#ধারাবাহিক গল্প
#অন্তহীন প্রেম
পর্ব-তেরো
মাহবুবা বিথী
—–তোমার মৃত ছেলে সন্তান হয়েছে।
——আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আম্মু। আমার মন বলছে আমার বেবিটা বেঁচে আছে।
——তোমার শারীরিক কন্ডিশন এমন ছিলো যে বেবিটাকে বাঁচানো সম্ভব হয় নাই। তোমার উপর গত একবছর যে ধকল গেছে সেখান থেকে তোমার এখন বেরিয়ে আসা উচিত। তুমি এখন যদি তোমার ফেলে আসা কষ্টের দিনগুলো নিয়ে ভাবো তাহলে তুমি নিজেকে কখনও ভালো রাখতে পারবে না। ধরে নাও ওটা ছিলো একটা দুঘর্টনা। একটি দুঘর্টনা তো সারাজীবনের কান্না হতে পারে না তাই না?
এমন সময় রুবাইয়াতের মা অর্থাৎ সানজিদা রহমানের ফোনটা বেজে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রীনে নাম দেখে সানজিদা রুম থেকে বের হয়ে ফোনে বললো,
—–কি আকলিমা,হঠাৎ ফোন দিলে কেন? জরুরী কিছু?
—–আজ তো রুবা মায়ের হাসপাতাল থেকে ফেরার কথা?
—–হুম, তো কি সমস্যা?
—–না মানে বলছিলাম কি রুবা মাকে সব জানালে হতো না?
——আমি আমার মতো করে জানিয়ে দিয়েছি। তুমি তোমার কাজটা ঠিক মতো করো। ফোন রাখছি।
ফোনে কথা সেরে সানজিদা মেয়ের রুমে চলে আসলো। রুবাইয়াত তখন ভাবনার অতলান্তিক সমুদ্রে হারিয়ে গেছে। সে ভাবনাটা ওর বিষাদমাখা অতীত। যাকে সবাই ভুলে থাকতে বলছে। কিন্তু ওর পক্ষে ঐ অতীতকে ভুলে থাকা কখনও সম্ভব নয়। বাসর শয্যার রেশ কাটতে না কাটতে যে নারীকে বৈধব্য বরণ করে নিতে হয় সেই স্মৃতিকে কি করে ভুলে থাকা সম্ভব হয়? সেই প্রসেস তো ওর জানা নেই। সন্তানকে গর্ভে ধারণ করলো অথচ মৃত হলো নাকি জীবিত হলো সে খবর জানার ওর অধিকার নেই। কি দুভার্গ্যে ওর সন্তান জন্ম দিলো অথচ সেই নারী ছেড়া ধনের মুখটা সে দেখতে পেলো না। কি করে এসব স্মৃতি ও ভুলে থাকবে? নাকি ভুলে থাকা যায়?
——কি অত ভাবছিস?
——না,কিছু না। তুমি আকলিমা খালাকে আর কাজে রাখলে না কেন?
——বয়স হয়েছে। কাজ করতে পারে না। তাই পাঠিয়ে দিয়েছি।
—–কাজটা তুমি ঠিক করলে না আম্মু। যে মহিলাটা তোমাকে বিশ বছর সার্ভিস দিলো আর এখন সে কাজ করতে পারে না বলে তাকে পাঠিয়ে দিলে। ভেবে দেখো তো কাজটা কি তুমি ঠিক করলে কিনা?
