অপয়া

0
1567

অপয়া
#মাধবী_ভট্টাচার্য

বিয়ের দুবছর বাদে মিনু মা হতে চলেছে । বাড়িতে প্রচুর খুশীর আবহাওয়া । শ্বশুর , শাশুড়ি , দেওরের আনন্দ উপভোগ করছে মিনু । প্রতাপ মিটি মিটি হাসছে । একা পেলে এখন কি করত কে জানে ! মিনুও খুব খুশী , ছোট্ট একটা প্রাণ ওর শরীরের ভেতরে বেড়ে উঠবে , ওর নিজের শরীরের অংশ , যে বড় হয়ে মিনুকে মা বলে ডাকবে , এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কি হতে পারে ! একটু একটু লজ্জাও অবশ্য লাগছে মিনুর ।
শাশুড়ি মা তো এখুনি শুরু করে দিয়েছেন , ” মিনু মা ! এখন থেকে খুব সাবধানে চলাফেরা করবে । মনে রাখবে আরেকটা প্রাণ রয়েছে তোমার মধ্যে।”
মিনু লজ্জা পেয়ে ঘাড় হেলায় । শাশুড়ি মা আবার বলেন , ” খাওয়া দাওয়াও এখন থেকে বাড়াতে হবে । মনে রেখো এখন থেকে তুমি দুজনের খাবার একসাথে খাবে । ”
কি যে বলে মিনু ! ভারি লজ্জা লাগছে । শ্বশুর মশাই হাসছেন , দেওর লাফাচ্ছে কাকু হবে বলে ।
এত এত আনন্দ এক অনাগত শিশু বয়ে আনতে পারে ! সত্যি কি আশ্চর্য !
==========================
আজ তিনমাস বয়স হল মিনুর গর্ভের । প্রতাপের সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে ও , চেক আপ করাতে হবে । ডক্টর সুব্রত রয় ভালো করে দেখে টেখে বলে দিলেন যে সব কিছু ঠিক আছে । সাবধানে থাকতে হবে আর কিছু ওষুধ খেতে হবে । ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরে ঢুকতে যাবে ওরা , তখনি কাতর ম্যাও ম্যাও আওয়াজে তাকিয়ে দেখে এক কুচকুচে কালো রঙের বেড়াল বাড়ির পাশের নর্দমায় পড়ে গিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে , আর করুণ সুরে ডেকে ডেকে বোধহয় সাহায্য চাইছে । পেটটা বেজায় মোটা বেড়ালটার , ,দেখে মনে হচ্ছে সেও মা হবে ।
মিনু বেড়াল খুব ভালোবাসে । বিয়ের আগে ওর নিজের পোষা দু তিনটে বেড়াল ছিল । শ্বশুরবাড়িতে কেউ বেড়াল পছন্দ করে না , তাই আর পোষা হয় না । এখন গর্ভবতী বেড়ালটার এই অবস্থা দেখে মিনু ওর বর প্রতাপকে বলল , ” তুমি প্লিজ বেড়ালটাকে ওখান থেকে উঠিয়ে দাও না ! ”
প্রতাপ বলল , ” ছি ছি ! বেড়ালকে উঠাতে গিয়ে আমি নোংরা ঘাঁটতে পারবো না এখন ”
” দাও না গো ! আচ্ছা আমিই যাই তবে । ” বলে মিনু গিয়ে বেড়ালটাকে টেনে ওখান থেকে উঠিয়ে দিল।
উঠেই বেড়ালটা লেজ তুলে মিনুর পায়ে মাথা ঘষতে শুরু করে দিল , সঙ্গে আহ্লাদী ম্যাও ম্যাও ডাক ।
মিনু বলল , ” কি রে ! কি চাস ! যা এখন ! ”
কিন্তু বেড়ালটা কিছুতেই যায় না , মিনুর পেছনে পেছনে বাড়ি ঢুকে পড়লো । এমনিতেই সারা গায়ে নোংরা মাখা , তার ওপর কালো কুচকুচে রঙ । শাশুড়ি মা আঁতকে উঠলেন , ” এ কি ! এই কালো বেড়াল এলো কোথা থেকে ? কালো বেড়াল খুব অপয়া হয় , তাড়াও এটাকে ! ”
মিনুর ততক্ষণে মায়া পড়ে গেছে বেড়ালটার ওপর , ওই ভারী পেট নিয়ে কোথায় যাবে বেচারি ! ওর এখন একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় দরকার । মিনু শাশুড়ি মাকে বলল , ” কিছুদিন ওকে থাকতে দাও মা ! দেখবে বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরেই নিজে থেকেই চলে যাবে । ”
” কি করে বুঝলে চলে যাবে ? না না ! এই কালো বেড়ালকে আমি এক মুহূর্তও থাকতে দিতে চাই না । কোন অলক্ষণ বয়ে আনবে কে জানে ! ”
” ওসব কুসংস্কার মা ! ঈশ্বরের সৃষ্টি কোনো প্রাণী কখনো অপয়া হতে পারে না । প্লিজ মা ! প্লিজ ! ওকে থাকতে দাও ! ”
ওর কাতর মিনতিতে শাশুড়ি মা নিমরাজি হলেন । বেড়ালটা রয়ে গেল এ বাড়িতে । বাইরের বাগানটায় একটা বড় প্যাকিং বাক্সের মধ্যে বেড়ালটা ঘুমায় , কারণ কেউ ওকে ঘরে ঢুকতে দেয় না । তাতে বেড়ালটার কোনো দুঃখ নেই , মিনু মনে করে করে দুবেলা ওকে খেতে দেয় । এরকম আরাম বোধহয় বেড়ালটার জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল ।
—————————————————————————
আজ হঠাত বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গেছে মিনু । জলদি জলদি ওকে নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডাক্তারের আপ্রাণ চেষ্টায় বাচ্চাটার কিছু হয় নি , মিনুও বিপদমুক্ত । কিন্তু দু দিন নার্সিং হোমে থাকতে হবে মিনুকে । ডাক্তাররা অবজার্ভেশনে রাখতে চান । বেডে শুয়ে শুয়ে মিনুর মনে পড়ছিল কালো বেড়াল মিনির কথা । বেচারিকে এখন কেউ খেতে দেয় কি না কে জানে ! জিজ্ঞেস করতেও ভয় হচ্ছে , কারণ শাশুড়ি মা যেভাবে এই দুর্ঘটনার জন্য বেচারি কালো বেড়ালটাকেই দায়ী করছেন , এখন মিনু কিছু বলতে গেলে ধমক খাবে ।
আশ্চর্য হয়ে যায় মিনু , কি করে মানুষ এরকম উদ্ভট জিনিষগুলো বিশ্বাস করে ! বেড়ালটা অপয়া , কারণ ঈশ্বর বেচারিকে কালো রঙ দিয়েছেন ! পয়া – অপয়া বলে কিছু আছে নাকি ! কে বোঝাবে ওদের যে এটা নিছক এক দুর্ঘটনা !
—————————————————–

