গিয়ে বাথরুমের দরজায় কষে থাবা মারল। ভেতর থেকে মেঘালয়া চমকে ওঠে প্রথমে। পরে যখন বুঝল, চিৎকার করে বলে ওঠে,

‘কী সমস্যা আপনার? দরজা ভাঙার পরিকল্পনা আছে নাকি?’

ইরাজ চিবিয়ে জবাব দেয়, ‘আমার সমস্যা তুই। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যদি বের না হোস, বিনা পরিকল্পনায় দরজা ভেঙে ফেলব।’

মেঘালয়া চোখ উল্টিয়ে, মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘ভেঙে ফেলুন। বাবাই আবার একটা লাগিয়ে দেবে।’

ইরাজ ক্ষেপে ওঠে এবার, ‘মেঘ! অতিরিক্ত সাহস দেখাবি না মোটেই। বের হলেই তোকে আমার হাতে পড়তে হবে, ডোন্ট ফরগেট ইট।’

‘আপনি কি মূর্খ! ডিগ্রি তো ভালোই অর্জন করেছেন, অথচ মগজ খালি। এখানে ঘুমোতে তো আর আসিনি নিশ্চয়ই! গোসল করতে করতে কি করে বের হওয়া যায়?’ শেষের কথাটা চিল্লিয়ে বলে মেঘালয়া।

ইরাজ দাঁতের মাড়ি শক্ত করে বলে, ‘সেটা তুই ভাব, ড্যাম!’

‘আর কিছুক্ষন লাগবে আমার, ততক্ষণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন বাইরে।’

ইরাজের সচেতন নজরে তাকাল বাথরুমের দরজার দিকে। আচমকা দুটো লাথি বসাল দরজায়। ধমকে ওঠে, ‘জ্ঞান দিচ্ছিস আমায়? এখনই তোকে গোসলে ঢুকতে হলো? জীবনে তো গোসল করতে দেখিনি। আমার বাড়িতে এসে তোর গোসলের শখ হয়েছে, তাও আবার যখন আমি ঢুকব তখন?’

এমন একটা কথার কী জবাব দেবে মেঘালয়া। চুপ রইল।
ইরাজ রুমের মধ্যে পায়চারী করতে শুরু করে। বিরবির করে বলল,

‘বা লে র বিয়ে না করে একটা গরুর খামার দিলেও পারতাম। গরুর দুধ বিক্রি করে বড়োলোক হওয়া যেত। এসব মেয়েলোক ঘরে এনে এক্সট্রা ঝামেলা পোহানোর প্লান কোন শালার মাথায় এসেছিল?’

চলবে…

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১১.

দুপুর প্রায় দু’টোর কাছাকাছি। ইরাজ গোসল শেষে রুমে এসে আয়নার সম্মুখে দাঁড়াল। গলায় টাওয়াল ঝুলছে, অর্ধভেজা চুল, মুখটা মাত্রাতিরিক্ত ভারী লাগছে দেখতে।
মেঘালয়া সবে তৈরী হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। তা দেখে ইরাজ জিজ্ঞেস করল,

‘কোন বাণিজ্যে বের হবি তুই?’

এটা কোন প্রশ্নের ধরন হলো? মেঘালয়া এর চেয়ে বেশি কিছু অবশ্য আশাও করেনা ওই ঘাঁড় ত্যাড়ার কাছে।অসন্তুষ্ট নজরে চেয়ে বলল, ‘আব্বুর কাছে যাব।’

ইরাজ বলল, ‘তো?’

‘আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। আর এর বিপরীতে কোন উল্টোপাল্টা কথা নয়।’

ইরাজ এ পর্যায়ে কিছু বলল না। মাথায় কয়েকবার টাওয়াল চালিয়ে টাওয়ালটা ছুঁড়ে মারল কোন একদিকে। এমন একটা দৃশ্য দেখে, রাগ উঠল মেঘালয়ার। কিছুক্ষন আগে ইরাজের অবুঝের মতো আচরণে এমনিতেই চটে আছে মেঘালয়া। এখন আবার এমন একটা কাজ। প্রায় চিৎকার করেই বলল,

‘আপনি গণ্ডমূর্খের চেয়েও অতি মূর্খ। টাওয়ালটা কোথায় ফেললেন, আর পড়লই বা কোথায়? সারাদিন রুমে থাকি আমি, রুমটাকে গুছিয়ে রাখি আমি। তা লণ্ডভণ্ড করেন আপনি, রুমের দাবিও করেন আপনি। যুক্তির বড়োই অভাব আপনার কর্মকান্ডে।’

ইরাজ ঘুরে তাকায়। ভাবলেশহীনভাবে আবার সামনের দিকে ফিরে তাকিয়ে নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘এক্সাক্টলি। রুমটা তো আমার, অথচ থাকিস তুই। এর ভাড়া তো আর তোর বাপে দেয় না। ভাড়ার বদলে রুমটা গুছিয়ে রাখিস। এ নিয়ে প্যানপ্যান করলে কানটা এক চড়ে গরম করে দেব।’

বলেই বিছানার ওপর থেকে ব্লেজারটা তুলে মেঘালয়ার ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘এটা আয়রন কর।’

মেঘালয়া সেটা হাতে ধরে বলল, ‘পারব না। আমি আপনার বেতনভুক্ত কর্মচারী না। আর আপনার এই মরুভুমি মার্কা বাড়িতে ভাড়া দিয়ে থাকার মতো বোকা আমি নই। আজই যাচ্ছি আমার বাপের বাড়ি।’

শেষের কথাটিতে ইরাজ উপহাস করে হেসে ওঠে। বলল, ‘তা যা। আমার রুম খালি হোক, হাওয়া বাতাস আসুক। তবে এ কদিন যে থেকেছিস বিনা পয়সায়, তার বদলে আমার ব্লেজার আয়রন করে রেখে আস্তে করে চলে যা।’

মেঘালয়া কপাল জড়িয়ে ফেলল। ব্লেজার হাতে নিয়ে ইরাজের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যাচ্ছেন কোথায়?’

‘জবাবদিহি করতে পারব না।’

‘আমিও।’

ইরাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘আমিও কী?’

‘আয়রন করতে পারব না।’

‘সময় খুব কম। কাজ না হলে তোর ঘটে শনি আছে।’

মেঘালয়া বলে উঠল, ‘ শনি থাক অথবা রবি। আমি যাব আপনার সঙ্গে।’

ইরাজ ঘুরে তাকাল। মেঘালয়াকে দেখল পরখ করে। অতঃপর খানিকটা পেছনে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দুপাশে দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি তোর থেকে যথেষ্ট দূরে। তোকে ধরে রেখেছি বলে তো মনে হয় না।’

মেঘালয়া গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। নয়ত কোথাও একা বের হব, যা নয় তা কথা শুনতে হবে। এখন থেকে আপনার সঙ্গে বের হব।’ মেঘালয়ার কথায় চাপা ক্ষোভ ঝরে পড়ে।

ইরাজ তা বুঝেও বুঝল না যেন। উল্টো ওকে খোঁচা দিয়ে বলল, ‘তোর বাপের রাখা রক্ষী আমি তোর?’

মেঘালয়া আওয়াজ সামান্য নিঁচু করে বলল, ‘আপনি কী, তা আপনার নিজের জানা উচিত।’

বলেই ব্লেজারটি নিয়ে আয়রন করতে বসে গেল। ইরাজ বিছানায় বসে রিমোট হাতে তুলে নিয়ে এসির টেমপারেচার কমিয়ে দেয়। চারদিকে গুমোট গরম। পরিবেশ কেমন থেমে আছে। গাছের পাতা ভুলেও নড়ছে না। শান্ত পরিবেশে গরমটা প্রকট লাগছে। ইরাজ অতিষ্ট হয়ে তাড়া দিয়ে বলল,

‘দ্রুত কর, লেইট হচ্ছি আমি।’

মেঘালয়ার কিছুক্ষন ধরেই কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে ইরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আমি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে চাই।’

ইরাজ উপহাস করে, ‘তোর রেজাল্ট কি আসবে কোন আইডিয়া আছে?’