—–স্ট্রোক করার পর আমি আগের মতো কাজ করতে পারি না। আমার একজন শক্তসামর্থবান হেল্পিংহ্যান্ড দরকার।
—–ঠিক আছে, তুমি আকলিমার খালার সাথে একজন ছুটা কাজের খালা রাখতে পারতে? এতো বছর শ্রম দেওয়ার পর এইটুকু সহানুভুতি পাওয়া তার অধিকার। তারউপর তার স্বামী সন্তান কেউ নেই।
——তুমি এতোদিকে মাথা না ঘামিয়ে শুধু নিজের কথা ভাবো। সারাজীবন তো এভাবে একা থাকা যাবে না। কিছুদিন সময় নাও। তারপর আবার বিয়েশাদি করে সংসারী হও।
——আম্মু, আমাকে আর কখনও বিয়ের কথা বলবে না। জুলকারনাইন বেঁচে না থাকলেও ও আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। যতদিন বেঁচে থাকবো ওর অস্তিত্বের অনুভবে বেঁচে থাকবো।
—–রুবাইয়াত এটা জীবনের কঠিন বাস্তবতা। সুতরাং বিয়ে তোমাকে করতেই হবে। একমাসের সম্পর্ককে এতে গুরুত্ব দিচ্ছো অথচ যে মানুষটা তোমাকে পাবার তরে একযুগ অপেক্ষা করছে তাকে কি জবাব দিবে? এতো কাহিনী হবার পরেও সে তোমার পথপানে চেয়ে বসে আছে। তোমার চরম দুর্দিনে ও তোমার জন্য কি করেছে তা তোমার ধারণার মধ্যে নাই। তাকে এভাবে কষ্ট দেওয়া তোমার ঠিক হবে কিনা ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো। যতটুকু জানি তুমিও একসময় তাকে পছন্দ করতে। । সিনেমা বা নাটক কিংবা গল্প উপন্যাসের মতো করে জীবনকে চালানো যায় না। কিছুদিন পর বিয়ে করে জীবনকে আবার নতুন করে শুরু করো।
——আম্মু প্লিজ,আমাকে একটু একা থাকতে দিবে? এই কথাগুলো বলার জন্য ভবিষ্যতে প্রচুর সময় পাবে।
——,শোনো রুবাইয়াত এতো স্বার্থপর হয়ো না। যে চলে গেছে সে তো আর কখনও ফিরে আসবে না। ওমরের কথাটা তোমার এখন ভেবে দেখা উচিত। ছেলেটা তোমার জন্য কি না করেছে?
——আম্মু আমার জীবনের সময়টা এখনও ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তোমার কি মনে হয় আমি রোবট। তোমরা যা আদেশ করবে আমি যন্ত্রচালিত ডিভাইসের মতো তাই করে যাবো? আমার পক্ষে সম্ভব না। তারপরও তুমি যদি এরকম করো আমি আবার হাসপাতালে ভর্তি হবো। এ ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নেই। আম্মু আমার মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। আমি একটু ঘুমাবো।
সানজিদা রহমান আর কথা বাড়ালেন না। মেয়ের রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের লাগোয়া বারান্দাটায় এসে রকিং চেয়ারটায় বসলেন। আর মনে মনে মেয়ের উপর প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হলেন। কিন্তু বেশী কিছু বলার উপায় নেই। ওমরের বারণ আছে। আসলে উনিও আর পারছেন না মেয়ের এই জীবনটা মেনে নিতে। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনেরা নানা কথা বলছে। কেউ কেউ বলছে রুবাইয়াতকে তুলে নিয়ে গিয়ে রেপ করা হয়েছে। তাই ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। এমনকি ওমরের মা বাবাও চাইছে না ও রুবাইয়াতকে বিয়ে করুক। একদিন তো আকার ইঙ্গিতে ওমরের মা বলেই ফেললো, “ওদেরও তো সমাজ নিয়ে চলতে হয়। সবজায়গায় আবেগ ইমোশন চলে না”। তাই সানজিদা রহমানের ভয় হয় ওমরও যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে মেয়েকে বিয়ে দিতে পাত্র পাবেন কোথায়?
পুলিশের রিটায়ার উচ্চপদস্ত কমকর্তা জুনায়েদুর রহমান স্ত্রীকে খুঁজতে এসে বেড রুমের লাগোয়া ব্যালকনিতে চলে আসলেন। উনি জানেন মন খারাপ হলে সানজিদা এখানে এসে বসে থাকে। বারান্দায় বসে যতদূর দেখা যায় শুধু সবুজ। এখানে প্রচুর বড় বড় গাছ রয়েছে। পাশেই রমনা পার্ক। ভি আই পি এ্যারিয়া বলে জায়গাটা খুব নিরিবিলি থাকে। জুনায়েদুর রহমান সানজিদার কাঁধে হাত রাখাতে ও চমকে উঠলো।
——তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
—–যে সিচুয়েশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি শরীর খারাপ হওয়াটাকি স্বাভাবিক নয়?