বাড়ি ফিরেই মিনু বাগানে গিয়ে বেড়ালটাকে দেখতে গেল । কিন্তু মিনি কোথাও ছিল না । প্যাকিং বাক্সটাও খালি । সে সবাইকে জিজ্ঞেস করেও কোনো সদুত্তর পেলো না । ওরা শুধু বলল , ” বেড়ালটা চলে গেছে । ” মিনুর বিশ্বাস হচ্ছিল না , কি করে জানবে সে , কোথায় গেল বেচারি !
সারাদিন মন খারাপ করে রইল মিনু । বিকেলে ঘরে একা শুয়ে ছিল , তখন কাজের মেয়েটা চা দিতে এলো । এসেই সে বলল , ” জানো বউদিমনি ! কালো বেড়ালটা মরে গেছে । ”
মিনুর বুকে ধক করে উঠলো , ” কি করে রে ! কই , ওরা তো কিছু বলল না ! ”
” তুমি হাসপাতালে ছিলে যখন , বেড়ালটা মনে হয় তোমাকে খুঁজতেই ঘরে ঢুকে গেছিল , দাদাবাবু দেখতে পেয়ে প্রচণ্ড জোরে লাথি মারেন , দোতলার সিঁড়ি থেকে নীচের তলার মেঝেতে ছিটকে পড়ে বেচারি , ভরা মাস ছিল , তাই এই আঘাত নিতে পারে নি গো , পড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ ছটফট করেই স্থির হয়ে যায় । ”
মিনু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না , প্রতাপ ! প্রতাপ এমন করেছে ! কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে মিনুর । শরীরটা খারাপ লাগছে , চুপচাপ বিধ্বস্ত মন নিয়ে শুয়ে রইল মিনু । একটু পরে প্রতাপ এলো , এসে বলল , ” কি গো ! ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছ কেন ? শরীর খারাপ লাগছে ? ”
ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো মিনু , ” কেন ওকে মেরে ফেললে ! কেন ! বল ! ”
হঠাত এই আক্রমণে প্রথমে থতমত খেয়ে গেল প্রতাপ , তারপরেই বলল , ” কাকে ? কার কথা বলছ?”
” কেন ? জানো না ? কালো বেড়ালটাকে ! কেন মারলে বল ! ”
” আরে , মারতে চেয়েছিলাম নাকি ! ওটা একটা দুর্ঘটনা । আর এমনিতেও ভালোই হয়েছে অপয়া বেড়ালটা মরে গেছে , আপদ গেছে । ”
” ওই বেড়ালটা নয় ! তোমরা , তোমাদের এই বাড়িটা অপয়া ! এই বাড়িতে এসেই তো বেচারি বাচ্চাদেরও খোয়ালো , নিজের প্রাণটাও খোয়ালো , তোমরা অপয়া ! তোমরা ! ”
উন্মাদের মত চেঁচাচ্ছিল মিনু , দৌড়ে এলেন শাশুড়ি মা , তাঁকে দেখে মিনু দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠলো , ” তোমরা সবাই অপয়া , এখন আমার বাচ্চাটার কিছু হয়ে গেলে তোমরা আমাকেও অপয়া বলতে ! তোমাদের ভাবনা গুলোই সব অপয়া ! চলে যাও এখান থেকে ! ”
এক হতভাগিনী মায়ের দুঃখে আরেক মায়ের হাহাকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল । ঈশ্বর কি সহ্য করতে পারছেন এই চীৎকার ! ডাইনি সন্দেহ করে যখন নিরীহ কাউকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয় , বা পিটিয়ে মারা হয় , তখনো কি ঈশ্বর সহ্য করতে পারেন ! ধর্মের দোহাই দিয়ে যখন মানুষ মানুষের প্রাণ নেয় , তখনো কি ঈশ্বর পারেন সহ্য করতে ! না , পারেন না , ঈশ্বর কষ্টে , ব্যথায় নীল হয়ে যান , কিন্তু মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হয় না কিছুতেই ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে