Friday, July 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 349



প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৫

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৫
জাওয়াদ জামী জামী

বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই কুহু ওর চাচাকে বাইক থামাতে বলল। ও এইখানেই নেমে যেতে চায়। সাইদ আহমেদ অনেকবার বলেও কুহুকে মানাতে পারলনা। বাধ্য হয়ে সে কুহুর কথায় রাজি হয়। আসলে কুহু চায়না ওর চাচি যেনে যাক বিষয়টা। তাহলে সে অশান্তি করবে। কুহু বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেই সাইদ আহমেদ ওকে ডাক দেয়। কুহু পেছনে ঘুরে তাকালে দেখতে পায় সাইদ আহমেদ টাকা বের করেছে।

” কুহু মা, এই টাকাগুলো নে। মাছ-মাংস কিনবি। সৃজনের স্কুলের জুতা জোড়াও দেখলাম নষ্ট হয়ে গেছে। ওকে জুতা কিনে দিস। ”

কুহু চাচার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসল। ও বুঝতে পারছে ছোট চাচা খুব আশা নিয়ে টাকাগুলো ওকে দিতে চাইছে। কিন্তু কুহু নিরুপায়। ছোট চাচি যদি এই কথা শোনে, তবে নির্ঘাত ওদের বাড়িতে গিয়ে ওর গায়ে হাত তুলবে। আরেকবার সংসারে অশান্তি বাঁধবে। তাছাড়া ওর মা’ও হয়তো কিছুতেই টাকাগুলো নিতে চাইবেনা। কুহু কিছুতেই অশান্তি চায়না।

” টাকা লাগবেনা, চাচা। তুমি আমাদের জন্য দোয়া কর। ”

” আমাকে পর করে দিচ্ছিস, মা? এভাবে আমাকে দূরে ঠেলে দিসনা। এই টাকাগুলোর ব্যাপারে শিরিন কিছুই জানতে পারবেনা। ”

” চাচিকে লুকিয়ে আমাদের কিছু দেয়া তোমার ঠিক হবেনা, চাচা। আমি সামনের মাসে বেতন পেলেই সৃজনকে জুতা কিনে দেব। এই মাসে আরও কয়েকজন ছাত্র পেয়েছি। আশা করছি আমাদের সংসারে আর কোন সমস্যা থাকবেনা। ”

” আমি আসলেই তোদের চাচা হবার যোগ্য নই। হয়তোবা কখনো তোদের সেভাবে ভালোবাসতেই পারিনি। তাই তোরা আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস। আর ভাবিও আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। ” সাইদ আহমেদের চোখে ছলছল করছে পানি। যা দেখে কুহুর কান্না পায়। কিন্তু ও নিজেকে শক্ত করে।

” তুমি এভাবে বলোনা, চাচা। আমরা কেউই তোমার থেকে দূরে যাইনি। আমরা যেমন ছিলাম তেমনই আছি। শুধু আমাদের মাঝখানে একটা অদৃশ্য পর্দা এসে আমাদের একটু আড়াল করে দিয়েছে। কিন্তু দেখ এই অদৃশ্য পর্দা আমাদের ভালোবাসা, স্নেহ একটুও কমাতে পারেনি। আমি যাই, চাচা। মা’য়ের শরীর খুব একটা ভালো নয়। আমাকে গিয়ে রান্না করতে হবে। ”

কুহুর কথা শুনে ধক্ করে উঠল সাইদ আহমেদের বুক। সে চিন্তিত মুখে বলল,

” কি হয়েছে, ভাবির? আমাকে আগে কিছু বলিসনি কেন? ”

চাচার অস্থিরতা বুঝতে পেরে কুহু ম্লান হাসল।

” কয়েকদিন থেকেই মা কিছু খেতে পারছেনা। দিনরাত কান্নাকাটি করে। রাতে ঠিকমত ঘুমাতেও পারেনা। ঘুমের ঔষধেও কাজ করছেনা। ”

” কি বলছিস এসব! বাইকে ওঠ, আমি ভাবিকে দেখতে যাব। ” সাইদ আহমেদ অস্থরচিত্তে বলল।

” চাচা, তুমি বাড়ি যাও। তোমার হুটহাট নেয়া কোন সিদ্ধান্তে আবার সমস্যা সৃষ্টি হবে। এরপর কোন সমস্যা হলে, আমি মা’কে সামাল দিতে পারবনা। ”

কুহুর কথার মানে বুঝতে পেরে সাইদ আহমেদও চুপসে যায়। সে বুঝতে পারছে কুহুর ভয়ের কারন। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় আজকে নয় বরং কালকে ভাবিকে দেখতে যাবে। এবং শিরিনকে জানিয়েই সে ঐ বাড়িতে যাবে।

শাকিলা সুলতানা সকাল সকাল ভাইয়ের বাড়িতে এসেছেন। গতরাতে তিনি আইরিনের শারিরীক অবস্থা জানতে পেরে ফজরের নামাজের পরই রওনা দেন।

আইরিন পারভিন বারান্দার এককোণে বসে কাঁদছেন। তিনি কিছুতেই স্বামীর স্মৃতি ভুলতে পারছেননা। তাছাড়া সংসারের অভাব অনটনের কথা চিন্তা করলেও তিনি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে এই দূর্মুল্যের বাজারে কিভাবে টিকে থাকবেন সেই চিন্তা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

ভাবিকে উদাসভাবে বসে থাকতে দেখে শাকিলা সুলতানার চোখে পানি জমা হয়। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন ভাবির এমনভাবে বসে থাকার কারণ। তিনি পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে আইরিন পারভিনের কাছে বসলেন।

” ভাবি, তুমি এত মন খারাপ করোনা। দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার চোখের পানি, প্রিয়জন হারানোর বেদনা, কুহুর ত্যাগ বৃথা যাবেনা। ”

” জানিনা কবে সেই দিন আসবে। আমার ছেলে-মেয়ে অল্প বয়সেই কত বড় হয়ে গেছে, বুঝদার হয়েছে। নিজেদের চাওয়া-পাওয়াকে মাটি চাপা দিয়ে, ভালো থাকার, হাসার অভিনয় করছে অহরহ। আমাকে বোঝাতে চাইছে ওরা ভালো আছে, ওদের কোন কষ্ট কিংবা সমস্যা নেই। মা হয়ে আজ ছেলে-মেয়েদের মিথ্যা অভিনয় দেখতে হচ্ছে আমাকে। আজ নিজেকে বড্ড অযোগ্য মনে হচ্ছে, শাকিলা। এখন বারবার মনে হয়, কেন লেখাপড়া করিনি। তোমার বড় ভাই বিয়ের পর অনেকবার আমাকে বলেছে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে। কিন্তু তার কথা না শুনে সংসারে মনযোগী হয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারি তার কথার মুল্য। ” ডুকরে কেঁদে উঠলেন আইরিন পারভিন।

শাকিলা তার ভাবিকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আইরিন পারভিন কেঁদেই চলেছেন।

” ভাবি, এভাবে কেদোঁনা। তুমি পড়াশোনা না করে সংসার করেছ, সেটাও খারাপ করোনি। তোমার দিক থেকে তুমি সঠিক ছিলে। তুমি দেবর-ননদের মানুষ করেছ, তারা আজ সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, তার কারন একমাত্র তুমি। কিন্তু আজ যখন তোমার বিপদ, তাদের উচিত ছিল তোমার পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু তারা সেটা করেনি। তোমার বিপদে তুমি পরিবারের সদস্যদের সাথে বেইমানী করোনি। কিন্তু তোমার নিজ হাতে গড়ে তোলা আপনজনেরাই তোমার সাথে বেইমানী করেছে। এর জন্য দায়ী তারা। তারা নিজেদের দ্বায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ”

” আমি তাদের কোন দোষ দিইনা, শাকিলা। তাদের ভালো আমি সব সময়ই চেয়ে এসেছি, এবং আজও চাই। ওরা সুখী হয়েছে এটা দেখলেও আমার শান্তি লাগে। দোষ আমার ভাগ্যের। নইলে কি বাপের বাড়ি থেকে চিরতরে বিতাড়িত হই। আমার বাপের বাড়ি থেকেও নেই। আব্বা-আম্মার মৃ’ত্যু’র সাথে সাথে ঐ বাড়ির সম্পর্কও চুকেছে। তিন ভাই কোনদিন তাদের একটামাত্র বোনের খবর নেয়না। এর থেকে বড় দূর্ভাগ্য কোনও মেয়ের কি হতে পারে! আমার স্বামী তিনটা বছর ধরে মৃ’ত্যু’র সাথে যুদ্ধ করে গেছে, কিন্তু আমার ভাইয়েরা একবারও তার খবর নেয়নি। এমনকি তার মৃ’ত্যু’র পরও কেউ একটিবারের জন্যও খবর নেয়নি। ” আবারও হু হু করে কেঁদে উঠলেন আইরিন পারভিন।

শাকিলা সুলতানা কিভাবে ভাবিকে শান্তনা দেবেন সেটা ভেবে পাচ্ছেননা। তিনি অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে রইলেন ভাবির দিকে।

তাহমিদ কলিং বেল বাজিয়ে বাহিরে অপেক্ষা করছে। অধৈর্য হয়ে বারবার হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে ও। প্রায় দশ মিনিট যাবৎ ও দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদ বেশ বুঝতে পারছে এই রাত দেড়টায় ওকে দরজা খুলে দেয়ার জন্য কেউ জেগে নেই। সেই সাথে এটাও বুঝতে পারছে, কে বাসার মেইডদের জেগে থাকতে বারণ করেছে। চিন্তাটা মাথায় খেলে যেতেই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে। কিন্তু ওকে বাসায় যেতেই হবে। কি করবে ও। কিছুটা সময় চিন্তা করার পর ও সামনের দিকে তাকায়।

ওর ব্যালকনির সামনে সগৌরবে মাথা তুলে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে কাঁঠালচাঁপার গাছ। হাতে থাকা ব্যাগ দরজার সামনে রেখে, জুতা খুলে এগিয়ে যায় কাঁঠালচাঁপা গাছের দিকে। গাচের গোড়ায় এসে তাহমিদ হাত বুলিয়ে দেয় গাছটায়। ওর মনে পরে যায় সেদিনের কথা। যেদিন মা’য়ের হাত ধরে স্কুল থেকে আসবার সময় বায়না ধরেছিল নার্সারিতে যাওয়ার । অনেকদিন থেকেই ওর নজর ছিল নার্সারির দিকে। নার্সারির গাছগুলোয় ফুটে থাকা নানান ধরনের ফুল ওকে আকর্ষিত করত। ওর মা মিথিলা আরজুমান্দও ছেলের বায়না মেটাতে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিল নার্সারিতে। সেই নার্সারিতে ছিল একটা বড় কাঁঠালচাঁপা গাছ। সেখানে থোকায় থোকায় ফুঁটে ছিল কাঁঠালচাঁপা। ছোট ছোট পায়ে তাহমিদ এগিয়ে যায় সেদিকে। ততক্ষণে ওর পুরো নাসারন্ধ্র কাঁঠালচাঁপার সুবাসে আটকে গেছে। এই ফুলের সৌন্দর্যে, সুবাসে এতটাই মোহিত হয়ে যায় তাহমিদ, মা’কে বলে একটা চারাগাছ কিনে নেয়।

বাসায় এসে মালী চাচাকে নিয়ে এখানে লাগিয়ে দেয় সেই চারাগাছ। কারন সেই ছোটবেলায় একদিন ওর মা বলেছিল, দোতলার দক্ষিণের ঝুল বারান্দাওয়ালা রুমটা ওর হবে। ছোট্ট তাহমিদ তখনই বুঝেছিল এই চারাগাছ একদিন নার্সারির গাছটার মত অনেক বড় হবে। আর ও একদিন বড় হয়ে ঝুল বারান্দায় এসে বসে কাঁঠালচাঁপার সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হবে।

এত বছর পর আবার সেইদিনের কথা মনে পরে যায় তাহমিদের। চোখের কোনে চিকচিক করতে থাকে অবাধ্য অশ্রুকনা। সেই চারাগাছ আজ অনেক বড় হয়েছে। এর ডালগুলো তাহমিদের ঝুল বারান্দায় এসে থোকা থোকা ফুলে ভরিয়ে দেয়। তাহমিদ রুমে থেকেও সেই সুবাস পায়। কিন্তু সে এখন আর কাঁঠালচাঁপার সুবাসে মোহিত হতে পারেনা। ওর ভেতরে অনেক আগেই জায়গা করে নিয়েছে সম্পর্কহীনতার দুষিত গন্ধ। গাছটা সদর্পে দাঁড়িয়ে থাকলে কি হবে, তাহমিদ এখন আগের সেই তাহমিদ আর নেই। সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুই বদলে গেছে। সেই ছোট্ট তাহমিদ ভুগেছে নিরাপত্তাহীনতায়, দগ্ধ হয়েছে অপমান আর অবহেলার বিষাক্ত বাণে। সর্বোপরি ও পেয়েছে এক ঘৃণিত জীবন।
চোখের পানি মুছে তাহমিদ গাছে উঠতে শুরু করল। একটা মোটা ডাল ওর বারান্দায় চলে গেছে। তাহমিদ অতি সন্তপর্ণে সেই ডালে পা রাখল। বেশ কয়েক বছর পর ওকে এই কাজ করতে হচ্ছে।

ঘুম থেকে উঠতে নয়টা বেজে যায়। এদিকে তাহমিদের ক্লাস নিতে হবে সাড়ে দশটায়। ও ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছাড়ল। এখনই যদি না বের হতে পারে তবে ক্লাসে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে।

পরিপাটি হয়ে দোতলা থেকে নামতেই তাহমিদ মুখোমুখি হয় ওর বাবা রাশেদ কুরাইশির। ভদ্রলোক অফিসের উদ্দেশ্য বাসা থেকে বের হচ্ছিল।

” তাহমিদ, তুমি গতরাতে বাসায় এসেছিলে! কখন এসেছিলে? ”

” দেড়টার দিকে। ” তাহমিদ হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে আবার পিছু ডাকে রাশেদ কুরাইশি।

” খেয়ে যাও। এভাবে বেরিয়ে যাচ্ছ কেন? ”

” জাষ্ট আ মিনিট। তুমি তোমার ছেলেকে আগে জিজ্ঞেস কর, ও বাসায় ঢুকেছে কিভাবে। আমি সকালে মেইডদের জিজ্ঞেস করেছি, তারা বলেছে তোমার ছেলে রাতে বাসায় ফেরেনি। ইনফ্যাক্ট ওরা কেউ দরজা খুলে দেয়নি। ”

স্ত্রী’র কথা শুনে ভ্রু সংকুচিত হয় রাশেদ কুরাইশির। সে উত্তরের আশায় তাকায় তাহমিদের দিকে।

তাহমিদ রাশেদ কুরাইশির মনোভাব বুঝতে পেরে ব্যাঙ্গের হাসি হাসল।

” আমি গাছ বেয়ে ভেতরে ঢুকেছি। রাত দেড়টায় আমাকে অভ্যর্থনার জন্য কেউই জেগে ছিলনা। তবে জেগে ছিলনা নাকি ঘুমাতে বাধ্য করা হয়েছে সেটা এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। আশা করছি আপনাদের উত্তর পেয়ে গেছেন? এবার আমাকে যেতে হবে। ” তাহমিদ কারও কোন উত্তরের আশা না করেই বেরিয়ে যায়।

” তোমার ছেলে কতবড় বেয়াদব সেটা তো নিজের চোখেই দেখলে, রাশেদ? ও চোর-ডাকাতদের বাসার ভেতরে ঢোকার রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছে! তোমার আস্কারা পেয়েই ও এতটা বেড়েছে। সব কিছুর জন্য তুমিই দায়ী। আমি জাস্ট অসহ্য হয়ে গেছি তোমার ছেলের এরূপ আচরনে। ”

রাশেদ কুরাইশি স্ত্রী’র কথার প্রত্যুত্তর না করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সে ভালো করেই জানে তার অনিহার কারণেই আজ তাহমিদ ছন্নছাড়ার ন্যায় এদিকওদিক ঘুরে বেড়ায়। সে যদি প্রথম থেকেই ছেলেটার প্রতি সদয় হত তবে আজ তার ছেলে একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারত।