—–কি করবে বলো সবই আমাদের ভবিতব্য।
——বুঝলাম, কিন্তু নিজের ভাগ্যে বদলাতে চেষ্টা করতে হয়। সুযোগ সবসময় হাতের নাগালে আসে না।
—–ওকে একটু সময় দাও। এখন বেশী জোরাজুরি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। ওমর তো তাই বললো।
জীবনে ঘটে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী কোনো ঘটনাকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা অনেকসময় কোনো মানুষের থাকে না। তখন নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে যায়। সেসময় মানুষের ঘুম খাওয়া বিশ্রাম আনন্দ আয়োজন সবই হ্রাস পেতে থাকে। রুবাইয়াতের অবস্থাটা অনেকটা সেরকম। সেদিন দুপুরে খেয়ে ঘুমের ভাণ করে পরে থাকলেও রুবাইয়াতের চোখে শেষ পর্যন্ত ঘুম আসেনি। আসরের আযান শোনা যায়। শোয়া থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে নামাজ পড়ে নেয়। এমনসময় কে যেন দরজা নক করে।
——কে?
——আপু আমি জরিনা,
——কিছু বলবি?
——পাশের বাড়ির খালাম্মা আসছে, আপনার সাথে দেখা করতে চায়?
——যা আমি আসছি।(একটু বিরক্ত হয়ে)
এদের কাজ হচ্ছে গসিপ করা। গসিপ না করলে এদের পেট ভরে না। অনিচ্ছা সত্বেও রুবাইয়াত ড্রইংরুমে গেস্ট এর সাথে দেখা করতে যায়। ওকে দেখে পাশের ফ্লাটের প্রতিবেশী ওর আব্বুর কলিগ আশরাফ সাহেবের স্ত্রী নুরজাহান বেগম গদ গদ হয়ে বললো,
——কেমন আছো রুবাইয়াত?
রুবাইয়াত এই মহিলাকে খুব একটা পছন্দ করে না। গদগদ ভাব নিয়ে কথা ঠিকই বলবে কিন্তু খোঁচা দিতে ছাড়বে না। রুবাইয়াত বিরক্ত হলেও সেটা আড়াল করে বললো,
——ভালো আছি?
—–ভালো আছো বলেই তো পাগলা গারদ থেকে ছাড়া পেয়েছো।
—–আন্টি আপনি ভুল বলছেন, ওটা পাগলা গারদ নয় হাসপাতাল।
—–ঐ একই হলো। এখন কি করবে কিছু ভেবেছো?
——-এখনও কিছু ঠিক করিনি।
——আহা! তোমার বেবিটার কথাশুনে খুব খারাপ লাগলো।
বেবির কথা উঠাতে ও নুরজাহান বেগম এর কাছে বিদায় নিয়ে ড্রইংরুম থেকে বের হয়ে আসার সময় শুনতে পেলো,
——ভাবি রুবাইয়াতের নাকি একটা মরা বাচ্চা হয়েছে?
রুবাইয়াতের আম্মু সানজিদা ছোট্ট করে বললো,
——হুম,
——ভালোই হয়েছে। ঐ বাচ্চার তো বাবার ঠিক নাই। ক,জন মিলে নাকি ওকে রেপ করেছে।
——না,ভাবি কথাটা ঠিক নয়,
—— সন্ত্রাসীদের কাছে ছিলো, আপনার কি মনে হয় ওকে রেপ না করে ওরা ছেড়ে দিবে? বাচ্চাটা মরে গেছে ভালোই হয়েছে।
রুবাইয়াত ওখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। দৌড়ে নিজের রুমে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশ মুখে চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলো। বুকটা অপমান আর লাঞ্চনার হোমানলে পুড়ে যেতে লাগলো। আজ ও বুঝতে পারছে কেন জুলকারনাইন ওকে বিয়ে করে একটা স্বীকৃতি দিয়ে গেল। ও জানতো রুবাইয়াতকে বিয়ে করার সাথে সাথে ওর রাজত্ব বিলীন হয়ে যাবে। আর জীবন প্রদীপটা চিরজীবনের তরে নিভে যাবে। ওর সাথে জুলকারনাইনের বিয়ে হয়েছে সে খবর পত্রিকার পাতাগুলোতে সেসময় ধারাবাহিকভাবে উঠেছে। বিশেষ করে নিজেদের পত্রিকার কাটতির জন্য প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা ওর এই খবর ছেপেছে। পুরো দেশ জানে তারপরও সুযোগ পেলে নোংরামনের মানুষগুলো ওকে খোঁচা দিতে ছাড়ে না। যদিও রুবাইয়াত স্বেচ্ছায় এই ঘটনার জালে আটকা পড়েনি। ও পরিস্থিতির শিকার। তারপর ঘটনাক্রমে জুলকারনাইনের সাথে ওর ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এরপরও এই সমাজের কাছে ওকে প্রতিমুহুর্তে জবাবদেহিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।এরকম চলতে থাকলে একসময় ওর হয়তো বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে যাবে। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো।
