#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
লেখনীতে- সানজিদা তাসনীম রিতু
অতন্দ্রিলা_আর_বৃষ্টি পর্ব-৪
=”কী?” কৌতূহলে জানতে চাইলো অতন্দ্রিলা। হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে অতন্দ্রিলার কাছে গিয়ে তার বাম কানের পাশে হাত দিলো অভ্র, শিউরে উঠে হাত সরিয়ে দিতে যাবে এমন সময় চিল্লিয়ে ওঠে অভ্র- “তুত-তুমি তন্দ্রা!”
=”কীহ! কে তন্দ্রা? আমি তো অতন্দ্রিলা। কার কথা বলছো তুমি!” আচমকা রেগে যায় অতন্দ্রিলা।
দুহাত দিয়ে মাথার চুল চেপে ধরে সরে গিয়ে আবার ধপ করে চেয়ারে বসে পরে অভ্র।
-“আমি জানি তুমি কিছুই জানো না বা মনে নেই, মনে থাকার বা জানার কথাও না। কিন্তু বিশ্বাস করো আমাকে, আমি মিথ্যা বলতে পারিনা। আমাদের ক্রিপটিতে কেউ মিথ্যা বলতে পারেনা, দরকারই হয়না।” হতাশ কণ্ঠে অভ্ৰ বললো।
=”কি বলছো তুমি এসব অভ্র! আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। গতকাল রাতেও আমি অতন্দ্রিলা ছিলাম। আমার ঘর, আমার সবকিছু… আর এসব কি বলছো তুমি! আমি নাকি তন্দ্রা! তুমি অভ্র আমার সামনে কিন্তু সে নাকি আমার অভ্র না, এটা নাকি পৃথিবী না, আমি…”কেঁদে ফেললো অতন্দ্রিলা।
অভ্র অতন্দ্রিলাকে না থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তারপর বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল- “বাবাদের গ্রুপ একটা অনেক বড় দায়িত্বে ছিলেন। তারা দেখতে চেয়েছিলেন যে একটা গ্যালাক্সি থেকে আরেকটা গ্যালাক্সিতে আমরা বাঁচবো কিনা কারণ আমাদের গ্রহটা ঘুরতে ঘুরতে সেরিনের দিকে যাচ্ছে। সেরিন আমাদের সৌরজগতেরই আরেকটা গ্রহ। যেখানে ভয়াবহ পাথর রুপি প্রাণীর বাস। ওখানকার আবহাওয়াও ভয়ংকর। ওরা একদম পাথরের মতো দেখতে, বিশালাকার, অনেক শক্তিশালী, ধূর্ত আর ভয়ংকর। ওদের গ্রহের কাছাকাছি গেলেই ওদের গ্রহের বায়ুমণ্ডলের প্রবল টানে আমাদের গ্রহ ওদের গ্রহের সাথে লেগে যাবে। সাথে সাথে ওরা আমাদের গ্রহকে আয়ত্তে নিতে থাকবে, ওরা তো তেমন নড়াচড়া করেনা তবে যে কোনো প্রাণীর ব্রেইন কন্ট্রোল করতে পারে তাই কোনো যুদ্ধ ছাড়াই আমাদেরকে ওদের বশবর্তী করে ওদের মতো পাথর বানিয়ে ওদের সাথে যুক্ত করে নিবে। ওদের সংস্পর্শে যা কিছুই যায় তাই ওরা ওদের মতো পাথর করে দেয় আর শক্তি বাড়াতে থাকে। তারপর আমাদের গ্রহটা ওদের সাথে মিশিয়ে আরো বড় করবে, আরো শক্তিশালী হবে আর একটা সময়ে ওরা পুরো সৌরজগৎ আর গ্যালাক্সি গ্রাস করে নিতে থাকবে এমনকি অন্য গালাক্সিতেও যেতে পারবে।”
অভ্রর কথা শুনে কখন কান্না থেমে গেছে অতন্দ্রিলার ও বুঝেনি। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে শুধু শুনে যাচ্ছে।
-“যাদের ভূমিষ্ঠ করা হয়ে গেছিলো তাদেরকে পাঠানো সম্ভব ছিলোনা কারণ তারা ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই এই গ্রহের আবহাওয়ার সাথে মিশে যায়, অন্য কোথাও বাঁচানো সম্ভব হয় না। তাছাড়া ব্ল্যাকহোল ভেদ করানোও সম্ভব না। সম্ভব ছিলো শুধু মাত্র ভ্রূণ পাঠানো তাও স্পেশাল টেকনোলজির মাধ্যমে। বাবার গ্রুপ সেই চেষ্টায় করতে থাকে। বাবাই পারতো ব্ল্যাকহোল তৈরি করতে, সে অনেক বছর যাবৎ অনেক চেষ্টার পরে সফল হয়েছিলো।”