স্বামীর বেরিয়ে যাওয়া দেখে ডেইজি কুরাইশি বাকহারা হয়ে তাকিয়ে থাকে।

চলবে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৪

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৪
জাওয়াদ জামী জামী

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘাসের ওপর সটান হয়ে শুয়ে আছে তাহমিদ। মাথার নিচে দুইহাত দিয়ে রেখেছে। তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ওর কাছে বরাবরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আকর্ষনীয় লাগে। তাই নানার বাড়িতে আসলেই ও ছুটে আসে এখানে।
তাহমিদের পাশে বসে ওকে খুঁটিয়ে দেখছে ওরই বন্ধু সজল। সে বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক। সে তাহমিদের ছোটবেলার বন্ধু। এইচএসসি পর্যন্ত ওরা একসাথে পড়াশোনা করেছে। এরপর তাহমিদ চান্স পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর সজল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রেজাল্ট ভালো হওয়ায় এখানেই শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছে সজল। আর তাহমিদ জয়েন করেছে দেশের নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে।

” ঐ ব্যাটা, চোখ সরা। এভাবে কি দেখিস? এই মুহূর্তে আমাকে কি কোন রমনী মনে করছিস? ” তাহমিদের কথা শুনে হেসে উঠল সজল।

” আমার বাসায় একটা সুন্দরী বউ আছে। তাই তোকে রমনী মনে করার কোন ভুল আমি করবনা। আমি তোর ত্বক দেখছিলাম। বয়স তো কম হলোনা বিয়ে করবি কবে? আর দুই বছর গেলেই চামড়া কুঁচকে যাবে। তখন বিয়ে করার মত মেয়ে পাবিনা। ”

” তুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার হয়েছিস জন্যই অকালে বউ পেয়েছিস। তাই বলে নিজেকে এভাবে জাহির করতে হবেনা, বুঝলি? সারাজীবন তোকে দেখে এসেছি রোড সাইড রোমিও হিসেবে। কোন মেয়ে পাত্তা দেয়নি, কিন্তু নিজেকে একাই একশো ভাবতিস। আজ সেই তুইও আমাকে ক্রিটিসাইস করছিস! তোর মত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার হতে পারিনি জন্যই অকালে কোন বউ পাইনি। আর ভবিষ্যতে বোধহয় পাবোওনা। তাই বিয়ের কথা আপাতত চিন্তা করছিনা। ”

” ফাঁপড় নিচ্ছিস, মামুর ব্যাটা! তুই ছিলি আমাদের স্কুলের সেরা স্টুডেন্ট। এমনকি কলেজেও তাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের টপার ছিলি তুই। কর্তৃপক্ষ তোকেও সেখানেই রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তুই তাদের কথার কর্ণপাত করেছিস? যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলি, সেখানে তুই কি করলি? সেই প্রস্তাব নাকোচ করে দিলি। আর গিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করলি। আবার কত ভালো ঘরের মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আসছে কিন্তু তুই একবারও সেদিকে নজর দিয়েছিস? আমাকে উল্টাপাল্টা বুঝ দিলেই যেন মেনে নেব! ”

” আরে সজল, তুইও মামুর ব্যাটা বুলছিস? এখানকার ভাষা বুঝি আয়ত্ত করে নিয়েছিস? চালিয়ে যা, দোস্ত। ”

সজল বুঝতে পারছে তাহমিদ প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু ও সেটা হতে দেবেনা।

” আমি এখানে একটা মেয়ের খোঁজ পেয়েছি। সে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী। বাবা ব্যাংকার, মা সরকারি কলেজের টিচার। মেয়েরা এক ভাই, এক বোন। তোর সাথে মানাবে। তুই আগামী সপ্তাহে রাজশাহীতে আসলে, মেয়েটার সাথে দেখা করবি। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব। ”

সজলের কথা শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল তাহমিদ। ওর চোখমুখ থমথমে হয়ে গেছে। ওর সামনে অন্য কেউ থাকলে এতক্ষণ তার গালে
সপাটে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিত সে। নেহাৎ সজল ওর বন্ধু তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সজলও তাহমিদের মনোভাব বুঝতে পেরেছে। তাই সে আবার কথা বলল।

” কি আমাকে থা’প্প’ড় মা’র’তে ইচ্ছে করছে? অসুবিধা নেই মা’র’তে পারিস। তুই মে’রে আমার হাত- পা ভেঙে দিলেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকব। ”

সজলের কথার ভেতর একগুঁয়ে ভাব দেখে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে তাহমিদ।

” সজল, তুই সবকিছু জানার পরও কেন এমন করছিস! সারাজীবন আমি মানুষের উপহাসের সম্মুখীন হয়েছি, কখনোবা হয়েছি করুণার পাত্র। তুই আবার নতুন করে আমাকে উপহাসের পাত্র বানাতে চাস? আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি, সজল। আমাকে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে দে। থাকিনা একা। বেশ তো আছি। নাকি আমার সুখ তোর সহ্য হয়না? ”

” শা’লা, দিব এক লা’থি। তোর একটুখানি সুখের জন্য আমি এতকিছু করছি, আর তুই বলছিস আমি তোর সুখ সহ্য করতে পারিনা? আমার একটা বোন থাকলে, তোকে এভাবে রিকুয়েষ্ট করতামনা। ঘাড় ধরে সোজা কাজী অফিসে নিয়ে যেতাম। ”

” তোর একটা বোন থাকলে আমার থেকে তাকে লুকিয়ে রাখতি। কোন পরিবারই চায়না, একটা ভ্যাগাবন্ডের নিজের মেয়েকে জড়াতে। ”

” তুই শা’লা নিজের দোষে ভ্যাগাবন্ড হয়েছিস। মানুষের জীবনে কতরকম চমক থাকে, দুঃখ-দুর্দশা থাকে। তাই বলে কি সব মানুষই স্বঘোষিত ভ্যাগবন্ড হয়? তুই গুটিকয়েক মানুষের জন্য নিজেকে এভাবে গুটিয়ে নিবি তা আমি কল্পনাও করতে পারিনা। অথচ তুই ছিলি আমার দেখা সবথেকে দৃঢ়চেতা মানুষ। তোর কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করা যায়না। এটা দুঃখজনক। ”

” মাস্টার, তালুকদার সাহেবকে কোথাও দেখা যায়না যে? সে কি তার বন্ধুর সাথে ক্যাম্পাসের বাহিরে গেছে নাকি? ”

তাহমিদকে আবার প্রসঙ্গ পাল্টাতে দেখে হতাশ হয় সজল। ও তাহমিদকে কিভাবে রাজি করাবে তা ভেবে পায়না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়,

” অনেকদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে, তাই হয়তো কোথাও আড্ডা দিচ্ছে। তুই কি এখনই বাসায় যাবি? প্রতি সপ্তাহে রাজশাহী আসিস, আমার সাথে দেখা করিস, অথচ একদিনও আমার বাসায় গেলিনা। তুই আমাকে এত পর ভাবিস কেন বলতো? ”

সজলের কথায় স্পষ্টই অভিমানের ছাপ। তাহমিদ হেসে ফেলল। এই ছেলেটা ওকে এত ভালোবাসে কেন বুঝতে পারেনা তাহমিদ। ছোট থেকেই সজল ওর একনিষ্ঠ ভক্ত। তাহমিদের কোন দোষ কখনোই ওর চোখে পরেনা। তাহমিদ ওর সাথে রা’গ করলেও ও কিছু মনে করেনা। তাহমিদ ভাবে, ওর জন্য যারা চিন্তা করে, ওকে যারা নিঃসার্থভাবে ভালোবাসে তাদের মধ্যে সজলও একজন। হঠাৎ করেই তাহমিদের ইচ্ছে জাগে সজলকে রা’গি’য়ে দেয়ার।

” তোর বাসায় আমি এ জন্মেও যাবনা। আর তুইও আমাকে কখনো জোর করিসনা। নিজের পায়ে নিজে কু’ঠা’র মা’রি’স’না। ”
তাহমিদের কথার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে সজল। এদিকে সজল কথা বলেই চলেছে।

” তোর বউ আমাকে দেখলে নির্ঘাত আমার প্রেমে পরে যাবে। তখন তোকে দু-চোখেও দেখতে পারবেনা। সব ছেড়ে আমার কাছে আসতে চাইবে। কোনভাবেই তাকে তুই আটকে রাখতে পারবিনা। তুই তো জানিসই, মেয়েরা আমাকে দেখলে কেমন হুমড়ি খেয়ে পরে। তোর বউও তার ব্যাতিক্রম হবেনা দেখিস। ”

তাহমিদের কথা শুনে সজল ওর পিঠে ধুপধাপ কয়েকটা বসিয়ে দেয়। ও ভালো করেই জানে তাহমিদ ওর সাথে ঠাট্টা করছে।

” তাহলে থাক, আমার বাসায় যাওয়ার দরকার নেই। একসময় মেয়েরা তোর পেছনে যেভাবে ঘুরঘুর করত! আমার বউ যে তোকে দেখে মত পাল্টাবেনা সেটা আমি বলতে পারিনা। সিরিয়াস বিষয় মনে করিয়ে দেয়ার জন্য তোকে ধন্যবাদ দেবনা। ”

সজলের কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠল তাহমিদ। ওর সাথে সজলও তাল মেলাল।

রাতে বাসায় আসতেই স্ত্রী’র রোষানলে পড়তে হয় রায়হান আহমেদকে। নায়লা আঞ্জুম বেডরুমে তার অপেক্ষায়ই ছিল।

” তুমি এতক্ষণ যাবৎ কোথায় ছিলে? তোমার কি একবারও মনে চায় উইকেন্ডে স্ত্রী-সন্তানদের সময় দিতে? আর তোমার কি মিনিমাম চক্ষু লজ্জাটুকুও নেই! তাহমিদ তোমার ছেলের বয়সী। আর ছেলের বয়সী কারও সাথে আড্ডা দিতে তোমার লজ্জা লাগলোনা? ”

” বাব্বাহা হঠাৎ বউয়ের মত আচরণ করছ যে! আমাকে নিয়ে এত চিন্তার কারণ কি? এতদিন জানতাম আমার টাকা, যোগ্যতা আর পজিশন নিয়ে তুমি চিন্তা কর। আজকে দেখছি সেগুলোর সাথে লজ্জাও যুক্ত হয়েছে! তোমার সমস্যা কোথায় আমাকে বলতো? আমি কি নিজের মত করে চলতেও পারবনা? এখন থেকে কার সাথে বাহিরে যাব, আড্ডা দেব সেটাও তুমি ঠিক করে দেবে? ”

” রায়হান, তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন? তুমি ভুলে যেওনা আমি কে? সমাজের আমার পজিশন কি। হঠাৎ করেই সাহসী হতে চাইছ নাকি? ”

” তুমিও ভুলে যেওনা আমি কে। সমাজে আমার পজিশন কি। আর একটা কথা মনে রেখ, তোমার বাবা অনেক আগেই মা’রা গেছে। তাই অযথাই সবখানে বাবাকে টেনে এনে নিজেকে পরিহাসের পাত্রী করোনা। তুমি বিয়ের পর থেকে সব জায়গায় আমার পরিচয়ে পরিচিত। সবাই তোমাকে সম্মান করে আমার জন্য। কথাটা মনে রাখলেই তোমার জন্য ভালো হবে। ” রায়হান আহমেদের বেশি কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছেনা। তাই সে কাপড় পাল্টে বিছানায় যায়। আজ অনেকদিন পর নিজের জন্য সময় বের করেছে। বন্ধুর সাথে অতীত রোমন্থন করেছে। এজন্য তার মন-মেজাজ বেশ ফুরফুরে আছে। তাই স্ত্রী ‘ র সাথে বিতণ্ডায় জড়িয়ে তার রেশ নষ্ট করতে চায়না।

নায়লা আঞ্জুম স্বামীর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছে। যে মানুষটা আজ পর্যন্ত তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনি, আজ সে হঠাৎ এভাবে রিয়্যাক্ট করল ভাবতেই রা ‘গে সে ফুঁসছে। সে চাইছে স্বামীকে আরও দু-চার কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু স্বামীকে পাশ ফিরে শুতে দেখে হাতের কাছে থাকা দামী ফুলদানি আছাড় মা’র’ল।

রায়হান আহমেদ বুঝতে পারল নায়লা আঞ্জুম কিছু একটা ভেঙেছে। সে কোনও প্রতিবাদ না করে ঠোঁটের কোনে ব্যাঙ্গের হাসি নিয়েই ঘুমের চেষ্টা করছে।

কলেজ থেকে বাড়ি ফিরতে আজকে কুহুর একটু দেরিই হয়েছে। ক্লাস শেষ করে ফিজিক্স স্যারের কাছে বসে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেখিয়ে নিয়েছে। এরপর দুইটা কোচিং করে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। দুইটা কোচিং-এর স্যারই ওর বাবার ছাত্র ছিল। তারা কুহুর বাবাকে খুব সম্মান করে। তারা কুহুদের বর্তমান পরিস্কার জানে। তাই কুহু কলেজে ওঠার পর তারা বিনা বেতনে কুহুকে কোচিং-য়ের সুযোগ করে দিয়েছে। অবশ্য প্রথমে কুহু রাজি হয়নি। কিন্তু সেই স্যারেরা কুহুর বাবার কাছে গিয়ে বলেছে, অনেক অনুরোধের পর কুহুর বাবা তার প্রাক্তন দুই ছাত্রের কথা মেনে নিয়েছিলেন। তারপর থেকে কুহু সেই দুই কোচিং-য়ে গিয়ে ক্লাস করে।

কোচিং থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। এই পথটুকু কুহু অটোতে যাতায়াত করে। আজও কুহু অটোর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু একটাও অটো চোখে পরছেনা। বাধ্য হয়ে ওকে সেখানেই দাঁড়াতে হয়।

” কুহু মা, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে? ” কারও গলা শুনে কুহু পেছনে তাকিয়ে ওর ছোট চাচাকে দেখল।

” অটোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি, চাচা। ”

” আমার বাইকে ওঠ। আজ অটোতে করে যেতে হবেনা। ”

” আজ তুমি এত তারাতারি বাড়ি যাচ্ছ যে? ব্যাংক তো এত তারাতারি ছুটি হয়না? ”

” আজকে মাথাটা ভিষণ ধরেছে, মা। তাই আজকে আগেই বেরিয়েছি। তুই বাইকে উঠে বস। আজকে আমরা সাড়া রাস্তা গল্প করতে করতে যাব। ”

কুহুও দেখল প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অটো পেতে হয়তো আরও সময় লাগবে। স্যারের কাছে না বসলে হয়তো এত দেরি হতোনা। তাই ও চাচার কথায় রাজি হয়। কিন্তু ওর মনে ভয় থেকেই যায়। সেই ভয় ওকে বারংবার বাঁধা দিচ্ছে।

” চাচা, তোমার সাথে আমাকে দেখলে চাচি কিছু বলবেনাতো? ”

” তুই সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে বাইকে উঠে বস। সন্ধ্যা হতে চলল। ”

কুহু আর কথা বাড়ায়না। বাইকে উঠে বসে।

চলবে…

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০৩

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩
জাওয়াদ জামী জামী

” ভাবির আঁচল ধরে তো ঠিকই বসে থাক, ম’রা ভাইয়ের জন্য শোকে দু চোখ ভাসাও, কিন্তু তাদের মধ্যে যে শোকের ছিটেফোঁটাও নেই, তা কি জানো? তারা মুরগীর মাংস রান্না করে, মজা করে খাচ্ছে, তোমার ম’রা ভাইয়ের চিন্তা তারা আদৌ করছে কিনা সেই সন্দেহ আমার আছে। ” শিরিন আক্তার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।

পাশেই সাইদ আহমেদ বিরক্তি নিয়ে সব শুনছে। এই মুহূর্তে তার স্ত্রী ‘ র কথা শুনতে মোটেও ভালো লাগছেনা। কিন্তু সে নিরুপায়। তাই চুপচাপ থেকে সবকিছু শোনার সিদ্ধান্ত নেয়। কারন সে জানে তার স্ত্রী’র সম্পর্কে। যদিও তার বড় ভাইয়ের বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে এটা নিয়ে সে মোটেও চিন্তিত নয়। সে চায় তার ভাবি ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালো থাকুক।