চলবে
#ধারাবাহিক গল্প
#অন্তহীন প্রেম
পর্ব-চৌদ্দ
মাহবুবা বিথী
রুবাইয়াতের ফোনটা ধরতে ইচ্ছে হলো না। এই মুহুর্তে পৃথিবীর কারো সাথে ওর কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বরং ওর মনে হলো জুলকারনাইনের সাথে কেন ওর মৃত্যু হলো না? তাহলে জীবনের এই কঠিন দিক ওকে দেখতে হতো না। ও যখন অসুস্থ হলো ওমরই বা কেন ওকে সুস্থ করে তুললো? এর তো দরকার ছিলো না। বরং বদ্ধ উম্মাদ হয়ে গেলে ভালো হতো। মানুষের এই রুঢ় শব্দগুলোর অর্থ বুঝতে পারতো না। নিজের জগতেই বিচরণ করতো। বেজে বেজে একসময় ফোনটা থেমে যায়। আবারও ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখে ওমর ফোন দিয়েছে। অনিচ্ছাসত্বেও ফোনটা ধরতে বাধ্য হয়।
——হ্যালো রুবাইয়াত তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
ফোনের ওপারের মানুষটি যেন নিরবতার আঁচলে নিজের মুখ বন্ধ রাখলো।
——-রুবাইয়াত কথা বলছো না কেন? তোমার শরীর ঠিক আছে তো?
নিজেকে কিছুটা ধাতস্ত করে রুবাইয়াত বললো,
——হ্যা আমি ঠিক আছি। তুমি কি বলবে বল?
—–তোমার শরীর কেমন আছে জানার জন্য ফোন দিয়েছি।
——আমি ভালো আছি।
রুবাইয়াত মুখে না বললেও ওমর ঠিক বুঝেছে রুবাইয়াত কাঁদছে।
——তোমার কি মন খারাপ? তুমি কি কাঁদছো?
রুবাইয়াত আর কথা বলতে পারলো না। ফোনের মধ্যে ডুকরে কেঁদে উঠলো। ওমর রুবাইয়াতের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,
——ঠিক আছে ফোন রাখো। আমি আসছি।
উত্তরা থেকে বাইকে করে রওয়ানা দিলো। ছুটির দিন থাকায় বিকালের দিকে রাস্তায় বেশ জ্যাম থাকে। এই জন্য গাড়ি নিয়ে ও বের হলো না। বাইক নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসার চেষ্টা করলো। আসলে রুবাইয়াতকে নিয়ে ও খুব টেনশনে আছে। এখন যদি ও কোনো কারণে আঘাত পেয়ে আবারো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তাহলে ওকে সুস্থ করা কঠিন হয়ে যাবে। এতো করে আঙ্কেল আন্টিকে বলার পর কি এমন ঘটলো যে ও এভাবে কাঁদছে?এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ও ইস্কাটনে চলে আসলো। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধা হয়ে গেল। ডোরবেল বাজাতে আয়ান দরজা খুলে দিলো। আয়ানের মুখটা ভার দেখে চিন্তিত মুখে ওমর জিজ্ঞাসা করলো,
——তোমাদের বাসার খবর সব ভালো তো?
—–হুম,ভালো(একটু গম্ভীর হয়ে)?
—–রুবাইয়াত কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
——না,মনে হয়। ওর রুমেই আছে। আপনি কি আপুর সাথে দেখা করতে আসছেন?
——কেমন আছে সে খোঁজটা নিতেই আসলাম।
—–ওকে ডেকে দিবো?
——আমিই বরং ওর রুমে যাই।
ওমর রুবাইয়াতের রুমে এসে দরজা নক করলো।
—–কে?
——আমি ওমর,
রুবাইয়াত বিছানা থেকে উঠে নিজের এলোমেলো পোশাকটা ঠিক করে দরজা খুলে বললো,
——তুমি কখন এলে?