=”ব্ল্যাকহোলের কাজ কি আসলে?” অতন্দ্রিলা কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলো।
-“ব্ল্যাকহোলের কাজ বলতে, এটা আসলে মহাকাশের এমন একটি অঞ্চল বা জায়গা যেখানে মাধ্যাকর্ষণ এতোটাই শক্তিশালী যে, কোন কণা বা পরমাণু এমনকি আলোর মতো বৈদ্যুতিক চৌম্বকীয় বিকিরণও এর থেকে বাঁচতে পারে না। সব কিছু নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে অন্য কোথাও ছেড়ে দেয় যেগুলোকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা ট্র্যাক করা ছাড়া খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, একটি যথেষ্ট কমপ্যাক্ট ভর দ্বারা একটি ব্ল্যাকহোল তৈরি করার জন্য একটি গ্যালাক্সির সময় বিকৃত অর্থাৎ পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।”
=”ওহ!” একটা ঢোক গিলে এটুকুই বলে অতন্দ্রিলা। এতো জটিল জটিল কথা তার বুঝতে পারার কথা না, কারণ সে তো পৃথিবীর সাধারণ পরিবেশে বড় হয়েছে।
-“বুঝেছো কিছু?”
=”কিছুটা। ওইতো সহজ মানে হচ্ছে ব্ল্যাকহোল তার মধ্যে সব কিছু নিয়ে খেয়ে ফেলে তারপর হজম করতে না পেরে অন্য কোথাও উগরে ফেলে।”
অতন্দ্রিলার দিকে পিছন ঘুরেই দাঁড়িয়ে ছিলো অভ্র, ওর কথা শুনে মুচকি হাসলো।
-“আচ্ছা শোনো, তারপর গ্রুপের সবাই মিলে স্পেশাল মেশিনও বানিয়ে ফেলে যেটা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ছিলো।”
=”স্যাটেলাইট কি?” আবার জানতে চায় অতন্দ্রিলা। সে তো এসব শব্দ শুনেইনি কখনো।
-“তুমি অনেক প্রশ্ন করো, অবশ্য প্রশ্ন করা স্বাভাবিক। স্যাটেলাইট হচ্ছে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ, যেমন পৃথিবীর চাঁদ একটি উপগ্রহ কিন্তু প্রাকৃতিক। এটি এমন একটি বস্তু যা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো গ্রহের কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। এর কাজ হচ্ছে তরঙ্গের মাধ্যমে কোনো গ্রহ বা স্পেসের অর্থাৎ মহাকাশের নির্দিষ্ট কিছু বা কোনো জায়গার খবর সংগ্রহ করে আদান-প্রদান করা।”
=”আচ্ছা বুঝলাম, তারপর?”
-“আমরা আছি ২য় গ্যালাক্সিতে, আর তোমাদের গ্রহ আছে ৯ম গ্যালাক্সিতে। ক্রমানুসারে ৩য়, ৪র্থ আর ৫ম গ্যালাক্সিতে একসাথে ৬টা করে ভ্রূণ পাঠানো হয়, সব গুলোই ছিলো ৪ মাস থেকে ৬ মাসের মধ্যকার…”
=”ভ্রূণ কিভাবে পাঠানো সম্ভব! ভ্রূণ তো গর্ভে থাকে।” অভ্রর কথার মাঝেই বলে ওঠে অতন্দ্রিলা।
-“না, আমাদের এখানে ভ্রূণের বয়স ৭ দিন হলেই আলাদা করে মাতৃ টিউবে রাখা হয়। মাতৃ টিউব হলো গর্ভ বা অমরার মতো, এমন একটি টিউব যাতে ভ্রূণের প্রয়োজনীয় সকল উপাদান থাকে। আলাদা করা হয় যাতে কম সময়ে বেশি ভ্রূণ তৈরি করা যায় কারণ আমাদের বয়সসীমা বেশি হলেও মৃত্যুহার অনেক বেশি। সময় আর প্রয়োজন মতো ভ্রূণ গুলোকে বড় করে ভূমিষ্ঠ করানো হয়।”