” আমার কথার উত্তর তো দিবেইনা। সত্যি কথা কি কারও কখনো ভালো লাগে। দুইদিনের বিধবার তেজ কি! সেদিন তোমার বোন কিভাবে আমাকে অপমান করল, আর ঐ বিধবা চুপচাপ দেখে গেল। শেষে আমাদেরকেই দোষী করে বাড়ি থেকে বের করে দিল! ওর দুঃখের দিন তো কেবল শুরু হয়েছে। ওর কপালে আরও দুঃখ আছে। বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই তো নাই. তা-ও ফুটানি কমেনা। দুইদিন পর যখন ছেলেমেয়েকে নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে, তখন মজা বুঝতে পারবে। ”

স্ত্রী’র কথা শুনে সাইদ আহমেদ রে’গে যায়। সে তার বড় ভাইয়ের পরিবার সম্পর্কে এরূপ কথা শুনতে চায়না।

” শিরিন, তুমি চুপ করবে? সমস্যা কি তোমার? আমার ভাবি তোমার পাকা ধানে মই দিয়েছে, যে তুমি তার সম্পর্কে এভাবে বলছ? বেয়াদবির একটা সীমা থাকে বুঝলে? তুমি সীমা অনেক আগেই পার করে দিয়েছ। আজ যে তোমার মুখে এত বড় বড় কথা আসছে, চাকরি না করলে সেই কথাগুলো কি বলতে পারতে? একটা চাকরি কর জন্যই নিজেকে অনেক বড় মনে কর! ভুলে যেওনা, তোমার সেই চাকরিটা কিন্তু আমার ভাইয়ের বদৌলতেই হয়েছে। আমার জানামতে, ভাবি কোনদিন তোমাকে কটু কথা শোনায়নি। আর সে তার পরিবার নিয়ে গত তিন বছর ধরে যে কষ্ট করছে, তারপরও তোমার কাছে কোন সাহায্য চাইতে আসেনি। তবুও তাদের ওপর তোমার এত রা’গ কেন? নাকি চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে নিজের বিবেক বিসর্জন দিয়েছ? ”

” ভাবির নামে কিছু বললে, এত লাগে কেন? কি আছে ঐ ভাবির মধ্যে? আমাকে ভালো লাগেনা? এই জন্যই মানুষ বলে পুরুষ মানুষের স্বভাবই হলো ছোঁক ছোঁক করা। ” শিরিন আক্তার আর কিছু বলতে পারেনা। সাইদ আহমেদের থা’প্প’ড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কল্পনাই করতে পারেনি তার স্বামী তার গায়ে হাত তুলবে।

” তোমাকে বারবার করে বলেছি, আমার ভাই-ভাবীর সম্পর্কে কোন খারাপ কথাই আমি শুনতে চাইনা। আজকের পর থেকে যদি তাদের নামে কোন কথা আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে পাই, তবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেব। বড় ভাই-ভাবী আমার কাছে আব্বা-আম্মার থেকে কোনও অংশে কম নয়। ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কে কিছু বলার আগে আজকের থা’প্প’ড়ে’র কথা মনে রাখবে। ” সাইদ আহমেদ সেখানে আর দাঁড়ায়না। গটগটিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে যায়।

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শিরিন আক্তার রা’গে ফুঁসছে। আজকের অপমানের কথা সে কোনদিনও ভুলবেনা। সে মনে মনে পণ করল, এই অপমানের শোধ সে তুলবেই। সে ঐ পরিবারকে শান্তিতে থাকতে দেবেনা।

শনিবার সকালে নাস্তার টেবিলে বসে চুপচাপ খাবার খাচ্ছে রায়হান আহমেদ। তাহমিদ তার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, সে কিছু একটা চিন্তা করছে। তাহমিদও তাকে না ঘাঁটিয়ে চুপচাপ খেতে থাকে।

খাবার পর নায়লা আঞ্জুম নিজের রুমের দিকে চলে যায়। কিন্তু রায়হান আহমেদ ডাইনিং রুমেই ঠাঁয় বসে রইল।

” তালুকদার সাহেব, আজকে এত কি ভাবছেন? আপনাকে এমন ভাবুক দেখতে আমার মোটেও ভালো লাগেনা। আপনি দেখতে হিরোদের মত। আর হিরোদের যেমন চুপসানো মুখে দেখতে ভালো লাগেনা, তাই আপনার চুপসানো মুখ দেখতেও ভালো লাগছেনা। হিরোরা সব সময়ই বুক চিতিয়ে চলাফেরা করে। আপনিও তাই করবেন। ” তাহমিদ টিপ্পনী কা’টে।

তাহমিদের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসে রায়হান আহমেদ। তার চোখের নিচে কালি পরেছে। একটু শুকিয়েও গেছে। সে তাহমিদের কথায় কিছুই মনে মনে করলনা। কারন সে জানে তাহমিদ তার মন ভালো করার জন্যই কথাগুলো বলেছে।

” কখনো বিয়ে করোনা, তাহমিদ। বিয়ে করেছ তো ম’রে’ছ। বউ কখন তোমাকে জ্ব’ল’ন্ত চুলায় ফেলছে, আবার কখন ফু’ট’ন্ত পানিতে চুবাচ্ছে কিছুই টের পাবেনা। শুধু জ্বা’লা অনুভব করবে। কিন্তু স্ত্রী নামক রমনীটিকে কিছুই বলতে পারবেনা। যখন কিছু বলার চেষ্টা করবে, মনে রাখবে তুমি নির্ঘাত ধ্বংসের পথে। এবং সেই পথ নিজেই বেছে নিয়েছ। ”

” মহাশয়, আপনি ভুল বললেন। নারীরা হচ্ছে কাদামাটির মত। আমরা পুরুষরা তাদের যেভাবে গড়ব, তারা সেভাবেই গড়ে উঠবে। আমাদের পরিচালনায় ভুল রয়েছে, তাই মাঝেমধ্যে নারীরা লাইন ছেড়ে বেলাইনে হাঁটার চেষ্টা করে। সংসারের রাশ সব সময় পুরুষদের হাতেই থাকে। কিন্তু আপনাদের মত দুর্বল পুরুষদের জন্যই তারা নিজেদের জাহির করতে পারে। আপনারা যদি প্রথম থেকেই স্ত্রী এবং পরিবারের মাঝে সমতা রাখতে পারতেন, তবে দিনশেষে আপনারাই ভালো থাকতেন। ”

” আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভাবছি তোমার খালামনির সাথে সেটা নিয়ে আলোচনা করব। ”

” গুড। ”

” শুনতে চাইলেনা যে, কি সিদ্ধান্ত নিয়েছি? ”

” আপনাদের ব্যাক্তিগত আলোচনা শুনতে চাওয়ার মত বোকামি আমি করতে চাইনা। ”

” কিন্তু তোমাকে শুনতেই হবে। শোনার পর তুমি বলবে আমি ভুল করছি নাকি ঠিক করছি। ”

” আমাকে বিচারক মানছেন নাকি! এখনো আমি সেই পর্যায়ে যেতে পারিনি। সামান্য একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমি। তারউপর ব্যাচেলর। সংসারের আমি কি বুঝি! ”

” তুমি আমার থেকে বেশি বুঝ। তাই আমিও তোমার সাথে কথা বলে বুকে সাহস পাই। তুমিই পার আমার ঠিক ভুল ধরিয়ে দিতে। ”

” বলুন শুনি, কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ”

” আমি রাজশাহীতে একটা ফ্ল্যাট কিংবা জায়গা কিনতে চাচ্ছি। যদি রেডি ফ্ল্যাট পেয়ে যাই, তবে যত তারাতারি পারি এখান থেকে চলে যাব। তুমি কি বল? তুমি মত দিলেই তবে আমি নায়লাকে বলব। ”

” আমার ওপর রা’গ করে কি এই বাসা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? ”

” মোটেও না। তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ। এর আগেও ভেবেছি, এখান থেকে চলে যাব। কিন্তু সাহস করে কাউকে বলার কথা ভাবতে পারিনি। ”

” ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে আমি বলব, আপনি এখন এখানেই থাকুন। নানিমা অসুস্থ। সে বিছানা নিয়েছে। আপনারা চলে গেলে সে একা হয়ে পরবে। আপনারা ছাড়া রাজশাহীতে নানিমার আপন বলতে কেউই নেই। তাছাড়া নানিমাকে দেখার দ্বায়িত্ব এখন খালামনির। সে চায়নি জন্যই মামা একমাত্র ছেলে হয়েও নিজের বাড়িতে থাকতে পারেনি। আজ সে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। এর দায় শুধু খালামনির। এবং একজন স্বামী হিসেবে সেই দায় আপনার ওপরও বর্তায়। সেদিন খালামনি বড় গলায় বলেছিল, তার মা’কে সে-ই দেখবে। সেদিন কিন্তু আপনিও চুপ ছিলেন। তাই আমি বলি কি যতদিন নানিমা বেঁচে আছে, ততদিন আপনারা এখানে থাকুন। ”

” এখন নিজেকে বারবার স্বামী হিসেবে অযোগ্য মনে হয়। আমার চোখের সামনে অনেক অন্যায় হয়েছে, কিন্তু আমি সব সময়ই চোখ বন্ধ করে থেকেছি। বিনিময়ে আজ আমি একূল-ওকূল দুকূলই হারিয়েছি। তুমি যখন বললে, আম্মা যতদিন বেঁচে আছে, ততদিন আমি এখানেই থাকব। ”

” আপনি পারলে জায়গা কিনে রাখুন। সময় সুযোগ বুঝে বাড়িও করবেন। নানিমার শারিরীক অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে। সে হয়তো বেশিদিন বাঁচবেনা। সারাজীবন সে যা যা অন্যায় করেছে, এখন তার ফল ভোগ করছে। ছেলে থেকেও নেই, একটা মেয়ে মা’রা গেছে, আরেকটা মেয়ে থেকেও নেই। এখন শুধু আপনারাই তার শেষ ভরসা। সে জীবনে দাপটের সাথে চললেও তার মনে ঠিকই অশান্তি ছিল। সুখ তার জীবনে ছিলনা। এখন আপনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে একটু ভালো থাকার রসদ পায়। তাই জীবনের শেষ কয়টা দিন তাকে একটু শান্তিতে বাঁচতে দিন। ”

” তোমার কাছে আমি প্রতিনিয়তই ঋণী হয়ে যাচ্ছি। তোমার এই ঋণ আমি শোধ করব কেমন করে! ”

” শোধ করতে হবেনা। নিজের কাছেই রেখে দিন। আমি এখন একটু বাহিরে বের হব, তালুকদার সাহেব। আপনি যাবেন নাকি আমার সাথে? চলুন কোথাও থেকে আড্ডা দিয়ে আসি। আপনার মন ভালো লাগবে। ”

” চল যাই। এই সুযোগে তোমার ফ্রেন্ডদেরও দেখার সুযোগ পাব। তুমি কি আজ রাতেই ঢাকা ফিরবে? ”

” হুম। এগারোটার গাড়িতে উঠব। ”

” একটা গাড়ি কিনে নাও। এভাবে কতদিন বাসে যাতায়াত করবে? ”

” আমার স্যালারি কি আপনার মত আকাশচুম্বী! সামান্য একজন শিক্ষক আমি। গাড়ি কেনার টাকা পাব কই! ”

” তোমার বাবাকে বললে দশটা গাড়ি তোমাকে কিনে দেবে। আর তুমি করছ টাকার চিন্তা! ”

” বাবা কিনে দিলে তার মালিক আমি হব কিভাবে? আর তাছাড়া আমি তার টাকায় কোন কিছু নিতে চাইনা। নিজের যেদিন সামর্থ হবে গাড়ি কেনার সেদিনই কিনব। এবার চলুন যাই। ”

রায়হান আহমেদ বুঝল তাহমিদ ঐ বিষয়ে আর কোন কথা শুনতে চায়না। তাই সে কথা বাড়ায়না। আঁড়চোখে তাকায় তাহমিদের দিকে। এই ছেলেকে দেখলে কে বুঝবে, ওর মনে পাহাড় সমান কষ্ট জমে আছে! সবকিছু থেকেও আজ তার কিছুই নেই, সে একা। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে, সমাজের সাথে যুদ্ধ করে ও বেড়ে উঠেছে।

সোহানী পারভিন আজ চলে যাবে। কিন্তু তার বড় বোন শাকিলা সুলতানা চাইছেন, আর কয়েকটা দিন তার ছোট বোন এখানে থাকুক। কিন্তু সোহানী পারভিন আপত্তি জানায়। তার বাড়িতে অনেক কাজ আছে, বিধায় সে আর থাকতে পারবেনা।

আইরিন পারভিন ছোট ননদকে যেতে দেখেও কিছুই বললনা। সে বুঝতে পারছে, সবাই তার সুসময়ের বন্ধু ছিল। তার দুঃসময়ের বন্ধু একমাত্র বড় ননদ। যেখানে তার নিজের ভাইয়েরাও বিপদে বোনের পাশে এসে দাঁড়ায়নি, সেখানে স্বামীর ভাই-বোনের কাছে সহানুভূতি আশা করা বোকামি।

কুহু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোট ফুপুর চলে যাওয়া দেখে চোখ মুছল। ও বুঝতে পারছে, ওদের দুঃখের সাথী কেউ হতে চায়না।

কেটে গেছে একমাস। কুহুর এইচএসসি পরীক্ষা সামনের মাসে। ও গ্রামের কয়েকজন ছেলেমেয়েকে প্রাইভেট পড়ায়। পাশাপাশি ভাইকেও পড়ায়। এবং নিজের পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছে। ইদানীং পড়াশোনায় বেশি মনযোগী হয়েছে সে। ওর লক্ষ্য সামনে এগিয়ে যাওয়া। মা,ভাইকে নিয়ে একটা সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখে ও। কিন্তু সুখ কি সহসাই ধরা দেয়? যদি মেয়েটা জানত, ওর জীবনে আরও দুঃখ এসে কড়া নাড়ছে তবে কি এমন নিশ্চিত থাকতে পারত?

চলবে….

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০২

0

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২
জাওয়াদ জামী জামী

মুখের সামনে ভাতের প্লেট নিয়ে বসে আছে সৃজন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্লেটের দিকে। ভাতের সাথে পুঁইশাকের চচ্চড়ি আর বেগুন ভাজা দেখে ওর খেতে ইচ্ছে করছেনা। কতদিন ধরে মাছ-মাংস খায়না। বাবা সেই তিন বছর আগে অসুস্থ হল, তারপর থেকেই শুরু হয়েছে ওদের দুর্দশা। বাবার চিকিৎসা করাতে একে একে সব শেষ হয়েছে। আর কতদিন এভাবে চলবে! কতদিন ওদের শুধু শাক-লতাপাতা খেয়ে বাঁচতে হবে? কতদিন লড়াই করবে নিয়তির সাথে?

কুহু সৃজনের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল, ছেলেটা খেতে পারছেনা। ছোট ভাইয়ের চুপসানো মুখ দেখে কুহুর বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়। এগারো বছর বয়সেই ছেলেটা জীবনের কঠিনতম দিকের সাথে পরিচিত হয়েছে। পরিচিত হয়েছে নিত্যনতুন অভাবের সাথে।

” সৃজু, এবেলা এসব দিয়ে খেয়ে নে। রাতে মাংস রান্না করে দিব। ”

” মাংস কোথায় পাবে, আপু? আমাদের তো আর কোন হাঁস-মুরগীও নেই। ”

” তোর এত কিছু ভাবতে হবেনা। তুই খেয়ে নিয়ে মা’য়ের কাছে যা। ”

শাকিলা সুলতানা কুহুর দিকে তাকিয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলছেন। কুহু তাদের কত আদরের ভাতিজী। বাবার রাজকন্যা ছিল মেয়েটা। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল! মেয়েটা তার বাবাকেও হারালো, সেই সাথে হারালো তার বর্তমান, ভবিষ্যৎ। ভাই সুস্থ থাকতে ছেলে-মেয়েকে রাজার হালে রাখত। কোন অভাব-অনটন ছুঁতে পারেনি ওদের। তিনবেলা মাছ, মাংস ছাড়া ভাত খেতনা। কিন্তু ভাই অসুস্থ হবার পর থেকেই মাসে একবার পাতে মাছ জোটে কিনা সন্দেহ। সৃজনের মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। যে ছেলে মাংস ছাড়া ভাত খেতে পারতনা, সেই ছেলেই এখন দিনের পর দিন সবজি দিয়েই খায়। একটাবারও অভিযোগ করেনা। শাকিলা সুলতানা সব বুঝেও নিশ্চুপ থাকেন। তাছাড়া তার করারই বা কি আছে! আব্বা মা’রা যাবার পর, যেখানে বড় ভাই তার পরিবারের দ্বায়িত্ব নিয়েছিল। তার সুখে-দুঃখে বড় ভাই ছায়া হয়ে পাশে থেকেছে। সেই ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তানদের দূর্দিনে, সব কিছু চোখে দেখে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। নিজের সন্তানদের জন্য দুশ্চিন্তার পাশাপাশি এখন আবার যুক্ত হয়েছে ভাতিজা-ভাতিজীর জন্য চিন্তা। তিনি বুঝতে পারছেন, ভাইয়ের মৃত্যুর সাথে সাথে দুইটা পরিবারে দুঃখের কালো ছায়া নেমে এসেছে।

আইরিন পারভিন খেতে না চাইলেও কুহু জোর করে তাকে কয়েক লোকমা ভাত খাইয়ে দেয়। এরপর নিজে খেয়ে, ব্যাগ হাতড়ে কিছু টাকা বের করে, বাড়ির বাহিরে যায়।

তাহমিদ গোসল সেড়ে রুমে এসে দেখল, ওর খালু রায়হান আহমেদ বিছানায় বসে আছে। আজ সকাল থেকেই তাকে কেমন মনমরা লাগছে। তাহমিদ ঝটপট টি-শার্ট গায়ে দিয়ে চেয়ার টেনে খালুর মুখোমুখি বসল।

” তোমার রুমে সিগারেট খেলে কি তুমি কিছু মনে করবে, তাহমিদ? ” কথাটা বলেই রায়হান আহমেদ তাহমিদের উত্তরের অপেক্ষা না করে সিগারেট ধরায়।

” আমার জানামতে, আপনি অনেক আগেই সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলেন। হঠাৎ করেই তাকে আবার আপ্যায়ন করার কোন বিশেষ কারন আছে নাকি! ” তাহমিদ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে রায়হান আহমেদের দিকে।

এদিকে রায়হান নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত। তাহমিদের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। লম্বা টান দেয় সিগারেটে।

” আমি চিরদিনের জন্য কালপ্রিট হয়ে গেছি, তাহমিদ। যারা আমাকে ছোট থেকে বড় করেছে, আমার পড়াশোনার রসদ জুগিয়েছে, আমার ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করেছে, তাদের দুঃসময়ে আমি নিস্পৃহ থেকেছি। তাদের যখন আমাকে প্রয়োজন ছিল, তখন আমি নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। আম দোষী হয়ে গেলাম। অথচ আমি তাদের কাছে সময়ে-অসময়ে ছুটে যেতে চেয়েছি। ” হু হু করে কেঁদে উঠল রায়হান আহমেদ।

হুট করে খালুর কেঁদে উঠায় তাহমিদ বেশ ভড়কে গেছে। ওর সামনে বসা ভদ্রলোকটিকে খারাপ বলা চলেনা মোটেও। একটু নরম স্বভাব তার। সেই সাথে ভীতুও বলা যায়। সে তার স্ত্রী’কে বেশ ভয় পায় এবং সমীহ করে। স্ত্রী’র মন জুগিয়ে চলতে ভদ্রলোক সদা তৎপর থাকে। তাহমিদ এখানে আসলেই ভদ্রলোক তার সুখ-দুঃখের ঝুড়ি নিয়ে হাজির হয় কাছে। আজও নিশ্চয়ই কোন দুঃখের আলাপ করতেই এসেছে ভদ্রলোক।
তাহমিদ আলতোভাবে হাত রাখল রায়হান আহমেদের হাতে।

” এভাবে কাঁদছেন কেন! জানেননা পুরুষদের কান্না মানায়না। পুরুষ হলো সিংহের জাতি। শত কষ্টেও তাদের কঠোর হতে হয়। শত অপমানেও অন্যদের ভালো রাখতে, নিজের ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয়। চোখ মুছে আমাকে বলুন আপনার কি হয়েছে। সকাল থেকেই আপনাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আমার কেমন যেন লাগছে। ”

চোখ মুছে সোজা হয়ে বসল রায়হান আহমেদ। কথা বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করল।

” আমার বড় ভাই মা’রা গেছে, তাহমিদ। তিন বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে, দুই দিন আগে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এই তিন বছর তাকে শুধু তিনবার দেখতে গেছি। তা-ও অতিথির ন্যায় মেডিকেলে গেছি, আধাঘন্টা পর ফিরে এসেছি। অথচ আমার ভাবি দিনের পর দিন মেডিকেলে পরে থেকেছে ভাইকে নিয়ে। এক বেলা খেলে দুইবেলা খালি পেটে থেকেছে। আমার ছোট ভাতিজা-ভাতিজীও মেডিকেলে থেকেছে। ওরাও না খেয়ে থেকেছে দিনের পর দিন। কিন্তু আমি তাদের সাহায্য করিনি। এক বেলার খাবারও দিইনি। অথচ আমি চাইলে তার চিকিৎসার পুরো টাকা দিতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করিনি। ফলশ্রুতিতে, আমার ভাইয়ের সব টাকা, জমিজমা সব শেষ। ”

রায়হান আহমেদের কথা শুনে তাহমিদ বেশ অবাকই হয়।

” আপনার বড় ভাই মানে যিনি স্কুলের টিচার ছিলেন তিনি মা’রা গেছেন! আমি শুনেছিলাম তিনি অসুস্থ। ”

” হুম, আমার স্কুল টিচার বড় ভাই। যে আমাকে পড়াশোনা শিখিয়েছে, মানুষ করেছে। আমার সেই ভাই মা’রা গেছে। আর আমি একটিবারও ভাইকে সাহায্য করার কোন চেষ্টাই করিনি। অথচ তাদের আমাকে ভিষণ প্রয়োজন ছিল। ” দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রায়হান আহমেদ।

” প্রয়োজনে যখন তার পাশে থাকেননি, তবে এখন অশ্রু ঝরিয়ে কোন লাভ হবে বলে আমি মনে করিনা। না কেঁদে বরং তার পরিবারকে সাহায্য করার চেষ্টা করুন। ”

” আমি চাইলেই কি সব হবে? আমার বিপরীতে কেউ একজন আছে, সেটা তুমি ভালো করেই জানো। আমি সংসার টিকিয়ে রাখতে গিয়ে, আমার মাথার ছাতাকে অযত্নে রেখেছি। অবহেলা করেছি আমার পিতার ন্যায় বড় ভাইকে। সে রাজশাহী মেডিকেলেই মা’রা গেছে, অথচ আমি সেটা জানতে পারিনি। হয়তো ভাবি অভিমান করেই আমাকে জানায়নি। এত অপরাধবোধ নিয়ে আমি কেমন করে বেঁচে থাকব, তাহমিদ? ”

” আপনার বিপরীতে কেউ আছে সেটা জেনেও কেন আপনি প্রতিবাদী হলেননা! সংসার টিকিয়ে রাখার দায় শুধুই আপনার? বিপরীতজনের কি একটুও দায় নেই? আপনি তো অযোগ্য নন। তবে কেন দায় আপনাকেই নিতে হলো? আমার চোখে দোষী আপনি। আপনি পারেননি আপনার স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করতে। অথচ দ্বায়িত্ববোধ কিন্তু আপনারই বেশি ছিল, আছে। আপনার যেমন স্ত্রী-সন্তানের প্রতি দ্বায়িত্ব আছে, তেমনি পরিবারের লোকজনের ওপরও কিছু দ্বায়িত্ব আপনাকেই পালন করতে হবে। সেজন্য স্ত্রীকেও আপনাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হত। কিন্তু আপনি সেটা করেননি। আপনি একজন সরকারি কমকর্তা হয়ে কেন স্ত্রী’র সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে থাকছেন? তাদেরকে কি আলাদা বাসায় ক্ষমতা আপনার নেই? অবশ্যই আছে। আপনি প্রথমেই যদি আপনার শ্বাশুড়ি কিংবা স্ত্রী’র কথা না শুনে আলাদা থাকতেন, স্বামী হিসেবে একটু কঠোর হতেন, সংসারের ভালোমন্দ, করনীয়গুলো স্ত্রী’কে শিখিয়ে দিতেন, তাকে সেসব মানতে বাধ্য করতেন, তবে ঘটনা এতদূর পর্যন্ত গড়াতোনা। আপনার ভাইও সুচিকিৎসা পেত, আপনার ভাবিও অভিমান, অভিযোগ করার কোন সুযোগ পেতনা। আমার কথা শুনে আপনার খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। ”

রায়হান আহমেদ তাহমিদের কথা শুনে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। সে ভাবছে, ছেলেটা কত সহজেই তার ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

” তোমার সব কথাই সত্যি। আমি জানি সব দোষ আমার। আর এজন্যই বোধহয় নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারছিনা। জানো তাহমিদ, ভাইয়ের দা’ফ’ন করার পর আর গ্রামে থাকতে পারলামনা। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল অন্তত একটা রাত ঐ এতিম ছেলেমেয়ে দুটোর কাছে থেকে আসি। কিন্তু তোমার খালা সেটা হতে দিলনা। মানুষজনের সামনেই রাগারাগী শুরু করল। অজ্ঞান ভাবি, ভাতিজীকে রেখেই চলে আসতে হলো। ”

” আপনি কেন খালামনির রা’গ’কে পাত্তা দিলেন? তাকে কেন গ্রামে থাকতে বাধ্য করলেননা? তাকে আড়ালে ডেকে কেন শাসন করলেননা? একটু ভয় তাকেও দেখাতেন। তাকে বুঝতে দিতেন আপনার ভাই আপনার জন্য কি। প্রয়োজনে কঠোর হতে পারতেন। আর কতকাল মেরুদণ্ডহীন হয়ে থাকবেন? এবার একটু সোজা হয়ে চলাফেরা করুন। আজ আপনার স্ত্রী আপনাকে মানছেনা, সেসব দেখে ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েরাও আপনাকে মানবেনা। তখন কি করবেন? তাই ভবিষ্যতে ভালো কিছুর জন্য বর্তমানকে কাজে লাগান। মিছেই তেঁতুল গাছে আম আশা করবেননা। এখনও সময় আছে। ”

রায়হান আহমেদ আরও একবার অবাক হয়ে তাকায় তাহমিদের দিকে। ছেলেটার বয়স আটাশ কি উনত্রিশ। কিন্তু তুখোড় বুদ্ধি তার। কঠিন সমস্যাও খুব সহজেই সমাধানে ওর জুড়ি নেই। তাই সে প্রয়োজনে, অপ্রোয়জনে তাহমিদের কাছে ছুটে আসে। এবং আশানুরূপ সমাধানও পায়। আজকে যেমন কত সহজ গলায় সমাধান দিল! রায়হান আহমেদ মনে মনেই তাহমিদের বলা কথাগুলো ভাবল। সে সিদ্ধান্ত নিল, আর তাকে এরকম থাকলে চলবেনা। এবার বোধহয় সময় এসেছে নিজেকে বদলানোর।

রাতে খাবার প্লেটে মাংস দেখে খুশি হয় সৃজন। আনন্দে ওর চোখে পানি এসেছে। সত্যিই আপু ওর জন্য মাংস রান্না করেছে! খুশিতে প্লেটের খাবার চেটেপুটে খাচ্ছে ছেলেটা। কিন্তু ওর ছোট মাথায় একবারও প্রশ্ন জাগলোনা, বাবার মৃ’ত্যু’র তিনদিনও হয়নি, কিন্তু বাড়িতে মাংস রান্না হয়েছে। এ নিয়ে কেউ কথা শোনাতে পারে।

চলবে..

প্রিয়াঙ্গন পর্ব-০১

0

#প্রিয়াঙ্গন
#সূচনা_পর্ব
জাওয়াদ জামী জামী

” ভাই কি আর কারও ম’রে’না? দুনিয়ায় কি একমাত্র তোমার ভাই-ই ম’রে’ছে? কাল থেকে এই বাড়িতে ধর্না দিয়ে পরে আছ! তোমার কি নিজের সংসার নাই? বউ-বাচ্চা নাই? বিয়ের এত বছর পরও ভাবির আঁচলের তলায় বসে থাকা লাগবে! ”

ছোট জা’য়ের এরূপ আ’ক্র’ম’ণা’ত্ব’ক কথা শুনে সদ্য বিধবা নারীটির দু-চোখ বেয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরতে থাকে। এত অপমানও তার ভাগ্যে ছিল! অথচ বিয়ের পর থেকে সব সময়ই ছোট দেবরদের ভাইয়ের নজরে দেখেছেন তিনি। আজ সেই পবিত্র সম্পর্কের মাঝে এ কোন কালো দাগ কে’টে দিল তার ছোট জা!

দরজায় দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে কুহু শুনছে ওর ছোট চাচির কথা। কালকেই ও তার বাবাকে হারিয়েছে কিন্তু ছোট চাচি এসব কি বলছে! চাচির মনে কি একটুও সহানুভূতি নেই বাবা-মা ‘ র জন্য! অথচ মা’তো কখনোই চাচির সাথে দূর্বব্যহার করেনি! আপনজনদের আচরণও এত নি’ষ্ঠু’র হতে পারে!
কুহুর ইচ্ছে করছে চাচিকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে। কালকে বাবা মা’রা গেছে, অথচ আজকে মেয়ে কাউকে কথা শোনাচ্ছে, এটা গ্রামাঞ্চলে মুহূর্তের মধ্যেই রটে যাবে। ধীর পায়ে মা’য়ের পাশে এসে বসল কুহু। তখনো ওর মা কেঁদেই চলেছে। আর ছোট চাচা বারান্দায় নতমুখে বসে আছে।

” এখনও ঐখানেই সংয়ের মত বসে থাকবে? তোমার ভাবির না হয় লজ্জা নেই, তাই বলে তুমিও কি লজ্জা বেঁচে খেয়েছ? ” আবার মুখ ঝামটা দিল কুহুর ছোট চাচি শিরিন আক্তার।

” কার যে লজ্জা নেই, সেইটা আমরা ভালো করেই জানি, শিরিন। তোকে আর নতুন করে বলে দেয়া লাগবেনা। তোর বিবেক বলে কি কিছু আছে? কালকে আমার ভাই মা’রা গেছে, আর তুই আজকে এসব কি জঘন্য কথাবার্তা বলছিস? যে ভাবি তার দেবর-ননদদের ভাই-বোনের নজরে দেখেছে সব সময়ই, আজ তার এই কঠিন সময়ে তাকে এভাবে বলতে তোর একটুও বাঁধছেনা? ” নিজের মাতৃসমা বড় ভাবির অপমান সইতে না পেরে কথাগুলো বললেন কুহুর বড় ফুপু শাকিলা সুলতানা।

ননদের মুখে এহেন কথা শুনে ফোঁস করে উঠল শিরিন আক্তার। সে বোধহয় বাড়ি থেকে পণ করেই এসেছিল, আজ কাউকে ছেড়ে কথা বলবেনা।

” আমার বিবেক, আবেগ, লজ্জা সবই আছে। এবং আপনার থেকে বেশিই আছে। আপনার যদি লজ্জা, বিবেক বলে কিছু থাকত, তবে যে ভাইয়ের খেয়েপড়ে বেঁচে আছেন, তার বউকে সমীহ করে কথা বলতেন। যার স্বামী মাতাল, নুন আনতে যার পান্তা ফুরায়, তার মুখে এসব কথা সাজেনা। ”

শিরিন আক্তারের কথা শুনে মিইয়ে যায় শাকিলা সুলতানা। চোখে জমা হয় অপমানের অশ্রু। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ খুলে,

” আমার স্বামী মাতাল, আমার নুন আনতে পান্তা ফুরায় এটা পুরাতন খবর। নতুন কিছু বল। মনে রাখিস আমি যদি কারও খেয়েপড়ে বেঁচে থাকি, সেটা বড় ভাইয়ের পয়সায় ছিলাম। তুই কিংবা তোর স্বামী আমার জন্য কিছুই করিসনি। বরং তোর জন্য আমরা সবাই অনেক কিছু করেছি। তুই যে শিক্ষিকা বলে নিজেকে নিয়ে গর্ব করিস, সেটাও আমার বড় ভাইয়েরই দান। তুই যে এই এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিস, সেটা আমি চেয়েছি বলেই হয়েছে। তাছাড়া তোর মত ছোট ঘরের মেয়েকে আমার আব্বা ছেলের বউ করতে ইচ্ছুক ছিলনা। সুতরাং নিজেকে নিয়ে বাহাদুরি না করে ভেতরে হাত দিয়ে দেখ, কি ছিলি আর কি হয়েছিস। তোর মত…..

শাকিলা সুলতানা কথা শেষ করতে পারেনা। তার কথার মাঝেই কথা বলে উঠল কুহুর মা আইরিন পারভিন।

” শাকিলা, আজকের দিনেও এসব কথা না বললেই কি নয়? আমার এসব শুনতে ভালো লাগছেনা। সাইদ তুমি তোমার বউকে নিয়ে বাড়ি যাও। আর কখনোই এদিকে এসোনা। মনে কর তোমার ভাইয়ের সাথে সাথে আমরাও ম’রে গেছি। ”

আর কিছু বলতে পারেননা আইরিন পারভিন। কান্নায় ভেঙে পরলেন। কুহুও কাঁদছে হাউমাউ করে। এতটা অপমানও ওদের ভাগ্যে ছিল!

উঠানে আম গাছের নিচে বসে এতক্ষণ সব শুনছিল কুহুর ছোট ভাই সৃজন। ছোট চাচির কথা শুনে ওর ছোট্ট বুকে জন্ম নেয় ক্ষোভ, অভিমান, রা’গ।

সাইদ আহমেদ মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায় বড় ভাইয়ের বাড়ি থেকে। তার পিছু পিছু শিরিন আক্তারও বেরিয়ে যায়।

কুহুর ছোট ফুপু সোহানী পারভীন রান্না চাপিয়ে দিয়েছে। উঠানের একপাশে রান্নাঘরে বসে সে কাজ করছিল। ছোট ভাইয়ের বউয়ের সব কথাই তার কানে গেছে। কিন্তু এতে তার কোন হেলদোল নেই। ওদের যা ইচ্ছে হয় করুক।

কুহু জানালার কপাটে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিছানায় ওর মা ঘুমাচ্ছে। অবশ্য কাল থেকে তাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হচ্ছে। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। কোথাও কোন সাড়া নেই। এই নিস্তব্ধতাকে গ্রাস করে একটু পর পর ফুঁপিয়ে উঠছে কুহু। চিন্তা করছে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কি হবে এরপর? কিভাবে চলবে ওদের সংসার? বাবা স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার পর যে টাকাগুলো পেয়েছিল, তার প্রায় সব টাকাই বাবার চিকিৎসায় খরচ করতে হয়েছে। জমজমাও যা আছে তার সবই বন্ধক রাখা হয়েছে। সেই জমিগুলো ছাড়াতেও পাঁচ-ছয় লাখ টাকা লাগবে। হাতে আর সামান্য কিছু টাকা আছে। এই টাকা দিয়ে কিভাবে ওরা দুই ভাইবোন পড়াশোনা করবে, সংসার চালাবে, জমিজমা ছাড়াবে ! এসব কথা ভাবতে গিয়ে কুহুর মাথা ঘুরে উঠল। এমনিতেই দুর্বল শরীর। তারউপর গতকাল থেকে না খেয়ে আছে। আর কিছু ভাবতে পারছেনা মেয়েটা। ধীরে ধীরে বিছানায় আসে। শুয়ে পরে মা’য়ের পাশে।

” তাহমিদ বাবা, ও তাহমিদ বাবা, এইবার উইঠ্যা পর। অনেক বেলা হইছে। তুমি খাইবা কখন? ”

কারও গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলো তাহমিদের। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। প্রথমেই ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখল। এরপর তাকালো সামনের দিকে। চোখের সামনে দাঁড়ানো বৃদ্ধাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

” রাজিয়া খালা, এখন সবেমাত্র আটটা বাজে। আজকে অন্তত এই সময় আমাকে না ডাকলেও পারতে। তুমি ভালো করেই জানো, সপ্তাহের এই দুইটা দিন আমি রাজশাহীতে আসি একটু বিশ্রাম নিতে। কিন্তু তুমি বরাবরের মতই আমার আরামকে হারাম করতে সদা তৎপর। কি শান্তি পাও বলতো ”

” তুমি নিয়ম কইরা খাইলেই আমার শান্তি। সূর্যরে মাথার উপরে নিয়া উঠলে কি টাটকা খাওন খাইতে পারবা? এবার বিছানা থাইকা নামো। আমি বিছানা গোছাইয়া দিই। তুমি মুখহাত ধুইয়া নিচে যাও। আমি তোমার জন্য ভুনা খিচুড়ি আর শুটকি ভুনা করছি। ” রাজিয়া খালা তাহমিদকে একপ্রকার বিছানা থেকে টেনে নামিয়ে, ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠায়।

তাহমিদ ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে দেখল ওর ছোট খালু মনমরা হয়ে বসে আছেন। খাবার মুখে না তুলে প্লেটে আঁকিবুঁকি করছেন। পাশেই ওর খালা মনযোগ দিয়ে খাচ্ছে। তার তৃপ্তি করে খাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে খাবার খুব টেস্টি হয়েছে।

” তালুকদার মুহাম্মদ রায়হান আহমেদের মনটা খারাপ নাকি? ঘটনা কি গুরুতর? আমার জানামতে আপনি সরকারি কমকর্তা এবং মাস শেষে মোটা টাকা আয় করেন। এবং স্ত্রী’র বাধ্য স্বামী। আর যেসব স্বামীরা স্ত্রী’র বাধ্য হয়, তাদের সংসারে সুখের কোন কমতি থাকেনা। আপনার কি এই তিনটার মধ্যে কোন একটা উৎসে ঘাটতি পরেছে? ”
তাহমিদের সাথে বরাবরই রায়হান আহমেদের সম্পর্ক ভালো। তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হাসিঠাট্টা হয়েই থাকে। সম্পর্কে খালু হলেও ওদের মধ্যের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণই বলা যায়। তাই তাহমিদ হাসতে হাসতে খালুর সাথে মজা নেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেনা।

তাহমিদের কথা শুনে ওর খালার ভ্রু কুঁচকে আসে। বিরক্তিতে ছেয়ে যায় তার মন। কিন্তু বোনের ছেলেকে কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারেনা। কারন সে ভালোভাবেই চেনে তাহমিদকে। তার বোনের ছেলে যে বদ রাগী সেটা ভালো করেই জানে নায়লা আন্জুম। তাই সে পারতপক্ষে বড় বোনের ছেলেকে ঘাটায়না। তাই খোঁ’চা কষ্ট করে হলেও হজম করল।

তাহমিদের কথা শুনে রায়হান আহমেদের চোখে পানি এসে জমা হয়েছে। কিন্তু তিনি স্ত্রী’র সামনে কাঁদতে পারছেননা। তিনি তাহমিদের কথার উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলেন।

এদিকে তাহমিদও ওর ছোট খালুর নিরবতা দেখে কিছু আঁচ করতে পেরেছে। ও বুঝতে পারছে ছোট খালুর কিছু হয়েছে। নয়তো চুপ করে থাকার মানুষ তিনি নন। তাহমিদ আর কিছু না বলে খাওয়ায় মনযোগ দেয়।

আইরিন পারভিন বিছানায় বসে কাঁদছেন। তিনি সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। একসময় তার স্বামী ছিল এই পরিবারের মাথা। নিজে স্কুলে মাস্টারি করে ভাইবোনদের পড়াশোনা শিখিয়েছে। ভাইদের স্বপ্ন পূরন করতে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়েছে। ছোট ভাইয়ের বউকে চাকরি নিয়ে দিয়েছে। বোনদের ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে। আজ সেই মানুষের অবর্তমানে তারই ছোট ভাইয়ের বউ আজেবাজে কথা শুনিয়ে গেছে! আইরিন পারভিন উপলব্ধি করতে পারছেন, তার সামনে কঠিন দিন আসতে চলেছে। এবং তিনি হয়তো কাউকেই পাশে পাবেননা। আবারও কান্নায় ভেঙে পরলেন আইরিন পারভিন। দরজায় দাঁড়িয়ে কুহু অসহায়ের মত মা’য়ের কান্না দেখছে। ও ভেবে পাচ্ছেনা কি করে মা’কে শান্তনা দেবে।

বিঃদ্রঃ আবারও চলে এলাম নতুন গল্প নিয়ে। আমার বেশ কয়েকজন পাঠক অনুরোধ করেছেন আবারও তাহমিদ-কুহুকে নিয়ে আসতে। তাদের চাওয়াকে সম্মান জানিয়ে আমি তাহমিদ-কুহুকে নিয়ে আসলাম। আপনারা আর একবার উপভোগ করতে থাকুন তাহমিদ-কুহুর প্রনয়, চড়াই-উৎরাই, ঘাত-প্রতিঘাত।

চলবে…

অসাধারণ পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0

#অসাধারণ ৩

ক্লাবঘরের আধো অন্ধকারে টগরকে অপার্থিব রকমের সুন্দর লাগছে। তার দৃষ্টিতে যেমন আমার প্রতি মুগ্ধতা কাজ করছে, সেই সাথে খেলা করছে বিষ্ময়৷ তবে কিসের একটা ঘোর কাটিয়ে উঠতে না পেরে দু’জন পরষ্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। চমক ভাঙল বাজ পড়ার শব্দে।

টগর জিজ্ঞেস করল, “তুমি চিঠি দিয়েছ?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“একটা কথা বলতে।”

“কী কথা?”

“আপনি বিয়ে করতে রাজি হচ্ছেন না কেন?”

“তা দিয়ে তোমার কাজ কী?”

“ন্যাকামো করবেন না প্লিজ!”

“ন্যাকামো আমি করছি না তুমি? এই ঝড়বাদলের দিনে আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে আসার মানে কী? আমার বিয়ে হলো কী হলো না তাতে তোমার কী?”

আমার মাথায় যেন একটা আকাশ ভেঙে পড়ল! আমার কী মানে? তাহলে কার কী? অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কার জন্য বসে আছেন?”

“আছে কেউ একজন।”

বলতে বলতে হঠাৎ সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে বলল, “তুমি কি ভাবছো তুমি?”

আমি চুপ করে মাথা নিচু করে রইলাম। সে বলল, “শোনো পুঁচকে মেয়ে, বেশি পাকনামি করবে না৷ তোমাকে আমি একবারও বলেছি তোমাকে পছন্দ করি বা এ জাতীয় কথা? নাকি কোনো ইঙ্গিত দিয়েছি? আঙ্কেলকে আমি খুব রেস্পেক্ট করি, সেই হিসেবে তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করি। তার মানে যা খুশি তাই ভেবে বসবে? আমার প্রেমিকা আছে। আমরা একসাথে লন্ডনে পড়াশুনা করেছি। তার ভিসা নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছে বলে আসতে পারছে না।”

আমার চোখ দিয়ে তখন অঝোর ধারায় জল ঝরছে। কী ভীষণ কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে আসছে ভেতরটা যে আমি বলে কাউকে বোঝাতে পারব না৷ শুধু মনে হচ্ছে আমার সবই শেষ। আর কিচ্ছু বাকি নেই।

আমার অবস্থা দেখে বোধহয় টগরের একটু দয়া হলো। সে নরম সুরে বলল, “দেখো শিলা, তুমি ছোটো। এখনো পুরো জীবন পড়ে আছে। প্রেম ভালোবাসা এসব ফ্যান্টাসির জন্য অনেক সময় পাবে। এখন মূল্যবান সময়টা নষ্ট করো না৷”

আমি কিছু বললাম না৷ বাইরের দিকে তাকালাম। ঝড় থেমে গেছে। বৃষ্টি পড়ছে এখনো।

টগর বলল, “বাড়ি চলে যাও। আমি বাজারের দিকে যাব।”

তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। একা যখন ঝুম বৃষ্টিতে চুপচুপে হয়ে বাড়িতে ফিরছি তখন আমার ভেতরে কোনো বোধ নেই। সবকিছু যেন চোখের পলকে বাষ্পের মতো উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। পড়ে রয়েছি শুধু আমি আর আমার আহত পাখির মতো ছোট্ট মন।

কী করে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম মনে নেই। এরপর আমার জ্বর এসেছিল। প্রচন্ড জ্বর। দিন রাতের পার্থক্য বুঝতাম না৷ ভুলভাল বকতাম সারাদিন৷ সেই ভুল বকা থেকেই বোধহয় মা বাবা আমার সমস্যাটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি৷

আমার জ্বরে থাকা অবস্থাতেই একদিন টগরের প্রেমিকা চলে এসেছে। তাদের বিয়ে হয়েছে। আমি এরপর যেদিন টগরের খবর প্রথম শুনলাম, তখন সে হানিমুনে গেছে।

আমি কেমন যেন নির্জীব হয়ে গেলাম৷ দিনগুলো ঝুপসি অন্ধকার সোঁদা সোঁদা গন্ধওয়ালা আর রাতগুলো অসহনীয় কষ্টের।

একদিন বিকেলে হিমেল স্যার পড়াতে এসে চুপচাপ বসে রইলেন৷ আমি স্যারের কাছেও ঠিকমতো পড়তাম না৷ পড়া শুনতে ইচ্ছে করত না৷ স্যার তবুও পড়িয়ে যেতেন। আমার মগজ সেসব ধরতে পারত না৷

সেদিন স্যার পড়ালেন না৷ আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “পড়াবেন না?”

“না।”

“না পড়ানোই ভালো।”

“আসলে তোমাকে পড়ানো না পড়ানো একই কথা। খামোখা এনার্জি নষ্ট করে কী লাভ?”

“বাবাকে কিছু বলবেন না প্লিজ!”

“তোমার বাবা সব জানে।”

“তবুও।”

“ঘুরতে যাবে শিলা?”

আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম, “ঘুরতে?”

“হ্যাঁ। যাবে?”

“আপনার সাথে?”

“হ্যাঁ।”

আমি প্রস্তাব শুনে অবাক। রাজি হব কি না বুঝলাম না। তিনি বললেন, “চলো যাই।”

কিন্তু আমার উঠতে ইচ্ছে করল না। স্যার নিজে উঠে গিয়ে মাকে ডেকে অনুমতি নিয়ে আমাকে সাথে করে বেরিয়ে পড়লেন। আমরা হাঁটতে থাকলাম৷ জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাব?”

“একটা বাড়িতে।”

“কার বাড়ি?”

“চলোই না আগে।”

আমি তার পিছু পিছু চলতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা বাড়ির সামনে এসে পৌঁছুলাম। বাড়িতে অনেক গাছপালা, উঠানো বড় একটা বড়ই গাছ। একধারে সবজির বাগান। ইটের দেয়াল, টিনের ঘর।

স্যার বললেন, “আমাদের বাড়ি।”

আমি চারদিক ভালো করে দেখে বললাম, “সুন্দর।”

স্যার আমাকে তার মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ খুব মিষ্টি তার মা। ভীষণ আদুরে। আমাকে যত্ন করে বসালেন৷ ফল কেটে দিলেন।

স্যার মায়ের সামনে ছোটো টুল পেতে বসে বললেন, “মা, তোমার গল্পটা বলো।”

“আমার গল্প?”

“স্যরি গল্প না। জীবনকাহিনী।”

“সে আবার শোনাবার মতো কাহিনী নাকি?

“আহা! বলোই না৷ প্লিজ!”

মা বলতে শুরু করলেন, “ঠিক আছে। বলি। তুমি জানো মেয়ে, আমার বিয়ে হয় কত বছর বয়সে? যখন তোমার থেকেও বছর চার ছোটো ছিলাম, তখনকার কথা। মাত্র বারো বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিয়ে কী তাই জানতাম না। প্রথম প্রথম শ্বশুরবাড়িতে যা ভয় পেতাম! সবাইকে ভয় পেতাম। সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম হিমেলের বাবাকে। আমার চেয়ে অনেক বড় ছিল কি না!

আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল বড় পরিবার। একগাদা লোকজন, বাড়ির লোক, আত্মীয় মিলে রমরমা বাড়ি। দিনরাত কাজ লেগেই রয়েছে। একবার রান্নাঘরে ঢুকলে বের হবার উপায় নেই। সারাদিন সেখানেই কেটে যেত। তোমার যা বয়স এই বয়সে আমি প্রথম স্বামীকে ভালোবাসতে শিখি৷ এর আগ পর্যন্ত ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম। কিন্তু যখন থেকে তাকে ভালোবাসি, তখন থেকে তার সাথে যতটুকু সময় কাটাতাম, স্বপ্নের মতো মনে হতো। সেই রান্নাঘরে কাটানো জীবনটাও বড় আনন্দের মনে হতো। হিমেলের বাবাও আমাকে খুব ভালোবাসতেন।

এরপর একদিন হিমেল পেটে এলো। আমাকে বাপের বাড়িতে রেখে গেল ওরা। দেখতে পর্যন্ত এলো না! হিমেলের জন্ম হলো আমার বাপের বাড়িতে। ওকেসহ আমাকে যখন আমার বাবা শ্বশুরবাড়িতে দিয়ে এলেন তখন গিয়ে দেখি আমার ঘরটা দখল হয়ে গেছে। আমার স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছেন।

এই তো তোমার কাছাকাছি বয়সেই আমার মন ভাঙল। কী যে কষ্ট পেয়েছিলাম তা বলে বোঝাবার মতো হয়। বাড়তি ঘর ছিল না। গুদামঘরের একপাশে বিছানা করে থাকতাম। ইঁদুর তেলাপোকার বাসা ছিল ওটা। কত কষ্টে যে ছেলে নিয়ে দিন কাটিয়েছি কী আর বলব! আমার স্বামী তো ফিরে তাকিয়েও দেখতেন না৷ তার নতুন বউকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকতেন।

আমি একদিন আর সইতে পারলাম না৷ ফিরে গেলাম বাবার বাড়িতে৷ বাবা মা রাখলেন, তবে বেশিদিন ওভাবে থাকা গেল না। হিমেলকে নিজেরা রেখে আমাকে আবার জোর করে বিয়ে দিলেন এক বুড়ো লোকের কাছে। আমার দ্বিতীয় স্বামী বিয়ের বছর তিনেক পরে মারা গেলেন৷ তার থেকেই এই বাড়িটা আমার পাওয়া।

তিনি মারা যাবার পর ছেলেকে নিয়ে এখানেই আছি। মা ছেলে মিলে বেশ আছি।”

স্যার বললেন, “যদিও মাঝখানে অনেক কিছু বাদ দিয়েছ, তবে চলবে। তোমাকে একটা প্রশ্ন করব ঠিক জবাব দেবে মা?”

“কী প্রশ্ন?”

“তোমার সবচেয়ে বড় আফসোস হয় কী নিয়ে?”

“কোনো আফসোস নেই। আমি ভালো আছি।”

“উহু, একটু কিছু বলতেই হবে।”

তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “পড়াশোনাটা করতে পারিনি।”

“ঠিক বলেছ। এখন ওকে দিয়ে আসি ওর বাড়িতে।”

আমরা সেখান থেকে বের হলাম৷ স্যার এবার আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “মায়ের কাহিনী শোনাতে চাইলাম কেন বুঝেছ?”

“না।”

“ভালোমতো আজ রাতে ভাববে। আমি আগামীকাল তোমাকে পড়াতে যাব। যদি দেখি ভালোভাবে পড়ছ তাহলে পড়াব, আর যদি দেখি একটা ছেলের জন্য একতরফা ভালোবাসার কষ্ট নিয়ে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস তৈরি করতে যাচ্ছ, তাহলে বিদায় নেব চিরতরে।”

আমি সারারাত ছটফট করলাম। শুধু মনে হতে লাগল স্যারের মায়ের জায়গায় থাকলে কেমন লাগত? পুরো বিষয়টা যখন কল্পনা করলাম, তখন নিজের দুঃখটাকে খুব ছোটো মনে হতে লাগল। এত কষ্ট করেও ভদ্রমহিলা হাসিমুখে বাস করছেন, ছেলেকে এত সুন্দর করে মানুষ করেছেন। আর আমি কী করছি?

ভোরবেলা খুব ভালো করে গোসল করলাম। পুরানো নোংরাগুলো ধুয়ে ফেলার মতো সব ভাসমান স্মৃতি ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। তারপর অনেকদিন পর বই খুলে সত্যিকার অর্থেই পড়াগুলোর দিকে চোখ মেলে তাকালাম।

এরপরেই মাথাটা ঘুরে গেল। দু’বছরে যা শিখেছি সব ভুলে গেছি!

বিকেলে স্যারের সামনে বসে কেঁদেই ফেললাম কথাটা বলতে বলতে। স্যার দেখলাম হাসছে। সুন্দর হাসি৷

স্যার আমাকে খুব যত্ন করে বাকি মাসগুলো পড়ালেন। যেন ছোট্ট আহত পাখির ছানাকে যত্ন করে সারিয়ে তোলা। আমি মাঝেমধ্যে ধৈর্যহারা হয়ে যেতাম৷ এসএসসির আগের প্রিপারেটরি পরীক্ষায়ও তিন বিষয়ে ফেল করে ভেঙেই পড়েছিলাম৷ কিন্তু স্যার হাল ছাড়ার পাত্র নন। নিজের পড়াশুনা রেখে আমাকে নিয়ে লেগে রইলেন। আমার আত্মবিশ্বাস খুব ধীরে হলেও একটু একটু করে ফিরে এলো। নিজেও প্রচুর খাটতে শুরু করলাম।

এক রাতে দুটো পর্যন্ত পড়াশুনা করে শুয়ে পড়ার পর কী একটা এলোমেলো স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম৷ উঠে বসে মনে হলো, আমি প্রায় পাঁচ ছয়দিন হলো দিনে একবারও টগরের কথা মনে করে কাঁদিনি। দারুণ একটা প্রশান্তিতে মন ভরে গেল।

শেষ পর্যন্ত আমার এসএসসি চলে এলো। পরীক্ষা ভালোই দিলাম। আমার পরীক্ষার পর স্যার তার পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন৷ আমাদের আর দেখা হলো না।

আমার রেজাল্ট দিল। টেনেটুনে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি৷ বাবা খুশিতে আমাকে মাথায় তুলে নাচতে বাকি রাখলেন৷ এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হলো। স্যারের বাড়িতেও আমরা মিষ্টি নিয়ে গেলাম৷ তার মায়ের সাথে দেখা হলো, তবে স্যার নেই। চলে গেছেন চাকরির পরীক্ষা দিতে। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। একবার বলে যেতে পারতেন!

এই হলো আমার সেসব দিনের গল্প। গল্পটা শেষ। উপসংহারটুকু বাকি।

ঠিক পাঁচ বছর পর স্যার ফিরেছিলেন৷ আমি তখন অনার্সে পড়ছি। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এমন সময় একদিন তিনি এলেন৷ জানালেন, আমাকে তার পছন্দ, ঠিক তখন থেকেই। তবে যে ভুলটা থেকে আমি সদ্য বেরিয়ে এসেছিলাম তার পুনরাবৃত্তি চাননি বলেই চলে গিয়েছিলেন। এখন উপযুক্ত সময়ে ফিরেছেন।

আমার আপত্তি করার কোনো কারন ছিল না৷ তার মতো ধীরস্থির, সুন্দর মনের মানুষ খুব কমই হয়। সে টগরের মতো সুন্দর নয়, একটু খাটো, গায়ের রঙ কালো। তবুও তার দিকে তাকালে মনে হতো, এত অসাধারণ মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।

আজও তাকে দেখলে আমার তাই-ই মনে হয়।

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

অসাধারণ পর্ব-০২

0

#অসাধারণ ২

সেদিনের পর থেকে আমার মাথা মোটামুটি এলোমেলো হয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া করতে ভালো লাগে না, পড়তে তো ভালো লাগেই না৷ বইয়ের একটা শব্দও মাথায় ঢোকে না৷ টিউশন ব্যাচে বসে থাকি চুপচাপ। সবই শুনি, কিছুই বুঝি না। বন্ধুরাও লক্ষ্য করল ব্যাপারটা, “কিরে শিলা, তোর কী হয়েছে? এমন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিস কেন?”

আমি বলতাম, বাড়ি থেকে ভালো রেজাল্টের জন্য খুব প্রেশার দিচ্ছে৷ কথা বলতে ভালো লাগে না।

তখন আমার আরেকটা জগৎ গড়ে উঠছিল। রঙিন, স্বপ্নিল একটা জগৎ। তাতে শুধু আমি আর টগর। সেই জগতটা আমার ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেখানে আমার একটা কাল্পনিক সংসার আছে। সে রোজ সকালে অফিসে যায়, সন্ধ্যায় ফেরে। ফিরবার সময় হাতে থাকে আমার জন্য একগুচ্ছ সাদা ফুল। আমি সেগুলো পরম যত্নে সাজিয়ে রাখি ফুলদানিতে। তার পছন্দের আইটেম রান্না করি। সে তৃপ্তি করে খায়৷ খাওয়াদাওয়া শেষে সব আলো নিভে যায়। জ্বলে ওঠে কিছু সুগন্ধি মোম। সেই মোমের আলোয় সে আমাকে খুব ভালোবাসে।

এ তো গেল কল্পনা। কল্পনাটুকু বাস্তব বানাতেও আমি কত কী না করেছি! ভোরে আমি অংকের টিউশন পড়তে যেতাম। যেদিক দিয়ে যেতাম সেদিক দিয়েই পাড়ার ক্লাব ছিল। ক্লাবের একটা ঘরে ছেলেদের জিম করার কিছু ইন্সট্রুমেন্টও ছিল। টগর রোজ যেত সেখানে। আর আমি টিউশনে দেরি করতাম তাকে দেখতে গিয়ে। সে জানত না, তার ব্যয়ামঘরের জানালার পাশের ঝাঁকড়া গাছের আড়াল থেকে কেউ একজন মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখে যায়।

বিকেলে তার আড্ডার জায়গা ছিল মঞ্জুর চায়ের দোকান৷ সেখানটা সব মেয়ে এড়িয়ে চলত একদল ছেলের আনাগোনার জন্য। আমি ইচ্ছে করে সেদিক দিয়ে যেতাম। একটু ধীর হয়ে যেত গতি। মানুষটাকে আরেকবার দেখতাম আঁড়চোখে। সেও দেখত, কিন্তু কখনো কিছু বলত না।

এভাবেই চলছিল। হঠাৎ এক দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার সময় আমি খেয়াল করলাম পেছন থেকে কেউ এসে হাঁটছে। তাকাতেই লম্বা অবয়বটা চোখে পড়ল। আমার বুকে কাঁপুনি ধরে গেল। কিচ্ছু বলতে পারলাম না।

সে বলল, “শোনো শিলা, বিকেলে ওই রাস্তা দিয়ে যাবে না তুমি।”

“কেন?”

“বখাটেরা থাকে।”

“আপনিও তো থাকেন।”

“তাতে কী? আমি তো আর মেয়ে নই।”

“মেয়েরা গেলে হলে কী হয়?”

“ওরা তোমাকে নিয়ে আলোচনা করে।”

“তাতে কী?”

“আমার ভালো লাগে না।”

“কেন?”

সে বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার ভালো লাগে রোজ একগাদা ছেলের মধ্যে দিয়ে যেতে? আরও তো পথ আছে। সেদিকেই কেন যেতে হবে? তুমি দেখতে যা সুন্দর, ছেলেরা কথা বলবেই। তাই দয়া করে নিজেকে একটু সম্মান করতে শেখো। খেলো হয়ে যেও না।”

সে এটুকু বলে চলে গেল। আমার চোখে পানি চলে এলো। সে বকেছে বলে নয়৷ প্রথমত, সে আমাকে নিয়ে ভাবে সেজন্য। আর দ্বিতীয় কারনটা হলো, সে আমাকে আজ সুন্দর বলেছে।

আমি সেই পথে যাওয়া ছেড়ে দিলাম। তবে ভোরে তাকে দেখা বন্ধ হলো না। আর বন্ধ হলো না আমার কল্পনার জগৎ। বরং বিস্তৃত হতে লাগল দিনকে দিন।

এদিকে সময় এগিয়ে যাচ্ছিল। আমার প্রি টেস্ট পরীক্ষা কেমন করে যেন চলে এলো। পরীক্ষা দিলামও৷ কিন্তু পুরো সময়টা যেন নিজের মধ্যে ছিলাম না আমি। পারা পড়াগুলো খাতায় লিখতে ইচ্ছে করত না। কেমিস্ট্রি পরীক্ষার খাতায় আমি গান লিখলাম৷ ফিজিক্সের খাতায় লিখলাম কবিতা।

সেবার পুরো ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ রেজাল্ট হলো আমার। তার ওপর আমার গান, কবিতা লেখার অপরাধে আমার বাবা মাকে ডাকা হলো। এরপর কী হলো তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অতশত বকা খেয়ে, মার খেয়ে, মায়ের কান্না দেখেও আমি যেন আমিতে ফিরতে পারছিলাম না। অন্ধ প্রেম আমাকে শেষ করে দিচ্ছিল।

আমি দিনে মার খেয়ে রাতে দরজা বন্ধ করে টগর ভেবে কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম। কল্পনার সে আমাকে সান্ত্বনা দিত। বেশি করে আদর করত। আমি সব ভুলে যেতাম।

এর মাঝে তার সাথে বাস্তবেও বহুবার দেখা হয়েছে। দেখা হলে সে পড়াশুনার খবর নিত। শুধুমাত্র তখনই আমার সত্যিকারের পড়াশুনা করতে ইচ্ছে করত। তারপর আবার ইচ্ছেটা উধাও হয়ে যেত তার রাতের উপস্থিতিতে।

বাস্তবে টগরের সাথে দেখা হলে সে ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়াত৷ মিষ্টি করে হেসে কথা বলত, আমি নতুন করে পাগল হতাম।

প্রি টেস্টের ভয়ানক রেজাল্টের পর আমার জীবনযাত্রায় অবশ্য একটু পরিবর্তন হলো। ব্যাচে পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বাবা বাড়িতে টিচার রেখে দিলেন৷ আমাকে পড়াতে শুরু করলেন আমাদেরই স্কুলের এক প্রাক্তন ছাত্র হিমেল। খুব ভালো রেজাল্ট করে সে ঢাকায় পড়তে চলে গিয়েছিল। এখন এসেছে বাড়িতে নিরিবিলিতে বসে চাকরির প্রস্তুতি নিতে। বাবা তাকে ধরে নিয়ে এলেন দিনে ঘন্টা দুই আমাকে সময় দিয়ে সেবারের মতো উদ্ধার করে দিতে।

স্যার আমাকে পড়াতে শুরু করার পরপরই বুঝলেন আমার কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু আমার সমস্যাটা গোপন, তাকে বলার প্রশ্নই আসে না। তবুও তিনি রোজ জিজ্ঞেস করতেন, তাকে বন্ধু ভেবে বলতে বলতেন। আমি কিছুই বলতাম না। তবুও তিনি পড়াশুনার দিকে আমার মন কিঞ্চিৎ ফেরাতে পেরেছিলেন। খুব সুন্দর করে পড়াতেন। প্রচুর উদাহরণ দিয়ে একেকটা টপিক বুঝিয়ে দিতেন যেন না ভুলে যাই। আমি তার কাছে পড়ার সময়টুকু সব ভুলে শুধু পড়তাম৷

এদিকে একদিন ক্লাসে আরেক কান্ড হলো। আমার এক বান্ধবী বলে বসল, সে একজনকে ভালোবাসে। তাকে প্রপোজ করবে খুব শীঘ্রই। কে সে? চেপে ধরে জানা গেল আর কেউ নয়, আমাদের পাড়ার টগর ভাই।

মেয়েরা টগরের জন্য পাগল সেটা জানা ছিল আমার। বাবাই বলতেন, টগরের জন্য রোজ রোজই নাকি ভালো ভালো সম্বন্ধ আসছে। আর সে সব সম্বন্ধই না করে দিচ্ছে। তার নাকি অন্য পছন্দ আছে। তবে সেই পছন্দের মেয়ে এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি। আমি মনে মনে জানতাম, সেই মেয়েটা আমি। আমি এখনো ছোটো, তাই সে অপেক্ষা করে আছে।

কিন্তু সেদিন বান্ধবীর কথায় আমার সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। আমি ঠিক করলাম, সরাসরি টগরের সাথে কথা বলে নেয়াই ভালো। নয়তো আমার চুপচাপ ভঙ্গি দেখে সে যদি অন্য কারো জন্য রাজি হয়ে যায় তখন?