——এই মাত্র, তোমাকে সরেজমিনে দেখতে আসলাম(মুচকি হেসে)
রুবাইয়াত ওমরের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, ওর হাসিটা তো খুব সুন্দর!অথচ ছোটোবেলা থেকে একসাথে বড় হলো এই হাসিটা যেন ওর চোখেই পড়েনি। ট্রিম করা দাঁড়ি, রিনলেজ চশমা, চুলটা বেশ কোঁকড়া, হালকা গোঁফের সারি, শ্যামলা বরণ একহারা গড়ন দেখতে ভালোই লাগছে। ওমর ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
——কি দেখছো অমন করে?
—–না কিছুনা, তোমার আসার দরকার ছিলো না।
—–কাঁদছিলে কেন?
——এমনি, ওমর আমার বাসায় কেন যেন ভালো লাগছে না? তুমি কি আমাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে?
——-চলো, কক্সবাজারে যাই।
——না, আমাকে একটু পাহাড়ে নিয়ে চলো। দুদিন,পরেই নববর্ষ। এসময় পাহাড়ে বৈসাবী উৎসব হয়। পাহাড় আর পাহাড়ের মানুষগুলো অপরূপ সৌন্দর্যে সেজে উঠে। আমার খুব যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। এছাড়াও পাহাড় এই মুহুর্তে আমাকে খুব টানছে।
রুবাইয়াতের মুখে পাহাড়ের কথা শুনে ওমরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ও বুঝতে পারছে রুবাইয়াত ওর হারিয়ে যাওয়া অতীতের উঠোনে হাঁটতে চাইছে। ও এটাও জানে রুবাইয়াত যতদিন পর্যন্ত ওর পুরোনো অতীতে বন্দী থাকবে ততদিন ওর কাছাকাছি আসতে পারবে না। আবার ওকে বাঁধাও দিতে পারবে না। তাহলে হয়তো কোনোদিন রুবাইয়াতকে ওর জীবনে পাবে না। ওমরের মুখটা গম্ভীর দেখে রুবাইয়াত বললো,
——তোমার কি পাহাড়ে যেতে সমস্যা?
—–না সমস্যা কেন হবে? তুমি যখন যেতে চাইছো অবশ্যই পাহাড়ে যাবো। আসলে আমার ডিউটি কবে ফ্রী আছে সেটা নিয়ে ভাবছিলাম। কবে যাবে?
——আমার তো আজকে রওয়ানা দিলেই ভালো লাগতো।
——ঠিক আছে আমরা কাল রওয়ানা দিবো। এখন একটু হাসিমুখ করে আমার জন্য এককাপ কফি বানিয়ে আনো।
ওমর রুবাইয়াতের রুম থেকে বের হয়ে ড্রইংরুমে গিয়ে বসলো। সানজিদা আর জুনায়েদুর রহমান ও ড্রইংরুমে ওমরের সাথে দেখা করতে আসলো। ওমর সেসময় রুবাইয়াতকে নিয়ে পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার প্লানটা জানিয়ে দেয়। এতে অবশ্য রুবাইয়াতের বাবা জুনায়েদ বলে,
——পাহাড়ের ওদিকটায় না গিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে গেলে ভালো হতো না?আবার সেই পাহাড়!
—-কক্সবাজারে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু রুবাইয়াত পাহাড়ে যেতে চাইলো। এখন ওর মনের বিরুদ্ধে কিছু করা ঠিক হবে না।
সানজিদা অর্থাৎ রুবাইয়াতের মা মনে মনে খুব আনন্দিতো হলো। এইভাবে যদি রুবাইয়াত আর ওমর কাছাকাছি চলে আসে তাহলে খুব দ্রুতই ওদের বিয়েটা দেওয়া সম্ভব হবে। আর মেয়েটাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। খুশীর ভাবটা আড়াল রেখে ওমর কে বললো,
——সাগর হোক আর পাহাড় হোক এতে সমস্যা নাই।রুবাইয়াতের মানসিক অবস্থা এখন খুব একটা ভালো না। কোথা থেকে ওর একটু বেড়িয়ে আসা দরকার। তোমরা সেখানে ক,দিন থাকবে?
—–সেটাও নির্ভর করছে রুবাইয়াতের চাওয়ার উপর।
রুবাইয়াত কফি বানিয়ে নিয়ে আসলে ওর মা বাবা কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে ড্রইংরুম থেকে চলে যায়। ওমর কফিতে চুমুক দিয়ে বলে,
——কফিটা দারুণ হয়েছে।
—–থ্যাংক ইউ,
——তাহলে গোছগাছ করে নাও। আগামীকাল রাতে রওয়ানা দিবো।
ওমর কফি শেষ করে ইস্কাটন থেকে বের হয়ে উত্তরার দিকে রওয়ানা হলো।
পরদিন রাত আটটায় ওমর ওর বাবা মায়ের সাথে বাড়ির ডাইনিং টেবিলে বসে ডিনার করছে। একটু পরেই ও আর রুবাইয়াত বান্দরবনের উদ্দ্যেশে রওয়ানা দিবে। বিশেষকরে ওমরের মা ওর এই আচরণে ভীষণ বিরক্ত। ওমর ইদানিং ওর বাবা মায়ের সাথে মন খুলে কথা বলে না। দিনরাত নিজের হাসপাতাল আর রুবাইয়াত এই যেন ওমরের পৃথিবী। ওমরের মা শায়লাবেগম নিরবতা ভঙ্গ করে বললেন,
——পাগলের সাথে পাগলামী আর কতদিন করবে। এছাড়া তোমার বাবার সম্মানের দিকে তোমার তাকানো উচিত। ঐ মেয়েকে নিয়ে বাজারে কতো কেচ্ছা কাহিনী চলছে। আর তুমি পড়ে আছো ঐ মেয়েকে নিয়ে?
——মা,আমি আমার পেশেন্টের সুস্থতার জন্য এসব করছি। এতে বাবার কি সম্মানহানি ঘটলো আমি তো বুঝতে পারছি না। বাবা নিজেও তো একজন ডাক্তার। আর আমি তোমার কাছে রুবাইয়াতের সম্পর্কে এধরণের কথা আশা করি না।
——সবই ঠিক আছে। কিন্তু রোগীর সেবা করতে গিয়ে নিজের জীবনকে বিসর্জন দেওয়া ডাক্তারের ধর্ম না তাই না? পাশাপাশি দুটোই চালাতে হয়। তোমার খুব দ্রুত বিয়েশাদী করে সংসারী হওয়া উচিত। শোনো ওমর যে সত্যি ঘুমায় তার ঘুম ভাঙ্গানো যায় আর যে জেগে জেগে ঘুমায় তার ঘুম ভাঙ্গানো খুব কঠিন।( গম্ভীর হয়ে ওমরের বাবা বললো)
——-তোমার বাবা দেশের ইন্টারনাল মেডিসিনের উপর একজন নামকরা কনসালটেন্ট। তার একটা আলাদা পরিচিতি আছে। তুমি এবার বাস্তববাদী হও। আমার নিষেধ সত্বেও রুবাইয়াতের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছো। সমস্যা নেই। ও তোমার পেশেন্ট। সুস্থ না হওয়া অবধি তুমি ওর চিকিৎসা চালাতেই পারো। তবে তোমার ব্যক্তিগত জীবনের চাকাটা সচল রাখো। বিয়েশাদী করে সংসারী হও।(ওমরের মা বললো)
——শোনো মা আমি ও তোমাদের বলছি, তোমরা আমাকে নিয়ে পড়ে থেকো না। বরং উসমানের বিয়ে দিয়ে দাও। ওর তো নিজের পছন্দের পাত্রী আছে।আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। রওয়ানা দিলাম।(দ্রুত খাওয়া শেষ করে)
ওমর আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে ইস্কাটনের দিকে রওয়ানা হলো। ও আসলে রুবাইয়াতের জায়গায় কাউকে বসাতে পারবে না। তাই বিয়ে করে শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবন ও নষ্ট করতে চায় না।
দশটার দিকে রুবাইয়াতের বাসায় পৌঁছে গেলো। ও রেডী ছিলো। গাড়ির হর্ণের শব্দে নিচে নেমে আসলো। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে।