এ কথা শুনে মেঘালয়া থমকে যায়। নিজেও চিন্তিত হয়ে উঠল। ইন্টারমিডিয়েট লাইফটায় সে আসলেই বড্ড অমনোযোগী ছিল। সর্বক্ষন তাবিরের জ্বালাতনে পড়ালেখার মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে এসেছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই ততক্ষনে হাত থেমে গেছে ওর। ইরাজ তাকিয়ে দেখল মেঘালয়ার উদাসীন ভাব। ভেতরে কেন জানি জ্বলে উঠল বোধহয়! ক্ষিপ্র গতিতে দ্রুত পায়ে উঠে এসে তড়াক করে ওর হাত থেকে আয়রন কেড়ে নিল। থাপ্পড় মারার ভঙ্গিতে হাত এগিয়ে নিয়ে যায়। মেঘালয়া চমকে উঠে ঘাঁড় কাঁত করল। ইরাজ কিছু একটা বলে বকে উঠল অস্পষ্ট স্বরে। ব্লেজারটা যদিও পুড়ে যায়নি তবে তা ছুঁড়ে মারল মেঝেতে। তা আর গায়ে চড়াল না। ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,

‘আমার কোন কিছুতেই তুই মনোযোগ দিতে পারিস না, না? আমি তোর কাছে চিরদিন গুরুত্বহীনই থেকে গেলাম?
বা লে র একটা ছোট্র কাজ দিলাম, তার মধ্যে অন্য ভাবনার সাগরে ডুব দিয়েছিস? ডুবে মরে যাসনি?’

বলেই শার্ট তুলে কাঁধে চড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। মেঘালয়া কেবল মেঝের দিকে চেয়ে রয় নিরবে। ইরাজ কি বুঝাতে চায়! ইরাজ কি চায়! ইরাজ আচমকা ক্ষেপে ওঠে, কখনও স্বাভাবিক, কখনও দুষ্ট তো কখনও কেমন জটিল হয়ে ওঠে। এতসবের মাঝে মেঘালয়ার নিজেকেই কেমন উন্মাদ উন্মাদ লাগে। ক্ষুধাও লেগেছে এবার। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। আর বসে রইল না, রুম থেকে বেড়িয়ে ডাইনিং রুমে এলো। ততক্ষনে ইরাজ আপন মনে খেতে বসেছে। তবে আজ আরআনতারা খানমকে প্রতিদিনের মতো পাশে দাঁড়িয়ে আহ্লাদের সঙ্গে ইরাজকে খাওয়াতে দেখা গেল না। মেঘালয়া এসে দেখল, খাবার সব সাজিয়ে রাখা আছে। সে দীর্ঘশ্বাসটুকু গোপন করে নিরবে খেতে বসল।

গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। ইরাজের চেহারা গুরুগম্ভীর। স্থির চোখদুটো সামনের গাড়ির কাঁচ ভেদ করে রাস্তা মেপে গাড়ি চালনায় ব্যস্ত। মেঘালয়া দেখল, ইরাজ ওদের বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরিয়েছে। আর চুপ করে থাকা হলো না। জিজ্ঞেস করল,

‘এদিকে কেন? আব্বু তো এখন অফিসে..

ইরাজের কথায় থেমে গেল, ‘আজ বাড়িতে আছে।’ সংক্ষিপ্ত জবাব। শীতল স্বর। মেঘালয়া একবার তাকাল ইরাজের দিকে। দেখে মনে হচ্ছে যেন এই মুহূর্তের সকল মগ্নতা ড্রাইভিংয়ে। অথচ মেঘালয়ার অন্য কিছু মনে হয়। যেন ইরাজ কোন এক অজানা উদাসীনতায় বুদ হয়ে আছে।

