#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
লেখনীতে- সানজিদা তাসনীম রিতু
অতন্দ্রিলা_আর_বৃষ্টি পর্ব-৫
-“তুমি কি খেয়াল করেছ তোমার চোখের পানির রঙ?” জানালার পাশ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অতন্দ্রিলার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো অভ্র।
=”মানে?” ফোঁপাতে ফোঁপাতে জানতে চাইলো অতন্দ্রিলা।
অভ্ৰ ডান হাতে ইশারা করতে একটা স্বচ্ছ স্ফটিকের আয়না চলে আসে ওর সামনে। সে আয়নাটা অতন্দ্রিলার দিকে বাড়িয়ে দেয়। অতন্দ্রিলা দেখে ওর ফরসা গাল বেয়ে বিভিন্ন হালকা রঙের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ও।
=”আচ্ছা অভ্র, তোমাদের সবার শরীর থেকেই কি এমন উজ্জ্বল রঙের আলো বের হয়? কই আমার তো হয়নি এখনও।” একটু স্থির হয়ে প্রশ্ন করে অতন্দ্রিলা।
-“না, শুধু আমারই।”
=”কেনো?”
-“আমি জানিনা, কেউ এর কারণ আমাকে বলতে পারিনি। বাবা বলতে পারতো হয়তো কিন্তু…”
=”কিন্তু?”
-“তোমাকে তো বললাম আমার বাবা আর মা দুজনই বিজ্ঞানী ছিলেন। তাদের কাজই ছিলো মহাকাশ নিয়ে। ব্ল্যাকহোল আবিষ্কার করেন আমার বাবা, বিপদজনক হওয়ার কারণে তিনি এটার ব্যাপারে কাউকে কিছু জানাননি, কোনো রেকর্ডও রাখেননি হয়তো আমার জানামতে। আমাকে ভূমিষ্ঠ করানোর কয়েক বছর পরের কথা, কিছুতেই আর নতুন ব্ল্যাকহোল তৈরি করা যাচ্ছিলো না। কিন্তু এটাই আমাদের টিকে থাকার একমাত্র আশা ছিলো। পরে তাড়াহুড়ো করে অন্য সিস্টেমে ব্ল্যাকহোল তৈরি করতে গিয়ে বাবা ব্ল্যাকহোলের মধ্যেই হারিয়ে যান। উনাকে ফিরিয়ে আনার উপায় কারোর জানা ছিলোনা।”
=”উনি হয়তো আছেন অন্য কোথাও অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে।” সান্তনা দিয়ে বললো অতন্দ্রিলা।
-“হয়তো।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভ্ৰ।
=”আর তোমার মা?”
-“মায়ের শরীর থেকে অতিরিক্ত ভ্রূণ তৈরি করতে করতে তার ডিম্বাশয়ে বিষক্রিয়া ঘটে তার শরীর নষ্ট হতে শুরু করে। অনেক চেষ্টা করেও তাকে ঠিক করা যায়নি, অনেক কষ্ট পেয়ে মারা যায় মা। তোমাকে বলেছি তো, ১৬৮ বছর ধরে আমি এখানে একা থাকি। আমার জন্য নির্দিষ্ট কিছু জায়গা আছে তার বাইরে আমাকে যেতে দেওয়া হয়না। অল্প কিছু মানুষের সাথেই আমি কথা বলতে পারি। বাবার গ্রুপ থেকে তার সবকিছু আমার জন্য এই বাড়িতে রেখে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমি আমার ইচ্ছায় সবকিছু ব্যবহার করতে পারিনা। তারা আমার সব প্রয়োজন মিটিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু আমার সাথে কখনো যোগাযোগ করেননি। আমাকে যখন যেটা দেওয়ার দরকার দিয়েছেন, যেটা জানানোর দরকার মনে করেছেন সেটা আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন ক্রিস্টাল রেকর্ডের মাধ্যমে। আমি অনেক চেষ্টা করেও তাদেরকে খুঁজে পাইনি।”
=”কিন্তু তোমাদের এখানের বাড়ি আর পরিবেশ তো দেখি পৃথিবীর মতোই।” চারিপাশে দেখতে দেখতে বলে অতন্দ্রিলা।
-“তুমি বাড়িটা যেমন দেখছো এটা এমন না, কি জন্য যেনো বাবা এটার ভিতরের ডিজাইনটা এমন অদ্ভুত করেছেন, অবশ্য আমার ভালোই লাগে। আর পরিবেশের সাদৃশ্যতার কারণেই তো পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কথা ভাবা হয়েছিলো।”
=”কিন্তু এতো গোপনীয়তা কেনো অভ্র, তুমি তো উনার ছেলেই? আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে?”
-“সব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমি তো এতোকিছুও জানতাম না। আমার যতোটুকু জানার দরকার বাবার তৈরি করে রেখে যাওয়া রেকর্ড থেকে জেনেছি। বাবা গুরুত্বপূর্ণ যাই করতেন রেকর্ড করে রাখতেন। যদিও সব রেকর্ড আমাকে দেওয়া হয়নি, যেটুকু দরকার সেটুকুই দিয়েছেন বাবার বন্ধুরা। এমনকি তোমার ৬ বছর বয়স পর্যন্ত সব এক্টিভিটিজও রেকর্ড করা আছে। এখানকার হিসাবে তোমার বয়স ১৬৪ বছর, তুমি আমার খুব বেশি ছোট না তন্দ্রা…”
=”প্লিজ, আমাকে এই নামে ডাকবেনা।” উত্তেজিত হয়ে ওঠে অতন্দ্রিলা।
-“আচ্ছা ডাকবোনা, তুমি শান্ত হও।”
=”আচ্ছা, তোমার সাথে আমি কথা বলছি কীভাবে! তোমার আর আমার ভাষা তো এক হওয়ার কথা না।”
-“হ্যা এক না। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছ তোমার সৃষ্টি হয়েছে এই ক্রিপটিতে তুমি এই গ্রহেরই, তাই হয়তো ভাষা এক হয়ে গেছে অথবা তোমাকে আনার সময় তোমার মধ্যে চেঞ্জিং ডাটা ইনপুট করা হয়েছে।”
=”কিন্তু তুমি আমাকে কীভাবে চিনলে?” বলে অতন্দ্রিলা নিজেই ওর বাম কানের পাশে হাত দিলো, বোঝা যায়না এমন একটা উঁচু ভাব আছে। আঙ্গুল বুলালে মনে হচ্ছে কিছু লেখা। ও তাকালো অভ্রর দিকে।
-“হ্যা, ওটা তোমার কোড। এখানকার সবার এমন আলাদা আলাদা কোড আছে, এটাকেই নাম বলি আমরা। ভ্রূণ তৈরি করার পরই তার বাম কানের পাশে কোড দিয়ে দেওয়া হয়।”
=”অভ্ৰ, আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই, আমি জানতে চাই আমার সাথে এমন কেনো করা হলো।”
-“তোমার সাথে এমন কেনো করা হয়েছে আমি জানিনা, তবে তোমাদের ব্যাপারে যতোটুকু জানি বলছি। তুমি সহ বাকি দুজনও বেঁচে ছিলো, একজন…”
=”আমি আমার কথা জানতে চেয়েছি।” অভ্রর কথার মধ্যে বলে ওঠে অতন্দ্রিলা।
-“আমি তো বললাম যেটুকু জানি বলছি। আমাকে বলতে তো দাও।”
=”হ্যা, বলো।”
-“একজন তোমার সাথেই বেড়ে উঠছিলো, আরেকজনকে রাখা হয়েছিলো তোমার মধ্যে, অর্থাৎ সে তোমার গর্ভ থেকে জন্ম নিবে এভাবে। তুমি ছাড়া বাকি দুজনকে আমায় দেখানো হয়নি। কিন্তু তুমি বলেছ যে তোমার গর্ভপাত হয়, অর্থাৎ ওটা রিহা!”
=”রিহা?”
-“হ্যা, যে তোমার গর্ভে ছিলো ওর নাম রিহা।”
=”ও তো মারা গেছে তাইনা?”
-“ও হয়তো পৃথিবীর জন্য মারা গেছে।” বলতে বলতে হাতের ইশারায় কিছু একটা টেনে নিলো অভ্ৰ। অতন্দ্রিলা দেখলো সেটা ১টা স্বচ্ছ কাঁচের কী-বোর্ড এর মতো। অভ্রর মুখে চিন্তার ছাপ। খুব দ্রুত ওই কী-বোর্ডে হাত চালিয়ে কিসব করলো সে। আস্তে আস্তে ঘরের একপাশের বড় দেয়ালটা ঝাপসা হয়ে স্বচ্ছ কাঁচের স্ক্রিনের মতো হয়ে গেলো, সেখানে ফুটে উঠলো ১টা মিষ্টি বাচ্চা মেয়ের হাসিমুখ। বাগানের মতো একটা জায়গায় বসে আছে, কি সুন্দর খিলখিল করে হাসছে আর খেলছে। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে অতন্দ্রিলা।
-“এটাই রিহা।” স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে অভ্ৰ।
=”এটা আমার মেয়ে?” চোখে আনন্দের ছোয়া অতন্দ্রিলার। ছলছল চোখে রিহার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলল- “ও…ও বেঁচে আছে!”
-“হ্যা।”
=”কিন্তু কীভাবে! ওই বা এখানে কীভাবে আসলো?”
-“আমি জানিনা তন…অতন্দ্রিলা। তোমাদের পৃথিবীর হিসেবে ২ বছর আগে রিহাকে হঠাৎ করেই আমার গাড়িতে পাওয়া যায় একটা মাতৃ টিউবের মধ্যে ছিলো। দুই মাসের ভ্রূণ ছিলো ও তখন। ও কোথা থেকে আমার গাড়িতে আসলো আমি বুঝতে পারছিলাম না। তাছাড়া আমি নিজেও কেমন অসুস্থ বোধ করছিলাম তাই ওকে খুব দ্রুত ল্যাবে পাঠিয়ে দেই। ল্যাব থেকে জানায় যে ওর মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা গেলেও ও সুস্থ আছে।আমি তখন ওকে ভূমিষ্ঠ করাতে বলি। তারপর থেকে ওর দায়িত্ব আমারই, কিন্তু ওকে আমি বেশিরভাগ সময় ল্যাবেই রাখি, যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। আজ আমি কিছুটা বুঝতে পারছি যে ওকেও হয়তো তোমার মতো করেই পৃথিবী থেকে আনা হয়েছিলো। কিন্তু আমার গাড়িতেই কেনো? আর তোমাকেও আমার কাছেই কেনো আনলো? আর কীভাবে আনলো!” একটু থেমে চোখ মুখ শক্ত করে বললো- “অনেক কিছুই ঝাপসা থেকে যাচ্ছে যা আমাকে জানতেই হবে।”
=”আমাকেও জানতে হবে আমাকে এখানে কীভাবে আর কেনো আনা হলো। জানিনা আমার অভ্ৰর কি অবস্থা, ওতো আমাকে ছাড়া কিছুই করতে পারেনা।” অসহায় কণ্ঠে বলে উঠলো অতন্দ্রিলা।