=”এটা কীভাবে সম্ভব! অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অতন্দ্রিলা।”
-“সম্ভব, তোমাদের চেয়ে আমরা টেকনোলজিতে অনেকটা এগিয়ে, তোমরা যেগুলো কল্পনাও করতে পারবেনা সেগুলো আমাদের এখানে প্রতি সেকেন্ডে হয়। যাইহোক, আমাকে বলতে দাও নাতো তুমি কিছু বুঝবেনা আর আমিও কোনো সমাধান পাবোনা। ৩য়, ৪র্থ আর ৫ম গালাক্সিতে ওদের গ্যালাক্সির নির্দিষ্ট গ্রহের নিয়ম অনুযায়ী ভ্রূণগুলোকে প্রতিস্থাপন করা হয়, কিন্ত শুধুমাত্র ৫ম গ্যালাক্সির ১টা ভ্রূণ ওই গ্রহের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে। বিজ্ঞানীরা ভাবেন হয়তো ভ্রূণের বয়স বেশি হওয়ার জন্য তারা অন্য গ্রহে টিকতে পারছে না তাই পরবর্তীতে পাঠানো হয় ৯ম মানে তোমাদের গালাক্সির গ্রহ পৃথিবীতে ১২টা ভ্রূণ। এবার সবগুলো ছিলো ১৫ দিনের বয়সের। কিন্তু সেখানেও বেঁচে থাকে মাত্র ৩টা। ঠিক কি কারণে ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো সেটা বের করা যাচ্ছিলো না। এদিকে বাকি সব গুলো গ্যালাক্সির নির্দিষ্ট গ্রহতে যাওয়ার ব্ল্যাকহোল হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় তোমাদের টা বাদে। অনেক চেষ্টা করেও আর ব্ল্যাকহোল তৈরি করা যাচ্ছিলো না তাই প্রতিনিয়ত ওই ৩টা ভ্রূণের উপর পর্যবেক্ষণ করা হতো। নিরাপত্তা দেয়া হতো যেনো এটাই আমাদের শেষ ভরসা ছিলো। তিনটা ভ্রূণের মধ্যে ১টি পুরুষ ভ্রূণ প্রথমে আর তোমাদের পৃথিবীর হিসেবে তার ৪ বছর পর আরেকটি মেয়ে ভ্রূণ অর্থাৎ তোমাকে ভূমিষ্ঠ করানো হয় পৃথিবীর নিয়মেই। এদিকে তখন পৃথিবীর ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বারবার সূক্ষ্ণ গবেষণা করা হয় কয়েকবছর ধরে। পরিবেশের ব্যাপারটা আয়ত্তে আনার পর যখন আবারও ভ্রূণ পাঠানো হবে ঠিক সেই মুহূর্তে শেষ ব্ল্যাকহোলটাও বন্ধ হয়ে যায়, আমরা আর কোনো যোগাযোগ রাখতে পারিনা তোমাদের গ্রহের সাথে।”
=”তুমি তো অনেক কিছুই জানো।” হালকা হেসে বলে অতন্দ্রিলা।
-“বাবার জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে জেনেছি, কিছু গবেষণাও করেছি মহাকাশ নিয়ে কিন্তু আমাকে তো আলাদা করে রাখা হয়েছে তাই তেমন কিছু করে উঠতে পারিনি আর খুব বেশি জানতেও পারিনি।”
=”তারপর কি হলো?” চরম কৌতূহলে প্রশ্ন করে অতন্দ্রিলা।
-“তখন তোমাদের বয়স যথাক্রমে ১০ আর ৬ বছর। তোমরা পৃথিবীর নিয়মেই বেড়ে উঠছিলে, কিন্তু তারপরের আর কিছুই আমরা কেউ জানিনা। অথবা হয়তো আমাকে জানানো হয়নি।”
=”আমি!”
-“হ্যা, তুমি কি?”
=”আমি পৃথিবীর মানুষ না!” অতন্দ্রিলা তার দুইহাত চোখের সামনে তুলে দেখতে থাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে।
-“হ্যা, তুমি এখনও পৃথিবীর মানুষ, কারণ ক্রিপটি গ্রহের সবকিছুই তোমার মধ্যে সুপ্ত আছে।”
=”কিন্তু…কিন্তু…”
-“কী?”
=”আমি এখানে আসলাম কীভাবে আর কেনো? তোমার সাথে আমার সম্পর্ক কি? এই গ্রহে কেনো আমাকে আবার আনা হলো? তুমি কেনো আমার হাজবেন্ডের মতো দেখতে? কেনো? কেনো?” প্রশ্নগুলো করে চিৎকার করে আবার কাঁদতে থাকে সে।