মেঘালয়াদের বাড়ির সম্মুখে এসে গাড়ি থামল। মেঘালয়া নিঃশব্দে নেমে দাঁড়াল। তবে ভেতরে যেতে অগ্রসর হলো না, আর না ইরাজ গাড়ি স্টার্ট করল। সামান্য কিছুসময় দুজনেই নিরবতায় কাটিয়ে, তা ভঙ্গ করতে চায় মেঘালয়া। ঠোঁট দিয়ে অপর ঠোঁট চেপে ধরল। কিছু বলার জন্য হাঁ করেও আবার থেমে যায়। ইরাজ অদ্ভুত আওয়াজে জিজ্ঞেস করে ওঠে,

‘একা ফিরতে পারবি?’

মেঘালয়া পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকাল ইরাজের দিকে। ইরাজও ঠিক ওই মুহুর্তে ওর দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যায় অপরিকল্পিত ভাবে দুজনের। মেঘালয়া দ্রুত চোখের নজর নত করল। আস্তে ধীরে দু’দিকে ঘাঁড় নাড়ল। ইরাজ আচমকা শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করে ধমকে ওঠে,

‘একা বাড়ি ছেড়ে পালাতে পারিস, তবে একা ফিরতে পারিস না। ন্যাকামি!’

মেঘালয়া অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় জিজ্ঞেস করে ওঠে, ‘এ কথা আর কতদিন শোনাবেন?’

দৃঢ় কণ্ঠে জবাব এলো, ‘আজীবন।’

মেঘালয়া সচকিত হয়। খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো এ মুহূর্তে, তাহলে কি আজীবন সঙ্গে রাখবেন! অন্তত এ কথা শোনানোর জন্য হলেও!

মুখে বলতে পারল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল দুপুরের তেজ্বী সূর্যের তীর্যক তাপময় আলোর নিচে। ঘেমে উঠছে শরীর, তবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে যেন! ইরাজ আদেশ করল, ‘যা ভেতরে যা।’

বলেই আবার কিছু মনে করার ভঙ্গিতে বলল, ‘আর তোর পাঠ্যবই গুলো সঙ্গে নিবি।’

মেঘালয়ার মস্তিষ্কে কথাটা পৌঁছাতেই একটু চমকাল, সঙ্গে সঙ্গে আবার মনটা খুশিতে নেচে উঠল যেন। দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে তাকাল ইরাজের দিকে। সে গাড়ি স্টার্ট করতে ব্যস্ত। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করে,

‘কখন আসবেন আপনি?’

ইরাজ সামনের দিকে তাকিয়েই জবাব দিল, ‘এসে কল করব তোর বাপের বাড়ির নাম্বারে।’ বলে আর দাঁড়াল না। মেঘালয়াকে ফেলে, গাড়ি এগিয়ে চলল সামনের দিকে।

_

বিকেলের দিকে প্রকৃতি বেশ অশান্ত হয়ে উঠেছে, চারদিকে বয়ে যাওয়া বাতাস জানান দিচ্ছে ঝড় না হলেও অন্তত বৃষ্টি হবেই। সেই সঙ্গেই আব্বুর সম্মুখে মেঘালয়া চোখ দুটোও যেন শ্রাবনের আকাশে মেঘ ঝরা বাঁধাহীন বৃষ্টির মতো বর্ষনে ভিজে উঠেছে। দুজনের মান-অভিমানের পালা ভেঙে এবার যেন অভিযোগগুলো উঠে এসেছে সম্মুখে। বাবা তো অভিযোগ করতে জানে না সন্তানের সম্মুখে। তাই মেঘালয়ার মুখেই ফুটে উঠল, অনুযোগের সুর,

‘আব্বু! ভুল কি কেবল তোমার মেয়েই করেছে? তোমার মেয়ের আব্বু করেনি?’

পাগলি মেয়ের এমন সরল অভিযোগে বাবার বুকটা ভিজে যায় নিমেষেই। সজল চোখে চেয়ে রইলেন কেবল হেলাল সাহেব মেয়ের ফুলো চোখদুটোর পানে। তার ছোট্র মেঘালয়া আজ শশুরবাড়ি থেকে এসেছে, তাও আবার শশুরবাড়ির নামে নালিশ জানাতে। ভাবতেই বুকে চাপ অনুভূত হলো। তিনি একদম চাননি তার সাজানো পুতুলটিকে নিজের থেকে দূর করতে। তবে পরিস্থিতি তো সায় দিল না সেদিন এ চাওয়াতে। তার বাড়ি জুরে তরতর করে আহ্লাদি পা ফেলে চষে বেড়ানো মেঘালয়া আজ অন্যের বাড়ির বউ!

মেঘালয়া ভেজা স্বরে আবারও বলে উঠল,

‘আব্বু! মামনি কবে যেন মামনি থেকে শাশুরি হয়ে উঠল! আজ আমি তার কাছে, তার বাড়িতে অবস্থানকারী এক অপ্রিয় সত্য। যা সে পারছে না উগরে ফেলে দিতে, গ্রহন করতে তো মোটেই পারছে না। তুমি কি ভুল সিদ্ধান্ত নাও নি– ও বাড়িতে বিয়ে দেওয়ার কথা ভেবে? তুমি মেয়ের সুখের নেশায় মেয়েকে ছোটো করে তোলো নি? যে ভুল আমি আগে তোমার সঙ্গে করেছি, তা তুমি সুধরাতে গিয়ে পুনরায় আমার সঙ্গে করেছ, আব্বু!’

মেয়ের বুকে যে অন্তহীন চাপা আর্তনাদের স্তর জমেছে তা বেশ বুঝলেন হেলাল সাহেব। এ ব্যাপারে তিনি আন্দাজ সেদিনই করেছিলেন, যেদিন আনতারা খানম এখানে এসেছিল এবং তিনি আনতারার চোখে মুখ-চোখে অপ্রসন্নতার ক্ষোভ লক্ষ্য করেছিলেন। আজ সত্যিই তিনি বাকরুদ্ধ। মেয়ের অভিযোগের বিরুদ্ধে, নিজের পক্ষে সাফাই দেওয়ার মতো উপযুক্ত যুক্তি নেই তার কাছে।

_

আকাশ সেই বিকেল থেকে মেঘাচ্ছন্ন। তুলনামূলক তাড়াতাড়িই আজ বেড়িয়ে পড়ল ইরাজ অফিস থেকে। তাছাড়া মেঘালয়াকেও পিক করতে হবে। রাত আটটার বেজে গিয়েছে। ইরাজ রাস্তায় বেরোনোর কিছুক্ষণের মাঝে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল জমিনে। তার মাঝেই গাড়ি চালিয়ে সে মেঘালয়াদের বাড়ির রাস্তার দিকে অগ্রসর হয়। ক্রমেই বৃষ্টির ফোঁটা ভারী হতে লাগল। সাথে বাতাসও প্রবল বেগে বেড়ে গেল যেন! প্রায় এক তাণ্ডবপূর্ন ঝড়ের রূপ নিলো আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের রাশিগুলো।

এই দুর্যোগের মাঝে গাড়ি চালাতে চালাতে মেঘের এই প্রলঙ্কর রূপের কথা মাথায় আসতেই, মেঘালয়ার মুখটা স্মৃতিতে ভেসে উঠল এক পলকের জন্য। ইরাজ একটু বিভ্রান্ত হয়ে ওঠে যেন! মেঘালয়া তার জীবনে অমাবস্যার রাতে এক খণ্ড মেঘ। তাইতো ইরাজ সর্বদাই মেঘালয়াকে ‘মেঘ’ বলেই সম্বোধন করে; সকলে যেখানে ছোটো করে মেঘালয়া বলে থাকে। বুকের ভেতরে সূক্ষ্ম ছিদ্রক ব্যাথারা নেচে উঠল যেন! মেঘ! এই এমনই তাণ্ডব চালিয়িছে তার জীবনে মেঘালয়া। ইরাজ নামক শান্ত প্রকৃতিকে অশান্ত, অস্থির, বিক্ষিপ্ত করে তুলেছে বারবার। জানায়-অজানায় বারবার আঘাত করেছে!