সমস্যাটা হলো, তাকে পাচ্ছিলাম না। সে নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেছে। একগাদা কম্পিউটার কিনেছে। সেই ব্যবসা দাঁড় করাতে ভীষণ ব্যস্ত। পাওয়াই যায় না। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম সুযোগের।

একদিন পেয়েও গেলাম। সেদিন ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। সাথে ঝোড়ো বাতাস। বিকেলে নোটসের কথা বলে যখন বেরিয়েছিলাম তখনো আকাশ মেঘলা ছিল, তবে এত বৃষ্টি নামবে বুঝিনি। ছাতা ছিল, তবুও আমার গোলাপি রঙের জামাটা ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আমি জানতাম সেদিন বিকেলে টগরকে ক্লাবের সামনে পাওয়া যাবে। কারন আমি একটা রহস্যময় উড়ো চিঠি ফেলে রেখে এসেছিলাম তার ঘরের জানালা দিয়ে।

আমি যখন পৌঁছুলাম তখন সে দাঁড়িয়ে আছে দরজার পাশে। আমাকে দেখে সরে জায়গা করে দিল। এলাকায় তখন লোডশেডিং চলছে। বেশ অন্ধকার ক্লাবঘরে সে একা ছিল। আমিও একা একটা মেয়ে। তবে ভয় হলো না মোটেও। বরং ইচ্ছে করল খুব ভুল কিছু করে বসতে।

চলবে
সুমাইয়া আমান নিতু

অসাধারণ পর্ব-০১

0

#অসাধারণ ১
সুমাইয়া আমান নিতু

আজ সন্ধ্যা থেকে আকাশে মেঘ জমেছে। খুব ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। এক কাপ চা হাতে বারান্দায় গিয়ে বসতেই গানের শব্দ ভেসে এলো- “আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি..” গানটা একেবারে বুকের ভেতরে গিয়ে বাজল! কত স্মৃতি এই গানের সাথে আমার! আমার জীবনের প্রথম অধ্যায়ের গল্পের সাথে অষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা সেই গান!

আমার মেয়ের ইদানীং পুরানো গান শোনার শখ হয়েছে৷ যখন তখন তার ল্যাপটপে বাজছে চেনা সুর৷ আজকের আবহাওয়া আর তার গানের সুর আমাকে হঠাৎ পুরানো সময়ে টেনে নিয়ে গেল নিজের অজান্তেই৷ ঠিক যেন সিনেমার পর্দায় ফ্ল্যাশব্যাকের মতো। যখনকার সময়ে ফিরলাম তখন আমার বয়স ঠিক ষোলো৷ শান্তিপুরে নিজেদের একতলা বাড়িতে থাকি৷ বাড়ির সামনে একচিলতে বাগান৷

তখন শীতকাল। বাগানে হলদে গাদার ছড়াছড়ি। একধারে লাল টকটকে ডালিয়া৷ বিকেলের মরে আসা রোদ আর মৃদু হাওয়ায় যারা বিষন্ন সুন্দর ভঙ্গিতে মাথা দোলায়। সেরকমই এক বিকেলে আমি তাকে দেখি৷ সে সদ্য বিলেত ফেরত সুদর্শন এক ব্যক্তিত্ব। যাকে বলা যায় এলাকার ‘মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর’। সে কি চেহারা! একমাথা উঁচু, গায়ের তামাটে রঙ, খাড়া নাক, বড় বড় উজ্জ্বল চোখ আর সবচেয়ে দেখবার মতো তার ব্যক্তিত্ব৷ সাহেবদের মতো করে চলাফেরা শিখে এসেছে কি না!

টগর ভাই যখন লন্ডন যায় করে তখন আমার বয়স দশ কি বারো। তখন তাকে চিনলেও অনুভূতি তৈরি হবার সময় হয়নি। তবে সে সময়েও চাহিদা কম ছিল তেমন নয়৷ বোর্ড স্ট্যান্ড করা অসম্ভব ভালে ফুটবল খেলা সেই গুণী ছেলের বিদেশে পড়াশোনা না করলে গুণের ষোলোকলা পূর্ণ হয় না বলেই হয়তো তার যাওয়া! আমাদের বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল না, তবে বাবার সাথে টগর ভাইয়ের বাবার ছিল দারুণ খাতির৷ সেই সুবাদেই আমাদের বাড়িতে সেই বিকেলের চায়ের নিমন্ত্রণ ছিল বাবা ছেলের। আমি তখন সদ্য ক্লাস টেনে উঠেছি। ক্লাস নাইনে ঘাড়ে চেপে বসা সায়েন্সের ধাক্কা সইতে গিয়ে জীবনের রঙ অর্ধেক উড়ে গেছে৷ কেমিস্ট্রির জটিল বিক্রিয়ার সমতা টেনেটুনে শেষরক্ষা করা গেলেও উচ্চতর গণিতের নৌকা প্রায় ডুবে ডুবে ভেসে আছে, যাকে ফিজিক্সের ভাষায় বলা যায় আংশিক নিমজ্জিত অবস্থায় ভাসতে থাকা! রেজাল্টের দিন বাবা বাড়ি ফিরে বলেছিলেন, “আর যাই করিস, মানসম্মানের কিছুটা যেন বাকি থাকে।” আমি তাই মন দিয়ে পড়ছি।

কিন্তু সেই মনটাই তার বিকেলের অতিথি এসে পুরোপুরি বিগড়ে দেবে তা কে জানত! আমি বাগানে বেতের চেয়ারে বসে তখন কোলাব্যাঙের বৈজ্ঞানিক নাম মুখস্থ করার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম৷ গেটে টোকা পড়ায় উঠে পড়লাম৷ গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে গেট খুলে দিলাম৷ খুলেই মুখটা কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেল। ওপাড়ে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে আমার বাড়ির সামনে না দেখে টেলিভিশনের পর্দায় দেখলে বেশি মানানসই মনে হতো।

নেভি ব্লু জ্যাকেট আর ডেনিম, মুখে হালকা দাঁড়ির রেশ, হাতে মস্ত এক কালে ডায়ালের ঘড়ি আর তার অন্তর্ভেদী চাহনি, সব যেন গিলে ফেলেছিলাম এক ধাক্কায়।

বাবা গেট খোলার শব্দে বেরিয়ে এসে তাদের অভ্যর্থনা না জানালে আমি সেদিন হয়তো উল্টোপাল্টা কিছু বলে বা করে বসতাম!

বাবা চলে আসায় নিজের স্বাভাবিক বোধ খুঁজে পেলাম। বাবা পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ও হচ্ছে তোর সেই টগর ভাই। লন্ডন থেকে ফিরেছে গত সপ্তাহেই। খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। আর এ হচ্ছে আমার মেয়ে শিলা। জানো তো টগর, তোমার গল্প বাড়িতে রোজই করি৷ মেয়েটা যাতে একটু পড়াশোনার ইন্সপিরেশন পায়।”

টগর ভাই আমাকে প্রথম যে কথাটা বলেছিল সেটা ছিল, “তোমার নাম শিলা? শিলা মানে কি পাথর? কোন শিলা তুমি? আগ্নেয় শিলা নাকি পাললিক শিলা?”

তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই না বুঝে চুপ করে রইলাম৷ বাবা তাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন৷ ভেতরে যাওয়ার পথে টগর ভাই ফিরে তাকাল৷ আমার দিকে নাকি আমাদের বাগানের ডালিয়া ফুলগুলোর দিকে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না৷ তবে মনে হলো, এই মানুষটাকে না পেলে আমি নির্ঘাত মরে যাব। মরে ভূত হয়ে এই ছেলের বাড়ির সামনে গাছে চড়ে বসে থাকব৷ তবুও একে ছেড়ে থাকা অসম্ভব!

চলবে।

আমি অর্ষা পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

#আমি_অর্ষা
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#অন্তিম_পর্ব

সেদিনের মত ক্লাস শেষ করে যখন আমি রুম থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছি,
হঠাৎ করেই চোখ যায় বিদ্যালয়ের মেইন গেইটের সামনে।
আর আমি আঁতকে উঠি।

_অরণ্য…
আমি অবাক হয়ে যাই,
দেখি যে অরণ্য দাঁড়িয়ে আছে।

অরণ্যকে দেখে আমি গেইটের সামনে এগিয়ে যাই।

_আপনি এখানে?
_হাই মিস অর্ষা
_হাই
_কেমন আছো?
_এইতো চলছে।
_আপনি?
_ভালো থাকতে দিলে আর কই
_আমি কি করলাম?
_কি করোনি বলো,
_কি করেছি তাইতো জানতে চাচ্ছি
_আরে ভাই,শাড়ি দিলাম আমি,ছাদে আসতে বললাম আমি।
আর আমার দেয়া শাড়ি পরে ছাদে গিয়ে প্রেম করো আরেক জনের সাথে।
_আপনিই তাহলে চিরকুট আর গিফট গুলো দিয়েছেন নাহ?
_জ্বী হ্যাঁ।
তাহলে সেদিন ছাদে কেন আসেন নি?
_ছাদে না গেলে জানলাম কি করে শাড়ি পরে ছাদে গিয়ে তুর্জর সাথে প্রেম করছিলে?

আমি যেদিন প্রথম শিলার জন্মদিনে তুর্জকে দেখেছিলাম তোমার হাত ধরে নাচার জন্য টানছে সেদিনই আমার রাগ হচ্ছিলো।
জেদ হচ্ছিলো।
সহ্য হচ্ছিলোনা।
তাই তো আমি মিথ্যা বলে তোমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলাম যে আম্মু ডাকছে।
তুমি সেদিনও আমার অনুভূতি বুঝোনি।

আচ্ছা ওইদিন যে ঘুর‍তে যাবার প্ল্যান করেছিলাম সবাইকে নিয়ে।
তা কেন করেছিলাম বলতো?
_কেন?
_যাতে তোমার সাথে কিছুটা মুহূর্ত এক সাথে কাটাতে পারি।
আরে মেয়ে তোমার ছবি গুলো কি এমনি এমনি আমার ফোনে তুলেছি নাকি?
_কেন তুলেছেন?
_তুমি যখন চোখের সামনে থাকবে না। তোমায় দেখবো বলে।
_কেন দেখবেন?
_ভালবাসি বলে।
_কিহ?
_জ্বী মিস অর্ষা।
আমি অরণ্য আপনাকে ভালবাসি।
আপনি যদি ওই ব্যাটা তুর্জকে এখন আর ভাল না বেসে থাকেন তাহলে আপনি আমাকে ভালবাসতে পারেন।
_এই যে মিঃ
আমি তুর্জ টুর্জ কাউকেই ভালবাসিনা বুঝলেন?
_তাহলে ওই দিন ছাদে কি করছিলে?
_আরে আমি ছাদে গিয়ে দাঁড়াতেই কিছু ক্ষণ পর সে আসে।
আর আমাকে প্রপোজ করে,তাইতো আমি ভেবেছি শাড়ি আর চিরকুট সে ই পাঠিয়েছে।
আমি কি জানি নাকি ওসব সে না আপনি পাঠাতেন?
_আর আমি যখন ছাদে গেলাম আমার মনের কথা জানাতে,দেখি আপনার সামনে তুর্জ সাহেব হাঁটু গেড়ে বসে আছে।
আর আপনি শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে।
তখন আমার কেমন লেগেছে বলেন।
তাইতো আমি ওই দৃশ্য দেখে কিছু না বলেই চলে আসি।

আর খুব দ্রুত দেশ ছেড়ে চলে যাই।
_আমার সাথে দেখা করেও যান না।
তাইনা?
_হুম তাই।

_আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে,এখন কি করবেন?
_উমহু,আমি সব জানি।
_কি জানেন?
_আমি আম্মুকে ফোন দিয়ে তোমাকে চেয়েছিলাম একটু কথা বলার জন্য।ভীষণ মিস করছিলাম।
আম্মু বললেন তুমি চলে এসেছো।
তাই প্রেমা আর রুনার সাথে কথা বলতে চাইলাম তোমার খবর জানতে।
তোমার আর তুর্জর প্রেম কেমন চলছে তা জানতে।

পরে ওরা বল্লো পুরো কাহিনী।

আর আমিও তাই দেরি না করে চলে আসলাম।
একবার হারাতে বসেছিলাম।
আর হারাতে চাইনা।

_কাকে?
_তোমাকে।
_তাহলে এখন আমার কি করতে হবে?
_কি আবার,আমাকে বিয়ে করতে হবে।
_আপনার পরিবার, সমাজ?মানবে আমাকে?
_আমার পরিবার কে আমি জানিয়েছি সব।
তাদের তোমাকে খুব পছন্দ বুঝলে?
তাদের কোন আপত্তি নেই।
বরং তারা কি বলেছেন শুনবে?
_কি?
_তারা বলেছেন আমি যেন তোমাদের এলাকায় জায়গা কিনে একটা বাড়ী তৈরী করি।
তারা তোমাকে নিয়ে এখানেই থাকবেন।
মানে আমার বাবা মা।
কারণ তাদের পুত্রবধূ তো তার স্বপ্নের শিক্ষকতা ছেড়ে শহরে যাবেন না।
তাই তারাই তাদের পুত্রবধূর কাছে চলে আসতে চান।
তাদের শেষ বয়স টা তারা গ্রামেই কাটাতে চান।
স্বচ্ছ আলো বাতাস উপভোগ করতে চান।
মাঝে মাঝে ঢাকায় গিয়েও থাকবেন।
ঘুরে দেখে আসবেন।
দুই জায়গায়ই ঘুরে ফিরে থাকবো আমরা।
কেমন হয় বলোতো?

আমার চোখ থেকে পানি পড়ছে।
এত সুখ আমার কপালে সইবে কিনা তাই ভাবছি।
আর অবাক হয়ে ভাবছি,মানুষ এত ভালো হয় কি করে?
উনারা এত ভালো কেন?

_এই মেয়ে,তুমি কাঁদছো কেন?
_এটা খুশির কান্না।
_এই যে অরণ্য সাহেব,
#আমি_অর্ষা দরিদ্র এক জেলের মেয়ে।
আপনি কি আমায় প্রতিদিন সকাল বেলা নাস্তা বানাতে সাহায্য করবেন?
_কাজের লোক হয়ে?
_যাহ দুষ্টু,বর হয়ে।
_ওরে লজ্জা পেয়েছেরে অর্ষা ম্যাডাম, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ আমি রাজি।ভালবাসি।
_আমিও বাসবো,তবে বিয়ের পর (দুষ্টুমির হাসি হেসে)

অতঃপর আমাদের দুই পরিবারের সম্মতিতে,উপস্থিতিতে ধুমধাম করে বিয়ে হয় আমাদের।
আমাদের এলাকায় অরণ্য একটা জায়গা কিনে সুন্দর করে একটা বাড়ী তৈরী করেন।
যাতে করে আমার স্বপ্নের শিক্ষকতা ছাড়তে না হয়।
বাবা মাকে ছেড়ে একবারে দূরে যেতেও না হয়।
দুই জায়গাতেই এখন থাকি আমরা।
অরণ্যর বাবা মা মানে আমার শশুড় শাশুড়ীরও গ্রাম অনেক পছন্দ।তাদের নাকি ইচ্ছেও ছিলো শেষ বয়সে তারা গ্রামের আলো বাতাস উপভোগ করবেন।
তারা এখন শহরের চেয়ে গ্রামেই বেশি থাকেন।
আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি এত সুখ যে আমার কপালে লিখা ছিলো।
অরণ্য আর অরণ্যর পরিবার আমাকে এত ভালবাসেন যা আমার কাছে মাঝে মাঝে স্বপ্নের মত মনে হয়।
এমন পরিবার পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
আমার বাবা মাকেও তারা যথেষ্ট সম্মান করেন।
একজন মেয়ের জন্য এর চেয়ে বেশি আর কি লাগে।

(সমাপ্ত)

#ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
সবাই ভালো থাকবেন।
আসসালামু আলাইকুম।

আমি অর্ষা পর্ব-০৫

0

#আমি_অর্ষা
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#পর্ব_৫
আপনারা যাবেন জেলে পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করতে।আমাদের সাথে নয়।
সেই মুহূর্তে আমি গিয়ে তুর্জর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেই।
আর তুর্জ আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

অতঃপর বলে উঠে,
_অর্ষা!
_হ্যাঁ #আমি_অর্ষা
আমিই অর্ষা,এই জেলের মেয়ে অর্ষা।
আমি এই জেলে পরিবারের মেয়ে।
আমি সেই মেয়ে,যার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।
আমি সেই অর্ষা যাকে বিয়ে করলে আপনার মান সম্মান নষ্ট হবে,আপনি আপনার বন্ধুদের কাছে আমার পরিচয় দিতে পারবেন না বলে গায়ে হলুদের দিন চো রের মত পালিয়ে গিয়েছিলেন।
হ্যাঁ আমি সেই অর্ষা,যে কিনা সেই দিনের পর এলাকায় মাথা তুলে কথা বলতে পারিনি।
আর না পেরেছে আমার পরিবার।
আপনি জানেন?গ্রামে একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেলে সমাজ তাকে কেমন চোখে দেখে?

লোকের চোখে আমি খারাপ।
তাই নাকি আমার বিয়ে ভেঙে গিয়েছে।
আমি নাকি অ পয়া,অ লক্ষী,আমার নাকি কোন দোষ আছে তাই আপনারা বিয়েটা ভেঙে দিয়েছেন।

আচ্ছা বলুন তো,আসলেই কি আমি খারাপ ছিলাম?

আপনি জানেন,আমার গরীব বাবা কত কষ্ট করে বিয়ের কেনাকাটা করেছিলেন?
কত কষ্টের টাকা তার।
আমার বাবা মাছ ধরেন বলে আপনার জাত যাবে আমার পরিচয় দিতে।
ওই আপনি কি মাছ খান না?
কেন খান আপনি মাছ?
ওই মাছ যারা ধরে তাদের ঘৃণা করেন,তাদের ধরে আনা মাছ কিনে খান কেন?
তখন ঘৃণা লাগেনা?

আমার বাবা কি চু রি করেন?
নাকি অ বৈধ কোন উপায়ে টাকা উপার্জন করেন?
আমার বাবা কষ্ট করে মাছ ধরেন,আর সেই মাছ বিক্রি করে সৎ ভাবে টাকা কামিয়ে আনেন।

আপনার মত নিচু মনের মানুষ তা বুঝবেনা।

_অর্ষা (রেগে গিয়ে)
_চুপ,একদম চুপ।
আজ আমি বলবো আপনি শুনবেন।
_আপনি বলেছিলেন না,আমি আপনাকে ঠকানোর মত বা আপনার সাথে প্রতারণা করার মত মেয়ে না?
আপনার সেই বিশ্বাস আছে আমার প্রতি।

আমি আসলেই কাউকে ঠকানোর মত বা প্রতারণা করার মত মেয়ে না।

আমি তো আজ প্রতারণা করলাম না।
আর না ঠকালাম।
আমি আমার বাবার অপমানের প্রতিশোধ নিলাম।
দিনের পর দিন আমার বাবা মায়ের মুখ লুকিয়ে কান্নার প্রতিশোধ নিলাম।
আপনার জন্য অন্যের কাছে অপমানিত হবার প্রতিশোধ নিলাম।
আর আজ আপনার কাছে অপমানিত হবার প্রতিশোধ নিলাম।

আর আপনি আমাকে ভালবাসেন তাইনা?
আপনি আমাকে না আমার সৌন্দর্য্য কে ভালবাসেন।
আমি সুন্দর না হলে আপনি আমাকে ভালবাসতেন না।
আজ আমি সুন্দর বলে আপনি আমার কোন কিছু জানার ও প্রয়োজন করেন নি।
আপনি আমার রুপ দেখে পাগল হয়েছেন।
আমার পরিবার সম্পর্কে জানলে কখনোই আমাকে ভালবাসতেন না।
আমি এমন ছেলেকে কখনোই আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে চাইবোনা,যে আমার বাবার কাজ কে অসম্মান করবে।
আমার বাবাকে অসম্মান করবে।
জেলে পেশাটাকে অসম্মান করবে।
খেটে খাওয়া মানুষদের অসম্মান করবে।
তাই আমি আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আমার পক্ষে আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব না।
আপনি আমাকে কি রিজেক্ট করবেন।
আমিই আপনাকে আজ রিজেক্ট করলাম।

_কিন্তু অর্ষা আমাকে তো কিছু বলার সুযোগ অন্তত দাও।
_না।
আজ আমি আপনার কোন কথাই শুনবোনা।
অনেক হয়েছে আর না।
_অর্ষা আমি অনুতপ্ত।আমার ভুল হয়েছে।
আমার উচিৎ হয়নি জেলে পেশাটাকে অসম্মানের চোখে দেখা।আমাকে একটা সুযোগ দাও।
_দুঃখিত মিঃ তুর্জ আমাকে ক্ষমা করবেন,আমি আপনাকে কোন সুযোগ দিতে পারলাম না।
আপনার আজকের এই শিক্ষাটা আশা করি সারাজীবন মনে থাকবে।
অন্তত আজকের এই ঘটনার জন্য আপনি ২য় বার কোন দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষকে অসম্মান করতে গেলেও ২য় বার ভাব্বেন।

_বাবা মা চলো,

ও হ্যাঁ,
মিঃতুর্জ,
আমি আপনার দেয়া চুড়ি,কাজল,ঝুমকো কানের দুল,আর শাড়ি সব কিছুই আপনাকে ফেরত পাঠিয়ে দিবো এই ঠিকানায়।
ওসব নিয়ে চিন্তা করবেন না।

_ওসব তুমি কোথায় পাবে?ওগুলো তো আমাদের বাসায়।
_আজকের গুলোর কথা বলিনি আমি।
আগে যে চিরকুটের সাথে পাঠিয়েছিলেন সেগুলোর কথা বলেছি।
_চিরকুট? আমি তো কোন চিরকুট পাঠাইনি।
_কোনো চিরকুট পাঠান নি মানে?
আপনি আমাকে একে একে কাজল চুড়ি ঝুমকা শাড়ি এগুলো পাঠাননি চিরকুটের সাথে?
_নাতো।
_তাহলে আপনি যে ওইদিন আমাকে ছাদে আসতে বললেন শাড়ি পরে?
_আমি?আমি কবে তোমায় শাড়ি পরে ছাদে আসতে বল্লাম?
_এক মিনিট এক মিনিট,
যেদিন আপনি আমাকে প্রপোজ করলেন।
ওইদিন আমি যেই শাড়িটা পরে ছিলাম,ওটা কি আপনি দেন নি আমাকে চিরকুটের সাথে?আর লিখেন নি,আমি যেন শাড়িটা পরে ছাদে যাই?
_আরে বাবা কত বার বলবো?
আমি দেইনি কোন শাড়ি টারি,আর না লিখেছি কোন চিরকুট।

আমার টাকা অত বেশি হয়ে যায়নি যে কোন মেয়ের পেছনে অযথা টাকা নষ্ট করবো।

_থ্যাংকস টু আল্লাহ।
আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন।
আপনার মত ছোট মনের মানুষ থেকে আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন।
আর এত্ত বড় ভুলের পর্দা আল্লাহ আমার চোখ থেকে আজ সরিয়ে দিয়েছেন।
ভালো থাকুন।
থ্যাংক ইউ অলসো,সত্যি টা বলার জন্য।
যে আপনি এসবের কিছুই আমাকে দেন নি।
আর এত বড় মনও আপনার নেই যে আপনি আপনার ভালবাসার মানুষকে আই মিন যাকে ভালবাসেন তাকে কিছু গিফট করবেন।
আপনি ছোট মনের মানুষ, সারাজীবন ছোট মনের ই থাকবেন।
আল্লাহ হাফেজ।

চলো বাবা মা,চল প্রেমা রুনা।

আমি বাবা মাকে নিয়ে আর ওদের নিয়ে চলে আসি বাসায়।

আর ভাবতে থাকি,
তুর্জ এসব না দিলে কে দিয়েছে তাহলে আমাকে এগুলো?

আদিব তো দিবেনা কারণ আদিব তো ভালবাসে প্রেমা কে।
তাহলে কি অরণ্য?
না না তা কেন হবে?
তারা ধনী মানুষ।
আমার মত মেয়েকে কেন তারা…
আর যদি সে দিয়েই থাকবে,তাহলে ছাদে কেন আসেনি সেদিন।
নাকি কেউ ফান করেছে আমার সাথে?
মাথায় কিছুই আসছেনা।

প্রেমা আর রুনা আমাকে বলে,এখন এত সব ভেবে লাভ নেই।
জানিতো মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
বাদ দে ওসব।
যখন ঢাকায় যাবো তখন খুঁজে বের করবোনে মানুষ টা কে।

এরই মধ্যে দুদিন পর হঠাৎ করেই খবর আসে আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে গেছি।
আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে।
বাবা মা আমি আমরা সবাই তো খুশিতে আত্মহারা।

আমাকে আমাদের এখানকার একটা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে হবে।
আজ আমি আমার বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি।

বাবা তো খুশিতে মিষ্টি আনতে চলে গেলেন।
আর খুশিতে বলতে বলতে গেলেন,আমি আজ থেইকা অর্ষা ম্যাডামের বাপ।
আমারে সবাই দেইখা কইবো,ওই যে ওইডা অর্ষা ম্যাডামের বাপ যায়।
আমার মাইয়্যা আজ শিক্ষক হইছে।জেলের মাইয়্যা আজ শিক্ষক হইছে।

আজ আমাদের ঢাকায় যাবার কথা ছিলো।
আমি প্রেমা আর রুনাকে বললাম,তোরা যা।
আমি কিছু দিন পর আসি।
আর ওদের বলি,বাসার সবাইকে যেন জানিয়ে দেয় আমার এই সুখবর টা।

এরপর ওরা চলে যায়।
আমি থেকে যাই গ্রামে।

কিছু দিন পর আমি ঢাকায় গিয়ে আমার সব কিছু গোছগাছ করি।
আর বাড়ীওয়ালা আংকেল এবং আন্টিকে জানাই,
আমার যেহেতু আমার গ্রামে থেকে শিক্ষকতা করতে হবে তাই আমার পক্ষে আর শহরে থাকা সম্ভব হচ্ছেনা।তাই আমার বাসা টা ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
যদিও রুনা আর প্রেমা থাকবে।
আমি শুধু আমার পরীক্ষার সময় এসে আমার পরীক্ষা গুলো দিয়ে যাবো।

আন্টি আমার শিক্ষকতার জন্য খুশি হলেও আমি চলে যাবো বলে মন খারাপ করছে।

আমি প্রথমার মা এবং আরেক স্টুডেন্ট এর মাকেও সব বুঝিয়ে বললাম।
আর বললাম,এখন থেকে ওদের রুনা পড়াবে।যদি তাদের কোন আপত্তি না থাকে।

প্রথমা আর আমার আরেক স্টুডেন্ট আমার জন্য মন খারাপ করে।
আর বলে,মাঝে মাঝে এসে যেনো আমি ওদের দেখে যাই।
আদর করে যাই।

আমারো সবার জন্য মন খারাপ লাগে।
কিন্তু কি আর করার।
স্বপ্ন যে পূরণ করতে হবে আমার।
আমার বাবা মায়ের স্বপ্ন।

চলে আসি বাসায়।
চলছে দিন।
রুনা আর প্রেমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি,
আর কি কোন চিরকুট বা গিফট এসেছিলো আমার নামে?

ওরা না করে।
দেখতে দেখতে চলে যায় আরো কিছু দিন।
আমার এখন আর বুঝতে বাকি নেই চিরকুট আর গিফট গুলো কে দিয়েছিলো।
ওই অরণ্যই দিয়েছিলো ওগুলো।
এছাড়া আর কেউ নয়।

কিন্তু সে কেন তাহলে দেশ থেকে চলে যাবার সময় আমার সাথে দেখা তো দূরে থাক।
একটু কথা পর্যন্ত করে গেলোনা?

এসব ভাবতে ভাবতে মা চলে আসেন আমার রুমে।

আর এসে বলেন,

_কেমন যাচ্ছে তোর দিন কাল?
_এইতো ভালো মা।
_এখানে একবারে যে চলে আসলি,পড়াশোনার ক্ষতি হইতেছে নাতো তোর?
_না মা হচ্ছেনা।
ক্লাস গুলো মিস যাচ্ছে,তবে আমি রুনা আর প্রেমার থেকে সাজেশন সংগ্রহ করে নিচ্ছি।
_দেখিস মা,পড়াশোনার যেন কোন ক্ষতি না হয়।
_আচ্ছা মা।

এভাবে কেটে যায় আরো কিছু দিন।
ভাবলাম,পরীক্ষা আসুক তখন প্রেমাদের ওখানে গিয়ে আন্টির নাম্বার থেকেই একটু অরণ্যর সাথে কথা বলে নিবো।
আর জিজ্ঞেস করবো,চিরকুট আর গিফট গুলো সত্যি সত্যিই সে ই দিয়েছেন কিনা।আর কেন ই বা দিলেন।
আর যদি সে ই দিয়ে থাকেন তাহলে ওই দিন ছাদে আসতে বলে কেন তিনি ছাদে আসলেন না।

পরের দিন আমি বিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস নিচ্ছিলাম বাচ্চাদের।
আর ওদের বলছিলাম,
কোন কাজই ছোট নয়।
তোমরা কখনো কোন কাজকে অসম্মান করবেনা।
কোন কাজের লোককে অসম্মান করবেনা।
কৃষক,তাতী,রিক্সাচালক,জেলে, কামার,কুমার,দর্জি,মুচি এরাও আমাদের মতই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ।
তারা আছেন বলেই আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারছি।

কৃষক না থাকলে আমরা ধান/চাউল,ডাল তেল,ফলমূল সবজি এগুলো পেতাম কই?
তাতী কাপড় না বু্নলে,দর্জি কাপড় না শেলাই করলে পরতাম কি?
রিক্সাওয়ালারা রিক্সা না চালালে তোমরা কিভাবে চলতে?
কষ্ট হতো না?

জেলেরা মাছ না ধরলে মাছ পেতাম কই?
মা রান্না করে দিতো কিভাবে?
আর মুচি যদি জুতা শেলাই না করতো আমাদের নতুন জুতা যে মাঝে মাঝে ছিঁড়ে যায়।
তা আমাদের শেলাই করে দিতো কে?

তারা সবাই আছেন বলেই আমরা আরামে বসবাস করতে পারছি।চাকুরীজীবিরা কি এগুলো করতে পারতো?চাকুরীজীবিরাও যেমন কাজ করেন।
তারাও তাদের কাজ করেন।

তাহলে সবাই বুঝেছো,কোন কাজকে ছোট করে দেখবেনা কখনো।
মনে থাকবে?

_জ্বী আপা মনে থাকবে।

_আর তোমরা কিছু না বুঝলে না জানলে আমাদের জিজ্ঞেস করবে।
আমরা তোমাদের শিক্ষক।
তোমাদের বোঝানো,জানানো,শেখানো আমাদের কাজ।
তোমাদের সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত করা আমাদের দায়িত্ব।
_জ্বী আচ্ছা আপা।

_আচ্ছা সবাই তাহলে ভালো থেকো।
আজকের মত এখানেই সমাপ্ত।
_আসসালামু আলাইকুম আপা।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম।

সেদিনের মত ক্লাস শেষ করে যখন আমি রুম থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছি,
হঠাৎ করেই চোখ যায় বিদ্যালয়ের মেইন গেইটের সামনে।
আর আমি আঁতকে উঠি,

চলবে…