পাহাড়ের গা বেয়ে চাঁদের আলো চুঁয়ে পড়বে। কি অপরুপ সে দৃশ্য! ওমর খুব রোমাঞ্চিতো আর শিহরিতো হচ্ছে। বান্দরবনে পাহাড়ের চূড়ায় সাইরু হিল রিসোর্টে দু,জনের জন্য ও রুম বুক করেছে। সাজানো গোছানো পরিবেশ সবুজ পাহাড়ের সারি মেঘেদের আনাগোনা রুবাইয়াতের নিশ্চয় খুব ভালো লাগবে । প্রাডো জীপে করে শহরের বুক চিড়ে ছুটে চলেছে ওমর। ড্রাইভিং সিটে ও আর পাশের সিটে রুবাইয়াত। রুবাইয়াতের পারফিউমের ঘ্রাণ ওমরের নাকে এসে লাগছে। রুবাইয়াতকেও বেশ ফুরফুরে লাগছে। ওর ও ভীষণ ভালো লাগছে। ঐ পাহাড়ের প্রতিটি জায়গায় জুলকারনাইনের ছোঁয়া লেগে আছে। জুলকারনাইন মারা গেলেও রুবাইয়াতের মনে হয় পাহাড়ে গেলে ও জুলকারনাইনকে খুঁজে পাবে। ওর স্পর্শ অনুভব করতে পারবে। প্রায় একবছর পর ওর সবচেয়ে কষ্টের আবার সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতির মাঝে কিছু সময়ের জন্য হারাতে পারবে এই খুশীতে ও খুব শিহরিতো। এর পুরো কৃতিত্ব ওমর। রুবাইয়াত ওর হাত স্টিয়ারিং এ রাখা ওমরের হাতে উপর রেখে বললো,
——- তুমি সত্যিই আমার বন্ধু। এই মুহুর্তে এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমাকে বোঝার মতো কেউ নাই। দিনদিন তোমার কাছে আমার ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে।
——রুবাইয়াত বন্ধুর কাছে ঋণ বলে কিছু থাকে না। সেখানে শুধু থাকে ভালোবাসা।
——আর কথা না বলি। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে কথা বেশী না বলাই ভালো। দোয়া পড়ে সাবধানে গাড়ি চালাও।
—–যথা আজ্ঞা ম্যাম।
ওমর রুবাইয়াতের হাতের উষ্ণ স্পর্শে আজ শিহরিতো। ওমর ওর হৃদয়ের উঠোনে স্বপ্নপূরণের পথে হাঁটছে। চিটাগাং এ ওরা একটা রেস্টুরেন্টে হালকা কিছু খেয়ে নিলো। একটানা গাড়ি চালিয়ে সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসলো। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করছে। পাহাড়ের কোলে সারি বেঁধে মেঘের দল ভেসে চলছে। মৃদুমন্দ শীতল বাতাস বইছে। রুবাইয়াত গাড়ির এসি অফ করে জানালাটা খুলে দিলো। পাহাড়ের শীতল বায়ুর স্পর্শে শরীর ও মন জুড়িয়ে গেল। দুপাশে ঘন জঙ্গল মাঝখানে মাথার সিঁথির মতো রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলছে রিসোর্টের পানে। পাহাড়ের গায়ের সুবাসে রুবাইয়াতের সব কষ্ট যেন আজ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ওদের গাড়ি আস্তে আস্তে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেল। রিসোর্টে পৌঁছাতে সকাল এগারোটা বেজে গেল। রুবাইয়াত নিজের রুমে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নীচে গভীর অরণ্যের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এখানে কোনো না পাহাড়ের কোলে ওর আর জুলকারনাইনের দেখা হয়েছিলো। ওমর রুমে এসে বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিলো। গাড়ি চালানোর ক্লান্তি ওর শরীরে ভর করছে।
দুপুরে খাওয়ার সময় হওয়াতে রুবাইয়াতের রুমে ওমর চলে যায়। সেসময় ও দেখে রুবাইয়াত রুমের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর ও সেই বারান্দা থেকে নিচে লাফ দেয়। বাঁধা দেওয়ার আগেই ওমরের চোখের সামনে ওর ভালোবাসার বিসর্জন হয়। তাহলে এই জন্যই কি রুবাইয়াত পাহাড়ে আসতে চেয়েছিলো? ওমর নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। ওমরের ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। এতোটাই ভয় পেয়েছিলো যে ঘটনাটা বাস্তব না স্বপ্ন সেটা বুঝতে কিছুটা সময় লেগে যায়। এরপর দৌড়ে রুবাইয়াতের রুমের সামনে গিয়ে এলোপাথারী দরজা নক করতে থাকে।
চলবে