এসব ভাবতে ভাবতে এসে পৌঁছাল মেঘালয়াদের বাড়ির সম্মুখে। বিদ্যুতহীন অন্ধকারচ্ছন্ন এলাকা। মাঝেমধ্যে মেঘে মেঘে ঘর্ষনে বিদ্যুতের ঝলকানি আকাশকে বিদীর্ণ করে পৃথীবিকে ক্ষণিকের জন্য আলোকিত করে তুলছে। এরই মাঝে একবার চোখ তুলে তাকাল মেঘালয়াদের সাদা বিল্ডিংটির দিকে। তৎক্ষনাৎ চোখ ফিরিয়ে নিলো। বুকের তিরতিরে ব্যথাগুলো সায় দিল না মেঘালয়াকে কল করতে। বাড়ির গেইট ভেতর থেকে আটকানো। এ ঝড়ের মাঝে ডাকলে লাভ হবে না।

গাড়ি ছেড়ে বাইরে বের হয়ে দাঁড়াল ইরাজ। মুহূর্তেই বৃষ্টির ঝাপটা ভিজিয়ে দেয় ইরাজকে। গাড়ি থেকে একটু সরে গিয়ে গাড়ির সম্মুখে গিয়ে ফাঁকা রাস্তার মাঝখানে হাত ছড়িয়ে দাঁড়াল। ওই কালো মেঘের ঘনঘটা থেকে ঝরে পড়া বারিধারা ইরাজের সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে, ইরাজকে ছুঁয়ে ধুয়ে গড়িয়ে পড়ে জমিনে। ইরাজ চোখদুটো আবেশে বুজে নিলো। ওর ব্যাথাময় মেঘে বৃষ্টি হয়ে ওর শরীরে ঝরে পড়ে। আশপাশে খেয়াল করে দেখল, মেঘের বর্ষন শুধু ওকেই নয় বরং আশপাশের সকল বস্তুকেও ভিজিয়ে তুলেছে। বিষাদের হাসি ফুটে ওঠে ইরাজের ঠোঁটে। মেঘের বর্ষনে শুধু ইরাজই নয়; আশেপাশের বস্তদ্বয়ও সিক্ত হয়। ইরাজ তো সামান্য; সে তুলনায় ইরাজ ব্যাতিত অন্যকেই বেশি ভেজায় ওই নিষ্ঠুর, নির্বোধ, বোকা মেঘ!

হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল রাস্তার ওপর। ভাবল, মেঘের এই বোকামির জন্য হলেও সে আজও মেঘকে কাছে পেয়েও আপন করে নেয়নি। তার মেঘের চেয়েও, বুকে বেড়ে ওঠা যন্ত্রনাগুলোকে সে বরাবরই বেশি প্রাধান্য দিয়ে আসছে!

_

মেঘালয়া সেই সন্ধ্যা থেকে তৈরী হয়ে বসে আছে। এই বুঝি আসবে ইরাজ, একটু দেরী হলে খিটখিটে মেজাজের মানুষটা ক্ষেপে উঠবে নিশ্চয়ই! তাই সে তৈরী হয়ে বসে রইল ক্ষেপা মানুষটির অপেক্ষায়। তারপরই আকাশ বিদীর্ণ করে বৃষ্টি নেমেছে মুষল ধারে। সঙ্গে দমকা বাতাসের ঝাপটাও আছে।

রাত নয়টা বেজে যাওয়ার পরও যখন ইরাজের কোন খোঁজ নেই মেঘালয়ার মনটা অজ্ঞাত কারনেই কেমন চিন্তিত হয়ে উঠল যেন! আব্বুর মোবাইল দিয়ে ইরাজের কন্টাক্ট নম্বরে ট্রাই করল একাধিকবার। তবে ওপাশ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া নেই ইরাজের। ক্রমেই চিন্তা বাড়তে থাকে মেঘালয়ার, সঙ্গে রাতও!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে